চাকমা লোককথা: দশ ক্ষুদে মুরগী ছানার প্রতিশোধ
905
বুনো মুরগীটি সবেমাত্র ডিম পেরেছে। মোট এগারটি ডিম। মুরগীটি সকালসন্ধ্যে নিয়মিত ডিমে তা দেয়।
একদিন এক বুনো বেড়াল দেখতে পেল মুরগীটিকে। দেখেই খাবার লোভে বেড়ালের জিহ্বায় যেন জল এসে গেল।
সে তখন থেকেই চুপি চুপি খবর নিতে থাকলো মুরগীটি কোন দিক থেকে আসে, কোনদিকে যায় এবং কোথায় থাকে।
এমনি করে একদিন সে খোঁজ পেল মুরগীটির আস্তানা। জানলো মুরগীটি থাকে একটি বড়সড় গাছের গোড়ায় গুল্ম-লতার ঝোপের আড়ালে এক নিরাপদ আস্তানায়।
সে ডিম পেরেছে। এখন সকাল-সন্ধ্যে নিয়মিত ডিমে তা দেয়। বুনো বেড়ালটি ঝাপটি মেরে মুরগীটিকে ধরে খাবার তালে সুযোগ খোঁজে।
এদিকে বুননা মুরগীটিও বেশ সেয়ানা। সে মাঝে-মধ্যে দেখতে পায় বুনো বেড়ালটিকে, দূর থেকে তার দিকে লোভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত।
সে বেড়ালটির মতিগতি আঁচ করতে পারে। বিপদের আশঙ্কায় তার বুকটি কাঁপে।
কিন্তু ডিমগুলো না ফুটিয়ে বেড়ালটির নাগালের বাইরে কোথাও চলে যাবার এখন যো নেই তার।
যেভাবেই হোক ডিমগুলোতে তার তা দিতে হবে এবং ডিম থেকে ছানাদের ফোটাতে হবে।
তাই সে অতি চুপিসারে বুনো বেড়ালটির নজর এড়িয়ে সময় পেলেই ডিমে তা দিতে থাকে যেন শীঘ্রই ডিমগুলো ফুটিয়ে ছানাদের নিয়ে দূরে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে চলে যেতে পারে।
একদিন মুরগীটি দুপুর বেলায় বেড়ালকে ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে তার ডিমগুলোতে তা দিতে থাকে।
দীর্ঘক্ষণ ডিমে তা দেয়ার ফলে সেদিন ডিমগুলো ফেটে তার ছানাগুলো বেরিয়ে আসে। মোট দশটি ছানা। একটি ফোটেনি, নষ্ট হয়ে গেছে।
এদিকে মুরগী ছানাগুলো ডিমের খোলস থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই হাঁটাহাটি ছুটোছুটি শুরু করে দেয়।
তা দেখে মুরগী মা- এর যেন খুশিতে বুক ভরে যায়। সে আপন মনে ভাবতে থাকে এবার সেইনচ্ছার বেড়ালটির হাতে তার মৃত্যু হলেও মনে দূঃখ থাকবে না।
কারণ প্রকৃতির নিয়মে এই ক্ষুদে ছানাগুলো এখন চরে-ফিরে আহার যোগাড় করে বেঁচে থাকতে পারবে। এই ভেবে মুরগী-মা যেন সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পায়।
তবু সে আপদের কথা ভাবে বলা যায় না, এই নধর-কচি ছানাগুলোর প্রতিও রাক্ষুসে বেড়ালটির কু-নজর পড়তে পারে! তাই সে আগে থেকেই তাদের সতর্ক করার জন্য তার মমতাভরা বুং-কুৎ-কুৎ শব্দ করে ছানাদের কাছে ডেকে নেয় এবং সেই বুনো বেড়ালটির কু-মতলব সম্পর্কে তাদের বুঝিয়ে বলতে থাকে।
মা-মুরগীটি বলেশোন বাছারা, বুননা বেড়ালটি সহজে আমাদের পিছু ছাড়বে বলে মনে হয় না। তাই তোমরা সদা-সর্বদা সাবধানে থেকো।
যে কোন সময় যে কোন দিক থেকে এসে সে আক্রমণ করতে পারে।
সে বলে, আরেকটি কথা শোন মন দিয়ে- ভগবান না করুক, যদি দৈবাৎ সেই রাক্ষুসে বেড়ালটির হাতে আমার মৃত্যু ঘটে, তাহলে কিন্তু তোমরা দশ ভাইবোন মিলে যে-কোন উপায়ে হোক অবশ্যই তার প্রতিশোধ নেবে। দেখো, কক্ষনো রেহাই দেবে না সেই হতচ্ছাড়াকে।
