চাক জনগোষ্ঠী বিবাহ বিচ্ছেদ (পেনেহে কা)
960
চাক বিবাহ বিচ্ছেদ
চাক পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করাকে ‘পেনেহে কা’ বলা হয়।
বিবাহ বিচ্ছেদের বিভিন্ন পদ্ধতি
স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কোনো একজনের মৃত্যুতে চাক সমাজ স্বীকৃত একটি দাম্পত্য জীবন তথা বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে সমাজ ও আইন স্বীকৃত উপায়ে নিম্নবর্ণিত কারণে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে জীবদ্দশায় বৈবাহিক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি বা ‘পেনেহে কা’ হতে পারেঃ-
ক) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে রোয়াজার উপস্থিতিতে ‘পেনেহে কা’ সম্পাদন হতে পারবে।
খ) চাক জনগোষ্ঠীভুক্ত রোয়াজার উপস্থিতিতে কার্বারীর আদালতে অথবা কার্বারী আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হেডম্যান আদালতে এবং হেডম্যান আদালতের বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সার্কেল চীফ-এর আদালতে আপীল করা যায়। এ বিষয়ে সার্কেল চীফের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। তবে অদ্যাবধি চাক সমাজে ‘পেনেহে কা’ সংক্রান্ত কোনো প্রকার সামাজিক মোকদ্দমা হেডম্যান আদালতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সার্কেল চীফ আদালত পর্যন্ত গড়ায়নি।
কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী ‘পেনেহে কা’ দাবী করার অধিকার লাভ করে
নিম্নোক্ত কারণে চাক সমাজে স্বামী বা স্ত্রী ‘পেনেহে কা’ প্রদানের অধিকার লাভ করেঃ-
ক) স্বামী যদি দৈহিক মিলনে অক্ষম বা পুরুষত্বহীন হয় কিংবা স্ত্রী সন্তান গর্ভধারণে অক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যথোপযুক্ত ডাক্তারী পরীক্ষার সনদপত্র দ্বারা ‘পেনেহে কা’ দাবী করতে পারে।
খ) স্বামী বা স্ত্রী যদি পরকীয়া প্রেম কিংবা ব্যভিচারে বা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে লিপ্ত হয়, এ ধরণের অপরাধের জন্য যে কোনো একজন তার সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে অর্থদন্ড দিতে হয়। অপরজন ‘পেনেহে কা’ দাবী করতে পারে।
গ) স্ত্রীর সম্মতি বা অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামী দ্বিতীয়বার বিবাহ করলে সেক্ষেত্রে সতীনের সাথে একত্রে বসবাসে অসম্মত হয়ে প্রথমা স্ত্রী সামাজিক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে ‘পেনেহে কা’ দাবী করতে পারে।
ঘ) স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের যে কেউ নিরুদ্দেশ হলে এবং বহু বছর যাবৎ উভয়ের কোনো প্রকার দাম্পত্য সম্পর্ক বা পারিবারিক যোগাযোগ না থাকলে সেক্ষেত্রে যে কোনো একপক্ষ সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘পেনেহে কা’ সম্পাদন করে দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হতে পারে।
ঙ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যদি মানসিক বিকারগ্রস্ত অথবা বিকৃত রুচির হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘পেনেহে কা’ প্রদান করতে পারে।
চ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন বৌদ্ধ পুরোহিত বা ‘সাধুমা’ হলে, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ একতরফাভাবে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘পেনেহে কা’ সম্পাদন করতে পারে।
ছ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ নিষ্ঠুর প্রকৃতির, অহেতুক সন্দেহ প্রবণ, মাদকাসক্ত, অকর্মণ্য এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনকারী হলে, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘পেনেহে কা’ সম্পাদন করতে পারে।
জ) স্ত্রী যদি স্বামীর সংসারে প্রাপ্য ভরনপোষণ, ন্যায্য অধিকার, চিকিৎসা-সেবা ও পারিবারিক মর্যাদাসহ স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সেক্ষেত্রে স্ত্রী সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘পেনেহে কা’ সম্পাদন করতে পারে।
ঝ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি পরস্পর অবিশ্বস্ত বা অবাধ্য হয়, পারিবারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালনে অনিচ্ছুক বা উদাসীন হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘পেনেহে কা’ প্রদান করতে পারে।
বিবাহ বিচ্ছেদের (পেনেহে কা) আইনগত ফলাফল
ক) সমাজ স্বীকৃত পদ্ধতিতে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘পেনেহে কা’ সম্পাদিত হলে স্বামী-স্ত্রী যে কেউ পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।
খ) ‘পেনেহে কা’ সম্পাদনের পর স্বামী বা স্ত্রী এমনকি উভয়ের সম্মতিতে দৈহিক মিলন অবৈধ হয়। এরূপ দৈহিক মিলনের কারণে গর্ভজাত সন্তান অবৈধ বা জারজ সন্তান হিসেবে গণ্য হয়।
গ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো পক্ষ দ্বারা ‘পেনেহে কা’ সম্পাদনের পর পারস্পরিক সমঝোতা ও আস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ‘মংনাঙ পো’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুনঃ বিবাহ দ্বারা সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হয়।
ঘ) ‘পেনেহে কা’ সম্পাদনের পর স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে উভয়ের প্রতি পারস্পরিক অধিকার এবং কর্তৃত্ব হারায়।
ঙ) ‘পেনেহে কা’ সম্পাদনের পর স্ত্রী তার পূর্ব স্বামীর উত্তরাধিকারসহ পারিবারিক পদবী ও মর্যাদা হারায়।
চ) ‘পেনেহে কা’ সম্পাদনের সাথে সাথে স্ত্রী তার স্বামীর আইনগত উত্তরাধিকার হারায়, তবে স্ত্রীর আর্থিক অসঙ্গতি কিংবা অসুস্থতার জন্য সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে স্ত্রী এক বছরের খোরপোষ পাবার অধিকারী হয়।
ছ) ‘পেনেহে কা’ হবার পর স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিসহ ভরনপোষণ হতে স্ত্রী বঞ্চিত হয় এবং স্বামী সরকারী চাকুরীজীবি হলে স্বামীর মৃত্যুর পর ‘পেনেহে কা’ প্রাপ্ত স্ত্রী পেনশন সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়।
‘পেনেহে কা’ সম্পাদনকালে স্ত্রী গর্ভবতী অবস্থা
ক) ‘পেনেহে কা’ বা বিবাহ বিচ্ছেদের সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী অবস্থায় থাকলে অনাগত সন্তানের দায়-দায়িত্ব থাকে অথবা ‘পেনেহে কা’ সম্পাদনের পর স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ সত্ত্বেও যদি ধাত্রী বিদ্যামতে প্রমাণিত হয় যে, বিচ্ছেদ পূর্ব সময়ে স্ত্রী গর্ভবতী ছিল, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত পূর্ব স্বামীকে পিতৃত্বের স্বীকৃতি দিতে হয়।
তাকে অবৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য করা হয় না। সন্তান পিতার সাথে থাকলে পিতার উত্তরাধিকারী হয়। তবে সন্তান কন্যা হলে মাতার সাথে অবস্থান করে এবং পিতার উত্তরাধিকারী হয় না।
সন্তান পুত্র হলে পিতার অধিকারে থাকে। উক্ত পুত্র সন্তান সাবালকত্ব অর্জন না করা পর্যন্ত বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর হেফাজতে রাখার অধিকার থাকে।
বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রীর অন্যত্র বিবাহ হলে, সেক্ষেত্রে সন্তান যদি মাতৃদুগ্ধ পান না করে তবে জন্মদাতা পিতা তার সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে নাবালক সন্তানের অভিভাবক হয়।
খ) গর্ভবতী অবস্থায় স্বামীর দ্বারা বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর ভরনপােষণ পাবার দাবি সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে নির্ধারণ হয়।
গ) বিবাহ বিচ্ছেদ বা ‘পেনেহে কা’ সম্পাদনের তারিখ হতে পরবর্তী ২৮০ দিন পর বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রী যদি গর্ভ ধারণ করে, সেক্ষেত্রে ধাত্রী বিদ্যামতে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্বামী উক্ত সন্তানের পিতৃত্বের গ্রহণে বাধ্য নয়। বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভজাত এ ধরণের সন্তানের দায়দায়িত্ব চাক সমাজের রীতিনীতি অনুসারে সামাজিক আদালত নির্ধারণ করে।
তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।