চাক জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার (পেঙহে)

Jumjournal
Last updated Dec 23rd, 2019

964

featured image

চাক উত্তরাধিকার প্রথার উদ্ভব

পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী চাক সমাজে অদ্যাবধি জুম চাষ তাদের অন্যতম পেশা। ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪২ নং বিধিমতে পাহাড়ে জুম চাষের জন্য জমির মালিকানার প্রয়োজন হয় না, যার কারণে চাক সমাজে স্থাবর সম্পত্তির তথা ভূমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা স্থায়ী মালিকানা অর্জনের প্রচেষ্টা অতীতে তেমন একটা ছিল না বললেই চলে।

এ অবস্থায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অতীতে পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী চাক সমাজে তেমন একটা সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠেনি।

ইদানীংকালে জুম চাষের জন্য জমির অপ্রতুলতা এবং পর্যায়ক্রমে একই জমিতে বংশানুক্রমিকভাবে চাষাবাদের কারণে চাক জনগোষ্ঠীর মধ্যে উদ্যান কৃষির প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্তমান শিক্ষিত সমাজে ভূ-সম্পত্তির উপর স্থায়ী মালিকানা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ধারণার উদ্ভব হয়েছে।

চাক সমাজভুক্ত পরিবারে কেউ মারা গেলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের দায়-দায়িত্ব পালন দ্বারা মৃতের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হওয়াটা সম্পর্কযুক্ত এবং সামাজিক ও পারিবারিক কর্তব্য হিসেবে সমাজে স্বীকৃত।

 

চাক উত্তরাধিকারের সাধারণ নীতি

উত্তরাধিকার: মৃত ব্যক্তির সৎকার/অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয়, তার অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে), জীবদ্দশায় সম্পাদিত উইল বা দানমূলে দখল হস্তান্তরিত হয়েছে কিন্তু মালিকানা স্বত্ব হস্তান্তরিত হয়নি এমন ভূ-সম্পত্তির দায়/দাবী মেটানোর পর যা অবশিষ্ট থাকে, তার উপরই উত্তরাধিকারীগণের দাৰী/অধিকার বর্তায়। এ সকল দায়/দাবী না মিটিয়ে সম্পত্তির মালিকের সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয় না।

 

উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি কি কি: সম্পত্তির মালিক যেসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রেখে মারা যায় সেসবই উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য। অস্থাবর সম্পত্তি যেমনঃ- আসবাবপত্র, থালা-বাটি, কাপড়চোপড়, অলংকার, গবাদিপশু ইত্যাদিও উত্তরাধিকারীগণের মধ্যে আপোষ রফায় ভাগবন্টন ও হস্তান্তর হয়। কিন্তু লিখিত কোনো আইন বা বিধি-বিধানমতে সেগুলো ভাগবন্টন করা হয় না। কেবলমাত্র ভূমি তথা জায়গা-জমিকে স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে সামাজিক বিধি-বিধানমতে ভাগবন্টন করা হয়। তাই উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি বলতে সাধারণভাবে স্থাবর সম্পত্তিকেই বুঝানো হয়।

কিন্তু একজন সম্পত্তির মালিকের সম্পূর্ণ স্থাবর সম্পত্তি উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয় না। সম্পত্তির মালিকের মৃত্যুর পর তার সৎকার/অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয়, তার অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে) এবং জীবদ্দশায় দখল হস্তান্তরিত হয়েছে কিন্তু মালিকানা হস্তান্তরিত হয়নি এমন ভূ-সম্পত্তির দায়/দেনা মেটানোর পর যা অবশিষ্ট থাকে তার উপরই উত্তরাধিকারীগণের অধিকার বর্তায়।

 

সম্পত্তির উত্তরাধিকার রীতি: তিন পার্বত্য জেলার সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান/ইউ.পি চেয়ারম্যান/কার্বারী/পৌর চেয়ারম্যান/সার্কেল চীফ-এর নিকট হতে মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ পূর্বক ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের ৭ নং ধারামতে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে সংশ্লিষ্ট জেলার দেওয়ানী আদালতের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে বিবিধ মামলা মুলে তিনি মৃত ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারীগণকে উত্তরাধিকার সনদপত্র প্রদান করেন।

পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী চাক পরিবারের কারো মৃত্যুর পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয় খরচ, তার জীবদ্দশায় অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে) এবং জীবদ্দশায় কোনো সম্পত্তি দান বা বিক্রি কিংবা মৃত্যুর পূর্বে সম্পাদিত উইল ইত্যাদির দাবী পরিশোধ বা নিষ্পন্ন করার পর নিম্নোক্ত উপায়ে চাক সমাজে উত্তরাধিকার রীতির প্রচলন রয়েছেঃ-

ক) বোমাং সার্কেলে বসবাসকারী চাক সমাজে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী ও পুত্র ত্যাজ্য সম্পত্তিতে অপ্রতিরোধ্য উত্তরাধিকারী হয়।

খ) পুত্র সন্তানের অবর্তমানে কন্যা সন্তানগণ মৃত পিতা সম্পত্তিতে মায়ের সাথে অপ্রতিরোধ্য আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

গ) পুত্র সন্তান থাকলে কন্যা সন্তানেরা মৃত মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হয়। তবে সম্পত্তির মালিক যদি মৃত্যুর পূর্বে দান বা উইলের মাধ্যমে কন্যাকে সম্পত্তি দান করেন, সেক্ষেত্রে কন্যা সন্তানগণ সেই সম্পত্তির অধিকারী হয়।

 

উত্তরাধিকারযোগ্য পদ পদবী: পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০-এর ৪৮ নং বিধিমতে সার্কেল চীফ নিয়োগ এবং হেডম্যান নিয়োগ ও বরখাস্ত বিষয়ে লিপিবদ্ধ আছে।

ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০-এর ৪৮নং বিধিতে চাক সমাজের হেডম্যান/কার্বারী এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্কেল চীফের সুপারিশ বা মতামতকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়। হেডম্যান/কার্বারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র যদি যোগ্য হন তাকে সেই পদে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হয়।

খ) চাক সমাজের রোয়াজা পদটি বংশানুক্রমিক হিসেবে। পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র এতে অগ্রাধিকার পায়, যদিও উক্ত রোয়াজা পদটি ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি মতে স্বীকৃত নয়। এ পদের জন্য যোগ্য উত্তরাধিকারী না থাকলে সমাজ কর্তৃক একজন যোগ্য ব্যক্তিকে রোয়াজা হিসেবে মনোনীত করা হয়।

 

চাক পরিবারের উত্তরাধিকার প্রশ্নে অগ্রাধিকার ভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাস:-

ক) চাক পরিবারে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা সন্তানেরা মৃতের অপ্রতিরোধ্য উত্তরাধিকারী। তার বা তাদের উপস্থিতি অন্য সকল নিকটাত্মীয়ের অধিকারকে খর্ব করে। স্ত্রী বলতে- প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রী, আর এক্ষেত্রে সন্তান বলতে- ঔরসজাত, অবৈধ ও দত্তক সন্তানকেও বুঝায় । পুত্র বা কন্যার মৃত্যুজনিত কারণে পুত্রবধূ (যদি স্বামীর ঘরে থাকে) এবং মৃত পুত্রকন্যার সন্তানগণ আইনগত উত্তরাধিকার হিসেবে গণ্য হয়।

খ) চাক পরিবারে মৃত ব্যক্তির কোনো পুত্র সন্তান যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে কন্যা সন্তানেরা মায়ের সাথে মুত্যুর সম্পত্তিতে আইনগত উত্তরাধিকারী হয় এবং কন্যা সন্তানগণ মৃতের সম্পত্তিতে মায়ের সমান হারে রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় তথা বংশের রীতি এবং সামাজিক সিদ্ধান্ত অনুসারে সম্পত্তির ভাগ পায়। মুতের কন্যা সন্তান বলতে- এক্ষেত্রে ঔরসজাত কন্যা, অবৈধ কন্যা, দত্তক কন্যা সকলেই কন্যা ও সন্তান রূপে গণ্য। হয়।

গ) স্বামীস্ত্রী: স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে যে স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রী উত্তরাধিকার লাভ করে। তবে স্ত্রীর সম্পত্তি তার জীবদ্দশায় স্বামী অথবা পুত্র-কন্যা যাকে ইচ্ছা দান করতে পারে, অন্যথায় মৃত স্ত্রীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী স্ত্রীর পিতৃকুল হবে।

ঘ) পিতামাতা: মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি-নাতনী যদি থাকে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি যাদের ঔরসজাত অথবা দত্তক সন্তান রূপে যাদের স্নেহে লালিত পালিত হয়েছে সেই পিতামাতা মৃতের আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

ঙ) রক্ত সম্পর্কীয়: চাক সমাজে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি, নাতনী, পিতা-মাতা কেউ যদি জীবিত না থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ভ্রাতা, তার পুত্রকন্যা তাদের অবর্তমানে বোন, বোনের পুত্র-কন্যাগণ মৃত ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

চ) চাক পরিবারে মৃতের যদি স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, ভাই, বোন এবং ভাইপো-ভাইঝি ও ভাগ্নে-ভাগ্নী, এদের রক্ত সম্পৰ্কীয় নাতি-নাতনী কেউ যদি জীবিত না থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে,সেক্ষেত্রে তাদের অবর্তমানে জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে কাকা/জেঠা, তাদের জন কাকার/জেঠার পুত্র-কন্যা উত্তরাধিকার লাভ করে।

ছ) মৃত ব্যক্তির ‘চ’ অংশের রক্ত সম্পর্কীয় কেউ যদি না থাকে সেক্ষেত্রে পিসি, তার অবর্তমানে পিসতুতো ভাই-বোন তাদের পুত্র-কন্যা আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।.

জ) মৃত ব্যক্তির ‘চ’ ও ‘ছ’ অংশের রক্ত সম্পর্কীয় উত্তরাধিকারী যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির মামা, তার অবর্তমানে মামাতো ভাই-বোন, তাদের পুত্র-কন্যা উত্তরাধিকারী হয়।

 

সম্পত্তির ভাগবন্টন: চাক সমাজে সম্পত্তির ভাগবন্টন নিম্নমতে সম্পন্ন হতে পারেঃ-

ক) চাক সমাজে মৃত স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিতে স্ত্রী আইনগত উত্তরাধিকারী হয়। তবে বিধবা স্ত্রী দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে সেক্ষেত্রে পূর্বের স্বামীর সম্পত্তিতে আইনগত উত্তরাধিকার হারায়।

খ) অবৈধ সন্তানের উত্তরাধিকার স্বত্ব: যে ব্যক্তির ঔরসে অবৈধ সন্তান (জারজ) জন্মগ্রহণ করেছে/করে সেই ব্যক্তির (জন্মদাতা) সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুসারে সন্তানের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা হয়। তবে ভিন্ন কোনো ব্যক্তির পিতৃ পরিচয়ে সে যদি পরিচিত হয়, সেক্ষেত্রে জন্মদাতা পিতার উত্তরাধিকার সে দাবী করতে পারে না, সন্তান কেবলমাত্র নিজ মায়ের নামীয় সম্পত্তির (যদি থাকে) উত্তরাধিকারী হয়।


তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা,  এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা