জলবায়ু সংকট সমাধানে আদিবাসীদের ভূমিকা অত্যাবশ্যক
1077
বলিভিয়া এবং পেরুর সীমান্তের ব্যাপ্তিকে পরিমাপ করলে আমরা মাদীদি-টেম্বোপাটার ( Madidi-Tambopata) বিস্তীর্ণ ভূদৃশ্যের পরিমাপ পাই, যেটি কিনা আমাজনের ঘন নিম্ন ভূমি থেকে ঊর্ধ্বাভিমুখী হয়ে প্রায় ৬০০০ মিটার উচ্চতার আন্দিজের শিখর পর্যন্ত উধীত হয়। গ্রহের আর অন্য কোনো সুরক্ষিত এলাকা এতো বিস্তীর্ণ নতিমাত্রায় বিস্তার করেনা।
এটা মোটেই আশ্চর্যজনক নয় যে এই উপবনটি পৃথিবীর অন্য যে কোনো সুরক্ষিত এলাকার চেয়ে অধিক সংখ্যক প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রানীকে গর্বের সঙ্গে ধারণ করে আসছে।
মূলত যেই কারণে এখানে এই অসাধারণ জীব বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়েছে তা হলো, পৃথিবীর শেষ শ্রেষ্ঠ অক্ষত বনগুলোর মধ্যে মাদীদি একটি। তবে তার সাথে তুলনা করলে সেখানকার অবস্থিত ৬টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী এলাকার অবস্থা সংকটপূর্ণ।
২০১৩ সালে আমি সেখানকার একজন আদিবাসী প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাত করি যিনি ছিলেন টাকানা জাতিগোষ্ঠীর একজন (The Tacana) এবং তারা ২০১৫ সালে জাতি সংঘের প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে বনভূমি রক্ষার্থে তাদের অঙ্গিকারনামার জন্য ইকুয়েটর পুরস্কার (the Equator Prize) লাভ করেন।
Nature এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, পৃথিবীর ভূমিস্থল এর অন্তত চার ভাগের এক ভাগের মালিক বা ব্যবহারকারি হলো বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী
সেই পুরো সপ্তাহটা জুড়ে টাকানাদের কথা আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো, যেহেতু সানফ্রান্সিসকোর The Global Climate Action Summit – এ আন্তর্জাতিক বহু নেতৃবৃন্দ মিলিত হোন জলবায়ু পরিবর্তনের গতি কমানোর জন্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে।
আমরা যদি বৈশ্বিক উষ্ণতাকে প্রশমিত করতে চাই এবং প্যারিস জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্য অনুযায়ী যদি বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি থেকে দুই ডিগ্রী সেলসিয়াস কমাতে চাই, তাহলে সেটার বাস্থবায়নের জন্য আমাদের অক্ষত বন এবং সেসব বনকে যেসব আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা ব্যবস্থাপনা করে তাদের সকলের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
যেখানে কিনা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বনাঞ্চলকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরী, সেখানে পৃথিবীতে অবশিষ্ট থাকা মোট বনাঞ্চলের শুধুমাত্র ২৪ শতাংশকে ধরা হয় যে মানুষের কবল থেকে অক্ষত।
বাকি অবস্থিত বনভূমিগুলো প্রতিনিয়ত ক্ষতি এবং ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছে। ২০০০ সাল থেকে ২০১৬ সালের ভিতরে পৃথিবী তার প্রায় ১০ শতাংশ রক্ষিত ভূমি হারিয়েছে। আজ ও এই ক্ষতি ক্রমবর্ধমান ।
এই হুমকি মোটেই অতিরঞ্জিত নয়। সুরক্ষিত বনভূমি প্রতি বছরে মনুষ্যসৃষ্ট কার্বনডাইঅক্সাইডের ২৫ শতাংশের বেশি অংশ শুষে নেওয়ার মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে কার্বন এর পরিমান ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়।
অক্ষত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনভূমিগুলো নদীর পরিষ্কার প্রবাহ নিশ্চিত করে এবং অন্য ক্ষয় হওয়া ভূমি থেকে বেশি বৃষ্টি উৎপাদন করে, যার কারণে খরা হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।
তবুও তারা যদি তাদের অত্যাবশ্যক এই ন্যস্ত দায়িত্বকে চালিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে রাষ্ট্রীয় সরকারের কাছ থেকে আদিবাসী মানুষদের স্বীকৃতি এবং তাঁদের নিজেদের ভূমি ও পানিকে পরিচালনা করার জন্যে তাঁদের যে বৈধ কর্তৃত্ব রয়েছে সেটার প্রতি সমর্থন দরকার।
জীব বৈচিত্র্য কে বজায় রাখার পাশাপাশি এইসব ভূদৃশ্য এই গ্রহের সবচেয়ে দরিদ্র্য এবং প্রান্তিক কিছু জনগোষ্ঠীর বাসস্থানও।
আদিবাসী মানুষরা তাঁদের সংস্কৃতি ও কল্যাণ বজায় রাখার জন্য বনসম্পদের উপর নির্ভর করে। এইসব ভূমির সাথে তাঁদের ভাগ্য এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে, সুস্থু বন্য ব্যবস্থা বজায় রাখার কাজে তাঁরাই আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ সহকর্মী।
Nature – এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, পৃথিবীর ভূমিস্থল এর অন্তত চার ভাগের এক ভাগের মালিক বা ব্যবহারকারি হলো বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী — ৮৭টি দেশে বা রাজনৈতিকভাবে পৃথক এলাকায় ছড়িয়ে থাকা এই এক ভাগ ভূপৃষ্ঠের পরিমাণ ১৪৬ লক্ষ বর্গমাইল।
জলবায়ুর বিতর্কের জন্য যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, এর মধ্যেই অবশিষ্ট অক্ষত বনভূমিসমূহের ৩৫% অংশ অবস্থিত।
এইসব বনভূমি যা আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের আবাস্থল – সেগুলো খনি, ইজারা, খামার, আবাদি জমি, তেলের খনি, সড়ক, বাঁধ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকল্প দ্বারা গ্রাসের কারণে সুরক্ষিত নয়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সর্বসাধারণের সাথে কোন ধরণের আলাপ আলোচনা কিংবা তাঁদের মতামত না নিয়ে এবং ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ ও তাঁর জন্যে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বিবেচনা না করেই এসব কাজ করা হয় ।
এই ধরণের অপরিনামদর্শী কাজ স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোকে বিপন্ন করছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য আমাদের যে প্রচেষ্টা তাঁতে বাধা তৈরি করছে।
আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীরা যে সফলভাবে অক্ষত বনভূমির বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করতে সক্ষম তার পক্ষে অনেক প্রমাণ আছে।
২০১৭ সালের এক গবেষণায় পাওয়া যায় যে আমাজনের বন নিধনের হার বাইরের অন্যান্য অঞ্চলগুলো থেকে আদিবাসীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এবং সংরক্ষিত অংশগুলোতে পাঁচ গুন কম।
আমরা যদি বৈশ্বিক উষ্ণতাকে প্রশমিত করতে চাই, তাহলে সেটার বাস্থবায়নে আমাদের অক্ষত বন এবং সেসব বনকে যেসব আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা ব্যবস্থাপনা করে তাঁদের সকলের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
তবুও তাঁরা যদি তাঁদের অত্যাবশ্যক এই ন্যস্ত দায়িত্বকে চালিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে জাতীয় সরকারদের থেকে আদিবাসী মানুষদের স্বীকৃতি এবং তাঁদের নিজেদের ভূমি ও পানিকে পরিচালনা করার জন্যে তাঁদের যে বৈধ কর্তৃত্ব রয়েছে সেটার প্রতি সমর্থন দরকার।
এখনও পর্যন্ত প্যারিস চুক্তি ১৩১ টি গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মধ্যে শুধুমাত্র ২১ টি দেশ তাদের আদিবাসীদের এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের ভূমির অধিকারগুলোকে সম্প্রসারণ করার আশ্বাস দিয়েছে।
আমরা যদি জলবায়ু পরিবর্তনের দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাওয়া গতিকে পিছিয়ে নিতে চাই, তাহলে আমাদেরকে এই নজিরকে সাদরে গ্রহণ করে নিতে হবে যে বৈশ্বিক উষ্ণতাকে নিরাপদ সীমার মধ্যে রাখার আমাদের যে সক্ষমতা,
সেটি সরাসরি জড়িত রয়েছে আমরা কিভাবে বিশ্বজুড়ে থাকা আদিবাসীদের ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করতে পারি, যাতে করে তাঁরা তাঁদের নিজেদের ভূমির উপরে তাঁদের যে অধিকার সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এবং তাঁদের পরিবেশগত জ্ঞানের প্রয়োগ করতে পারে।
অনুবাদকারীঃ প্রিয়াসী চাকমা
মূল লেখকঃ ক্রিশ্চীয়ান স্যাম্পার, WCS (ওয়াইল্ডলাইফ কনজার্ভেশন সোসাইটি) – এর সভাপতি এবং সিইও(CEO) ।
উৎসঃ https://blogs.scientificamerican.com/observations/indigenous-peoples-are-vital-to-curtailing-the-climate-crisis/?amp
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।