পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা লেখক সমাজ ও সাহিত্য চর্চা
1966
আমার দৃষ্টিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের সাহিত্য চর্চা সম্পর্কে সব্যসাচী চাকমা সাহিত্যিক প্রয়াত সুহৃদ চাকমার মতো করে এ যাবত কালে কেউ এতো গভীরে গিয়ে আলোচনা করেছেন বলে আমার মনে হয়না।
তিনি তাঁর এ বিষয়ে নিখুঁত তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করে একটি সেরা গবেষণা প্রবন্ধ জাতিকে উপহার দিয়েছেন এবং সে প্রবন্ধতে তিনি চাকমা সাহিত্য চর্চা ও ক্রমবিকাশকে তিনটি ভাগ করেছেন।
এ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল সুহৃদ চাকমা স্মারকগ্রন্থে। উক্ত স্মারকগ্রন্থটি এ মূহুর্তে আমার সংগ্রহ হতে খুঁজে বের করতে পারলাম না বলেই এ লেখার সাথে সামঞ্জস্য রেফারেন্স উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হলাম।
বিষয়টি সুধিভিজ্ঞ মহল সদয় হয়ে ক্ষমার দৃষ্টি রাখবেন এমনটি আশা পোষণ করছি খুব দৃঢ়ভাবে।
যাহোক এক ধাপ দূ’ধাপ করে এগুতে এগুতে মহামান্য চাকমা রাণী বিনীতা রায় কর্তৃক সম্পাদিত গৈরিকার হাত ধরে যৌথবদ্ধভাবে চাকমা লেখক সমাজ গড়ে ওঠে এবং তাঁরা জাতিকে উপহার দেয় এক অনবদ্য কালজয়ী সাহিত্য।
এই গৈরিকা প্রকাশিত হয় চাকমা রাজবাড়ি হতে ১৯৩৬ সালে যা আজ হতে(২০২০-১৯৩৬=৮৪)৮৪ বছর পূর্বে। আর মাত্র ১৬ বছর পর অর্থাৎ ২০৩৬ সালে গৈরিকার একশত বছর পূর্তি হবে।
স্মরণে রাখতে হবে যে, গৈরিকার একশত বছর পূর্তি হওয়া মানেই তো চাকমা জাতির লেখক সমাজ সৃষ্টি হওয়া এবং পথ চলার একটি গর্বিত ইতিহাসের জন্ম।
এই ৮৪ বছরের অর্জনে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। পেয়েছি বিশ্ব সাহিত্য মানের শত কবিতা। রাজ কুমার খোকন দাক্ষ রায় নাট্য সাহিত্যকে সাজিয়ে গিয়েছেন তাঁর শ্রম ও মেধা দিয়ে।
বিনীতা রায়ের The Empthy Chair কবিতাটি প্রিয়জন বিয়োগের মর্মর ব্যথা উপলব্ধিকর একটি বিশ্ব সাহিত্য মানের কবিতা। রাজকুমারী অমিতা রায়ের First the mist, A light lunch, কবি সলিল রায়, কবি অরুণ রায়, কবি মুকুন্ড তালুকদার, কবি চুণী লাল দেওয়ান, কবি ফেলাযেয়্যে চাকমাসহ সমকালের বহু অমিত প্রতিভাধর কবি, সাহিত্যিক নিজ নিজ অবস্থান থেকে চাকমা সাহিত্যকে এক অনন্য স্তরে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছেন বা পৌঁছে দিয়ে গেছেন।
এমতাবস্থার প্রেক্ষাপটে চাকমা সাহিত্যজনদের অনবদ্য সৃষ্টি অস্বীকার করা বা অস্বীকার করতে সহায়তা করা অথবা নেপথ্যে থেকে অস্বীকারের প্রণোদনা যোগানো খু্বই দুঃখ জনক ও হতাশা ব্যঞ্জকও বটে।
আমিতো মনে করি আমাদের চাকমা সাহিত্যের কবিতা, নাটক, গীতি-কবিতা ও গদ্য সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক বেশি ফলপ্রসূ আলোচনা হওয়া দরকার।
কারোর অক্ষম মূল্যায়ন, একচক্ষু বিচার, সাহিত্য বিচারের ক্ষীণক্ষমতা, অমনোযোগীতা, অনুদারতা, অবমূল্যায়ন অথবা অতিরঞ্জিত মূল্যায়ন আমাদের সামগ্রিক প্রচেষ্টা এবং একান্ত ইচ্ছে শক্তিকে যেন বিচ্যুতি ঘটাতে না পারে সে দিকে সকলের সর্বদা দৃষ্টি রাখা একান্ত অপরিহার্য।
দেশ, অঞ্চল, কাল ও ঐতিহ্য এবং চাকমা সাহিত্যকে নিয়ে যাঁরা চিন্তা করেন, কাজ করছেন তাঁদের এগিয়ে আসা উচিত সর্বাগ্রে আর স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
কর্পোরেট সাহিত্য সমালোচক আমাদের সাহিত্য সমাজের এ মূর্হুত্বে প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করতে পারি না।
আমাদের প্রয়োজন সাহিত্যের নিখাঁদ সমালোচক যে সাহিত্য সমালোচক তাঁর সৃষ্টি সাহিত্য দ্বারা সাহিত্যের রূপ, রস ও মৌলিকত্ব যৌক্তিকতা উপস্থাপন করে চলমান সাহিত্যের বাঁকের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হবেন বা নুতন পথের সন্ধান দিতে পারবেন।
আর তার বিপরীত অবস্থান গ্রহণ অথবা অযাচিত সাহিত্য সমালোচনা হবে সাহিত্য সমাজকে গালাগাল করার সামিল।
এ ধরণের সাহিত্য সমালোচনার যৌক্তিকতা নেই এবং নেই কোন মৌলিকত্ব। আশার কথা হলো আমাদের চাকমা সাহিত্য সমাজে এখন তরুন কবি ও লেখকের সাহিত্য কাতারে বিচরণ চোখে পড়ার মতো।
আমি এমন তরুণ কবি ও লেখকদের সাহিত্য কর্ম দেখে আশাবাদী এবং আন্তরিকভাবে উৎফুল্লতা অনুভব করি।
পরিশেষে বলবো-
কে আছো জওয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে উজ্জ্বল ভবিষ্যত।
গত ২৮-০৩-২০২০ তারিখ শনিবার বিকাল সময়ে উপরিউক্ত (উপরোক্ত শব্দটি আমি ব্যবহার করি না) শিরোনামে আমি যৎসামান্য লিখে আমার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের আইডিতে পোস্ট করি।
আমার এমন কোন উদ্দেশ্য ছিল না যে, প্রসঙ্গটির বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখব কিন্তু আমার কয়েক হিতোকামীর ইনবক্সের ম্যাসেজ এ বিষয়ে না লিখে ইচ্ছে শক্তিকে আর দমন করে রাখতে পারলাম না।
আলোচ্য বিষয়টি একান্তই সাহিত্য আলোচনা ছাড়া আর কিছুই নয় যদিও বা সাহিত্য উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের খনিতে প্রবেশ করে অথবা সাহিত্যের সাগরে ডুবুরী হয়ে মণি মুক্তা খুঁজে ওঠে নিয়ে আসাও সম্ভব নয়।
কারণ, আমার একাডেমিক শিক্ষা, সাহিত্যে অধ্যয়ন, অনুধাবণ অথবা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করার উপযোগিতা আমার কোনটা নেই।
