চাকমা রূপকথা: হঅ্’বি আর ধঅ্’বি
2163
অনেক দিন আগে, এক ছিল বুড়ো আর এক বুড়ি। ছেলে পুলে কেউ নেই, একটিই শুধু মেয়ে তাদের। পরীর মত ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটি। অনেক কাল পরে বুড়ো বয়সে যখন কোলে এল সে, বুড়ো খুব খুশি হয়ে আদর করে ওর নাম রাখল হঅ্’বি।
বুড়ো আর বুড়ি জুম করে। মেলাই ধান ফলে জুমে। তারা খেয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না। তা’ছাড়া তিল, কার্পাস (জুম্ম তুলো), কুমড়ো, মার্পা, চিনার এসব তো আছেই। এককথায় বুড়ো বুড়ির খুব সুখের সংসার।
কিন্তু সুখ চিরদিন আর কারোর কপালে জোটেনা। বুড়ো বুড়ির সংসারেও হঠাৎ একদিন দেখা দিল কালো মেঘ। নেমে এল তাদের দুঃখের দিন।
বুড়ো আর বুড়ি একদিন গেছে জুমে নিড়ানী দিতে। ধানের চারাগুলো সবে বিঘত খানেক হয়েছে। এ সময়টায় একবার ভাল করে নিড়ানী দিলে পরে আগাছা বাড়তে পারে না জুমে, আর ধানও হয় খুব।
জ্যৈষ্ট মাস। বুড়ো আর বুড়ি জুম বাছে। চারধারে খাঁ খাঁ রোদ্দুর। কাছে পিছে কোথাও ছায়াটুকু পর্যন্ত নেই। যে কটা গাছ দাঁড়িয়ে আছে জুমের মাঝখানে, সেগুলোরও সব ন্যাড়া মাথা। জুম পোড়ার আগুনে সব ঝলসে গেছে। পাতা মেলতে তাদের এখনও অনেক দেরি।
বুড়ি বলে বুড়োকে, “চলনা বুড়ো! একটু জল খেয়ে আসি। ভারী তেষ্টা পেয়েছে।”
বুড়ো বলে, “আরে সবুর! সবুর! এপাশটা সমান করে নিই আগে। দেখছিস না কী রকম আগাছা হয়ে আছে? তাড়াতাড়ি নিড়ানী শেষ করতে না পারলে ধানগুলো যে আর বাড়বে না।”
বললে কী হবে! এদিকে বুড়োর নিজেরই খুব তেষ্টা লেগেছে। তাই তাড়াতাড়ি কাজটা একপেশে করে নিয়েই ছুটলো দু’জনে জলের খোঁজে।
কিন্তু কোথায় জল! জ্যৈষ্ট মাসের কাঠ ফাটা রোদ্দুরে ছড়াছড়ি সব শুকিয়ে ফুটিফাটা হয়ে আছে। অন্যদিন তারা খাবার পানি আনত গাঙ থেকে ‘কত্তিতে’ (১) ভরে। আজ আনেনি তাই ফ্যাসাদ বেঁধেছে।
খুঁজতে খুঁজতে দেখতে পেল বুড়ি, একটা ঠান্ডা মত জায়গায়, – ওটা বোধহয় আগে জলাই ছিল, অনেকগুলো হরিণের পায়ের দাগ পড়েছে, আর কিছুটা জল জমে রয়েছে সেগুলোর খাঁজে খাঁজে।
বিষম তেষ্টায় বুড়ি ঐ জলটাই মরুভূমির মত শুষে নিলো মাটিতে ঠোঁট ঠেকিয়ে। কিন্তু তাতে তার গলাটা পর্যন্ত ভিজলনা। তেষ্টা মেটা দূরে থাক, সেটাকে বরং আরো দ্বিগুন বাড়িয়ে দিলো।
এদিকে বুড়ো খুঁজে পেয়েছে এক কাঁকড়ার গর্ত। ভেতরে বেশ পরিষ্কার ঠান্ডা পানি। মহা উল্লাসে বুড়ো আঁজলা ভরে জল খেতে যাচ্ছে, এমন সময় বুড়ি এসে কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো তাকে, “বুড়ো! আমাকে একটুখানি খেতে দেনা?”
বুড়োর নিজেরই তখন তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। খাবার সময় বুড়ি এসে বাগড়া দিতেই সে খেঁকী কুকুরের মত খেঁকিয়ে উঠল হন্যে হয়ে, “দুরর! দুরর! দুরর!”
বুড়ো আর বুড়ি দুর রুপে (কচ্ছপ), আর্টঃ তৃপ্তা চাকমাএখন হয়েছে কী; চাকমা ভাষায় দুর বললে কচ্ছপকেও বোঝায়। আর সেকালটা ছিল সত্যযুগ, লোকের কথায় কথায় মুখের বাক্য ফলে যেত।
তাই বুড়োর বলার সাথে সাথে একেবারে এক অবাক কান্ড! দূর হবার বদলে বুড়ি অমনি মস্তবড় এক ‘দূর’ অর্থাৎ কিনা কচ্ছপ হয়ে গেল! আর সেটা তখন জল খুঁজে খুঁজে গড়াতে গড়াতে পড়ল গিয়ে তাদের গাঁইয়ের পাশের নদীটায়।
আর জল খাবে কী? বূড়োর তো মুখের বাক্য বন্ধ হয়ে গেল, চোঁখের সামনে অত বড় তাজ্জব ব্যাপারটা ঘটতে দেখে। কী বলতে কী ঘটে গেল চোঁখের পলকে, ব্যাপারখানা বুঝে উঠতেই বুড়ো কপাল চাপড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল ‘হায়! হায়!’ করে বুড়ির শোকে।
বুড়িকে হারিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বুড়ো যা’হোক এক সময় ফিরে গেল ঘরে। এদিকে বাপকে একা ফিরতে দেখে মেয়েটা ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল তাকে, “বাবা! মা কই?”
মেয়ের কথা শুনে আবার দ্বিগুণ জ্বলে উঠল বুড়োর বুক হু হু করে। ছোট্ট মেয়েটি কখনও মায়ের কাছ ছাড়া হয়নি কোনদিন। এখন বুড়ো কী বলে বোঝাবে তাকে? মেয়ের মুখ চেয়ে পাষাণে বুক বাঁধল বুড়োর। ছল করে বলল মেয়েকে, “আসবে রে! তোর মা বিকালে আসবে।”
মেয়েটি তাতেই আপাতত প্রবোধ পেল বটে, কিন্তু মাকে না পেয়ে উসখুস করে কাটাল সারাদিন। বেচারী ঘন ঘন ভেতর বাহির করল সারাক্ষণ, পথের পানে চেয়ে চেয়ে দেখতে গেল ওই বুঝি আসছে তার মা!
ক্রমে দুপুর গড়িয়ে বিকেল এল আর দেখতে দেখতে বেলা পড়ে গিয়ে সন্ধ্যে হয়ে এল, কিন্তু তবুও তার মাকে আসতে দেখা গেল না।
মেয়েটি আর রাখতে পারল না নিজেকে। বাপের কাছে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল তার পিঠে মুখখানা গুঁজে। বারে বারে শুধোতে লাগল তার বাবাকে, কখন আসবে তার মা।
এদিকে মেয়ের দুঃখে বাপের নিজের চোঁখেও তখন জলের ধারা নেমেছে। পরম স্নেহে মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে বারে বারে বুঝাতে লাগল, “কাঁদিসনে মা! কাঁদিসনে! তোর মা নিশ্চয় আসবে কাল সকালে।”
অনেক করে ভুলিয়ে ভালিয়ে কোন রকমে মেয়েটিকে একটু শান্ত করল বুড়ো। আনাড়ি হাতে চারটে রেঁধে নিয়ে মেয়েকে খাওয়াল আর নিজেও কিছু মুখে দিল। তারপর তাকে বুকে নিয়ে শুতে গেল বিছানায়।
পরদিন সকাল না হতে মেয়েটি আবার বায়না ধরলো তার মায়ের কাছে যাবার জন্যে। বুড়ো তাকে নিয়ে গেল নদীর ধারে। তারপর এক এক করে খুলে বলল তাকে সব কথা।
শেষে বলল, “দেখ, তোর মা এখন কচ্ছপ হয়ে আছে ঐ নদীর জলে। সে আর ফিরবে না। পানিতেই থাকতে হবে তাকে, আর ফিরতে পারবে না।”
বাপের কথা শুনে মেয়েটি একেবারে আছড়ে পড়ল মাটিতে। ‘হাউ, মাউ’…… কাঁদতে লাগল মায়ের শোকে। তার সে কান্না শুনে হঠাৎ ‘ভু-স!’ করে ভেসে উঠল কচ্ছপটি।
পানির উপরে গলা বাড়িয়ে ডেকে বলল মেয়েকে, “কাঁদিসনি মা! কাঁদিসনি! কপালের লেখন আমি এখন কচ্ছপ হয়ে আছি। ঘরে ফেরার উপায় নেই।
মিছিমিছি কেঁদে দুঃখ দিসনি। তোর যখনই দেখতে ইচ্ছে করবে, ঘাটে এসে হাততালি দিস, আমি যেখানেই থাকি, নিশ্চয় দেখতে আসব তোকে।”
হঅ্’বি নদীর ধারে তার কচ্ছপ হয়ে যাওয়া মায়ের সাথে, আর্টঃ তৃপ্তা চাকমামায়ের কথায় মেয়েটি শান্ত হয়ে ফিরে এল ঘরে। সেই থেকে তার মায়ের কথা মনে পড়লেই নদীর ধারে গিয়ে হাত তালি দেয়, আর সঙ্গে সঙ্গে কচ্ছপটি ভেসে উঠে জলের উপর। তীরে কাছে এসে দেখা দিয়ে যায় মেয়েকে, নানান কথ বলে তার সঙ্গে।
এমনি করে দিন চলে যায়।
বুড়িকে হারিয়ে বুড়ো একেবারে একলা পড়ে গেল তখন থেকে। জুম করার আর তার সামর্থ্য রইল না। বড় কষ্টে পড়ে গেল সে মেয়েকে নিয়ে। তবে বেতের কাজ জানত সে খুব ভালো। যেমনি করে হোক, এখন খেতে তো হবে।
তাই বন থেকে সে বাঁশ, বেত কেটে আনল আর তাই দিয়ে টং (২) আর কুলো বুনে সেগুলো গাঁয়ে গাঁয়ে নিয়ে ফেরি করে বেচতে লাগলো –
“ভাত দিবে জরা জরা,
তোন দিবে টরা টরা
টং হুলো লবানি,…
মা বোন পাড়া?”
বাংলা:– “ভাত দিয়ো মুঠো ভরা
তরকারী দিয়ো থোড়া,
টং কুলো নেবেনি,
মা বোন পাড়া?”
বাপ আর মেয়ের এভাবে কোন রকমে এখন দিনানিপাত চলে।
ভিনগাঁয়ে থাকতো এক বুড়ি, অনেক কাল তার স্বামী মারা গেছে। একটি মাত্র মেয়ে নিয়ে তারও দিন গুজরান চলছে কোনমতে।
মেয়ের নাম ধঅ্’বি – বুড়োর মেয়ের প্রায় সমান বয়সী। বুড়ো যখন ফেরি করে নিয়ে আসতে লাগল তাদের গাঁয়ে, বুড়ির খুব পছন্দ হয়ে গেল তাকে দেখে।
কী করে বুড়োর মন ভোলানো যায়, সেই চেষ্টা দেখতে লাগলো বুড়ি তখন থেকে। রাস্তা দিয়ে বুড়োকে যেতে দেখলেই তাকে ডেকে বসায়, ঠান্ডা পানি খেতে দেয়।
পাশে বসে হাওয়া করতে করতে সুখ দুঃখের গল্প করে দু’দন্ড তার সঙ্গে। বলে, “আহা বুড়ো! তোমার তো ভারি কষ্ট! থাকত যদি আমার মত তোমার এক বুড়ি, তাহলে নিশ্চয় আসতে দিতনা তোমাকে এই রোদ্দুরে।”
আর কোন কোন দিন বুড়ি বলে, “আহা বুড়ো! তোমার কষ্ট আর চোঁখে সয়না। থেকেই যাও না হয় আজ এখানে।”
বুড়ো তাড়াতাড়ি বলে উঠে, “না না আজ থাক। কচি মেয়েটা একলা ঘরে রয়েছে। দিনমানটা যা’হোক করে কাটে, সন্ধ্যে হলেই কেঁদে ভাসিয়ে দেবে।”
একদিন বুড়ি একেবারে চেপে ধরল বুড়োকে রাখবার জন্যে। অন্যদিনের মত ওজর দেখাতে বুড়ি বলল তাকে, “থাক, থাক! মেয়ের ভাবনা ভাবতে হবে না তোমায়।
এই তো পাশের গাঁ, আমারও মেয়ে রয়েছে, পাঠিয়ে দিচ্ছি তাকে। ওকে এখানে নিয়ে আসবে।”
বুড়োর আর কোন আপত্তিই খাটলনা সেদিন। বুড়োর টং কুলো (হুলো) তখনো যেগুলো বিক্রি হয়নি, একেবারে ঘরের ভিতরে নিয়ে সেগুলো লুকিয়ে রাখল বুড়ি, যাতে বুড়ো পালাতে না পারে। তারপর মেয়েটাকে পাঠিয়ে দিল পাশের গাঁয়ে, বুড়োর মেয়েকে আনতে।
রাত্রে খাবার জন্যে একটা মুরগি জবাই করে দিল বুড়ি। তারপর ভাল করে রেঁধে বুড়ো আর তার মেয়েকে খেতে দিল খুব যত্ন করে। মা মেয়ে নিজেরাও খেল।
রাত্রে যখন সবাই ঘুমিয়েছে, চুপি চুপি নিজের কাপড়ে আর বুড়োর কাপড়ে একটা গিঁট বেঁধে নিল বুড়ি; তারপর শুয়ে পড়ল বুড়োর পাশে। এদিকে ভোর না হতে, বাড়ির মোরগটা কী করে জানি বুড়ির কান্ডটা টের পেয়ে ডেকে উঠল ডানা ঝেড়ে,—
“কঁক্-ক-রে! কঁক্!
বুজ্যালই বুড়ি জদন বান্যন্দে-
জক্-রে! জক্!”
বাংলা:– কঁক্-রে-কঁক্!
বুড়ো আর বুড়ি গাটছড়া বেঁধেছে,
মজার কান্ড দেখ!
ঘুম ভাঙতেই বুড়ি শাসিয়ে উঠল মোরগটাকে কপট রাগে, “হারামজাদা পাঁজি! ভোর হোক, দাড়া! কালই তোকে জবাই করে দিচ্ছি!”
এদিকে বুড়োরও তখন ঘুম ভেঙেছে। জেগে উঠে দেখে, সত্যি সত্যি তার গাটছড়া বাঁধা হয়ে আছে বুড়ির সঙ্গে! আর বুড়ি তো যেন আকাশ থেকে পড়ল একেবারে, “ওমা!
একী কান্ড বুড়ো! গাটছড়া বাধলে কে? ছি! ছ! ছি! এখন বিয়ে না হলে মুখ দেখায় কি করে লোকের কাছে? আর মেয়ে দুটোই বা বলবে কী?”
