পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা আদিবাসীর জাতিত্ত্ব বিচার ও অভিবাসন
1841
চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগােষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি বৃহৎ জনদল। এদের জীবনাচরণ আদিম সংস্কৃতি চেতনাবাহিত। এই তিনটি জাতিগােষ্ঠীর রয়েছে নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ও জাতিগত ইতিহাস। এরা পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও ভারত এবং মায়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ইতিহাস সাম্প্রতিক কালের হলেও এর অতীত ইতিহাস চমকপ্রদ। এখানে রয়েছে দশ ভাষাভাষী এগারােটি আদিবাসী জনগােষ্ঠী ও বাঙালীগণের বসবাস।
এদের অধিকাংশই বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসিত হয়েছে। বক্ষ্যমান আলােচনা মূলত চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর পরিচয়, জাতিত্ত্ব বিচার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের অভিবাসন ইতিহাস কেন্দ্রিক।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত বরাবর পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে দক্ষিণের মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত যে পার্বত্যভূমি তা পার্বত্য চট্টগ্রাম বা চিটাগাং হিলট্রাক্টস নামে পরিচিত।
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি এ অঞ্চলটি একদা অজ্ঞাত অচেনা জনপদ হিসাবে চিহ্নিত ছিল।
অতীতে বার্মা (মিয়ানমার) আরাকান সহ এ পার্বত্য অঞ্চলকে কিরাতভূমি নামে অভিহিত করা হত।
প্রাচীন কিরাতভূমির ঐতিহাসিক ও ভৌগােলিক সংযােগে এবং কিরাত জাতির নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক সঙ্গমে তিব্বতি বর্মী পরিবারভুক্ত চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাসহ ১১টি ক্ষুদ্র জনগােষ্ঠী বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছে (সুপ্রিয়: ২০০৮: ৫)।
ভূমন্ডলের ২১°২৫” থেকে ২৩°৪৫” উত্তর অক্ষাংশে এবং ৯১°৪৫” থেকে ৯২°৫২” ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে এর অবস্থান। ভেলাম ভান সেন্দেলের বিবরণ থেকে জানা যায়, এ অঞ্চলটি বস্তুত ১৮০০ কিমি বিস্তৃত পশ্চিম বার্মার পর্বতমালার অংশবিশেষ।
বার্মা থেকে বিস্তৃত হয়ে অঞ্চলটি পূর্ব হিমালয়ে চীনের সাথে মিলেছে। একটি সংকীর্ণ অংশ (২৮০X৬০ কিমি) ঢাকার অধীন। উত্তরের শেষাংশ ব্যতীত এই পর্বতমালা ভারতবর্ষ ও বার্মার মধ্যে বিভক্ত (সেন্দেল: ২০০২:৭৮)।
বর্তমানে এটি একটি প্রান্তিক এলাকা (Border Land) যার উত্তরে ত্রিপুরা, পূর্বে মিজোরাম বা দক্ষিণ আরাকান বা রাখাইন স্টেট এবং দক্ষিণ পশ্চিমে কক্সবাজার জেলা অবস্থিত।
ফেণী, কর্ণফুলী, সাঙ্গ ও মাতামুহুরি এ চারটি নদী তাদের প্রবাহিত বালুকণা, টেকণা, ও মাটি দিয়ে সষ্টি করেছে। চারটি উপত্যকা’ (উল্ক গেং মে: ১৯৯৫: ১)। এই উপত্যকাগুলাে এবং পশ্চিমের একই দিকে উঁচিয়ে ওঠা পর্বত শিখরের সঙ্গে এসেছে এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
আদিকালে এ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে কেউ বসবাস করতাে বলে মনে হয় না। ‘শিকারজীবী কিছ আদিম যাযাবর জনগােষ্ঠী মাঝে মাঝে পূর্বদিক থেকে এসে হানা দিয়ে কিছুদিন পর ফিরে যেতাে (অশােক দেওয়ান : ১৯৯১:১০)।
শুরুতে এ জেলার আয়তন ছিল ৬৭৯৬ বর্গমাইল। ১৯০১ সালে এর আয়তন স্থির হয় ৫,০৯৩ বর্গমাইল (সুরেন্দ্রলাল :১৯৯৪:৯)।
বাংলাদেশ আমলে এর আয়তন নির্ধারণ হয় ৫,০৮৯ বর্গমাইল। ইংরেজ অধিকারের পূর্বে এ অঞ্চল অনেকটা No Man’s Land হিসাবে পরিগণিত ছিল। পাশ্ববর্তী কোন রাষ্ট্রশক্তি কোন কালে এ অঞ্চলের উপর সার্বভৌম অধিকার স্থাপন করেনি।
তবে মাইনী উপত্যকা পর্যন্ত জেলার উত্তর প্রান্ত বরাবরই করার প্রভাব বলয়ের মধ্যে অবস্থিত ছিল। বস্তুত গভীর বনাকীর্ণ এই দুর্গম পার্বত্যভূমি আগলে পাঠান, ত্রিপুরা, আরাকান প্রভৃতি রাজশক্তির কাছে অনেকটা উপেক্ষিত ছিল’ (অশােক দেওয়ান: ১৯৯১ : ৯)।
১৭১৫ থেকে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অঞ্চলটি মােগল এবং ১৭৬০ সালের পর ব্রিটিশ শাসনের আওতায় কার্পাস মহল নামে পরিচিত ছিল। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল নিয়ে একটি জেলা স্থাপন করে।
১৮৬৮ সালে জেলা সদর স্থাপিত হয় চন্দ্রঘােনায়। ১৮৬৯ সালে তা রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তরিত হয়। তখন এর মহকুমা ছিল ৩টিযথা সদর, সাঙ্গ ও কক্সবাজার। ১৮৬১ সালে কক্সবাজার এবং ১৮৬৭ সালের ১৪ মার্চ সাঙ্গ মহকমা স্থাপিত হয়।
১৮৭৭ সনের রেঙ্গুনের এক সরকারি গেজেটিয়ার-এ পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিচিতি বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘এটি ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব সীমানার উপরে পর্বত ও অরণ্য সংকল বহদাঞ্চল যেখানে উপজাতীয় বসতি আছে, যারা কোনরূপ কর দেয় না এবং ব্রিটিশ সরকার নির্ভর না হয়ে স্বাধীন ও উর্বরতায় আনন্দে উচ্ছল (রেঙ্গুন গেজেটিয়ার: ১৮৭৯: ৬)।
১৯৮১ সালে বান্দরবান ও ১৯৮৩ সালে খাগড়াছড়ি জেলা স্থাপিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে তিনটি সার্কেল রয়েছে। চাকমা, মং ও বােমাং সার্কেল নামীয় এসব সার্কেল নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনজন সার্কেল চীফ যারা স্থানীয় ভাবে রাজা হিসাবে পরিগণিত।
তিনটি সার্কেল ২২৫ টি মৌজায় বিভক্ত। প্রতিটি মৌজার তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন একজন হেডম্যান। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত হয় একটি মৌজা।
প্রতিটি গ্রাম দেখাশােনা করেন একজন কারবারি। হেডম্যান ও কারবারিগন সার্কেল চীফ বা রাজা কর্তৃক মনােনীত হয়ে থাকেন।
চাকমা- পরিচয় জাতিতু বিচার ও অভিবাসন :
চাকমাগণ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগােষ্ঠী। এখানে বসবাসরত অন্যান্য জনগােষ্ঠীর মত চাকমারাও মঙ্গোলীয় গােষ্ঠীভুক্ত।
এরা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ব্যতীত কক্সবাজার জেলার টেকনাফ সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসবাস করে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামে এদের জনসংখ্যা ২,৫২,৮৫৮ জন। বর্তমানে তা তিন। লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করা যায়।
চাকমা জাতির উৎপত্তি ও বসতি বিস্তারের ইতিহাসকে ঘিরে বহুবিধ মতামত প্রচলিত। বিষয়টি জটিলতা সৃষ্টি করেছে এ কারণে যে প্রত্যেক মতকেই বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে গ্রহণযােগ্য মনে হয়।
পূর্ব পুরুষের সংখ্যার বৈষম্য থেকে বােঝা যায় ব্যাপারটি একটু জটিল। যেমন, রাণী কালিন্দি কেবল আধ ডজন পূর্বপুরুষের কথা জানতেন, (সতীশ :১৯০৯: ১৩৩) অন্য দিকে চাকমা রাজপূণ্যাহ স্মারকগ্রন্থ ২০০৩ সূত্রে জানা যায় রাজা দেবাশীষ রায় চাকমা রাজবংশের ৫১তম রাজা।
চাকমা রাজপরিবারে এ বিশ্বাস সুপ্রতিষ্ঠিত যে তাদের পূর্বপুরুষেরা দক্ষিণ বিহার থেকে এসেছিল এবং সেই পূর্ব পুরুষরা জাতিতে ছিল ক্ষত্রিয়। চাকমাদের উৎপত্তিকে ঘিরে বহু। কিংবদন্তী শােনা যায়। লুইন বলেন ‘চাকমারা মূলত মােগল বা মুসলমান ছিলেন’ (টি, এইচ. লুইন: ১৮৭০ অনুঃ : ৯২)।
‘মঘেরা বলে, ইহারা মােগল বংশধর’ (সতীশ : ১৯০৯ : ৫) এই সম্পর্কিত জনশ্রুতি সমর্থন করে লুইন দেখিয়েছেন, ১৭১৫ থেকে ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জামাল। খা, শেরমুস্ত খাঁ, শের দৌলত খা, জানবকস খা, জব্বর খা, টব্বর খাঁ, ধরম বকস খাঁ প্রমুখ।
যারা চাকমা রাজা হিসাবে অধিষ্ঠিত ছিলেন তারা সবাই খাঁটি পাঠান বংশনাম খাঁ ব্যবহার করেছেন (লুইন : ১৮৭০: অনু, জ্ঞানেন্দু: ৯৩) এ সময় চাকমা মহিলাদের বিবি নামে আখ্যায়িত করা হত।
এখনাে সাধারণ্যে অভিবাদন অনুভবে সালাম এবং আশ্চর্য বা খেদসূচক আবেগে খােদার নাম স্মরণ করা হয়। সম্ভবত চট্টগ্রামে মুসলমান শাসনামলে এই করদ রাজন্যবর্গ এবং সম্ভ্রান্ত পরিবার ‘খাঁ’, ‘বিবি’ প্রভৃতি খেতাব লাভ করেছিল। এদের জড় কামান কালু খাঁ, ফতে খা প্রভৃতি গৌরববাচক খাঁ আখ্যা লাভ করেছিল।
বহুবিধ মুসলমানি আদব কায়দা ও সংস্কার এসময় চাকমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হতে পারে। এসব যুক্তির আলােকে চাকমাদের মােগল উদ্ভূত বলে প্রমাণের চেষ্টা করা হলেও তা সঠিক নয় (সতীশ : ১৯০৯ : ৬) বিশেষতঃ চট্টগ্রামে মােগল অধিকার স্থায়ী হয়েছিল সাড়ে তিনশত বছরের কম।
তারও দেড়শ বছর পূর্ব থেকে চেষ্টা আরম্ভ হয়েছিল মাত্র । পূর্বোক্ত প্রবাদ সত্য হলে চাকমা জাতির উৎপত্তিকাল চারশ বছরের বেশী হতে পারেনা, যা একেবারেই অসম্ভব।
চাকমা ইতিহাস প্রণেতা রাজা ভূবন মােহন রায় চাকমাদের আদিরাজার নাম বলেছেন ‘শাক্য’। চাকমারা নিজেদের কাছে চাংমা নামে পরিচিত।
বর্মী ভাষায় চাং মানে হাতি আর মাং মানে রাজা অর্থাৎ চাংমাং মানে হাতির রাজা। এইভাবে চাংমাং শব্দ থেকে চাংমা শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে।
বিরাজ মােহন দেওয়ান (১৯৬৯) মনে করেন বিভিন্ন কাজে হাতির প্রচুর ব্যবহারের কারণে বর্মী আরাকানিরা চাকমা রাজাকে হাতির রাজা উপাধিতে ভূষিত করেছিল।
চাকমা রাজ মনােগ্রামে হাতির প্রতীক দেখে মনে হয় এটি চাকমা রাজশক্তির প্রতীক’ (বিরাজ: ১৯৬৯, পৃ: ৩৫-৩৬)।
কিংবদন্তী ও প্রচলিত লােক কাহিনীর সূত্রে জানা যায় চাকমাদের আদি নিবাস চম্পক নগর নামক। স্থানে। চাকমা ইতিহাসে যে চম্পা বা চম্পক নগরের কথা বলা আছে সেটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছে।
ভারতের বিহার রাজ্যের গঙ্গা নদীর তীরে একটি চম্পক নগরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে পূর্ব দিকে ত্রিপুরা আসামের প্রধান সড়কের উপরে এখনাে অন্য একটি চম্পক নগর বিদ্যমান।
চম্পক নগরের কাছাকাছি দুরত্বে চাকমাঘাট নামে আরেকটি জায়গার নাম পাওয়া যায়। এছাড়া বার্মা, মালয়, লাওস, ভিয়েতনাম এমনকি থাইল্যান্ডেও চম্পক নগর নামে কিছু স্থানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
চাকমাদের চারণ কবি গেংখুলিদের লােকগানে রাজা বিজয়গিরির দিগ্বিজয়ের কাহিনী জানা যায়।
লুইন তার WILD RACES OF SOUTH FASTERN INDIA (১৮৭০: পৃ: ৯২) গ্রন্থে কিছুটা পরিবর্তিত রূপে লিখলেও কাহিনীটি হচ্ছে- ‘চম্পক নগরের জেষ্ঠ্য রাজপুত্র বিজয়গিরি রাজ্য জয়ের মানসে একদা দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে অক্সাদেশ, রােয়াংদেশ ইত্যাদি এলাকার বহুরাজাকে পরাজিত করে সাপ্রেইকল পর্যন্ত পৌছেন। এবং সেখানে সসৈন্যে বসতি স্থাপন করেন। ফলে চম্পক নগর থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়’।
চাকমা ইতিহাস রচয়িতা অশােক কুমার দেওয়ানের ধারণা, বর্তমান পার্বত্য চট্টগাম সত স্থাপনের আগে চাকমারা ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা বা তৎকালীন কামরূপ অঞ্চলে বেশ কতকাল বসবাস করেছিল।
বর্তমানে আসামের অহমদের সাথে চাকমাদের সাংস্কৃতিক, দৈহিক গঠন, প্রথাগত ও ভাষাগত প্রচুর মিল রয়েছে।
তাঁর মতে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা ছেড়ে একসময় শাক্য বংশের চাকমারা আসাম, মনিপুর হয়ে মধ্যবার্মার পেগু অবধি ছড়িয়ে পড়ে। (অশােক দেওয়ান১৯৯১: ১২) পেগুতে যে চাকমা রাজার অস্তিত্ব ছিল তা বার্মা ইতিহাসে লেখা আছে।
শিয়াটিক সােসাইটির জার্নালে প্রকাশিত A Map of Joa de Barros dated about 1550 A.D, প্রবন্ধে ড. আবদুল করিম উল্লেখ করেন, ‘আনুমানিক ১৫৫০ খ্রীষ্টাব্দে ‘জোয়া ডি রােস’ নামে একজন পর্তুগীজের অংকিত ‘Enseade De Bangalla’ মানচিত্রে কর্ণফুলী নদীর উজানে চাকমা (Chacomas) নামের সন্ধান পাওয়া যায়।
চাকমা জাতির উৎপত্তির প্রথম বিবরণ প্রকাশিত হয় ব্রিটিশ আমলে । স্যার আর্থার প্রেইরির Journal of the Asiatic socity of Bengal, 1841, 10.996.73019 The Hill tracts of Chittagong and dwellers therein 1869, আর, এইচ, এস হাসিনসনের An account of Chittagong Hill Tracts 1906 STOCK IMG1003 Tribesman of the Chittagong Hill Tracts 1957 এর সূত্রে জানা যায় চাকমাদের পূর্বপুরুষ দক্ষিণ বিহার থেকে এসেছিল এবং তাদের পূর্বপুরুষেরা জাতিতে ছিল ক্ষত্রিয়।
লুইন ও ব্যাসানেত মনে করেন, চাকমারা ক্ষত্রিয়জাত (উল্ফ গেং মে : ১৯৯৬ : ৩৩) লােফলার চাকমা জাতির উৎস। সন্ধান করতে গিয়ে একদিকে দৈন্যাক, তঞ্চঙ্গ্যা, বরুয়া ও ত্রিপুরাদের সঙ্গে চাকমাদের সম্পর্ক অনুসন্ধান করেছেন।
অন্যদিকে নৃতত্ত্ব গবেষণার নিয়মে চাকমা জাতিকে বৃহত্তর পটভূমিতে রেখে কাড়, শাক, চাক এবং লুইদের সাথে তাদের তুলনা করেছেন। লােফলারকে শাকরা জানিয়েছেন। চাকমা ও শাক জাতিদ্বয় একই পিতার দুই সন্তান’(উল্ক গেং মে : ১৯৮০: ৩৩)।
ষােড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়কালে চট্টগ্রামের পশ্চাভূমিকে ঘিরে শুরু হয়। ত্রিপুরা, রিয়াং, শাক, দৈন্যাক ও মারমাদের মধ্যে নানা টানাপােড়েন। উপত্যকা থেকে পর্বতে।
প্রত্যাবর্তনকারীদের সঙ্গে শুরু হয় পর্বত থেকে সমতলে আগত উপজাতিদের সংঘাত। কর্ণফুলী উপত্যকার শাকদের বসতি বিস্তারের নতুন পরিকল্পনাই রূপ নেয় চাকমা জাতির বিকাশে।
শাকরা পারস্পরিক সংঘাত এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ সহবাসে উদ্যোগী হয়ে উঠে। এর জন্য দরকার। পড়ে সর্বজনগ্রাহ্য একটি ভাষা ও সংস্কৃতি। বাংলা ও বাঙালী সংস্কৃতি এ ভূমিকা পালন করে।
এইভাবে বাঙালী, ত্রিপুরা ও মারমাদের জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির মিশ্রণে সৃষ্টি হয় চাকমা জাতি ও চাকমা সংস্কৃতি (লােফলার, ১৯৬৯ : ১১০)।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা অভিবাসন :
চাকমা জনবিস্তরণের ইতিহাস চাকমা ইতিহাসের মতােই বিভিন্ন কারণে অস্পষ্ট। ঐতিহাসিক উপাদানের অভাব ও প্রাপ্ত উপাদানের দুর্বলতা এ অস্পষ্টতার অন্যতম কারণ।
লুইন (১৮৭০) আরাকানী ইতিহাস ‘রাজওয়াং’ এবং ‘দেঙ্গ্যাওয়াদি আরেদ ফং এ বর্ণিত কাহিনীকে চাকমা ইতিহাস বলে অনুমান করেছেন।
সতীশ চন্দ্র ঘােষও (১৯০৯) একই ধারণার বশবর্তী হয়ে। কমা ইতিহাস রচনা করেছেন। পরবর্তী কালে রাজা ভুবন মােহন রায় (১৯১৯), মাধব চন্দ্র। মা কমী (১৯৪০), নােয়ারাম চাকমা (১৯৬২), বিরাজ মােহন দেওয়ান (১৯৬৯), প্রাণহরি পার (১৯৮১) প্রমুখ চাকমা ইতিবৃত্তকার লুইন ও সতীশ ঘােষকে সূত্র হিসাবে বিবেচনা অনুরূপ ইতিহাস রচনায় ব্রতী হয়েছেন।
পাশাপাশি ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের গল্পকথা, পৌরণিক “হনা, সভাকবির কাব্য, লােক কাহিনী ও কিংবদন্তী ব্যাপকভাবে চাকমা ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।
ফলে ইতিহাস, পুরাণ ও লােক কাহিনীর দ্বন্দ্ব নানা ধরনের অস্পষ্টতা ও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। সে কারণে কোন কোন গবেষক (অশােক দেওয়ান : ১৯৯১ : ৩) বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘পরিতাপের বিষয় চাকমা জাতির সঠিক এবং গ্রহণযােগ্য একটি ইতিহাস প্রণয়নের প্রয়াস আজ অবধি সফল হয়নি। আমরা এখনাে Mithology কে ইতিহাস বলে বিশ্বাস করি জনশ্রুতিকে অভ্রান্ত ঐতিহাসিক সত্য বলে স্বীকার করি, পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই অপরের দেয়া তত্ত্ব ও তথ্যকে নির্বিচারে মেনে নেই।’‘চাকমারা এই জেলার আদি বাসিন্দা নহে’ (বিরাজ : ১৯৬৯ : ভূমিকা)।