তথাপিও মনের জোর খুঁজে পাই এ কারণে যে, আমার পরম শ্রদ্ধেয় প্রফেসর স্যার মংসানু চৌধুরী মহোদয় ১৯৯০-৯১ শিক্ষা বর্ষে রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে পড়ার সময় অর্থনীতি সাবজেক্ট পড়ানোর সময় একটি কথা বার বার উপদেশ দিয়ে বলেছেন- জীবনটা চাহিদা সূচি আর যোগান সূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ।
সে নিরেখেই বলতে হয় যে, পাঠক সমাজের চাহিদা থাকার কারণেই সীমাবদ্ধ জ্ঞানের ভেতরেই বিষয়টি নিয়ে লিখছি।
আশা করি পাঠক সমাজ আমার সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনায় নিয়ে সদয় হয়ে ভূলভ্রান্তি সংশোধন করে নিবেন এবং যথাযথ তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করবেন।
চাকমা সাহিত্য চর্চাকে কবি সুহৃদ চাকমা ভাগ করেছেন তিনভাগে তাঁর চাকমা সাহিত্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ শিরোনামের গবেষণা প্রবন্ধে।
চাকমা সাহিত্যযুগ যেমন :
০১. ১৩০০ খ্রিঃ হতে ১৬০০খ্রিঃ প্রাচীন যুগ
০২. ১৬০০-খ্রিঃ হতে ১৯০০ খ্রিঃ মধ্য যুগ
০৩. ১৯০০-খ্রি: হতে অদ্যাবধি পর্যন্ত অাধুনিক যুগ(সূত্র-সুহৃদ চাকমা স্মারকগ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৯৪-১১২)।
কবি সুহৃদ চাকমা লোক সাহিত্যকে অর্থাৎ জ্ঞেনহুলি(গেঙখুলি)পালা বা প্রেম সাহিত্য বা ইতিহাস সম্পৃক্ত সাহিত্য রাধামন-ধনপুদি পালার যুগকে চাকমা সাহিত্যের প্রাচীণ যুগ, ধর্ম সম্পৃক্ত সাহিত্য, গোজেন লামা ও সামাজিক প্রণালী সম্পৃক্ত সাহিত্য কালকে মধ্য যুগ এবং ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দকে চাকমা সাহিত্যের আধুনিক যুগ হিসেবে আলোচনা করতে তিনি ঠিকভাবে বলেছেন –
বিশ শতক হতে চাকমা সাহিত্যের আধুনিক যুগ হিসেব করা হলেও কার্যতঃ চাকমারা যখনই আত্মপ্রত্যয়ের উপলব্ধি হতে চাকমা কবিতা রচনার প্রয়াস পান, তখনই এই যুগের শুভ সূচনা ১৯৪০ সালে খ্রিষ্টাব্দ হতে ৪৫ খ্রিষ্টাব্দের সময়ে চাকমাদের মধ্যে প্রথম চিত্র শিল্পী চুনিলাল দেওয়ানই প্রথম চাকমা আধুনিক কবিতা রচনা করেন। সূতরাং, চাকমা সাহিত্যে আধুনিক যুগের সূচনা বিশ শতকের চতুর্থ দশক হতেই ধরে নিতে হয় (সুহৃদ চাকমা)।
অপরদিকে পৃথিবীর একচ্ছত্র পরাশক্তি জাতি ফরাশি (ফ্রান্স) সাহিত্যের আধুনিক যুগ ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ, আমেরিকান সাহিত্যে আধুনিক যুগ ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দ, আয়ারল্যান্ড বা আইরিশ সাহিত্যের আধুনিক যুগ ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দ এবং সমসাময়িক কালে সোভিয়েত মার্কসবাদী এবং গ্রীস-স্পেনিশ আধুনিক কবিতার ভাবধারার আলোকে বাংলা কবিতার ত্রিশোত্তর আধুনিকায়ন যুগের সূচনা (সূত্র: আবিদ আনোয়ার, বাংলা কবিতার আধুনিকায়ন)।
বঙ্গীয় সমাজ ও বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসুদন দত্ত ইউরোপীয় সাহিত্য -সংস্কৃতির বাঁক ঘুরিয়ে দিয়ে যেমন বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তেমনি গৈরিকা যুগে চুনিলাল দেওয়ানই সর্বপ্রথম চাকমা কবিতার গতিধারা বদলে দিয়েছেন।
কারণ চুনিলাল দেওয়ান ছিলেন হাতে-কলমে ও সর্বসত্ত্বায় শিল্পী এবং সাহিত্যের মানুষ।
তাছাড়া তিনি ছিলেন কলিকাতা আর্ট কলেজের ছাত্র যে কলিকাতায় বসে সে সময়ে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর নবতর প্রাণ দিচ্ছেন সমগ্র বাংলা সাহিত্যকে।
কিন্তু বাংলা কবিতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে পরিদৃষ্ট হয় যে, বাংলা কবিতার যুগ বিভাজন করলে রবীন্দ্র যুগ বলে কোন কথায় নেই।
বাংলা কবিতার প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ ও আধুনিক যুগ বলে সাহিত্যের ঐতিহাসিকগণ যে যুগ ভাগ করেন সেখানে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর যুগের স্রষ্টা নয়।
সাহিত্য ঐতিহাসিকগণের তথ্য বা মতবাদ অনুয়ায়ী রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর কেবল মাত্রই মাইকেল মধুসুদন দত্তের প্রবর্তিত বাংলা কবিতার আধুনিক যুগে একজন বড়মাপের কবি মাত্র যুগ স্রষ্টা নয়।
তদ্রুপভাবে চাকমা কবিতা সাহিত্যের আধুনিক যুগস্রষ্টা কবি চুনিলাল দেওয়ানের পর অর্থাৎ চাকমা কবিতা সাহিত্যের উত্তর আধুনিক যুগে প্রবেশ না করা পর্যন্ত বা চল্লিশ দশকের পর হতে বর্তমান পর্যন্ত যতো জন কবি আছেন বা ছিলেন তাঁরা কেউই যুগস্রষ্টা কবি নন একেকজন উঁচুমানের বা বড় মাপের কবি মাত্র অন্ততঃ সাহিত্যের ইতিহাস বিশ্লেষণ তাই বলে।
সাহিত্যের ইতিহাস বিচার, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে আমরা ধরে নিতে পারি যে, পৃথিবীর সব দেশে এবং সব জাতির সাহিত্যের আধুনিকায়ন ঘটেছে খুবই ধীরে ধীরে।
পৃথিবীর সাহিত্য ও সংস্কৃতির পীঠভূমি ফরাসী সাহিত্যে কবিতার আধুনিক যুগ শুরু হয় ১৮৫৭ সালে আর আমেরিকান জাতির কবিতার আধুনিক যুগ শুরু ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ ফরাসী কবিতার আধুনিকায়নের ৫৭ বছরের পর আমেরিকান সাহিত্যের কবিতার আধুনিক যুগের উদ্ভব।
অপর দিকে আমেরিকান জাতির কবিতা সাহিত্যের( চাকমা কবিতার আধুনিক কাল ১৯৪০ আর আমেরিকান সাহিত্যের আধুনিক কবিতা কাল ১৯১৪ সুতরাং ১৯৪০-১৯১৪=২৬ বছর মাত্র) আধুনিক কাল চলার মাত্র ২৬ বছর পর চাকমা কবিতার আধুনিক কাল শুরু করেন কবি চুনীলাল দেওয়ান।
