জনসংহতি সমিতির গৃহযুদ্ধ ও তারপর
653
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে। সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধিবাসীগণের মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।
আন্দোলনে প্রবীণদেরকে শরীক করবার জন্য সভাপতি পদে নির্বাচিত করা হয়েছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সাবেক সদস্য শ্রী বীরেন্দ্র লাল রােয়াজাকে।
সমিতির অন্যান্য পদে শ্রী তিলক চন্দ্র চাকমাসহ সে সময়কার আরাে অনেক নেতৃস্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি ছিলেন। সমিতি প্রতিষ্ঠার এক যুগের মাথায় ১৯৮০ দশকের প্রথমার্ধে সমিতির অভ্যন্তরে গৃহহিবাদ থেকে গৃহযুদ্ধ সূচিত হয়।
ঐ গৃহযুদ্ধে ক্ষতি হয় অনেক অনেক। এক পর্যায়ে সমিতির গৃহযুদ্ধ অবসান হয়। সমিতি নানা ধরনের অনুকূল-প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। পরিশেষে ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে ০২ ডিসেম্বর তারিখে সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীগণের অধিকার সনদ ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশের শাসকগােষ্ঠীর উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদী ও উগ্র ইসলামিক সম্প্রসারণবাদী দৃষ্টিভঙ্গীজনিত তীব্র আগ্রাসী দমন নীতির কারণে কার্যত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন ফলপ্রসূ হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না। তবু মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার পরিচালনাধীন সমিতি তথা জুম্ম জনগণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে থাকে।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য আইন পরিষদ সম্বলিত স্বায়ত্বশাসন দাবী তুলে ধরে। পাহাড়ী ছাত্র সমিতি ৯ জুন ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দ তারিখে রাঙামাটি শহরে স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে মিছিল ও সভা করে। তবে বাজার এলাকায় সরকারী প্রশাসন ও বাঙালী ব্যবসায়ীদের উগ্র সাম্প্রদায়িকতামূলক একাধিপত্য থাকায় সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক আক্রমণের আশংকায় পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য স্থানে সে ধরনের সভা বা মিছিল সে সময়ে হতে পারে নি।
১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে জরুরী অবস্থা জারী হয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ করে রাইংখ্যং উপত্যকায় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ রাইফেলস বাহিনীর দমন অভিযান শুরু হয়।
১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে একদলীয় শাসন ঘােষিত হয় এবং এর পরে ১৫ আগস্ট সেনা অভ্যুত্থান হয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। জনসংহতি সমিতি ও পাহাড়ী ছাত্র সমিতির কাজ কার্যত বেআইনী হয়ে পড়ে। এ সমিতিদ্বয়ের যেসব কর্মী ও নেতৃবৃন্দ আন্দোলনের কাজ-কর্মে সক্রিয় ছিলেন তারা আত্মগােপন করতে বাধ্য হন।
কথায় আছে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি কি ধরনের হবে তা নির্ভর করে শাসকগােষ্ঠীর উপর। শাসকগােষ্ঠী যদি কঠোর দমন-পীড়ন চাপিয়ে দেয় তখন সাধারণ মানুষ জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধানের জন্য বাধ্য হয়ে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
তার সংগ্রামের পদ্ধতি কি ধরণের হবে অর্থাৎ সংগ্রামের পদ্ধতি গণতান্ত্রিক হবে নাকি অগণতান্ত্রিক হবে তা শাসকগোষ্ঠীর পদক্ষেপের উপর ভিত্তি করেই আন্দোলনকারীগণ নির্ধারণ করতে বাধ্য হন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। দেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকে প্রথমে বিদ্রোহীদের দমনের নামে এবং পরে জুম্মদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনকে বানচাল করবার জন্যে চরম দমন পীড়ন চলতে থাকে। জমি জবর দখল, বিনা দোষে গ্রেপ্তার, মারধাের জোরদার হয়। এ সব প্রতিরােধের জন্য সরল প্রাণ অসহায় ও শান্তিপ্রিয় জুম্ম জনগণ অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়।
সামরিক সমাধানের অংশ হিসাবে সরকার ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে পর্ণাঙ্গভাবে অতি দ্রুত বাঙালী মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করবার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের শুরু থেকে সরকারী অর্থায়নে ব্যাপকহারে সমতল অঞ্চলের বাঙালীদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি প্রদানের কার্যক্রম হাতে নেয়।
পাশাপাশি জন সংহতি সমিতির সাথে আলােচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের অপপ্রচারমূলক বক্তব্য জোরদার করে। এতে সহায়ক ভূমিকা রাখেন বিশেষতঃ ‘ট্রাইবেল কনভেনশন’এর নেতৃবৃন্দ।
তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মােস্তাফিজুর রহমান তাঁর এক বক্তব্যে ঘােষণা করেন যে, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানার্থে জন সংহতি সমিতির সাথে শান্তি আলােচনা করতে ইচ্ছুক। তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য শ্রী উপেন্দ্র লাল চাকমাকে সমিতির সাথে আলােচনার ব্যবস্থা করতে মৌখিকভাবে দায়িত্ব দেন।
শ্রী উপেন্দ্র লাল চাকমা ও তার নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস হতে সমিতির সাথে যােগাযােগ করতে থাকেন। সমিতি এতে সাড়া দেয়। সমিতির সভাপতি শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সে সময়কার রাজনৈতিক এবং তথ্য ও প্রচার বিষয়ক সম্পাদক গৌতম কুমার চাকমার নেতৃত্বে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদলকে যােগাযােগ ও আলােচনার জন্য দায়িত্ব প্রদান করেন।
সমিতি শ্রী উপেন্দ্র লাল চাকমার মাধ্যমে সরকারের নিকট হতে লিখিতভাবে জানতে চায় সমিতির সাথে আলােচনার ব্যবস্থা করতে সরকার কতৃক তাকে (উপেন্দ্র বাবুকে) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কিনা অর্থাৎ তিনি সরকারের স্বীকৃত প্রতিনিধি কিনা। এ বিষয়ে সরকার কোন কিছুই লিখিতভাবে জানাতে বরাবরই অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে।
তা থেকে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, সরকার কার্যত আনুষ্ঠানিকভাবে কোন আলােচনা বা সমস্যা সমাধান করতে তখনাে প্রস্তুত ছিল না। কেবল “বাঙালী সেটেলার বসতি প্রদান কার্যক্রম’কে আড়াল করবার জন্যই সরকার আলােচনা করতে চায় ও সমস্যা সমাধানে আগ্রহী বলে ব্যাপকভাবে অপপ্রচার করতে থাকে।
এ উদ্দেশ্যে সরকার সেনা কর্তৃপক্ষের মা ট্রাইবেল কনভেনশন নেতাদেরকে দিয়ে সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বক্ষণ সভা ও আলােচনার ব্যবস্থা করে। দেশে ও বিদেশে প্রচার করা হয় যে, সরকার সমস্যা সমাধানে আন্তরিক; কিন্তু সমিতি তা চায় না। জুম্ম জনগণ ও বিশ্ববাসী তাতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।
ট্রাইবেল কনভেনশন নেতৃবৃন্দ ও জনগণ সমিতির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সরকারের সাথে বৈঠক করার বিষয়ে অনমনীয়তার অভিযোগ তুলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মাত্র তিন দশমিক এক শতাংশ জমি সমতল ও লাঙল দিয়ে চাষযোগ্য এবং উক্ত প্রায় সব জমি তখন স্থানীয় পাহাড়ী ও বাঙালী অধিবাসীদের নামে রেকর্ডভুক্ত ছিল।
সমতলবাসী বাঙালী সেটেলারদের পক্ষে পাহাড়ে জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করা ছিল কল্পনাতীত। অগত্যা সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে বাঙালী সেটেলারদেরকে দিয়ে আদিবাসী পাহাড়ী বা জুম্ম অধিবাসীদের উপর বরাবরই এক তরফা সামপ্রদায়িক আক্রমণ চালানাে হয়। উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসী জুম্মদেরকে উচ্ছেদ করে বাঙালী সেটেলারদেরকে সমতা চাষযোগ্য ভূমিতে পুনর্বাসন দেওয়া।
জন সংহতি সমিতি তা প্রতিরােধ করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সমিতির নেতৃতে পরিচালিত সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধের কারণে তা অনেকাংশে বাধাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে ফেনী উপত্যকায় মাটিরাঙ্গা, রামগড় ও মানিকছড়ি উপজেলায় বা থানা এলাকায় সংঘটিত ব্যাপক আক্রমণের প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং বাঙালী সেটেলারগণ হাজারে হাজারে স্ব স্ব জেলায় প্রত্যাবর্তন করতে থাকে।
এমনি সময়ে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে অভ্যন্তরীণ মত পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। বিভেদ-বিবাদ চলতে থাকে। সমিতির সশস্ত্র কার্যক্রম ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ে।
সরকার শ্রী উপেন্দ্র লাল চাকমার মাধ্যমে সমিতির সাথে সে দফায় সর্বশেষ যােগাযোগ করে। ১৯৮২ সালের অক্টোবর মাসে। সমিতির মধ্যেকার বিবাদের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সরকার সমিতির সাথে যােগাযােগ বন্ধ করে।
বলা যায়, সমিতির অভ্যন্তরে বিবাদ, বিভেদ ও যুদ্ধ না হয়ে থাকলে সমিতির শক্তিকে বিবেচনা করে সরকার তখনকার সময়েই হয়তাে আনুষ্ঠানিক আলােচনা শুরু করতাে। আলােচনা শুরু হলে বাঙালী সেটেলারদেরকে বসতি প্রদানের বিষয়টি হয়তাে স্থগিত বা মন্থর হতে পারতাে।
এর পর সমিতির মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ১৪ জুন ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ তারিখে। পরিণতিতে সমিতির প্রতিষ্ঠাতা নেতা এম. এন. লারমা শহীদ হন ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর তারিখে। জুম্ম জনগণের জাতীয় প্রতিরােধ যুদ্ধের ঐক্যবদ্ধ শক্তি ভেঙে পড়ে।
তবুও সমিতি ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে বরকল উপজেলায় সেনাবাহিনী ও মানব ঢাল (Human Shield) হিসাবে ব্যবহৃত বাঙালী সেটেলারদের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত আক্রমণ পরিচালনা করে ও সফলতা অর্জন করে। জুম্ম জনগণ গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে বিভ্রান্তিমুক্ত হন এবং সমিতির জাতীয় সংগ্রাম পরিচালনার কার্যকরী শক্তি ও লক্ষ্য বিষয়ে আশ্বস্ত হন।
১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৯ এপ্রিল সেনা কর্তৃপক্ষের সাথে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির ভিত্তিতে সমিতির বিভেদপন্থী হিসাবে আখ্যায়িত প্রীতি গ্রুপ রাঙ্গামাটি স্টেডিয়ামে সে সময়কার সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল নুরুদ্দিন খানের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয়।
