চাকমা লোককথা: সাদা কাক কালো হল কেন
1196
একটি শ্রীফল গাছে শ্রীফল পেকেছে । টকটকে লাল শ্রীফল। দূর থেকে তা দেখতে পেল একটি ধবধবে সাদা কাক। উড়ে এসে কাকটি জুড়ে বসলো শ্রীফল গাছের মগডালে।
কিন্তু যেই সে ঠোকর মেরে একটি শ্রীফল খেতে যাবে অমনি শ্রীফলটি চীৎকার করে বলে উঠলো – ছিঃ ছিঃ, তোমার ঠোটটি এঁটো । তুমি পঁচা-টচা খাও– নোংরা খাও। আমাকে খেতে হলে যাও তোমার ঠোঁটটি আগে ধুয়ে এলো।
শ্রীফলের কথা শুনে কাক বেজায় লজ্জা পেল। সে ভাবলো- সত্যিই তো অমন সুন্দর লাল টকটকে ফল খাওয়ার আগে ঠোটটি আমার ধুয়ে আসা দরকার ছিল।
তাই সে ঠেটিটি ধোয়ার জন্য উড়ে গেল পাশের একটি নদীতে। কিন্তু সে গলা বাড়িয়ে নদীর জলে যেই তার ঠোটটি ডোবাতে যাবে অমনি নদীর জল চীৎকার করে বলে উঠলো- ছিঃ ছিঃ, তোমার নৌঁরা ঠোট জলে ছোঁয়াবে না। তুমি পঁচা-টচা খাও।
ঠোটটি ধুতে হলে বরং তুমি একটি মাটির হাঁড়ি নিয়ে এসো। তাতে জল ভরে নিয়ে তবেই তুমি তোমার ঠোটটি ধুতে পারবে। তখন কাক উড়ে গেল গাঁয়ের এক কুমোরের কাছে। গিয়ে সে কুমোরকে নিবেদন করে বললোঃ
কুমোর রে কুমোর ভাইটি আমার দেবে হাঁড়ি তুলবো জল ধুবো ঠোঁট তবেই খাবো
লাল শ্রীফল।
কাকের কথা শুনে বয়েসের ভারে ন্যুজ কুমোর বললো- দ্যাখছে না, আমার জিরজিরে শরীর। মাটি তুলতে পারি না, তাই হাঁড়ি-কলসীও বানানো হয় না।
তুমি অনুরোধ করে বলছো যখন অবশ্যই তোমার জন্য একটি হাঁড়ি বানিয়ে দেব। তবে আমার জন্য পাশের ঝিলের পাড় থেকে কিছু মাটি এনে দাও।
কুমোরের কথায় কাক গেল ঝিলের পাড়ে মাটির কাছে। গিয়ে মাটিকে অনুরোধ জানিয়ে বললোঃ
মাটি লো মাটি কাঁদা মাটি দেবে মাটি একটুখানি, কুমোর বানাবে হাঁড়ি তুলবো জল ধুবো ঠোঁট। তবেই খাবো লাল শ্রীফল।
কাকের কথা শুনে মাটি চাপাগলায় বললো- একটুখানি কেন? যতো ইচ্ছে মাটি তুমি নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু বলি, মাটি তুমি খুড়বে কি ভাবে? তুমি বরং মহিষের কাছে যাও।
তার কাছ থেকে একটি শিং বলেকয়ে নিয়ে এসো। তা দিয়ে তুমি মাটি খুঁড়তে পারবে। | মাটির কথা শুনে কাক শিগগির উড়ে গেল এক মর্দা মহিষের কাছে। গিয়ে সবিনয়ে বললোঃ
মহিষা রে মহিষা শিং-অলা মহিষা দেবে ভাই একটি শিং খুঁড়বো মাটি। কুমোর বানাবে হাঁড়ি, তুলবো জল ধুবো ঠোট। তবেই খাবো লাল শ্রীফল।
কাকের মুখে অমন ছিরি কথা শুনে চোখ দুটি কপালে তুলে আর কান দুটি খাড়া করে মহিষ বললো-তুমি বলো কি! জ্যান্ত অবস্থায় আমি তোমাকে কেমন করে আমার শিং দেবো? এই শিং আমার পৌরুষত্বের প্রতীক – আত্মরক্ষার হাতিয়ার।
এ দিয়ে আমি শত্রুদের গুতো মারি, প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করি। তবে তা তুমি এতো করে অনুরোধ করছে যখন তোমাকে তাই এটুকুন বলতে পারি- যেদিন আমি বুড়ো হয়ে মারা যাবে, সেদিন তুমি আমার দু’দুটো শিং তুলে নিয়ে যেতে পারবে।
বরং তুমি এদ্দিন অপেক্ষা করো গে। মহিষের কথা শুনে কাক তো থ বনে গেল। ব্যাটা বলে কি! অমন পুরুষ্ট ও বলিষ্ঠ মহিষ কবে যে মারা যাবে কে জানে। তবে কি অনির্দিষ্টকাল ধরে তার মরণ অপেক্ষা করতে হবে আমাকে?