সত্যিই মুরগী বেচারীর এমনই দৃভ্যগ যে, তার এই কথাগুলো শেষ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কোথা থেকে সেই বেয়াড়া বুনো বেড়ালটি অতর্কিতে এসে ঝপাৎ করে লাফ মেরে জাপটে ধরলো মুরগীটিকে।
এদিকে সন্ত্রস্ত মুরগী ছানারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে মুহূর্তের মধ্যেই ঝোপের আড়ালে পড়লো লুকিয়ে।
তারা আড়াল থেকে দেখলো সেই রাক্ষুসে বেড়ালটি তাদের মুরগী মা-কে অতি নির্মমভাবে দাঁতে কামড় দিয়ে, নখে আচড় মেরে রক্তাক্ত ও ক্ষত-বিক্ষত করে কিছুক্ষণের মধ্যেই মেরে ফেললো।
এরপর সে একটুখানি জিরিয়ে নিয়ে তাদের মুরগী মা-এর স্পন্দনহীন মৃত দেহটি মুখে খাবলে ধরে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে গেল নিজের আস্তানার দিকে।
ভাগ্যহীনা ও অসহায় মুরগী ছানাগুলো ঝোপের আড়াল থেকে আতঙ্কিত প্রাণে নিজেদের চোখে প্রত্যক্ষ করলো এমনই নির্মম ও নৃশংস দৃশ্যাবলী ।
তাও আবার আপন মায়ের হত্যাকান্ড। তারা যেন কিছুক্ষণের জন্য বিমূঢ় ও হতবাক হয়ে গেল।
এ ভয়াবহ ঘটনার অনেক্ষণ পরে ভয়ার্তচিত্তে একে একে তারা বেরিয়ে এলো ঝোপের আড়াল থেকে।
তারা চিচি শব্দে পরস্পর ডাকাডাকি করে একপাশে পড়ে থাকা। তাদের সেই ভ্রাতৃ প্রতিম নষ্টডিমটি সঙ্গে নিয়ে এই অকুস্থান ছেড়ে চলে গেল দূরবর্তী এক নিরাপদ স্থানে।
সেখানে তারা তাদের মৃত মুরগী মা-এর শোকে আপ্লুত অবস্থায় সবাই মিলে শল্লা করে মায়ের উপদেশ ও নির্দেশমূলক কথাগুলো স্মরণ করে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞা করলো সেই রাক্ষুসে বেড়ালকে হত্যা করে তারা অবশ্যই মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে।
এরপর থেকেই শুরু হলো ক্ষুদে দশ মুরগীছানার প্রতিজ্ঞাপূরণের পরিকল্পনা গ্রহণও কর্ম-তৎপরতা শুরু করার পালা।
নিজেদের মধ্যে পরামর্শ মতো তারা যোগাযোগ করতে লাগলো বিভিন্ন সহযোগী শক্তির সঙ্গে।
তারা দেখা করলো একটি কুকুর, একটি মুগুর, একটি পঁচা শশা ও একটি কাঁকড়ার সাথে।
তারা এদের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে তাদের মুরগী মা-এর নির্মম হত্যার ঘটনা, নিজেদের প্রতিজ্ঞা ও প্রতিজ্ঞাপূরণের জন্য প্রস্তাবিত পরিকল্পনার কথা বলে একে একে সকলের সহানুভূতি এবং সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আদায় করলো।
এরপর তারা অত্যন্ত চুপিসারে বেড়ালটির আস্তানার খোঁজ নিল। খোঁজ নিয়ে তারা জানতে পারলো যে, বেড়ালটি রাত্রে ঘুমোতে যায় একটি পরিত্যক্তজুমঘরে।
সেখানে সে ঘুমোয় উনুনের উপর স্তুপীকৃত ছাইগাদায়। তারা ঠিক করে নিল এই জুমঘরেই বেড়ালটিকে হত্যা করা হবে।
চূড়ান্ত পরিকল্পনা মতো তারা নির্দিষ্ট দিনে বেড়ালটির অনুপস্থিতিতে নিজেদের সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে অতি সন্তর্পণে হাজির হলো সেই জুমঘরে।
সেখানে গিয়ে সন্ধ্যের আগেই নিজ নিজ অবস্থানের স্থানগুলো তারা ঠিক করে নিল।
প্রথমে তারা তাদের ভ্রাতৃতুল্য নষ্ট ডিমটিকে রেখে দিল বেড়ালটির শোবার স্থান সেই ছাইগাদায় ছাইচাপা দিয়ে।
কাঁকড়াকে তারা থাকতে বললো রান্না ঘরে ফেলে রাখা একটি জলের হাঁড়িতে, পঁচা শশাকে বললো রান্নাঘরে দরজার মুখে থাকতে, মুগুরকে থাকতে বলল ঘর থেকে উঠোনে বেরোবার দরজাটির একপাশে, কুকুরকে থাকতে বললো উঠোনের এককোণায় এবং নিজেরা চুপচাপ লুকিয়ে রইলো রান্নাঘরের এক কোণায় এক লাউএর খোলর ভেতরে।
এদিকে সন্ধ্যে উতরে যেতেই বুননা বেড়ালটি সেদিনের শিকারপর্ব শেষ করে ফিরলো জুমঘরে।
সে হন্ হন্ করে ঢুকে পড়লো ঘরের ভেতরে এবং থামলে গিয়ে রান্নাঘরের উনুনের পাশে।
সেখানে গিয়ে সে শোবার জন্য ছাইগাদার উপর নড়ে-চড়ে বসতে গিয়ে তার একটি পা নষ্ট ডিমটির গায়ে লাগতেই ডিমটি ফেটে গেল বিকট শব্দে।
ডিমটি ফেটে গেল এমনভাবে যাতেতার পচা ঝোল ছিটকে পডলো বেড়ালটির চোখে-মুখে।
হঠাৎ বিকট শব্দশুনে বেড়লটি গেল ঘাবড়ে প্রচন্ডভাবে। সে চারদিক তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো।
কিন্তু পচাঝোল তার দু’চোখে লেপটে যাওয়ায় সে কিছুই দেখতে পেল না।
এরপর সে চোখ বন্ধ অবস্থায় হাতড়াতে হাতড়াতে কোন মতে গিয়ে পৌঁছলো রান্নাঘরের জলের হাঁড়িটার পাশে।
সেখানে গিয়ে জলের হাঁড়িতে মুখ ডুবিয়ে সে যেই চোখ দু’টি ধুতে গেল তখন কাঁকড়াটি তার দুটি দাঁড় দিয়ে বসিয়ে দিল কামড় বেড়ালের মুখে।
বেড়ালটি যন্ত্রনায় হাঁউ-মাউ করে উঠলো ।
ঠিক ঐ সময়েই রান্নাঘবের কোণা থেকে দশটি ক্ষুদে মুরগী ছানা একযোগে চিক্ চিক্ শব্দে চিৎকার করে উঠলো।
এবার বেড়ালটিগেল আরও ঘাবড়ে।
সে তার দুটি হাত দিয়ে কোনক্রমে কাঁকড়াটিকে ঝেরে ফেলে লেজতুলে পালাবার জন্য রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই পচা শশাটির উপর পা পড়ে গেল পিছলে।
হুমড়ি খেয়ে সে আছড়ে পড়লো গিয়ে ঘরের দরজার চৌকাঠের উপর। সেখানে মুগুরটি তৈরী হয়েই ছিল।
সে বেড়ালকে কশিয়ে দিল দু-দা কয়েক ঘা। বেড়ালটি কোমর বাঁকিয়ে কোনমতে পড়ি মরি অবস্থায় লাফ দিয়ে পড়লো উঠোনে একেবারেই কুকুরটির সামনে।
কুকুরটি তখন খাপাখপ। বেড়ালটির ঘাড়ে বসিয়ে দিল মস্ত এক কামড়।
বেড়ালটি আর নড়তেই পারলো না। কুকুরের কামড়ে বেড়ালটি কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা গেল।
ঠিক সে সময় লাউ-এর খোল থেকে দশটি ক্ষুদে মুরগীছানা বেরিয়ে এসে নেমে এল উঠোনে।
তারা দেখলো শয়তান বুনো বেড়ালটির নিথর দেহখানি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে উঠোনে।
এবার সত্যিই তাদের প্রতিজ্ঞা পূরণ হলো। তারা মাতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে পেরে যারপরনাই পরিতৃপ্ত হলো।
এরপর সহযোগী বন্ধুদের ধন্যবাদ জানিয়ে তারা নিজেদের আস্তানায় ফিরে গেল।
তথ্যসূত্র: ত্রিপুরার আদিবাসী লোককথা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।