আমাদের আবশ্যিকভাবে ভাবা উচিত মার্কিনীদের সাহিত্যের সমসাময়িক কালে চাকমা সাহিত্যের আধুনিক কাল শুরু হলেও আজ আমাদের চাকমা সাহিত্যের এমন দশা কেন? চাকমা সাহিত্যের এমন দশা হবার পেছনে লেখক, কবি সাহিত্যেকগণ দায়ী পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্তি।
মোট কথা চাকমা রাজ পরিবারের অবাধ পৃষ্ঠপোষকতার কারণে সেই সময়ে চাকমা সাহিত্য দ্রুত আধুনিকায়ন হয়ে লাভ করে।
অপরদিকে আমাদের মনে রাখতে হবে যে সাহিত্য সৃষ্টি কর্ম বা সাহিত্য আন্দোলন কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নয়।
রাজনৈতিক আন্দোলন হয় গণজমায়েত করে রাজপথে আর শিল্প সাহিত্যের বিপ্লব হয় আড়ালে থেকে নীরবে নীরবে।
শিল্প সাহিত্যের কাজটি হলো ব্যক্তিমানসের উপর নির্ভরশীল। সেহেতু, সাহিত্য সৃষ্টি কর্ম চলাকালে কাউকে যেমন প্রতিদন্ডী ভাবা যাবেনা তেমনিভাবে কাউকে হুমকী-ধামকী ও দেয়া যাবেনা এবং সমর্থন ও মানসিক শক্তিযোগানো যাবেনা।
কারণ সাহিত্য সৃষ্টির কাজটি ব্যক্তি ইচ্ছের নির্ভর। ব্যক্তি সাহিত্য সৃষ্টি করলে করলো না করলে নেই এমনই বলা যেতে পারে সাহিত্য সাধনার কাজটি।
তাই সাহিত্য কাজে মানসিকভাবে বাঁধাগ্রস্থ সৃষ্টিকারী অথবা তার শক্তি যোগানকারীকে জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টির স্বার্থে সমর্থন বা অনুকম্পা প্রদর্শন হবে আমাদের সাহিত্যের অগ্রযাত্রাকে পেছনে ঠেলে দেওয়া।
একজন কবি বা লেখকের সৃষ্টি যা হোক তাঁর সৃষ্টির জন্য তাঁকে অবজ্ঞা, হুমকী-ধামকী অথবা তির্যকভাবে ঘৃণা বিদ্রুপ করা যাবে না।
ফরাসী কবি শার্ল বোদলেয়র জন্ম ১৮২১ সালে আর মৃত্যু ১৮৬৭ সালে। মৃত্যুর মাত্র দশ বছর আগে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ “ল্য ফ্ল্যর দ্যু মাল”।
এই সংকলনটি প্রকাশিত হবার পর ক্যাথলিক মতবাদী পাঠকবৃন্দ তাঁর বিরুদ্ধে অশ্লীলতা ও ঈশ্বরদ্রোহিতার অভিযোগ আনয়ন করলে আদালতের রায়ে কবির ৬টি কবিতা পুনর্মুদ্রণ ও প্রচার নিষিদ্ধতা জারি করা হয় যা ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বৎবৎ ছিল।
পরে ১৮৭১ সালে ফরাসী সাহিত্যের আরেক দেশ শ্রেষ্ঠ প্রথিতযশা কবি কিশোর জ্যাঁ আর্তুর রাঁবো ঘোষণা করেন কবি বোদলেয়র ছিলেন ফরাসী সাহিত্যের কবিদের রাজা, ফরাসীর সাহিত্যের প্রাণদাতা, সত্য- দেবতা এবং আধুনিক ফরাসী সাহিত্যের প্রথম স্থপতি।
সম্মানিত বিজ্ঞ পাঠক, এবার বলুন কার সাহিত্য কাজে আপনি বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেন আর কেনই দিবেন হুমকী অথবা কেনই বা সমর্থন করবেন?
