চাকমা লোককথাঃ শিয়ালনীর উপস্থিত বুদ্ধি

Jumjournal
Last updated Mar 23rd, 2020

949

featured image

এক বনে থাকত এক শিয়াল আর এক শিয়ালনী। ওরা জুটি বেঁধেছে খুব বেশিদিন হয়নি। তাই ওদের নির্দিষ্ট কোনো আস্তানা নেই। ওরা বনে বনে ঘুরে ফেরে, আহার খুঁজে খায়-দায় এবং দিন কাটায়।

শিয়ালনী কিন্তু গর্ভবতী হয়েছে। ঘনিয়ে এসেছে তার প্রসবের দিন। তাই শিয়ালনী একদিন শিয়ালকে বললো-“ওগো শুনছে, আমার সন্তান প্রসবের দিন প্রায় ঘনিয়ে এসেছে।

এক্ষুনি চলো, কাছাকাছি কোথাও একটা গর্ত খুঁজে নিই।” তা শুনে শিয়াল বললো – “সত্যিই তো, বাচ্চাদের নিরাপত্তার জন্য একটি ভাললা আস্তানা দরকার।

তাই চলো, দু’জনে মিলে সুবিধেমতন গর্ত একটি খুঁজে বের করি।” এই কথা বলাবলির পর ওরা দুজনেই একসঙ্গে একটি গর্ত খুঁজতে বেরুল।

 কিছুদুর যেতে-না-যেতেই হঠাৎকঁকিয়ে উঠলো শিয়ালনী। সে কঁকাতে কঁকাতে শিয়ালকে বললো – “আমার তো প্রসব যন্ত্রনা শুরু হয়ে গেছে। আমি আর হাঁটতে পারছি না।”

তা শুনে শিয়াল পরম সহানুভূতির দৃষ্টিতে শিয়ালনীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো -“কষ্ট করে কোনমতে চলার চেষ্টা করো, হয়তো কাছাকাছি কোথাও কোন একটা গর্ত-তর্ত পেয়েও যেতে পারি।”

শিয়ালনী তার যন্ত্রনাক্লিষ্ট বিবর্ণ মুখখানি তুলে বললো –“দেখা যাক কতটুকু যাওয়া যায়, চলো।” শিয়ালের কথায় শিয়ালনী প্রসবযন্ত্রনা সহ্য করে চলার চেষ্টা করলো।

কিন্তু একটুখানি গিয়েই সে মাটিতে ধড়াস করে বসে পড়লো এবং বললো– “না, আর কিছুতেই পারছি না। আমার দারুণভাবে প্রসবযন্ত্রনা শুরু হয়েছে। দেখছি এখানে এই খোলা জায়গায় আমাকে সন্তান প্রসব করতেই হবে।”

এই বলে শিয়ালনী কারাতে লাগলো প্রচন্ডভাবে। এই অবস্থায় শিয়াল বেচারা আর কী-ই বা করতে পারে! সে নির্বাক হয়ে কাতর ও সহানুভূতির দৃষ্টিতে কেবল শিয়ালনীর দিকে তাকিয়ে রইলো।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে প্রচন্ডভাবে গোঙানী ও হাত-পা নেড়ে ছটফট করার পর শিয়ালনী একের পর এক পাঁচটি সন্তান প্রসব করলো। সন্তান প্রসবের পর সে কিছুক্ষণ নিশ্ৰুপ ও নিথর হয়ে রইলো।

এরপর সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে ক্লান্ত ও ক্ষীণ গলায় শিয়ালকে বললো- “প্রসবের পর আমি বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছি। আমার ক্ষিধেও পেয়েছে প্রচন্ডভাবে। এই অবস্থায় তুমি আমার জন্য কিছু আহার যোগাড় করে এনে দাও।”

শিয়ালনীর কথা শুনে শিয়াল বললো– “তাহলে আমি এক্ষুনি আসছি। তুমি বাচ্চাদের নিয়ে সাবধানে থেকো।” এই কথা বলে শিয়াল আহারের সন্ধানে হন্ হন করে চলে গেল।

শিয়াল আহারের সন্ধানে চলে যাবার কিছুক্ষণ পরেই শিয়ালনী দেখতে পেল অদূরে বেশ মোটাসোটা একটা ডোরকাটা বাঘ লেজতুলে তার দিকে তাক করে চুপিসারে এগিয়ে আসছে।

তা দেখে শিয়ালনী শিউরে উঠলো। এই সংকটময় মুহূর্তে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য কি করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ-ই যেন শিয়ালনীর মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেল।

সে তখন বাঘটাকে দেখেও না দেখার ভান করে আপন মনে বিড় বিড় করতে লাগলো-সন্তান বিয়োবার পর আমার এমনই ক্ষিধে পেয়েছে যে, এখন সামনে যাকে পাই তাকেই খাই।

আর ঐ নিকম্মার টেকি শিয়ালটার কথা তো বলে লাভ নেই। তাকে কখন যে পাঠালাম আস্ত একটা জ্যান্ত বাঘ ধরে আনবে বলে, তারও দেখা নেই।

আহা! এই মুহূর্তে যদি একটি জ্যান্ত বাঘের কজে খেতে পেতাম, তাহলে কতোই না মজা হতো।

দূর থেকে শিয়ালনীর কথাগুলো বাঘ শুনতে পেল। শোনা মাত্রই বাঘের পিলে গেল চকে। এ আবার বলে কি! জ্যান্তু বাঘের কজে খাবে?

আমার ভাগ্য ভালো মাঝপথে শেয়ালের সঙ্গে দেখা হয় নি অথবা এক্ষুনি শিয়ানীর কথাগুলো শুনতে পেয়েছি, তা না হলে আজ তো বেঘোরে আমার প্রাণটি চলে যেতো।

বাঘটি ভাবলো এই মুহূর্তে সে করবেটা কী? সে তখন পড়িমরি করে লেজতুলে দিল ছুট আর ছুট। থামার নামগন্ধ নেই-পেছন ফিরে তাকাবার ফুরসৎ নেই।

বাঘটাকে এমন বেহাল অবস্থায় ছুটতে দেখে গাছের উপর তেকে একটি হুলো বানর বাঘটাকে উচ্চৈঃস্বরে ডেকে বললো- “ও-বাঘমামা, ও-বাঘমামা, হয়েছে কি?

এমন মরণপণ ছুটছো কেন? বানরের ডাকশুনে বাঘটি থমকে দাঁড়ালো। আর হাঁফাতে হাঁফাতে বললো-“আর বলিস্ নে ভাগ্নে, ভাগ্যিস্আমি দূর থেকে শিয়ালনীর কথাগুলো শুনতে পেয়েছিলুম, নইলে আজ বাপের দেয়া প্রাণটিই হারাম।

সে বলে কিনা, জ্যান্তবাঘের কজে খাবে।” বাঘের কথা শুনে বানরটি হোঃ-হো-হোঙ করে হেসে উঠলো এবং বললো- “বলছো কি মামা, শিয়ালনী জ্যান্ত বাঘের কলজে খাবে?

এমন আজব কথাতো কক্ষনো শুনিনি”। বানরের কথায় বাঘ বেশ রেগেমেগে বললো – “ভয়ে আমার এদিকে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবার অবস্থা, আর তুমি কিনা দিব্যি হাসছে। আমি শিয়ালনীর কথাগুলো নিজের কানে শুনে এলাম।

আসলে তুমি তো দেখোনি, শিয়ালনীর চেহারাটা ছিল সত্যিই ভয়ঙ্করী। কাছে গেলে নির্ঘাৎ আজ প্রাণটি আমার চলে যেতো।

তাই ভাগ্নে, তুই যা বলিস নে কেন, আমি কিন্তু পালাচ্ছি।” এই বলে বাঘটি পূনরায় লেজ তুলে দৌড়াতে লাগলো। বানরও কিন্তু ছাড়বার পাত্র নয়।