ফাঁদে পড়ে বাধ্য হয়ে বুড়োর বিয়ে করতে হল বুড়িকে। বিয়ে করে একেবারে নিয়ে এল তাকে নিজের বাড়িতে।
এরপর শুরু হল বুড়োর মেয়ের আসল দুঃখের দিন। বাড়িতে এসে পা দিতেই বুড়ি নিজের মূর্তি ধরলে। কালে কালে প্রকাশ পেতে লাগল তার হিংসুটেপনা।
বুড়োর মেয়ে কিনা সতীনের মেয়ে। বিষ নজর পড়ে গেল বুড়ির, মেয়েটার উপর প্রথম থেকে। তাকে দিয়ে সংসারের সব কাজকর্ম করায়, জল আনতে পাঠায় আর হাঁড়ি কুঁড়ি এঁটো বাসন সব মাজটে দেয়।
একটুখানি গাফিলতি দেখলে কাজে বুড়ি অমনি মারমূর্তি হয়ে উঠে একেবারে। তাছাড়া কথায় কথায় গালমন্দ আর শাপমন্যি বুড়ির মুখে যেন নিত্য লেগেই আছে।
বুড়োর মেয়ে কাজ করে যায় প্রাণপণে। বাপকে কিছুই বলতে পারে না বুড়ির ভয়ে। শুধু একেবারে যখন অসহ্য হয়ে উঠে, তখন এক ফাঁকে সে নদীর ধারে গিয়ে কাঁদতে বসে।
আর ওদিকে ওর মা তার সে কান্না শুনে ‘ভু-স’ করে আবার ভেসে উঠে জলের ভেতর থেকে। কূলের কাছে এসে বোঝাতে থাকে মেয়েকে, “কাঁদিসনি মা! কাঁদিসনি! সবই কপালের লেখন, সয়ে যা!”
থাকতে থাকতে বুড়ি একসময় জানতে পারল তার সতীনের কথা। তার সতীন এখনও কচ্ছপ হয়ে বেঁচে আছে, আর বুড়ো আর তার মেয়ে গিয়ে ডাকলে পরে জলের উপর ভেসে উঠে তাদের দেখা দিতে আসে, এসব খবর শুনে হিংসেয় বিষম জ্বালা ধরে দিল বুড়ির সারা গায়ে।
সতীনের মাংস কুড়মুড়িয়ে চিবিয়ে খাবার জন্যে তখন থেকেই উঠে পড়ে লাগল সে একেবারে।
কচ্ছপটা ধরার জন্যে হরেক রকম তোড়জোড় শুরু করে দিল বুড়ি। লোকজন লাগিয়ে নদীর উজানে পেতে রাখল সারি সারি সব চেই।
ভাটিতে বসাল একসার টেরা, আর নদীর দু’ধারে ফেলে রাখল মেলাই বঁড়শীর টোপ। বুড়ির মতলবটা বুঝতে পেরে বুড়োর মেয়ে আগে ভাগে তার মাকে গিয়ে হুঁশিয়ার করে দিল এক ফাঁকে,
“হেই-ই মা!—–
উবুরে গেলেহ্ চেয়্যত্ বাজিবে
লামনি গেলেহ্ তেরাত্ বাঝিবে,
কুলত্ এলেহ্ বজ্জিত্ বাঝিবে, —-
মধ্যমধ্য থাক্।“
বাংলা:– উজানে গেলে চাঁই
আর ভাটিতে গেলে টেরায় আটকা পড়বে।
কুলের কাছে এলে বঁড়শীতে গাঁথ্বে।
মাঝগাঙেই থাকো।
সময়মত মেয়ের হুঁশিয়ারী পেয়ে কচ্ছপটা সেদিন আর ধরা পড়লনা। তারপরের দিনও না, এমন কী তারপরের দিনও না। এমনি করে নিরাশ হতে বুড়ি যেন ক্ষেপে রইল একেবারে।
কচ্ছপটি এখন না যেতে পারে উজানে, না যেতে পারে ভাটিতে। কুলের কাছে গেলেও বিপদ। সব সময় ধরা পরার ভয়।
চড়ে বড়ে খাওয়া একদম বন্ধ হয়ে গেল তার। কিন্তু এমনি করে কতোদিন আর না খেয়ে থাকা যায়! পর পর বেশ কিছুদিন উপোস যাবার পর ক্ষিধের জ্বালায় কচ্ছপটা একদিন চড়তে এক কুলের কাছে সকালে, আর অমনি বুড়ির একখানা টোঁপে গেথে গেল ‘ঘ্যাঁ-চ্!’ করে।
বুড়ির খুশি আর দেখে কে? এতদিনে শত্রু ধরা পড়েছে! হুড়মুড় করে সে কচ্ছপটা ডাঙায় টেনে তুলে বয়ে নিয়ে এল বাড়িতে আর হুকুম করল বুড়োর মেয়েকে সেটাকে আগুনে ঝলসে নিয়ে কেটে কুটে আনতে।
বুড়োর মেয়ে তো সব দেখে শুনে যেন বোবা হয়ে গেছে। কিন্তু সৎমার হুকুম, না বলারও উপায় নেই তার।
বাধ্য হয়ে মেয়েটি আগুন ধরাল উঠানের একধারে। আর কচ্ছপটাকে পোড়াতে নিয়ে গেল সেখানে। বুড়ি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে লাগল মহা আহ্লাদে।
এখন কচ্ছপ হলেও সে তার মা। মেয়েটি ভেবে পেল না, প্রথমে তা কোন দিকটায় আগে আগুনে নেবে। পিঠের দিকটা অবশ্যি শক্ত বেশী, কিন্তু সেদিকটা আগুনে দিতে গেলে গেলে তার মুখটা চোঁখে পড়বে আগে।
সাত পাঁচ ভেবে মেয়েটি প্রথমে কচ্ছপটার বুকের দিকটায়ই দিল আগুনে। আঁচ লাগার সাথে সাথে ‘উঃ–হু-হু-!’ করে একেবারে ধড়ফড় করে উঠল কচ্ছপটি, “হেই মা! তোকে কত এই বুকের দুধ দিয়ে মানুষ করেছি, তুই আমাকে পোড়াচ্ছিস্ কেন?”
শিউরে উঠে মেয়েটি তাড়াতাড়ি কচ্ছপটাকে উলটে দিল তার পিঠের দিকে। এবারেও কচ্ছপটা ‘উঃ-হু-হু! করে ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠল আবার, “হেই মা! তোকে কত করে বেড়িয়েছি এই পিঠে করে, আমাকে তুই পোড়াস কেন?”
তার কাতরানি সইতে না পেরে মেয়েটি ফের উলটে দিল কচ্ছপটাকে। সেটার ছটফটানি দেখে বুড়ি এদিকে হেসে কুটিকুটি। হোক না কচ্ছপ, সতীন বইত নয়? সতীন না, শত্তুর! দগ্ধে দগ্ধে মরুক। শত্তুরের শেষ রাখতে নেই।
দু’য়েক বার এপিট ওপিট করতেই সারা হয়ে গেল কচ্ছপটি। চোঁখের জলে বুক ভাসিয়ে বুড়োর মেয়ে তখন সেটাকে নিয়ে গেল ঘাটে।
কেটে কুটে ভাল করে ধুয়ে মাংসটা এনে দিল বুড়ির কাছে।। খুব খুশি হয়ে বুড়িত রান্না করতে গেল সেটা খাবার জন্যে, এদিকে উনুনের আঁচ পেয়ে তরকারীর ঝোলটা যখন ফুটছে টগ্বগ্ টগ্বগ্ করে, তখন হাড়ির ভেতর থেকে যেন একজন বলে উঠল হাঁড়ি গলা করে, —
“ববগ্ ববগ্ সুদিনঅ মাধা খাং!
“ববগ্ ববগ্ সুদিনঅ মাধা খাং!”
