চাকমা জাতির রাজনৈতিক সগ্রামের ইতিহাস
1214
চাকমাদের রাজনীতি
চাকমারা প্রকৃতিগতভাবে স্বাধীনচেতা। তারা কখনাে অধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। তাদের ভাষায় পরাধীনতার কোন শব্দ নেই। মােঘল আমল হতে চাকমাদের উপর উপনিবেশিক পরাধীনতার শৃঙ্খল এসে পড়ে। বাণিজ্য অবরােধ সৃষ্টির মাধ্যমে মােঘলরা চাকমা রাজ্যের উপর এক ধরণের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। তাই মােঘলদের সাথে চাকমাদের যুদ্ধ সংঘাত বেধেছিল বেশ ক’ বার।
বৃটিশ আমলেও চাকমাদের বিদ্রোহ লক্ষ্যণীয় । তারা কখনাে বৃটিশদের বশ্যতা অন্তর দিয়ে মেনে নিতে পারেনি। বৃটিশরাও চাকমা রাজাকে ব্যবসাগতভাবে অবরােধ করে চাকমা রাজ্যের অর্থনীতিকে বিপর্যস্থ করে ফেলে।
অর্থনৈতিকভাবে পরাজয়ের সূত্র ধরে চাকমা রাজ্য বৃটিশ উপনিবেশে পরিণত হতে বাধ্য হয়। তবে বৃটিশ আমলে চাকমারা আভ্যন্তরীণভাবে স্বাধীন ছিলেন বলে পরবর্তীতে বিদ্রোহ হতে সরে আসে। কিন্তু কাগজে কলমে বৃটিশদের প্রতিনিধি ডিসিরাই ছিলেন সর্বেসর্বা। তারপরও বৃটিশদের সাথে তারা সম্প্রীতি নিয়ে বাস করেছিল ।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে চাকমারা যখন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠা শুরু করেন তখন থেকে তারা বুঝতে পারেন যে, সামন্ত রাজাগণের নেতৃত্বে তাদের স্বাধীনসত্বা রক্ষা করা সম্ভবপর নয়। রাজারা যে সকল অভিজাতদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন তারাও ব্যক্তি স্বার্থ সিদ্ধিতে পরস্পরের প্রতি অনাস্থাশীল।
এমতাবস্থায় ১৯১৫ সালে রাজমােহন দেওয়ান গঠন করেন ‘চাকমা যুবক সমিতি’। এই চাকমা যুবক সমিতি গঠনের ফলে সাধারণ প্রজারা নিজ অধিকার ও চেতনা সম্পর্কে সংগঠিত ও রাজাদের দুর্বলতা সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে উঠে। ফলে সাধারণ প্রজাকুল ও রাজাদের মধ্যে জাতীয় নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্ধ হতে শুরু করে।
১৯১৬ সালে কামিনী মােহন দেওয়ান ও স্নেহ কুমার চাকমার নেতৃত্বে গঠিত হলাে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতি’। এর বেশ কয়েক বছর পরে ১৯২৮ সালে ঘনশ্যাম দেওয়ান গড়ে তুললেন ‘চাকমা যুবক সংঘ’। ঘনশ্যাম দেওয়ান ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে চলে যান। তিনি সেখানে চাকমাদের মধ্যে প্রথম এমএলএ নির্বাচিত হন।
চাকমা রাজ শ্রেণীতে বৃটিশ শাসনের যাঁতাকলে আর প্রজাকুলের সংগঠনের চাপের মুখে নড়েচড়ে উঠতে হয়। ১৯৩৪ সালে ২০ জানুয়ারী যুবরাজ নলিনাক্ষ রায় বাংলার লাট সাহেবের কাছে গিয়ে রাজার অবস্থান ব্যাখ্যা করেন।
তিনি ভারতের জন্য যে শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হচ্ছে তাতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অন্তর্ভুক্ত না করার জন্য অনুরােধ জানান। কেননা অধিবাসীরা এখনাে পশ্চাদপদ। শিক্ষার আলাে নেই। তারা এখনাে ভােটাধিকার প্রদানের উপযুক্ততা অর্জন করেনি। ইত্যাদি কারণ তিনি লাট সাহেবের কাছে তুলে ধরেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে শাসন বহির্ভূত অঞ্চল হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তন সূচিত হয়। নতুন নতুন জাতীয় রাষ্ট্র উদ্ভবের সুযােগ ঘটে। ভারতীয় উপমহাদেশ হতেও বৃটিশ উপনিবেশ গুটিকা নেবার ঘন্টা বেজে উঠে। তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি বিভক্ত ভারতের কোন অংশে যুক্ত হবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়।
১৯৪৬ সালের শেষ ভাগে কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধি দল পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন ধরণের শাসনের উপযােগিতা বা কোন অংশে যুক্ত হবে এ বিষয়ে জানতে রাঙ্গামাটিতে আসেন। এই প্রতিনিধি দলের চেয়ারম্যান ছিলেন এ ভি ঠক্কর। অন্যান্য সদস্যরা হলেন ডা. প্রফুল্ল ঘােষ, জয়পাল সিংহ, রাম কৃষ্ণ বােস, ফুলবান সাহা ও জয়প্রকাশ নারায়ণ। এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে স্নেহ কুমার চাকমাকে কো-অপ্ট করা হয়।
পরে ভারত পাকিস্তান বিভাজনে ভারসাম্য রাখতে মাউন্ট ব্যাটেন তড়িঘড়ি করে বাংলার গভর্ণর স্যার ফেড্রিস বারােসকে তারবার্তা পাঠালেন পার্বত্য চট্টগ্রাম কোন অঞ্চলে অন্তর্ভুক্তি হবে তা জানাতে।
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগােলিক সীমানা, জনসংখ্যাগত তথ্য ফেড্রিস বারােস এর কাছে ছিল না। অন্যদিকে বারােসের রিপাের্ট মাউন্ট ব্যাটেনের কাছে পৌঁছুনাের আগে রেড ক্লিপ রায় গৃহীত হয়ে যায় এবং প্রকাশ করার জন্য সীল মেরে ভাইসরয়ের কাছে পাঠানাে হয়।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে এবং সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশের চক্রান্তে, তৎকালীন ভারতীয় নেতৃবৃন্দের উদাসীনতা এবং সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামের সামন্ত নেতৃত্বের সংকীর্ণ ও অদূরদর্শীতার কারণে শেষ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলাে। সামন্ত ও প্রতিক্রিয়াশীল মহল পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠীর সাথে নিজেদের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সখ্যতা গড়লাে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ তা মেনে নিতে পারেনি। বিশেষ করে যারা শিক্ষিত ও সচেতন ছিল তারা এর ঘাের বিরােধীতায় নামলেন। তাদের একজন হলেন স্নেহ কুমার চাকমা।
১৫ আগস্ট স্নেহ কুমার চাকমা তার দলবল নিয়ে রাঙ্গামাটি ডিসি অফিসের সামনে ভারতীয় ইউনিয়নের পতাকা উত্তোলন করেন। তিনি প্রয়ােজনে পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত করা হলে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যাবেন বলেও মনস্থ করেছিলেন। অন্যদিকে বান্দরবানে বার্মার পতাকা উত্তোলন করা হয়। রাঙ্গামাটিতে ভারতীয় পতাকা ২০ আগষ্ট পর্যন্ত উড্ডীন ছিল। পরে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এসে ভারতীয় পতাকা নামিয়ে ফেলে এবং ২০ আগষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তানী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
পাকিস্তান আমলে শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে চাকমাদের মনে সন্দেহ জন্ম লাভ করে। বিশেষ করে দেশভাগের সময়েও চাকমাদের সাধারণ প্রজাকুলের অংশটি ভারতের সাথে যুক্ত হতে চেয়েছিল। এতে পাকিস্তানী শাসকমহল প্রথম থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ আরম্ভ করে। তাই তারা তড়িঘড়ি করে ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করে। এতে চাকমারা নিশ্চিত হয় যে, পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠী তাদের অস্তিত্ব ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে।
কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হলে স্থায়ীভাবে ২৫৬বর্গ মাইল (১,৪৬,৮৪০ একর) এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। এর মধ্যে ২০ বর্গমাইল সংরক্ষিত বনাঞ্চল এলাকা এবং ২৩৪ বর্গমাইল অশ্রেণীভূক্ত বনাঞ্চল এলাকা। যাতে প্রথম শ্রেণীর ধান্য জমির পরিমাণ ছিল ৫৪,০০০ একর বা মােট ধান্য জমির ৪০% ।
এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে ১৮,০০০ হাজার পরিবার যাদের মধ্যে ১০,০০০ পরিবার ছিল হালচাষী এবং ৮,০০০ পরিবার ছিল জুম চাষী। কাপ্তাই বাঁধের ফলে উদ্বাস্তু হয়েছিল প্রায় ১,০০,০০০ পাহাড়ী যা মােট জন সংখ্যার ৪/১ ভাগ এবং এদের সিংহভাগই হলেন চাকমা। কাপ্তাই বাঁধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত বা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য ৫১ মিলিয়ন ডলার বরাদ্ধ করা হয়েছিল কিন্তু ব্যয় করা হয়েছিল মাত্র ২.৬ মিরিয়ন ডলার। ফলে মাত্র ৩০০০ পরিবার পুনর্বাসন প্রাপ্ত হলেও বঞ্চিত হয় ১৫ হাজার পরিবার। তখন ছাত্র সমাজ জেগে উঠে।
১৯৬১ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে কাচলং এলাকায় ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্থদের যথাযথ পুনর্বাসন প্রদানের জন্য দাবী জানানাে হয় ।
ছাত্র সমাজের সংগঠিত হওয়া ও দাবীনামা আদায়ের প্রক্রিয়াকে রুদ্ধ করার জন্য পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে চট্টগ্রামের পাথরঘাটাস্থ পাহাড়ী ছাত্রাবাস হতে ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী গ্রেপ্তার করে। তবে তাতে তিনি দমে যাননি। ১৯৬৫ সালের ৮ মার্চ শর্ত সাপেক্ষে জেল থেকে মুক্তি লাভের পর ১৯৬৫ সালের ১৮ জুন তারিখে এমএন লারমার নেতৃত্বে ‘পার্বত্য ছাত্র সমিতি’ গঠন করা হয়।
১৯৬৬ সালে এই সমিতির কেন্দ্রীয় অফিস ঢাকা থেকে রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তরিত করা হয়। সে সময়ের প্রগতিশীল ছাত্র সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় চাকমা ছাত্র সমাজ আলােকিত হয়ে উঠে। ফলে ছাত্র সমাজের নেতৃত্ব হতে ভাবী জাতীয় নেতৃত্বের বীজ অংকুরিত হতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জয়লাভ চাকমা রাজার বিপরীতে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিরূপে প্রগতিশীল সংগ্রামের ভিত্তি রচিত হয় ।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে চাকমারা সন্দেহের চূড়ান্ত অর্থে সন্দিহান হয়ে উঠে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে পানছড়ি, ফেনী, খাগড়াছড়িতে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক চাকমাদের উপর হত্যাকান্ড চালানাে হলে স্বাধীন দেশে চাকমারা নিজেদের নিরাপত্তাহীন ভাবতে শুরু করে। এসময়টাতে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ছিলেন পাকিস্তানে। তিনি ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তান চলে যান। ফলে চাকমা জাতি হালহীন অবস্থায় ছিল।
খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে প্রথম হত্যাকান্ডে মেতে উঠলাে মুক্তিবাহিনী, সারা বাংলাদেশে যখন হানাদার বাহিনী বাঙালী জাতির উপর গণহত্যা ধর্ম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনি পার্বত্য চট্টগ্রামেও মুক্তিবাহিনীর একটি উগ্র জাত্যাভিমানী অংশ এই হত্যাকান্ডে মেতে উঠে।
এই হত্যাকান্ডের মূল হোতা ছিলেন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার বাবুল চৌধুরী, খাগড়াছড়ির দোস্ত মােহামম্মদ, ইপিআর এর সুবেদার তাজুল ইসলাম প্রমুখ। এই পানছড়ি হত্যাকান্ডে ১৬৭ জন চাকমা নর-নারীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এর তিন দিন পর ৮ ডিসেম্বর তারিখে দীঘিনালা থানার বড়মেরুং এলাকায় মুক্তিবাহিনীরা ১০ জন নিরীত চাকমাকে গুলী করে হত্যা করে এবং একজনকে আহত করে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই হত্যাকান্ড চলছিল। ১৯ ডিসেম্বর আবার পানছড়ির কালানালে মুক্তিবাহিনীরা হত্যাকান্ড চালায়। এতে ৪৭ জন চাকমাকে গুলী করে হত্যা করে এবং ৪ জনকে আহত করে। এতে চাকমাদের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ও ভীতি জন্ম লাভ করে। পরে ভারতীয় তথা মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর এহেন কার্যকলাপ বন্ধ করার উদ্যোগ নিলে স্বস্থি ফিরে আসে।
এধরণের হত্যাকান্ড ও উস্কানিমূলক কর্মকান্ড কেবলমাত্র খাগড়াছড়িতে সীমাবদ্ধ ছিল না। বান্দরবানে অনুরূপ চরম উস্কানী কতিপয় মুক্তিবাহিনী সদস্য সংঘটিত করে। ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারী বান্দরবান শহরে এক জনসভা আয়ােজন করা হয় ।
এই জনসভা হতে সাতকানিয়া কলেজের জনৈক বাঙালী ছাত্র বােমাং রাজা ও মারমা জাতিকে অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষায় গালিগালাজ করে। এই সময় তিনি মারমা জাতির উদ্দেশ্যে হুমকী দিয়ে বলেন যে, যদি বাঁচতে চাও তবে বাঙালী হয়ে যাও নতুবা বার্মায় চলে যাও। অন্যদিকে কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা তখন বােমাং রাজার ছােট ভাই এসএস প্রূ’র মাথা মুড়িয়ে জুতার মালা গলায় পরিয়ে তাকে বান্দরবান শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘােরায়।
পাঠানদের প্ররােচনায় বিশেষ করে রাঙ্গামাটি জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক এইচটি ইমাম মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করলে হানাদার বাহিনী রাঙ্গামাটি শহর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। তখন কতিপয় চাকমা ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট (ইপিআর)এ যােগ দেয়।
জানা যায় যে, তাদের মূল কাজ ছিল রাস্তাঘাট ও ব্রীজ পাহারা দেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের ১৫ ডিসেম্বরের রাতে ২জন চাকমা ইপিআর সাধারণভাবে রাজাকার নামে পরিচিত তবলছড়ির ব্রীজ পাহারা দিচ্ছিল। সকালে দেশ স্বাধীন। হলে ততক্ষণে পাকিস্তানীরা পলায়ন করেছে।
তবে চাকমা প্রহরীদের তারা কোন খবর নেননি। তাই চাকমা প্রহরীরা তখনাে পাহারায় ছিলেন। পরে জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে মুক্তিবাহিনী যখন মিছিলযােগে সেদিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখনই তাদের বােধােদয় হয় দেশ স্বাধীন হয়েছে। ফলে ঐ দুজন চাকমা রাজাকার মুহুর্তেই মুক্তিবাহিনীর রােষানলে পতিত হয় বলে জানা যায় ।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা কতিপয় মুক্তিবাহিনীর এহেন জাতিবিদ্বেষী কাজে খুবই মর্মাহত হন। এসময়ে ঐতিহাসিক দায়িত্ব কাঁধে নেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।
তিনি তখন আর চাকমাদের সংগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পতাকাতলে সমবেত হয় জাতি, ধর্ম শ্রেণী নির্বিশেষে পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর জনসাধারণ। একই দিনে পার্বত্য চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানাতে খাগড়াছড়ির মং রাজা মং প্রু সাইনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে।
এই প্রতিনিধি দলে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ কেকে রায়, বিনীতা রায়, প্রাক্তন বােমাং রাজা, সুবিমল দেওয়ান এবং জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা ছিলেন। ১৯৭২ সালের প্রথম গণ পরিষদে পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হওয়ায়। তাতে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সদস্যভূক্ত ছিলেন। এই গণ পরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়। সংবিধান রচনাকালে তিনি বাংলাদেশের জন্য একটি জনগণবান্ধব তথা কৃষক, শ্রমিক, মজুর, নারী, ক্ষুদ্র জাতির অনুকুল শােষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য সংবিধান চেয়েছিলেন।
১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বাংলাদেশ খসড়া সংবিধা প্রণয়ন কমিটির কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে চারটি দাবীনামা সম্বলিত স্মারকলিপি পেশ করেন। দাবীসমূহ হলাে –
১. পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হবে এবং ইহার একটি নিজস্ব আইন পরিষদ থাকবে।
২. উপজাতীয় জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ‘১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি’র অনুরূপ সংবিধি ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে।
৩. উপজাতীয় রাজাদের দফতর সংরক্ষণ করা হবে।
৪. পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয় নিয়ে কোন শাসনতান্ত্রিক সংশােধন বা পরিবর্তন যেন না হয়, এরূপ সংবিধি ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি যােগ্যতার সাথে জাতির হাল ধরেন এবং শুধুমাত্র চাকমা নন অন্যান্য সকল জাতির আস্থা ও সমর্থন লাভ করেন। তার প্রবর্তিত জুম্ম জাতীয়তাবাদ পার্বত্য চট্টগ্রামে সংগ্রামকে চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন সূচনা করে।
চাকমাদের সংগ্রাম এক পর্যায়ে সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হয়। ১৯৭৩ সালের ৭ই জানুয়ারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সামরিক শাখা শান্তিবাহিনী গঠন করা হয় । শান্তিবাহিনী গঠন করার পেছনে বাংলাদেশের মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে উৎসাহিত করেন বলে জানা যায়।
১৯৭৩ সালের মধ্যেই শান্তিবাহিনীর প্রথম শ্রেণীর পরিচালক কর্মীদের সশস্ত্র করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে গজিয়ে উঠা অপরাপর সশস্ত্র গ্রুপগুলােকে শান্তিবাহিনীরা ১৯৭৫ সালের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে দেয় এবং পুরাে অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবর রহমানের পতন হলে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা আত্মগােপন করেন। অন্যদিকে নতুন সরকার সে বছরই জনসংহতি সমিতিকে বেআইনী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। ফলে ১৯৭৬ সালের ১৬ই মে জনসংহতি সমিতি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা কৌশল নিয়ে প্রতিরােধ যুদ্ধ ঘােষণা করে।
জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি ১৯৭৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি’ গঠন করে। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাস সর্বপ্রম ৩৫ (পঁয়ত্রিশ) জন মহিলা সমিতির সদস্যা নিয়মিতভাবে শান্তিবাহিনীতে যােগদান করেন।
এসময়ে আন্দোলন দমণে বাংলাদেশ সরকার নতুন নীতির আশ্রয় নেয়। মােঘল, বৃটিশ শক্তি অর্থনৈতিক অবরােধ করেছিল। পাকিস্তানী শাসকগােষ্টী ভূমি ডুবিয়েছিল । কিন্তু বাংলাদেশের শাসকগােষ্টী ভূমি কেড়ে নেবার নীতি গ্রহণ করে।
তাই ১৯৭৯ সাল হতে ১৯৮১ সালের মধ্যে সমতল এলাকার ৩০,০০০ বাঙালী পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারীভাবে পুনর্বাসন করা হয়। যাদের পরিবার প্রতি ৫একর পাহাড়ী জমি, ৪ একর মিশ্র জমি ও ২.৫ একর ধান্যজমিসহ নগদ ৩৬০০ টাকা দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। এসকল পরিবারকে এখনাে রেশন বরাদ্ধ দেয়া হয় বলে জানা গেছে।
এসকল পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলে রাঙামাটি জেলার কাউখালী থানা, কাপ্তাই হ্রদ এলাকার বরকল, লংগদু, নানিয়ারচর ও বাঘাইছড়ি থানায়। খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি, দীঘিনালা, মাটিরাঙ্গা ও রামগড় থানা এবং ফেনী, মাইনী, চেঙ্গী, পানছড়ি ও লােগাং উপত্যকায়। বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা ও আলীকদম থানায়। এ সমস্ত জায়গার ৮০% চাষযােগ্য ভূমি বেদখল হয়ে যায়।
শুধু তাই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে স্মরণাতীতকাল ধরে চলে আসা স্ব-শাসন ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। অগণতান্ত্রিক ও প্রশাসন নির্ভর শাসন ব্যবস্থা জোরদার হয়ে উঠে। সরকার শান্তিবাহিনীদের মােকাবিলা করার জন্য বাজার, নদীপথ, সড়ক পথ, গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম, চলাচলের চৌমুহনী, উঁচু পাহাড় চূড়া প্রভৃতি সামরিক কৌশলগত জায়গায় সেনাছাউনি ও ক্যাম্প স্থাপন করে।
অন্যদিকে শান্তিবাহিনীও সরকারের উপর চাপ প্রয়ােগ করতে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে। তাদের মধ্যেকার তুমুল সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে থাকে। আবার বাংলাদেশ সরকার অর্থনৈতিক সামরিক নানান দিক হতে এই অঞ্চলের সংগ্রাম নিরসনে উদ্যোগী হয়। পরে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে এরশাদ সরকার আলােচনায় বসে।
এক পর্যায়ে ১৯৮৫ সালের ২১ অক্টোবর এরশাদ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যেকার প্রথম শমান্তি আলােচনা অনুষ্ঠিত হয় । কিন্তু শান্তি আলােচনার পাশাপাশি সশস্ত্র সংঘর্ষ জোরদার হলে সাধারণ মানুষের জীবনে ব্যাপক নিপীড়ন ও নির্যাতন নেমে আসে।
ফলে ১৯৮৬ সালের দিকে প্রায় ৬০,০০০ পাহাড়ি যাদের ৯০ ভাগই চাকমা শরণার্থী হিসেবে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে কোনমতে আশ্রয় লাভ করে। সেখানে তারা প্রত্যহ মানবেতর দিনযাপন করতে থাকে। অনেক পরিবার রােগে শােকে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
অন্যদিকে ১৯৮৮ সালের ৮ মার্চ হিল উইমেন্স ফেডারেশন, ১৯৮৯ সালের ২০ মে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ এবং ১৯৯০ সালে পাহাড়ী গণপরিষদ গঠিত হলে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ধারা সূচিত হয়।
শান্তি আলােচনার প্রাক্কালে ১৯৮৮ সালের ২৫ জানুয়ারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এরশাদ সরকারের নিকট প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ৫ দফা দাবীনামা পেশ করে। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এরশাদ সরকার স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠন করার উদ্যোগ নিলে শান্তি আলােচনার ইতি ঘটে।
এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক একটি কমিটি গঠন করেন। তৎকালীন যােগাযােগ মন্ত্রী কর্ণেল (অব:) অলি আহমেদ এই কমিটির প্রধান ছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি শান্তি আলােচনা ফলপ্রসু করার স্বার্থে ১৯৯২ সালের ১০ আগস্ট একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করে।
এই কমিটি আবার জনসংহতি সমিতির সাথে আলােচনায় বসে। তবে এই শান্তি আলােচনায় বেশ অগ্রগতি সাধিত হলেও ফলাফল ছিল নিষ্ফল। বিএনপি সরকার কালক্ষেপন নীতি অবলম্বন করে তার সময়টা পার করে দেয়।
পরে ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্টিত হয়। তখন সংসদের চীফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি জনসংহতি সমিতির সাথে আলােচনায় বসে। এভাবে তিনটি সরকারের গঠিত কমিটির সাথে ২৪ বার আলােচনার পর ১৯৯৭ সালে একটি চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগ্রামের অবসান ঘটে। বিলুপ্তি ঘটে শান্তিবাহিনীর। সূচিত হয় শান্তি ও উন্নয়নের নতুন দ্বার।
চাকমাদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব- সংঘাত
চাকমা সমাজ একাধারে ঐক্যবদ্ধ, সংগ্রামী অন্যদিকে পারস্পরিক কলহ ও দ্বন্ধ সংঘাতে পরিপূর্ণ। চাকমারা যখন স্থিতিশীল পরিবেশ লাভ করে তখন দ্রুত বিকশিত হবার যােগ্যতা রাখে । আবার সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে সবকিছু চুরমার ও করতে পারে। অতীত হতে দেখা যায় যে, চাকমারা নিজেদের মধ্যে হলে সামান্য কারণেও রক্তারক্তি পর্যন্ত করতে পারে। আবার বিজাতীয়দের গুরুতর অপরাধকেও খুব সহজে ক্ষমা করে দিতে পারে।
আরাকানে রাজ্যে চাকমা রাজার পতন ঘনিয়ে আসার পেছনেও কারণ হিসেবে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছিল প্রধান। মােঘল আমলে রাজশক্তি দুর্বল হবার পেছনেও অভিজাতদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব সংঘাত দায়ী ছিল । বৃটিশ আমলে চাকমা অভিজাতদের দ্বন্দ্ব সংঘাত তীব্র হয়ে উঠে। চাকমা অভিজাতরা পরস্পরকে এক হাত দেখে নিতে কুকী ভাড়া করে প্রতিপক্ষের উপর হত্যাকান্ডে লেলিয়ে দিত।
এপ্রসঙ্গে মুলিমা গােজার ধাবানা গুথির গীরিশ চন্দ্র দেওয়ান ও ত্রিলােকচন্দ্র দেওয়ান এর মধ্যেকার দ্বন্দ্বটি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তারা ছিলেন পরস্পর কলহপ্রিয় এবং প্রতিশােধপরায়ণ। তাদের এই দ্বন্দ্বে ত্রিলােক চন্দ্র দেওয়ান কুকীদের হাতে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তখন তার পুত্র নিলচন্দ্র দেওয়ান অতিশয় মর্মাহত হন।
জানা যায় যে, সে দ্বন্দ্বের কারণে কুকীরা বদাচোগী নামে এক রূপবতী চাকমা যুবতীকে হরণ করে নিয়ে যায়। তখন তিনি বৃটিশদের কাছ হতে কুকী দমণের জন্য সহায়তা কামনা করেন।
শুধু তাই নয়, এজন্য তিনি রাণী কালিন্দি ও অভিজাতদের স্বমতে আনার জন্য প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু রাণী তার স্বাধীনতা বিপন্ন হবে মনে করে তাতে অসম্মতি দেন। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে নিলচন্দ্র দেওয়ান রাজসভা ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে কুকীরা কতিপয় ইউরােপিয়ান, বৃটিশ এলাকায় বহু গ্রাম লুটপাট ও হিল ত্রিপুরা এলাকায় নির্যাতন চালালে বাংলার গর্ভণর টমাস হার্বাট লুইনকে কুকী অভিযানে প্রেরণ করে।
রাণী কালিন্দির সময়ে চাকমাদের গােজাগত দ্বন্দ্বও ছিল বলে জানা যায়। বিশেষ করে রাজানগরের বিজ মেলার সময়ে এই দ্বন্দ্ব অধিকভাবে প্রকাশিত হতাে। মদ খেয়ে গােজাধিপতিরা রাস্তা আটকে রাখতাে। তারা নিজেদের গােজার লােকেদের মাথার উপর দিয়ে এবং অন্য গােজার লােকদের পায়ের নীচ দিয়ে যেতে করতাে।
কেহ কেহ বলেন যে, প্রভাবশালী লােকেরা মদ খেয়ে নাকি বলতো বাপের পুত হলে আমার মাথার উপর দিয়ে যাও। আর লাঙের (গােপণ প্রেমিকা) পুত অর্থাৎ জারজ সন্তান হলে আমার পায়ের নীচ দিয়ে যাও। এতেও হরহামেশা মারামারি বাঁধত।
মূলত বিজুমেলায় গােজাগত প্রভাব বিস্তার করার জন্য চাকমারা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াত। একবার মহামুনি বৌদ্ধ মেলায় দল বেঁধে ঘােরার এক পর্যায়ে তােন্যা গােজা ও কুরাকুত্যাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
এতে তােন্যাগােজার লােকেরা ব্যাপক মারধর ও হেনস্থার শিকার হয়। তখন তােন্যাগােজার লােকেরা তাদের অধ্যুষিত ঘাগড়া এলাকায় পুনরায় সংগঠিত হয় এবং কুরাকুত্যাদের আক্রমণের জন্য ওৎ পেতে বসে। অন্যদিকে কুরাকুত্যাদের ঘাগড়া অতিক্রম করে নিজ গ্রামে ফিরতে হতাে।
কুরাকুত্যারা যখন বাড়ী ফিরছিল তখন এক পর্যায়ে অতর্কিতে তােন্যাগােজারা হামলা করে। এতে কুরােকুত্যারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। কেহ কেহ তােন্যাগােজার নাগালের মধ্যে পড়ে যায়। তখন তােন্যাগােজারা ধর ধর বলে। করােকুত্যাদের ধাওয়া করে বসে। এদিকে একজন পালিয়েছে বলে সে এলাকাটি ঘেরাও করা হয়। তখন একজন লােক ধরা পড়ে। ধাওয়াকারী তােন্যা গােজারা জিজ্ঞেস করে- তুমি কি তােন্যাগােজা নাকি কুরােকুত্যা?
লােকটি নিজেকে রক্ষার জন্য তােন্যাগােজা বলে পরিচয় দেয় । তারপর ধাওয়াকারী তােন্যাগােজারা প্রশ্ন করে- এখানে তুমি কি করছ?
‘আগঙল্ল্যে’ বলে সে উত্তর দেয় । উল্লেখ্য যে, চাকমাদের মধ্যে কুরােকুত্যারা বাক্যের শেষে ‘লে’ যােগ করে কথা বলে। তখন তােন্যাগােজারা তাকে কুরােকুত্যা বলে চিহ্নিত করে আর রামধােলাই দিয়ে দেয়।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময়ও আমরা চাকমা রাজা ও অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে মতানৈক্য দেখতে পায়। যার কারণে তারা ঐক্যবদ্ধ থাকতে না পারায় মুসলমানদের পাকিস্তানের সাথে চাকমাদের ভাগ্য জড়িয়ে যায়। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ কালেও চাকমাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব ছিল। তখন রাজা ত্রিদিব রায় ছিলেন নির্বিকার।
অন্যদিকে ছাত্রনেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ছিলেন প্রতিবাদী। এজন্য তিনি কয়েকবছর ধরে জেল জীবন খাটতে বাধ্য হন। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর বিভেদ ও অনৈক্য অভিজাত শ্রেণীর গন্ডি পেরিয়ে শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
একদিকে গড়ে উঠে জনসংহতি সমিতি, অন্যদিকে গড়ে উঠে যুবক সংঘ, সর্বহারা ও ট্রাইবেল পিপলস পার্টি নামে ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন। জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে ছিল প্রগতিশীল অংশ।
যুবক সংঘের পৃষ্ঠপােষকতা ছিল রাজ পরিবার ও প্রতিক্রিয়াশীল অভিজাতদের। সর্বহারায় যােগ দেয় অতি বিপ্লবী অংশ। ফলে একটি জাতীয় নেতৃত্ব সৃষ্টি হতে পারেনি এবং একধরণের মতাদর্শগত ও সশস্ত্র সংগ্রাম দেখা দেয়।
এসময়টাতে চাকমাদের মধ্যে আন্ত: শ্রেণী দ্বন্দ্বটি ‘সংগঠন’ আকারে প্রকাশ পায়। পরে জনসংহতি সমিতি এতে বিজয় লাভ করে। কিন্তু স্থিতিশীল হতে না হতে তাদের মধ্যে আবার শ্রেণীর মধ্যে মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে প্রীতি কুমার চাকমা, ভবতােষ দেওয়ান, ত্রিভঙ্গিল দেওয়ান ও দেবজ্যোতি চাকমা চক্রটি। তাদের এই চ্যালেঞ্জে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছিল বলে জানা যায়। দলটি দুটি উপদলে ভাগ হয়ে যায়। মানবেন্দ্র নারয়ণ লামার উপদলটি নিজেদের মূল দল দাবী করে এবং তারা জনগণের কাছে লাম্বা (দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রামে বিশ্বাসী) নামে পরিচিতি লাভ করে।
অপর দলটি বাদি দল (দ্রুত নিষ্পত্তি) নামে তারা পরিচিতি লাভ করে। উভয়ের মতপার্থক্যের ফলে দ্বন্দ্বটা তীব্র সশস্ত্র সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে অনেক নিরাপরাধ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিসহ ব্যাপক সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। নিম্নে এধরণের একটি হত্যকান্ডের কাহিনী তুলে ধরা হলাে।
দীঘিনালা উপজেলার মাইনী নদীর পাশে একটি চাকমা গ্রাম ছিল । গ্রামের একজন লােক ছিল সবার চাইতে লাম্বা। সচরাচর চাকমা কোন ব্যক্তিকে তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ডাক নাম দেয়। এখানে তার ব্যতিক্রম হলাে না। সে গ্রামের লােকদের কাছে ‘লাম্বা’ নামে পরিচিত ছিল। একদিন রাতের দিকে সে গ্রামের একটি অংশে বাদি দল অবস্থান নেয় এবং চারদিকে পাহারা বসায়। রাতে গ্রামে ফিরছিল লাম্বা। গ্রামে যে বাদি দল অবস্থান করছে সেটা সে জানে না। যখন সে গ্রামে পৌঁছে তখন বাদি দলের পাহারাদার জিজ্ঞেস করে- তুমি কে?
আমি ‘লাম্বা’ বলে সে পরিচয় দেয়।
মুহুর্তে স্বয়ংক্রিয় বন্দুকের বুলেটে তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেল ।
ভ্রাতৃঘাতী এ গৃহযুদ্ধের এক পর্যায়ে মানবেন্দ্র লারমা ১০ নভেম্বর ১৯৮৩ সালে শহীদ হন। তার মৃত্যুর দু’ বছর পর ১৯৮৫ সালের ২৯ এপ্রিল তারিখে বাদি দলটি বাংলাদেশ সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করলে এই ভয়াবহ যুদ্ধের অবসান ঘটে। এরপরও চাকমা সমাজে দ্বন্দ্ব সংঘাত থেমে থাকেনি।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যেকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের নাম দিয়ে আরেকটি অংশ তার বিরােধীতায় অবতীর্ণ হয়। পরে তারা ইউনাইটেড পিপলস ডেমােক্র্যাটিক ফ্রন্ট নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে।
এতে গােটা পার্বত্য অঞ্চলটি চুক্তির পক্ষ বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যেকার মতানৈক্য সশস্ত্র সংঘর্ষ রূপ পরিগ্রহ করে। যা এখনাে নিরসন হয়নি। উল্লেখ যে, বাংলাদেশ স্বাধীনতা উত্তরকালে যদিও জুম্ম জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে চাকমা বাদেও সকল জাতির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম সূচিত হয়েছিল কিন্তু নিজেদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টিতে চাকমাদের নেতৃত্ব ছিল প্রধান এবং অন্য জাতিগােষ্ঠীর নেতৃত্ব ছিল অপ্রধান ।
চাকমাদের বাণিজ্যতে পরাজয়
বাণিজ্য ঐতিহাসিকভাবে চাকমা রাজ্যকে প্রতিকূল অবস্থায় নিয়ে গেছে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দরকষাকষি করার সামর্থ্য না থাকার কারণে রাজনীতি ও সমাজে পরাধীনতা নেমে এসেছে। মােঘল আমলে চাকমা রাজাদের বশ্যতা স্বীকার করার পেছনে এই বাণিজ্য ছিল একটি প্রধান দিক। তাই বাণিজ্য নিয়ে মােঘলদের সাথে চাকমা রাজার বিরােধ ও সংঘর্ষ হয়েছে অনেক বার।
ফতে খাঁ ও বাংলার নবাবের মধ্যেকার যুদ্ধে বাংলার নবাব পরাজিত হলে মােঘলরা চাকমা রাজাকে বাণিজ্য দিক হতে অবরােধ আরােপ করেন। অবরােধের কারণে বাংলার ব্যবসায়ীরা চাকমা রাজ্য হতে কোন কিছু ক্রয় করতে পারতাে না বা বিক্রয় করতে পারতাে না। এতে চাকমা রাজ্যে চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে।
এ কারনে চাকমা রাজাকে কিছু কার্পাস শুল্ক হিসেবে বাংলার নবাবকে প্রদানের ব্যবস্থা নিয়ে চাদিগাঙ এর নিম্নাঞ্চলের ব্যবসায়ীদের সাথে চাকমাদের বিনিময় বা বাজার চালু রাখতে হয়। কিন্তু বাংলার নবাবী ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে চলে গেলে শের ধৌলত খাঁ এতদিন ধরে বাংলার নবাবদের সাথে কার্পাসের বিনিময়ে চলে আসা বাণিজ্যকে অস্বীকার করেন।
অন্যদিকে ইংরেজরা পূর্বের চেয়েও বেশী কার্পাস দাবী করতে থাকেন। এতে তিনি ইংরেজদের কবল হতে মুক্ত হতে সচেষ্ট হন। তখন ইংরেজরা চাকমা রাজার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। ক্যাপ্টেন মি. লেন ও টারমানের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী দু’বার চাকমা রাজ্যে অভিযান চালায় কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। এ যুদ্ধটি কিল্লামরং যুদ্ধ নামে খ্যাত।
১৭৮২ সালে জান বক্স খাঁ পিতৃ সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনিও বৃটিশদের কোন প্রকার শুল্ক দিতে অস্বীকার করেন। ইংরেজরা তখন আবার তার বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। অভিযান ব্যর্থ হলে তারা অর্থনৈতিক অবরােধের নীতি অবলম্বন করেন। ফলে চাকমা রাজ্যের প্রজাকুলের উপর দুর্দশা নেমে আসে।
তখন তাদের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বিক্রয়ের আর কোন উৎস ছিল না। ফলে তখনকার সময়ের নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের তীব্র ঘাটতি দেখা দিল। জনজীবন বিপর্যস্থ হয়ে পড়লাে। তাই চাকমা রাজা ইংরেজদের প্রভাবকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন।
১৭৮৯ সালে জানবক্স খাঁ ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করে গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এর নিকট বার্ষিক ৫০১ মণ কার্পাস দেবার চুক্তিতে আবদ্ধ হন। তখন এই কার্পাস বিক্রয় করে সম পরিমাণ অর্থ কর হিসেবে ইংরেজদের প্রদানের নিয়ম চালু হলাে।
১৭৯৯ সালে কার্পাসের পরিবর্তে টাকায় রাজস্ব বা কর দেয়ার বিধান করা হয়। এ সময় রাজা জান বক্স খাঁ সুখবিলাস হতে রাজধানী রাজানগরে স্থানান্তর করেন। ১৮১২ সালে ধরম বক্স খাঁ রাজপদে আসীন হবার পরে তিনি ইংরেজদের সাথে নতুন করে বােঝাপড়া করেন।
দেখা যায় যে, তখন থেকে চাকমা সমাজে ব্যবসায়ী শ্রেণী গড়ে উঠেনি। চাকমারা কেবল নিজেদের বনজ সম্পদকে সমতল অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রয় করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল দেখা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরেও একসময় সমতল এলাকার লােকেরা ব্যবসাটা দখল করে বসে।
বিশেষ করে বৃটিশ আমলে হিন্দু বাঙালীদের হাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আভ্যন্তরীণ বাজার হস্তগত হয়ে যায়। ব্যবসার মধ্যে দোকান ব্যবসার সিংহভাগ ছিল হিন্দুদের হাতে। তবে নৌপথের মাঝি আর তেজারতি ব্যবসায়ীরা ছিলেন মুসলমান বাঙালী। বৃটিশ আমলে ২০/২২টির বেশী বাজার গড়ে উঠে এবং তাতে বহিরাগতরা ছিল নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়।
বৃটিশ আমলে ডিসিরা সবসময় বহিরাগত বাঙালী ব্যবসায়ীদের স্বার্থে কাজ করতাে। বাঙালি ভাসন্যা বেপারিরা শীতকালে নদীর পাড় ধরে গুণ বা রশি টেনে উজানে নৌকা টেনে নিত। অন্যদিকে নদীর দুধারে তামাক চাষ করত চাকমারা। বাঙালি বেপারিরা যখন তাদের নৌকা টেনে নিয়ে যেত তখন চাকমাদের তামাক ক্ষেত নষ্ট হতাে।
এতে প্রায়ই কথা কাটাকাটি এমনকি মারামারির ঘটনাও ঘটত। বাঙালী বেপারীরা এতে হেনস্থা হত। তখন তারা ডিসির কাছে এই বিষয়ে অভিযােগ করে। ডিসি বাঙালী বেপারিদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এরূপে নিষেধাজ্ঞা জারী করে যে, নদীর দু’ধারে দেড়শত ফুট বা ৫০ গজ এলাকার মধ্যে কেহ কোনরকম চাষ করতে পারবে না।
এতে চাকমারা তামাক চাষে চরম বিপাকে পড়ে যায়। ফলে তাদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠে এবং এর সুরাহা করার জন্য জনৈক প্রভাবশালী ব্যক্তি বাবু চন্দ্র মােহন দেওয়ান যিনি ভূষণছড়া মৌজার হেডম্যান ছিলেন একদিন প্রত্যুষে উঠে রাঙ্গামাটি কোতয়ালী থানার মাঠ কোপাতে আরম্ভ করেন।
তখন থানার দারােগা সাহেব তাকে মাটি কোপাতে বারণ করেন এবং এর কারণ জানতে চান। কিন্তু তিনি কোনরূপে নিবৃত্ত হলেন না এবং কারণ একমাত্র ডিসি সাহেবের কাছে ব্যক্ত করবেন বলে গাে ধরলেন। বিষয় সঙ্গতকারণে ডিসি সাহেবের গােচরীভূত করা হলাে। তারপর ডিসি সাহেব চন্দ্রমােহন দেওয়ানকে তলব করেন। এবার চন্দ্রমােহন দেওয়ান মাটি কোপানোর স্বরূপ ব্যাখ্যা করলেন।
চাকমা সমাজে তামাক পরিবেশন অতিথি আপ্যায়নের একটি প্রধান অঙ্গ । তাই তারা শীতকালে নদী পাড় ও ঢালু জমিতে তামাক চাষ করে। কিন্তু ভাসন্যা বেপারিদের স্বার্থে ডিসি সাহেবের আরােপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে চাকমাদের আর তামাক চাষের ক্ষেত্র নাই। অনুরূপে তিনিও আর তামাক চাষ করতে পারছেন না। অথচ তামাক ছাড়া তার পক্ষে দিনাতিপাত করা কঠিন। তাই তিনি বিরাট থানা মাঠে তামাক চাষের জন্য মাটি কোপাচ্ছেন।
ডিসি সাহেব তার ব্যাখ্যা শােনার পর উপলদ্ধি করলেন যে, তার বা সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে কতিপয় বাঙালি ব্যবসায়ীর স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভবপর হলেও চাকমাদের অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনে প্রভূত অসন্তোষ জমেছে।
তাই তিনি শীঘ্রই সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন। চাকমারা ব্যবসার ক্ষেত্রে পিছিয়ে বা ব্যবসার সাথে পরিচিত না থাকলেও রিজার্ভে পাস নিয়ে গাছ বাঁশ কাটতাে। এছাড়া অশ্রেণীভূক্ত বনাঞ্চলে ইচ্ছেমত গাছ বাঁশ কাটত।
সেগুলাে চালি বেঁধে তারা চন্দ্রঘােনা বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যেত। কিন্তু বর্ষাকালে চেঙ্গী, কাচলং, সুবলং আর রেইংখ্যং এর মিলিত স্রোতে কর্ণফুলী নদীর স্রোত তীব্র হতাে এবং প্রায়ই এসব চালির রশি ছিড়ে ভাটি অঞ্চল পর্যন্ত চলে যেত।
আবার ডিসি সাহেব এরূপে নির্দেশ দিলেন যে, ভাটি অঞ্চলে এরূপ গাছ বা বাঁশের চালি যে ধরবে সে চালির অর্ধেক মূল্য পাবে। তাই দেখা যেত যে, চাকমারা ভাটি অঞ্চলে গিয়ে কদাচিৎ তাদের চালিগুলাে চিহ্নিত ও ফিরে পেলেও ভাটি অঞ্চলের বাঙালিদের অর্ধেক টাকা দিতে হতাে। এছাড়াও শুধু নদীর স্রোত নয় বাঙালিরাও অর্ধেক টাকা পাবার আশায় উজানে এসে চুপিসারে চালিগুলাের রশি কেটে দিত। এতে চাকমারা চরমভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতাে।
এধরণের আর্থিক লােকসানের ঘটনা প্রায়ই সে এলাকার জমিদার কামিনী মােহন দেওয়ানের কাছে প্রায়ই অভিযােগ আকারে আসত। তখন কামিনী মােহন দেওয়ান এর সুরাহা করার জন্য এক ধরণের কুটচালের আশ্রয় নেন বলে জানা যায়। নিম্নে তার কুটচালটি তুলে ধরা হলাে।
তখনকার ডিসি সাহেবের লক্ষ টাকা মূল্যের ‘থাংলিয়ানা’ নামের একটি প্রমােদতরী ছিল । রাঙ্গামাটি কোতয়ালী থানার ঘাটে সেটা বাঁধা থাকতাে। বর্ষাকালে রাত্রিবেলা সেটা একজন লােক উদ্দেশ্যপ্রণােদিত হয়ে কেটে দেয়। ভােরে পুলিশরা দেখে যে, ডিসি সাহেবের বােটটি ঘাটে নেই। রশি ছিড়ে ভেসে গেছে।
প্রমােদতরীটি তাে আর উজানে যায় নাই তাই দারােগা সাহেব সদলবলে ভাটির দিকে প্রমােদতরীটি খুঁজতে গেলেন। এক পর্যায়ে এসে দেখেন যে, কামিনী দেওয়ানের ঘাটে প্রমােদতরীটি বাঁধা অবস্থায় আছে।
তখন দারােগা সাহেব প্রমােদতরীটি নিয়ে আসতে চাইলে কামিনী দেওয়ান অর্ধলক্ষ টাকা দাবী করেন। এর সমর্থনে তিনি বলেন যে, তিনি যেহেতু প্রমােদতরীটি ধরেছেন এবং এভাবে কোন কিছু ধরলে তার অর্ধেক মূল্য যিনি ধরেছেন তিনি পান। কাজেই আমিও অর্ধলক্ষ টাকা পাবাে।
দারােগা সাহেব বিষয়টি ডিসি সাহেবের নজরে আনেন। তখন ডিসি বুঝতে পারেন যে, সরকারের আইনে স্ববিরােধীতা রয়েছে। পরে সেই নির্দেশটি বাতিল করা হয়।
বৃটিশ আমল হতেই শিক্ষা দীক্ষায় হিন্দু বাঙালীরা অগ্রসর থাকায় পার্বত্য চট্টগ্রামে ডিসি কাচারীতে হিন্দু বাঙালীরা অফিসার হিসেবে কিংবা চট্টগ্রামে গভর্ণরের কাচারীতে উকিল হিসেবে বেশী সংখ্যায় ছিল। আর এসকল হিন্দু অফিসাররা সব সময় চাকমাদের ঠকিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করত।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জনৈক ডিসি সাহেব একসময় বরকল এলাকায় সফরে গেলে। প্রচন্ড পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হন। তিনি পেটের ব্যাথায় মৃত্যুযন্ত্রণা ভােগ। করছিলেন। তখন দেওয়ান হেডম্যানেরা স্থানীয় একজন নামকরা চাকমা বৈদ্য ডেকে পাঠান।
বৈদ্য পেটের পীড়ার ওষুধ খাইয়ে ডিসিকে সুস্থ করে তােলেন। এতে ডিসি সাহেব খুবই প্রীত হন। এবং বলেন যে, এ মুহুর্তে তাকে উপকার করার মতাে তার কিছু নেই। তার কাচারীতে যেন বৈদ্য চলে আসেন তা অনুরােধ করেন।
ডিসি সাহেবকে চিকিৎসায় সুস্থ করে তােলা এবং ডিসির আমন্ত্রণ পাওয়ায় . চাকমা বৈদ্যটির কদর বেড়ে গেল। সবাই ডিসি সাহেবের কাছে সে কি চাইতে পারে তার জন্য জনমত চর্চা হতে লাগল। কেহ কেহ মত দিল যে, মৌজা দাবী করবে। কেহ বললাে যে, বন্দুকের লাইসেন্স চাইবে। ইত্যাদি।
একদিন চাকমা বৈদ্যটি ডিসি কাচারীতে এলাে । ডিসি তাকে ডেকে তার রুমে বসালেন। সে রুমে আরও উপস্থিত ছিল এক হিন্দু ডাক্তার।
সে ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে ডিসি বললাে যে, বরকলে প্রচন্ড পেট ব্যাথা হলে ইনি আমায় চিকিৎসা করে সুস্থ করেছেন। আমি তার জন্য কি পুরষ্কারের ব্যবস্থা করতে পারি? বৈদ্য খুব খুশী মনে ডিসির কাছে এসেছিল। এহেন কথা শুনে সে আরও আপুত হলাে।
তখন হিন্দু ডাক্তারটি বৈদ্যের দিকে তাকাল। তারপর তার কাছে জানতে চাইলাে ডিসি সাহেব এর পেট ব্যাথার অসুখের নাম কি এবং তিনি যে ওষুধ দিয়েছেন সেসব ওষুধে কি কি গুণ আছে? হিন্দু ডাক্তারটির প্রশ্নগুলাে ছিল উদ্দেশ্য প্রণােদিত এবং সরল চাকমা বৈদ্যটির কাছে তার যথাযথ উত্তর জানা ছিল না। এতে সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।
তারপর হিন্দু ডাক্তারটি ডিসি সাহেবকে বললাে যে, চাকমা বৈদ্যটির চিকিৎসায় আপনি সৌভাগ্যক্রমে সুস্থ হয়েছেন। কিন্তু আপনি মারাও যেতে পারতেন । কেননা যে ওষুধ আপনাকে দিয়েছে তা সম্পর্কে সে কিছু জানে না। আমি মনে করে তাকে পুরস্কারের বদলে গ্রেফতার করা দরকার এবং তার বৈদ্যগিরি বন্ধ করে দেয়া উচিত।
ডিসি সাহেব এত নির্দয় হতে পারলেন না। তিনি চাকমা বৈদ্যটিকে গ্রেপ্তার না করে বৈদ্যগিরির উপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করে ছেড়ে দিলেন। এভাবে হিন্দু বাঙালিরা সব সময় চাকমা ও ইংরেজদের মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টি করতে বলে জানা যায়। শুধু তাই নয়, হিন্দু ব্যবসায়িরা ক্রমে চাকমাদের উপর শােষকে পরিণত হতাে। চাকমারা যারা গুণতে পারতাে না তাদের নানান ভাবে ঠকাতাে।
চাকমারা যেহেতু উৎপাদক ছিল কিন্তু ব্যবসায়ী ছিল না তাই ব্যবসায়ীদের মর্জিতেই তাদের উৎপাদিত জিনিসপত্রাদির মূল্য নির্ধারিত হত। পাকিস্তান আমলে দোকান ব্যবসাটা বেশীরভাগই হিন্দুদের দখলে ছিল। তবে পাথর, গাছ, বাঁশ ব্যবসাগুলাে বাঙালী মুসলমানদের হাতে ছিল।
নির্মাণ ব্যবসাটি দখলে ছিল পাঠানদের হাতে। পাকিস্তান আমলে কয়েকজন ঠিকাদার ছিলেন। সিনেমার ব্যবসায় নামেন কামিনী মােহন দেওয়ান ও পুত্রগণ। লঞ্চ ব্যবসায় ছিলেন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ও পুরঞ্জয় খীসা। পাকিস্তান আমল শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত মােট ৬৬টি বাজার ছিল।
দু’একজন চাকমা দোকানদার ছিলেন। তাদের মধ্যে চন্দ্রমােহন দেওয়ান এর ‘কদম্ব হােটেল’ নামে একটি হােটেল ব্যবসা। ছিল বলে জানা যায়। কাপ্তাই বাঁধের পরে সেই হােটেলটি রিজার্ভ বাজারে স্থানান্ত রিত করেন। তার হােটেলে সাধারণ চাকমারা খাওয়ার জন্য যেত না বলে জানা যায়।
কারণ হােটেলটি পরিচালনা করতাে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার নিবারণ চন্দ্র দেওয়ান আর অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট বলভদ্র তালুকদার। এর পেছনে কারণ হিসেবে জানা যায় যে, সাধারণ চাকমারা ভাবতাে যে, তাদের হােটেলে খেতে গেলে আগে ঐ দুজন বাবুকে নমস্কার দিতে হবে।
নিজের টাকা দিয়ে খাবাে আবার দোকানদারকে সেলাম করবাে এটাতাে হতে পারে না। বরং হিন্দু হােটেলে। খাবাে সেখানে দোকানদারের নমস্কারও পাবাে। যে কাপ্তাই বাঁধ এ অঞ্চলের অধিবাসীদের বুকের উপর দিয়ে গড়ে তুলে হদ সৃষ্টি করা হয় সে হদে চাকমাদের স্বাভাবিক চলাচল ছিল না। কেননা বহিরাগত বাঙালী মাছ শিকারীরা ৫০/৬০টি নৌকাতে দল বেঁধে মাছ শিকার করতাে। তারা নৌপথগুলােতে জাল ফেলতাে। আর পাহাড়িরা ঐসব পথে চলাচল করলে বিধি নিষেধ করতাে।
বাংলাদেশ আমলে ব্যবসার কিছুটা প্রসার ঘটলেও রাজনৈতিক নিপীড়নের কারনে চাকমা সমাজ বিপর্যস্থ হয়ে পড়ে। গাছ, বাঁশ, মাছ সকল প্রকারের ব্যবসা। বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পরে চাকমারা কিছু কিছু তেজারতি ব্যবসায় এগিয়ে আসে। বিশেষ করে কাঁচামাল সংগ্রহ করে তা শহরাঞ্চলে আনা পর্যন্ত মধ্যবর্তী পর্বটাতে চাকমাদের ব্যবসার প্রসার ঘটেছে। কিছু কিছু চাকমা জাতীয় বাজার পর্যন্ত ব্যবসা করার চেষ্টা করলেও রাজনৈতিক কারনে বারবার মার খায়।
চাকুরীর সুবাদে কিছু কিছু চাকমা আমলা পুঁজির মালিক বনে গেলেও তা ব্যবসা বা উৎপাদনের পথে না গিয়ে ভােগবিলাসের দিকে বেশী ব্যয়িত হয়।
পরিবেষ্টনে চাকমা জাতি
বৃটিশ আমল হতে চাকমারা ভৌগােলিকভাবে পরিবেষ্টিত হতে থাকে। বৃটিশরা পূর্বদিকের লুসাই হিল দখল করে চাকমাদের পূর্বাভিমুখী যাত্রাকে সীমিত করে দেয়। তারপর তিনটি সার্কেল সৃষ্টির পাশাপাশি কয়েকটি সংরক্ষিত বনও সৃষ্টি করেন। এসকল সংরক্ষিত বনগুলাে হলাে- কাচালং, মাইনী, রেইংখ্যং, কাপ্তাই শঙ্খ ও মাতামুহুরী। এছাড়া ছােট ছােট সংরক্ষিত বনের মধ্যে ঠেগা, বরকল ও রাঙ্গামাটি।
বৃটিশ আমলে রিজার্ভ গঠনের পেছনে পরিবেশ বিষয়কে মুখ্য মনে ক হলেও এর অন্তর্নিহিত কারণ হলাে চাকমাদের দমিয়ে রাখা। বলা যায় ভৌগােলিকভাবে চাকমাদের বিচরণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই রিজার্ভ এলাকা সৃষ্টি করা হয়। পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই বাঁধের পর রাঙ্গামাটি রিজার্ভকে কেটে নিতে রাঙ্গামাটি বাজারকে স্থানান্তর করে রিজার্ভ বাজার সৃষ্টি করা হয়। যা বর্তমানেও রিজার্ভ বাজার নামে অভিহিত করা হয়।
পাকিস্তানী আমলে নতুন করে পরিবেষ্টন নীতি গ্রহণ করা হয়। কাপ্তাই বাঁধ ছিল তার প্রথম পদক্ষেপ। এ বাঁধ সৃষ্টির প্রকল্পের নাম ছিল কর্ণফুলী মাল্টি পারপাস হাইডেল প্রজেক্ট। এই প্রকল্পের পেছনে সচরাচর যেসব কারণ কারণ দেখানাে হয় সেগুলাে হলাে-
১. বিদ্যুৎ উৎপাদন করা;
২. ভাটি অঞ্চলে জল সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা;
৩. মৎস্য চাষ করা;
৪. কাঁচামাল সংগ্রহ ও শিল্প স্থাপন করা।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর অন্তর্নিহিত কারণগুলাে অন্যরকম। যথা-
১. চাকমাদের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙে দেয়া।
২. চাকমাদের সামাজিক ভিত্তি ও বন্ধন চুরমার করে দেয়া।
৩. জলপথের পরিধি বাড়িয়ে সম্ভাব্য বিদ্রোহ দমণ করা।
৪. বহি: শত্রুর আক্রমণ হতে প্রতিরক্ষা জোরদার করা।
৫. বনজ সম্পদ পাচার করা;
৬. মৎস্য আহরণের জন্য বিপুল সংখ্যক বহিরাগত লােকের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।
৭. হদ এলাকার বাইরে পুনর্বাসনের নামে অন্যান্য জাতিদের পূর্ব আবাদী।
জায়গাগুলাে চাকমাদের দিয়ে দেয়া তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিদের মধ্যে জাতিগত সংঘাত ও অনৈক্য সৃষ্টি করা।
কাপ্তাই বাঁধ নির্মিত হওয়ার ফলে চাকমারা শুধু পরিবেষ্টিত হলাে না, হারিয়ে ফেললাে তাদের জমিজমা। বাংলাদেশ আমলে সরকার জনসংখ্যা দ্বারা পরিবেষ্টনের নীতি গ্রহণ করে। তার পাশাপাশি সামরিক শক্তি দ্বারাও নিয়ন্ত্রণ জোরদার করে।
এমতাবস্থায় চাকমা জাতি সর্বক্ষেত্রে পরিবেষ্টিত হওয়ায় বর্তমানে অতিশয় অস্তিত্বহীনতার মুখােমুখি হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা হতে উত্তরণে চাকমা। জাতির মধ্যেকার সকল প্রকারের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিরােধ আলাপ আলােচনা এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবােধ রেখে মিটিয়ে ফেলা জরুরী। মনে রাখা প্রয়ােজন যে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, বয়স, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই এই সংঘাত হতে শান্তিপূর্ণ উত্তরণ কামনা করে।
তথ্যসূত্রঃ চাংমাটারা
লেখকঃ তনয় দেওয়ান।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।