প্রথাগত আইনে আদিবাসী চাক নারীর অবস্থান
1364
চাক জাতি বান্দরবান পার্বত্য জেলার দক্ষিণাংশে বসবাস করে। চাক জাতি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বর্মী ও আরাকানীরা চাকমা এবং চাক এ দুইটি স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীকে সাক বা খেক এই একই নামে ডেকে থাকে।
তবে মঙ্গোলীয় মানবধারার চাক বা সাক নামে পরিচিত এ জাতি নিজেদের ‘আসক’ নামে আখ্যায়িত করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
চাকদের ’আন্দো’ এবং ‘ঙারেক’ নামে দুটি প্রধান দল রয়েছে, এই দুটি দলের আবার কিছু গোত্র রয়েছে। চাক সমাজে দল ও গোত্রের সংখ্যা অপরিসীম।
বান্দরবান পার্বত্য জেলায় চাকদের আন্দো’ দলের জনগোষ্ঠীর সাথে ভারতের মনিপুরের ‘আন্দো’ জনগোষ্ঠীর ও ভাষাগত সাদৃশ্য ও যোগাযোগ রয়েছে। আবার আরাকানের চাকদের সমগোত্রীয় ‘সাক বা খেক’ নামধারী জনগোষ্ঠীর যে সকল লোক রয়েছে, তাদের একটি দল বা গোত্র ‘আনদুং’।
বার্মা, মনিপুর ও পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত সাক, আন্দ্রো এবং চাকদের মধ্যে যে একটি যোগাযোগ ছিল, সে বিষয়ে যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। চারা কথা বলে বাড়ি ভাষার একটি শাখায়, যার লিখিত রূপ বাংলাদেশে অনুপস্থিত।
চাক জাতির পারিবারিক ব্যবস্থায় পুরুষদের ভূমিকার প্রাধান্য বেশি। তবে ক্ষেত্র বিশেষে নারীদের মতামত গ্রহণও অপরিহার্য। সামাজিক বিচার-আচার সম্পর্কিত কার্যাদিতে পুরুষেরাই অধিকতর ভূমিকা পালন করে থাকেন।
পারিবারিক কোনো সমস্যা দেখা দিলে সেক্ষেত্রে সমাধানের জন্য নারীদের মতামত গ্রহণ অনিবার্য। লেখাপড়ায় পুরুষেরা অগ্রগামী। সাধারণভাবে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো লেখাপড়ার ক্ষেত্রে কন্যাসন্তানের চেয়ে পুত্র সন্তানদের বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
অতীতে চাক সমাজের নারীরা গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি তাঁতের বস্ত্র তৈরি, পশুপালন ও জুম চাষাবাদের কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। বর্তমানে চাকরা সরকারি ও বেসরকারি চাকুরিসহ বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন তথা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত রয়েছে।
চাক সমাজের নারী-পুরুষ সবাই মাঠে কাজ করেন। তবে কঠোর পরিশ্রমের কাজ, যেমন জুমচাষের জঙ্গল কাটা, মাঠে লাঙ্গল দিয়ে চাষ করা, বাড়িঘর নির্মাণ, ভারী জিনিস পরিবহণ, ইত্যাদি কাজ নারীরা করেন না।
সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে পুরুষের সমান নারীরা অংশগ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে নারী-পুরুষের কোনো ভেদাভেদ সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে পুরুষের সমান তালে নারীরা অংশগ্রহণ করে থাকেন।
সাধারণভাবে চাক সমাজে নারী-পুরুষে কোনো বৈষম্য নেই বলে বিবেচিত। বরং ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে নারীরাই এগিয়ে আছেন।
তবে অন্যান্য আদিবাসা ও মতো চাক জনগোষ্ঠীর নারীরাও স্থাবর সম্পত্তির অংশ পান না। তবে মায়ের জায়গা-জমি থাকলে তা অবশ্যই সামাজিকভাবে কন্যা সন্তানরা পায়।
তবে এটা অনস্বীকার্য যে, তুলনা মূলক ভাবে অশিক্ষিত ও প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী চাক পরিবার সমূহের নারীরা অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ অবস্থায় রয়েছে।
বিষয়-সম্পত্তি ও ফসল ক্রয়-বিক্রয়, ছেলে/মেয়েদের বিয়ে সহ নানা বিষয়ে নারীরা সীমিত পরিসরে মতামত রাখতে পারলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ভাবে গৃহীত হয়ে থাকে।
বিয়ে
কোনো ছেলের বিয়ের উপযুক্ত বয়স হলে তার মা-বাবা নিজেরা অপবা অন্য কারোর মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব এমন গোত্রে মেয়ে খুঁজতে শুরু করেন।
আন্দো গোত্রের ছেলে হলে ঙারেক গোত্রের মেয়ে এবং বিপরীত ক্রমে ঙারেক গোত্রের ছেলে হলে আন্দো গোত্রের মেয়ের মধ্যকার সম্পর্ক প্রশস্ত।
তাই এভাবেই খোঁজখবর চলে। চাক সমাজে স্বগোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। প্রচলিত চাক সামাজিক রীতিনীতি অনুসারে বরপক্ষকে কনে পক্ষের ঘরে তিনবার যেতে হয়।
প্রথমবারে ছেলের মাতা-পিতা শুধু বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মেয়ের পিতা-মাতার কাছে যান। রীতি অনুযায়ী সাথে এক বোতল মদ, পিঠা ইত্যাদি নিয়ে যেতে হয়।
দ্বিতীয় বারে ছেলের মা-বাবা তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন ও কয়েক জন মুরব্বিকে সঙ্গে নিয়ে মেয়ের মা-বাবার কাছে যান। সে সময় সাথে করে লেমং বোতলের মদ, হলুদ ও লবণ দিয়ে সিদ্ধ করা একটি আস্ত মোরগ ও একটি মুরগি নিয়ে যেতে হয়।
সিদ্ধ করা আন্ত মোরগ ও মুরগি বেটে তৈরি একটি পহদাং অথবা একটি পবিত্র পাত্রে সাজিয়ে মেয়ের মা বাবার সামনে সম্মানের সাথে আনুষ্ঠানিক ভাবে তুলে দিতে হয়।
এ সময় আবেদন করা হয় যে, ‘আমরা আজ আমাদের পুত্র অমুক (নাম অবশ্যই বলতে হবে) ও আপনাদের মেয়ে অমুকের (নাম বলতে হবে) সাথে বিবাহের মাধ্যমে রক্তসম্পর্ক অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে উভয়ের জন্ম তারিখ, রাশি ইত্যাদি মিলিয়ে দেখার জন্য এসেছি।
এই বলে এক কাপ করে মদ মেয়ের বাবার হাতে তুলে দিতে হয়। যদি দেখা যায়, ছেলে ও মেয়ের কুষ্ঠি অর্থাৎ উভয়ের জন্ম তারিখ, দিনক্ষণ ও রাশি ঘর-সংসার করার জন্য মিলছে এবং সাথে নিয়ে যাওয়া মুরগির (১টি ছেলে ও ১টি কনের উদ্দেশ্যে) ‘আচাংগাও ভালো, তাহলে ওই বারেই বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করা হয়।
উল্লেখ্য, মোরগ-মুরগির জিহ্বার গোড়ায় দুটি আঁটা থাকে, যে দুটির মাঝখানে থাকে একটি ছোট আঁটু; আনুষ্ঠানিক ভাবে নিয়ে যাওয়া মোরগ-মুরগি দুটির আঁটা ও আঁটু সামনের দিকে নুইয়ে থাকলে তাকে ভালো আচাংগা বা ভালো লক্ষণ বলে ধরা হয়।
তৃতীয় বার যখন বরের পিতামাতা কনের বাড়িতে যান, তখন তারা বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে আসেন। ওইদিন কনে পক্ষের নিমন্ত্রিত আত্মীয় স্বজন ও সামাজিক মুরব্বিরা (রোয়াজা ও কার্বারিসহ) কনেপক্ষের কোন দাবি-দাওয়া থাকলে তা ফয়সালা করে থাকেন।