সরকার বা সেনা কর্তৃপক্ষ কিছু সংখ্যক নেতা বা কর্মীকে চাকুরীতে নিয়ােগ প্রদান করে ও কিছু আর্থিক সুযােগ-সুবিধা দেয়। তবে উক্ত চুক্তির অন্য কোন দফা যেমন-জায়গা-জমি বেদখল ও বাঙালী সেটেলারদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি প্রদান বন্ধ করা ইত্যাদি সরকার পূরণ করেনি। বিভেদপন্থী গ্রুপ অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয়ায় সমিতির গৃহযুদ্ধ অবসান হয়।
সমিতি নতুন করে প্রস্তুতি নিতে থাকে। সে সময়কালের গৃহযুদ্ধে কোন বিদেশী শক্তি জড়িত ছিল কিনা এবং থাকলেও কোন বিদেশী তা আজো রহস্যাবৃত। তবে, এ গৃহবিবাদ ও গৃহযুদ্ধের মূলে প্রথমতঃ কিছু সংখ্যক নেতা ও কর্মীর ক্ষুদ্র স্বার্থপরতাজনিত কারণে আদর্শগত ও নীতিগত বিচ্যুতি এবং সাথে যুদ্ধের কৌশলগত প্রশ্নে বিভ্রান্তি এবং দ্বিতীয়তঃ কোন না কোন বিদেশী শক্তির প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ প্ররােচনা অবশ্যই দায়ী ছিল।
উল্লেখ্য, সে গ্রুপের অন্যান্য নেতা ও কর্মীরা নিছক রাজনৈতিক বিভ্রান্তির কারণে অতি দ্রুত যুদ্ধ বিজয়ের ও জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খায় সে পথে রেখেছিলেন। জান্তে ভুল করা আর অজান্তে ভুল করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে ঠিকই। কিন্তু সে ক্ষতি আর পূরণ করা যায়নি।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সরকার পাঁচ লক্ষাধিক বাঙালী সেটেলারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানান্তর করে। এতে গৃহযুদ্ধের সযােগে সরকার জম্মদেরকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করবার প্রথম পর্যায়ের কাজ উল্লেখযােগ্য বাধা ছাড়াই সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়।
সে পর্বে সরকার পক্ষেরই হয় বিজয়। আর এ বিজয়ে সহায়তা করেছিল সমিতির গহযুদ্ধ। সরকার পক্ষ যুদ্ধের মাধ্যমে যে সফলতা অর্জন করতে পারেনি সমিতির আত্মঘাতী গৃহবিবাদ ও গৃহযুদ্ধ সরকারকে সে সফলতা অর্জনের সুযােগ করে দিয়েছিল।
সমিতির অপরিণামদর্শী কতিপয় নেতার অহেতুক অহংকারবােধ, নিছক ক্ষুদ্র স্বার্থপরতা ও রাজনৈতিক বিভ্রান্তিজনিত কারণে জুম্ম জাতির জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়- যা কার্যত পঞ্চম বাহিনীর অর্থাৎ জাতীয় বিশ্বাসঘাতক বাহিনীর ভূমিকায় সামিল হয়ে পড়ে।
গৃহযুদ্ধ অবসানের পর জুম্ম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ও জাতীয় যুক্তফ্রন্টের নীতির আলােকে এম. এন. লারমার প্রদত্ত ক্ষমা করা ও ভুলে যাওয়া নীতি’কে ধারণ করে সমিতি নতুন করে পার্টি সংগঠন ও গণ সংগঠনকে পুনর্গঠিত করতে থাকে।
তবুও বিভেদপন্থী গ্রুপের কিছু কিছু নেতা ও কর্মীর অপপ্রচার ও অপতৎপরতা চলতে থাকে বেশ কিছুদিন। সমিতিতে কথা উঠে যারা এতাে বড়াে ক্ষতি করেছেন তাদের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অর্থাৎ প্রাণ হরণের জন্য।
এম. এন. লারমার ধ্যান-ধারণা ও জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রাধিকারের বাণী তখনাে ছিল তরতাজা। তাই, ‘নাকের বদলে নাক নেবার নীতি’ কার্যকর হতে পারেনি।
এ বিষয়ের সমর্থনে যুক্তি উত্থাপিত হয় যে, ‘যতদিন সমাজ থাকবে, বৈষম্য থাকবে ততদিন মত-পার্থক্য ও মত-বিভেদ প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকবে’। তবে জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকালে জুম্ম সমাজে তা যেন সশস্ত্র সংঘাতের দিকে মােড় নিতে না পারে সে চেষ্টা রাখতে হবে।
সমিতির এ নীতি ও প্রক্রিয়ার অনুকূল ফলস্বরূপ জাতীয় স্বার্থে বিভেদপন্থী গ্রুপের অনেকে সমিতিতে যােগদান করেন, অনেকে নিরপেক্ষ হন এবং অবশিষ্টরা কম-বেশী নিষ্ক্রিয় বা দুর্বল হয়ে পড়েন।
পরিণতিতে আভ্যন্তরীণ বিভেদ ও কলহ ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। অতি দ্রুত জাতীয় ঐক্য পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় ও আন্দোলন অব্যাহত থাকে। হয়তাে জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার ঐকান্তিক আন্তরিকতা ও আকাঙ্খাই এতাে দ্রুত এ বিবাদ-বিভেদ নিরসনে সহায়ক হয়েছিল।
প্রমাণিত হয়েছিল যে, জুম্ম জাতি জাতীয় স্বার্থে আত্মঘাতী বিবাদ-বিভেদকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে, ব্যক্তি বিশেষের অহংবােধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সমগ্রের স্বার্থে।
এ অবস্থায় ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট জেনারেল মুহম্মদ এরশাদ সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সংহতি সমিতির প্রথমবারের মত আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়।
এরশাদ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা হিসাবে পরিচিহ্নিত করে এবং উক্ত সমস্যা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের জন্য লিখিতভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সরকার পক্ষ হতে প্রকাশ্যে উক্ত বিষয়ে ঘােষণা দেয়া হয়। এতােদিন যাবৎ পূর্বেকার সরকারসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে অর্থনৈতিক সমস্যা হিসাবে তুলে ধরে প্রচুর বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে আন্দোলন দমনের জন্য উক্ত অর্থ ব্যবহার করে আসছিল।
তাই, সেনা সরকারের উক্ত ধরনের ঘােষণা ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। ১৯৭৫-পরবর্তীকালের বাংলাদেশের দুর্বল রাজনৈতিক নেতৃত্বের বাস্তবতায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত কোন সরকার সে সময়কালে উক্ত ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ও সে রকম ঘােষণা দিতে পারতাে কিনা প্রশ্ন থেকে যায়।
সমিতি আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা রাখে সরকারের সাথে আলােচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানকল্পে চুক্তিতে উপনীত হবার জন্য। সরকারের গতি-প্রকৃতি মূল্যায়ন করে সমিতি ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সফলভাবে প্রস্তুতি পর্ব সম্পন্ন করে এবং সশস্ত্র কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে ঠিক করে যে, সরকারের সেনাবাহিনী ও বাঙালী সেটেলারদের নৃশংস সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার প্রেক্ষিতে যেসব পাহাড়ী পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে পড়বেন এবং তাদের মধ্যে যে সব পরিবার কোনাে অবস্থাতেই নিরাপত্তাজনিত কারণে নিজেদের গ্রামে বা বাড়ী-ঘরে ফিরতে পারবেন না ও জীবন-জীবিকার সংস্থান করতে সক্ষম হবেন না কেবল তাদেরকেই প্রতিবেশী দেশ ভারতে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নিতে দেওয়া হবে।
কারণ, এম. এন. লারমা বলেছিলেন যে, জায়গা একবার হারালে তা পুনরুদ্ধার করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। তাই, সমিতি ‘ভূমি আঁকড়ে থাকবার নীতি’ অর্থাৎ জনগণকে জায়গা-জমি ছেড়ে যেতে না দেবার নীতি গ্রহণ করে।
অতঃপর ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ এপ্রিল থেকে সমিতি পুনরায় বিভিন্ন সেনা ক্যাম্পের উপর সশস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা শুরু করে। সমিতি লড়াইয়ে সফলতা অর্জন করতে থাকে। এ সব লড়াইয়ের প্রেক্ষিতে নিরাপত্তাহীন হয়ে অনেক সেটেলার পরিবার সমতল অঞ্চলের স্ব স্ব গ্রামে ফিরে যায়।
সেনা কর্তৃপক্ষ এ ধরনের পালিয়ে যাওয়া বারণ করবার জন্য সেনা চেকপােস্টে কড়াকড়ি ব্যবস্থা। গ্রহণ করে। তখন অনেক সেটেলার পরিবার স্থানীয় পাহাড়ী ও সমিতির সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় পাহাড় ও বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে সমতল অঞ্চলে চলে যেতে থাকে। অনুমান করা যায় যে, এভাবে সাড়ে পাঁচ লক্ষ সেটেলারদের মধ্যে প্রায় দেড় লক্ষ সেটেলার স্ব স্ব জায়গায় ফিরে যায়।
সরকার সেনা কর্তৃপক্ষ এবং বিভিন্ন মৌলবাদী ব্যক্তি ও সংগঠনের ব্যবস্থাপনায়। সমতল অঞ্চল হতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্নভাবে সেটেলার পরিবারকে নানাভাবে প্রলুদ্ধ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসা অব্যাহত রাখে।
তবে, সমিতির সশস্ত্র কার্যকলাপের কারণে অধিকাংশ সেটেলার পরিবার সেনা ক্যান্টনমেন্ট বা ক্যাম্পের গুচ্ছগ্রামে বসবাস করতে বাধ্য হয় এবং সরকারের দ্বিতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম অর্থাৎ সেটেলারদেরকে জায়গা-জমি দিয়ে ভালভাবে পুনর্বাসন করার কাজ ব্যাহত হয়।
সমিতির সাথে সশস্ত্র লড়াইয়ে সুবিধা করতে না পেরে সরকার সেনাবাহিনী ও সেটেলারদেরকে নিরীহ ও নিরস্ত্র পাহাড়ীদের উপর লেলিয়ে দেয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাক হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকার, আলবদর, আল শামসবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধ বিরােধী ঘাতক বাঙালীরে সহায়তায় যেভাবে নিরস্ত্র বাঙালী নারী-পুরুষ-শিশুর উপর নির্মম নিষ্ঠুর কর্মকান্ড সংঘঠিত করেছিল ততােধিক হিংসা ও নৃশংসতায় বাঙালী সেটেলার দিয়ে স্থানীয়ভাবে গঠিত গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী ও বাঙালী সেটেলারদের সহযােগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাহাড়ীদের গ্রামের উপর নির্বিচারে ঝাপিয়ে পড়ে।
গ্রামের পর গ্রাম পাহাড়ী শূন্য হয়ে পড়ে। ঘর-বাড়ী লুন্ঠন, ভূমি বেদখল, নারী-ধর্ষণ ও নির্বিচারে নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ ও শিশুকে গুলি করে হত্যার ঘটনা বিভিন্ন মহাদেশে উপনিবেশিক শাসনামলে সংঘঠিত দৃষ্টান্তকেও হার মানায়।
সমিতির বিভিন্ন ইউনিট জায়গা-জমি খালি না করবার নীতি যথাসম্ভব কার্যকর রাখার প্রচেষ্টা রাখে। তবে এর ব্যতিক্রম ঘটেনি তা বলা যাবে না। আন্তর্জাতিক প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহায়তার মাধ্যমে অতি দ্রুত যুদ্ধ নিষ্পত্তির ভ্রান্ত আশাই ছিল উক্ত ব্যত্যয়ের কারণ।
প্রতিবেশী দেশ ভারত পাহাড়ীদেরকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে। আদিবাসী পাহাড়ী উদ্বাস্তুরা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বাধার সম্মুখীন হয়। ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী উদ্বাস্তু পাহাড়ীদেরকে সীমান্ত অতিক্রমে বাধা দেবার জন্য কোথাও কোথাও বেদমভাবে মারধর করে।