বাংলাঃ– টগবগ! টগবগ! সতীনের মাথা খাই।
দেখে শুনে বুড়ি আটকে উঠল ভয়ে। চোঁখ উঠে গেল কপালে। কী অলুক্ষণে কান্ড রে বাবা! মরে গিয়েও সতীন খেতে চাচ্ছে তাকে। রান্না করা তরকারীটা আর খেতে সাহস করল না সে কোনমতে, না জানি যদি একটা কোন মন্দ হয়ে যায় কোন ফাঁকে? ভয়ে ভয়ে সে তরকারীটা ফেলে দিয়ে এল আস্তাকুঁড়ে।
কয়েকদিন যেতে দেখা গেল, একখানা লাউশাকের চারা গজিয়েছে সেখানে। বুড়োর মেয়ে সেটার খুব যত্ন নিতে লাগল হরেক রকম ভাবে। দেখতে দেখতে সেটা থেকে একটা লক্লকে আগা বেরিয়ে ওটা বেয়ে উঠল রান্নাঘরের চালে আর ছেয়ে ফেলল দু’দিনে।
কালে কালে তার ফুল হল আর একটা লাউয়ের কুঁড়িও দেখা দিল এক সময়। একটুখানি বড় হতেই সেটা ঝুলে পড়ল চালের বাতা থেকে দুয়োরের ঠিক সামনে, বাড়তে লাগল দিনে দিনে। রোজ সকালে বুড়ি যখন বেরোতে যায় ঘর থেকে, ‘ঠকাস্’ করে অমনি তার কপালে ঠুকে দেয় সেটা।
ঢোকবার বেলায় আর একবার। বুড়ি অমনি গাল মন্দ দিয়ে উঠে রাগে, “আঃ মোলো যাঃ! হতচ্ছাড়া লাউটা, ধরবার আর জায়গা পেলিনে! আর দু’দিন থাক। তোকে না তখন খাচ্ছি……”
আর কয়েকদিন যেতে যখন বেশ বড় হয়েছে লাউটা, বুড়ি সেটা তুলে আনলে আর কুচি কুচি করে কুটে বেশ রাঁধতে গেল খাবার জন্যে। রাঁধতে রাঁধতে ঝোলটা যখন ‘টগ্বগ্’ করে ফুট্ছে আগুনের আঁচ্ পেয়ে, আগের মতই কে যেন বলে উঠল হাঁড়ি গলা করে,-
“ববগ ববগ সুদিননঅ মাধা খাং!
ববগ ববগ সুদিনঅ মাধা খাং!”
এবার আরো বেশী ভয় পেয়ে বুড়ি তো ভীমরি খাবার জোগাড় একেবারে। সব্বোনাশ! এত সেই আগের গলা! কী জানি কী হয় এই ভেবে তরকারীটা আর সে খেলো না সাহস করে। হাঁড়ি সুদ্ধ ফেলে দিয়ে এল ঢেঁকীশালে তুষের গাদায়।
আবার কয়েকদিন যেতে দেখা গেল, একটা গাছের চারা উঠেছে সেখানে। বিরিখ গাছ। অল্পদিনেই বেশ বড়সড় হয়ে উঠল সেটা, আর ডাল পালে মেলে দাঁড়িয়ে গেল অনেকখানি জায়গা জুড়ে।
বুড়ি বুড়োর মেয়েকে পাঠায় ধান ভানতে। বেচারী একা একা ধান ভানে দুপুর রোদে। খাটুনীতে আর রোদের গরমে ‘দর্দর্’ করে ঘাম ঝরে তার সারা গা বেয়ে।
বিরিখ গাছটা সে সময় ছায়া দেয় তাকে মায়ের মত পরম স্নেহে। ডালপালা দুলিয়ে হাওয়া করে। মায়ের মতই যেন তার সব ক্লান্তি মুছে দেয় নিবিড় স্নেহে।
বুড়োর মেয়েকে অতখানি কষ্টের মধ্যে রেখেও বুড়ির তবু আশ মেটেনা। সতীনের মেয়েকে কষ্ট দেবার চিন্তায় রইল শয়তান বুড়ি। বুড়িকে হাড় ভাঙ্গা-চাড়া ভাঙ্গা রোগে ধরল।
এবার ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করতে হবে। এবার নাকি বুড়িকে হাড়ভাঙ্গা চারাভাঙ্গা রোগের ঔষধ হিসাবে বাঘের দুধ খেতে হবে।
কিন্তু গভীর জঙ্গল হতে বাঘের দুধ কে আনবে বুড়ির জন্য? সব ব্যবস্থা বুড়িই করল। হঅ্’বি আর ধঅ্’বি সন্ধ্যা বেলা বাঘের দুধ আনতে যাবে।
এদিকে দুপুর বেলা বুড়ি নিজের মেয়ে ধঅ্’বিকে বেশ কিছু দুষ্ট বুদ্ধি শিখিয়ে দিল। বুড়ি তার মেয়েকে বলল, “আজ বিকালে বাঘের দুধ আনতে যাবার সময় সিঁড়ি হতে পা পিছলে তুই নিচে পড়ে যাবি এবং কোমরে ব্যথা পাওয়ার ভান করবি। তুই যেতে না পারলে হঅ্’বি একাই বনে গিয়ে বাঘের দুধ আনতে হবে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল এবং আস্তে আস্তে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল হঅ্’বি চোঁখে মুখে সন্ধ্যার সাথে সাথে আঁধার দেখা দিল। বুড়ি হঅ্’বি আর ধঅ্’বিকে গিয়ে বাঘের দুধ আনার জন্য বলল।
তখন দুই সৎবোন মিলে বাঘের দুধ আনতে অন্ধকার বনের মধ্যে রওনা হল। বুড়ির কথামত ধঅ্’বি মাচাঘরের সাঙু (সিঁড়ি) দিয়ে নামার সময় আছাড় খাওয়ার ভান করে মাটিতে পড়ে গেল।
ফলে হঅ্’বিকে একাই বনে যেতে হল। বাঘের দুধের জন্য। হঅ্’বি একাকী গভীর জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করল। বনের হিংস্র জীবজন্তুর ডাক শুনে ভয়ে তার গা ছমছম করতে লাগল।
মনে মনে সে ভাবল বনের বাঘ ভালুকেরা আজ তাকে নিশ্চয় খেয়ে ফেলবে। সে আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগুচ্ছে। অমনি হঠাৎ তার সামনে পড়ে গেল আদ্যিকালের ইয়া বড় এক বিরাট বাঘিনী।
হঅ্’বিকে দেখতে পেয়ে সেটা তেড়ে খেতে এল তাকে ‘হালুম!’ করে। তাড়াতাড়ি জোড়হাত করে হঅ্’বি বলল তাকে,
“জু! মুঝি! জু!
খেলে খা, দেলে ধা
খেলে, তর অ ভুক্ জুরেব
মর অ দুক্ ফুরেব।”
বাংলাঃ- পেন্নাম হই মাসি! পেন্নাম!
খাও অথবা পালাও, যা খুশি চাও।
খাও তো তোমার বুক জুড়োবে,
আমারও দুঃখ ফুরোবে।
বনের ভিতর বাঘিনীর সামনে হঅ্’বি, আর্টঃ তৃপ্তা চাকমা“ভ্যালারে ভ্যালা!” বলে উঠল বাঘিনী মনুষের গলা করে, “ভাগ্যিস মাসি বলে ডেকেছিস! নইলে এতক্ষণ তোকে খেয়ে ফেলেছিলাম আর কি? তা কাদের বাছারে তুই? আ-হা-হা! মুখখানা শুকিয়ে যেন আমসি হয়ে গেছে।“
“মাসি”…… হঅ্’বি বলল, “আমার সৎমার ‘হাড়ভাঙ্গা চাড়াভাঙা’ ব্যামো হয়েছে। ভারি শক্ত ব্যামো। খানিকটা বাঘের দুধ চাই তার ঔষুধের জন্যে; নইলে আর বাঁচবেনা।
“ওমা! তাই নাকি?” বাঘিনী বলল সদয় হয়ে, “তা নে বাছা! নে! মাসি বলে যখন ডেকেছিস, তখন তোকে না দিয়ে কী আর পারি? বিশেষ করে ঔষুধের জন্যে যখন বলছিস।”
একটুখানি পা ফাঁক করে দাঁড়াতে বাঘিনীর মাই থেকে অমনি ঝর্ ঝর্ করে দুধ ঝরে পড়তে লাগল মাটিতে। আর হঅ্’বি তারই খানিকটা ধরে নিল একটা বাঁশের চুংগায় করে।
যাবার আগে বাঘিনী ফের বলল তাকে, “আহা! তোকে দেখে মনে হচ্ছে, ভারী দুঃখী মেয়ে তুই! দাঁড়া, আমার কাছে মেলাই কাপড় চোপড় রয়েছে; দিয়ে দিচ্ছি তোকে, নিয়ে যা। সেসব পরবি আর তোর এই বাঘিনী মাসিকে মনে করবি, কেমন?”
সেই আদ্যিকাল থেকে কত মানুষ বাঘিনীর পেটে গেছে, তাদের সব রকমারী পোষাক আশাক স্তুপ হয়ে পড়ে আছে একধারে।
হঅ্’বিকে সেখানে নিয়ে গিয়ে সব দেখিয়ে দিল বাঘিনী। এখন অতসব কাপড়ের পাহাড় তার মত বাচ্চা মেয়ে কী আর একলা একলা বয়ে নিতে পারে?
তাই সে বেছে বেছে খালি কয়েক জোড়া সুন্দর সুন্দর রেশমের তৈরী ‘পিনোন আর খাদি’ বেধে নিল পুটলী করে, আর বাকিগুলি পড়ে রইল সেখানে।
বাঘিনী মাসির কাছে বিদেয় নিয়ে হঅ্’বি ফিরে চলল বাড়িতে। এক হাতে বাঘের দুধ আরেক হাতে কাপড়ের পুঁটলী নিয়ে খুশি মনে পথ চলছে সে, হঠাৎ একটা ভাবনা এসে গেল তার মনে। যেমন তরো দেখছে সে হামেশা, এসব নিয়ে বাড়ি গেলে তার সৎমা না আবার সব কেড়ে কুড়ে নেয়! চট করে অমনি একটা বুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়।
সন্ধ্যের মুখে যখন সে পৌছে গেল তাদের গাঁয়ে, বাড়িতে ঢোকার আগে সে গিয়ে হাজির হল ঢেঁকীশালে বিরিখ গাছটার কাছে। জোর হাত করে বলল তাকে, “দোহাই তোমার! তুমি যদি সত্যিকারের বিরিখ গাছ হও তবে ফাঁক হয়ে যাও।
হঅ্’বির কথা শুনে বিরিখ গাছটা ফাঁক হয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি কাপড়ের পুটলিটা সেখানে রেখে বাড়ি চলে গেল।
এদিকে তার আগের রাতে হঅ্’বি বাড়িতে না ফেরায় তার বুড়ো বাপটি কান্নাকাটি করে চোঁখ লাল করল। কিন্তু বুড়ি মনে মনে খুশি হলো। বুড়োর কান্না দেখে বুড়িও নাকি সুরে কান্নার ভান করল।
পরদিন বিকালে হঅ্’বিকে জীবিত অবস্থায় ফিরতে দেখে সৎমা বুড়ি রেগে আগুন হয়ে বলল, পাজি মেয়ে। হতচ্ছাড়ি কোথাকার। গতরাত্রে কোথায় গিয়েছিলি? নিশ্চয় বনে যাসনি? কারোর বাড়িতে গল্পগুজব করে ফিরলি।
কিন্তু হঅ্’বি যখন সত্যি সত্যি বাঘের দুধ তার হাতে দিল তখন শয়তান বুড়ি মনের রাগ মনে চেপে চুপসে গেল। আর ওদিকে বুড়ো বাপ তার মেয়ে ফিরে আসায় খুব খুশি হলো।
তাকে খুব আদর করলো শয়তান বুড়ি কিন্তু হঅ্’বিকে ছাড়ল না সহজে। কিছুদিন পর আবার বুড়িকে সেই হারভাঙ্গা চাড়াভাঙ্গা রোগে ধরল।
এবারের ঔষধ হল সাপের দুধ। এবারও আগের মত ধঅ্’বি মাচা ঘরের সাঙুতে আছাড় খেল আর হঅ্’বিকে একাকী বনে যেতে হল সাপের দুধ আনার জন্য।
এবারও হঅ্’বি বনে গিয়ে একটা বিরাট সাপকে দেখে পেছন থেকে পিসি ডেকে প্রমাণ করল।
বিশাল এক সাপের সামনে হঅ্’বি, আর্টঃ তৃপ্তা চাকমাসদয় হয়ে এক চুংগা দুধ দিয়ে দিল সাপটা হঅ্’বিকে। তারপর ফের বলল তাকে, “তোকে দেখে খুব দুঃখী বলে মনে হচ্ছে। দাঁড়া, আমার কাছে মানুষের গয়না পত্তর মেলাই পড়ে আছে। তোকে দিচ্ছি, নিয়ে যা। সে সব পড়বি আর তোর এই বনের পিসিকে মনে করবি, কেমন?”
সেই আদ্যকাল থেকে কত মানুষ গিলে খেয়েছে সাপটা, তাদের হাড়গোড় সব কবে হজম হয়ে গেছে তার পেটে। কিন্তু গয়নাগুলো তো আর হজম হয় না!
সেগুলো সব উপরে উপরে রেখে দিয়েছে সে একখানে হঅ্’বিকে নিয়ে গিয়ে সাপটা দেখিয়ে দিল তাকে সেই গয়নার ভাঁড়ারটা। হঅ্’বির সাধ্যি কিসে সব একা বয়ে নিয়ে আসে! বুদ্ধি করে সে কয়েক সেট খালি দামী দামী জড়োয়া গয়না পুঁটলী বেঁধে নিল, তারপর সাপের কাছে বিদেয় নিয়ে বাড়ি ফিরে চলল।
সাঁঝের মুখে মুখে যখন সে পৌঁছল গাঁয়ে, বাড়ি ঢোকার মুখে আগের মতই সে গয়নাগুলো লুকিয়ে রেখে দিল বিরিখ গাছটার কোটরে। সাপের দুধটা বাড়িতে নিয়ে দিয়ে দিল তার বাপের হাতে।
দু’বারের মত হঅ্’বিকে জ্যান্ত ফিরে আসতে দেখে বুড়ি তো চটেমটে লাল ভেতরে ভেতরে। সতীনের মেয়েটা কিছুতেই যেন মরতে জানে না, এমনি আপদ জুটেছে! কিন্তু মুখে তো আর কিছু বলার জো নেই, তাই মনের রাগ তার মনেই চেপে রাখতে হল, পাছে না বুড়ো সব টের পেয়ে যায়!
সাপের দুধটা এনে বুড়ো খেতে দিল তাকে। বুড়ি কিন্তু ফের চালাকী করে সব ফেলে দিল মাচানের নীচে। তাহলে কি হবে? কতদিন আর রোগী সেজে থাকা যায় মিছিমিছি শখ করে। তাই বুড়ির নিজেরই অতিষ্ঠ লেগে গিয়ে সে উঠে বসল বিছানায় ধীরে ধীরে।
এমনি করে দুঃখ পেয়ে পেয়ে বুড়োর মেয়েটা বড়সড় হয়ে উঠল কালে কালে। দেখতে ভাল হলে কী হবে? একটা ভাল কাপড় পড়তে দেয় না বুড়ি তাকে।
মাথার চুলে তেল পড়ে না কোনকালে। খালি হাত, খালি পা। গয়নাগাটির বালাই নেই। অষ্টপ্রহর বুড়ি তাকে শুধু খাটিয়েই মারে, আর উঠতে বসতে গাল মন্দ করে।
মেয়েটা বড় হয়ে উঠেছে, অথচ বুড়ি পড়তে দিলনা তাকে কোনদিন একজোড়া পায়ের খাড়ু কী এক জোড়া হাতের বালা। ওদিকে নিজের মেয়েটার বেলায় কিন্তু সাজ পোশাকের ঘটা। গয়না যেখানের যা কমতি নেই কোনখানে।
কাজকর্ম কিছুই করতে হয় না বুড়ির মেয়েটাকে। খায়, দায় আর খালি ফুর্তি করে বেড়ায় সেজে গুঁজে।
এমনি করে দিন কাটে।
থাকতে থাকতে একদিন গাঁয়ে গাঁয়ে বিষম হৈ চৈ পড়ে গেল একেবারে। রাজার লোক এসে একদিন হঠাৎ গাঁয়ে ঢেঁড়া পিটিয়ে দিল, রাজ্যে যেখানে যত কুমারী মেয়ে আছে, আসছে পুন্নিমেয় রাজা নেমন্তন্ন করেছেন তাদের সবাইকে। রাজকুমারের যাকে পছন্দ হবে তাদের মধ্যে, তার সঙ্গেই তার বিয়ে হবে।
তখন আর কী? নীরব নিথর পানিতে কে যেন এসে একেবারে হাজার ঢিল ছুঁড়ে মারলে একসঙ্গে।
গাঁয়ে গাঁয়ে সাজ সাজ রব পড়ে গেল এরপর মেয়ে মহলে। এমন লোভনীয় ব্যাপার, কার না সাধ জাগে নিজের ভাগ্যটাকে একবার পরখ করে দেখতে? চাই কী; রাজার ছেলের সাথে বিয়ে। রাজরাণী হবে। কত সুখেই না থাকবে।
কে কার আগে সাজিয়ে গুছিয়ে মেয়েকে রাজবাড়ি পাঠাবে তার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। এদিকে শয়তান বুড়িও ধঅ্’বিকে রাজবাড়ি পাঠানোর জন্য আত্নীয় কুটুমের কাছ থেকে নানারকম গয়নাগাটি চেয়ে আনলো।
তারপর নির্দিষ্ট দিনে ধঅ্’বিকে ঘোড়ার গাড়িতে করে রাজবাড়িতে পাঠিয়ে দিল। সাথে অবশ্য সতীনের মেয়েকেও পাঠিয়ে দিল চাকরানী হিসেবে।
শয়তান বুড়ি নিজের মেয়েকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিল, “তোর সৎবোনকে লোকের কাছে চাকরানী বলে পরিচয় দিবি।” এরপর হঅ্’বি আর ধঅ্’বি দুজনকে দু’গাড়িতে করে পাঠিয়ে দিল। কদ্দুর যাবার পর হঅ্’বির গাড়িটা খারাপ হলো।
তখন ধঅ্’বি কোথায় হঅ্’বিকে নিজের গাড়িতে তুলে নেবে, তা না করে একাই ড্যাং ড্যাং করে হঅ্’বিকে ফেলে চলে গেল। আসলে হঅ্’বির গাড়িটা খারাপ হওয়াতে ধঅ্’বি আহ্লাদে আটখানা।
কারণ হলো কী, হঅ্’বি রূপেগুণে ধঅ্’বির চাইতে শ্রেষ্ঠ হওয়ায়, ধঅ্’বি মনে মনে তাকে হিংসে করতো। ধঅ্’বির গাড়িটা চোঁখের আড়ালে চলে গেলে হঅ্’বি আস্তে করে নামলো। নেমে সেই বিরিখ গাছটার কাছে হাজির হল।
বিরিখ গাছটার কাছ থেকে সোনার জড়োয়া গয়না আর সুন্দর সুন্দর রেশমের পোশাক চেয়ে নিল। সেগুলো পড়ে সুন্দর ভাবে সেজে গুজে রাজবাড়ির দিকে রওনা হলো। হঅ্’বির এমনিতে ফুটফুটে গায়ের রঙ, তাই সুন্দরী।
সোনার জড়োয়া গয়না আর ঝলমলে রেশমের কাপড় পড়ে তাকে পরী কন্যার মত সুন্দর লাগছিল। তারদিকে যে তাকায় আর চোঁখ ফেরাতে পারে না। হঅ্’বি যখন রাজবাড়িতে পৌঁছল সেখানেও একই অবস্থা। রাজবাড়ির বাদ্যবাজনা, নাচগান নিমিষেই থেমে গেল।
কারণ সকলে সব ভুলে গিয়ে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। এমন সুন্দরী কন্যা কেউ জীবনে দেখেনি। ও কী মানুষ না পরী কন্যা।
মুহূর্তের মধ্যে সারা রাজবাড়িতে খবর রটে গেল, এক পরমা সুন্দরী কন্যা এসেছে। কন্যাকে এক নজর দেখার জন্য সকলের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। খবর পেয়ে কুমারও চলে আসলো।
রাজকুমারের সাথে প্রথম সাক্ষাতে হঅ্’বি, আর্টঃ তৃপ্তা চাকমাহঅ্’বির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে কুমারও মুগ্ধ হয়ে গেল। রাজকুমারের চোঁখে চোঁখ পড়াতে হঅ্’বি লজ্জায় মাথা নিচু করলো। লজ্জায় তার গালদুটি আরো লাল হয়ে গেল।
এতে তার সৌন্দর্য আরো বেড়ে গেল। কুমার খুশি হয়ে হঅ্’বির হাত ধরে নাচতে লাগলো। এদিকে হয়েছে কী, ধঅ্’বি আগে তার সৎবোনকে চিনতে না পারলেও পরে ঠিকই চিনতে পারলো।
তখন হিংসেয় জ্বলে পুড়তে লাগলো। রাজা-রাণী হঅ্’বির আদর যত্ন করে রাজবাড়িতে রেখে দিল।
কয়েকদিন পর মহাধুমধাম করে কুমারের সাথে হঅ্’বির বিয়ে হলো। সারা রাজ্যের লোক আনন্দ উৎসবে মেতে উঠলো। সাতদিন সাতরাত ধরে রাজবাড়িতে খানাপিনা আর গানবাজনা চললো।
রাজকুমার আর হঅ্’বির বিয়ের দিন, আর্টঃ তৃপ্তা চাকমাবেচারী ধঅ্’বি হিংসায় জ্বলে পুড়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে গেল। তখন শয়তান বুড়ি মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “কাঁদিসনে, ঐ শত্তুর যখন কুমারকে নিয়ে বাপের বাড়ি আসবে, তখন সুযোগ বুঝে তাকে মেরে ফেলবো।
তখনি তুই হঅ্’বি সেজে রাজবাড়িতে যাবি।” শয়তান বুড়ি আর তার মেয়ে মিলে ফন্দি আটতে লাগলো কিভাবে হঅ্’বিকে মেরে ফেলবে।
তাদের সে সুযোগও মিলে গেল। একদিন হঅ্’বি সত্যি সত্যিই তার স্বামীকে নিয়ে বুড়ো বাপের বাড়িতে এলো। সাথে হাতি ঘোড়া, দাসদাসী, সৈন্য সামন্ত কতজনই না এলো।
দেখে দেখে হঅ্’বির বুড়ো বাপের আনন্দ আর ধরে না। সে নিজে গিয়ে রাজকুমার জামাইকে মহাসমাদরে বাড়িতে নিয়ে এলো। সারা বাড়ি আলো করে হঅ্’বি খুশিতে এঘর ওঘর ঘুরে বেড়ায়।
আর সতীনের মেয়ের সৌভাগ্য দেখে শয়তান বুড়ির দু’চোঁখ হিংসেয় জ্বলতে থাকে। তবে বুড়ি খুবই চালাক। মনের মধ্যে হিংসা লুকিয়ে রেখে উপরে উপরে জামাইকে খুব যত্ন করতে লাগলো। নিজেকে হঅ্’বি সত্যিকারের মা বলে পরিচয় দিল।
পরম আদর যত্নের মধ্য বাপের বাড়িতে হঅ্’বির দিন কাটতে লাগল। দিন কয়েক পরে কুমার ফিরে যেতে চাইলে হঅ্’বিরতো মন খারাপ।
আসলে অনেক দিন পর বুড়ো বাপকে পেয়ে আবার ফেলে যেতে মন কিছুতেই চাইছিল না। শয়তান বুড়িও সে সুযোগ ছাড়লোনা। সেও হঅ্’বিকে আরো কিছুদিন থাকার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলো।