সে বাঘের পিছে পিছে দৌড়াতে দৌড়াতে বলতে লাগলো -“ও বাঘমামা! ও বাঘমামা! আমার কথাটি একবার শোন তো।” বানরের ডাকশুনে বাঘটি পূনরায় থামলো।

তখন বানরটিও থেমে গিয়ে বলতে লাগলো-“মামা,আমারকথাটি একবার গভীরভাবে ভেবে দেখো।

এমন ছোটখাটো শিয়াল কেমন করে তোমার মতো বলবন্ত পশুরাজকে ধরে খাবে, বলো? সাধারণ শিয়ালের ভয়ে তোমার যদি এমন দশা হয় এবং এই খবর যদি বনের অন্যপশুদের মধ্যে চাউর হয়ে যায়, তখন তোমার মান-ইজ্জত থাকবে কি?”

বাঘটি হাঁফাতে হাঁফাতে বললো- “তোমার কথা সবই ঠিক আছে। কিন্তু ভাগ্নে, ঐ শিয়ালনীটা তার কথাগুলো এমন জোর দিয়ে বলছিল যে, সামনে পেলে সে সত্যিই আমাকে জ্যান্ত চিবিয়ে খেতো।

তাছাড়া, সন্তান বিয়োবার পর তার সেই কঙ্কালসার চেহারাটা আমার কাছে এমন বিদঘুটে লেগেছিলো যে, তারদিকে তাকাতেই আমি চমকে গিয়েছিলাম।

আমার মনে হয়েছিল তার উপর নিশ্চয়ই কোন জাদুশক্তি ভর করেছে। তা না হলে, সাধারণ এক শিয়ালনী কী করে এতো জোর দিয়ে এমন কথা বলতে পার?”

বাঘের এই আতঙ্কিত সংলাপ শুনে বানরটি বুঝলো এখন বাঘের অবস্থা এমন হয়েছে যে তাকে আর যুক্তি দিয়ে কিছুই বোঝানো যাবে না।

তাই সে কথার সুর পাল্টে নিয়ে বললো — “আচ্ছা মামা, তোমার কথা না হয় আমি মানলাম। কিন্তু সদ্যপ্ৰসবা সেই শিয়ালনীর চেহারাটা কেমন ভয়ঙ্করী , তা আমাকে একবার দেখাবে তো?”

বাঘ চীৎকার করে বললো, – “না ভাগ্নে, না! তুমি যা-ই বলো না কেন আমি কিন্তু ওদিকে কিছুতেই আর পা মাড়াচ্ছি না। বানর বাঘমামাকে পূনরায় শান্ত গলায় বুঝিয়েসুঝিয়ে বললো- “বাঘমামা, আমরা কি ওদিকে গেলেও থোরাই ওর নাগালের কাছে যাবো ? আমরা তাকে দেখবো নিরাপদ দূরত্ব থেকে। তাছাড়া এখন তো তুমি আর একা। নও। আমিও বরাবর তোমার সঙ্গেই থাকবো।”

বানরের কথা শুনে এবার বাঘটি কিছুটা যেন আশ্বস্ত হলো। সে একটুখানি ভেবে নিয়ে বললল – “তুমি একা নও বলচো কেন? কাছে গেলে শিয়ালনী যদি সত্যি সত্যি আমাদের আক্রমণ করে বসে, তখন তুমি তো একলাফে চড়ে যাবে গাছের উপর, আর অমি পড়ে থাকবো গাছতলায়মাটিতে।”

বানর তখন বললো-“আচ্ছা মামা, তুমি যদি চাও তাহলে আমরা দু’জনের লেজএকসঙ্গে বেঁধে নিতে পারি। উভয়ের লেজ একসঙ্গে বাঁধা থাকলে আমি তোমাকে ছেড়ে কক্ষনো পালিয়ে আসতে পারবো না। কেমন, এই শর্তে রাজী তো ?”

