চাকমা জাতির আদিনিবাস সন্ধানে
3199
চাকমা জাতির আদিনিবাস সন্ধানে – ১ম পর্ব
আমরা চাকমারা বিশ্বাস করি আমাদের পূর্বপুরুষরা এসেছে চম্পক নগর থেকে। আমাদের এই ধারণাটা চলে আসছে বংশ পরম্পরায় – বাপ-দাদা, পূর্বপুরুষদের মুখ থেকে শুনে, আমাদের ‘গেংখুলি গীত’ নামক লোকগীতি বা পালাগানের মাধ্যমে। কিন্তু ঝামেলা হলো আমরা জানিনা কোথায় এই চম্পক নগর।
চাকমা জাতির ইতিহাস লিখতে গিয়ে চাকমাদের এই আদি বাসস্থান চম্পক নগরের সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে অনেক লেখালেখি হয়েছে কিন্তু চম্পক নগরের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। এই লেখাতে আমারও ক্ষুদ্র প্রয়াস থাকবে চাকমাদের চম্পক নগরের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য।
তবে চম্পক নগরের অবস্থান নির্ণয়ের আগে সম্ভবতঃ বিগত কয়েক শতাব্দীর প্রমাণযোগ্য ইতিহাস নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি, যা থেকে আমরা কিছুটা ইঙ্গিত পাবো যে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসার আগে, বা পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও চাকমারা কোথায় বসবাস করতো। এর অংশ হিসেবে আমরা এখানে রামু জনপদে চাকমাদের অবস্থানের উপর আলোকপাত করবো।
রামু জনপদে চাকমারা
চাকমারা বর্তমানে মূলত চট্টগ্রামের উত্তর-পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে বসবাস করছে। তবে তারা চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিশেষতঃ রামু জনপদে দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী বসবাস ও রাজত্ব করেছিল।
রামু উপজেলার পটভূমিতে লেখা হয়েছে “বিশ্বখ্যাত পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থান রামু। রামুতে আছে গৌরবোজ্জ্বল অতীত অধ্যায়ের স্মৃতিচিহ্ন। কালের পরিক্রমায় রাজা, রাজবংশ সবই গেছে। তবু ও এখানে টিকে আছে বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন” (http://ramu.coxsbazar.gov.bd/…/%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6…)। এখানে কিন্তু বলা হচ্ছেনা রামুর রাজা, রাজবংশ কারা ছিল। রামুতে বর্তমানে চাকমারা বলতে গেলে নেই, অন্ততঃপক্ষে সদর বা শহর এলাকায়, যেখানে এককালে তাদের রাজারা বসবাস ও রাজত্ব করত।
উখিয়া, টেকনাফে কিছুসংখ্যক চাকমা এখনো রয়েছে হয়তো। (যেমন ১৯৫৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসনের সময় অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উখিয়ার চেনছড়িতে ফেলোরাম চাকমার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন কয়েকটা দিন (https://www.prothomalo.com/…/%E0%A6%89%E0%A6%96%E0%A6… )। কিন্তু এই চাকমাদের দীন-দরিদ্র, শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া অবস্থা দেখলে কেউ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারবেনা এককালে তাদের পূর্বপুরুষরা রামুতে রাজক্ষমতায় ছিল।
তবে সেখানে জায়গার নাম, সেখানকার জনশ্রুতি এখনো চাকমাদের ইতিহাসের সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে তাদের সেখানে বসবাস ও রাজত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক রামু জনপদের উপর সংযুক্ত ডকুমেন্টারীটি দেখা যেতে পারে (https://www.youtube.com/watch?v=9PiapWvtnGQ) ।
গাঁয়ের বধূ মীনা বড়ুয়ার মতে (ডকুমেন্টারীর ৯:১৫ – ৯:৪০ পর্যন্ত) বাঁকখালী নদীর দক্ষিণ পাড়ে রাজারকূল, উত্তর পাড়ে চাকমার কূল – এই দুই জনপদের সাথে জড়িয়ে রয়েছে চাকমাদের প্রথম রাজা বিজয়গিরির স্মৃতি ।
শুধু রাজার কূল আর চাকমার কূল ইউনিয়ন নয়, রামুতে এখনো আছে রাজার কূল ও চাকমার কূলের অনতিদূরে চাকমা রাজা ফতে খাঁর নাম অনুসারে ‘ফতে খাঁর কূল’ ইউনিয়ন (সংযুক্ত গুগুল ম্যাপে এটা দেখা যেতে পারে)। রাঙ্গামাটিতে চাকমা রাজবাড়ির আঙিনায় এখনো রয়ে গেছে রাজার কামান ‘ফতে খাঁ’ (ছবি সংযুক্ত) https://www.jagonews24.com/feature/news/59928 ।
চাকমা রাজা ‘ফতে খাঁ’-র নাম অনুসারে নাকি কামানটা। না, চাকমারা সম্ভবতঃ অতো উন্নত জাতি ছিলোনা যে কামান বানাতে পারে। তবে সেই কামানটা নাকি যুদ্ধে মোগলদের থেকে হস্তগত করা হয়। অর্থাৎ চাকমারা বিনা প্রতিবাদে, বিনা প্রতিরোধে মোগলদের বৈশ্যতা স্বীকার করার মতো অতো দুর্বলও ছিলোনা, অন্ততঃ যুদ্ধে মোগলদের থেকে কামান ছিনিয়ে নেয়ার সক্ষমতাও তাদের ছিল।
সেই সময়েও চাকমারা দক্ষিণ চট্টগ্রামে – রামু, কক্সবাজার, টেকনাফে বসবাস ও রাজত্ব করত। এমনকি ১৬৬৬ খ্রীস্টাব্দে চট্টগ্রামের যুদ্ধে মোগল, ডাচ, পর্তুগীজদের সমন্বিত বাহিনীর কাছে আরাকান রাজা চন্দ্র সুধর্ম (সন্দা থুধম্ম) পরাজিত হলে (https://bn.wikipedia.org/…/%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%AF… ) এবং চাদিগাং বা চট্টগ্রাম মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হলেও চাকমা রাজা ধরম্যা স্বাধীনভাবেই ছিলেন এবং পরবর্তীতে মোগলদের সাথে চাকমাদের বরং সখ্যতা হয়।
১৭১৫ খ্রীস্টাব্দে রাজা ফতে খাঁর সাথে মোগলদের বাণিজ্য চুক্তিই তার প্রত্যক্ষ নিদর্শন (স্বর্গীয় বিরাজ মোহন দেওয়ান প্রণীত “চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত” পৃঃ ১০৪-১০৫)। এই সখ্যতার কারণে সম্ভবতঃ রাজা ধরম্যা এক মোগল রমণীর পাণি গ্রহণ করেন এবং তাঁর গর্ভে যে রাজপুত্র জন্মগ্রহণ করেন তাকে চাকমারা ‘মোগল্যা’ নামে অভিহিত করে।
মোগল রমণীর বংশজাত হওয়ার কারণেই হয়তো পরবর্তী চাকমা রাজারা খাঁ উপাধি গ্রহণ করেন। যেমন মোগল্যার দুই পুত্রের নাম ছিল যথাক্রমে সুভল খাঁ ও ফতে খাঁ। তাঁদের সেনাপতির নাম কালু খাঁ। রাজা সুভল খাঁ (১৭১২) থেকে রাজা ধরমবক্স খাঁ (১৮৮২) পর্যন্ত চাকমা রাজারা খাঁ উপাধি ধারণ করেন।
শুধু রাজারা নয়, চাকমাদের মধ্যে অনেক গোত্র-প্রধানও খাঁ উপাধি ব্যবহার করতেন (যেমন আমার নিজের পূর্বপুরুষদের যে বংশ তালিকা আমার হস্তগত হয়েছে তাতে ‘মাখ খাঁ’ নামে এক পূর্বপুরুষের নাম উল্লেখ আছে)।রাজা সুভল খাঁ মাত্র তিন বছর শাসন করে মারা গেলে তার ছোট ভাই ফতে খাঁ রাজা হন।
মোগলদের সাথে বাণিজ্যচুক্তি, মোগলদের থেকে হস্তগত করা কামান, তাঁর নামে অদ্যাবধি ‘ফতে খাঁর কূল’ নামে সম্পূর্ণ এক ইউনিয়নের নামকরণ ইত্যাদি থেকে মনে হয় যে রাজা ফতে খাঁ বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। এখানে চাকমাদের জায়গার নামকরণে ‘কূল’ এবং বিশেষতঃ রাজার কূল শব্দটি বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়।
চাকমাভাষায় কোন এক বৃহৎ এলাকা, উপত্যকা বুঝাতে এখনো ‘কূল’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যেমন – চেঙ্গী (চেঙে) নদীর অববাহিকা বুঝাতে ‘চেঙে কূল বা চেঙ্গী কূল’ ব্যবহৃত হয়, মাইনী (মেগিনি) নদীর অববাহিকা বুঝাতে ‘মেগিনি কূল’ বলা হয়।
অনুরূপ ভাবে কাজলং কূল, লোগাং কূল, পুজগাং কূল ইত্যাদি। রাঙ্গামাটির অধিবাসী বুঝাতে রাঙামাত্যা কুল্যা, খাগড়াছড়ির অধিবাসী বুঝাতে খাগড়াছড়ি কুল্যা বলা হয়। অনুরূপভাবে ব্যবহৃত হয় – ঢাকা কুল্যা, কুমিল্লা কুল্যা ইত্যাদি।
‘রাজার কূল’ বলতে রাজার বসবাস করা এলাকাকে বুঝায়। যেমন ভারতের মিজোরাম বা লুসাই হিলে বসবাসকারী চাকমারা বর্তমানে রাঙ্গামাটির চাকমাদের ‘রাজ-কূল্যা’ বা রাজার কূলের চাকমা হিসেবে অভিহিত করেন, নিজেদের বলেন লুসাই হিল্যা।
রাজা ফতে খাঁ ১৭১৫ থেকে ১৭৩৭ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। রামুতে রাজারকূল, চাকমারকূল, ফতেখাঁরকুল জায়গার নামকরণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে এসব এলাকা ঐ সময়ে তাদের শাসনাধীনে ছিল।
রামুতে চাকমারা বলতে গেলে এখন আর নেই এবং থাকলেও নগণ্যসংখ্যক, কিন্তু তদসত্বেও সেখানে, কক্সবাজারে ও তার আশে পাশে এলাকায় অনেক জায়গা রয়েছে যেগুলোর নামের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের গ্রাম, এলাকার মিল রয়েছে। যেমন ধলিরছড়া, কালিছড়া, পানিরছড়া, বরইছড়া, বনিয়া ছড়া, ধওয়াপালং ছড়া, হাদরা ছড়া, ধালির ছড়া, বাহার ছড়া, হাদুর ছড়া, দোচারি ছড়া, মনিয়া ছড়া, হারবাং ছড়া, জুমছড়ি, দোছড়ি, জাংছড়ি, ফুলছড়ি, নাক্ষ্যংছড়ি, সোনাইছড়ি, হিমছড়ি, চেংছড়ি, নুনছড়ি, জয়ছড়ি, মিঠাছড়ি, করল্যাছড়ি, থিমছড়ি, নোনাছড়ি, পানছড়ি, কোয়াংছড়ি, ঘিলাতলী, কলাতলী, তুলাতলী, সিবাতলী, পাহাড়তলী, বেলতলী, জারইলতলী (জারুলতলী?), বাথতলী, শ্রীমুরা, ফকিরামুরা, চৌচুলা মুরা, করলিয়া (করল্যা?) মুরা, বালুখালী, বাঁকখালী, রাজাখালী, মনাখালী, উলটাখালী, ভারুয়াখালী, নাপিতখালী, ফাস্যাখালী, মহেশখালী, উমখালী, খনাখালী, নন্দাখালী, উখিয়ার ঘোনা, খেংচরঘোনা, কালুয়ারঘোনা, আসমারঘোনা, হাউরিঘোনা, থোলিয়াঘোনা, খেনচুর ঘোনা, লাফার ঘোনা, পানিস্যা ঘোনা, জিরানিখোলা, কাচিরখোলা, হরিতলা, মুরাপাড়া, আলিখখ্যং, হোয়াইখ্যং, জওয়ারিয়া নালা, মরিচ্যা (মারিশ্যা?), বেতবুনিয়া, কাটাবনিয়া, কচুবনিয়া, আছারবনিয়া, মেরং(মেরুং?)লোয়া, চাকমারকাটা ইত্যাদি।
সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো টেকনাফের দক্ষিণে সাগরপাড়ে ‘সাবরাং’ নামে একটা ইউনিয়ন রয়েছে যা একান্তই চাকমাদের ব্যবহৃত একটি মশলা গাছের নাম অনুসারে। এটা টেকনাফ তথা বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ ইউনিয়ন (https://bn.wikipedia.org/…/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%AC…) । সাবরাং (Lemon Basil) চাকমাদের রান্নায় নিত্য ব্যবহৃত একটি মশলা পাতা যা পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ঘরে ঘরে চাষ হয়। অথচ সমতলে এর ব্যবহার খুব একটা দেখিনি (অতি সম্প্রতি ঢাকায় সবজি বাজারে বেশ চড়া দামে একটু-আধটু বিক্রি হচ্ছে বলে আমি লক্ষ্য করেছি)।
বৃটিশরা অষ্টাদশ শতকে যখন ভারতবর্ষে রাজত্বের সূচনা করে তখন কোলকাতা ছিল একটা গ্রাম। ঢাকার ইতিহাসও খুব বেশি প্রাচীন নয়। কিন্তু ঐতিহাসিক রামু জনপদের উপর নির্মিত সংযুক্ত ডকুমেন্টারীর মতে রামু ঠাঁই পেয়েছে ১৮৫৮ বছর আগে গ্রীক ভুগোলবিদ টলেমীর ভুগোল গ্রন্থে।
চীনা পরিব্রাজক ফাহিয়েন এর ভ্রমণ-বৃত্তান্ত যদি সঠিক হয়ে থাকে তবে মহামানব গৌতমবুদ্ধ হয়তো তাঁর জীবদ্দশায় স্বশরীরে এসেছিলেন এই রামু জনপদে অথবা তিনি না এলেও তাঁর মহাপরিনির্বাণের পরে এখানে আনা হয়েছিল তাঁর বক্ষাস্থির অংশবিশেষ।
গৌতমবুদ্ধের এই স্মৃতিকে ধারণ করার জন্য পরবর্তীতে মহান সম্রাট অশোক তাঁর ৮৪ হাজার ধাতুচৈত্যের একটি নির্মাণ করেছিলেন এখানে, যা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। মহামানব বুদ্ধ ও সম্রাট অশোকের স্মৃতিবিজড়িত এমন স্বনামধন্য এক জনপদে চাকমারা রাজত্ব ও বসবাস করত ভাবতে নিজেকে নিঃসন্দেহে অনেক গৌরবান্বিত বোধ হয়।
চাকমারা নিজেদের শাক্যবংশীয় হিসেবে দাবি করে। প্রশ্ন জাগে শাক্যবংশীয় হিসেবে চাকমারাই কি তাহলে রামু জনপদে নিয়ে এসেছিল নিজেদের পরমাত্মীয় শাক্যমুনি গৌতমবুদ্ধের বক্ষাস্থির অংশবিশেষ? রামু জনপদে বসবাসকে ভিত্তি করে চাকমাদের ইতিহাস, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির উপর বেশ কিছু জটিল প্রশ্নের উত্তর দেয়া যেতে পারে, যা আমরা পরবর্তীতে আলাপ করবো (চলবে)।
চাকমাজাতির আদিনিবাস সন্ধানে – ২য় পর্ব
আদিবাসী বন্ধুদের সবাইকে আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা। এবারের পোস্ট থেকে আমরা যা জানবোঃ
১) প্রাচীন ভারত বা বর্তমান বাংলাদেশের পূর্বাংশে আরাকান সংলগ্ন বর্তমান চট্টগ্রাম অঞ্চলে হরিকেল নামে এক প্রখ্যাত ও সম্মৃদ্ধশালী রাজ্য বা জনপদ ছিল।
২) এই হরিকেলের রাজধানী ছিল চম্পানগরী বা চম্পকনগর যা সম্ভবত চাকমাদের আদিবাসস্থানের একটি।
৩) হরিকেলের রাজারা সম্ভবতঃ একসময় চাকমাদের আদিরাজা বিজয়গিরির অনুরূপ ‘গিরি’ উপাধি ধারণ করতেন এবং এই উপাধিতে রৌপ্য মুদ্রাও প্রবর্তন করেছিলেন।আগের পর্বে আমরা জেনেছি একসময় চাকমাদের বসবাস ছিল প্রায় ২০০০ বছর প্রাচীন ঐতিহাসিকভাবে সম্মৃদ্ধ রামু জনপদে। তবে চাকমারা এই রামু জনপদে কখন থেকে বসবাস করে এসেছে সে সম্বন্ধে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়না।
আমাদের সিংহভাগ ইতিহাসবিদ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন যে চাকমারা এসেছে আরাকান-রামু হয়ে বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামে। কিন্তু এই ইতিহাসবিদরা এটা বিশ্লেষণের চেষ্টা করেননি যে এককালে রামু-চট্টগ্রাম এসব অঞ্চল আরাকানেরই শাসনাধীন ছিল এবং চাকমারা বর্তমান আরাকানে বসবাস না করলেও তারা এককালে আরাকান অধীনস্ত রামু-চট্টগ্রাম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছে বিধায় আরাকান থেকেই এখানে এসেছে হিসেবে অভিহিত করা যায়।
যেমন চাকমাদের ইতিহাসমতে রাজা ফতে খাঁ ১৭১৫ থেকে ১৭৩৭ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন এবং বিগত প্রায় তিন শত বছর ধরে রামু জনপদে তাঁর নামে জায়গার নাম রয়েছে, কাজেই ধরা যায় যে সেই অষ্টাদশ শতকেও চাকমারা সেই অঞ্চলে শাসন ও বসবাস করতো।
চাকমারা কি এর আগেও চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করতো, নাকি পরে রামু থেকে এই পাহাড়ী অঞ্চলে আসে? যেমন পর্তুগীজ ইতিহাসবিদ Joao de Barros (১৪৯৬-১৫৭০) ষোড়শ শতকে এতদ অঞ্চলের যে মানচিত্র (https://mappingbengal.com/the-de-barros-map) প্রণয়ন করেন তাতে Chacoma নামে যে স্থান প্রদর্শিত হয়েছে তা আরাকান ও ত্রিপুরার মাঝামাঝি অঞ্চলে চাকমারা বর্তমানে যে জায়গায় বসবাস করছে মোটামুটি তার সন্নিকটেই (সংযুক্তি-১)।
অন্যদিকে ষোড়শ শতাব্দীতে বিরচিত রাজমালার দ্বিতীয় লহরে যে মানচিত্র সন্নিবেশিত হয়েছে তাতে চাকমাদের অবস্থান ‘চাখমা’ হিসাবে চট্টগামের সাথেই (সামান্য দক্ষিণে) প্রদর্শিত হয়েছে (সংযুক্তি-২)।
কাজেই উপরে বর্ণিত দুই মানচিত্রের তথ্য যদি সত্য হয় তাহলে ষোড়শ শতাব্দীতেও চাকমারা চট্টগ্রাম ও তার আশেপাশের এলাকায় বসবাস করত। তারও আগে কি চাকমারা এতদঅঞ্চলে ছিল? পরবর্তী আলোচনাগুলো হয়তো তার কিছুটা তথ্য দেবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বাধিক নিকটে যে চম্পকনগর ———————-রামু, চট্টগ্রাম ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে চাকমাদের অবস্থান বিষয়ে আমরা আলাপ করছিলাম। তারমধ্যে চাকমাদের আদি বাসস্থান চম্পকনগর সম্পর্কে এখনো কোন আলাপ করা হয়নি।
আগে যেমন উল্লেখ করেছি আমাদের ইতিহাস লেখকগণ ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন চম্পা নগরীর উল্লেখ করেছেন যার বিস্তৃতি ভারতের হিমাচলের চাম্বা থেকে সুদূর ভিয়েতনামের চম্পা পর্যন্ত বিস্তৃত।
আমার মনে হয়েছে এতদুদ্দেশ্যে উপমহাদেশে এবং সুদূর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত যে কয়টি চম্পা-নগরী বা চম্পক নগর পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে পারস্পরিক একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। তবে আমি এখানে এমন এক চম্পা বা চম্পকনগরীর কথা বলবো যা ঐতিহাসিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিভিন্ন চম্পা বা চম্পকনগরীর মধ্যে চাকমাদের বর্তমান বাসস্থান পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে নিকটে, কিন্তু আমার জানামতে এত নিকটে থাকা সত্বেও ইতোপূর্বে কোন গবেষক বা ইতিহাসবিদ চাকমাদের সাথে সম্পর্ক টানতে এই চম্পকনগরীর কথা উল্লেখ করেননি।
অবশ্য আমি নিজে অন্য আরেক গ্রুপে এ সম্বন্ধে আগেও লিখেছি। কিন্তু তবুও এখানে লিখছি ব্যাপকভাবে প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে যে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামে এসেছি অনেক দূরের চম্পকনগর থেকে নয়, সম্ভবতঃ খুব কাছের সেই চম্পকনগর থেকে। হাঁ, আমি আলোচনা করতে চাচ্ছি চট্টগ্রাম বা তদসংলগ্ন এলাকায় হরিকেল (সযুক্তি-৩) নামক প্রাচীন রাজ্য বা জনপদের রাজধানী চম্পা-নগরী বা চম্পক-নগরকে নিয়ে, যেখানে সম্ভবতঃ চাকমাদের গিরি উপাধিধারী রাজারা শাসন ও বসবাস করতেন।
হরিকেল সম্পর্কে বাংলাপিডিয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে -(http://bn.banglapedia.org/index.php…) – “হরিকেল প্রাচীন পূর্ববঙ্গের একটি জনপদ। এর শনাক্তীকরণ নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। খ্রিস্টীয় সাত শতকের প্রাচীন ভারতীয় লেখকগণ পূর্বভারতীয় একটি অঞ্চলকে হরিকেল বলে উলে¬খ করেন। এটি পূর্ববঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য।
সাত শতকের চৈনিক পরিব্রাজক ই-ৎসিঙ্ হরিকেলের অবস্থানকে ‘পূর্বভারতের পূর্বসীমা’য় নির্দেশ করেন। নয় শতকের সাহিত্য কর্ম কর্পূরমঞ্জরীতে এ বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়। এতে হরিকেলের রমণীগণকে পূর্ব বঙ্গীয় নারীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
……. চন্দ্র বংশের লেখসমূহের উপর পর্যালোচনা ও গবেষণা এবং বঙ্গে তাদের বিজয় সম্পর্কে যথার্থ বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, আরাকান সীমান্তবর্তী চট্টগ্রাম এলাকায় এ রাজ্য অবস্থিত ছিল। এ ধারণার আরও জোরালো সমর্থন পাওয়া যায় চট্টগ্রামে কান্তিদেবের তাম্রশাসনের আবিষ্কারে।”
বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে হরিকেল বর্তমান চট্টগ্রাম অঞ্চলে খুব সম্ভবত রামু, দিয়াঙ্গ অথবা চট্টগ্রামের নগরাঞ্চলে অবস্থিত ছিল। দৈনিক প্রথম আলোর ৩১ শে আগষ্ট ২০১৩ সংখ্যায় “হরিকেল থেকে চট্টগ্রাম” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় -(http://archive.prothom-alo.com/…/2012-04-06/news/238162)। ‘অদম্য চট্টগ্রাম উৎসব’ শিরোনামে ডেইলি স্টার আয়োজিত প্রদর্শনীর আলোকে এই প্রবন্ধে বিশ্বজিৎ চৌধুরী লেখেনঃ “অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু ইতিহাস বলছে, চৌদ্দ শ বছরের এক প্রাচীন শহরের নাম চট্টগ্রাম। আমরা জানি, ৯০০ বছরের প্রবীণ নগর লন্ডন, আমাদের রাজধানী ঢাকার রয়েছে ৪০০ বছরের ইতিহাস; আর বছর কয়েক আগে ৩০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বর্ণময় উৎসবের আয়োজন হয়েছিল কলকাতা নগরে।
চট্টগ্রামের ইতিহাস এই প্রসিদ্ধ নগরগুলোর চেয়েও দীর্ঘ।সপ্তদশ শতাব্দীতে ইৎসিঙ নামের একজন চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রথম উল্লেখ করেন ভারতের পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলে হরিকেল নামে একটি রাজ্য আছে।
এই ‘হরিকেল’ই যে চট্টগ্রাম, এই তথ্য উঠে আসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বিএন মুখার্জির গবেষণায়। এই খ্যাতিমান মুদ্রাবিশারদ হরিকেল রাজ্যে প্রচলিত মুদ্রা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হন, সমৃদ্ধ এই রাজ্য ছিল কর্ণফুলী নদীর তীরে, যা কালক্রমে চট্টগ্রাম নামে পরিচিতি পায়। বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামের জার্নালে এ তথ্য প্রকাশ করেন তিনি।আরাকান, ত্রিপুরা ও মোগল—এই তিন রাজশক্তির লড়াইয়ের ক্ষেত্র ছিল চট্টগ্রাম।
বহুকাল চলেছে এই দখল প্রতিষ্ঠার লড়াই। মোগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মুনিম খান ১৫৭৫ সালের ৩ মার্চ আফগান শাসক দাউদ খার কররানীকে পরাজিত করলে মোগল সাম্রাজ্যের অধিকারে আসে বাংলা।
কিন্তু এরপর আরও প্রায় ৮০ বছর পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে যায় অধরা। অবশেষে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি ‘কর্ণফুলীর যুদ্ধে’ মোগল নৌবাহিনী জয়লাভ করে। আসলে এই লড়াই ও জয়ের মধ্য দিয়েই বঙ্গ বা বাংলার সঙ্গে যুক্ত হয় চট্টগ্রাম”।
ইতিহাসবিদরা হরিকেলের অবস্থান সনাক্তকরণ বিষয়ে মনোনিবেশ করলেও এর রাজধানী চম্পানগরী বা চম্পকনগর সম্পর্কে খুব বেশি আলোকপাত করেননি। সম্ভবতঃ এই বিষয়টি তাঁদের গবেষণায় কোন উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারেনি।
ফলে এত সন্নিকটে থাকা চম্পক নগরী আমাদের অগোচরে রয়ে গেছে।ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর History of Bengal, Vol-1 গ্রন্থে ভারতের পূর্বাংশে হরিকেল রাজ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন –Writers of the seventh century mention a country called Harikela. According to I-tsing it was the eastern limit of East India. The evidence of the Chinese writer is confirmed by that of the Karpura-Manjuri (9th Century A.D.) which includes Harikela girls among women of the east –“Thou gallant of women of the east, though Champak-bloom ear-ornament of the town Champa, thou whose lustre transcends the loveliness of Radha, who hast conquered Kamrupa by thy prowess who providest merri mekings (Keli) for Harikeli”.ডঃ মজুমদার উল্লেখিত নবম শতাব্দীতে বিরচিত কর্পূর-মঞ্জরী নাটকে আমরা দেখি হরিকেলের রাজাকে ‘পূর্বদিকপতি’ হিসেবে বিশেষিত করা হয়েছে, চম্পানগরের “চম্পক” কর্ণভূষণ, চম্পক-কোদণ্ড (চম্পক-ধনুর্ধর) নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে (সংযুক্তি-৪, ৫)।
এও উল্লেখ করা হয়েছে যে অবলীলাক্রমে তিনি রাঢ়দেশ জয় করেছেন, ভূজবিক্রমে কামরূপ জয় করেছেন। এই বিবেচনায় দেখা যায় হরিকেল একসময় বঙ্গ বা রাঢ় এবং সিলেটসহ কামরূপ বা আসাম পর্যন্ত জয় করেছিল। তার রাজধানী ছিল চম্পানগরী বা চম্পকনগর।
Numismatic Society of India প্রকাশিত Coinage and Economy of North Eastern States of India গ্রন্থে ইতিহাস ও মুদ্রাতত্ববিদ ডঃ বি, এন মুখার্জী তাঁর ‘A survey of the Coinage of Harikela’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন – “Harikela or Hariketa was the name of a territory which in 7th century A.D. included inter alia the Chittagong district area (now in Bangladesh).”হরিকেল যে অনেক সমৃদ্ধ জনপদ ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় এই রাজ্যের রাজাদের ধাতব মুদ্রা প্রবর্তনের মাধ্যমে। ডঃ বি, এন মুখার্জী তাঁর উপরিবর্ণিত প্রবন্ধে হরিকেলের মুদ্রা সম্বন্ধে লিখেছেন – “The Original Structures of the series of thin silver coins mentioned above were apparently inspired by the Arakan coinage. This is not impossible, since the Chittagong district region of the Harikela was contiguous to Arakan.”ডঃ মুখার্জীর বর্ণনা থেকে দেখা যায় হরিকেলের অনেক মুদ্রায় ‘গিরি’ নামাঙ্কিত রয়েছে –“Thus a silver coin, bearing a bull and tripartite symbol, is inscribed with a legend (La)lagiri ……….., Among such legends we can refer ……… Sivagiri, Jayagiri etc.” হরিকেল মুদ্রার বড় ভাণ্ডার পাওয়া গেছে ময়নামতি ও ত্রিপুরার বিলোনিয়ায়।
হরিকেল মুদ্রা মূলত সপ্তম ও অষ্টম শতকের দিকে এখনকার সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লার ময়নামতি ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় ব্যবহৃত হতো। সিলেট থেকে ৩০-৪০টি হরিকেল মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জোবরা গ্রামে পাওয়া গেছে ৩৫টি (https://www.kalerkantho.com/…/oboshore/2017/04/29/491940)। এর থেকে বুঝা যায় হরিকেলের প্রভাব চট্টগ্রাম থেকে সিলেট বা আসাম পর্যন্ত ছিল।
ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংগৃহীত দুটি পরবর্তী সময়ের পাণ্ডুলিপিতে হরিকোলকে সিলেটের সমার্থক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, আর কর্পূরমঞ্জুরী নাটকে হরিকেলের রাজাকে কামরূপ বা আসাম বিজয়ী রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। এর সাথে উপরে উল্লেখিত হরিকেলের মুদ্রার ব্যবহারের বিষয়টি বিবেচনা করলে চট্টগ্রাম থেকে সিলেট পর্যন্ত হরিকেলের প্রভাব ছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায় –
১) প্রাচীন ভারত বা বর্তমান বাংলাদেশের পূর্বাংশে আরাকান সংলগ্ন বর্তমান চট্টগ্রাম অঞ্চলে হরিকেল নামে এক সম্মৃদ্ধশালী রাজ্য বা জনপদ ছিল।
২) এই হরিকেলের রাজধানী ছিল চম্পানগরী বা চম্পকনগর
৩) হরিকেলের রাজারা সম্ভবতঃ একসময় গিরি উপাধি ধারণ করতেন এবং এই উপাধিতে রৌপ্য মুদ্রাও প্রবর্তন করেছিলেন। চাকমারা নিজেদের চম্পকনগর থেকে আগত এবং সেই নগরের রাজা বিজয়গিরির বংশধর বলে দাবী করে।
এই বিবেচনায় আমরা কি বলতে পারি চম্পকনগরের গিরি উপাধিধারী চাকমা রাজারা আরাকান রাজাদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রৌপ্য মুদ্রা প্রবর্তন করেছিলেন? বাংলাপিডিয়ার ইতোপূর্বের বর্ণনা অনুসারে আমরা দেখেছি হরিকেলের জনগণ মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল। উল্লেখ্য বিগত শতকেও চাকমারা মহাযানী আচার-আচরণ অনুসরণ করত এবং বেশি দেরী হয়নি তারা থেরবাদীতে রূপান্তরিত হয়েছে।
এটাও চাকমাদের হরিকেলের চম্পক নগরীর মহাযানী বৌদ্ধ জনগন হওয়ার দিকে ইঙ্গিত দেয়। পরিশেষে বলতে হয়, উপরে যেমন বর্ণিত হয়েছে, চট্টগ্রাম বাংলার সাথে যুক্ত হয় ১৬৬৬ খ্রীস্টাব্দে।
কিন্তু তারও প্রায় হাজার বছর আগে সপ্তম শতাব্দীতে এই জনপদ হরিকেল নামে পরিচিত ছিল, যার রাজধানী চম্পক নগর বা চম্পা নগরীতে সম্ভবতঃ গিরি উপাধিধারী চাকমা রাজারা রাজত্ব করতেন এবং তাঁরা নিজেদের নামে রৌপ্যমুদ্রা প্রবর্তন করেছিলেন। তুলনামূলকভাবে হরিকেল একটি ভিন্ন ধরণের নাম। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে হরিকেলকে কোন কোন ক্ষত্রে হরিকোলও বলা হয়েছে। চাকমারা নারিকেলকে বলে নারিকুল।
সেক্ষেত্রে হরিকেলকে হরিকোল বা হরিকূল বলা অস্বভাবিক নয়। কারণ চাকমাদের জায়গার নামে রাজারকূল, চাকমারকূল, ফতেখাঁরকূল ইত্যাদি কূলযুক্ত স্থানের নাম আমরা আগেও দেখেছি।
চাকমা জাতির আদিনিবাস সন্ধানে – ৩য় পর্ব
এই পর্বে আমরা ভারতের ত্রিপুরায় চাকমাদের সম্ভাব্য চম্পকনগরের অবস্থান জানার চেষ্টা করবো যেখান থেকে চাকমাদের আদিরাজা বিজয়গিরি ও সেনাপতি রাধামন চট্টগ্রাম-রামু অঞ্চলের উদ্দেশ্যে বিজয় অভিযানে যাত্রা করেন।
চাকমারকূলে চাকমা নেই, চাকমাঘাটে চাকমা নেই————————————-আগের পর্বে আমরা দেখেছি সপ্তম শতাব্দী থেকে চট্টগ্রাম রামু এলাকায় হরিকেল রাজ্য ছিল যার রাজধানী ছিল চম্পক নগর।
নবম শতাব্দীতে বিরচিত ‘কর্পূর-মঞ্জুরী’ নাটকে হরিকেলের রাজধানী হিসেবে এই নাম দেখা যায়। একমাত্র চাকমারা ছাড়া এতদঅঞ্চলের অন্য কোন জাতির এই নাম ব্যবহার করার কথা নয়।
কাজেই সপ্তম শতাব্দী থেকে চাকমারা এই অঞ্চলে ছিল বলে ধারণা করা যায়। এখন আমরা দেখি চাকমাদের ইতিহাস মতে এতদঅঞ্চলে বিজয়গিরির অভিযান কখন পরিচালিত হয়েছিল। ‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের দ্বিতীয় পরিচ্ছদের বর্ণনা মতে এই অভিযান পরিচালিত হয়েছিল আনুমানিক ৫৯০ খৃষ্টাব্দে (পর্ব -৩, সংযুক্তি–১)।
ষষ্ঠ শতাব্দীর একদম শেষের দিকে বিজয়গিরির চট্টগ্রাম, রামু অঞ্চলে অভিযান ও বিজয় এবং ইতিহাসের বর্ণনামতে তাদের এতদঅঞ্চলে বসতি স্থাপনের সাথে সপ্তম শতাব্দীতে এই অঞ্চলে হরিকেল রাজ্যের উত্থান এবং ঐ রাজ্যের রাজধানীর নাম তাদের প্রাচীন রাজ্য বা রাজধানী চম্পকনগরের সাথে মিল থাকা ইত্যাদির মাধ্যমে চাকমাদের ইতিহাসের সামঞ্জস্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।
এখন আমরা দেখি রাজা বিজয়গিরি কোন অঞ্চল থেকে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন, অর্থাৎ চট্টগ্রাম, রামু জনপদে আসার আগে বিজয়গিরির দেশ কোথায় ছিল এবং চাকমাদের ইতিহাসে বর্ণিত তাঁর অভিযান পরিচালনার বর্ণনার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু।
বিপ্রদাস বড়ুয়া সম্পাদিত শ্রীমাধবচন্দ্র চাকমা কর্ম্মী বিরচিত ‘শ্রীশ্রীরাজনামা বা চাকমা জাতির ইতিহাস গ্রন্থ’ অনুসারে রাজা বিজয়গিরির পিতৃমহ রাজা ভীমঞ্জয়, তার পুত্র সাংবুদ্ধা, যার দুই পুত্র বিজয়গিরি ও উদয়গিরি।
রাজা ভীমঞ্জয়ের কালাবাঘা নামে একজন সেনাপতি ছিল, যিনি রাজার আদেশে দিগ্বিজয় মানসে প্রভূত সৈন্য নিয়ে ‘লোহিত্য’ বা ‘কপিলা’ নদীর পরপারস্থ রাজ্যসমূহ জয় করার ইচ্ছায় ক্রমশঃ পূর্ব দক্ষিণ দিক জয় করতঃ তথায় কালাবাঘা নামে এক রাজ্য স্থাপন করেন এবং ঐ রাজ্যের প্রান্তভাগে নূতন চম্পানগর নামে এক নগর স্থাপন করে রাজধানী করেন।
উক্ত গ্রন্থের টিকায় বর্ণিত হয়েছে যে ‘লোহিত্য’ বা ‘কপিলা’ নদী ব্রহ্মপুত্রের নামান্তর, যা ত্রিপুরার রাজমালার দ্বিতীয় লহর মধ্যমণির ৩১৫ নং পৃষ্ঠায়ও উল্লেখ করা হয়েছে আর অচ্যুতচরণ চৌধুরী তাঁর ‘শ্রীহট্টের ইতিহাস’ গ্রন্থে শ্রীহট্ট জিলা পূর্বে কালাবাঘা রাজ্য নামে অভিহিত হতো বলে উল্লেখ করেছেন।
‘শ্রীশ্রীরাজনামা’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে ভীমঞ্জয়ের মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র সাংবুদ্ধা রাজা হন। নূতন চম্পানগরের শাসনকর্তা সেনাপতি কালাবাঘার মৃত্যু হলে রাজা সাংবুদ্ধা তদস্থলে বিজয়গিরিকে শাসনকর্তারূপে প্রেরণ করেন। বিজয়গিরি কালাবাঘায় পৌঁছে স্বীয় আধিপত্য দৃঢ় করেন এবং দিগ্বিজয়ের জন্য এক বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করেন।
স্বর্গীয় বঙ্কিম চন্দ্র চাকমা তাঁর ‘চাকমা জাতি ও সমসাময়িক ইতিহাস’ গ্রন্থে পুরাতন আসাম প্রদেশের কিয়দংশ, শ্রীহট্ট জেলা, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণ বাড়িয়া জেলা, পার্বত্য ত্রিপুরার বৃহদংশ ও চট্টগ্রামের উত্তর অংশ নিয়ে কালাবাঘা রাজ্য গঠিত ছিলো বলে উল্লেখ করেছেন।
এখন আমরা দেখি উপরিবর্ণিত স্থানে যুবরাজ বিজয়গিরি পিতৃরাজ্য থেকে দূরে দ্বিতীয় চম্পকনগরে যে তার আধিপত্য দৃঢ় করেছিলেন তাঁর প্রমাণ কতটুকু। এতদুদ্দেশ্যে গুগুল ম্যাপ থেকে নেয়া উপরে বর্ণিত স্থানসমূহের একটি মানচিত্র ‘পর্ব-৩ এর সংযুক্তি-২’ এ দেখা যেতে পারে।
সংযুক্ত এই মানচিত্রে প্রাচীন কালাবাঘা নামক বর্ণিত রাজ্যের জন্য চিহ্নিত জনপদে চাকমাদের ইতিকাহিনীর সহিত সংশ্লিষ্ট নিম্নবর্ণিত স্থানসমূহ দেখা যায়, যা সংযুক্ত গুগুলম্যাপে চিহ্নিত করা হয়েছেঃ
১) বিজয়নগর – বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি উপজেলা, স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয়ের পতাকা এ ইউনিয়ন দিয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছিল বিধায় স্মারক হিসেবে ২০১০ সালে এই উপজেলার নামকরণ করা হয় বিজয়নগর। তবে আমরা পরবর্তীতে বিজয়গিরির নামের সাথে বিজয়নগরের কোন সম্পর্ক রয়েছে কিনা তা খুঁজে দেখতে পারি।
২) চম্পকনগর-১ – ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার একটি ইউনিয়ন।
৩) চম্পকনগর-২ – উপরে উল্লেখিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চম্পকনগর-১ থেকে বেশি দূরে নয়, কিন্তু ভারতের পশ্চিম ত্রিপুরায়।
৪) চাকমাঘাট – ভারতের পশ্চিম ত্রিপুরায় উপরের ৩ নং ক্রমিকে উল্লেখিত চম্পকনগরের সন্নিকটে।
৫) উদয়পুর – এর নাম ছিল রাঙ্গামাটি যা ত্রিপুরা রাজাদের বংশাবলী সংক্রান্ত গ্রন্থ ‘শ্রীরাজমালা’-র বর্ণনামতে লিকা নামক মঘ সম্প্রদায় কর্তৃক শাসিত হত। তাদের থেকে ত্রিপুরার রাজা জুঝারু ফা এই স্থান দখল করেন এবং ঐ নামে প্রায় হাজার বছর ধরে ত্রিপুরার রাজধানী ছিল। পরবর্তীতে ষোড়শ শতাব্দীতে ত্রিপুরা মহারাজ উদয় মাণিক্য রাঙ্গামাটির নাম পরিবর্তন করে নিজের নামানুসারে উদয়পুর রাখেন।
৬) চম্পকনগর-৩ – উদয়পুরের প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে দক্ষিণ ত্রিপুরায় চম্পকনগর, বাংলাদেশের ফেনী জেলা সঙ্গলগ্ন।
৭) বিজয়নগর-২ – চম্পকনগর-৩ থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে দক্ষিণ ত্রিপুরায় চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্নিকটে।
৮) রাঙ্গামাটি – সিলেটের দক্ষিণ-পূর্বে আসামের করিমগঞ্জ জেলায়।
৯) চম্পকনগর-৪ – সিলেটের পূর্বদিকে, আসামের করিমগঞ্জ।উপরের স্থানসমূহের অবস্থান পর্যালোচনা করে কালাবাঘা রাজ্যটি যে সিলেটের সন্নিকটস্থ আসাম, ত্রিপুরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইত্যাদি অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ হওয়াতে রাজ্যটি এখন আর নেই, কিন্তু বিভক্ত অঞ্চলগুলোর প্রত্যেকটিতে সেই রাজ্যের জনপ্রিয় নগর চম্পকনগর রয়ে গেছে, সেই সাথে আছে রাঙ্গামাটি, যেটি চম্পা বা চম্পকনগরের মত প্রাচীন বঙ্গ-ভারতবর্ষের একটি প্রাচীন নগর এবং চাকমাদের একটি প্রিয় নগর, যুগে যুগে চাকমারা যেখানে গেছে হয়তো এই নগরের নামটিও সাথে নিয়ে গেছে। উপরে উল্লেখিত জায়গাগুলো সম্বন্ধে পরে বলবো।
তদুপরি আগে যেমন বলা হয়েছে, কালাবাঘার চম্পকনগর হলো দ্বিতীয় চম্পকনগর। সেক্ষত্রে আমাদের কালাবাঘার আগের চম্পকনগরও খুঁজতে হবে। ভারতে, আসামে আরো চম্পকনগর, বিজয়নগর, রাঙ্গামাটি রয়ে গেছে।
তবে এই মুহূর্তে আমাদের কাজ হলো ত্রিপুরা বা কালাবাঘা অঞ্চলের চম্পকনগরকে তুলে ধরা যেখান থেকে বর্তমান চাকমাদের আদিরাজা বিজয়গিরি এবং তাঁর সেনাপতি রাধামন রোয়াং বা চট্টগ্রাম-রামু অঞ্চলে অভিযান চালিয়েছিলেন।
‘চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে দেখা যায় রাজা বিজয়গিরি সেনাপতি রাধামনসহ ৭ চিমু (২৬ হাজার) সৈন্য নিয়ে রোয়াংদেশ বা চট্টগ্রাম-রামু অঞ্চলে অভিযানের জন্য তার রাজ্য থেকে দক্ষিণ দিকে গমন করেন।
তদকালীন ত্রিপুরা রাজা তাঁর সাহায্যার্থে কুঞ্জধন নামে এক সেনাপতিকে একদল সৈন্যসহ রাধামনের সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। তারা প্রথমে খৈ গাং (খৈয় নদী) পার হয়ে আসেন। গেংখুলীর গানে এ বিষয়ে এভাবে উল্লেখ আছে (পর্ব-৩, সংযুক্তি–৩)-“নাজের উল্লাসে রাধামন,খৈ গাঙত পল্লাক্কি সৈন্যগণ”।
অর্থাৎ সৈন্যবাহিনী খৈয় নদীতে উপস্থিত হলে সেনাপতি রাধামন আনন্দ উল্লাস করেন। আমরা এখন গুগুল ম্যাপ থেকে দেখি বিজয়গিরি উপরে বর্ণিত খৈয় নদীতে উপস্থিত হওয়ার বিষয়টির গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু। এই উদ্দেশ্যে ইতোপূর্বে ক্রমিক নং – ৪ এ উল্লেখিত “চাকমাঘাট” স্থানটিকে গুগুল ম্যাপ থেকে সম্প্রসারিত আকারে সংযুক্তি-৪ ও ৫ এ দেখানো হল।
স্পষ্টতই চাকমাঘাট এলাকাটি ‘খোয়াই নদী’র সাথে। বর্তমানে ঐ নদীতে বাধ দেয়া হয়েছে যা Chakmaghat Barrage নামে গুগুল ম্যাপ ও স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যাচ্ছে। স্নেহভাজন অ্যাডভোকেট Nicolas Chakma নাকি ত্রিপুরার চাকমাঘাটে বেড়াতে গিয়েছিলেন।
তার কাছে শুনলাম সেখানে এখন কোন চাকমা নেই, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ধামাই গোষ্ঠীর লোকজন সেখানে বাস করে, তাদের নারীরা চাকমা নারীদের মত পিনোন-খাদি পরে, তবে তাদের পিনোনে নাকি চাবুঘী নেই। ত্রিপুরার শ্রীরাজমালা গ্রন্থে অবশ্য ধামাই জাতিকে মগজাতির শাখা বিশেষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজমালার প্রথম লহর (যুঝার খণ্ড) ৪৯ নং পৃষ্ঠায় লেখা আছে (পর্ব-৩, সংযুক্তি-৬)-রাঙ্গামাটি দেশেতে যে লিকা রাজা ছিল ।
সহস্র দশেক সৈন্য তাহার আছিল ॥ ধামাই জাতি পুরোহিত আছিল তাহার। অভক্ষ্য না খায়ে তারা সুভক্ষ্য ব্যভার ॥ আকাশেত ধৌত বস্ত্র তারাহ শুখায়। শুখাইলে সেই বস্ত্র আপনে নামায় ॥ বৎসরে বৎসরে তারা নদী পূজা করে। স্রোত যে স্তম্ভিয়া রাখে গোমতী নদীরে ॥
এখানে রাঙ্গামাটি হল লিকা সম্প্রদায় থেকে ত্রিপুরা রাজা কর্ত্তৃক অধিকৃত বর্তমান উদয়পুর যা উপরে ক্রমিক নং-৫ এ উল্লেখ করা হয়েছে। রাজমালার টিকায় লিকা এবং ধামাই দুই জাতিকে মঘ জাতির শাখা বিশেষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে রাঙ্গামাটি নামটি নিঃসন্দেহে মূল আরাকান/মিয়ানমার থেকে আগত মঘ বা আরাকানী জাতির দেয়া নাম হতে পারেনা। আর মঘ জাতির মধ্যে ধামাই নামে কোন সম্প্রদায় আছে বলে শোনা যায়না, বরং চাকমা সম্প্রদায়ের মধ্যে ধামাই নামক গোঝা/গোষ্ঠী রয়েছে, আর চাকমারা বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হলেও নদী বা গাঙপূজা এখনো করে, চৈত্র সংক্রান্তিতে ফুলবিঝুর দিনে নদীতে গিয়ে ফুল দিয়ে পূজা করে।
অন্যদিকে চম্পকনগরের মত রাঙ্গামাটি নামটিও সম্ভবতঃ চাকমারা যেখানে গেছে সাথে নিয়ে গেছে। খুব সম্ভব সেই ষষ্ঠ শতাব্দীতে চাকমারা তখনো ‘চাকমা’ নামে এত পরিচিতি লাভ করেনি, তখনো বৌদ্ধ ধর্মের ধারক-বাহক মৌর্য সম্রাট অশোকের ‘মগধ’-এর নাম এত সুপরিচিত ছিল যে প্রাচীন বিহার, ভারত, আরাকানের যে কোন বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে সম্ভবতঃ মগ নামে অভিহিত করা হত।
এ বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত আলাপ করা যাবে (কারণ এত দীর্ঘ আলোচনা এক পর্বে ফেসবুকে দিলে লেখাটি একঘেঁয়ে লাগতে পারে)। এখন ‘খৈ গাঙ’ বা ‘খোয়াই নদী’র অবস্থান জানার পরে ‘ঠেওয়া’ নামে আরেক নদীর অবস্থান আমরা খুঁজি।
‘শ্রীশ্রীরাজনামা’ গ্রন্থের মতে রোয়াং রাজ্যে পৌঁছার আগে এই নদীর তীরে প্রথম শিবির স্থাপন পূর্বক রাজা বিজয়গিরি সেনাপতি রাধামনকে মগরাজ্য আক্রমণের অনুমতি প্রদান করেন। উক্ত গ্রন্থের ৪৭ নং পৃষ্ঠার টিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, “ঠেওয়া নদী কোথায় জানা যাইতেছে না”। আমরা চাকমারা অনেক ক্ষেত্রেই অন্তস্থঃ ‘গ’-কে অ-উচ্চারণ করি। যেমন – খাগড়াছড়ি জায়গাটি মূলতঃ চাকমা ভাষায় বলা হয় “হাআরাসরি’, ‘নাগরি’-কে উচ্চারণ করা হয়, ‘নাঅরি’, ‘বাগান’-কে ‘বাআন’। তাই ‘ঠেওয়া’ নদীটি চাকমা ভাষায় ‘থেআ’ হবে যা বাংলায় ‘থেগা’, ইংরেজিতে “Thega” লেখা হয়।
তার অর্থ হলো বর্তমান রাঙ্গামাটি জেলা ও মিজোরাম সীমান্তে থেগা নদীর তীরে সম্ভবতঃ থেগামুখ অর্থাৎ থেগা নদী যেখানে এসে কর্ণফুলীতে মিশেছে সেই স্থানে এসে বিজয়গিরি শিবির স্থাপন করলেন। প্রশ্ন জাগে এই স্থানে এসে শিবির স্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন কি কারণে? কারণ ছিল রোয়াং রাজ্য বা রামু ছিল সাগর তীরে, সেখানে যেতে হলে নৌপথে সাগর পাড়ি দিয়ে যেতে হবে।
গেংখুলী গীত এর ভাষায়ও গাওয়া হয়েছে -অপার পানি সাগর বেই, কুল-কিনারা দেঘা নেই,জাদিপুজাত তে ঘি দিল, রোয়্যাঙ্গা দেঝত তে কুলেল।(স্বর্গীয় বঙ্কিম চন্দ্র চাকমা, ‘চাকমা জাতি ও সমসাময়িক ইতিহাস’ – পৃঃ ৩২)অর্থাৎ সাগর বেয়ে তারা রামু বা রোয়াং দেশে উপনীত হয়। এই লেখার প্রথম পর্বে যেমন উল্লেখ করেছি রামু ঠাঁই পেয়েছে ১৮৫৮ বছর আগের টলেমির ভুগোল গ্রন্থে।
সেই হিসেবে আরব বণিকদের মত চাকমারাও হয়ত জানত সেখানে যেতে হবে জলপথে – থেগা, কর্ণফুলী হয়ে। কিন্তু ২৬ হাজার সৈন্য বহন করার মতো নৌকা সেই পাহাড়ি পথে সাথে বয়ে নিয়ে যাওয়া বিজয়গিরি-রাধামনদের নিশ্চয় সম্ভব ছিলোনা।
তাই এই প্রস্তুতির জন্য থেগাতে তারা শিবির স্থাপন করলেন। এই শিবিরে বসে তাঁরা নৌকা তৈরি করেছিলেন কিনা জানা নেই, তবে সহজ সমাধান ছিল থেগার দুপাশের পাহাড় থেকে বাঁশ কেটে ঝটপট ভেলা তৈরি।
চাকমারা সেই আদিকাল থেকে ‘কাত্তোন’ অর্থাৎ বাঁশ কাটা আর সেটা দিয়ে ভেলা তৈরিতে অভ্যস্ত, এখনো কাপ্তাই-এ বাধ দেয়ার পরে কয়েক কিলোমিটার প্রশস্ত কর্ণফুলী নদীর বুকে কিলোমিটার দীর্ঘ ভেলার সারি বানিয়ে চন্দ্রঘোনার পেপার মিলে তারা বাঁশ সরবরাহ করে। আর নৌকা ফুটো হলে ডুবে যায়, কিন্তু ভেলাতে সেই ভয় নেই।
তাই ২৬ হাজার সৈন্য হয়তো ঝটপট কয়েক হাজার ভেলা বানিয়ে ফেলেছিল। ভাবতে সে এক মজার দৃশ্য হবে নিঃসন্দেহে। তবে তারপরেও রামু পর্যন্ত পৌঁছা হয়তো অত সহজ ছিলোনা। তার আগে কর্ণফুলীর মোহনায় দিয়াং (দিগাং<(চা)দিগাং?) নামক স্থানে প্রতিপক্ষ মগ রাজার সাথে যুদ্ধ হয়।
যুদ্ধে জয়ী হলে চাকমারা আরো দক্ষিণে রোয়াং দেশ বা রামুতে অগ্রসর হয়। খৈ গাঙ বা খোয়াই নদী অতিক্রম করার বর্ণনা থেকে আমরা বিজয়গিরি ও রাধামন কোন চম্পকনগর থেকে থেগা-কর্ণফুলী হয়ে রোয়াং রাজ্য গমণ করেছিলেন তার ধারণা করতে পারি।
সিলেটের সন্নিকটে আসামের করিমগঞ্জ জেলার চম্পকনগর থেকে ‘থেগা’ গেলে আদৌ খোয়াই নদী অতিক্রমের দরকার পড়েনা। অন্যদিকে পশ্চিম ত্রিপুরার চম্পকনগর খোয়াই নদী থেকে বেশি দূরে নয়, তাই এখান থেকে যাত্রা করলে খোয়াই নদীর তীরে পৌঁছাটা গেংখুলী গীতিকাব্যে রাধামনের আনন্দ উল্লাস করার মতো এই অভিযানের একটি মাইলফলক হতে পারে বলে বিবেচিত হয়না।
তাই বিজয়গিরির বাহিনী বর্তমান বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চম্পকনগর থেকে যাত্রা করে, ত্রিপুরার রাণীর বাজার, চম্পকনগর, বড়মুড়া হয়ে তেলিয়ামুড়ার সন্নিকটে খোয়াই নদী অতিক্রম করে বলে অনুমিত হয়।
গুগুল ম্যাপ থেকে থেগা পর্যন্ত এই অভিযানের সম্ভাব্য গতিপথ পর্ব-৩, সংযুক্তি-৭ ও ৮ এ পদর্শিত হল।
এখানে উল্লেখ্য হাজার বছর ধরে চাকমাদের ইতিহাস নিয়ে বংশ পরম্পরায় গান করে আসছে যে গেংখুলীরা তাদের সিংহ ভাগ ছিলেন বাংলাভাষায় অশিক্ষিত। আজকে আমরা খুব সহজেই গুগুল ম্যাপে অনুসন্ধান করে তাদের বর্ণিত ‘খৈ গাং’ এর অবস্থান এবং ত্রিপুরার চাকমাঘাট জায়গা/তালুক এর অবস্থান ও তার উপর ভিত্তি করে ত্রিপুরায় চাকমাদের চম্পকনগর অন্বেষণের চেষ্টা করছি।
কিন্তু এই গেংখুলীরা হয়তো জীবনে ত্রিপুরার চম্পকনগর, খোয়াই নদী, চাকমাঘাট ইত্যাদি এলাকা ভ্রমণ করেননি, বরং উত্তরসূরী হিসেবে পূর্বপুরুষদের গাওয়া লোকগীতি বংশ পরম্পরায় গেয়ে আসছেন।
তাই এগুলো তাদের নেহাৎ বানানো কাহিনী হিসেবে উড়িয়ে দেয়া সমীচিন হবেনা, বরং এগুলো সংগ্রহ করে সেখান থেকে আমাদের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে। আগামীপর্বে ত্রিপুরা-কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানের নামের ভিত্তিতে চাকমাদের এসব অঞ্চলে বসবাসের আরো সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থাপনের প্রচেষ্টা থাকবে।
উপরের এবং এর আগের পর্বের আলোচনা সমালোচনা থেকে দেখা যায় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষে ত্রিপুরা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-সিলেট অঞ্চলের চম্পকনগর থেকে চাকমারা চট্টগ্রাম-রামু অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে সম্ভবতঃ হরিকেল বা হরিখোলা নামের রাজ্য স্থাপন করে যার রাজধানীও চম্পকনগর নামে অভিহিত হয়।
তাদের জাতির নামানুসারে জায়গা চাকমাঘাট, চাকমারকূল এখনো এসব অঞ্চলে এককালে তাদের শাসন, তাদের বসবাসের সাক্ষ্য বহন করে। কালের প্রবাহে চাকমাঘাট, চাকমারকুল এই দুই জায়গাতেই আর কোন চাকমা নেই।
লেখকঃ পুলক খীসা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।