তৃতীয় বারে কনের বাড়িতে যাওয়ার সময় বরপক্ষের সাথে করে ১০০ থেকে ৫০০টি সিদ্ধ ডিম নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ আছে। বরপক্ষের নিয়ে যাওয়া ডিমগুলো অবশ্যই কনেপক্ষের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে ভাগ করে দিতে হয়।
এর অর্থ হলো, অমুকের মেয়ের অমুকের ছেলের সাথে বিয়ে চুড়ান্ত হয়ে গেছে। এ অবস্থায় অন্য কারো ওই মেয়েকে ‘বউ দেখা সামজিকভাবে অপরাধ।
এসময় কনেপক্ষ আছোয়াং (পণ) দাবি করে। এই দাবি-দাওয়াগুলোর মধ্যে পাই, (হাতের বারা), নাতং (কানফুল, কানের রিং), পানের বাটা, লম্বা দা, বাসন-কোসন কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য অলংকার হতে পারে।
চাক সমাজে স্বাভাবিক বিয়ের ক্ষেত্রে সাধারণত নগদ টাকা দাবি করা হয় না। তবে বরপক্ষের সামর্থ্য বিবেচনা করে কনে বিয়ের দিন একটি শুকর বিয়ের অনুষ্ঠানে ভুড়িভোজনের জন্য দাবি করতে পারে।
তাছাড়া কনের দাদু-দাদিমা জীবিত থাকলে তারা বরের মাতাপিতার কাছে এক বা একাধিক বিশেষ ম্যাকমান বা স্মৃতিস্বরূপ উপহার দাবি করতে পারেন।
বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেলে নির্দিষ্ট তারিখে বরের নিকটাত্মীয়দের মধ্য থেকে এক জোড়া স্বামী-স্ত্রী ও বিপরীত গোত্রের এক জোড়া স্বামী-স্ত্রী ‘আঞোইং মেহেকা’ অর্থাৎ নির্মল দুই জোড়া বরের মাতা-পিতার প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন প্রকার অলংকার নিয়ে বউ আনতে যান এবং সাথে আন্দো গোত্রের ২ জন ও ধারেক গোত্রের ২ জন মিলে মোট ৪ জন যুবক-যুবতীকে ওই প্রতিনিধির সাথে যেতে হয়।
তাদের চাক ভাষায় ‘প্রেংছছা’ বা ‘নাং লা লুহ বলা হয়। অবশ্য তাদের সাথে অন্যলোকও যেতে পারে। তবে তাদের নাংলা লুই’-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা হয় না।
বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে যাওয়ার পর অপরপক্ষের নিকটাত্মীয়রা বেশ কিছুদিন ধরে কনেকে আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণ দিয়ে ভাত খাওয়া এবং নতুন ঘর-সংসার সম্বন্ধে সার্বিক ধারণা দিতে থাকেন। অবশ্য আজকাল আর এই রীতির প্রচলন নেই।
আগের দিনে চাকদের বিয়েতে সচরাচর বর-কনে উভয়ের বাড়িতেই ৩ দিন ধরে বিয়ের উৎসব উদযাপন করা হতো।
বিয়ের গানের মাধ্যমে কনের দাদু-দাদি, পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন ও আমন্ত্রিত সকলের কাছে ক্ষমা এবং আশীর্বাদ চাওয়ার অনুষ্ঠান শেষ হলে ‘নাংলা লুহু’ দল কনেকে বরের বাড়িতে নিয়ে যায়।
এদিকে অপেক্ষমাণ বরের পিতা-মাতা কনেকে মাথায় ছাতা দিয়ে গালে গানে আনন্দে মুখরিত পরিবেশে পা ধুইয়ে পবিত্র পানি ছিটিয়ে বাড়িতে তোলেন। ওই রাত্রে অথবা তার পরদিন সকালে শুভ বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়।
প্রথম সন্তান লাভের পর কনে স্বামী অথবা শশুর-শাশুড়ির সাথে মদ, মুরগি, পিঠা খাদ্যদ্রব্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে পিতা-মাতার বাড়িতে বেড়াতে যায়। এ আনুষ্ঠানিক ” চাক ভাষায় ‘আরাক চিক প্রাইঙ চিক প্রাইঙ’ বলা হয়।
এ সময় কন্যাসন্তান পিতা-মাতার কাছে তার প্রাপ্য অংশের সম্পত্তি দাবি করে। পিতা-মাতা তাদের সামর্থ্য অনুযায় মহিষ, অলংকারাদি, নগদ টাকা কন্যাসন্তানকে দিয়ে থাকেন।
মেয়েকে সাধারণত অংশ দেওয়া হয় না। উল্লেখ্য, কথিত আছে যে, এ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা না-হলে সময়ে এক পর্যায়ে মামা-ভাগ্নের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় চাক সমাজে বিয়ের ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। কনের অজান্তে চুরি করে ছেলের বাড়িতে তুলে নিয়ে বিয়ে করা এবং ছেলে ও মেয়ের পছন্দ অথবা প্রেম করে বিয়ে করা ব্যতীত অন্য দু’ধরনের বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েকে সরাসরি ছেলের ঘরে তোলা সামাজিক ভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য।
মেয়েকে ছেলের গরে তোলার আগে নিঠ এক বা একাধিক ব্যক্তির মাধ্যমে ছেলের মা-বাবাকে জানাতে হয়। মা-বাবার সম্মতি পাওয়ার পরই মেয়েকে ছেলের বাড়ি/গরের উঠানে এনে বসাতে হয়।
মা-বাবা স্বয়ংঅথবা অন্যের মাধ্যমে পাড়ার কার্বারি, রোয়াজা ও আত্মীয়স্বজনদের ডেকে এনে কনেকে তাদের সামনে বসিয়ে সাক্ষী করা হয়।
পাড়ার মুরব্বিরা কনেকে কয়েকটি প্রশ্ন করেন—১. সে (কনে) স্বেচ্ছায় অমুকের ছেলে অমুকের ঘরে এসেছে কি না অথবা তাকে জোর করে আনা হয়েছে কি না; ২. সে তার পিতার কোনো মূল্যবান জিনিস বিশেষভাবে সোনা, রুপা, নগদ টাকা, অলংকার সাথে করে নিয়ে এসেছে কি না; ৩. সে তার বাবার ঘর থেকে চলে আসার আগে সে সম্পর্কে কোনো ব্যক্তিকে জানিয়ে এসেছে কি না ইত্যাদি।
এসব প্রশ্নের জবাবে উপস্থিত মুরব্বিগণ সস্তুষ্ট হলে পরে কনের সালাম গ্রহণ করেন এবং কনেকে ছেলের ঘরে তোলার অনুমতি দেন। ঘরে তোলার পর চাক সামাজিক রীতি অনুযায়ী বিয়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়।
পরে ছয় মাস অথবা এক বছরের মধ্যে বর ও কনে উভয়পক্ষ মিলে ‘কাংবোয়ে’ বা আশীর্বাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্বামী-স্ত্রীর সামাজিক স্বীকৃতি লাভের জন্য চাকদের মধ্যে কাংবোয়েং’ অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা আছে।
চাক সমাজে বহুবিবাহ সাধারণত দেখা যায় না। তবে এ ব্যাপারে নিষেধও নেই। চাকদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের রীতি প্রচলিত আছে, এজন্য সুনির্দিষ্ট গ্রহণযোগ্য কারণ থাকতে হয়।
উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে আছে বন্ধ্যাত্ব, পুরুষত্বহীনতা, কাজে অক্ষমতা, সংক্রামক রোগ থাকা। যেকোনো পক্ষের এসব থাকলে সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী বিবাহবিচ্ছেদ হতে পারে। বিয়ের ক্ষেত্রে আরো কিছু নিয়মনীতি প্রচলিত আছে, সেগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো:
- চাক জনগোষ্ঠীর সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী কোনো পুরুষ স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায়ও আবার বিয়ে করতে পারেন। কিন্তু স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় স্বামীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদ ব্যতীত কোনো চাক নারী দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারেন না।
- চাক জনগোষ্ঠীর নারী বিয়ের পূর্বে পারিবারিক যে পদবি ও সামাজিক মর্যাদার অধিকারীই হোন না কেন, বিয়ের পর তিনি স্বামীর পদবি ও মর্যাদার অধিকারী হবেন।
- স্বামী স্ত্রীর বিবাহ-বিচ্ছেদের সময় দম্পত্তির নাবালক সন্তান থাকলে বিবাহবিচ্ছেদের পর নাবালক সন্তান সাবালকত্ব অর্জন না-করা পর্যন্ত নিজের হেফাজতে রাখার অধিকার স্ত্রীর রয়েছে। তবে সাবালকত্ব অর্জনের পর সন্তান পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় এবং সন্তানের আইনগত অভিভাবক হন পিতা।
- বৈধ বিয়ে ব্যতিরেকে ভালোবাসা জনিত বা অনাবিধ কারণে হওয়া যৌনমিলনের ফলে কোনো যুবতী গর্ভবতী হলে, সামাজিক আদালতে গর্ভবতীর প্রমাণ সাপেক্ষে ভুমিষ্ঠ সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকৃত হলেও সন্তান পিতার সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকার হতে পারে না। এক্ষেত্রে উক্ত সন্তান শুধু মাতার সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।
উত্তরাধিকার
চাক সমাজে মংনাঙ পো’ অনুষ্ঠানের সমাজসিদ্ধ নিয়মে একজন বিবাহিত স্ত্রী তার কাছ থেকে ভরণপোষণ পাবার অধিকারী হয়।
একজন চাক নারী বিয়ের পূর্বে বা পরে স্বামীর সংসার কিংবা পৈতৃক অথবা মাতৃক সূত্রে প্রাপ্ত কিংবা তার আত্মীয় কর্তৃক দান উপহার হিসেবে প্রাপ্ত কিংবা উপার্ভিতি অর্থে সম্পত্তি ক্রয় অথবা লাভ করতে পারে বিয়ের পূর্বে অর্জিত যেকোনো সম্পত্তির ওপর আইনত নিরঙ্কুশ মালিকানাস্বত্ব ও অধিকার স্ত্রীর থাকে।
স্বামী নিষ্ঠুর প্রকৃতির হলে, স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করলে সতিনের সাথে একসঙ্গে বসবাসে অসম্মত হলে প্রথম স্ত্রী স্বামীর ভিটায় নিরাপদ অঙ্গ থেকে স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ লাভের অধিকারী হয় অথবা সামাজিক আদালত মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্তে পিত্রালয়ে অবস্থান করেও স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ লাভের অধিকারী হয়।
বিয়ের পর স্বামী বৈবাহিক সম্পর্ককে অগ্রাহ্য করলে বা অব্যাহত না-রাখলে অথবা ভরণপোষণ প্রদানে বিরত থাকলে স্ত্রী তার দাম্পত্য সম্পর্ক ও দাবি পুনরুদ্ধারের জন্য সমাজপতি বা কার্বারি-হেডম্যান আদালতে মামলা করার অধিকার রাখেন।
স্বামীর দ্বিতীয় বা একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে স্ত্রী আপত্তি করার অধিকার রাখেন। পক্ষান্তরে স্বামী যদি পুরুষত্বহীন বা নপুংশক হন অথবা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন হন, তাহলে স্ত্রী সমাজপতি বা কার্বারি-হেডম্যান আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ (পেনেহে-কা) লাভের অধিকারী হন।
বর্তমানে চাক জনগোষ্ঠী বোমাং সার্কেলের রীতিনীতি অনুসরণ করে থাকে। চাকদের সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক হওয়ায় উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয়সমূহ মুখ্যত পুরুষনির্ভর।
চাকদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পালনীয় রীতিনীতিও পিতৃপ্রধান। পরিবার কাঠামো ও গোত্রপ্রাধান্য সকল ক্ষেত্রে পুরুষ নির্ভর।