বাঘ ভেবে দেখলো – প্রস্তাবটি মন্দ নয়। সে তখন রাজী হলো এবং কথামতো তারা উভয়েই লেজের অগ্রভাগ একসঙ্গে শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধলো। তারপর অতি সন্তর্পণে চললো সেই ভয়ঙ্করী শৃগালিনীর সন্দর্শনে।

তারা শিয়ালনীর নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে পৌঁছতেই সদা-সতর্কিত শিয়ালনী তাদের দেখতে পেল। বাঘ ও বানরকে লেজে লেজে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পেয়ে সে প্রথমেই হকচকিয়ে গেল।

কিন্তু একটুখানি ভেবেই সে অনুমান করতে পারলো যে, বানরটির উস্কানিতেই অবশ্যই ঘটতে চলছে এই অভূতপূর্বকাভটি।

তাই শিয়ালনী পূনরায় সেই আগের ভঙ্গীতেই আপন মনে বলতে লাগলো- “শিয়ালটির দেরী হচ্ছে দেখে একটি দুলো বানরকে ডেকে এনে তাকে পেটভরে ফলমূল খাইয়ে-দাইয়ে এতো করে বললাম যে, লক্ষী ভাইটি আমার, তুমি একটি জ্যান্তবাঘ ভুলিয়ে – ভালিয়ে লেজে বেঁধে নিয়ে এসো তো।

কিন্তু হতচ্ছাড়া সেই বানরটিরও দেখা নেই। যত্তোসব নিকম্মার দল। কেবল মুখে বড়ো বড়ো কথা আর কাজে অষ্টরম্ভা । এদিকে জ্যান্তবাঘের কলজে খেতে না পেয়ে আমার যে প্রাণ যায়!”

শিয়ালনী তার কথাগুলো এমন জোরে জোরে এবং সুষ্পষ্টভাবে বললো যাতে বাঘ ও বানর উভয়েই শুনতে পায়। বলাবাহুল্য, বাঘ ও বানর দু’জনেই পরিস্কারভাবে শিয়ালনীর কথাগুলো শুনতে পেল।

সঙ্গে সঙ্গে বাঘটি রেগে গিয়ে বলে উঠলো “বিশ্বাসঘাতক বানর কোথাকার! আমাকে বলি দেওয়ার জন্য তোমার তাহলে এই ষড়যন্ত্র !”

এই বলে সে আর কোন কথা না বলেই দিল দৌড়। তখন বাঘ ও বানরের কান্ড আর দেখে কে। বাঘের লেজের টানে হাঁচড়ে চললো বানর। এদিকে বানরটি যন্ত্রনায় মরণ-চীৎকার দিয়ে উঠলো এবং জোরে জোরে বলতে লাগলো -“ও মামা, শিয়ালনী মিথ্যে কথা বলছে-তার কথা তুমি বিশ্বাস করোনা” কিন্তু কে কার কথা শোনে।

বাঘের থামাথামির নামগন্ধ নেই। সে ছুটছে তো ছুটছেই। আর এদিকে বানরটি হাঁচড়ে চলছে তো চলছেই। বাঘের এই হ্যাঁচড়া টানে বানরের প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবার অবস্থা।

এই ভাবে হ্যাচড়িয়ে যেতে যেতে এক সময় বানরটি মস্তবড়ো একটি গাছের গুড়িতে গেল আটকে। তখনই বাঘের প্রচন্ড হ্যাচকা টানে হঠাৎ খুলে গেল উভয়ের লেজের বাঁধন।

ছাড়া পেয়ে বাঘটি আর পেছন ফিরে না তাকিয়েই দৌড়ে পালালো। আর বেচারা বানরটি তার ক্ষত-বিক্ষত দেহটি নিয়ে মূমুর্ষ অবস্থায় যন্ত্রণায় গোঙাতে গোঙাতে গাছের গুঁড়িতে রইল পড়ে। এদিকে শিয়ানলী এই অভূতপূর্ব দৃশ্যটি দেখে বেজায় হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরাল।

তথ্যসূত্র: ত্রিপুরার আদিবাসী লোককথা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা