ভারতের চাকমা ভাষা ও সাহিত্যের ক্রমবিকাশ: সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
4036
চাকমা লোকসাহিত্য ভান্ডার সমৃদ্ধ বলা যায়। লোকমুখে বংশ পরম্পরায় প্রচারিত অজস্র ছড়া, প্রবাদ, ধাঁ ধাঁ, পালাগান (ব্যালাড), রুপকথা, কিংবদন্তি, উভোগীত প্রভৃতি পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্যে চাকমা লোকসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে ।
চাকমাদের নিজস্ব লিপিমালা রয়েছে। এই লিপিমালার ব্যবহার সীমিত ছিল। দৈনন্দিন চিকিৎসা কাজে তান্ত্রিক ওঝা-বৈদ্যরা, ধর্মীয় কাজে পুরোহিত লুরি বা লাউলিরা চাকমা লিপির ব্যবহার করে আসছেন সুপ্রচীন কাল থেকে।
হাতে লেখা কিছু পুথিঁ, সাহিত্যের উপাদান চাকমা লিপিতে পাওয়া যায়। পালাগান (ব্যালাড), বারমাসী, চৌতিশা উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া ওঝা-বৈদ্যদের বিভিন্ন মন্ত্র বনজ ঔষধপত্রের নাম ইত্যাদি চাকমা লিপিতে লিখে রাখা হত। এমন কি বর্তমান কালের ওঝা-বৈদ্যরাও পরম্পরাগতভাবে চাকমা লিপিতে তাদের চিকিৎসা মন্ত্র ও চিকিৎসা পদ্বতিতে ব্যবহার করে আসছেন।
চাকমাদের ধর্মগ্রন্থ আগর তারা, গোজেন লামা, তাল্লিক শাস্ত্র চাকমা লিপিতে লিখিত হয়েছে। কালিন্দী রাণীর উদ্যেগে ১৮৪৪-১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলা ভাষা ও বাংলা লিপির প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে চাকমা লিপির ব্যবহার হ্রাস পেতে থাকে।
এরপর থেকে শুরু হয় বাংলা ভাষা ও বাংলা লিপিতে চাকমাদের ধর্ম ও সাহিত্য চর্চা। কালিন্দী রানীর উদ্যেগে বর্মী ভাষায় রচিত ‘তাদুয়াং’ বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ বাংলা অনুবাদ জনৈক নীল কমল দাস কর্তৃক বাংলা পদে লেখা ‘বৌদ্ধরঞ্জিকা’ গ্রন্থটি চাকমা সমাজে প্রচলন করা হয়।
এই গ্রন্থটি বৌদ্ধধর্মের প্রথম বাংলা ভাষায় অনুবাদ গ্রন্থ। ড. আশা দাশ ‘বাংলা সাহিত্যে বৌদ্ধধর্ম ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা২৩০) তা উল্লেখ করেছেন। ১৯০০ সাল থেকে শুরু হয় আধুনিক চাকমা সাহিত্য চর্চা।
ত্রিপুরা তথা ভারতে চাকমা ভাষা-সাহিত্য চর্চা, প্রকাশনা ও তার ক্রমবিকাশ:
ত্রিপুরায় চাকমা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা মূলত সূচনা হয় ১৯৬৬-১৯৬৭ সাল থেকে। ওই সময়ে উত্তর ত্রিপুরা জেলার কবি পিযুষ রাউত সম্পাদিত কৈলাসহর থেকে প্রকাশিত ‘জোনাকি’ কবিতা বিষয়ক পত্রিকার মাধ্যমে কবি জনেশ চাকমা বাংলা কবিতার মাধ্যমে সাহিত্য আসরে প্রবেশ করেন।
ওই সময়ে তিনি বাংলা লিপিতে চাকমা সাহিত্য আসরে প্রবেশ করেন। ওই সময়ে তিনি বাংলা লিপিতে চাকমা সাহিত্য চর্চার উদ্যেগ গ্রহণ করেন।
তিনি চাকমা ভাষায় সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করার লক্ষ্যে পোস্ট কার্ডে বাংলা লিপিতে চাকমা ভাষায় একটি চিঠি ছাপিয়ে চাকমা কবিতা, গল্প প্রবন্ধ পাঠানোর জন্য চাকমা শিক্ষিত সমাজের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন।
কিন্তু সচেতনতার অভাবে তৎকালীন শিক্ষিত সমাজ এগিয়ে না আসায় শ্রী চাকমার উদ্যেগ সফল হয়নি।
পরবর্তী সময়ে ধর্মধন পন্ডিত রচিত ‘চান্দবী বার মাচ’ ১৯৬৯ সালে অক্ষয় চান চাকমা কর্তৃক বাংলা অনুবাদ কাঞ্চনপুর থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৭০ সালে ফরা কিংকর চাকমার ‘তাবতিংশ স্বর্গ’ নামে বাংলা ভাষায় একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ষাটের দশকের শেষ দিকে ত্রিপুর চন্দ্র সেন ‘গোজেন লামা’ নিজ উদ্যোগে প্রকাশ করেন। প্রকাশিত গোজেন লামায় তিনি উল্লেখ করেছেন মাধব মাষ্টার কর্মীর নিকট-আত্নীয়দের কাছ থেকে এটি সংগ্রহ করেছেন।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, লক্ষীপালা (ব্যালাড) তিনি প্রকাশ করেছেন। দুর্ভাগ্য বশত এই প্রকাশিত লক্ষী পালাটি দেখার বা সংগ্রহ করার সুযোগ হয়নি। গবেষক রমা প্রসাদ দত্ত (পল্টু দা) জীবিত থাকা কালে বলেছিলেন তার পাঠাগারে গিয়ে জেরক্স করে আনার জন্য।
আজ যাবো কাল যাবো করতে করতে আমার আর যাওয়া হয়নি। অথচ আমার কর্মস্থল থেকে দু’কদম মাত্র। এখন তিনি লোকান্তরিত। রমা প্রসাদ পাঠাগার বীর চন্দ্র স্টেট সেণ্ট্রাল লাইব্রেরীতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। সেখানে গিয়েও চেষ্টা করেছি। কিন্তু উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
১৯৭৩ সালে জনেশ চাকমা ‘কবি জনেশ আয়ন চাকমা’ নাম নিয়ে ‘গাকমা সাহিত্য’ নামে সাইক্লোস্টাইলে চার পাতার একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন।
ওই সনেই উত্তর ত্রিপুরা মাছমারার মোহিনী মোহন চাকমার প্রত্যক্ষ মদদ ও তত্ত্বাবধানে তাঁরই বাসভবনে সাহিত্য আসর বসতো। আসরে অংশগ্রহণ করতেন আগ্রহী শিক্ষক যুব সমাজ। আসরে চাকমা কবিতা, গল্প পাঠ করা হতো।
সাথে সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা। সেই সাহিত্য আসর থেকেই ‘ফলক’ মানে একটি চাকমা সাহিত্য প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হল। গঠিত হয় ‘ফলক’ নামে একটি প্রকাশনা কিটি।
উক্ত কমিটির সভাপতি ও যুগ্ম সম্পাদক যথাক্রমে মোহিনী মোহন চাকমা ও সুকুমার চাকমা, নিরঞ্জন চাকমা। সাথে সাথেই চাকমা কবিতা, গল্প সহ বিভিন্ন লেখা পাঠানোর জন্য আবেদনপত্র ছেপে প্রচার করা হয়।
অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ‘ফলক’ সাহিত্য প্রকাশনার আত্নপ্রকাশ ঘটলো। প্রকাশিত ‘ফলক’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রথম কপি নিলামে বিক্রি করা হয়েছিল। সর্বোচ্চ দরদাতা ছিলেন মোহিনী মোহন চাকমা।
এই পত্রিকার প্রায় সব লেখক এখনও উল্লেখযোগ্য স্থানের অধিকারী। যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছেন সুকুমার চাকমা এবং নিরঞ্জন চাকমা।
এ সংখ্যায় যারা লিখেছেন মোহিনী মোহন চাকমা, পুলিন বয়ন চাকমা, রিসি জনেশ আয়ন চাকমা, বহিু শিখা চাকমা, লক্ষী মোহন টডা, শাক্রমনি চাকমা, বিমল কান্তি চাকমা,
সুকুমার চাকমা, অনিল বরন চাকমা, মোহন লাল দেওয়ান, অসিম যায় চাকমা, বিমল জ্যোতি চাকমা, প্রীতি কুসুম চাকমা, ভাগ্য চন্দ্র চাকমা, মনীষা চাকমা, সুজাতা দেওয়ান, হিটলার চাকমা, দুকুল চাকমা, নিরঞ্জন মুলিমা।
১৯৪৭ সালে নিরঞ্জন চাকমার সম্পাদনায় ‘সদক’ নামে ৭টি কবিতা নিয়ে একটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৯৭৫ সালে ‘ফলক’ পত্রিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যা এক সাথে প্রকাশিত হয়।
ওই সনেই সুপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যয়ের লেখা শিক্ষা অধিকার থেকে প্রকাশিত ‘চাকমা’ নামে একটি ছোট আকারের বই প্রকাশিত হয়। মিজোরাম থেকে সত্যপ্রিয় দেওয়ানের সম্পাদনায় ‘সোনারেগা’ নামে একটি কবিতা সংকলন ওই সনেই প্রকাশিত হয়।
১৯৭৬ সালে ঠাকুর বিমল মমেন চাকমার সম্পাদনায় মনুভ্যালি ছৈলেংটা থেকে প্রকাশিত হয় জাঙাল নামে আরও একটি সাহিত্য পত্রিকা।
ওই পত্রিকার প্রথম কপিও নিলামে বিক্রি করা হয়। সর্বোচ্চ দরদাতা ছিলেন মোহিনী মোহন চাকমা। ১৯৭৭ সালে শিলচর প্রবাসী চাকমা ছাত্ররা প্রকাশ করেন ‘চেরাগ’।
সম্পাদনা করেন সুভাষ চাকমা। ১৯৭৯ সালে ‘চেরাগ’ এর দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ১৯৭৮ সালে অরুনাচল প্রদেশ থেকে পূণ্যধন চাকমা ‘চাকমা ইতিহাস’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন।
১৯৮৩ সালে ভুরুম্ভ চাকমা ও ড. দুলাল চৌধুরীর সম্পাদনায় বাংলা অনুবাদ সহ একটি কবিতা সংকলন ‘ক’জলি’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়।
১৯৮৪ সালে নিরঞ্জন চাকমার সম্পাদনায় ত্রিপুরা সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর থেকে ‘ত্রিপুরা সদক’ নামে প্রথমে পাক্ষিক ও পরবর্তী সময়ে মাসিক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে ‘ত্রিপুরা সদক’ পত্রিকার সম্পাদনা করছেন গৌতম লাল চাকমা।
১৯৮৪ সালে প্রমোদ বিকাশ তালুকদার ‘সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনী ও চাকমা ইতিহাস’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন।
১৯৮৫ সালে পুলিন বয়ন চাকমার রোমান লিপিতে লেখা chakma pattam sikke নামে একটি পুস্তিকা ও পরবর্তী সময়ে একটি ‘চাকমা ডিকশনারী ’ প্রকাশ করেন। ১৯৭৬ সালে সত্যপ্রিয় দেওয়ানের লেখা ‘বোধিযান’ ধর্ম বিষয়ক বই মিজোরাম থেকে প্রকাশ করেন।
পরবর্তী বছরে কলকাতা থেকে সি আর চাঙমার ‘চাঙমা কধা ভান্ডাল’ নামে একটি চাকমা-বাংলা অভিধান প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হয় অনিল চাকমার লেখা পঞ্চাঙ্ক নাটক ‘আওজর বিঝু ফিরি আয়’।
১৯৮৭ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় সি আর চাঙমার লেখা ‘যুগ বিবর্তনে চাকমা জাতি’। ১৯৮৮ সালে গৌতম লাল চাকমা, স্বর্ণ কমল চাকমা ও বিমল মমেন চাকমার কবিতা সংকলন ‘আঝা-নিরাঝা’ ১৯৯০ সালে চিত্তরঞ্জন চাকমার লেখা ‘জিংগানী’,
‘যুগ বিবর্তনে চাকমা জাতি মধ্যযুগ’ এবং ১৯৯৩ সালে জীব কল্যাণে গৌতম বুদ্ধের মানবতা প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ সালে করুণালঙ্কার ভিক্ষুর সম্পাদনায় দার্জিলিং থেকে ‘নূয় মোন র’ নামে কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়।
প্রকাশিত হয় অনিল বরন চাকমার ‘আমার সনার জুম্ম দেজর মাদির মা’ নামে কবিতা সংকলন ১৯৯৩ সালে। ১৯৯৪ সালে অনিল চাকমার পঞ্চাঙ্ক নাটক ‘দানবীর বিশ্বান্তর’। মিজোরাম থেকে প্রকাশিত হয় বিকাশ চাকমার আলাম। দিল্লী থেকে করুনালঙ্কার ভিক্ষুর প্রকাশিত হয় আরও একটি কবিতা সংকলন।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৭৮ সালে সারা বাংলা কবি সাহিত্যিক সম্মেলন উপলক্ষে, ভারত ও বাংলাদেশের নির্বাচিত চাকমা কবিদের কবিতা নিয়ে ‘মাসিক সৈনিকের ডায়রী’ পর পর দুটি সংকলন কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়।
সম্পাদনা করেন নির্মল বসাক ও অভিজিৎ ঘোষ। তাঁদের এই উদ্যোগকে শ্রদ্ধা জানাতে হয়। ওই সনেই উত্তর ত্রিপুরা মাছমারা থেকে প্রকাশিত হয় গৌতম লাল চাকমার সম্পাদনায় ‘লুববুঅ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয় বছরে একটি করে চারটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
একই সময়ে আগরতলা থেকে সনানী চাকমার সম্পাদনায় একটি ও ললিত চাকমার সম্পাদনায় ২টি সংখ্যা ‘নিজেনি’ প্রকাশিত হয়।
১৯৭৯ সালে বিমল মমেন চাকমা ও অসীম রায় চাকমার সম্পাদনায় বহুল প্রচারিত ত্রৈমাসিক ‘তলবিচ্’ ধারাবাহিক প্রায় পাঁচ বছর প্রকাশিত হয়।
ওই সনেই প্রীতি কুসুম চাকমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘পিলে ভেঙুর’ এই সাহিত্য পত্রিকাটি মূলত বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের উপর বর্বরোচিত অত্যাচারের প্রতিবাদী কাগজ। এই কাগজ দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
পরবর্তীতে এই ‘পিলে ভেঙুর’ বাংলা ভাষার পর পর আরও দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত হয় নিরঞ্জন চাকমার দীর্ঘ কবিতা ‘যে ধুন্দুগত জ্বলের বুক’। ১৯৮১ সালে ভবেন্তু বিকাশ চাকমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘বিঝু’।
তৃপেন্দু বিকাশ চাকমা ও সমীরন চাকমার সম্পাদনায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ‘রাঙামাত্যা’। রসিক মোহন চাকমার সম্পাদনায় মিজোরাম থেকে সাইক্লোস্টাইল সংবাদ বিষয়ক পত্রিকা মাসিক ‘উজনী’ প্রকাশিত হয়।
শিলচর প্রবাসী চাকমা ছাত্ররা প্রকাশ করেন ‘জুনি’ সম্পাদনায় রসিক মোহন চাকমা। পুলিন বয়ন চাকমার ‘চোখ’ প্রকাশিত হয় মিজোরাম থেকে।
১৯৮২ সালে রিসি জনেশ আয়ন চাকমা ও প্রীতি কুসুম চাকমার যুগ্ম সম্পাদনায় মাছমারা থেকে প্রকাশিত হয় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংবাদ বিষয়ক মাসিক ‘বার্গী’।
বহুল প্রচারিত ও উন্নত মানের কাগজে নির্বাচিত লেখকরাই সুযোগ পেতেন এই কাগজে। এই কাগজে অনেক মূল্যবান সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল। বছর তিনেক প্রকাশিত হয়েছিল এই কাগজ।
১৯৮২ সালে চাকমা সাহিত্যকে আরও একধাপ এগিয়ে দিলেন কবি নির্মল বসাক ও অভিজিৎ ঘোষ। এই দুই কবির সম্পাদনায় ভারত ও বাংলাদেশের নির্বাচিত চাকমা কবিদের কবিতা নিয়ে বাংলা অনুবাদসহ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ‘চাকমা কবিতা সংকলন’।
এই সংকলনে ভূমিকা লেখেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদা শংকর রায়। এই সময়েই আগরতলা থেকে প্রকাশিত হয় ভবন্তু বিকাশ চাকমার সম্পাদনায় ‘তুদুঙ’। পর পর বেশ কিছু সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
অর্জন চাকমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘নাক্সফুল’ দুটি সংখ্যা। ১৯৮৭ সালে এস পি তালকদারের লেখা ‘The Chakma: Life and Struggle’ নিউ দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়।
কলকাতা থেকে শ্রী মানেয়্যে-র চাকমা লিপিতে ‘চাকমা আগরতলা’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালে নিরঞ্জন চাকমার লেখা ‘প্রসঙ্গ চাকমা সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ নামে একটি মূল্যবান বই আগরতলা থেকে প্রকাশিত হয়।
১৯৯৫ সালে চাকমা ভাষায় প্রথম পঞ্চাঙ্ক নাটক, রচনাকাল ১৯৭৪ মোহিনী মোহন চাকমারচিত ‘শেষ বান্ন্যে বেড়া’ প্রকাশিত হয়। এখানে উল্লেখ্য ত্রিপুরা তথা ভারতে সাহিত্য সংস্কৃতি আন্দোলনের ঊষাকালে এই নাটকটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
সত্তর দশকের গোড়ার দিকে চাকমা অধ্যুষিত এলাকায় সফল মঞ্চস্থ করে জন জোয়ারের সহায় করেছিল। যা জন জাগরণ বলা য়ায়। নাটকের এত শক্তি ‘শেষ বেন্ন্যা বেড়া’ তারই প্রমাণ। ত্রিপুরা তথা ভারতে চাকমা সাহিত্য সংস্কৃতির আলোর দিশারী ছিলেন মোহিনী মোহন চাকমা।
১৯৯৪ সালে রবীন্দ্র লাল চাকমা ও জয়ন্ত কুমার চাকমার লেখা ‘বাদালী গোষ্ঠীর বংশ পরিচিত’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য ১৯৯৫ সাল থেকে ত্রিপুরা সরকারের এসসিআরটি-র ল্যাঙ্গুয়েজ সেল থেকে সুমন কুমার চাকমা ও অনিন্দ্যা বর্ণা চাকমার যুগ্ম সম্পাদনায় ষান্মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘সদরক’ প্রকাশিত হয়।
এখনও নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে সম্পাদনা করেছেন অনিন্দ্যা বর্ণ চাকমা। ওই সনেই অনিল চাকমার লেখা ‘সভ্যতার অভিশাপ’ নিরঞ্জন চাকমার কবিতা সংকলন ‘রানি খুয়র আন্দলে জিংকানী’ পরে নিরঞ্জন চাকমার ‘পত্তাপত্তি’ নামে একটি ছড়া সংকলন প্রকাশিত হয়।
মাতৃভাষা দিবসে তৃভঙ্গিল দেওয়ানের সম্পাদনায় ইন্জেব এবং ১৯৯৫ সালে চাকমা সাহিত্য সংস্কৃতি সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশ করেন ‘রেগা’। ১৯৯৭ সনে কুসুম কান্তি চাকমা (সিনিয়র) সম্পদনায় আগরতলা থেকে প্রকাশিত হয় ‘তুম্বাচ’।
উপজাতি গবেষণা কেন্দ্র থেকে নিরঞ্জন চাকমার সংগৃহীত ‘চাঙমা পজ্জন’ নামে একটি লোককথার বই প্রকাশিত হয় এবং একই প্রতিষ্ঠান থেকে পান্নালাল মজুমদারের লেখা ‘The Chakma of Tripura’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়।
১৯৯৯ সালে ধর্মনগর ছাত্র জধার উদ্যোগে ‘বিঝুগুল’ এখনও প্রতি বছর প্রকাশিত হচ্ছে। শ্যামল চাকমার সম্পাদনায় একটি চাকমা গানের সংকলন প্রকাশিত হয়।
২০০১ সালে বিমল মমেন চাকমার ‘রান্যাঘর’ নামে সাইক্লোস্টাইলে চাকমা লিপিতে কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। ২০০০ সালে ভবন্তু বিকাশ চাকমার সম্পাদনায় ‘দেড়গাঙ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকার আত্নপ্রকাশ ঘটে। যা এখনও নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
২০০২ সালে কৈলাসহর ছাত্র জধার উদ্যোগে ‘বড়গাঙ’ প্রকাশনার কাজ নিয়মিত চলছে। ২০০৩ সালে কুসুম কান্তি চাকমা (সিনিয়র) সম্পাদনায় সংবাদ সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা ‘খাদি’ নিয়মিত কয়েক বছর প্রকাশিত হয়।
২০০৬ সালে পেচারতল থেকে প্রকাশিত হয় ‘বড়পড়ং’ সম্পাদনা করেন প্রধীর তালুকদার। ২০০২ সালে গন্ডাছড়া থেকে প্রকাশিত হয় ‘বিঝুফুল’ সম্পাদনা করেন প্রদীপ দেওয়ান। ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় চিত্তিগুল চাকমার সম্পাদনায় একটি কবিতা সংকলন।
২০০৬ সালে নিরঞ্জন চাকমার লেখা ‘অন্য চোখে রাজমালা’ নামে এক তথ্য ভিত্তিক গ্রন্থ। ২০০৭ সালে প্রকাশিত হয় সত্যপ্রিয় দেওয়ানের লেখা ‘দীঘোল রাজ পদেদি’ নামে একটি পঞ্চাঙ্ক নাটক।
এই সনেই দক্ষিণ ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত হয় ‘হিল চাদিগাঙ-র লারমা-র বারমাস’ সম্পাদনা করেন সন্জীব চাকমা। উদয় জ্যোতি চাকমার সম্পাদনা প্রকাশিত হয় ‘তুদুং’। প্রকাশিত হয় যোগমায়া চাকমার ‘হলুদ চিঠি’ কবিতার বই; ও ২০০৮ সালে অপর কাব্যগ্রন্হ ‘হিল্লোবীর জুম্ম কধা’।
২০১০ সালে করুনালঙ্কার ভিক্ষু ও প্রজ্ঞালঙ্কার ভিক্ষুর ‘মনোগীত’ ও ‘ছদক’ প্রকাশিত হয় নিউ দিল্লী থেকে। ওই একই বছরে সঞ্জীব চাকমার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘গাওলী’। অরুন চাকমার কবিতা সংকলন ‘ইদোদর পললাপল্লিত্তুন’।
ভারত ভুষণ চাকমার সম্পাদনায় কাঞ্চনপুর থেকে প্রকাশিত হয় ‘সাঙফুল’। ২০১১ সালে অরুন চাকমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এছাড়া ত্রিপুরা সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর থেকে রবীন্দ্র রচনাবলীর নির্বাচিত কবিতা ও গল্প চাকমা ভাষায় অনুদিত গ্রন্থ।
‘নবভাজিত রবীন্দ্রনামা’ প্রকাশিত হয়। সম্পাদনা করেন নিরঞ্জন চাকমা ও গৌতম লাল চাকমা।
২০১০সালে ‘The partition and the chakma and others writes of sneha kumar chakma-Edited by D.K chakma’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। ২০১২ সালে চাকমা সাহিত্য ‘ফু’ প্রকাশিত হয় কবিতা সংকলন ‘চাবগি’ ও ‘ফু’ নামে সাহিত্য পত্রিকা।
২০১৩ সালে তিমির বরন চাকমার, চাকমা ভাষায় গীতাঞ্জলির অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া ১৯৭৬ সালে সারা ভারত চাকমা সাংস্কৃতিক সম্মেলন উপলক্ষে মাছমারা থেকে প্রকাশিত হয় ‘হুজমাজারা’ নামে একটি পুস্তিকা।
১৯৮৪ সালে বিজন তালুকদারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘উভোগীত’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা।
শ্রীমৎ জ্যোতিপাল মহাথের অরুনাচল প্রদেশ থেকে প্রকাশ করেন ‘চাকমা আদি বাল্য শিকখা’। ‘The chakma voice’ সম্পাদনা করেন স্বাগতম চাকমা। ‘STOP GENOCIDE IN CHT BANGLADESH. By ven. AGGAVAWSA MAHATHERO’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়।
ভুরুং চাকমার সম্পাদনায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ‘বাত্তা পেখ’। ‘Genesis of Chakma Movement 1772-1989, Historical Background By B.K Chudhury’ চিত্রা মল্লিকা চাকমার কবিতা সংকলন ‘পোত্যা পেঘোর র’ নামে কবিতা সংকলন, ‘দুধুক’ সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনায় শান্তি বিকাশ চাকমা।
গন্ডাছড়া থেকে প্রকাশিত হয় ‘ফুল বারেং’। ২০১৪ সালে প্রদীপ চাকমার লেখা ‘চাকমা লিপির উদ্ভানী-র ইতিহাস’ পেচারতল থেকে প্রকাশিত হয়।
সাহিত্য একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় ‘Chakma Folk Nd Modern Litereture, Editor-Nirangan Chakma. Dr. Rupak Debnath’-এর লেখা ‘Tanchangya’ একটি বই এবং ‘Chakma Folktals’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়।
‘রাধামন ধনপুদি পালা’ সম্পদনায় ভবন্ত্ত বিকাশ চাকমা, সংগ্রহে ইন্দুমাধব চাকমা। প্রকাশিত হয় পেচারতল থেকে। ‘ত্রিপুরার চাকমা জাতি এবং অন্যান্য লেখা’ স্নেহ কুমার চাকমা-সম্পাদনায় দীপক কুমার চাকমা। আগর তলা থেকে প্রকাশিত হয়।
‘ইদোনামো’ সম্পাদনায় গৌতমলাল চাকমা ও জীবনানন্দ চাকমা প্রকাশিত হয় আগরতলা থেকে। ‘বরগাং’ ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়। সম্পাদনা করেন জীবন সসু চাকমা। কৈলাসহর ছাত্র জধা কর্তৃক প্রকাশিত হয়।
‘আলাম’ নিরঞ্জন চাকমার সম্পাদনায় এ ডি সি থেকে প্রকাশিত হয় কবিতা সংকলন। ২০১০ সালে কুসুম চাকমার লেখা ‘চাকমা ভাষা সাহিত্য ও লিপি চর্চা’ আগরতলা থেকে প্রকাশিত হয়।
২০১৩ সালে অরুন চাকমা লেখা ‘ইতিহাসের আলোকে চাকমা ভাষা, লিপি ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে’ একটি বই আগরতলা থেকে প্রকাশিত হয়।
এ ছাড়া বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ থেকে ‘গীতাঞ্জলি’ চাকমা ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার পথে। ড. বিন্দু বন্ধন চাকমা লেখা ‘Stateless People in the New Global Ordet’ নামে একটি বই নিউ দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়।
মিজোরাম থেকে ২০১৫ সালে ‘Chakma Literary Journal’ প্রকাশিত হয়। সম্পাদনা করেন জ্যোতিরময় চাকমা। এ ছাড়া ‘Ethonographic study of the chakmas of Tripura, By S.R Maitra’ ২০১২ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়।
১৯৯৪ সালে এস পি তালুকদারের লেখা ‘Chakmg: An Embattled Tribe’ নিউ দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয় এবং এস পি তালুকদারের আর একটি প্রকাশিত বই ‘Chakma: Life and Struggle’ নিউ দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়।
২০১৩ সালে ‘গোমেট’ উদয়পুর ছাত্র জধা কর্তৃক প্রকাশিত হয়, সম্পাদক বিতরণ চাকমা। ‘বিঝু ফুলর ফুল বারেং’ সম্পাদক নন্দ মোহন চাকমা ও সুমন্ সেন চাকমা, গন্ডাছড়া থেকে প্রকাশিত হয়।
১৯৯৯ সাল থেকে ‘বিঝুফুল’ আগরতলা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। ২০০৫ সালে মিজোরাম থেকে প্রকাশিত হয় ‘Chakma Legar Bharta’ বইটি লিখেছেন জয়ন চাকমা। এছাড়া ‘বিঝু নিজেনি’ প্রতি বছর প্রকাশিত হচ্ছে।
এছাড়া ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘চাকমা সামাজিক আইন ও বিচার পদ্ধতি’ সংকলন করেন বিমল মমেন চাকমা, কালাচাঁদ তালুকদার ও শান্তিমনি চাকমা। ‘Chakma Literary Journal’ মিজোরাম থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়।
মুখ্য সম্পাদক জ্যোতিরময় চাকমা। ওই সনেই চিত্র মল্লিকা চাকমার ‘চাঙমা ভাঝে রবীন্দ্র সংগীত’ প্রকাশিত হয়।
পাশাপাশি অরুন চাকমার চাকমা ব্যাকরনের উপর একটি বই প্রকাশিত হয়। ২০১৬ সালে মালবিকা চাকমার কবিতা সংকলন বাংলা ভাষান্তরসহ ‘এক ফুদ শিরোপানি’ প্রকাশিত হয়।
এই সময়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চাকমা লেখক কবিরা হলেন মোহিনী মোহন চাকমা, গোপাল ভুষন চাকমা, অনিল বরন চাকমা, ভাগ্য চন্দ্র চাকমা, সীবলি চাকমা, অসীম রায় চাকমা, জনেশ আয়ন চাকমা, নিরঞ্জন চাকমা, অনিল চাকমা, ভিক্ষ তেজবন্ত,
সুকুমার চাকমা, বিমল মমেন চাকমা, প্রীতি কুসুম চাকমা, বহি শিখা চাকমা, প্রান্তিকা চাকমা, গৌতম লাল চাকমা, যোগমায়া চাকমা, মানকা তালুকদার, বিপুল কুমার চাকমা,
শাক্যমনি চাকমা, হরেন্দ্র চাকমা, চিত্রা মল্লিকা চাকমা, কাকলি চাকমা, কুসুম কান্তি চাকমা, অরুন চাকমা, পঙ্কজ চাকমা, ঝানুদেবী চাকমা, চিত্তিগুল চাকমা,
চাকমা ধুজি যায়, মালবিকা চাকমা, দেবল চাকমা, প্রগতি চাকমা, শান্তিপ্রিয় দেওয়ান, উদয় জ্যোতি চাকমা, বিজয়া চাকমা, আলোক তালুকদার, ত্রিভঙ্গিল দেওয়ান, অরুন কান্তি চাকমা প্রমুখ।
ত্রিপুরায় আধুনিক চাকমা সাহিত্য চর্চায় বিভিন্নবিভাগের মধ্যে কবিতার বিভাগটি সমৃদ্ধ হলেও প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থের সংখ্যা কমই বলা যায়। ত্রিপুরায় চাকমা লেখকদের মধ্যে অন্যতম অগ্রগণ্য কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, গবেষক নিরঞ্জন চাকমা।
সাহ্যিত্যের সব বিভাগেই তার বিচরণ। এছাড়া প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তারই বেশি। কবিদের মধ্যে জনেশ আয়ন চাকমা পাঠক মহলে তার শক্তিমত্তা প্রমাণিত। তার কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল-ভাবের গভীরতা ও চাতুর্যময় বাক্য বিন্যাস।
কবির বক্তব্য পাঠকের মনে নাড়া দেয়। চাকমা অসীম রায়ের প্রচুর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রপত্রিকায়। রোম্যাণ্টিকতা তার কবিতার মূল বিষয়। প্রাচীন দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার তার কবিতায় লক্ষ্য করা যায়।
চাকমা কবিদের মধ্যে বিমল মমেন চাকমা, স্বর্ণ কমল চাকমা এরা প্রত্যেকেই প্রতিশ্রুতিবান কবি। শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে অতি সচেতন। বহি শিখা চাকমা কবিতা এবং গল্প দুটি বিভাগেই তার শক্তি প্রদর্শিত হয়েছে।
কবি প্রীতি কুসুম চাকমার কবিতায় শোনা যায় এক প্রতিবাদী কণ্ঠ। তার কবিতায় সমাজ সচেতনতা ফুটে উঠেছে সার্থকভাবে। ললিত চাকমার কবিতায়ও এই লক্ষণগুলো প্রত্যক্ষ করাযায়।
এছাড়া প্রতিশ্রুতবান কবিদের মধ্যে ভবন্তু বিকাশ চাকমা, যোগমায়া চাকমা, প্রান্তিকা চাকমা, শশাঙ্ক দেওয়ান, নমিতা চাকমা, বিপুল কুমার চাকমা, কুসুম কান্তি চাকমা (সিনিয়র)।
এ যাবত চাকমা সাহিত্যে বিভিন্ন বিষয়ের উপর কম বেশি রচনার নিদর্শন পাওয়া গেলেও চাকমা সাহিত্যের অঙ্গনে এখনও পর্যন্ত কোন উপন্যাস সৃষ্টি হয়নি। এই বিভাগটি অন্তন পূরণ হওয়া দরকার।
নাট্য সাহিত্য:
মধ্যযুগের শেষ ভাগে চাকমাদের মধ্যে কিছু নাট্যমোদির আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায়। বুঝে না বুঝে বাংলা ভাষার যাত্রা পালা মঞ্চস্থ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালে ৭০ দশকের গোড়ার দিকে চাকমা ভাষায় প্রথম নাটক লেখেন মোহিনী মোহন চাকমা।
রাধামন ধনপুদি পালা (ব্যালাড)-কে কেন্দ্র করে এই নাটক। ব্যালাড ধর্মী নাটক হলেও নাট্যকার আধুনিক চিন্তা মননের দিকে জোর দিয়েছেন। এই নাটকটি ১৯৭৪ সালে মঞ্চস্থ করা হয়।
১৯৭৫ সালে আগরতলায় প্রথম বর্ষ নিখিল যাত্রা সম্মেলনে একমাত্র আদিবাসী ভাষায় নাটক সফল মঞ্চায়ন করা হয়। এই নাটকটি চাকমা সমাজে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিল।
পরবর্তী সময়ে বিমল মমেন চাকমা ‘কয়েক ফুদ চোগো পানা’ সামাজিক নাটক লেখেন এবং পরবর্তী সময়ে ‘যমছাবা’ ও ‘আন্ধার পার অইন্যায়’ ঐতিহাসিক নাটক লেখেন। চাকমা অসীম রায় লেখেন ‘ধুল্য ফুরি লো উধে’।
স্বর্ণ কমল চাকমা লেখেন ‘বন হে আঘে দুল কেনা’ অনিল চাকমা দানবীর ‘দানবীর বিশ্বন্তর ও আওজর বিঝু ফিরি আয়’ নাটক লেখেন। মোহিনী মোহন চাকমা আরও লেখেন গৌতম বুদ্ধ, সুদত্তুবী বান, শাক্য সিংহ ইত্যাদি নাটক। বহুল প্রচারিত ‘উন্দুচ্যে বৈদ্য’ নাটকটি উল্লখযোগ্য।
এখানে উল্লেখ্য যে, মিজোরামে সিএডিসি ১৭৪টি স্কুলে ৮ম শ্রেনী পর্যন্ত চাকমা লিপিতে পঠন পাঠন চলছে ত্রিপুরা রাজ্যে ২০০৪ সাল থেকে ৫ম শ্রেনী পর্যন্ত বাংলা লিপিতে পাঠ্যক্রম চালু করা হয়েছে। বর্তমানে চাকমা লিপিতে পাঠ্যক্রম করা হচ্ছে।
২০১০ সালে সাহিত্য একাডেমি কর্তৃক আগরতলায় একটি জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে বিশিষ্ট চাকমা লেখক নিরঞ্জন চাকমাকে সাহিত্য একাডেমি-র ‘ভাষা সম্মান’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
লেখক : গৌতমলাল চাকমা কবি ও প্রাবন্ধিক, ত্রিপুরা, ভারত।
তথ্যসূত্র :
১. চাকমা জাতি-সতীশ চন্দ্র ঘোষ-১৯০৯।
২. শ্রী শ্রী রাজনামা-মাধব চন্দ্র চাকমা কর্মী।
৩. চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত-বিরাজ মোহন দেওয়ান-১৯৬৯।
৪. চাকমা প্রবাদ-ড. দুলাল চৌধুরী-১৯৮০।
৫. চাকমা ভাষা ও সাহিত্য প্রসঙ্গে-নিরঞ্জন চাকমা-১৯৮৯।
৬. চাকমা পরিচিতি-সুগত চাকমা ১৯৭৮।
৭. গোজেনলামা-ত্রিপুর চন্দ্র সেন-১৯৬৯।
৮. বাংলা সাহিত্যে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি-ড. আশা দাশ- ১৯৬৯।
৯. প্রকাশিত বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।