চাক পরিবারের কারো মৃত্যুর পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য ব্যয়িত খরচ, মৃত ব্যক্তির জীবদ্দশায় অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে) এবং জীবদ্দশায় করা সম্পত্তি দান বা বিক্রি কিংবা মৃত্যুর পূর্বে সম্পাদিত উইল ইত্যাদির দাবি পরিশোধ বা নিম্পন্ন করার পর বাকি সম্পত্তি উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টিত হয়।
- চাক সমাজের প্রথা অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির ছেলেরা সমান অংশে সম্পত্তির অংশীদার হয়ে থাকে। কন্যাসন্তান কেবল বিয়ে পর্যন্ত ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী। ভূসম্পত্তিতে তাদের কোনো দাবি নেই। তবে জীবদ্দশায় যে কেউ তার মেয়েদের ভূমির যেকোনো অংশ দান করতে পারেন।
- কোনো ব্যক্তি পুত্রসন্তানহীন অবস্থায় মারা গেলে কন্যাসন্তানরা সমান ভাগে ” লাভ করতে পারে। পুত্রের বর্তমানে কন্যারা ভূ-সম্পত্তি পায় না।
- ভূ-সম্পত্তি ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে মেয়েরা সম্পত্তির নির্ধারিত অংশ পায়। বিয়ে প্রথম সন্তান জন্ম দেয়ার পর মেয়েরা নানারকম খাদ্যসামগ্রী নিয়ে আনুষ্ঠানিক বাবার বাড়ি যায়। এসময় কন্যাসন্তান সম্পত্তির অংশ দাবি করে থাকে। রীতি অনুযায়ী কন্যার বাবা টাকা-পয়সা, অলংকার, গবাদিপশু ইত্যাদির মাধ্যমে পানি পরিশোধ করে থাকেন।
- মৃত ব্যক্তির অস্থাবর ও স্থাবর সম্পত্তিতে স্ত্রীর আইনগত উত্তরাধিকার রয়েছে। তবে বিধবা স্ত্রী দ্বিতীয়বার বিয়ে করলে পূর্বের স্বামীর সম্পত্তিতে আইনগত উত্তরাধিকার হরান।
- যে ব্যক্তির ঔরসে অবৈধ বা জারজ সন্তান জন্মু গ্রহণ করে, তার সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুসারে সন্তানের উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়। তবে ভিন্ন কোনো ব্যক্তির পিতৃ পরিচয়ে সন্তান পরিচিত হলে জন্মদাতা পিতার উত্তরাধিকার সে সন্তান দাবি করতে পারে না। এ অবস্থায় জারজ সন্তান কেবল নিজ মায়ের নিজস্ব সম্পত্তির উত্তরাধিকার হয়।
- দত্তক সন্তান পালিত পিতা-মাতার ঔরসজাত সন্তানের সমতুল্য সকল অধিকার ভোগ করে থাকে। তবে ঔরসজাত সন্তান পিতার পদ ও পদবির উত্তরাধিকারী হয়।
চাক জাতির উত্তরাধিকারের বেলায় পিতার সম্পত্তিতে পুত্র ও কন্যাগণ একই সাথে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না।
পুত্রসন্তানের উপস্থিতিতে কন্যারা সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। মৃত ব্যক্তির স্ত্রী এবং কন্যা পুত্রসন্তানের উপস্থিতিতে তা সম্পত্তি থেকে কেবল ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী।
চাক জনগোষ্ঠীর বৈষম্যপূর্ণ উত্তরাধিকার আইন এবং পিতৃতান্ত্রিক পরিবার কাঠামোতে সামাজিকভাবে পুরুষকে বিশেষ সুবিধা দেবার কারণে চাক নারীকে নানারকম নির্যাতনের বলি হতে হয়।
পিতার সম্পত্তিতে পুত্রের সাথে কন্যার সমান ভাগ দেয়া হলে এবং সম্পত্তির ওপর কন্যাসন্তানের পূর্ণ অধিকার দেয়া হলে নারী নির্যাতন বহুলাংশে রোধ হবে এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা লাভ করবে বলে মনে হয়।
তথ্যসূত্রঃ প্রথাগত আইনে আদিবাসী পাহাড়ী নারীর অবস্থান (এডভোকেট সুস্মিতা চাকমা)।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।