হ্যাঁ, সাহিত্যে সমালোচনা আছে, থাকবে কিন্তু সমালোচনা হবে চলমান সাহিত্যের বাঁক ঘুরিয়ে দেওয়ার পক্ষে সাহিত্যজনের ব্যক্তিসত্তাকে সদর্পে আঘাত করার জন্য নয়।
আমরা তো জানি চাঁদ ও সমালোচনার উর্দ্ধে নয়। যেমন কবি চাঁদকে বর্ণনা করেছেন ঠিক এভাবে-
মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে(১০)
আমার মূখে দিকে -ডাইনে আর বাঁয়ে
পোড়া জমি-খড় নাড়া -মাঠের ফাটল
শিশিরের জল
মেঠো চাঁদ কাস্তের মতো বাঁকা, চোখা
চেয়ে আছে; এমনি সে তাকায়েছে কত রাত- নাই লেখাজোখা(২২)
এমনতর অক্ষরবৃত্তীয় কবিতা সৃষ্টি করে জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতা সাহিত্যকে সাজিয়ে দিয়েছেন নবরূপে এবং সুধীন্দ্র নাথ দত্তের কবিতার মূখোমূখী হয়ে দাঁড়িয়েছেন সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে মূখের কথায় নয়।
আমরা সবাই জানি বাস্তবতা অনেক কঠিন। মূখে অনেক কিছু কথা বলা যায়, কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ এবং বৃত্ত হতে বের হয়ে আসা খু্বই কঠিন।
কবিতায় শিল্প, শব্দে চিত্র নির্মাণ করে কবিতা লিখে বা সাহিত্য সৃষ্টি করে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিক সমকালের সাহিত্যিকদের প্রতি।
সমালোচনা করলে আমরা পারি কিন্তু করিনা সাহিত্য সৃষ্টির আকাঙ্খায়।
২০০৯ সালে রাঙ্গামাটির একজন কবির একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেই কাব্যগ্রন্থ হতে ” জীবনের গান” কবিতা হতে এক স্তবক তুলে ধরলাম।
নীলাম্বরে দুই ডানা বিষ্ফারিয়া গ্রহ তারার মাঝে সেতু রচিয়া
মোরা আভূমি লুটাইব তুলি অট্টহাস
মরণেরে পদে পদে করে যাবো পরিহাস।
সাগর সেচিয়া মানিক কুড়াব ঝিনুকের বুকের মুক্তা হরিব
পরি লব বিজয়ের মাল্য গলে
খেলিব দুলিব সাগর তরঙ্গে লোনা ফেনপুঞ্জ মাখিব রে অঙ্গে
টর্পেডো হব রুদ্র সাগর তলে।
এ কাব্যগ্রন্থের কবি একদিন আমাকে বললেন আজকাল যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁদের বাংলাগুলি খুবই পাতলা এবং বিমূর্ত নয়।
আমি বললাম আপনি যা বলছেন সদাসত্য কথা তবেই একশত বছর আগে বানানো চাবি দিয়ে এ যুগের তালা খুলতে কষ্ট হবে বৈকী এবং এমনও হতে পারে হয়তো খোলাও যাবেনা।
আপনাদের বাংলাগুলি ভারি ঘোর জিদু আমনর সান্নে মান্নে এক শব্দ উল্লাদে কাঙেল ভাঙে জিদু এই কথা বলে কবি খুবই খুশি হয়েছেন( বাধ্য হয়ে উদাহরণ টানতে হলো বলে কবির কাছে শতবার ক্ষমা প্রার্থনা করছি)।
বর্তমানেও এমন ধরণের পূরণো শত বছরের ভাষা ব্যবহার কবি যথেষ্ট চোখে পড়ে এবং যাদের কবিতায় মোরা, তোরা, তজ্জন্য ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার অধিক মাত্রায় চোখে পড়ে।
কিন্তু আধুনিক বাংলায় মোরা, তোরা, তজ্জন্য শব্দগুলো আর সাহিত্য ভাষা নয় অর্থাৎ বুঝতেই হবে এমন কবিগণ আধুনিক বাংলার সাথে বা সাহিত্য ভাষার সাথে পরিচিত নয়।
তা সত্ত্বেও সাহিত্য সৃষ্টির জন্য আর সাহিত্য চর্চাকারী মানুষের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য এবং ছোট বড় সকলেই এক কাতারে দাঁড়ানোর জন্য কোন কথা না বলে যার যার অবস্থান হতে সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
গঠন মূলক হোক বা ভাঙন মূলক হোক কোন আলোচনা -সমালোচনা করিনা।
যাহোক, আমার আলোচ্য প্রবন্ধটি প্রায় শেষ প্রান্তে এসে গেছে।
চাকমা সাহিত্যের আধুনিক যুগ স্থপতি কবি চুনীলাল দেওয়ানের সে কবিতাটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরলাম-
ঘর দুয়ারত এইনে ডাগের
সিবা কন্না মরে?
