হারিয়ে যাচ্ছে সপ্তদশ শতাব্দীর চাকমা রাজার রাজধানী
2442
রাঙ্গুনিয়ার রাজা নগর একটি প্রসিদ্ধ নাম। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে চাকমা রাজাদের সাবেক রাজধানী রাজা নগরের স্থাপত্য কীর্তসমূহ কালের সাক্ষী হয়ে নীরবে ক্ষয়ে যাচ্ছে ধীরগতিতে।
সপ্তদশ শতাব্দীর নবাবী আমলে চাকমাদের রাজধানী ছিলো রাঙ্গুনীয়া রাজা নগরে। এখানে দাঁড়িয়ে আছে ইট-সুরকি দিয়ে নির্মিত অট্টালিকা। এটির একটির দেয়ালের প্রস্থ দুই হাতেরও অধিক। লতা-গুল্মে আচ্ছাদিত এই প্রাসাদে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস।
নবাবী আমলে চাকমা রাজাদের রাজধানী হিসাবে রাজা নগরের গৌরবময় অধ্যায়ের সুচনা ঘটে। ইতিহাস-ঐতিহ্যর নিদর্শন হলো এই প্রাসাদটি। বায়ান্ন একর জায়গার উপর প্রতিস্থিত সপ্তদশ শতাব্দিতে নির্মিত রাজপ্রাসাদ, রাজদরবার, হাতি-ঘোড়ার পিলখানা, বিখ্যাত সাগরদিঘী, পৌরাণিক দালান কৌটা, পুরাকীর্তি, বৌদ্ধ-বিহার ইত্যাদি প্রয়োজনীয় তদারকির অভাবে ইতিহাসের পাতা থেকে ঠাঁই নেয়ার পথে।
রাজবাড়ীতে ঢুকতে ছোখে পড়ে রাজা ভুবন মোহন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৪৩ সালে রাজা ভুবন মোহনের নামে প্রতিস্থিত হয়। রাজার হাট সংলগ্ন উত্তর পাশে এক প্রকান্ড দিঘী। দিঘীর পাড়ে রয়েছে রাজা ভূবন মোহন উচ্চ বিদ্যালয়। লাগোয়া সদর রাস্তা। রাস্তার পাশেই একটি পুকুর। এই পুকুর পাড়েই বৌদ্ধ বিহার।
পূর্ব কথাঃ- ইতিহাসের অন্তরালে রাজা-রানীদের অনেক অজানা কথা এই রাজ বাড়িতে স্মৃতি হয়ে আছে। পার্বত্য চট্ট্রগ্রামের গোড়াপত্তনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এ রাজাদের ভূমিকা লিখে শেষ করা যাবেনা। এই প্রাসাদ থেকে নবাবী আমলের শেষ রাজা সেরমুস্ত খাঁ বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যার অধিপতি নবাব আলিবদ খান এবং তাঁর দৌহিত্র নবাব সিরাজউদদৌল্লার অনুগত্য লাভ করেন। রাজ প্রাসাদকে ঘিরে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর বেশ কয়েকটি হলোঃ-
১। কালীন্দী রানী কর্তৃক খাজনা আদায়
২। নবাব এবং সরকারের সাথে কুটনৌতিক সম্পর্ক স্থাপন
৩। ফোর্ড উইলিয়াম চুক্তি
৪। পাহাড়িদের ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ইত্যাদি।
শ্রুত আছে এই প্রাসাদ যে এলাকায় অবস্থিত সেই পার্বত্য রইন্যা হতে রাঙ্গুনিয়া নামের উৎপত্তি ঘটে। প্রবাদ আছে
“হাতে কাস্তে, কোমড়ে দা
ভাত খাইলে রইন্যা যা”
অতীতে এখানে সমতল ভূমি ছিলো, লোকবসতি ছিল খুবই কম। জমি আবাদের সূত্র ধরে এখানে আদিবাসীরা বসতি গড়ে তোলে। জানা যায় সেরমুস্ত খাঁর ছেলে সুকদেব ১৭৩৭ খ্রীঃ খাজনা দেয়ার স্বীকৃতিতে নবাব সরকার হতে কোদালা জঙ্গল বন্দোবস্তি নিয়েছিলেন।
তার মৃত্যুর পর রাজা রাম জমি জমা তদারকি করতেন। ১৭৫৫ খ্রীঃ সের জব্বর খাঁ’র পুত্র নুরুল্ল খাঁ কোদালা গ্রামের সুকদেবের পক্ষ হয়ে শাসনভার প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
রাজা সেরমুস্ত খাঁ নবাবি আমলে প্রায় একশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। ১৭৫৮ খ্রীঃ তিনি মৃত্যু বরন করলে নবাবী আমলের শেষ রাজা হিসেবে সেরমুস্ত খাঁ ইতিহাসে রইলো বলে জানা যায়।
সেই সময় সের মুস্ত খাঁ আরাকানীদের অত্যাচারে মোঘল নবাবের সাথে সন্ধি করেছিলেন। তখন জুনকদর খাঁ চট্টগ্রামের নবাব ছিলেন। ১৭৩৭ খ্রীস্টাব্দে তিনি এখানে চাকমা রাজত্বের গোড়া পত্তন করেন বলে জানা গেছে।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার মাতা মুহুরী নদীর অববাহিকায় আলীকদমে তাঁর রাজধানী ছিল। এ রাজ্যর পরিধি পূর্বে লুসাই, উত্তরে ফেনী এবং দক্ষিণে শঙ্খনদী।
১৭৫৮ খ্রীস্টাব্দে সেরমুস্ত খাঁ’ র পরলোকগমন করলে তাঁর পুত্র সুকদেব রায় রাজা হন। উল্লেখ্য যে সুকদেব রায় ছিলেন সেরমুস্ত খাঁ এর পোষ্য পুত্র।
সুকদেব আলিকদম ত্যাগ করলে চাকমা অধ্যুষিত রাঙ্গুনিয়া শিলক নদীর তীরে রাজার নামে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। সুকদেব রায়ের স্ত্রীর নাম ছেলেমা।
সুকদেব যেহেতু রাজা তাই রানীর স্মৃতি রক্ষার্থে রাজপ্রাসাদের পাশে একটি পুকুর খনন করে পুকুরটি নামকরন করেছিলেন ছেলেমা পুকুর।
সুকরায়ের কোন সন্তান-সন্ততি ছিলনা। তিনি ১৭৭৬ খ্রীস্টাব্দে মৃত্যুবরন করার পর শের দৌলত খাঁ রাজ্য ভার গ্রহন করেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে জান বক্স খাঁ ১৭৮২ খ্রীস্টাব্দে দায়িত্ব গ্রহন করেন।
দীর্ঘ ১৭ বছর জান বক্স খাঁ রাজত্ব করে নানাবিদ অসুবিধার কথা বিবেচনা করে রাঙ্গুনিয়ায় চাকমা অধ্যুষিত রাজানগরে রাজধানী স্থানান্তর করেন।
জান বক্স খাঁ পরলোকগমন করার পর তাঁরই ছেলে টবর খাঁ ১৮০০ খ্রীঃ দায়িত্বভার গ্রহন করেন। উল্লেখ্য যে সুকদেব রায় ত্রিপুরা রাজ্য হতে সুন্দরী মূর্তি এনে চন্দ্রঘোনায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ত্রিপুরা সুন্দরী নাম অনুসারে এখনও নাকি চন্দ্রঘোনায় ত্রিপুরা সুন্দরী নামে একটি ছড়া আছে।
টবর খাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই কনিষ্ঠ ভ্রাতা জবর খাঁ ১৮০২ সালে রাজ্য ভার গ্রহন করেন। ১৮১২ খ্রীঃ তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই পুত্র ধরম বক্স খাঁ রাজা হন। রাজা ধরম বক্স খাঁর তিন রানী ছিলেন।
১। রানী কালীন্দী দেবী
২। রানী আটকবি
৩। রানী হারিবী
হারিবীর মেয়ের নাম চিকনবী। ১৮৩২ খ্রীস্টাব্দে ধরম বক্স খাঁর মৃত্যু হলে তাঁরই জ্যেষ্ঠ স্ত্রী কালিন্দী দেবী রাজ্য ভার গ্রহন করেন।
কালিন্দী দেবীর রাজত্বকাল ছিল বিশেষ গুরুত্ববহ। তিনি যেমন ছিলেন ধর্মশীলা তেমনি ছিলেন প্রজাদরদী। বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমত্বার অধিকারী কালিন্দী দেবীর রাজত্বকালে এদেশে ব্রিটিশ শাসনের সূত্রপাত ঘটে বলে জানা গেছে।
এ সময়ে কালিন্দী দেবী রাজকার্যে ফরাসি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজী ভাষা চালু করেন। তিনি সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বৌদ্ধদের জন্য বিহার নির্মানের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মের প্রতিষ্ঠান গড়তেও তিনি সার্বিক সহযোগিতা করেছেন বলে জানা গেছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায় শিলক ফজু দীঘির পাড়ে এক ভয়াবহ যুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যদের রানী কালিন্দী দেবী চরমভাবে পরাজিত করেছিলেন।
তাঁর নাম অনুসারে শিলক হতে পাদুয়া, রাজঘাট হতে পারুয়ার মধ্য যে রাস্তাটি সংযোগ স্থাপন করেছে এই দুইটি রাস্তা রানী কালিন্দী নামে নামকরন করা হয়েছে।
রানী কালিন্দী দেবীর রাজত্বকালে আদিবাসী কুকি সপ্রদায়ের লোকজন চাকমা এলাকায় এসে মানুষ হত্যা করে লুটপাট চালাতো।
তাঁদের অত্যাচারে এলাকাবাসী যখন অতিষ্ঠ হয় তখন কালিন্দী দেবীর হস্তক্ষেপে এলাকায় সকল নির্যাতন, হত্যা,-লুট চিরতরের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।
১৮৫৭ খ্রীস্টাব্দে ভারতে ব্রিটিশ সিপাহী বিদ্রোহ হয়। তখনকার সময়ে বহু বিদ্রোহী সিপাহী পার্বত্য চট্টগ্রামে পালিয়ে আসেন।
রানী কালিন্দী দেবী এদের পাকড়াও করে ব্রিটিশদের কাছে হস্তান্তর করায় ব্রিটিশ শাসক বাহিনী রানীর উপর বেশ সন্তুস্ত হন।
এরই পরিপেক্ষিতে ১৮৬০ খ্রীঃ ৩ ডিসেম্বর কর্নফুলী নদীর উপর ধার্যকৃত বার্ষিক জলকর ৭৫৬৬ টাকা থেকে কমিয়ে ৪০০০ টাকা করে দেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসক টমাস হাবার্ট লুইনের কার্যপলাপ চাকমাদের বিপক্ষে চলে যাওয়ায় রানী কালিন্দী এর জোরালো প্রতিবাদ করে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল।
উল্লেখ্য যে রাজা ধরম বক্স খাঁ রাজত্বকালে এবং পরে রানী কালিন্দী দেবীর রাজত্বকালে (১৮৫০ খ্রীঃ) ব্রিটিশ সরকারের পরামর্শে এবং নিজেদের প্রয়োজনে রানী কালিন্দী দেবী সমতল ভূমির চাষবাসে পাহাড়িদের শিক্ষা দেয়ার জন্য বাঙালী কৃষককে রাজার জমিতে বর্গাচাষী নিয়োজিত করেন।
ইংরেজরা ১৮৬০ খ্রীস্টাব্দে অধিক লাভের আশায় লাঙল দ্বারা চাষের উদ্যোগ করেন। অর্থাৎ তারা অধিক খাজনা আদায় করার কৌশল নিয়েছেন।
১৮৬৯ খ্রীস্টাব্দে ১ জানুয়ারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার শসনভার চন্দ্রঘোনা হতে রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৮৩ খ্রীঃ রাঙ্গুনীয়া রাজানগর হতে চাকমা রাজার রাজধানী রাঙ্গামাটি নিয়ে যাওয়া হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সহকরি কমিশনার মিঃ ডিবলিউ এন ডেলিডিন সি.এস. যুবরাজ ভূবন মোহন রায়কে ১৮৯৭ খ্রীঃ মে মাসে রাঙ্গামাটি রাজপ্রাসাদে রাজাপদে অভিষিক্ত করেন।