যারা চুপিসারে সীমান্ত অতিক্রম করে ত্রিপুরা রাজ্যের শিলাছড়িতে প্রবেশ করে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স- বিএসএফ) তাদেরকে জোর। করে ফেরত পাঠাবার (পুশব্যাক) করার প্রচেষ্টা চালায়।
বাংলাদেশের মাটিরাঙ্গা উপজেলার তবলছড়ি ও তাইন্দং সীমান্তে বাধাপ্রাপ্ত আদিবাসী পাহাড়ী উদ্বাস্তুদের মধ্যে ১৯৮৬ সালের মে মাসে একদিনে প্রায় ১৫০ (এক শত পঞ্চাশ) জন বাংলাদেশ বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। এতে ভারতের বিরুদ্ধেও মানবাধিকার লংঘনের গুরুতর অভিযােগ উঠে।
উক্ত সংবাদ দেশে-বিদেশে প্রচারিত হলে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের গভর্নর কে. ভি. কৃষ্ণ রাও দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার শিলাছড়ি সফরে যান। তিনি আশ্রয়প্রার্থী আদিবাসী পাহাড়ীদের সাথে কথা বলেন এবং পরিস্থিতির বাস্তবতা অনুধাবন করে মানবিক সাহায্য ও আশ্রয় প্রদানের আশ্বাস জ্ঞাপন করেন।
তৎকালীন মানবতাবাদী ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী নৃপেন চক্রবর্তী তাতে সায় দেন। সর্বাগ্রে স্থানীয় পাহাড়ী অধিবাসীগণ ও রাজ্যপালের সহধর্মিনীর নেতৃতে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার মহিলা সংগঠন আশ্রয়প্রার্থী আদিবাসী পাহাড়ীদেরকে ত্রাণ সামগ্রী সরবরাহ করে। পরে সরকার দায়িত্ব নেয়।
আদিবাসী পাহাড়ীরা মানবিক কারণে আশ্রয় পেলেও প্রতিকূল পরিবেশ, খাদ্য, চিকিৎসা ও বাসস্থানের অপ্রতুলতার কারণে প্রথম দিকে শতে শতে প্রাণ হারায়। বাংলা সেনাবাহিনী ও বাঙালী সেটেলারগণ সম্মিলিতভবে সম্পদ লণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ, নারী ধর্ষণ এ গণহত্যার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে যেতে থাকে।
সমিতি প্রতিরােধ যুদ্ধ অব্যাহতভাবে চালিয়ে গেলেও সকল আদিবাসী পাহাড়ীকে নিরাপত্তা প্রদান করা সম্ভব ছিল না।
আদিবাসী পাহাড়ীরা প্রতিবেশী দেশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় নিতে থাকে। ভারতের মিজোরাম রাজ্য সরকার বৈরীতামূলক আচরণ করে ও তাদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
১৯৮৬ খ্রীষ্টাব্দে পরবর্তীতে আরাে কিছু সংখ্যক আদিবাসী পাহাড়ী মিজোরাম রাজ্যে প্রবেশ করে। মিজোরাম সরকার এ সব শরণার্থীদেরকে আশ্রয় দেয় নি। এদের মধ্যে অনেকে পরে অতি কষ্টে ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়।
তবে, আদিবাসী পাহাড়ী উদ্বাস্তুদের মধ্যে অধিকাংশই পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থান করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন।
সরকার ও সমিতির মধ্যে আলােচনার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। জন সংহতি সমিতি ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বৈঠকে সরকারের নিকট প্রাদেশিক আইন পরিষদ সম্বলিত স্বায়ত্বশাসনসহ পাঁচ দফা দাবীনামা পেশ করে।
সরকার পক্ষের প্রতিনিধিদল তাৎক্ষণিকভাবে আলােচনার জন্য ঐ দাবীনামা গ্রহণ করে। বিশেষতঃ বৈঠকে উপস্থিত সামরিক কর্মকর্তাগণ কোন কোন দাবী পূরণযােগ্য সে বিষয়ে মতামত জ্ঞাপন করেন।
তবে যিনি বেসামরিক কর্মকর্তা ছিলেন তিনি ছিলেন নিরুত্তর। উক্ত বেসামরিক কর্মকর্তা উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদী ও উগ্র ইসলামিক আদর্শে প্রভাবিত থাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পক্ষপাতী ছিলেন না বলে অনুভূত হয়েছিল।
পরবর্তী দিনের বৈঠকে সরকার পক্ষের প্রতিনিধিদল সমিতির দাবীনামা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণের ক্ষেত্রে অপারগতা প্রকাশ করে। পরিবর্তে সরকার পক্ষ নয় দফা রূপরেখা উত্থাপন করে। সরকার পক্ষ উভয় পক্ষের দাবীনামা পাশাপাশি রেখে আলােচনা চালিয়ে যেতে প্রস্তাব রাখে। সমিতি তাতে অসম্মতি প্রকাশ করে। আরাে কয়েক দফা বৈঠক হয়। উভয় পক্ষ অনড় অবস্থা নিলে আলােচনার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় আদিবাসী পাহাড়ী বা জুম্ম নেতৃবৃন্দকে দিয়ে নয় দফা রূপরেখার অনুকূলে ব্যাপক প্রচার কার্য চালাতে থাকে। শান্তিপ্রিয় জুম্ম জনগণ সরকারের দমন পীড়নে ততক্ষণে প্রায় শ্রান্ত ও ক্লান্ত। শান্তিই তাদের একমাত্র কাম্য হয়ে উঠে।
সরকার পক্ষ ব্যাখ্যা দেয় পাঁচ দফার চেয়ে নয় দফা বেশী। এ ধরণের প্রচার কাজে সহায়তা করে সেনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত ট্রাইব্যাল কনভেনশন। জুম্ম জনগণ এতে প্রভাবিত হন। তারা প্রশ্ন তুলেন সমিতির পাঁচ দফার পরিবর্তে সরকার নয় দফা অধিকার দিতে চায় অর্থাৎ সরকার বেশী পরিমাণ আধকার দিতে চায়- সমিতি তা গ্রহণ করতে চায় না কেন? তাঁদের মধ্যে অনেকে সমিতির উপর রুষ্ট হন। সমিতি কঠোর চাপের মুখােমুখী হয়ে পড়ে।
অনেক কষ্টে সমিতি জুম্ম জনগণের নিকট সে বিভ্রান্ত কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়। বিশেষতঃ গ্রামাঞ্চলের সাধারণ জম্ম জনগণ বুঝতে পারেন যে পাঁচ দফার মধ্যে স্থানীয়ভাবে নিজেরাই নিজেদেরকে শাসন করতে পারার অধিকার রয়েছে অথচ নয় দফায় তা নেই।
পাঁচ দফায় ভূমি অধিকারের বিধান রয়েছে নয় দফায় তা নেই। সবচেয়ে বড়াে কথা হল- পাঁচ দফায় বাঙালী সেটেলারদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নেবার দাবী রয়েছে নয় দফায় সে বিষয়ে কোন ব্যবস্থা রাখা হয় নি।
জুম্ম জনগণ বাঙালী সেটেলার সমস্যা বিষয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ছিলেন। কারণ প্রতিনিয়ত তারাই মুখােমুখী হন। বাঙালী সেটেলারদের নানা ধরনের হয়রানি ও অত্যাচারমূলক কার্যকলাপের। বাগান-বাগিচার লতা-পাতা থেকে শুরু করে জুম্ম নারী-পুরুষের সম্ভ্রম, জীবন ও সম্পত্তি কোনাে কিছুই নিরাপদ নয়।
তাদের সবারই ছিল এক কথা সেটেলারদের সাথে সহ-অবস্থান কোন মতেই সম্ভব নয়। তবে, খাৱা শহরাঞ্চলে বসবাসরত ছিলেন এবং বিশেষ করে সরকারের আনুকূল্যের উপর যাদের জীবনতীবিকা নির্ভরশীল ছিল তাঁদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি এ সব বুঝার পরও না বুঝার মতাে করে সমিতির বিরুদ্ধে। ও নয় দফার অনুকুলে কথা বলতে থাকেন।
অনেক সময়ের ব্যবধানে উভয় পক্ষের যােগাযােগের প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের শেষার্থে পুনরায় বৈঠক শুরু হয়। সরকার পক্ষ নয় দফা রূপরেখার ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে প্রচেষ্টা চালায়।
সমিতি পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবী জানিয়ে যেতে থাকে। এরশাদ সরকারের সাথে মােট ৬ বার আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। এক পর্যায়ে জন সংহতি সমিতিকে বাদ দিয়ে সরকার ট্রাইবেল কনভেনশন নেতাগণের সাথে নয় দফা রূপরেখা ভিত্তিক এক চুক্তি স্বাক্ষর করে।
এর আলােকে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে অর্থাৎ পূর্ব নির্ধারিত ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকের ৬ (ছয়) দিন আগে এক তরফাভাবে পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯ জাতীয় সংসদে পশি করে।
সমিতির সাথে আলােচনার প্রক্রিয়া ভেঙে যায়। শ্রী উপেন্দ্র লাল চাকমা স্থানীয় সরকার পরিষদ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। তিনি নিরাপত্তাজনিত কারণে অনতিবিলম্বে ভারতে শরণার্থী হন।
পরে জানা গেছে যে, প্রেসিডেন্ট এরশাদ পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক পরিষদ সম্বলিত অধিকতর অধিকার প্রদানের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আন্তরিক ছিলেন। সে বিষয়ে তার আরাে প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ ছিল।
এ ব্যাপারে তিনি তখনকার প্রতিমন্ত্রী শ্রী বিনয় কুমার দেওয়ানকে দায়িত্ব দেবার জন্য ডেকেছিলেন। কিন্তু সে সময়কার ২৪ তম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) মেজর জেনারেল আবদুস সালাম ততক্ষণে চাপ দিয়ে তড়িঘড়ি করে স্থানীয় জুম্ম নেতাদেরকে তথাকথিত নয় দফা রূপরেখা ভিত্তিক স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানীয় সরকার পরিষদ ব্যবস্থা গ্রহণ করবার জন্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করাতে সফলকাম হন।
সরকার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচন করে। সমিতি নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয় এবং নির্বাচন বাতিলের প্রচেষ্টা চালায়। জুম্ম অধ্যুষিত অনেক স্থানে ভােট হতে পারে নি এবং কোন কোন স্থানে ভােট পড়ে ৭ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। তবে সেটেলার বাঙালীরা সেনা নিয়ন্ত্রণে ভােট দিতে সক্ষম হয়। সরকার তিনটি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠন করে। পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে উপ-মন্ত্রী পদ-মর্যাদা প্রদান করে।
পরিষদের সদস্য সচিব হিসাবে রেখে দেয় জেলা প্রশাসককে। এ সদস্য সচিবের দায়িত্ব ছিল মূলতঃ দুটি- এক, পরিষদের সভা আহ্বান করা এবং দুই, পরিষদের চেয়ারম্যানকে উপদেশ দেওয়া। পার্বত্য জেলা পরিষদ সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ছিল।
অথচ, জেলা প্রশাসক হলেন মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন কর্মকর্তা। স্বাভাবিকভাবে জেলা প্রশাসক পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের অধীনস্ত ছিলেন না। এতে পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদের কাজ-কর্ম পরিচালনায় সমস্যা দেখা দেয়।
স্থানীয় সরকার পরিষদের হাতে মােট ২২টি কার্যাবলী বা বিষয় হস্তান্তরের বিধান থাকলেও সরকার তা হস্তান্তর করেনি। উন্নয়নের অর্থের সিংহভাগ ব্যয়িত হতে থাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বাের্ডের মাধ্যমে- যার চেয়ারম্যান ছিলেন সেনা বাহিনীর ২৪ তম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কম্যান্ডিং এবং যিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলন দমনের জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিলেন।
পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদসমূহকে কার্যত আন্দোলন দমনের অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করবার প্রচেষ্টা চলতে থাকে। এতে সমস্যার সমাধান হয় নি।