ইতিহাসের বিভিন্ন কাল। পরিক্রমায় বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে তারা খ্রিস্টিয় ষােড়শ শতকের পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসিত হয়েছে। তবে জনশূণ্য এ জনপদে জনবিস্তরণের সূচনালগ্নে তারা এখানে বসতি স্থাপন করতে পরে বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা।
প্রাচীনকাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চল ত্রিপুরা এবং দক্ষিণাঞ্চল বর্মী শাসকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মধ্যবর্তী অঞ্চলটি মােগল শাসনের শেষের দিকেও কোনরূপ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ছিলনা।
এ অঞ্চলে চাকমা বসতি গড়ে উঠলেও তাদের আগমন উত্তরের বিহার থেকে হয়েছে নাকি দক্ষিণের বার্মা, আরাকান থেকে হয়েছে তা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট বিতর্ক।
চাকমাদের আগমন ঘটেছে উত্তর ভারত থেকে এ তত্ত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছেন অশােক কুমার দেওয়ান (১৯৯১)। অন্যদিকে সুপ্রিয় তালুকদার চাকমা সংস্কৃতির আদিরূপ (১৯৮৭) পর্যালােচনা করে প্রমাণের চেষ্টা করেন, চাকমাদের সংস্কৃতি মূলতঃ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার শান বা শ্যাম দেশীয় সংস্কৃতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
তবে Indo Mongoloid জনগােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত লােক হিসাবে চাকমা সংস্কৃতিতে ভারতীয় সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে (সুপ্রিয় : ১৯৮৭: ৫৭)।
অশােক কুমার দেওয়ান (১৯৯১) কিংবদন্তীর সূত্রকে ভিত্তি করে লিখেছেন, শাক্য নামীয় জনৈক রাজা হিমালয়ের পাদদেশে কলাপনগরে তার রাজধানী স্থাপন করেন।
পরে চম্পককলি নামে জনৈক রাজা কলাপ নগর থেকে রাজধানী চম্পক নগরে স্থানান্তর করেন। চাকমাদের আদিরাজা বলে কথিত বিজয়গিরি এই চম্পককলিরই উত্তর পুরুষ।
যুবরাজ থাকাকালে বিজয়গিরি সেনাপতি রাধামােহনকে নিয়ে দক্ষিণে যাত্রা করেন এবং মগদেশ, খ্যাংদেশ, অক্ষাদেশ, কাঞ্চন নগর, কালঞ্জর প্রভৃতি দেশ জয় করে স্বদেশ ফিরে জানতে পারেন ইতমধ্যে তার পিতার মৃত্যু হওয়ায় এবং রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার আশঙ্কায় প্রজাবৃন্দ কনিষ্ঠ রাজপুত্র সমরগিরিকে সিংহাসনে বসিয়েছে।
তখন ক্ষোভে, দুঃখে বিজয়গিরি বিজিত রাজ্য সাপ্রেইকুলে নতুন এক চাকমা রাজ্যের পত্তন করেন। তারই পরবর্তী রাজা চাকমাগণের কীর্তিমান রাজা বলে কথিত ‘সিরিত্তমা’।
এই বংশের মনিজগিরি নামে একজন রাজা পুরাতন রাজধানী থেকে উচ্চব্রহ্মে সরে গিয়ে নিজের নামানুসারে নতুন রাজধানী মাইচাগিরির পত্তন করেন।
তার পরবর্তী রাজারা ব্রহ্মদেশে কালক্রমে প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠেন। ১৩৩৩ সালে আরাকান রাজা মেংদি উচ্চব্রহ্মের চাকমা রাজা ইয়াংজয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত করেন।
তিন রাজপুত্র, রাজকন্য এবং দশ হাজার চাকমা প্রজাসহ রাজাকে বন্দী করে আরাকান নিয়ে আসা হয় পরে তাদেরকে দৈন্যাক আখ্যা দিয়ে আরাকানে বসবাসের অনুমতি দেয়া হয়।
চাকমা রাজ্য ধ্বংস হওয়ায় রাজপুত্র চজুং আরাকান থেকে পালিয়ে গিয়ে ‘মং জামু’ নামে নতুন এক রাজধানী স্থাপন করেন। চজুং এর মৃত্যুর পর তার ভাইপাে মইসাং এর আমলে আরাকানরাজ ‘মং জাম্র’ রাজ্য আক্রমন করে ধ্বংস করে।
ফলে মইসাং কোলাডান নদীর তীরে পালিয়ে আসে। কিন্তু সেখানেও টিকতে পরে তিনি বা তার ছেলে মারেক্যাজ’ ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশে পালিয়ে আসে এবং নবাবের কাছ থেকে সীমান্তের নিকট বার খানি গ্রামের অধিকার লাভ করে সেখানে হীনভাবে বাস করতে থাকে।
কালক্রমে চাকমারা প্রতাপশালী হয়ে উঠে। রাজা তৈনসুরেশ্বরীর পত্ৰ জন। ৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে জনুর নেতৃত্বে পেগু রাজার বিরুদ্ধে অভিযানের সময় ব্যাংকক পর্যন্ত বিজিত হয়।
জনুর মৃত্যুর পর ‘সাত্তয়া রাজা হন যিনি পাগলা রাজা নামে খ্যাত। রণনীর চক্রান্তে পাগলা বাজা নিহত হলে প্রজাগণ অপুত্রক রাজার দৈহিত্র ‘ধাবানাকে রাজা মনােনীত করে।
ধাবানার পরবর্তী রাজারা হলাে যথাক্রমে ধরম্যা, মােগল্যা ও সুভল খাঁ । প্রচলিত ইতিহাসে এর পরবর্তী বাজাই ইংরেজ শাসনামলের কাগজপত্রে উল্লেখিত রাজা জালাল খাঁ যিনি ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে মােগল। সমাট ফররুখ শিয়ারের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে আবদ্ধ হন (অশােক দেওয়ান :১৯৯১: ১৮)।
চাকমাদের ভাষার মধ্যে ইতিহাসের যে সংকেত নিহিত আছে তা থেকে এ সিদ্ধান্তে আসা যায়দ্বাদশ ত্রয়ােদশ শতকে চাকমা জাতির উদ্ভব যুগেই চাকমাদের এবং যে মঙ্গোলীয় দল থেকে তাদের উদ্ভব সেই মূলদলের ভাষা ছিল তকালীন বঙ্গকামরূপী ভাষার উত্তরাঞ্চলীয় কোন উপভাষা।
চাকমা জাতির উদ্ভব স্থলটি যেখানেই হােক, সেখান থেকে সরে আসতে আসতে একসময় তারা সিলেট হয়ে পার্বত্য ত্রিপুরায় উপস্থিত হয় এবং সেখানে তারা যাত্রাবিরতি করে (অশােক দেওয়ান: প্রাগুক্ত)।
চাকমা বসতি বিস্তারের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রচিত হয় ১৫৯৯ সালে নিম্নবর্মার পেগু জয়ের ফলে। এসময় স্থানীয় অধিবাসী তেলেইংদের বহিষ্কার করা হয়। তেলেইংরা চট্টগ্রামের দিকে আশ্রয়ে খুঁজতে থাকলে একই এলাকায় বসবাসরত চাকমারা তাদের অনুসরণ করে।
আরাকানীদের সাম্রাজ্য বিস্তার ও প্রসার, তেলেংদের পলায়ন ও চাকমাদের একটি দলের উত্তর পশ্চিমে আগমন একই সুত্রে গ্রথিত। উল্ক গেং মে এর মতে চাকমাদের উত্তরে সরে আসার কারণ নিম্নবর্মার অধিবাসী তেলেংদের ক্রমবর্ধমান চাপ।
আরেকটি কারণ হতে পারে উত্তরাঞ্চলে মুদের অভিবাসন ও বসতিবিস্তার। চাকমাদের দক্ষিণাঞ্চলে বসতির প্রচেষ্টা অনেকদিন ধরেই চলতে থাকে।
‘১৭৮৭ সালে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা কাছে আরাকানরাজের একটি সতর্কবাণী থেকে বােঝা যায়, ব্রিটিশ অধিকত অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণকারী ব্যক্তিদের বর্মী সরকার ফেরত চাইছে। এই আশ্রয় গ্রহণকারীদের মধ্যে চাকমারাও ছিল।’
মােগল আমলের বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায় অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগে চাকমারা আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে রামুর চাকমাকুল ও তৈনছড়ি নদীর তীরে বসতি স্থাপন করে।
পরে শাহ সুজার অনুসারী মােগল বাহিনী আলীকদমে স্থানান্তরিত হলে চাকমারা জুমিয়া প্রজা হিসাবে তাদের অনুসরণ করে (জামাল উদ্দিন : ২০১১: প্রারম্ভিক কথা)।
আলীকদমে সুজার সাথে আগত সেনাপতি মর্যাদার বেশ কয়েকজন সর্দার চট্টগ্রামের নবাবকে কাপসি কর প্রদান করে জমিদারীর দায়িত্ব পালন করে আসছিল।
কিন্তু ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে জালাল খাঁন চুক্তি অমান্য করলে চট্টগ্রামের নবাবের সাথে তার সম্পর্কে ফাটল ধরে এবং তাকে দমনের উদ্দেশে নবাব বাহিনী হামলা চালিয়ে আলীকদম দুর্গ সমূলে ধ্বংশ করে।
পরাজিত জালাল খাঁ চাকমা অনুসারীদের নিয়ে আরাকান পালিয়ে যায়। এর ১৩ বছর পরে ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে শেরমস্ত খাঁ পুনরায় চট্টগ্রামের নবাবের সাথে কাপাস প্রদানের চুক্তি করে পদুয়া কোদালা এলাকার বন্দোবস্তী লাভ করেন।
পরে আলীকদমে অবস্থানরত জুমিয়া চাকমাদের এখানে নিয়ে আসেন। চাক শেরমস্ত খাঁকে রাজা হিসাবে মান্য করতেন। শেরমস্ত খা’র পক্ষ হয়ে পদুয়া কোদালার জমিদারীর দায়িত্ব পালন করতেন তারই পােষ্যপুত্র শুকদেব রায়।
১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে নবাব মীর কাসিমের কাছ থেকে ইংরেজরা চট্টগ্রামের শাসনভার গ্রহণ করলে চাকমা রাজা হিসাবে জমিদা লাভ করেন শের জব্বার খাঁ।
তার মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র শের দৌলত খাঁ জমিদার তত ব্রিটিশদের অতিরিক্ত করারােপের প্রতিবাদে ১৭৭৭ সালে কর প্রদান বন্ধ করে দেয়।
ঐ বছর তার জামাতা সেনাপতি রনু খা’র সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ শুরু হয়। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে শের দৌলত খাঁ মৃতমুবরণ করলে তার পুত্র জান বক্স খাঁ জমিদারী লাভ করেন। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে সুচারুভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করেও সফলকাম হতে পারেননি।
পরে ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতা গিয়ে গভর্ণর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে আত্মসমর্পন করেন। চুক্তির শর্তানুযায়ী তিনি অরণ্যভুমি পদুয়া-কোদালা ত্যাগ করে সমতলভূমি রাঙ্গুনিয়ার রাজা নগরে পুনরায় জমিদারী প্রতিষ্ঠা করে।
আরাকান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা চাকমারা এভাবেই রামু, আলীকদম, পদুয়া – কোদালা, রাঙ্গুনিয়া হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে অভিবাসিত হয় (জামাল উদ্দিন ; ২০১১: প্রারম্ভিক কথা)।
ত্রিপুরা রাজ্যেও চাকমারা অভিবাসিত হয়েছে। ১৮৯০-৯৮ সালের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে শিকাৰ্য্যা দল ত্রিপুরার কাঞ্চনপুরে অভিবাসিত হয়। নানা অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত হয়ে চলে এসেছে, এমন অনেকেও এখানে আছে।
বিশ শতাব্দির প্রথমদিকে বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্যের গুমেটল, পেচারতল, কাঞ্চনপুর শৈলেংটায় কিছু চাকমা জুম চাষের উব্বর ভূমির অনুসন্ধানে এসে বসবাস শুরু করে। পরবর্তীকালে কেউ কেউ শিকার করতে এসেও এখানে স্থায়ীভাবে রয়ে গেছে।
দেশ বিভাগের সময়ও বেশকিছু চাকমা পরিবার ভারতে চলে এসেছে এবং থেকে গেছে ত্রিপুরাসহ অন্যান্য যায়গায় স্থায়ীভাবে। ১৯৪৭ সালের পরও ত্রিপুরায় চাকমাদের অভিবাসন বন্ধ হয়নি।
তবে ১৯৬০ এরপর কাপ্তাই বাঁধের কারণে উদ্বাস্তু হাজার হাজার চাকমা পরিবার ত্রিপুরা, মিজোরাম, অরুণাচলের নেফায় স্থায়ীভাবে স্থানান্তর হয় (প্রধীর:২০০২:৫)।
রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর চাকমাদের শেষ রাজধানী হলেও সেখানে তারা স্থায়ী বসবাস করেনি। তারা বিভিন্ন সময় দলে দলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ করে রাঙ্গামাটির বিভিন্ন জনপদে প্রবেশ করে বসতি স্থাপন করে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল তখন জঙ্গলাকীর্ণ দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল। নদীগুলাের গতিপথ ধরেই চাকমারা দলবদ্ধ বসতি গড়ে তােলে (নির্মলেন্দু: ২০০৩)। ফলে কর্ণফুলী, চেঙ্গী, কাচালং সুবলং প্রভৃতি নদীর গতিপথের বিভিন্নস্থানে গড়ে উঠে চাকমাদের সর্বশেষ জনবিস্তরণ।
মারমা- পরিচয় জাতিত্ত্ব বিচার ও অভিবাসন :
বাংলাদেশে মারমারা মূলত একটি ক্ষুদ্র জাতিগােষ্ঠী এবং সংখ্যালঘু। প্রকৃতির লীলায় বেড়ে ওঠা অরণ্যচারী মারমারা সহজ সরল জীবনযাপন করে।
হাসি-খুশি, বিনয়ী ও কর্মঠ এই জনগােষ্ঠীর লােকেরা পার্বত্য চট্টগ্রামের আরাে এগারােটি জাতিগােষ্ঠীর সাথে সকল সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে একসাথে মিলেমিশে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে।
প্রান্তীয় পরিস্থিতির কারণে তারা যেমন ভৌগােলিকভাবে বিচ্ছিন্ন তেমনি শিক্ষাদীক্ষা ও আর্থসামাজিক পশ্চাৎপদতা তাদের দিন দিন গ্রাস করছে।
বিশেষ করে ভূমিহীনতার কারণে দারিদ্র্য তাদের নিত্যসঙ্গী’ (মুস্তফা মজিদ : ২০০৪: ১ম ফ্ল্যাপ)। কর্নেল স্যার আর্থার ফেইরী (১৮৪১) তাঁর ‘আরাকানের বিবরণে উল্লেখ করছেন।
খ্যাংথা ও রাখােয়াংথা বা আরাকানীরা একই বংশোদ্ভূত। বর্মীদের মত তাদের জাতীয় নাম ‘মারমা’ পার্বত্য চট্টগ্রামে মার্মা নামে উচ্চারিত হয় (লুইন :১৮৬৯ : ৫০)।
মারমারা পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ নৃগােষ্ঠী। বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় তাদের অধিকাংশের বসবাস। এছাড়া কক্সবাজার, মহেশখালী ও পটুয়াখালীতে তাদের বসতি রয়েছে।
১৯৯০ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী তাদের জনসংখ্যা ১,৪২,৩৩৪ জন হলেও বর্তমানে মারমাদের সংখ্যা দুই লক্ষের কাছাকাছি।
‘পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্মী সংস্কৃতির অনুসারীগণ প্রধানত তিনভাবে পরিচিত। বান্দরবান এলাকায় মারমা, কক্সবাজার এলাকায় রাখাইন এবং খাগড়াছড়ি এলাকায় বা মং সার্কেলে তাদের পরিচয় পে-ইংসা মগ’ (সুরেন্দ্রলাল : ১৯৯৪ : ৭৩)।
দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ার সর্বত্র একদা এই জনগােষ্ঠীর লােকেরা বিচরণ করতাে। তারা প্রাচীন জ্যোতিষ শাস্ত্র, চিকিৎসা শাস্ত্র, তন্ত্রমন্ত্র ও সমর শাস্ত্রে পারদর্শী ছিল। মারমাদের পূর্বপুরুষ কর্তৃক উদ্ভাবিত মঘা ভেষজ ঔষধ এদেশে ইউনানী ও আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসাশাস্ত্র নামে আজও সুপ্রসিদ্ধ।
আবদুল মাবুদ খানের (২০০৭) মতে, কেউ কেউ মারমা নৃগােষ্ঠীকে জুমিয়া মগ ও রাজবংশী মগ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। এই শ্রেণীবিভাগের মধ্যে মারমাদের আসল পরিচয় নেই।
মারমা ছাড়া আববা বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র গােষ্ঠী এ এলাকায় জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
সেজন্য জুমিয়া শব্দটি জাতিবাচক শ্রেণীকরণের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র পরিচয়জ্ঞাপক হতে পারে না।
রাজবংশী মগ হিসাবে বােমাং রাজ পরিবারকে এককভাবে চিহ্নিত করাও যথার্থ নয়। এরা ছাড়া আরাে অনেকের সঙ্গে ম্রাউ (১৪৩০-১৭৮৪) রাজবংশের আত্মীয়তার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলাে।
অপরাপর জনগােষ্ঠীর সাথে ভাষাগত তারতম্য মারমাদের অগ্রগতির অন্যতম অন্তরায়।
‘নিজস্ব জাতিসত্তা সম্পর্কে সচেতন এই জাতির মধ্যে রক্ষণশীল মনােভাব পােষণ; শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বঞ্চনা, অফিস আদালতে প্রচলিত ভাষা, নিয়ম-কানুন, রীতি-নীতি সম্পর্কে অজ্ঞতা তাদের নিজস্ব সমাজকে আরাে পশ্চাৎপদ ও অনগ্রসর করে দিয়েছে’ (মংক্যশােয়েনু নেভী : ২০০৮ : ৮)।
মারমা জনগােষ্ঠী সাধারণত মগ নামে পরিচিত। কিংবদন্তী থেকে জানা যায়, “ভারতের ক্ষত্রিয় রাজবংশ একদা আরাকানে একটি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দী থেকে আরকানের চন্দ্রবংশীয় রাজন্যবর্গ নিজেদেরকে মগধ বংশােদ্ভূত বলে পরিচয় দিতে শুরু করে। কালক্রমে চন্দ্রবংশীয় রাজাদের যশ খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং সমুদয় আরাকানবাসী সাধারণভাবে ‘মগ’ নামে পরিচিতি লাভ করে”। (আবদুল মাবুদ খান :২০০৭; ২০) তাদের মগ নামে আখ্যায়িত করার পেছনে বিবেচনা সমূহ নিম্নরূপ:
গ্রীয়ার্সনের (১৯০৯) মতে, মগ শব্দটি ইন্দোচীন জনগােষ্ঠী থেকে গৃহীত। প্রফেসর ডি, জি, হল বলেন, ‘মগ’ শব্দটি মঙ্গোল শব্দের বিকৃত রূপ (তালাশ : আবদুল হক চৌধুরী, ১৯৮৪ : ২৬) মঙ্গোলীয় জনগােষ্ঠীর সাথে আরাকানী জনগােষ্ঠীর সাদশ্য আছে।
যদুনাথ সরকার তার হিস্ট্রি অব বেঙ্গল ২য় ভাগ গ্রন্থে (পৃ- ৩৮১) বলেন, ফারসী মুগ (অগ্নিউপাসক) শব্দ থেকে মগ শব্দের উৎপত্তি। ‘আরাকানীরা অগ্নি উপাসক বা জড়াে উপাসক। সংস্কৃত মদণ্ড শব্দ থেকে (জলচর পক্ষী/জলদস্যু) মদণ্ড, মগ বা মঘ হয়েছে’ (চৌধুরী পূর্ণচন্দ্র দেববর্মা : ১৯২০: ৩৮)।
১৪৫৯ থেকে ১৫৬১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে মগ রাজত্ব পরিদৃষ্ট হয়। ড. মুহম্মদ এনামুল হক মনে করেন, ‘মগধ থেকে মগ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে’ (তালাশ : আবদুল মাবুদ খান, ২০০৭ ২০)।
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা ও তার সন্নিহিত অঞ্চলে আরকানী ও বর্মী জনগণ মগ নামে অভিহিত। এই নাম বা বিশেষরীতি সুনাম দুর্নাম উভয় চরিত্রে মন্ডিত।
‘মগ’ শব্দের অর্থ দস্যু হওয়ার ধারণা আসলে কৃত্রিম। কিন্তু এই অর্থের বহুল প্রচারের প্রতিক্রিয়ায় আজকাল বর্মী ও আরাকানী বংশােদ্ভূতরা এ নামে পরিচিত হতে কুণ্ঠিত (আতিকুর রহমানঃ ২০০০ : ৩৭)।
‘বােমাং রাজা মং শৈ প্রু চৌধুরী’ ১৯৫০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সরকারের প্রতি মারমাদের মগ আখ্যা দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানান এবং ১৯৫১ সালের আদমশুমারীতে তাদের প্রকৃত জাতি পরিচয় মারমা তালিকাভুক্ত করার অনুরােধ জ্ঞাপন করেন’ (অংসুই মারমা: ১৯৮৪)।
আতিকুর রহমানের (২০০০:৩৭)) মতে, ১৯৬৪ সালে বােমাং চীফ বান্দরবান মহকুমা প্রশাসকের নিকট এক চিঠির মাধ্যমে এ অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন যে, ‘মগ নয়, মারমা নামই তাদের কাছে অভিপ্রেত।’
যদিও মধ্যযুগে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে মগ, ফিরিঙ্গী, পূর্তগীজ জলদস্যুদের হামলা ও অত্যাচারে অতীষ্ঠ ছিলাে এদেশের জনগণ এবং তাদের আক্রমণের বিস্তৃতি ছিলাে বাংলাদেশের অভ্যন্তর পর্যন্ত ‘তথাপি সেই মগ জলদস্যুদের উত্তরসূরি বর্তমান রাখাইন ও মারমারা যে নয় সেই সত্য ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে (মুস্তফা মজিদ: ২০০৪: ভূমিকা)।
পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমা অভিবাসন :
প্রাচীনকাল থেকে আরাকান ও বাংলার একটি ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিল। ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে আরাকান থেকে দফায় দফায় আরাকানী জনগােষ্ঠী বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করে।
এসব অভিবাসীর বৃহৎ অংশই ছিল মারমা জনগােষ্ঠী যাদেরকে সাধারণভাবে মগ নামে অভিহিত করা হত (মুস্তফা মজিদ: ২০০৪)।
বান্দরবানের মারমাদের আগমনের ইতিহাস বিবেচনা করতে গেলে; বেঙ্গল সিক্রেটস এন্ড পােলেটিক্যাল কনসালটেশান (৪ ফেব্রুয়ারি ১৭৯৫), ফ্রান্সিস বুখাননের ভ্রমণ ডাইরী (১৭৯৮), টি এইচ লুইনের ‘এ ফ্লাই অন দি হুইল (১৮৭৯), স্যার আর্থার প্রেইরির ‘হিস্ট্রি অব বার্মা (১৮৮৩), জর্জ গ্ৰীয়ার্সনের “লিঙ্গুইস্টিকস সার্ভে অব ইন্ডিয়া (১৮৯১), জি ই হার্ভের ‘হিস্ট্রি অব বার্মা’ (১৯২৫), বি আর পার্ণ এর ‘কিং বেরিং’ (১৯৩৩), পিয়ের ব্যাসানেতের ‘ট্রাইবস ম্যান অব সিএইচটি (১৯৫৪) ইত্যাদি নথি, প্রতিবেদন, নিবন্ধ ও গ্রন্থের আলােকে তা মূল্যায়ন করতে হবে।
সাম্প্রতিককালে আবদুস সাত্তার, আবদুল মাবুদ খান, আবদুল হক চৌধুরী, মুস্তফা মজিদ, আতিকুর রহমান, জামাল উদ্দিন প্রমুখ লেখক এ বিষয়ে কিছুটা পূর্বতন তথ্য যাচাই এবং কিছুটা নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে একটা মােটামুটি ধারণায় পৌছুতে পেরেছেন যে প্রাচীন আরাকান থেকে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে মারমাদের একটি বৃহৎ দল অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করেছে।
মিলস ও হাসিনসনের মতে মারমাদের চট্টগ্রামে আগমনের ইতিহাস সপ্তদশ শতাব্দীর। মিলসের মতে ‘কক্সবাজার থাকাকালীন সময়ে মারমারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে অভিবাসনের পথ বেছে নেয়।
কিছু মারমা এগিয়ে আসে মূল বাংলার দিকে। অন্য দুটি বেছে নেয় হিলট্রাক্টের পথ (উল্ফ গেং মে : ১৯৯৬ : ২৪)।’ সুগত চাকমার মতে ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমাদের অভিবাসন ঘটে দুটি দলে।
১৭৮৪ সালে বর্মীরাজ বােদাপায়া কর্তৃক আরাকান অধিকৃত হলে মারমাগণ সেখান থেকে দলে দলে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বরিশাল ও পটুয়াখালীতে অভিবাসিত হয়।
আরাকান খেকে শরণার্থী হয়ে আসা প্রথম দলটি বান্দরবান জেলার মাতামুহুরী নদীর উপত্যকায় চলে আসে। পরে সেখান থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড পাহাড় হয়ে চট্টগ্রামের উত্তরাংশ মানিকছড়ির আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় দলটি বান্দরবান জেলার শংখনদীর তীরে বর্তমান ভবান শহরে অভিবাসিত হয় (সুগত চাকমা : ১৯৮৮: ৫)।
১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম ইউ ৪ কোম্পানির অধিকারভুক্ত হলে কোংলা প্রু মারমা জনগােষ্ঠীর দলপতি হিসাবে বান্দরবান আর কর সংগ্রাহক নিযুক্ত হন।
১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সার্কেল গঠিত হলে কোংলা পুর পরিবারের বােমাং খেতাবের স্মারকরূপে ‘বােমাং সার্কেল’ এর নামকরণ করা হয়।
‘১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের প্যালাইংসা নদীর উপত্যকায় বসবাসকারী প্যালাইংসা মগ বা মারমা গােত্রপ্রধান মাচাই দাহবইং (ধাবিং) তার কয়েক হাজার অনুগামীসহ আরাকান ত্যাগ করে চট্টগ্রামে শরণার্থী হয়ে আসে এবং তারা ইংরেজ সরকারকে কার্পাস তুলা কর হিসাবে দেওয়ার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মাতামুহুরী নদীর উপত্যকায় বসতি স্থাপন করে।
১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে মাচাই ভাবিং নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তার ভাইপাে খেদু গােত্র প্রধান হন। তিনি তার অনগামী প্যালেইংসা মগ বা মারমাদের নিয়ে মাতামুহুরী উপত্যকা ত্যাগ করে সীতাকুন্ড পাহাড়ে চলে আসেন এবং সেখানে একটি কাপাস মহল লাভ করেন।
১৮০০ খ্রিস্টাব্দে খেদুর মৃত্যুর পর তার পত্র ক্যঅংজাই সীতাকুন্ড পাহাড়ের প্যালেইংসা মারমাদের গােত্র প্রধান হন। তিনি উত্তর চট্টগ্রামে কুঞ্জধামাই নামে সুপরিচিত হন।
তিনি রাঙ্গুনিয়া থানার পাহাড়তলী গ্রামে মহামুনি বৌদ্ধমন্দির ও দিঘি খনন করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে সীতাকুন্ড পাহাড়ে মারমা পরিবারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮৭ এ।
ক্রমে তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে তারা সীতাকুন্ড পর্বত পরিত্যাগ করে চট্টগ্রামের উত্তর পূর্বসীমান্তবর্তী পার্বত্য এলাকা মানিকছড়িতে অভিবাসিত হয়। (জামাল উদ্দিন, ২০১১: ১৫৭-১৫৮)।
কালক্রমে তারা রামগড়, হেঁয়াকো, মহালছড়ি, মাটিরাঙ্গা, পানছড়ি ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে পড়ে।
মারমা ইতিহাসবেত্তা বি. আর ফার্ন এর মতে ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আরাকানের দুই-তৃতীয়াংশ অধিবাসী স্বদেশ ত্যাগ করে। এবছরই কমপক্ষে দশ হাজারের একটি আরাকানী দল চট্টগ্রামে প্রবেশ করে।
যেসব আরাকানী পূর্ব সময় থেকেই চট্টগ্রামে বসবাস করছিলাে তারা অভিবাসী শরণার্থীদের সহযােগিতা করতে প্রয়াসী হয়।
কিন্তু সীমাহীন খাদ্যাভাবে শরণার্থীরা পর্যদস্ত হয়ে পড়ে। সে সময় গিরগিটি ও বনের লতাপাতা খেয়ে জীবনধারণ ছাড়া তাদের কোন গত্যন্তর ছিল না। (বি. আর ফান : ১৯৩৩)।
এসময় একজন ইউরােপীয় পর্যটক তার ভ্রমণ ডাইরিতে উল্লেখ করেন, তখন (জুন-১৭৯৮) কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে এত বিপুল সংখ্যক আরাকানী মৃত্যুবরণ করেছিল যে তাদের লাশ দিয়ে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত রাস্তাটি ঢেকে দেয়া যেত। (ভেনাম ভেন সেলে : ১৯৯৪ : ৬৮)
এসময় কোম্পানী সরকার শরণার্থীদের খাদ্য ও গৃহনির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ করে এবং আভা রাজ্যে নিয়ােজিত সাবেক কটনীতিক ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সকে এসব ভাগ্য বিড়ম্বিত জনগণকে পনর্বাসনের কাজে তদারক করার জন্য প্রেরণ করে।
১৭৯৯ সালে হিরাম কক্স চট্টগ্রাম পৌছে রিপাের্ট করেন- বিগত ১২ মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার আরাকানী চট্টগ্রামে প্রবেশ করেছে।
পূর্ব থেকে বসবাস করা আরাকানী মিলিয়ে এদের বর্তমান চাল্লশ থেকে পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি (বি.আর ফার্ন : ১৯৩৩)। হিরাম কক্স দশ হাজারের মত আরাকানীকে কক্সবাজারের কাছে পিঠে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন।
কিন্তু এর আগে ২০ থেকে ৩০ হাজার আরাকানী বনে জংগলে ছড়িয়ে পড়ে। কালক্রমে তারা বান্দরবানসহ কাছাকাছি অন্যান্য এলাকায় জনবসতি গড়ে তােলে।
‘মারমাদের এই অভিবাসনের বিষয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোনরূপ আপত্তি উত্থাপন করেনি কিছুটা মানবিক বিবেচনায় এবং কিছুটা এ কারণে যে জনবিরল এ জেলায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি কোম্পানীর অভিপ্রেত ছিল’ (বি, আর, ফার্ন: প্রাগুক্ত)।
পার্বত্য চট্টগ্রামে মারমা অভিবাসনের বিপক্ষে অন্য কোনরূপ ভিন্নমত না থাকায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, এখানে বসবাসরত মারমারা বান্দরবানের আদি বাসিন্দা নয়। কয়েকশ বছর পূর্ব থেকে তারা চট্টগ্রাম ও এর পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়গুলােতে বসবাস করে আসছিল।
১৭৮৪ সালে বর্মী রাজা কর্তৃক প্রাচীন আরাকান আক্রান্ত হলে মারমারা আরাকান ছেড়ে টেকনাফ, কক্সবাজার, রামু, উখিয়া ও মহেশখালী এলাকায় প্রবেশ করে। ঔপনিবেশিক শাসকরা অভিবাসীদের প্রতি বিদ্বেষ পােষণ না করে তাদের সাদরে গ্রহণ করায় তারা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আগ্রহী হয়ে পড়ে।
কালক্রমে তারা তাদের সর্দার কোং এর নেতৃত্বে শঙ্খনদীর তীরবর্তী বান্দরবানে বসতি শুরু করে। ধীরে ধীরে অন্যান্য স্থান থেকে মারমারা এখানে এসে জড়াে হতে থাকে। এভাবেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে মারমাদের অভিবাসন সম্পন্ন হয়।
ত্রিপুরা- পরিচয় জাতিত্ব বিচার ও অভিবাসন :
ভারতীয় উপমহাদেশে ত্রিপুরা জনজাতি একটি প্রাচীনতম জনগােষ্ঠী। সুদূর অতীতে উপমহাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূভাগে একটি শক্তিশালী শাসক জাতিরূপে তাদের অধিষ্ঠান ছিলাে।
‘ইতিহাস বিবেচনায় প্রমাণিত হয় ত্রিপুরা নৃগােষ্ঠীর পূর্বপুরুষরা প্রায় ৫ হাজার বছর আগে মঙ্গোলিয়া থেকে মধ্য এশিয়ার তিব্বত ও সাইবেরিয়ার পথ পরিক্রমায় ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে আগমন করেছিলাে’ (জাফর আহমদ খান : ২০০৪ : ৩৬)।
এই বৃহৎ জনগােষ্ঠীর একটি অংশ Boro বা Boro নামে পরিচিত ছিল। এই Boro জাতির একটি অংশ গঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার বিস্তীর্ণ ভূখন্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেছিলাে।
তারাই পরবর্তীকালে ত্রিপুরা নামে পরিচিতি লাভ করে (আজাদ বুলবুল : ২০০৫: ২১)। বাংলাদেশে ত্রিপুরাদের সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক।
এরা পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলে তথা খাগড়াছড়ি জেলায় অধিক সংখ্যক বসবাস করে। এদের কেন্দ্র কুমিল্লার পূর্বদিকে অবস্থিত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। ত্রিপুরারা দাবী করেন যে, তাদের পূর্ব পুরুষরা বর্মী আক্রমণের মুখে মনিপুর থেকে পলায়ন করে এখানে এসেছে।
ভারতীয় সংস্কৃতি দ্বারা এরা বিপুলভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছে। এদের ভাষার নিজস্ব লিপি নেই। তারা অবশ্যই হিন্দু; শিবের পূজক, শ্রেণীবিভক্তি হিন্দুদের মতােই।
কিন্তু বাংলাদেশের ত্রিপুরাদের আদিবাসী, উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগােষ্ঠী হিসাবে পরিগণিত করা হয়। ত্রিপুরারাও নিজেদের উপজাতি মনে করে।
ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি বিষয়ে কয়েকটি ধারণা প্রচলিত আছে;
১. ত্রিপুরা নামধারী তাদের কোন প্রাচীন রাজার নাম থেকে ত্রিপুরা নামের সৃষ্টি।
২. কুমিল্লা (কমলাংক) চট্টগ্রাম (চট্টল) ও ব্রহ্মানক (আরাকান) এ তিন দেশ বা পুর নিয়ে ত্রিপুরা।
৩. তােয় প্রা থেকে ত্রিপুরা (তােয়-জল, নদী, প্রা-সংগমস্থল) অর্থাৎ তারা একদা কোন নদীর সংগমস্থলে বসবাস করতাে এই অর্থে।
৪. তপত রাও (তিপেত-তিব্বত; রাও-কল) অর্থাৎ তিব্বত থেকে আগত। উপজাতীয় গবেষক সলিল রায় (১৯৮৬: ১০৮) মনে করেন এগুলাের কোনটাই গ্রহণযােগ্য নয়।
ত্রিপারা, তিপরা, তিপা, ত্রিপুরী, দেববর্মণ, বর্মণ, রায়বর্মণ, দেব ইত্যাদি নানান উপাধি ক্রবারা তাদের নামের সাথে ব্যবহার করে। বরেন ত্রিপুরা (১৯৮১: ৩৩) মনে করেন, ত্রিপুরা শব্দটি হিন্দুকৃত তিপরা শব্দের সংস্কৃতকরণ (ভুয়া শব্দ)। কারণ ত্রিপুরারা নিজেদের কখনাে ত্রিপুরা বলে না। তারা সাধারণত নিজেদের বরাে (বরােক) বলে থাকে।
বাংলাদেশে বর্তমানে বসবারত ত্রিপুরা জনগােষ্ঠী অতীতে কী নামে পরিচিত ছিল সে সম্পর্কে ভয় তথ্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
তবে সুদূর অতীতকালে ত্রিপুরাগণ ময়মনসিংহ সিলেট কমিল্লা, নােয়াখালী, চট্টগ্রাম ও আরাকান অঞ্চলে রাজ্য বিস্তার করেছিল। পাত্তিকার বিকেল প্রভতি রাজ্য ত্রিপুরাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন।
চৌধুরী পূর্ণচন্দ্র দেববর্মার (১৯২০: ৩২) মতে, ত্রিপুরা রাজ্য অতি পুরাতন। ইহা প্রাচীনকাল হইতে হিল নরপতিগণ কর্তৃক শাসিত হইয়া আসিতেছিল।
পুরাতত্ত্ব আলােচনায়, প্রতীয়মান হয়, আর্যগণ ভারতে আসিবার পূর্ব হইতে এই দেশ পরাক্রান্ত কিরাত নামক এক জাতির বাসস্থান ও কিরাত রাজার শাসনাধীন ছিল। সেজন্য পুরাণে ত্রিপুরাসুরের উল্লেখ করা হইয়াছে।
‘১৪৯০ খ্রিস্টাব্দের পর ত্রিপুরারাজ ধন্যমাণিক্য তার মুদ্রায় ত্রিপুরেন্দ্র উপাধি খােদিত করেন। এ ছিলাে ত্রিপুরা নামের প্রথম পরিচয়।
১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগীজ নাবিক জোয়া ডি বরােস অঙ্কিত দক্ষিণ ভারতের ম্যাপে রেইনাে ডে ত্রিপুরা নামে চিহ্নিত করেন। অতীতের মঙ্গোলীয় মানব গােষ্ঠীর যারা বরােক বা বরাে অথবা কিরাত বা কাম জনগােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, তাদেরই ঐতিহাসিক নামকরণ প্রতিষ্ঠিত হয় ত্রিপুরা নামে’ (আজাদ বুলবুল :২০১০: ২৮)।
বিজয় মাণিক্যের রাজত্বকালে (১৫৩২-১৫৬৪) ভারত পরিভ্রমণকারী পর্যটক র্যালফ ফিচ (Ralph Fitch) লিখেছেন, রেকন (আর্কান<আরাকান<রাখাইন-ত্রিপুরাদের ভাষায় রােসাং) ও রেমি (ব্রাহমিরমিবার্মিহ) রাজ্যের মগরা (বর্তমান মারমা ও রাখাইনরা) ত্রিপুরাদের তুলনায় বেশি।
শক্তিশালী হয়ে প্রাটো গ্রান্ডাে তথা চট্টগ্রাম প্রায়ই দখল করে নিতে (বরেন ত্রিপুরা: ১৯৯৬ : ৬০)। এতে বােঝা যায় চট্টগ্রাম অঞ্চল (তখনকার সময়ের চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম) ত্রিপুরার শাসনাধীন ছিল এবং ত্রিপুরারা বাংলাদেশের ভাটি প্রদেশের বিরাট ভূখন্ডে বসবাস করতাে। তারা ছিল এখানকার আদি অধিবাসী তথা আদিবাসী।
১৫১৩ খ্রিস্টাব্দের গােড়ার দিকে ত্রিপুরারাজ ধন্যমাণিক্য গৌড়ের সুলতান হােসেন শাহ’র আধকার থেকে উত্তর চট্টগ্রাম অধিকার করেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দের। শেষের দিকে হােসেন শাহ পুনরায় চট্টগ্রাম দখল করেন। এতে হােসেন শাহ এর সাথে নাকের বিবাদ বাধে।
১৫১৪-১৫ খ্রিস্টাব্দে ধন্যমাণিক্য নারায়ণ রায়কছম ও রায়চাগের নেতৃত্বে হােসেন শাহ এর বিরুদ্ধে বিশাল বাহিনী প্রেরণ করে অধিকৃত উত্তর চট্টগ্রাম জয় করেন।
পরে আরাকানরাজ অধিকৃত দক্ষিণ চট্টগ্রাম জয় করে ত্রিপুরা বাহিনী আরাকান অবধি হানা দেয়। ১৫১৭ ব্দের প্রথমদিকে হােসেন শাহ এর পুত্র যুবরাজ নশরত শাহ’র নেতৃত্বে গৌড় বাহিনী কর্তৃক ততীয়বার উত্তর চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের শঙ্খ নদী অবধি বিজিত হয়।
১৫১৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের মংরাজ নশরত শাহ’কে বিতাড়িত করে উত্তর চট্টগ্রাম অবধি দল নেয়। ১৫১৯ সালে সুলতান আলাউদ্দিন হােসেন শাহ মৃত্যুবরণ করে।
তাঁর জীবদ্দশায় বা মলত পরে চট্টগ্রাম তিনবার গৌড়ের অধিকারভুক্ত হলেও কোন বারই আরাকান ও ত্রিপরাশক্তির ছিল আক্রমণের ফলে চট্টগ্রামকে এক বছরের অধিককাল দখলে রাখতে পারেন নি (আবদুল হক চৌধুরী: ১৯৮০ : ২৭)।
বাহারিস্তান গাইবির বর্ণনা অনুযায়ী মােগল সুবেদার ইব্রাহিম খাঁ ষােড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে জল ও স্থলপথে ত্রিপুরা আক্রমণ করেন।
মির্জা ইনকানদিয়ার ও মির্জা নূর উদ্দিনের নেতৃত্বে পরিচালিত দুটি স্থল বাহিনীতে ৫,৭০০ অশ্বারােহী ৯,০০০ গােলন্দাজ ও ১০০টি রণহস্তী ছিল। এছাড়া বাহদুর খাঁর নেতৃত্বে ছিল ৩,০০০ রণতরী সমন্বিত বিশাল বাহিনী।
মােগলদের এই বিপুল রণসজ্জাই প্রমাণ করে সেকালে ত্রিপুরারাজ্যের সীমা বৃহৎ ছিল অন্তত তিন হাজার রণতরী একসাথে এগিয়ে যাওয়ার মতাে অঞ্চল ত্রিপুরা রাজ্যভুক্ত ছিল।
সেসময় ত্রিপুরারাজ্যের সীমা ছিল সম্পূর্ণ চট্টগ্রাম বিভাগ, ঢাকা বিভাগের পূর্বাঞ্চল, বরিশালের প্রায় অঞ্চল, বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্য, কাছাড়, গােহাটি এবং মিজোরামের উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা (বরেন ত্রিপুরা: প্রাগুক্ত)।
১৫২৮ সাল থেকে মহারাজ বিজয়মাণিক্য ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করতেন। তার রাজত্বকাল ৪৭ বছর। ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ভাটি প্রদেশের হুগলি নদীর তীর থেকে মেঘনার তীর পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাজ্য আছে।
রাজার নাম বিজয়মাণিক্য (যিনি রাজা হতেন তিনি মাণিক্য উপাধি পেতেন)। রাজার দুই লক্ষ পদাতিক এক সহস্র হস্তী আছে। কিন্তু অশ্ব অতি বিরল (কৈলাশচন্দ্র সিংহ: রাজমালা)।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রিপুরাদের অভিবাসন :
এ অঞ্চলে ত্রিপুরাদের অভিবাসনের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায়-পঞ্চদশ শতকের প্রথমদিকে আগরতলা, আসাম ও ত্রিপুরা থেকে আগত ত্রিপুরা নৃগােষ্ঠীর একটি অংশ বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় বসবাস করতাে। একসময় উপকূলে বসবাস করা তাদের জন্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ে; ঝড়, দুর্যোগ, বন্যা থেকে বাঁচার জন্য এই জনগােষ্ঠী অরণ্যে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেয়।
এরপর তারা, সীতাকুন্ড, মিঠাছরা, মিরসরাই, নাজিরহাট, বিবিরহাট, করেরহাট, হিংগুলি, হেঁয়াকো প্রভৃতি স্থান হয়ে রামগড়, মাটিরাঙ্গা, গােমতির দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে সেখান থেকে পানছড়ি, খাগড়াছড়ি, দিঘিনালাসহ বিভিন্ন জায়গায় বিস্তৃতি। লাভ করে (আজাদ বুলবুল: ২০১০: ২৩)।
স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্য হতে এসে লুসাই যুদ্ধে পরাজিত বন্দি বিচ্ছিন্ন ত্রিপুরারা সাজেক উপত্যকায় বসবাস করতে বাধ্য হয়। এই বিচ্ছিন্ন দল রাজার প্রশাসন থেকে দূরে সরে এসে মারমাদের উপাধি ধারণ করে (সুরেন্দ্রলাল: ১৯৮০: ২৬)।
ত্রিপুরাদের বসবাস তিন পার্বত্য জেলায়। তবে সংখ্যাধিক্যের অবস্থান খাগড়াছড়ি জেলায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা ও মারমা অভিবাসনের বিস্তারিত ইতিবৃত্ত থাকলেও ত্রিপুরাদের অভিবাসনের তেমন কোন বৃত্তান্ত আমাদের জানা নাই।
প্রাক-ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম। ত্রিপরার প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে না থাকলেও নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। ১৭৯৮ সালে ফ্রান্সিস বখানন মাইনী নদীর তীরবর্তী লংগদু এলাকায় ত্রিপুরা রাজার পরিত্যক্ত স্থাপনা, ইমারত ও দিঘির চিহ্ন
ছন। রাজা গােবিন্দমাণিক্য ১৬৫৩ সালে রাজধানী ত্যাগ করে দিঘিনালা, মাইনী এলাকায়। কাল বসবাস করেন। বুখানন সম্ভবত গােবিন্দমাণিক্যের পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থানকালীন। কাতার বিভিন্ন চিহ্ন দেখে থাকবেন।
ধারণা করা হয় রাজা গােবিন্দমাণিক্য ত্রিপুরা রাজপ্রাসাদ ছেড়ে দক্ষিণে অজ্ঞাতবাসের সময় মাইনী, চেঙ্গি ও কর্ণফুলীর মােহনায় বহু অনুচরসহ বেশ ভচকাল কাটিয়েছেন। এতেও প্রতীয়মান হয় যে, সেসময় এসব এলাকায় ত্রিপুরাদের বসতি ছিল।
সীতাকন্ড চন্দ্রনাথ, রামগড় পাহাড় ও ফেণী, চেঙ্গি, মাইনি ও আচালং উপত্যকায় প্রাচীন কাল থেকে ত্রিপুরারা বসবাস করে আসছে।
একসময়ের ত্রিপুরা রাজার শাসনাধীন এসব অঞ্চল মােগল ও ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে ত্রিপুরাদের মধ্যে স্থানত্যাগ বা অভিবাসনের কোন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। যেমন রিয়াং ও উসুই নামে ত্রিপুরাদের দুটি গােত্র বর্তমানে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে বসবাস করছে।
ত্রিপুরা থেকে বেশ খানিকটা দূরে তাদের বসবাসের বিষয়টি অভিবাসনের ফল নয়। এর কারণ হলাে ষােড়শ শতকে যখন ত্রিপুরা রাজ্য আরাকান অবধি।
বিস্তত ছিল তখন আরাকান হিল ও লুসাই হিলের নিচে ত্রিপুরাদের দুটি বড়াে গােষ্ঠী বসবাস করতাে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ত্রিপুরা অধিকার থেকে মােগল রাজ্যভুক্ত হলেও রিয়াং ও উসুইরা তাদের পূর্বতন রাজ্যে ফিরে যায়নি।
ব্রিটিশ শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী ও দক্ষিণাঞ্চল তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা হিসাবে চিহ্নিত হলেও ত্রিপুরা অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চল বরাবরই ছিল ত্রিপুরা রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির অধীন।
এ এলাকায় ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় ঊনবিংশ শতকের শেষের দশকে। তবে বিশ শতকের প্রথমভাগেও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন জনপদে ত্রিপুরা মুদ্রায় লেনদেন চলতাে (প্রভাংশু ত্রিপুরা: সাক্ষাঙ্কার: ১৫/১২/২০১১)।