১৯১১ খ্রীঃ ডিসেম্বরে ভারত সম্রাট পঞ্চম জর্জের ভারত আগমনকালে লিল্লিতে এক মহা দরবার বসে। সেই দরবারে রাজা ভূবন মোহন রায় বঙ্গদেশের রাজাদের মধ্যে প্রথম এবং ভারতীয় রাজবর্গের মধ্যে ষষ্ঠ স্থান আসন পেয়েছিলেন।
১৮৭৭ সালে রানী কালিন্দী দেবীর মৃত্যুর পর তার পৌত্র হরিশ চন্দ্রকে ব্রিটিশ সরকার রাজা উপাধি দিয়ে দায়িত্ব অর্পন করেন। হরিশ চন্দ্রের পিতার নাম গোপীনাথ দেওয়ান। আর মাতার নাম চিকনবী।
উল্লেখ্য যে, নবাব সুজাউদ্দিন খাঁ চাকমা রাজাকে খুশি করার জন্য খাঁ উপাধি দিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। এরপর থেকে তারা মুসলমানী নামকরন করে খাঁ উপাধি লিখতেন।
রানি কালিন্দী দেবীর সময়কালে রানীর সঙ্গে হিন্দুদের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। তখনকার সময় থেকে চাকমা রাজারা খাঁ উপাধী বাদ দিয়ে দেন এবং রায় লেখে শুরু করেন।
বর্তমানে চাকমাদের ৫১তম রাজার রাজত্ব চলছে রাঙ্গামাটিতে। তাঁর পিতা রাজা ত্রিদিব রায়। তিনি বর্তমানে স্বেচ্ছায় পাকিস্তানে জীবন যাপন করছেন।
শেষ কথাঃ
রাঙ্গুনিয়ার রাজানগরের চাকমা রাজধানী ইতিহাসখ্যাত হলেও এই ঐতিহ্যবাহী রাজপ্রাসাদ রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে ইতিহাস থেকে শেষ স্মৃতি চিহ্নও নিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। রাজপরিবার, সরকারের সংরক্ষণ বিভাগের চোঁয়ায় ফিরে পেতে পারে হারানো সেই গৌরব। এটি হতে পারে পর্যটকদের আকর্ষনীয় স্থান।
সম্পূর্ণ তথ্যটি নেয়া হয়েছে ২০০৭ সালে দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত শতদল বড়ুয়ার কলাম থেকে।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।
আরও কিছু লেখা
Leave a Reply
chandan
হা হা হা না হেসে পারলাম না, মৌলবীদের মতো গাঁজাখুরী ইতিহাস না লিখলেই কী নয়? চন্দ্রঘোনার ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির তৈরী করিয়েছিলেন ত্রিপুরা মহারাজা৷ চট্টগ্রামের বিক্ষ্যাত নন্দকানন বৌদ্ধ মন্দির প্রতিষ্ঠায় ত্রিপুরা মহারাজা অনুদান দিয়েছিলেন৷ চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া এ ধরনের কোন এক মাঝামাঝি স্থানে এখনো ত্রিপুরা সুন্দরী নামক স্থান ইন্টারনেটে সার্চ করলে পাবেন, যেটা ত্রিপুরা মহারাজাদের শাসনামলের ইতিহাস বহন করছে, রাঙ্গুনিয়ায় এখনো ত্রিপুরা মহারাজার খননকৃত দিঘি স্বনামে বলিয়ান রয়েছে৷ আর যে সীমানা উল্লেখ করেছেন সেটাও পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছুই না, সারা বিশ্ব বলবে ত্রিপুরা মহারাজার সীমানা কোথায়৷ দয়া করে কোন জাতির ইতিহাসকে লুকিয়ে কিছু লিখবেননা৷ ধন্যবাদ৷