তাই কাক অন্য এক উপায়ের কথা চিন্তা করলো। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে হাজির হলো বাঘের কাছে। এবং গিয়েই সে বাঘকে করজোড়ে প্রণাম জানিয়ে বললোঃ
বাঘ মামা বীরের পুত্, মারবে মহিষ নেবো শিং খুঁড়বো মাটি কুমোর বানাবে হাঁড়ি তুলবো জল ধুবো ঠোট তবেই খাবো লাল শ্রীফল।
কাকের এই নিবেদনটুকু শোনার পর বাঘ শোওয়া অবস্থা থেকে হাঁটু গেড়ে বসলো এবং বললো- ভাগ্নে, এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব।
মহিষ মারার কথা বলায় আমার তো জিহ্বায় জল এসে গেছে। কিন্তু দ্যাখছো না, আমি বুড়ো হয়েছি। বুড়ো হলে যা হয়, নানা অসুখে-বিসুখে আমার শরীরও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সেই পুরুষ্ট মর্দা মহিষটার ঘাড় মটকে দেবো এখন আমার অমন শক্তি কই।
বরং তুমি এক্ষুনি যাও এক দুধেল গাভীর কাছে। আমার জন্যে কিছু দুধ আনে গে। দুধ খেলে আমার শরীর পূনরায় তাজা হবে-শরীরে শক্তি বাড়বে।
তখন আমি বেয়াড়া মহিষটিকে মেরে তার সুস্বাদু মাংস খেতে পাবো, আর তুমিও মহিষের শিং দু’টো নিয়ে যেতে পারবে।
বাঘের কথায় সন্তুষ্ট হয়ে কাক ছুটে গেল এক গোয়াল ঘরে গাভীর কাছে। গিয়ে গাভীটাকে মিনতি করে বললো :
গুলো মাসি দুধেল গাভী, দেবে দুধ খাবে বাঘা, হবে বলমারবে মহিষ নেবো শিং, খুড়বো মাটি কুমোর বানাবে হাঁড়ি তুলবো জল ধুবো ঠোঁট তবেই খাবো লাল শ্রীফল।
কাকের কথা শুনে বেচারী গাভী মিনমিনে গলায় বললো,- দ্যাখছো না বোনপো, আমার ছোট্ট বাছুরটির চেহারা — প্রায় মারা যাবার অবস্থা।
গেরস্ত আমাকে সারাদিন বেঁধে রাখে গোয়াল ঘরে। তাজা ঘাস খেতে দেয় না। কেবল একবেলা শুকনো খড় খেতে দেয়। তা দিয়ে কি দুধ হয় বললা?
তাই তোমাকে বলছি শোন- যদি দুধ তুমি পেতে চাও, তাহলে আমাকে কিছু তাজা ঘাস এনে দাও?
গাভী বেচারীর করুণ অবস্থার কথা শুনে কাক দয়ার্দ্র চিত্তে ঝপাটু ঝপাট শব্দ করে ঝিলের ধারে বাতাসে আন্দোলিত ঘাসের কাছে গিয়ে বললোঃ
ঘাস রে ঘাস সবুজ কচিঘাস, দেবে ঘাসের আঁটি পরিপাটি, খাবে গাভী হবে দুধ খাবে বাঘা হবে বল , মারবে মহিষ নেবো শিং। খুঁড়বো মাটি কুমোর বানাবে হাঁড়ি তুলবো জল। ধুবো ঠোঁট। তবেই খাবোর
লাল শ্রীফল।
শুনে ঘাস বললো- আমি তোমাকে কেমন করে ঘাস দেবো বললা? একখানি কাস্তে দিয়ে তোমাকেই ঘাস কেটে নিয়ে যেতে হবে।
তাই বলছি, তুমি যাও কামারের কাছে। তার কাছ থেকে কাস্তে একটি এনে যতো ইচ্ছে ঘাস কেটে নাও।
ঘাসের পরামর্শ মতো এবার কাক গেল এক বুড়ো কামারের গাছে। গিয়ে সে কামারকে সম্মান জানিয়ে বেশ বিনয়ের সুরে বললো :
কামার রে কামার। শিল্পী চমৎকার, দেবে আমায় কাস্তে কাটবো ঘাস, খাবে গাভী হবে দুধ, খাবে বাঘা হবে বল মারবে মহিষ নেবো শিং খুড়বো মাটি কুমোর বানাবে হাঁড়ি তুলবো জল। ধুবো ঠোঁট তবেই খাবো লাল শ্রীফল।
কথা শুনে কামার বিষন্ন গলায় বললো- দ্যাখছে না, আগুনের অভাবে হাঁপর আমার জ্বলছেনা। ছাদ বেয়ে জল পড়ে তা নিভে গেছে।
আমি কাস্তে বানাবো কেমন করে। তাই কাস্তে যদি একখানা পেতে চাও গেরস্তের বাড়িতে যাও । গেরস্তকে বলে আগুন নিয়ে এসো। | এবার কাক গেল এক গেরস্তের বাড়িতে। গিয়ে গেরস্তকে সে বললোঃ
গেরস্তরে গেরস্ত গেরস্ত কাজে বেশ দড়,দেবে আমায় আগুন কামার জ্বালাবে হাঁপর বানাবে কাস্তে কাটবো ঘাস খাবে গাভী হবে দুধ খাবে দুধ বাঘা হবে বল।
মারবে মহিষ নেবো শিং খুড়বো মাটি কুমোর বানাবে হাঁড়ি তুলবো জল ধুবো ঠোট তবেই খাবো লাল শ্রীফল।
কাকের একনাগাড়ে-বলা দীর্ঘ এই কাজের ফিরিস্তি শুনে গেরস্ত একটু মুচকি হেসে বললো- তোমার শ্রীফল খাওয়ার অমন মহৎ কর্মটি কেন্দ্র করে এত্তোসব কান্ড কারখানা যখন ঘটতে যাচ্ছে এবং তাসবইসম্পন্ন হতে এখন আগুনই একমাত্র দরকার, তাই আগুন দিতে আমার কী-ই বা আপত্তি থাকতে পারে!
কিন্তু বলি, তুমি আগুনটা নেবে কেমন করে? একটুখানি ভেবে গেরস্ত নিজেই আবার বললো- তবে হ্যাঁ, একটি উপায় অবশ্যই আছে। আমি একটি আগুন গুঁজে দেওয়া খড়ের বেণা তোমার লেজের পাখনার সঙ্গে বেঁধে দিচ্ছি।
এই বলে গেরস্ত একটি খড়ের বেণাতে একটি জ্বলন্ত অঙ্গার গুজে দিয়ে তা কাকের লেজে বেঁধে দিল।
আগুন পেয়ে কাক খুশিতে ডগমগ হয়ে অগুনযুক্ত খড়ের বেণাটি নিয়ে আকাশ পথে উড়ে চললো বায়ুবেগে বুড়ো কামারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু একটুখানি উড়ে গিয়েই দমকা বাতাসে ধুমায়িত খড়ের বেণাটি উঠলো জ্বলে দাউ দাউ করে।
তখন তার সহজ দাহ পাখনা সহ কাকটির আস্ত শরীর জ্বলে-পুড়ে যাবার অবস্থা। কাক দেখলো এ তো মহাবিপদ!
সে কোন উপায়ান্তর খুঁজে না পেয়ে তৎক্ষণাৎ আগুন নেভাবার জন্য অন্য এক গেরস্তের উঠোনে রাখা কালো রঙের জলে ভর্তি এক মস্তবড় গামলার দিকে পড়িমরি করে উড়ে গিয়ে তার জলে দিল এক ডুব।
তাতে অগুন নিভে গিয়ে কাকের প্রাণ বাঁচলো বটে, কিন্তু কালোরঙে ডুব দেওয়ার ফলে ধবধবে সাদা কাক হয়ে গেল মিনমিনে কালো। সেই থেকে কাকের রঙ চিরতরে হয়ে গেল কালো।
আর এদিকে আগুন নিয়ে কাকের পৌছানো সম্ভব হলো না কামারের কাছে,কামারের দ্বারা বানানো হলো না কাস্তে, কাটা হলো না ঘাস, গাভীর হলো না ঘাস খাওয়া, হলো না সে পয়স্বিনী, বাঘের হলো না দুধ খাওয়া, তাই তার দ্বারা মারা হলো না বেয়াড়া মোষটাকে, পাওয়া গেল না মোযটার শিং, খোঁড়া হলো না মাটি, মাটি না পেয়ে কুমোরর দ্বারা বানানো হলো না মাটির হাড়ি, হাঁড়ির অভাবে কাকের ধোয়া হলো না এটো ঠোঁট এবং ঠোট না ধোয়ার ফলে কাকের আর কক্ষনো খাওয়া হলো না অমন লোভনীয় টকটকে লাল শ্রীফল।
তথ্যসূত্র: ত্রিপুরার আদিবাসী লোককথা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।