চাকমা রাজবংশের ইতিহাস ও চাকমা রাজাদের নামের তালিকা
4170
চাকমা রাজবংশের ইতিহাস
আমরা তখন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরনার্থী অবস্থায় ছিলাম। সেখানে অনেক ছেলে- মেয়েকে আমার আজু প্রায়ই গল্প শুনাতেন। একদিন আজু চাকমা রাজবংশের ইতিহাস সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার গল্প বলেছিলেন। আজু যে ভাবে চাকমা রাজবংশের ইতিহাস বলেছিলেন ঠিক সেইভাবে ঐ ঘটনার কথা নিয়ে আজকে আলোচনা করতে যাচ্ছি। সবাই সাথে থাকুন।
চাকমা রাজবংশের ইতিহাস অনুসারে সময়টা আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগ। চম্পক নগরের রাজা সাংবুদ্ধ। সাংবুদ্ধর দুই ছেলে- বড় ছেলের নাম বিজয়গিরি এবং ছোট ছেলের নাম সমরগিরি। যুবরাজ বিজয়গিরি যুদ্ধবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। ছেলেবেলা হতেই তিনি রাজ্য জয় ও রাজ্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখতেন। চম্পক নগরের ভাবি রাজা একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলেন।
ত্রিপুরার দক্ষিনে অবস্থিত মগ রাজ্য। মগরা ছিল দুস্য প্রকৃতির। তারা শহর ও গ্রামে লুন্ঠণ এবং মানুষের ওপর অত্যাচার করে বেড়াত । ত্রিপুরা রাজের অধিভূক্ত দক্ষিনাঞ্চলেও তাদের দৌরাত্ম্য থেকে মুক্ত ছিল না ।
এসময় ত্রিপুরা রাজ্যে অন্তঃবিপ্লবের সম্ভাবনা থাকায় রাজা মগদের দমনে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেনি। যুবরাজ বিজয়গিরি তার সামরিক অভিযানের শিকার হিসেবে বেছে নিলেন এই মগ রাজ্যকে। এ উদ্দেশ্যে তিনি এক বিপুল সৈন্যবাহিনী গঠন করলেন। সেনাপতি নিযুক্ত করলেন রাধামনকে।
বিজয়গিরি ত্রিপুরা রাজার সাথে সাক্ষাৎ করে সাহায্য কামনা করলে রাজা সানন্দে একদল ত্রিপুরা সৈন্য প্রদান করলেন। বিজয়গিরি ত্রিপুরা সৈন্য বাহিনীর সেনাপতি কুঞ্জধনকে সেনাপতি রাধামনের সহকারী নিযুক্ত করলেন। অতঃপর শুরু হল দক্ষিণ অভিমুখে যাত্রা।
ত্রিপুরা রাজ্যের অধিভূক্ত দক্ষিণের প্রদেশ কালাবাঘা। কালাবাঘা প্রদেশের ঠেওয়া নদীর তীরে শিবির স্থাপন করলেন রাধামনের বাহিনী। রাধামন পাশ্ববর্তী সামান্ত মগ রাজার নিকট দূত প্রেরন করলেন আত্নসমর্পনের জন্য। মগ রাজা আত্নসমর্পনে অস্বীকৃতি জানালেন। কর্ণফুলী নদীর মোহনায় ইধং পর্বতের কাছে দুপক্ষের মধ্যে শুরু হল যুদ্ধ।
রাধামনের শক্তি ও রনকৌশলের নিকট পরাজিত হল মগবাহিনী। মগ রাজা বশ্যতা স্বীকার করলে রাধামন তাকে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে আরো দক্ষিণে রোয়াং রাজ্য (বর্তমানে রামু)আক্রমন করলেন। যুদ্ধে মগ রাজা পরাজিত হয়ে রাধামনের নিকট প্রান ভিক্ষা ও রাজ্য ত্যাগের অনুমতি চাইলেন।
পর পর দুটি যুদ্ধে জয় লাভ করে রাধামনের সৈন্য বাহিনীর মনোবল বেড়ে গেল। এর পর তারা আক্রমন করেন নিম্ন আরাকানের অক্সাদেশে।শক্তিশালি অক্সাদেশের মগ সৈন্যদের সাথে ভীষন যুদ্ধে আহত হন রাধামন। সাহায্যে এগিয়ে আসেন সেনাপতি কুঞ্জধন। কুঞ্জধনের সহযোগিতায় রাধামন পরাজিত করে আক্সাদেশের মগ রাজাকে।
আক্সাদেশ জয়ের পর রাধামন সৈন্যদল নিয়ে পূর্বদিকে যাত্রা করেন। জয় করেন কাঞ্চন দেশ ও কালঞ্জ।কালঞ্জ জয়ের মাধ্য দিয়ে বিজয়গিরি তার সামরিক অভিযানের সমাপ্তি টানেন।
দ্বিগ্বিজয়ী বিজয়গিরি কালঞ্জ জয়ের পর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছে পোষন করেন। এরই মধ্যে তিনি অনেকগুলো রাজ্য জয় করেন। দীর্ঘ বছর পর চম্পক নগর প্রত্যাবর্তনের পথে কালাবাঘাই উপস্থিত হলে তিনি পিতার মৃ্ত্যুর দুঃসংবাদ পান। তিনি আরো জানতে পারেন দেশের শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ছোট ভাই সমরগিরি রাজ সিংহাসনে বসেছেন।
অভিমান কিংবা ভ্রাতৃস্নেহের কারনে বিজয়গিরি চম্পক নগরে ফিরে গেলেন না। তিনি পূনরায় বিজিত রাজ্যে ফিরে এলেন। বিজয়গিরির অনুরক্ত সৈনাগণও তার সাথে রয়ে গেল। বিজয়গিরি বিজিত রাজ্যেসমুহ নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন এক নতুন রা্জ্য, রাজধানী সাপ্রাইকুল।
তিনি সৈন্য ও অনুচরবর্গকে স্থানীয় রমনী বিয়ের অনুমতি প্রদান করলেন এবং নিজেও উচ্চ বংশীয় এক রমনী বিয়ে করলেন। শতাব্দীকাল রক্ত ও সংস্কৃতির মিশ্রনের ফলে সৃষ্টি হল এক নতুন জাতি। পরবর্তীতে এদের নাম হল চাকমা জাতি।
মনিজগিরি, উত্তর ব্রহ্মে চাকমা শাসিত এক রাজ্যের রাজধানী। নিম্ন আরাকানে রাজা বিজয়গিরি একটি চাকমা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে রাজা সিরত্তমা চাক রাজ্যের পরিধি আরও বিস্তৃত করেন। কিন্তু পরবর্তীতে চাকমা রাজ্য ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে।
পরিশেষে আরাকান রাজ্যের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ১১১৮ সালে নিম্ন আরাকান হতে চাকমারা বিতারিত হয়। তারা ক্রমশঃ ব্রহ্মরাজ্যের উত্তরদিকে সরে পড়েন। রাজা মনিজগিরি চাকমাদের সংগঠিত করে উত্তর ব্রহ্মে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার নাম আনুসারে রাজধানীর নাম রাখেন মনিজগিরি।