সবাইকে দেখাচ্ছে হঅ্’বিকে সেও কতই না ভালবাসে। হঅ্’বির ইচ্ছে বুঝে কুমার তাকে আরো কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়িতে রেখে রাজপুরীতে ফিরে গেলেন। হঅ্’বি কুমারকে খুবই ভালবাসে।
তাই স্বামীর যাতে সামান্য অসুবিধা না হয় তার সেবার জন্য সব দাসদাসীদেরও রাজবাড়িতে পাঠিয়ে দিল। এবার শয়তান বুড়ি আর তার হিংসুটে মেয়ে ধঅ্’বি আসল কাজে নেমে পড়লো।
তক্কে তক্কে রইল কিভাবে শত্তুরের নিকেষ করবে। মুখে অবশ্য হঅ্’বির সাথে মিষ্টি মিষ্টি ভাব দেখাতে ভুললোনা। হঅ্’বির ছিল বেইন বোনার শখ।
সে প্রতিদিন দুপুরে বেইন বুনতো। সুযোগ বুঝে শয়তান বুড়ি আর তার হিংসুটে মেয়ে বেইন ঘরের পেছনে একটা মস্ত বড় গর্ত খুড়ে ফেললো।
একদিন দুপুরে হঅ্’বি বেইন বুনছিল আর ধঅ্’বি পাশে বসে তা দেখছিল। আর হঅ্’বির শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে নানা কথা জিজ্ঞেস করছিল। এটা সেটা জিজ্ঞেস করার পরেক’বি হঅ্’বিকে বললো আচ্ছা দিদি, তোর তো বিয়ে হয়েছে মেলাদিন, অথচ তোর বিয়ের আংটি এখনও ভাল করে দেখাই হলো না।
বড্ড ইচ্ছে করছে হাতে নিয়ে দেখতে। দেখতে দিবি একটুখানি? হঅ্’বি বোনের কথা শুনে সহজ সরল মনে বিয়ের আংটিটি খুলে বোনের হাতে দিল। বললো, “ভাল করে দেখ, হারিয়ে ফেলিসনি যেন।”
ধঅ্’বি আংটি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। হঠাৎ ইচ্ছে করেই আংটিটা গর্তের মধ্যে টুক করে ফেলে দিল।
তারপর হায় হায় করে উঠল, কি হবে রে দিদি, আংটিটা গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে। হঅ্’বি তখন করে কি, সে ছিল সাদাসিধে ধরণের। শয়তান বুড়ি আর তার মেয়ের কুবুদ্ধি ধরতেই পারলোনা।
সরল মনে তার বিয়ের আংটিটা আনার জন্য গর্তের মধ্যে নেমে পড়লো। শয়তান বুড়ি আর ধঅ্’বি এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। যেইনা হঅ্’বি গর্তে নেমে পড়লো, অমনি দুজনে দু’দিক থেকে মাটি চাপা দিয়ে হঅ্’বিকে মেরে ফেললো।
হঅ্’বি মারা যাবার সাথে সাথে একটা হলদে পাখি হয়ে রাজবাড়ির দিকে উড়ে গেল। শয়তান বুড়ি আর তার মেয়ে মাটি সরিয়ে হঅ্’বির আংটি আর তার অলংকারগুলো নিয়ে নিল।
কয়েকদিন সবুর করার পর হঅ্’বি ধঅ্’বির আংটি আর অলংকার পরে হঅ্’বি সেজে রাজবাড়ির দিকে রওনা হলো। তাকে দেখে কুমারের মনে প্রথম থেকেই সন্দেহ দেখা দিল।
কারণ হঅ্’বির চালচলনের সাথে ধঅ্’বির চালচলনের ম্যালা ফারাক। হঅ্’বিতো অপরূপ সুন্দরী ছিল এবং কুৎসিত ছিল না, গায়ের রঙ এত কালো ছিল না।
তার গালও এত ফোলা ফোলা ছিল না। গলার স্বর কি মধুর ছিল। তাই কুমারতো তাকে কিছুতেই নিজের স্ত্রী বলে মেনে নিতে রাজী হলো না। তখন ধঅ্’বি বুক চাপরে বিলাপ করতে লাগলো।
কুমার, তুমি আসার পর তোমার জন্য কাঁদতে কাঁদতে আমার চোঁখ ফুলে গেছে। গাল ফোলা ফোলা হয়ে গেছে। গলার স্বর ভেঙে গেছে। দুঃখে আমার দুধে আলতা গায়ের রঙও কালো হয়ে গেছে।
বিয়ের আংটি কুমারকে দেখিয়ে বললো, ‘কুমার এই দেখো, আমার হাতে এখনো তোমার পরিয়ে দেয়া আংটি আছে। কুমার ধঅ্’বির হাতের আংটি দেখে অবাক হয়ে গেল।
তবুও তার মন থেকে সন্দেহ দূর হলো না। যা হোক কুমার ধঅ্’বিকে রাজবাড়িতে থাকতে দিল। আর ধঅ্’বিকে নানাভাবে পরিক্ষা করার জন্য দাসদাসীদের হুকুম দিল।
ধঅ্’বি রাজবাড়িতে ঠাঁই পেলো। ঠাঁই পেলে কি হবে। তার আসল বিপদ শুরু হলো। প্রথমদিন তাকে রাঁধতে দেয়া হলো। রাঁধতে বসে কোনটায় বেশি নুন দেয়।
কোনটায় নুন দিতে ভুলে যায়। কোনটায় ঝাল বেশি দেয়। সেদিন কেউ তার রান্না মুখে দিতে পারলোনা। তখন ধঅ্’বি নানা অজুহাত দেখাতে লাগলো। “আসলে রাজবাড়িতে বৌ হয়ে আসার পর অনেকদিন রান্নাবান্না করিনি।
তাই রান্না ভাল হয় নি।” দ্বিতীয় দিন তাকে গাইতে বলা হলো। সে তখন হেড়ে গলায় দিদির শেখানো গান গাইতে লাগলো। তার সেই ভয়ঙ্কর আওয়াজ শুনে যে যেদিকে পারল পালিয়ে বাচল। এতে ধঅ্’বি ভীষণ লজ্জা পেলো।
তবুও সে নিজের দোষ ঢাকার জন্য বলতে লাগলো, “কুমারের বিরহে কাঁদতে কাঁদতে আমার গলার স্বর এমন বেসুরো হয়েছে।” নিজেকে বাঁচানোর জন্য ধঅ্’বি যতই অজুহাত দেখাক না কেন, রাজবাড়ির দাসদাসীদের কাছ থেকে সে রেহাই পেলোনা।
এবারে তারা ধঅ্’বিকে ছবি আঁকার জন্য রংতুলি এনে দিল। ধঅ্’বি ছবি আঁকার কিচ্ছু জানে! সে আঁকলো কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং। সে ছবি দেখে সবাই নাক সিটকায়। শেষে সবাই তাকে বেইন বুনতে দিল।
হঅ্’বি খুব সুন্দর কাপড় বুনত। ভারী সুন্দর সুন্দর ফুল তুলতে পারতো। তা দেখে রাজবাড়ির সকলে কি প্রশংসাই করতো।
ধঅ্’বি জন্মে কোনদিন বেইন বুনেনি। সে পড়লো মহা ফ্যাসাদে। কিভাবে বেইন বুনবে বসে বসে ভাবছে। এমনি সময়ে মাথার উপর থেকে হলদে পাখিটি বলে উঠলো,
“তিনজুর ফেলেই তিনজুরর তুল
ভূদুনি ঝি ভূদুনি
বিগুন বিজি ফুল্ল তুল”
বাংলাঃ- “তিন জোড়া ফেলে তিন জোড়া তুল
ভূতনীর ঝি ভূতনী
বেগুন বিচি ফুলটি তুল”।
হলদে পাখির কথাটা শুনে ধঅ্’বির রাগ হলো খুব। সে একটা ব’কাঠি পাখিটার দিকে জোরে ছুড়ে মারলো। বেচারী হলদে পাখিটা সাথে সাথে মারা গেল।
সেদিন ঐ পথ দিয়ে যাবার সময় কুমার দেখতে পেলো হলদে পাখিটা মরে পড়ে আছে। তার বড়ো মায়া হলো।
কুমার পাখিটাকে আনলো তার শোবার ঘরে। রাখলো ঘরের এককোণে বড় যত্ন করে। পাখিটার কথা ভাবতে ভাবতে কুমার একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন ভোরে যখন তার ঘুম ভাঙলো, কুমার দেখলো অবাক কান্ড। তার ঘরটা কে যেন সুন্দরভাবে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। এমনি সময়ে তার চোঁখ পড়ে গেল ঘরের কোণে।
হলদে পাখিটাকে যেখানে রেখেছিল সে জায়গায় দেখল, রাতারাতি সে জায়গায় একটা ছদরক ফুলের (গাঁদা) গাছ উঠেছে। গাছটাতে মাত্র একটা বড় সুন্দর ফুল ফুটে আছে। দেখেশুনে কুমার বড় অবাক হল। ভাবল, এটা কি স্বপ্ন নাকি মনের ভুল!
এরপরদিনও ঘুম থেকে উঠে কুমার দেখল, সে একই কান্ড। গতরাতের মতই তার ঘর সুন্দরভাবে সাজানো গোছানো।
শুধু তা নয়, তার পরনের কাপড়েও কে যেন পানের পিক লাগিয়ে দিয়ে গেছে। তা দেখে কুমারে ভীষণ রাগ হলো। রাজবাড়ির সকল দাসদাসীদের ডেকে বললো, তোমাদের মধ্যে কে এই কান্ড করেছো?
সকল দাসদাসী তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। তারা কেউ কিছু বলতে পারলোনা, আসলে কে এই কাজ করেছে।
কুমার তখন ঠিক করলো নিজেই এর সুরাহা করবে। সেদিন রাতে সে ঘুমালো না। ঘুমাবার ভান করে পড়ে রইল। রাত যখন গভীর, তখন কুমার দেখতে পেল, ঘরের কোণের ছদরক ফুল থেকে এক পরমা সুন্দরী কন্যা বের হয়ে আসছে।
কুমার অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল, তার চোঁখে আর পলক পড়ে না। সুন্দরী মেয়েটি প্রথমে ঘরের জিনিসপত্র সুন্দরভাবে সাজালো। তারপর ভাত রাঁধতে বসল।
রাঁধা শেষ হলে, ভাতের অর্ধেক নিজে খেয়ে বাকী অর্ধেক পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখল। এরপর পানের বাটা খুলে পান সাজিয়ে মুখে দিল।
পান খেয়ে মুখ টুকটুকে লাল করে ফেলল। তারপরে কুমারের পরনের সাদা কাপড়ে পানের পিক লাগিয়ে দিয়ে টুক করে ছদরক ফুলটার মধ্যে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এই আশ্চর্য কান্ড দেখে কুমার হতবাক হয়ে রইল। সে পরের রাতের অপেক্ষায় রইলো। সে রাতেও একই ব্যাপার। এবার কিন্তু কুমার সুযোগের অপেক্ষায় রইল।
একে একে সব কাজ শেষে সুন্দরী মেয়েটি যখন কুমারের পরনের কাপড়ে যেইনা পানের পিক লাগাতে গেল। অমনি কুমার তার সুন্দর লম্বা চুল ধরে ফেলল।
কুমার জিজ্ঞেস করলো, “কে তুমি। কি তোমার পরিচয়?” সুন্দরী মেয়েটি তখন বলে উঠল-
“কুমার রে কুমার
লেজত্ ন ধরিচ
পেজত্ ধর”
বাংলাঃ- “কুমার চুলে না ধরে আঁচলে ধরো”
কুমার যেই না চুল ছেড়ে দিয়ে আঁচল ধরতে গেল, তখন মেয়েটি সুরৎ করে ছদরক ফুলের ভিতরে ঢুকে গেল। কুমার তখন আর কি করে।
পরের রাতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। এবার আর কুমার ভুল করলো না। যেই না মেয়েটি তার কাপড়ে পানের পিক লাগাতে গেল, অমনি কুমার মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরল। তার পরিচয় জিজ্ঞেস করল। হঅ্’বি তখন কাঁদতে লাগলো।
কাঁদতে কাঁদতে তার সৎমা আর সৎবোনের ষড়যন্ত্রের কথা সব খুলে বললো। হঅ্’বিকে ফিরে পেয়ে কুমার আনন্দে আত্নহারা হয়ে গেল।
দুজনের কথা আর ফুরায় না। কথা কথা বলতে বলতে কখন যে ভোর হয়েছে সেদিকে তাদের খেয়ালই রইলনা।
সকালে হঅ্’বিকে দেখে রাজবাড়ির সকলে যারপর নাই অবাক হয়ে গেল। তাদের প্রিয় পুত্রবধুকে আবার ফিরে পেয়ে রাজবাড়িতে আনন্দের সাড়া পড়ে গেল।
নিমিষে রাজবাড়িতে আগের সেই প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসলো। এদিকে শয়তান বুড়ির মেয়ে ধঅ্’বি দেখে মহাবিপদ। তাদের সব ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেছে।
এবার নিশ্চিত প্রাণটা যাবে। প্রাণের মাইয়া বড় মায়া। প্রাণে বাঁচার জন্য ধঅ্’বি হঅ্’বির পায়ের উপর আছড়ে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে ক্ষমা চাইলো।
হঅ্’বির মন ছিল খুব নরম। ধঅ্’বির কান্না দেখে তার মন গলে গেল। তার সব দোষ মাফ করে দিল। তবে রাজবাড়ির লোকজন তাকে দুরদুর করে তাড়িয়ে দিল।
কঅ্’বিকে পেয়ে রাজারাণী মহাখুশি। রাজবাড়িতে যেন খুশির মেলা বসল। রাজার আদেশে সারারাজ্যে সাতদিন সাতরাত ধরে আনন্দ উৎসব চলল।
সমস্ত রাজ্যে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। কুমারের আদেশে হঅ্’বির বুড়ো বাপকেও সসম্মানে রাজবাড়িতে আনা হলো। কুমার তাকে একেবারে রাজবাড়িতে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করলো। বাপকে কাছে পেয়ে ধ’বি মহাখুশি।
তার সুখে কুমারও সুখী। আরো বেশি সুখী হলো রাজ্যের সকল প্রজা। পরে রাজারাণী গত হলে কুমার রাজা আর হঅ্’বি রাণী হয়ে পরম সুখে রাজ্যশাসন করতে লাগলো।
কিংবদন্তী আছে, আমাদের দেশে যে হলুদ পাখি দেখা যায়, হঅ্’বিই সে পাখি হয়ে এখনো আছে।
(১) এক প্রকার মাটির তৈরী জলপাত্র। দেখতে অনেকটা গাড়ুর মত, গলাটা সরু আর লম্বা।
(২) চাল রাখার জন্যে এক প্রকার বেতের টুকরী।
বঙ্কিম কৃষ্ণ দেওয়ান, চাকমা রুপকাহিনী – ২০০০ ইং, রাঙামাত্যা (রাঙ্গামাটি)
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।