অপরদিকে, সেনাবাহনী ও সেটেলারদের সম্মিলিত অভিযান অব্যাহত থাকে জুম্মদেরকে বিতাড়নের জন্য। খােদ রাঙামাটি শহরের বুকে আদিবাসী জুম্ম গ্রামের উপর লুটপাত ও অগ্নিসংযােগের ঘটনা ঘটে।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদের চেয়ারম্যান শ্রী গৌতম দেওয়ান প্রত্যক্ষভাবে আপ্রাণ চেষ্টা করেও সেদিন এ আক্রমণ বন্ধ করতে পারেন নি। তিনি ছাত্র জীবনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগের নেতা হিসাবে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন।
তাই এ তরুণ নেতা প্রতিবাদে স্থানীয় সরকার পরিষদের চেয়ারম্যান পদ ত্যাগ করেন। দেশে-বিদেশে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। স্থানীয় সরকার পরিষদ ব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের বিভ্রান্তি ও মােহ কেটে যেতে সহজতর হয়।
সমিতি দেশে-বিদেশে প্রচার কার্য জোরদার করতে সক্ষম হয়। উনিশ শ’ আশি দশকে গঠিত। সমিতির ছাত্র ফ্রন্ট ‘পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ’ ও গণফ্রন্ট ‘পাহাড়ী গণ পরিষদ’ প্রতিবাদ ও প্রচার কার্যে ভূমিকা রাখে।
বৌদ্ধ ভিক্ষুগণসহ আরাে অনেকে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ফোরামে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি তুলে ধরেন। জুম্ম জাতির জাতীয় সংগ্রামের অগ্রদূত স্নেহ কুমার চাকমা ও তাঁর সহযােগী ভাগ্য চন্দ্র চাকমা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যানিটি প্রটেকশন ফোরাম’ নিরলসভাবে আন্তর্জাতিক মহলে প্রচার কাজ চালাতে থাকে।
রাষ্ট্রপাল মহাথেরাের পরিচালিত ইন্ডিয়ান বুড্ডিস্ট কাউন্সিলও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখে। দেশবিদেশের রেডিও, টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে মানবাধিকার লংঘন ও আদিবাসীদের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে সমিতি প্রতিনিয়ত প্রচার চালাতে সক্ষম হয়।
এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশন্যাল, সারভাইক্যাল ইন্টারন্যাশন্যাল, ইন্টারন্যাশন্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ইন্ডিজেনাজ এ্যাফেয়ার্স, ইন্টারন্যাশন্যাল ফেলােশীপ অফ রিকন্সিলিয়েশন, লন্ডনস্থ মাইনােরিটি রাইটস গ্রুপ, ওয়ার্ল্ড বুডিডস্ট কাউন্সিল প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং ইউরােপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জার্মান, ফ্রান্স, চীন, জাপান, ভারত প্রভৃতি দেশ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকে আহ্বান জানাতে থাকে।
১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে এরশাদ সরকারের পতন হয়। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। সমিতি সমস্যা সমাধানকল্পে আলােচনার অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য এক তরফা যুদ্ধ বিরতি ঘােষণা করে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বধীন জোট সরকার ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ বিরতি ঘােষণা দেয় ও আলােচনার জন্য জনাব অলি আহম্মদের আহ্বায়কত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি গঠন করে।
এ কমিটির সাথে সমিতির ৬ বার বৈঠক হয়। সেটেলার সমস্যা বাদে বৈঠকে বেশ কিছু বিষয়ে ঐক্যমত্য হয়। পরে জানা গেছে যে, স্বীয় দলের কতিপয় নেতার বিরােধিতার কারণে জনাব অলি আহমেদ আর এগােতে পারেননি।
তবে পরবতী সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নুতন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করা পর্যন্ত আলােচনার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার স্বার্থে সরকার জাতীয় সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পাটির সভাপতি এবং জাতীয় কমিটির অন্যতম সদস্য জনাব রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে একটি সাব-কমিটি গঠন করে। এ সাব-কমিটি সমিতির সাথে আরাে ৭ বার বৈঠক করে। এ সময়কালে উভয় পক্ষ যুদ্ধ বিরতির মেয়াদ বাড়াতে থাকে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের জন্য সমিতিকে এর মতামত জানায়। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে সমিতি আওয়ামী লীগকে সমর্থন জ্ঞাপণ করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহকে আহ্বায়ক করে।
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি গঠন করে। মােট ৭ বার আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য সর্বস্তরের জুম্ম জনগণ একান্ত উদগ্রীব ছিলেন।
চুক্তির প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সকলে স্বস্তি লাভ করেন। দেশে-বিদেশে এ চুক্তি সমাদৃত হয়। তবে সমিতির ছাত্রফ্রন্টের কিছু নেতা ও কর্মী অধিকারের অপর্যাপ্ততার অভিযােগে এ চুক্তিকে প্রত্যাখান করেন।
অপরদিকে, বাঙালী সেটেলারদেরকে দিয়ে সে সময়কার স্থানীয় সেনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত সংগঠন ‘সম অধিকার আন্দোলন’ আদিবাসী পাহাড়ীদেরকে বেশী অধিকার দেওয়া হয়েছে অভিযােগ তুলে এ চুক্তির বিরােধিতা করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, দীর্ঘ বছর যাবত সশস্ত্র সংগ্রামের অস্বাভাবিক জীবনের প্রেক্ষিতে সমিতির । সদস্য, তাদের পরিবারবর্গ, সাধারণ মানুষ সকলে কম-বেশী রণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। সরকার পক্ষও অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিল যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাকে সামরিক উপায়ে সমাধান করা সম্ভব নয়। বিশ্ব সম্প্রদায়ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানে ঐকান্তিকভাবে এগিয়ে আসে। তাই, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদন ছিল অপরিহার্য।
১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ১০,০০০ আদিবাসী পাহাড়ী উদ্বাস্তু শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেবার জন্য ভারতের মিজোরাম রাজ্যে প্রবেশ করে। মিজোরাম সরকার তাদেরকে পুশব্যাক করে।
বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বাংলাদেশ রাইফেলস-বিডিআর)-এর হাতে তাদেরকে তুলে দেয়। সে সময় অনেকে নানাভাবে নিগৃহীত হয়। পরে ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দ হতে ত্রিপুরা রাজ্যের শিলাছড়ি, করবুক, তাকুমবাড়ি, লেবাছড়া ও সাব্রুম নামক ৫টি জায়গার শরণার্থী শিবিরে সর্বসাকল্যে ৭৫,০০০ আদিবাসী আশ্রয় নেয়।
তাদের মধ্যে কিছু কিছু শরণার্থী সরকারের আহ্বানে চুপিসারে ফিরে আসে। অন্যান্য শরণার্থীগণ (সর্বমােট ১২ ২২২ টি পরিবারের ৬৫,৪৩৩ জন শরণার্থী) সরকারের সাথে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে স্বাক্ষরিত ১৬ দফা ও ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ দফা চুক্তির ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে আসে।
১৯৯৪-১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দফায় ১ ৭৯৭ টি শরণার্থী পরিবারের ৮,১৭৭ জন সদস্য যারা প্রত্যাবর্তন করে সরকার তাদের মধ্যেকার অধিকাংশকে আর্থিক সুবিধা ও জায়গা-জমি ফেরত দেয়। ১৯৯৭-১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় দফায় ১০.৪২৭ টি শরণার্থী পরিবারের মােট ৫৬, ২৫৬ জন জন শরণার্থী দেশে ফিরেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির প্রাক্কালে ও পরে আভ্যন্তরীণ পাহাড়ী উদ্বাস্তুদের মধ্যেকার অধিকাংশ পরিবার স্ব স্ব গ্রামে ও বসতবাটিতে ফিরে যান।
উক্ত চুক্তি সম্পাদিত না হলে ভীবা ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুরা পার্বত্য চট্টগ্রামে কিংবা নিজেদের গ্রামে বা বাড়ী-ঘরে হয়তাে ভাবছি ফিরতে পারতেন না। যারা নিজেদের গ্রামে বা বাড়ী-ঘরে ফিরতে পেরেছেন তারা। সকলে এখন নিজেদের জায়গা-জমি ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা শত প্রতিকূলতার আখ নানা ধরনের জীবন-জীবিকা গ্রহণ করে টিকে থাকার সংগ্রাম করে চলেছেন।
বলা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী-বাঙালী সকল অধিবাসীর অধিকার সনদ। শান্তি ও সম্প্রীতি নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল মানুষের বসবাস করবার অধিকারের মাপকাঠি।
বিশেষতঃ আদিবাসী পাহাড়ী জাতিসমূহের অস্তিত্ব সংরক্ষণের সংগ্রামের সফলতার এক অনন্য ফসল। এ চুক্তির সফল বাস্তবায়নের উপরই নির্ভর করছে তাদের অনাগত দিনের ভবিষ্যৎ।
স্মর্তব্য যে, মুখরােচক ও উত্তেজনাকর নানা কথা বলা কিংবা স্বপ্ন দেখা হয়তাে এখনাে সম্ভব; কিন্তু সার্বিক ক্ষেত্রের বাস্তবতায় সব স্বপ্ন এক্ষণে বাস্তবায়ন আদৌ অসম্ভব। তাই, বাস্তবসম্মত সঠিক মত ও পথ ধরে সঠিক কাজই করতে হবে।
এ বিষয়ে স্মতর্ব্য যে, চাকমা কথায় একটা প্রবাদ (ডাগ কধা) আছে। সেটা হল ‘যে বুঝে ন’ বজরে বুঝে আ যে ন বুঝে তে নব্বই বজরেয়্য ন বুঝে’ (অর্থাৎ যিনি বুঝেন তিনি নয় বছর বয়সে বুঝতে পারেন আর যিনি বুঝেন না তিনি নব্বই বছর বয়স হলেও তা বুঝতে পারেন না। অন্য একটি প্রবাদ হল ‘যে বুঝে তে ধাঙর’ (অর্থাৎ যিনি বােঝেন তিনিই বড়)। সুতরাং, আবেগের পরিবর্তে যুক্তি এবং কল্পনার পরিবর্তে বাস্তবতার আলােকে সব কিছুকে বিবেচনায় এনে আদিবাসী পাহাড়ীদেরকে ধৈৰ্য্য সহকারে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে- মূলতঃ জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে।
সাথে বিরােধিতা করতে হবে জাতীয় সংগ্রামের পরিপন্থী আত্মঘাতী অনৈক্য, বিভেদ ও সংঘাতকে অর্থাৎ প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ পঞ্চম বাহিনীর ভূমিকামূলক বা জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতামূলক কার্যকলাপকে। উক্ত ধরনের কার্যকলাপ দেশের বিশেষতঃ উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদী ও উগ্র ইসলামিক সম্প্রসারণবাদী শক্তির দ্বিতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম (সেটেলারদেরকে জায়গা-জমি দিয়ে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের কাজকে) নির্বিঘ্নে বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে সহায়ক হবে।
আর জুম্ম জাতির ইতিহাসে তা চরম বিশ্বাসঘাতকতার আরেকটি নজির হিসাবে পরিচিহ্নিত হয়ে থাকবে। তাই, আওয়াজ তুলতে হবে – ‘আর নয় গৃহযুদ্ধ’, ‘রক্ষা কর জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব’।
লেখক : শ্রী গৌতম কুমার চাকমা।
তথ্যসুত্র : তাক্রুপ্ : বৈসুক -সাংগ্রাই-বিঝু-বিষু-বিহু-সংকলন ২০১৩
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।