চাকমা রাজ্যের প্রভাবশালী শাসক রাজা অরুনযুগ(মায়ানমারের ইতিহাসে রাজা ইয়ংজ নামে পরিচিত) ।-অরুনযুগ উত্তর ব্রহ্মে কয়েকটি রাজ্য দখল করেন।তিনি ছিলেন তদানিন্তন ব্রহ্মদেশীয় পরাক্রান্ত রাজাদের মধ্যে অন্যতম। ব্রহ্মদেশীয় রাজা মেঙ্গাদি রাজা অরুণযুগের বিরুদ্দে দুবারযুদ্ধে লিপ্ত হন। দুবারই তাকে পরাজয়ের স্বাদ গ্রহন করতে হয়।
১৩৩৩ খ্রিঃ। রাজা মেঙ্গাদি রাজা অরুণযুগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য লক্ষাধিক সৈন্য প্রেরণ করেন। যুদ্ধে তিনি এক অভিনভ কুটকৌশল গ্রহন করেন ।চাকমা রাজার সাথে মিত্রতার অভিপ্রায়ে তিনি রাজার জন্য এক রূপবতী রমনী ও শতাধিক হাতি প্রেরন করেন। রূপবতী রমনীকে রাজা মেঙ্গাদির বোন হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়।
উপহার পৌছে দেয়ার অভিপ্রায়ে একজন শাসনকর্তা ও সহাস্রাধিক সৈন্য মনিজগিরিতে প্রবেশ করে। মূল সৈন্যদেরকে দূরে পাহাড়ে লুকিয়ে রাখা হয়। অরুনযুগ আনন্দের সাথে রাজা মেঙ্গাদির উপহার গ্রহণ করেন। রাতে রাজপুরিতে উৎসব শুরু হলে পুরিতে অবস্থানরত সহাস্রাধিক সৈন্য প্রথমে আক্রমন শুরু করেন।
অতঃপর পাহাড় থেকে বের হয়ে আসেন লক্ষাধিক সৈন্য। অতি সহজে পরাজয় ঘটে রাজা অরুণযুগের। ছয় শতাব্দী পূর্বে চম্পক নগরের যুবরাজ বিজয়গিরী আরাকান অভিযানের মাধ্যমে ব্রহ্মদেশে চাকমা রাজশক্তির যে সূচনা ঘটান রাজা অরুণযুগের পরাজয়ের মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটে।
ব্রহ্মদেশীয় রাজা মেঙ্গাদির অত্যন্ত সুযোগ্য মন্ত্রী কেরেগ্রি। তার নেতৃত্বে ব্রহ্মসৈন্যরা শক্তিশালী রাজা অরুনযুগকে পরাজিত করে। রাজার পরামর্শে যুদ্ধে তিনি অনৈতিক কুট কৌশল অবলম্বন করলেও তাতে তিনি অনুতপ্ত নন। সকলেই শুধু তার জয়টাকেই দেখবে। আর ইতিহাস! সে তো সবসময় বিজয়ীর পক্ষে।
কেরেগ্রি যুদ্ধে বন্দী রাজা অরুনযুগ, তিন রানী, তিন রাজপুত্র ও দুই রাজকন্যাকে রাজা মেঙ্গাদির নিকট প্রেরণ করেন। কয়েকদিন পর মন্ত্রী বিজিত রাজ্য হতে অসংখ্য হাতী, গয়াল, অপরিমিত স্বর্ণ ও রৌপ্য, রাজকীয় বহু মূল্যবান সম্পদ এবং বন্দী দশ হাজার সৈন্যসহ নিজ রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন।
মন্ত্রীর কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে রাজা মেঙ্গাদী তাকে মূল্যবান উপহার প্রদান করেন এবং “মহা প্রাজ্ঞ” খেতাবে ভূষিত করেন। এছাড়াও মন্ত্রীর পুত্রের সাথে বন্দী চাকমা রাজার এক কন্যার বিবাহ দেন। চাকমা রাজার অপর কন্যাকে মেঙ্গাদী নিজেই বিবাহ করেন।
রাজা মেঙ্গাদি বন্দী চাকমা রাজা, রজপুত্রগণদের প্রতি কঠোর হতে পারলেন না। সম্ভবত বিশ্বাসঘাতকতা ও অনৈতিক উপায়ে যুদ্ব জয় করায় নৈতিক দূর্বলতার কারনে চাকমা রাজা ও রজপুত্রগণদের প্রতি মেঙ্গাদি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি রাজা অরুনযুগকে আরাকানের “ক্যামুছা” নামক স্থানে “ক্যাক্যা” জাতির শাসনভার অর্পণ করেন।
চাকমা রাজপুত্র সূর্য্যজিতকে “কিউদেজা” এবং রাজপুত্র চন্দ্রজিতকে “মিঞা” অঞলের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। রাজপুত্র শত্রুজিতকে “কংজা” নামক স্থানে জলকর তহসীলদার রূপে প্রেরণ করেন। বন্দী দশ হাজার সৈন্যকে আরাকান রাজ্যের “ইয়ংখ্যং” নামক স্থানে বাস করার অনুমতি প্রদান করেন।
রাজা মেঙ্গাদি চাকমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও রাজা মেঙ্গাদির্ মত্যুর পর পরবর্তী রাজারা চাকমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না। চাকমাদের ওপর চলে নিপীড়ন ও নির্যাতন। ধিরে ধিরে চাকমারা অসহায়, রিক্ত ও নিঃস্ব হয়ে পরে।
১৪১৮ খ্রিঃ। চাকমা জাতির ভরসার শেষ প্রতীক রাজা মানেকগিরি (মায়ানমারের ইতিহাসে রাজা মারেক্যাস নামে পরিচিত) বিগত এক শতাব্দী চাকমা জাতি ব্রহ্মদেশের বিভিন্ন আংশে ছড়িয়ে পড়লেও মূল স্রোতের নের্তৃত্ব দিচ্ছেন রাজা মানেকগিরি।রাজ্যহীন রাজা। রাজা কিছুদিন পুর্বে বঙ্গদেশে গোপনে দূত প্রেরণ করেছিলেন।
বঙ্গদেশের সুলতানের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে তার দূত প্রেরণ। দূত সুস্ংবাদ নিয়ে ফিরে এসেছে। সুলতান জালালুদ্দীন মোহাম্মদ শাহ আশ্রয় প্রদানে সম্মত হয়েছেন। রাজা অনেক ভেবে চিন্তে ব্রহ্মরাজ্য ত্যাগের সি্দ্বান্ত নিয়েছেন। মগ সৈন্য ও রাজকর্মচারীর অত্যচার থেকে বাচার জন্য ব্রহ্মরাজ্য ত্যাগের বিকল্প নেই।
এছাড়াও চাকমা জাতিকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে পারলে ধিরে ধিরে শক্তি অর্জন করে ভবিষ্যতে হয়ত হারানো রাজ্য উদ্বার করা যাবে অথবা নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে। হয়ত মানেকগিরি তার জী্বদ্দশায় সেই সূদিনটি দেখে যেতে পারবে।
রাজবাড়ীতে রাজা মানেকগিরি অতি বিশ্বস্ত কয়েকজন চাকমা নেতা নিয়ে গোপন বৈঠক করছেন। বৈঠকে মন্ত্রী থৈন সুরেস্বরী সবাইকে ব্রহ্মরাজ্য ত্যাগ ও চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনের গুরুত্ব বর্ণনা করছেন। থৈন সুরেস্বরী সুবক্তা ও সুচতুর বুদ্ধির অধিকারি। রাজার অতি প্রিয় ও আস্থাভাজন। রাজা থৈন সুরেস্বরীকে দূত হিসবে বঙ্গদশে পাঠিয়েছিলন।
রাজাকে নিরাশ হতে হয়নি। সে নবাবের নিকট হতে দক্ষিন চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনের অনুমতি নিয়ে এসেছে। বৈঠকে চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনে সবাইকে রাজি করাতে সুরেস্বরীর খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
চাকমা জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় যে দেশ ত্যাগের পরিকল্পনা তা সবাই উপলব্দি করতে পারছে। কিন্তু ব্রহ্মরাজের নিয়ন্ত্রনাধীন আরাকান রাজা কি তাদেরকে দেশ ত্যগের সুযোগ দিবে? সবাই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিল প্রথমে রাজা, রাজার দুই ভাই এবং নেত্রিত্বাস্থানীয় ব্যক্তিরা আরাকান ত্যাগ করবে।
পরবর্তীতে অন্যেরা পর্যায়ক্রমে তাদের অনুসরণ করবে। সুরেস্বরী প্রত্যেককে আলাদা ভাবে তাদের করনীয় বুঝিয়ে দিলেন। রাজা মানিকগিরি চাকমা প্রধানদের সাথে আবারো আলোচনায় বসেছেন। রাজা ধির-স্থির ও শান্ত স্বভাবের হলেও আজ তাকে কিছুটা বিচলিত দেখাচ্ছে। গুপ্তচর মারফত তিনি জানতে পেরেছেন আরাকান রাজসৈন্যরা এগিয়ে আসছে।তাদের আরাকান ত্যাগের পরিকল্পনা আরাকান রাজা জানতে পেরেছে্ন।
তাদের পলায়নে বাধা দেওয়ার জন্য আরাকান রাজার সৈন্য প্রেরণ । রাজা মানিকগিরির দুই ভাই রাজাকে পালিয়ে যাবার প্রস্তাব দিলেন। রাজার পলায়ন নিশ্চিত করতে দুই রাজকুমার আরাকান সৈন্যদের বিরুদ্বে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। পরে তারাও রাজাকে অনুসরন করে চট্টগ্রামে পৌছবে।
দুই ভাইকে বিপদের মুখে ফেলে পালিয়ে যেতে রাজা কিছুতে রাজি হলেন না। মন্ত্রী ও সর্দারদের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত রাজা পালাতে রাজি হলেন। চাকমা জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় তাকে পালাতে হবে। রাজা কয়েকজন সর্দার ও অল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। মন্ত্রী, অধিকাংশ সর্দার ও সৈন্যগন রাজকুমারদের সাথে রয়ে গেল।
চাকমারা আরাকান সৈন্যদের সাথে বীরের মত যুদ্ধ করল। যুদ্ধের পাশাপাশি তারা চট্টগ্রামের অভীমূখে অগ্রসর হতে লাগল। যুদ্ধে রাজার ভাই রদংমা ও বহু চাকমা সৈন্য বীরত্বের সাথে লড়াই করে মৃত্যু বরন করলেন। যুদ্ধ শেষে সুলতানের রাজ্যে যাত্রার পথে অনেক চাকমা সৈন্য ও প্রজা অর্ধপথে পাহাড়ে থেকে যায়।
রাজার ছোট ভাই কদমগিরি ও মন্ত্রী অবশিষ্ট সৈন্য, সর্দার ও অনুচরসহ চট্টগ্রামে সুলতানের রাজ্যে প্রবেশ করেন। রাজা মানিকগিরি ইতিপূর্বেই সেখানে নিরাপদে পৌছেছে। রাজা ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রাজা, রাজকুমার, মন্ত্রী, সর্দার, সৈন্য সকলের চোখেই অশ্রু।
এ অশ্রু আনন্দের, এ অশ্রু বেদনার।দক্ষিন চট্টগ্রামে অরণ্যঘেরা জনমানবহীন বিস্তৃর্ণ অঞল। বঙ্গদেশের সুলতান চাকমাদের এখানে বসতি স্থাপনের অনুমতি দিয়েছেন। প্রবল উৎসাহে চাকমারা জঙ্গল কেটে চলছেন। এখানেই তারা গড়ে তুলবে নতুন জনপদ। নতুন চাকমা রাজ্যের ভিত্তি।
রাজা মানিকগিরি নতুন চাকমা রাজ্যটির নাম করলেন “চাকোমাস”। রাজ্যের জন্য শাসন ব্যবস্থা দাড় করালেন। তিনি রাজ্যকে বারোটি অঞ্চলে বিভক্ত করেন। প্রত্যেক অঞ্চলেন জন্য একজন দলপতি নির্বাচন করেন। অঞ্চলের দলপতির পদবী হল রোয়াযা। রাজ্য পরিচালনার জন্য রাজা একটি মন্ত্রণা সভা গঠন করেন।
মন্ত্রণা সভার সদস্যদের পদবী চেগে (মন্ত্রী)।- সেনাপতির পদবী (সর্দার) এবং সৈন্যদের পদবী (লস্কর)। রাজস্ব আদায়ের জন্য রোয়াযা, আমু, খীসা, রোয়াসই, সইসুখ ইত্যাদি পদবিধারি রাজকর্মচারী তৈরি করলেন। রোয়াযা রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি বিচারকার্যও পরিচালনা করবেন।
শিশু রাজ্যের অস্তিত্ব রক্ষা ও সমৃদ্ধ্বি অর্জনের জন্য সকলেই সচেষ্ট হলেন। শতাব্দীকাল নিপীড়িত, লাঞ্জিত জাতি নতুন করে স্বপ্ন দেখছে। অতীতেও নিম্ন আরাকান হতে বিতাড়িত হয়ে উত্তর ব্রহ্মে তারা সমৃদ্ধ রাজ্য গড়ে তুলেছিল। হারানো গৌরব ফিরে পেতে সকল চাকমাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তবে চাকমা জনগষ্ঠির একটি বড় অংশই ব্রহ্মদেশে রয়ে যায়। এই হলো আজুর সত্য ঘটনার গল্পটি।
আজুর এই সত্য ঘটনার গল্পের কাহিনীর সাথে অনেকের ইতিহাস লেখকের লেখা কাহিনীর সাথে মিল পেয়েছি। কারণ বহু লেখক লিখেছেন চাকমাদের রাজ্যের নাম “চাকোমাস”। এবং কিছু কিছু ঘটনাবলীও অনেক মিল রয়েছে।
ইতিহাসের সূত্রমতে, হিমালয়ের পাদদেশে শাক্য নামে এক রাজা বাস করতেন। তার রাজধানী ছিল কালপ্পানগর। সেখানে ঈশ্বরের মূর্তি তৈরি করে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন তিনি।
যানকুনী মন্ত্রীর জন্ম ওই পরিবারে। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে রাজ্য চালানোর জন্য তার খ্যাতি ছিল ব্যাপক। সুধন্য নামে শাক্য রাজার ছিলেন এক সাহসী ছেলে। তিনি ক্ষত্রীয় বীরদের মতো শত্রুদের দমন করতেন।
রাজা সুধন্যর দুই রাণী ও তিন পুত্র সন্তান ছিল। প্রথম রাণীর ছেলে গুণধর রাজকীয় আনন্দ ত্যাগ করে মোহমুক্তির উদ্দেশ্যে সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করেন। কনিষ্ঠ রাণীর আনন্দ মোহন ও লাঙ্গলধন নামে দুই ছেলে ছিল।
আনন্দ মোহন সিদ্ধার্থের শিষ্য হয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুর জীবন গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় ছেলে লাঙ্গলধন রাজা হয়ে রাজ্য শাসন করেন। কিন্তু খুব অল্প বয়সে মুত্যুবরণ করেন তিনি।
এরপর লাঙ্গলধনের ছেলে সমুদ্রজিৎ বেশ কয়েক বছর রাজ্য শাসন করেন। কিন্তু তিনিও মাত্র বিশ বছর বয়সে রাজত্ব ত্যাগ করে বৌদ্ধ ভিক্ষুত্ব গ্রহণ করেন। এতে তার সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।
এভাবে বংশ পরম্পরায় রাজ্য পরিচালিত হয়ে আসে। আনুমানিক ৫৯০ সালের দিকে চাকমা যুবরাজ বিজয়গিরি ও সেনাপতি রাধামন খীসার নেতৃত্বে পরিচালিত যুদ্ধে রোয়াং রাজ্য (বর্তমান রামু), অক্সাদেশ (আরাকান সীমান্ত), খ্যয়ং দেশ, কাঞ্চননগর (কাঞ্চন দেশ) ও কালজর (কুকিরাজ্য) প্রভৃতি রাজ্য বিজিত হলে বিশাল পার্বত্য রাজ্য’র (চাকোমাস) পত্তন ঘটে।
একসময় ধারা মিয়ার ছেলে মোগাল্যা রাজা হিসেবে সিংহাসন আরোহণ করেন। জুবান খাঁ ও ফতে খাঁ নামে তার দুই ছেলে ছিল। মগ জলদস্যুদের সঙ্গে জুবান খাঁর অনেক যুদ্ধ হয়। তাঁর সেনাপতি কালু খাঁ সর্দারের সঙ্গে মুসলমান নবাবদের বড় বড় যুদ্ধ হয়।
এসব যুদ্ধে তাঁরা দুটি বড় কামান দখল করেন। সেনাপতি ও রাজার ভাইয়ের নামানুসারে কামান দুটির নাম রাখা হয় কালু খাঁ ও ফতে খাঁ। বর্তমানে কামান দুটি ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে চাকমা রাজবাড়ির কাচারীর সামনে রাখা হয়েছে।
ফতে খাঁর ছিল তিন ছেলে। তাঁর মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ ছেলে শেরমুস্ত খাঁ ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা হন। এরপর শেরমুস্ত খাঁর ভাইয়ের ছেলে শের দৌলত খাঁ ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে রাজা হন।
এভাবে শের দৌলত খাঁর মৃত্যুর পর তার ছেলে জান বক্স খাঁ ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে, তাঁর মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ ছেলে জব্বার খাঁ ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে, তাঁর মৃত্যুর পর ধরম বক্স খাঁ ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে, ধরম বক্স খাঁর মৃত্যুর পর রাণী কালিন্দী জমিদারি সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্ত্ব ভার গ্রহণ করেন।
তিনি চট্টগ্রামের মহামুণি মন্দির নির্মাণ ও মহামুণি দীঘি খনন করে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে অমর হয়ে আছেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে হরিশচন্দ্র কার্ব্বারী কালিন্দী রাণীর মৃত্যুর পর রাজা হন।
ব্রিটিশ সরকার তাকে চট্টগ্রামের রাজানগর ছেড়ে রাঙামাটিতে বাসস্থান পরিবর্তনের অনুরোধ করে। সেই থেকে চট্টগ্রামের রাজানগর থেকে চাকমা রাজবাড়ি স্থানান্তর হয় রাঙামাটিতে।
রাজা হরিশচন্দ্রের দুই রাণীর দুই ছেলে ছিল। ভুবন মোহন রায় ও রাণী মোহন রায়। ভুবন মোহন রায় নাবালক থাকাকালীন রাজা হরিশ চন্দ্র মৃত্যুবরণ করলে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জমিদারি ও চাকমা রাজার শাসনভার নেয় ব্রিটিশ সরকার।
এরপর ১৯০৭ সালে কুমার ভুবন মোহন সাবালক হয়ে সিংহাসন আরোহণ করেন। রাজা ভুবন মোহন রায়ের মৃত্যুর পর যুবরাজ নলিনাক্ষ রায় ১৯৩৫ ইংরেজীর ৭ই মার্চ, বিভাগীয় কমিশনার মিঃ টুইনাম আই. সি. এস. মহোদয় কর্তৃক রাজা গদীতে অভিষিক্ত হন।
রাজা নলিনাক্ষ রায় বি. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইংরেজী সাহিত্য এম. এ. পর্যন্ত অধ্যায়ন করেন। রাজ কুমার বিরূপাক্ষ রায় ডিস্ট্রিক্ট কন্ট্রোলার হিসাবে চাকুরী করার পর অবসর গ্রহণ করেন। তিনি গভর্নমেন্ট প্রদত্ত রায় বাহাদুর উপাধি প্রাপ্ত হন।
রাজা নলিনাক্ষ রায় মাত্র ১৬ বছর রাজত্ব করেন। ১৯৩৯ সালের ৮ জুন সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের জন্মদিবস উপলক্ষে সম্রাট জয়ন্তীতে তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি প্রদান করা হয়।
রাণী বিনীতা দেবী একজন সাহিত্য সেবী ও স্বশিক্ষিত মহিলা। তাঁর আগ্রহে ও সাহায্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র পত্রিকা “গৈরিকা” একসময় পরিচালিত হতো। রাজা নলিনাক্ষ রায়ের সময়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে।
বিগত ১৯৫১ সালের ৭ অক্টোবর তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তিনি সফলভাবে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৫৩ সালে ত্রিদিব রায় রাজ্যভার গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজা ত্রিদিব রায় বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করার অভিযোগে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে তিনি পাকিস্তানে চলে যান।
সেকারণে তাঁর ছেলে বর্তমান চাকমা সার্কেল চিফ রাজা দেবাশীষ রায় ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর ৫১তম রাজা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের জন্ম ১৯৫৯ সালের ৯ এপ্রিল। চাকমা রাজার শাসন ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা জানা যায় বিশাল পার্বত্য রাজ্য গঠনের পর পরই।
১৫২০ সালে চাকমা রাজা জনুর সময় রাজ্যসীমা ছিল পূর্বে নাম্রে (বর্তমান নাফ নদী), পশ্চিমে সীতাকুন্ড পাহাড়, দক্ষিণে সমুদ্র ও চাঁইচল পর্বতশ্রেণি।
১৫৫০ সালে জো দি বরোস নামে জনৈক পর্তুগিজের আঁকা মানচিত্রে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীরে দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে ‘চাকোমাস’ নামে একটি রাজ্যের সন্ধান পাওয়া যায়।
এর অবস্থান শ্রীহট্ট ও ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্বে এবং আরাকানের উত্তরে অর্থাৎ বর্তমান বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পর্যন্ত। ১৭১৪ সালের দিকে মুসলিম নবাবদের সঙ্গে চাকমা রাজা জল্লাল খাঁর যুদ্ধ-বিগ্রহ ঘটে।
পরে ১৭১৫ সালে চাকমা রাজকুমার ফতে খাঁর সঙ্গে মুসলিম নবাবদের শান্তি স্থাপন হয়। ১৭৬০ সালের ১৫ অক্টোবর নবাব মীর কাশিম চট্টগ্রামের শাসনভার ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামেও ইংরেজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়।
১৭৭৭ ও ১৭৮১ সালে চাকমা রাজা শের দৌলত খাঁর সঙ্গে ইংরেজদের দুইবার যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এতে চাকমা রাজা জয়লাভ করেছিলেন। এরপর চাকমা রাজা জান বক্স খাঁর সঙ্গে পর পর তিন বছর (১৭৮৩, ১৭৮৪ ও ১৭৮৫ সাল) যুদ্ধ চলে।
পরে ১৭৮৭ সালে চাকমা রাজা জান বক্স খাঁ কোলকাতায় গিয়ে বড়লাটের কাছে ক্ষমা চান এবং বছরে পাঁচশ মণ তুলা দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি করেন।
১৮৪৪ সালে চাকমা রাণী কালিন্দীর সঙ্গে ক্যাপ্টেন লুইনের তীব্র দ্বন্দ্ব হয়। ১৮৬০ সালের ১ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে একটি স্বতন্ত্র জেলা গঠন করা হয়।
১৮৮১ সালের ১ সেপ্টেম্বর ‘চাকোমাস’ রাজ্যকে (বর্তমান বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম) তিনটি সার্কেলে বিভক্তিকরণ করা হয়। তার আগে ১৮৭০ সালে ঘোষিত সার্কেল বিভক্তিকরণের বিরুদ্ধে চাকমা রাণী কালিন্দীর আপিল অগ্রাহ্য করা হয়।
চাকমা রাজ প্রথা:
রাজা-প্রজার সেই প্রাচীন সম্পর্ক এখন আর খুব একটা দেখা যায় না। বাংলাদেশে জমিদারি অধিগ্রহণ আইনের আওতায় (পাকিস্তান আমলেই) সব রাজ-রাজাদের রাজত্ব বিলুপ্ত হয়েছে।
কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামেই আজও চালু রয়েছে রাজ প্রথা। পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং এর অধিবাসীদের ঐতিহাসিক পটভূমিকায় এ অঞ্চলের তিনটি প্রধান জনগোষ্ঠী চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরাদের নিয়ন্ত্রিত তিনটি প্রশাসনিক এলাকা বা রাজস্ব সার্কেল সৃষ্টি ছিল স্বাভাবিক।
কিন্তু বৃটিশ শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তা হতে পারেনি। ১৮৬০ সালের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ছিল দুই দলপতির হাতে।
মোগল শাসনের সময়ও দুই জমিদার বা সার্কেল চিফ যথাক্রমে চাকমা রাজা ও পোয়াং (বোমাং) রাজা হিসেবে রাজস্ব আদায়ের স্বীকৃতি ছিল।
১৭৬১ সালে চট্টগ্রাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারভুক্ত হলে কোংলাপ্রু মগ বা মারমা আদিবাসীদের দলপতি হিসেবে বান্দরবান এলাকার রাজস্ব আদায়কারী নিযুক্ত হন।
এরপর ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতি সার্কেল তিনটি গঠিত হলে কোংলাপ্রু পরিবারের বোমাং খেতাবের স্মারকরূপে বোমাং সার্কেলের নামকরণ এবং তাকে ওই সার্কেলে চিফ নিযুক্ত করা হয়।
প্রচলিত আইন ও রাজ প্রথার সঙ্গে কোনো তফাৎ আছে কিনা জানতে চাইলে রাজা দেবাশীষ বলেন, আলাদা করে দেখলে আলাদা। কিন্তু যুগ অনুসারে আমরা যদি চলতে না পারি তাহলে ব্যর্থ।
তবে জনগণ যদি কিছু গ্রহণ করতে না চায় এর বিকল্প তারাই ব্যবস্থা নেবে। পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর বসবাস। তাদের সংস্কৃতি লালন পালন, সংস্কার, সংযোজনে আমাদের কিছু ভূমিকা থাকে।
তিনি আরো বলেন, প্রচলিত আইন ও রাজ প্রথার সঙ্গে তেমন কোনো সাংঘর্ষিক বিষয়বস্তু নেই। বিচারের ক্ষেত্রে ১৯০০ সালের হিল ট্র্যাক্টস ম্যানুয়েল সংস্কার করে ২০০৩ সালে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত চালু করা হয়।
ফলে সিভিল প্রশাসন বা কমিশনার আদালতে যেতে হয় না। পর্যায়ক্রমে আইন কানুন সংস্কার হচ্ছে। এর ফলে রাজা বা হেডম্যান প্রথার সঙ্গে দেওয়ানি ও ফৌজদারি পদ্ধতির একটি সহাবস্থানের সুযোগ হয়েছে।
খাজনা আদায়:
তিন পার্বত্য জেলায় রাজ প্রথা চালু থাকায় প্রতি বছর আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে রাজপূণ্যাহ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে খাজনা আদায় করেন তিন সার্কেল প্রধান।
তিন পার্বত্য জেলার ভূমি রাজস্ব ঐতিহ্যগত রাজ প্রথার মাধ্যমে হেডম্যানরা আদায় করেন। তাঁরা আদায় করা খাজনার অর্থ জমা করেন পৃথকভাবে সরকার, রাজা এবং হেডম্যানের অংশে।
রাঙমাটির রাজবাড়িতে অনুষ্ঠিত রাজপূণ্যাহ অনুষ্ঠানে চিরাচরিত নিয়মে চাকমা সার্কেলের মৌজা হেডম্যানদের কাছ থেকে খাজনা আদায় এবং ঐতিহ্যবাহী নিয়মে তরবারি সমর্পণের মাধ্যমে হেডম্যানরা রাজার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
২০০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজ্যাভিষেকের রজত জয়ন্তী ও রাজা দেবাশীষের ছেলে রাজপুত্র ত্রিভূবন আর্য্যদেব রায়কে যুবরাজ হিসেবে অভিষিক্ত করতে এক আড়ম্বরপূর্ণ রাজপূণ্যাহ আয়োজন করে চাকমা রাজপরিবার।
ওই অনুষ্ঠানে দেশি-বিদেশী অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন। খাজনা প্রসঙ্গে রাজা দেবাশীষ বলেন, আমরা মূলত তিন ধরনের খাজনা আদায় করে থাকি।
এগুলো হচ্ছে – জুম খাজনা পরিবার পিছু বাৎসরিক ৬ টাকা, এর মধ্যে রাজার অংশ আড়াই টাকা, বাকি অংশ পায় সরকার। জমির খাজনা করা হয় গ্রোভ ল্যান্ড (উঁচু ভূমি) এবং ফ্রিঞ্জ ল্যান্ড (নিচু ভূমি) থেকে।
এ খাজনার মধ্যে রাজার অংশ ৪২, হেডম্যান ২৭ এবং বাকি অংশ সরকারের। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধিমালার ৪৩ (১) মতে, সব শ্রেণীর প্রজার নিকট থেকে হেডম্যান খাজনা আদায় করবেন।
গ্রোভ ল্যান্ড ব্যতীত অন্যান্য ভূমি থেকে আদায়কৃত খাজনার জন্য কি পরিমাণ কমিশন প্রদান করা হবে তা সবসময় সরকার নির্ধারণ করবে।
হেডম্যান আদায়কৃত খাজনা জেলা প্রশাসকের নিকট জমা দেবেন। জেলা প্রশাসক কারণ উল্লেখপূর্বক সংশ্লিষ্ট সার্কেল চিফ ও মৌজা হেডম্যানের সুপারিশক্রমে জুম খাজনা হ্রাস বা মওকুফ করতে পারেন। মৌজা হেডম্যানরা নিজ নিজ এলাকার প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে থাকেন।
আদায় করা খাজনা প্রতি বছর রাজপূণ্যাহ অনুষ্ঠানে রাজার কাছে জমা দেন তাঁরা। নিয়মিত রাজপূণ্যাহ আয়োজন করা না হলে হেডম্যানরা আদায় করা খাজনা সুবিধা মতো সময়ে পরিশোধ করতে পারেন।
রাঙ্গামাটি চাকমা সার্কেল
রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার ৫টি ও রাজস্থলী উপজেলার ৯টি মৌজা বাদে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার ২১টি, খাগড়াছড়ি সদরের ১২টি এবং রাঙামাটি জেলার ১৪৪টি মৌজাসহ মোট ১৭৭টি মৌজা নিয়ে চাকমা সার্কেল গঠিত।
মৌজাগুলোর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন হেডম্যান বা মৌজা প্রধানরা। তারা প্রথাগত নিয়মে সামজিক বিচার-আচারসহ স্থানীয়ভাবে সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪৭ ধারার আইন অনুযায়ী, বিভাগীয় কমিশনারের মঞ্জুরি সাপেক্ষে সার্কেল প্রধান যে মৌজার অধিবাসী সে মৌজাকে খাস মৌজা হিসেবে অধিকারে রাখতে পারেন।
সেক্ষেত্রে মৌজা প্রধান হিসেবে তিনিও নিজে হেডম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। হেডম্যানের জন্য নির্ধারিত সম্মানী ভাতা ও পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন তিনি।
বর্তমানে চাকমা সার্কেল চীফ চারটি মৌজা নিজের দায়িত্বে পরিচালনা করেন। সার্কেল চিফগণ জেলা প্রশাসকের উপদেষ্টা কাউন্সিলর হিসেবে পরিগণিত হন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট সার্কেল সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্য ও উপদেশ দিয়ে জেলা প্রশাসককে সহায়তা করেন।
সার্কেল চিফগণ তাদের কর্তৃত্বের প্রভাব বলয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সার্কেলের আওতাধীন মৌজাগুলোতে জেলা প্রশাসকের আদেশ কার্যকরীকরণ নিশ্চিত করে থাকেন।
তাঁরা ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে রাজস্ব আদায়, গণশান্তি, কল্যাণমুখী প্রশাসন ইত্যাদি বিষয়ে মৌজা হেডম্যানদের দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
আইনের ৪০ ধারা মতে, প্রচলিত রীতি অনুসারে উপজাতীয় বিরোধগুলো বা হেডম্যানদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেরিত বা হেডম্যানগণ নিজেরাই দাখিল করেছেন এমন বিরোধগুলোর বিচার সার্কেল চিফরা নিষ্পত্তি করেন।
এছাড়াও সার্কেল চিফদের আরও অনেক দায়িত্ব ও ক্ষমতা রয়েছে প্রথাগত আইনে। সার্কেল চিফ বা রাজা বর্তমানে সরকার থেকে মাসিক ১০ হাজার সম্মানী ভাতা পেয়ে থাকেন। এছাড়া আদায়কৃত জমির খাজনার ৪২ ভাগ পেয়ে থাকেন।
চাকমা সার্কেলের ৫১তম রাজা দেবাশীষ রায়:
পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০ সালের আইনের ৪৮ ধারা মতে, সার্কেল প্রধান বা রাজার পদে অভিষিক্তকরণ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে সরকার।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তান চলে যাওয়ায় শূন্য হয় রাজ সিংহাসনটি। স্বাধীনতা পরবর্তী তৎকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিল ১৯৭৩ সালের ৩০ এপ্রিল রাঙামাটি সফরে আসলে চাকমা রাজার বাড়িতে বেড়াতে যান।
ওই সময় তিনি রাজা ত্রিদিব রায়ের ছেলে দেবাশীষ রায়ের ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হলে তাকে সিংহাসনে বসানোর সম্মতি দেন।
পরে রাজপদে অভিষিক্তকরণের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২৫/৫/৭৪ খ্রিস্টাব্দ তারিখের ৪১৫ শাখা (১) প্রজ্ঞাপন মূলে নিয়োগ আদেশ জারি করা হয়েছিল।
তারই আলোকে ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর ১৮ বছর পূর্ণ হলে দেবাশীষ রায় আনুষ্ঠানিকভাবে রাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি রাঙামাটি চাকমা সার্কেলের ৫১তম রাজা।
চাকমা রাজ পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৪ সালে রাজা নলিনাক্ষ রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে ত্রিদিব রায় রাজার সিংহাসনে বসেন।
রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি পাকিস্তান চলে যান।
সে সময় তার ছেলে দেবাশীষ রায় নাবালক ছিলেন। সেজন্য রাজা ত্রিদিব রায়ের ছোট ভাই কুমার সুমিত রায় রাজ প্রতিনিধির দায়িত্বে কাজ করেন। পরে আঠারো বছর পূর্ণ হলে দেবাশীষ রায় রাজ সিংহাসন আরোহণ করেন।
রাজা দেবাশীষ রায় যুক্তরাজ্য হতে বার-অ্যাট-ল ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় জনগণের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত।
প্রবাদ আছে ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার’ কালের বিবর্তনে প্রবাদটির বাস্তব রূপ এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী তিন রাজার বেলায়।
বাংলাদেশে সম্ভবত শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজ প্রথা চালু রয়েছে। তবে রাজ প্রথা থাকলেও ঐতিহাসিক শাসনক্ষমতা রাজাদের আর নেই।
খর্ব করা হয়েছে রাজাদের প্রথাগত শাসন ক্ষমতা। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান তিন রাজার মধ্যে রাঙামাটির চাকমা সার্কেল চিফ হলেন রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়।
বান্দরবানের বোমাং সার্কেল চীফ কেএসপ্রু ২০১৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পরলোকগমন করেন। জানা যায়, প্রয়াত রাজা কেএসপ্রু ২০১২ সালের ২০ নভেম্বর ১৬তম রাজা হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন। খাগড়াছড়ির মং সার্কেল চীফ হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন রাজা সাচিংপ্রু চৌধুরী।
তথ্যসূত্র মতে, এক কালে পার্বত্য অঞ্চলের ওই তিন রাজার ছিল দুর্দান্ত প্রতাপ আর অসীম রাজকীয় প্রভাব। বিশেষ করে চাকমা সার্কেলের রাজা ছিলেন সবচেয়ে বেশি প্রতাপশালী ও ক্ষমতাধর।
কালের বিবর্তনে সেই ঐতিহ্য আর ক্ষমতা খর্ব হওয়ায় রাজাদের অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্য।
এখন আর ঐতিহাসিক সেই শাসনক্ষমতা নেই পার্বত্য তিন রাজার। তবে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের নিদর্শন নিয়ে চালু রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজ প্রথা।
পাশাপাশি বজায় রয়েছে প্রথাগত সামাজিক বিচার-আচার, খাজনা আদায়, ঐতিহ্যগত সংস্কৃতিসহ বিশেষ কার্যাদি। পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজ প্রথা আইনের পাশাপাশি প্রথাগত আইন প্রচলিত ও বিচার্য্য।
কিন্তু ঐতিহাসিক শাসনক্ষমতা খর্ব হওয়ায় রাজারা এখন অনেকটাই বলা চলে কাগুজে রাজা। তারপরও এমন তিন রাজার তিন রাজ্য টিকে আছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে।
জানা যায়, তিন রাজার মধ্যে চাকমা রাজার আধিপত্যের গোড়াপত্তন হাজার বছরের আগে। ঐতিহাসিক বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৫০০ সালের দিকে এখানে রাজ্য দখল ও রাজত্ব শুরু করেন চাকমা রাজবংশীয়রা।
সেই থেকে রাজ প্রথার সূচনা। বৃটিশরা এ প্রথাকে স্বীকৃতি দেয়। পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন রাজার ক্ষমতা, দায়িত্ব এবং অস্তিত্বের স্বীকৃতি দেন।
প্রচলিত রয়েছে ১৯০০ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি চলে আসছে। চাকমা সার্কেলের বর্তমান রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বিগত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রধান উপদেষ্টার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারীর (প্রতিমন্ত্রীর পদ মর্যাদায়) দায়িত্ব পালন করেন।
এ ব্যাপারে চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুগ যুগ ধরে বিশেষ শাসন ব্যবস্থায় শাসিত।
এখানে প্রথাগত শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি অনুযায়ী সামাজিক বিচারকার্য পরিচালিত হয়ে আসছে।
তবে বর্তমানে বিভিন্নভাবে প্রথাগত আইন ও ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে। ফলে এখানকার রাজ প্রথার অনেক ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতির অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন।
এছাড়া প্রথাগত নেতৃত্ব, সার্কেল চীফ, হেডম্যান, কারবারীদের অফিস-কাচারিসহ নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান।
শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তাদের যে ভূমিকা সেই তুলনায় সম্মানী ব্যবস্থা একদম নগণ্য। এসব সমস্যার উত্তরণে প্রয়োজন সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা।
চাকমা রাজবংশের রাজাদের নামের তালিকা
চাকমা রাজবংশের ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও লেখক বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। তারাও স্বীকার করেছেন যে, হয়ত একদিন সঠিক ইতিহাস বেরুবে মনে করে তারা যা জেনেছেন তা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বিভিন্ন লেখকের পুস্তক হতে যাচাই করে একটি তালিকা প্রস্তুত করার চেষ্টা করেছি। এসকল বই হতে প্রাপ্ত চাকমা রাজাদের নামের তালিকা নিম্নে প্রদত্ত হলো।
ক্রমিক নং | রাজার নাম |
১ | রাজা সুধন্য |
২ | মরুদেব |
৩ | চম্পক কলি |
৪ | লাঙ্গলধন (দ্বিতীয় মহিয়সীর সন্তান) |
৫ | ক্ষুদ্রজিত (বৌদ্ধ সন্যাসী) |
৬ | সমুদ্রজিত (ভ্রাতা। নি:স্তান) |
৭ | শ্যামল (সুভল মন্ত্রীর পুত্র) |
৮ | সান্ধাসুর (বৌদ্ধ ভিক্ষু ব্রত গ্রহন) |
৯ | চাম্পাসুর (ভ্রাতা) |
১০ | সাদেংগিরি |
১১ | ধর্মসুখ |
১২ | সুধন্য (২য়) |
১৩ | চম্পাসুর |
১৪ | বিশ্বশ্বর (নি:সন্তান)। অপর ভাই সুমেশ্বর। তিনি ভিমঞ্জয় নামে নাবালক পুত্র রেখে মৃত্যুবরণ করেন। |
১৫ | ভিমঞ্জয় |
১৬ | সংবুদ্ধ (কালবাগা ও ২য় চম্পকনগর স্থাপন) |
১৭ | উদয়গিরি |
উপরোক্ত রাজাগণ প্রাচীন রাজবংশের রাজা। উক্ত তালিকা অস্পষ্ট বলে অনেকে মনে করেন।
ক্রমিক নং | রাজার নাম |
১৮ | বিজয়গিরি (তাই ভাই চমকগিরি বা সমরগিরি। তিনি নি:সন্তান। তার মন্ত্রী সিরিত্তমা চাক অরাকানে রাজ্য স্থাপন করেন।) |
১৯ | সিরিত্তম চাক (উত্তম চাক) |
২০ | সরলনামা |
২১ | উলতনামা |
২২ | জনু |
২৩ | কমলজনু (কমল চেগেও বলা হয়)। |
উক্ত রাজাগণ আরাকানে চাকমা রাজ্যে স্থাপন করে রাজত্ব করেন।
ক্রমিক নং | রাজার নাম |
২৪ | মনিজগিরি (৮ম শতাব্দীর শেষ ভাগে উচ্চ ব্রক্ষ্মে রাজধানী স্থানান্তর করেন এবং নিজের নামানুসারে রাজধানীর নামকরণ করেন। |
২৫ | মদনযুগ |
২৬ | জীবনযুগ |
২৭ | রতনগিরি |
২৮ | কালা থংজা |
২৯ | বুদ্ধাংগিরি |
৩০ | ধর্মগিরি |
৩১ | শ্বেতব্রত (নি:সন্তান) |
উল্লিখিত রাজাগণ ৯ম শতাদ্বীর শেষ হতে ১১ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত উচ্চ ব্রক্ষ্মে রাজত্ব করেন।
ক্রমিক নং | রাজার নাম |
৩২ | শাকালিয়া |
৩৩ | বাঙালী |
৩৪ | মাদালিয়া |
৩৫ | রামথংজা (ভাই) |
৩৬ | চেইল্ল্যা ধাবেং |
৩৭ | সেরমত্যা |
৩৮ | অরুনযুগ (ইয়ংজ) |
৩৯ | সূর্যজিৎ |
৪০ | মইসাং |
৪১ | মানেকগিরি (মারেক্যাস) |
৪২ | কদম থংজা |
৪৩ | রদংসা |
৪৪ | তৈনসুশ্বেরী |
৪৫ | জনু (পুত্র সন্তান ছিল না) |
৪৬ | সাত্তোয়া (পাগল রাজা) রাজা জনুর বড় কন্যা রাজেস্বীর সন্তান। |
৪৭ | কাট্টুয়া রাণী |
৪৮ | ধাবানা (রাজকুমারী অমঙ্গলীর সন্তান) (মলিমা রাজবংশের উৎপত্তি) |
৪৯ | ধরম্য (১৬৬১) (তিনি মোঘল বংশীয় নারীর পাণি গ্রহণ করেন) |
৫০ | মোঙ্গল্যা / মোগল্যা |
৫১ | সুভল খাঁ |
৫২ | জল্লাল খাঁ (ফতে খাঁ) (তিনি ভ্রাতা) |
৫৩ | সেরমুস্ত খাঁ (১৭৭৬) |
৫৪ | শুকদেব রায় (১৭৫৭ ইং ১১১৯ মঘী) |
৫৫ | শের জুবের খান (১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে রাজ্যভার গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন শেরমুস্ত খানের ভ্রাতুষ্পুত্র। |
৫৬ | শের দৌলত খাঁ (১৭৭৬) |
৫৭ | জান বক্স খাঁ |
৫৮ | টব্বর খাঁ |
৫৯ | জব্বার খাঁ (ভাই) |
৬০ | ধরমবক্স খাঁ |
৬১ | রাণী কালিন্দি (১ম রাণী) |
৬২ | হরিশ্চন্দ্র রায় (৩য় রাণী হারিবির কন্যা মেনকার সন্তান। মেনকার বিয়ে হয় ওয়াংঝা গোজ গোপীনাথ দেওয়ান এর সাথে) তার পুত্র হলো হরিশ্চন্দ্র। |
৬৩ | কৃষ্ণ চন্দ্র দেওয়ান (রায় সাহেব উপাধি লাভ করে ভূৃবন মোহন রায় নাবালক থাকাকালে চাকমা রাজ্যভার লাভ করেন)। |
৬৪ | ভূবন মোহন রায় (১৮৯৭) |
৬৫ | নলিনাক্ষ রায় (১৯৩৫) |
৬৬ | ত্রিদিব রায় (১৯৫৪) (নাবালক সন্তান রেখে ১৯৭১ সালে মুুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানে থেকে যান। |
৬৭ | কুমার সমিত রায় (ভ্রাতা)। তাকে রিজেন্ট বলা হয়। |
৬৮ | দেবাশীষ রায় (ত্রিদিব রায়ের পুত্র) ১৯৭৭ |
তথ্যসূত্রঃ
১. পার্ব্বত্য চট্টলের এক দীন সেবকের জীবন কাহিনী- কামিনী মোহন দেওয়ান, ১৯৭০ ইং
২. চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত- বিরাজ মোহন দেওয়ান, ২য় সংস্করণ, ২০০৫ ইং
৩. উপজেতীয় গবেষণা পত্রিকা, ২য় সংখ্যা, উসাই, রাঙ্গামাটি, ১৯৮৪ ইং
৪. বাংলাদেশ ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার অব চিটাগাং হিল ট্রাক্টস, ১৯৭১ ইং
৫. চিটাগাং হিল ট্রাক্টস ম্যানুয়েল ১৯০০ ইং
৬. ভিশন, ১৯৯৫ ইং
৭. পার্বত্য চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সংস্কৃতি, বিপ্রদাশ বড়ুয়া সম্পাদিত. ২০০৩ ইং
৮. বার্গী, সুহৃদ চাকমা, ১৯৮৭ ইং
৯. মন পরানী, মৃত্তিকা চাকমা, ২০০২ ইং
১০. গিরি নির্ঝর, উসাই, ১৯৮৭ ইং
১১. পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও সংস্কৃতি, সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, ১৯৯৪ ইং
১২. গিরি নির্ঝর, উসাই, ১৯৮৮ ইং
লেখকঃ নিঝুম তালুকদার
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।