অর্থাৎ ইংরেজ শাসনে বসবাস করেও তারা নিজেদের স্বাধীনজাতি হিসাবে বিবেচনা করতাে এবং ত্রিপুরার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখতাে।
এ কারণে বলা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরা জনগােষ্ঠী এ জনপদের আদি অধিবাসী তথা আদিবাসী। তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিজ রাজ্যে বসবাস করে আসছে।
কোন রাজনৈতিক দুর্বিপাকে পড়ে তাদেরকে কখনাে দেশছাড়া হতে হয়নি। কোন যুদ্ধ বিগ্রহ বা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন তাদেরকে ভিন্ন কোন রাষ্ট্রে অভিবাসিত হবার ক্ষেত্র তৈরি করেনি। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র।
উপরােক্ত আলােচনায় প্রতীয়মান হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাস নিকট অতীতের। এখানে বসবাসরত চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাগণ আদিবাসী বা উপজাতি শ্রেণীভুক্ত।
তাদের রয়েছে উৎপত্তির ইতিহাস ও জাতিগত স্বাতন্ত্র্যচেতনা। চাকমা ও মারমারা এই জনপদের আদিবাসিন্দা নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন কালপরিক্রমায় তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসিত হয়েছে।
আর যাযাবর ও জুমচাষী ত্রিপুরাগণ উর্বরভূমির অনুসন্ধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনপদে প্রবেশ করেছে। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদের পরিচয়, অতীত ইতিহাস, জাতিতত্ত্ব বিচার ও অভিবাসনের বৃত্তান্ত গােষ্ঠীর সমাজ সংস্কৃতি গবেষণার এক অনালােকিত বিষয়। অনুরূপ আলােচনা তাদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে অতীব জরুরী।
সহায়ক গ্রন্থ:
১ অশােক কমার দেওয়ান। চাকমা জাতির ইতিহাস বিচার। মিসেস দীপিকা দেওয়ান, খাগড়াছড়ি, ১৯৯১।
২. আজাদ বুলবুল। পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরা ভাষা পরিচিতি। আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০০।
৩. আজাদ বুলবুল। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় সংস্কৃতি। মিজান পাবলিশার্স, ২০০৫।
৪. আজাদ বুলবুল। খাগড়াছড়ির ত্রিপুরা নৃগােষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি। মিজান পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০১০।
৫, আতিকুর রহমান, গবেষণা কর্ম : পার্বত্য চট্টগ্রাম। গ্রন্থকার, ২০০০। ৬, আবদুল মাবুদ খান। বান্দরবান জেলার মারমা সম্প্রদায়, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০৭।
৭. আবদুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গে, সায়েমা আক্তার চৌধুরী, চট্টগ্রাম, ১৯৮২।
৮. এডমিনিস্ট্রেশন অব দ্যা হিন্ট্রাক্টস, নর্দান আরাকান ফর দ্যা ইয়ার ১৮৭৭-৭৮, রেঙ্গুন গর্ভমেন্ট প্রেস, ১৮৭৯।
৯. কৈলাস চন্দ্র সিংহ-রাজমালা ১ম লহর। পারুল প্রকাশনী সংস্করণ, আগরতলা, ১৯৯৩।
১০. চৌধুরী পূর্ণচন্দ্র দেববর্মা তত্ত্বনিধি। চট্টগ্রামের ইতিহাস। ১৯২০।
১১. জাফর আহমেদ খান ড.(সম্পা)। রাঙ্গামাটি: বৈচিত্র্যের ঐকতান, জেলা প্রশাসন, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা, ২০০৪।
১২. জামাল উদ্দিন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস। বলাকা, চট্টগ্রাম, ২০১১।১৩. টি.এইচ লুইন। The Hill tracts of Chittagong and dwellers therein. Culcata, 1869।
১৪. রাজা ভুবনমােহন রায়। চাকমা রাজবংশের ইতিহাস, রাঙ্গামাটি, ১৯১৯।
১৫. উল্ক গেং মে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কৌম সমাজ। অনুবাদ: স্বপ্না ভট্টাচার্য, কলিকাতা, ১৯৯৬।
১৬. ভেলাম ভেন সেলে। দক্ষিণ পূর্ব বাংলায় ফ্রান্সিস বুকানন, অনুবাদ সালাউদ্দিন আইউব, সেন্টার ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ,ঢাকা ১৯৯১।
১৭. মুস্তফা মজিদ। মারমা জাতিসত্তা। বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০৮।
১৮. সুগত চাকমা। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় ভাষা। উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি, ১৯৮৮।
১৯. সুপ্রিয় তালুকদার। চাকমা সংস্কৃতির আদিরূপ। টুকু তালুকদার, রাঙ্গামাটি, ১৯৮৭।
২০. সুরেন্দ্রলাল ত্রিপুরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও সংস্কৃতি। উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি, ১৯৯৪।
21. Loffler, Lorenz G. Chakma and Sak. Vo-L, No.1 Heidelberg, 1969.
সহায়ক প্রবন্ধ :
১ অংসুই মারমা। ‘মারমা ইতিহাসের উপর একটি অনুপুঙ্খ আলােচনা’, পইংজ্রা, বােমাং রাজপুণ্যাহ স্মরণিকা, বান্দরবান, ১৯৮৪।
২. আজাদ বুলবুল। বান্দরবানে মারমা অভিবাসন’, নােঙর, চট্টগ্রাম, ২০১১।
৩. আবদুল হক চৌধুরী। পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা উপজাতি, উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা, রাঙ্গামাটি, ১৯৮৪।
৪. জার্নাল অব এশিয়াটিক সােসাইটি অব বেঙ্গল এর ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দের ১১৭ নং সংখ্যা।
৫. নির্মলেন্দু ত্রিপুরা। উপজাতীয় সামাজিক জীবনে ধর্মের প্রভাব, বােধিনী, রাঙ্গামাটি, ২০০৩।
৬. অধীর তালুকদার। আদিবাসী চাকমা বুড্ডিস্টদের অভ্যুদয় এবং বিশ্বব্যাপী তাদের ছড়িয়ে পড়া, তাগছা, জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল, রাঙ্গামাটি, ২০১১। ৭. অধীর তালুকদার। অরুণাচল থেকে ঘুরে এসে’, লেবা, জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল, রাঙ্গামাটি, ২০০২।
৮. প্রভাংশু ত্রিপুরা। সাক্ষাত্তার, ১৫/১২/২০১১।
৯. বরেন ত্রিপুরা। ত্রিপুরা জাতি পরিচিতি”, পূর্ব-ই রাবাইনি সাল, ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ, খাগড়াছড়ি, ১৯৮১।
১০. বরেন ত্রিপুরা। বাংলাদেশের আদিবাসী তথা উপজাতি প্রসঙ্গে’, বিচক, ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ, খাগড়াছড়ি, ১৯৯৬।
১১. বি.আর ফার্ণ। ‘কিং বেরিং’, অনুবাদ, মােশতাক আহমেদ, উর্মী, কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ১৯৯৬।
১২. ভগদত্ত খীসা। চাকমা লিপি ও ভাষা’, গিরি নিৰ্বর, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি, ১৯৮৭।
১৩. ভেলাম ভেন সেলে। জুম্মাদের আবিষ্করণ : দক্ষিণপূর্ব বাংলাদেশের রাষ্ট্র সংগঠন ও জাতিগােষ্ঠী রূপায়ণের আলেখ্য, শুভলং, (সম্পাঃ) বিপ্লব চাকমা, এপ্রিল ২০০২।
১৪. মংক্যশােয়েনু নেভী। প্রসঙ্গ মারমা সমাজ ও সংস্কৃতি,সমুজ্জ্বল সুবাতাস, সম্পাদক, হাফিজ রশিদ খান ও চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া ,২০০৮।
১৫. সলিল রায়। ত্রিপুরা জাতির পূর্ব পরিচয়’, পূর্ব ই রাবাইনি সাল, ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ, খাগড়াছড়ি, ১৯৮১।
১৬. সুপ্রিয় তালুকদার। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা’, ত্যেঠা, জাক, রাঙ্গামাটি, ২০০৮।
১৭. সুপ্রিয় তালুকদার। সাক-চাকমা-তঞ্চঙ্গ্যা এবং প্রসঙ্গত কিছু কথা’, সুলাই-প, জাক, রাঙ্গামাটি, ২০০৯, পৃ- ১৬।
১৮. সুরেন্দ্রলাল ত্রিপুরা, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজস্বের ইতিহাস’ উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা, উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি, ১৯৮০।
লেখকঃ আজাদ বুলবুল
তথ্যসূত্র : কেদাকতুক বৈসুক-সংগ্রাই-বিঝু-বিষু-বিহু সংকলন।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।