মুয়ান চিনং নাঙ নহ জানং
কুধু দেখ্যেং তারে?
ডাক শুনিনেই পুরি ফেলেলুং
যেদককানি মর কাম
পরানে কত্তে তারে চেইনেই
পুঝর গত্তুং নাঙ।
পুঝারগরি চিন পরিচয়
তাল্লোই যুদি হো্ই
হাওচ্ গরি ভিদিরে বোজি
দ্বিজনে কধা কোই।
কধা কোইনেই মনত পলে
থেবাত্তেই কোম তারে
জনমত্ত্যেই মিলিমিঝি
থেবং আমি সমারে।
কবির এই কবিতা চাকমা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবিতা এবং সেই কারণেই কবি চাকমা সাহিত্যের আধুনিক যুগের স্থপতি কবি।
গৈরিকা যুগ, পার্বত্য বাণী যুগ, জুম ঈসথেথিকস কাউন্সিলের সাহিত্য যুগের সূচনার মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা সাহিত্য সংস্কৃতি এ পর্যায়ে এসে গেছে।
এখন চলছে চাকমা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। কবি সুহৃদ চাকমা বেঁচে থাকলে বহু আগে বলতেন এখন চাকমা সাহিত্যের উত্তর আধুনিক যুগ চলছে।
তিনি বলে যাবার সুযোগ না পেলেও কবি সুহৃদ চাকমার সহপাঠী জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসি প্রফেসর ড. আফসার আহমেদ মহোদয়ের কালের খেয়া সাহিত্য ম্যাগাজিনে তাঁর পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা ভাষার কবি ও কবিতা আলোচনা শিরোনামের প্রবন্ধে চাকমা সাহিত্যের উত্তর আধুনিক যুগ চলছে বলে সুস্পষ্টভাবে মতপ্রকাশ করেছেন ( কালের খেয়া সেই সংখ্যাটি শ্রদ্ধেয় মৃত্তিকা দাদা ও শ্রদ্ধেয় কবি শিশির চাকমা মহোদয়ের সংগ্রহে থাকতে পারে)।
উক্ত প্রবন্ধে কবি চুনীলাল দেওয়ানসহ তাবৎ কাল হতে সমকালে যাঁরা লেখা লেখি করছেন তাঁদেন সকলের কবিতা আলোচনায় উঠে এসেছে যা উক্ত কালের খেয়া সাহিত্য পত্রিকাটি এ অঞ্চলের চাকমা সাহিত্যিকদের জন্য একটি ঐতিহাসিক দলিল।
প্রবন্ধের শেষে এসে বলবো, সমালোচনা হবে, সমালোচনা করবেন কিন্তু গর্হিত অমার্জিত ভাষায় নয় সাবলীল ও গঠনমূলকভাবে। একচোখা বিবেচনা নয় বিবেচনায় নিবেন বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থকে।
তোষামোদী, সুবিধাবাদীতা বাদ দিয়ে সর্বাগ্রে ঐক্যের জন্য মনোভাব দেখাতে হবে। ইন্দি এগ কধা উন্দি এগকধা নয় কধা কুয়ো পরিবোদে বেক্কুনর গমত্তে আমনর পাল্লাবুয়া ভর গরিবাত্তে নয়।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।