জাতিরাষ্ট্রে জাতিগত সমস্যা ও এর সমাধান : বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
830
পুঁজিবাদী বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জাতিরাষ্ট্রে অন্যতম একটি জাতীয় ও রাজনৈতিক সমস্যা হলো জাতিগত সমস্যা। ‘এক জাতি এক রাষ্ট্র’- এই তত্ত্বের ভিত্তিতে পূজিবাদী বিশ্বে জাতিরাষ্ট্র গঠিত হলেও এমনটি দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ছােট হােক বড় হােক প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রে একাধিক জাতির বা বিভিন্ন জাতির বসবাস রয়েছে। আর জাতিরাষ্ট্রের অন্তর্নিহিত দর্শন ও ৪ অবস্থানের কারণে মূল জনগােষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র জাতিসত্তার অধিকারী এসব ভিন্ন ভিন্ন জাতিসমূহের বিষয়ে প্রায় প্রতিটি জাতিরাষ্ট্রে বরাবরই কোন না কোন সংকট তৈরী হয়ে থাকে।
বিশেষ করে এসব ভিন্ন ভিন্ন জাতিসমূহের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারসহ তাদের জাতিগত স্বীকৃতির ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় এক জটিল রাজনৈতিক ও জাতিগত সমস্যা।
তবে গণতান্ত্রিক ধারায় তুলনামূলকভাবে অগ্রসর কিছু কিছু রাষ্ট্রে এসব জাতিগত সমস্যাকে অত্যন্ত প্রশংসীয়ভাবে রাজনৈতিক উপায়ে সমাধান করতে দেখা যায় এবং চড়তে সমাধান না হলেও জাতিগত সমস্যাকে ন্যুনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে দেখা যায়।
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলাের দিকে যদি তাকাই, তাহলে এরূপ জাতিগত সমস্যা চোখে পড়ে। এর মধ্যে প্রতিবেশী মিয়ানমারে অন্যান্য সমস্যার মধ্যে অন্যতম একটি সমস্যা হলো জাতিগত সমস্যা।
মিয়ানমারে চিন, কারেন, কোচিন, মন, রাখাইন ইত্যাদি জাতিসমূহ এখনাে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশী নেপালের প্রায় ৫০টির মতাে আদিবাসী জাতিসমূহের সমস্যার প্রতি বর্তমান অন্তর্বর্তী নেপাল সরকার বেশ গুরুত্বের সাথে নজর দিয়েছে যদিও এক্ষেত্রে নেপালের রাজনৈতিক দলগুলাের এখনাে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
প্রতিবেশী ভারতে ভাষা-ভিত্তিক রাজ্য গঠনের মাধ্যমে জাতিগত সমস্যার সমাধান এবং সংবিধানের ৫ম ও ৬ষ্ঠ তফসিলের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রান্তিক আদিবাসী জাতিসমূহের জন্য স্বশাসিত জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ গঠন এবং লােকসভা, বিধান সভা ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় আসন সংরক্ষণের মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতে এখনাে জাতিগত সমস্যা সম্পূর্ণভাবে সমাধান হয়েছে তা বলা যায় না। এখনাে সেখানে জাতিগত সমস্যাকে একটি অন্যতম সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। পশ্চিমা বিশ্বের জাতিরাষ্ট্রের ভাবাদর্শ নিয়ে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে। তারই আলােকে বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে যে- “ভাষা ও সংস্কৃতিগতভাবে একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।” কিন্তু বাঙালি জাতি ছাড়াও এদেশে ৫৪টির অধিক আদিবাসী জাতি রয়েছে যারা বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্র গঠনের পূর্ব থেকে এদেশে বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছে।
ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাঙালি জাতির সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং আত্মবলিদানে সামিল হয়েছে।
কিন্তু এসব প্রান্তিক আদিবাসী জাতিসমূহের অস্তিত্ব ও অধিকারের সমস্যা সমাধান হয়নি। এখনাে এসব জাতিসমূহের জাতিসত্তা, ভাষা, সংস্কৃতি ও অস্তিত্বের স্বীকৃতি অর্জিত হয়নি এবং তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকার ভূলুণ্ঠিত অবস্থায় রয়েছে।
জাতিগত সমস্যার স্বরূপ
সমাজ বিকাশের ঐতিহাসিক ধারায় পৃথিবীর সকল জাতির বিকাশ সমান নয়। নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ভৌগােলিক কারণে তাদের বিকাশের মাত্রা অসম।
কোন কোন জাতি সমাজবিকাশের অনেক উন্নত স্তরে পৌছে গেছে। আর অনেক জাতি এখনাে বিকাশের নিম্ন স্তরে অবস্থান করছে। পশ্চিম ইউরােপের অনেক জাতি যেমন- ব্রিটিশ, ফরাসী, জার্মান, ইটালিয়ান ও অন্যান্য জাতিগুলাে অনেক এগিয়ে গেছে।
আবার পূর্ব ইউরােপের জাতিগুলাে যেমন- চেক, ক্রোয়াট, আর্মেনীয় ইত্যাদি জাতিগুলাে তুলনামূলকভাবে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। তার থেকে আরাে বেশি পিছিয়ে রয়েছে এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাতিন আমেরিকাসহ তৃতীয় বিশ্বের জাতিসমূহ। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলাের মধ্যে আবার রয়েছে মূলধারার বৃহত্তর জাতিসমূহ ও প্রান্তিক ধারায়। আদিবাসী সংখ্যাল্প জাতিসমূহের মধ্যকার বিকাশের তারতম্য। তাই বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বে বসবাসরত প্রান্তিকধারায় আদিবাসী জাতিসমূহের উপর জাতিগত শােষণ-নিপীড়নের মাত্রা সবচেয়ে প্রকট আকারে দেখা যায়। স্বাভাবিকভাবে এসব রাষ্ট্রে জাতিগত সমস্যাও তুঙ্গে।
গণতন্ত্রের উপরই জাতিগত সমস্যার তারতম্য নির্ভর করে। যে দেশে গণতন্ত্র নেই বা কম সে দেশে জাতিগত সমস্যা সবচেয়ে প্রকট ও নৃশংস। আর যে দেশে গণতন্ত্রের মাত্রা বেশি বা গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে সে দেশে জাতিগত সমস্যা কিছুটা কম বা ন্যুনতম পর্যায়ে নিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
বিশ্বের যেসব দেশ সবেমাত্র সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ভেঙ্গে পুঁজিবাদী সমাজে প্রবেশ করছে কিন্তু এখনাে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ধারা বিদ্যমান রয়েছে সেসব দেশে জাতিগত সমস্যা প্রবল আকারে বিরাজ করছে।
সামন্ততন্ত্র বরাবরই জাতি নিপীড়নের পক্ষে থাকে। প্রচলিত গণতন্ত্রের ধারায় যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আধা-সামন্ত ও আধা-পুঁজিবাদী শাসকগােষ্ঠীর হাতে থাকে তারা তাদের শ্রেণীগত স্বার্থে প্রবল অত্যাচারী হয়ে উঠে এবং পদার্নত জাতিসমূহের উপর নৃশংস শােষণ-নিপীড়ন চালায়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলােতে জাতিগত সমস্যার রূপ অনেকটা এই ধারাতেই বিদ্যমান থাকতে দেখা যায়।
সামন্ত সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজ অনেক প্রগতিশীল হলেও এবং অধিকতর মাত্রায় গণতান্ত্রিক অধিকার ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকলেও পুঁজিবাদী শাসকগােষ্ঠীও জাতিগত নিপীড়নের পক্ষে থাকে। উপনিবেশিক কায়দায় তারাও সাধারণ জনগণ ও প্রান্তিক আদিবাসী জাতিগুলােকে দাসত্বে আবদ্ধ রাখে এবং তাদের উপর শােষণ-নিপীড়ন চালায়।
এই শােষণ-নিপীড়নের সাথে যুক্ত হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণী (পেটি-বুর্জোয়ারা) ও বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ। এমনকি মেহনতি শ্রেণীর উপরতলায় একটি সংখ্যালঘু অংশও তার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। যারা সরাই লুন্ঠনের ফল উপভোগ করে।
সুতরাং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তির একটি সামগ্রিক ধারায় জাতিগত নিপীড়ন অব্যাহত থাকে যার নেতৃত্বে থাকে ধনিক শ্রেণী। পূঁজিবাদী সমাজে প্রজাতান্ত্রিক কাঠামাে ও শাসনব্যবস্থার মধ্যেই জাতিগত সমস্যার কিছুটা সমাধান করতে দেখা যায়।
তাই পূজিঁবাদী সমাজে প্রজাতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থায় যে মাত্রায় গণতন্ত্র সুসংহত রূপ লাভ করে সেই মাত্রায় রাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রান্তিক আদিবাসী জাতিসহ সকল সমমর্যাদা ও সমঅধিকার লাভ করে থাকে। তাই গণতন্ত্র বিকাশের উপরই নির্ভর করে জাতি সমাধানের মাত্রা।
বাংলাদেশে এই শাসকশ্রেণীর মধ্যে রয়েছে মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া, আমলা পুঁজিপতি ও সাম্প্রদায়িক ধারক-বাহক মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একটি অংশ। বাংলাদেশ সামন্তবাদী সামাজিক স্তর অতিক্রম করে সবে ধীরে ধীরে পুঁজিবাদী সামাজিক স্তরে পদার্পন করছে।
তবে সমাজের রন্দ্রে এখনাে সামন্তবাদী চিন্তধারা ব্যাপকভাবে পরিব্যাপ্ত রয়েছে। সামন্তবাদী চিন্তাধারার অগণতান্ত্রিকতা, আত্মমুখীনতা, পরনির্ভরশীলতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, শ্রমবিমুখতা, প্রগতিবিরােই মানসিকতা ইত্যাদি এদেশের শাসকগােষ্ঠীর মধ্যে চরমভাবে বিরাজ করছে।
বাংলাদেশের সবে গড়ে উঠা পুঁজিপতিদের মধ্যে কিছু পুঁজি গঠিত হলেও তা মূলতঃ মুৎসুদ্দী পুঁজি ও আমলা পজির সমষ্টি। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলাে কালাে টাকা সাদা করার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠাপােষকতা। স্বভাবতই বাংলাদেশে এখনাে সেভাবে জাতীয় বুর্জোয়ার বিকাশ লাভ ঘটেনি।
জাতীয় পুঁজিও সেভাবে মজবুত অবস্থানে গড়ে উঠতে পারেনি। মুৎসুদ্দী পুঁজি ও আমলা পুঁজিই হচ্ছে দেশীয় পুঁজিপতিদের একমাত্র মূলধন। এককথায় বলা যায় যে, বাংলাদেশের পুঁজিপতিরা হচ্ছে মুৎসুদ্দী বুর্জোয়া; যাদের মূল ভিত্তিই হলাে সাম্রাজ্যবাদের দালালীপনা ও তাদের কিছু উচ্ছিষ্ট লাভ করা।
শ্রেণীগত অবস্থানের কারণে মুৎসুদ্দী বুর্জোয়াদের মধ্যে জাতীয় চরিত্র গড়ে উঠতে পারে না। প্রয়ােজনে দেশের স্বার্থকে বিকিয়ে দিয়ে তারা সাম্রাজ্যবাদের দালালীপনা করে থাকে। তাই বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে তাদের নতজানু নীতি আমরা লক্ষ্য করে থাকি।
এদেশের পুঁজিপতিরা নিজেদের মধ্যে মূলতঃ সাম্রাজ্যবাদের তাবেদারগিরি লাভের প্রতিযােগিতা করে টিকে থাকে। সাম্রাজ্যবাদী উচ্ছিষ্ট্যের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে তাদের মধ্যে মাঝে মধ্যে প্রবল সংকট তৈরি হয় এবং এদেশের জনগণ এক অরাজক পরিস্থিতির মুখােমুখী হতে বাধ্য হয়।
যে কোন জাতিরাষ্ট্রে মুৎসুদ্দী চরিত্রের শাসকগােষ্ঠী যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে স্বাভাবিকভাবে সে দেশে গণতন্ত্র তত বিকাশ লাভ করতে পারে না। গণতন্ত্র থাকে অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায়। তাই বাংলাদেশের গণতন্ত্রও এখনাে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগােনাের পর্যায়ে রয়েছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তে শাসকগােষ্ঠীর মধ্যে সামন্ত চিন্তাধারা পরিব্যাপ্ত থাকায় অগণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবলভাবে লক্ষ্য করা যায়।
এদেশের শাসকগােষ্ঠী তাদের শ্রেণীগত অবস্থানের কারণে এদেশের মূল জনগােষ্ঠীর সাধারণ মানুষকে যেমন শােষণ-নিপীড়ন করে, তেমনি ততধিক পরিমাণে এদেশের প্রান্তিক আদিবাসী জাতিসমূহকে নানা বঞ্চনা ও বৈষম্যের মধ্যে নিক্ষেপ করে থাকে।
এদেশে শাসকগােষ্ঠী কর্তৃক আদিবাসী জাতিসমূহের উপর জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক দলন-পীড়ন চালানাের যে প্রক্রিয়া দেখতে পায় তা হচ্ছে অগণতান্ত্রিকতার প্রত্যক্ষ ফসল।
ফলতঃ এদেশে জাতিগত সমস্যা এক প্রকট অবস্থায় বিরাজ করছে এবং প্রান্তিক আদিবাসী জাতিসমূহের জাতীয় অস্তিত্ব ও আবাসভূমির অস্তিত্ব এক বিপন্ন ও সংকটজনক অবস্থায় বিরাজ করছে।
দেশের বিদ্যমান জাতিগত সমস্যা নিরসনের ক্ষেত্রে দুটো দিক রয়েছে; একটি হচ্ছে দেশের বর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন আর অন্যদিকে হচ্ছে প্রান্তিক আদিবাসী জাতিসমূহের জাতীয় অস্তিত ও আবাসভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের সংগ্রাম।
জাতীয় আন্দোলনের এই দুটো ধারার মধ্যে একটা থেকে আরেকটিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কোন সুযােগ নেই। বরঞ্চ একটা আরেকটির সাথে ওতপ্রােতভাবে জড়িত। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটি এগিয়ে যেতে পারে না।
জাতীয় আন্দোলনের এই দুটো ধারাকে সমানতালে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণসহ প্রান্তিক আদিবাসী জাতিসমূহের জাতীয় অস্তিত্ব ও আবাসভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের সংগ্রাম একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় এগিয়ে চললেও জাতীয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবস্থা তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। এদেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল শক্তি অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় বিরাজ করছে।
জাতিগত সমস্যার উত্তরণ
পূর্বেই আলােচনা করা হয়েছে যে, পুঁজিবাদী সমাজের জাতিরাষ্ট্রে প্রজাতান্ত্রিক কাঠামাে ও শাসনব্যবস্থার মধ্যেই জাতিগত সমস্যার কিছুটা সমাধান করতে দেখা যায়। তারই আলােকে এদেশে আদিবাসী জুম্ম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে বিশেষ শাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতির দাবী উঠেছে বা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের বিধান করা হয়েছে।
অপরদিকে সমতল অঞ্চলের আদিবাসী জাতিসমূহের জন্য প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি, জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় আসন সংরক্ষণ করা, ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও প্রসারের দাবী উঠে এসেছে।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, স্বাধীনভাবে নিজের ভাগ্য স্থির করার অধিকার প্রত্যেক জাতির আছে। নিজের মনের মতাে করে নিজের জীবন রচনা অধিকার প্রত্যেক জাতির রয়েছে।
সেই অধিকার অন্য জাতির অধিকার পদদলিত করে নয়। স্বশাসনের ধারায় জাতীয় জীবন রচনা করার অধিকার প্রত্যেক জাতির আছে। তাই জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক চুক্তিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইনে “প্রত্যেক জাতিগােষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার বলে তারা অবাধে তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা নির্ধারণ করে এবং অবাধে জাত অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রাখে” বলে ব্যক্ত করা হয়েছে।
প্রজাতান্ত্রিক কাঠামাে ও শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে জাতিগত সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রধানতঃ যে গঠনমূলক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় তা মূলতঃ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের মূল চেতনাকে ভিত্তি করে।
বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে জাতি-সমস্যা সমাধানে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে একটি মূল উপাদান হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে অঞ্চলগত (রিওজিনাল) স্বশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে জাতি-সমস্যা সমাধান করা হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যেসব জাতিসমূহের অঞ্চল-ভিত্তিক একক কেন্দ্রীভূত (concentration) সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই সেসব জাতিসমূহের বেলায় কি হবে? এক্ষেত্রে অনেকে সংস্কৃতিগত জাতীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার সুপারিশ করেছেন। তবে সংস্কৃতিগত জাতীয় স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট মতভেদ ও বিতর্ক রয়েছে।
(ক) অঞ্চলগত (রিওজিনাল) স্বশাসন ব্যবস্থা
আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার বিষয়টি অত্যন্ত ব্যাপক একটি বিষয়। এই অধিকার ন্যূনতম স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার অধিকার পর্যন্ত অধিক্ষেত্রকে বুঝায়। কিন্তু পুঁজিবাদী জাতিরাষ্ট্রে স্বাধীন হওয়ার অধিকারকে স্বীকার করা হয় না।
জাতিরাষ্ট্রের জাতি-সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রজাতান্ত্রিক কাঠামাে ও শাসনব্যবস্থার মধ্যে বড়জোর ভূখন্ডগত স্বায়ত্তশাসন বা স্বশাসনকে স্বীকার করে নেয়া হয়। বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের যে বিধান করা হয়েছে তা অঞ্চলগত স্বশাসন ব্যবস্থার একটি ব্যবস্থা হিসেবে বলা যেতে পারে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থায় এসব পরিষদকে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, জেলা পুলিশ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা, রক্ষিত নয় এমন বন ও পরিবেশ, যুব উন্নয়ন, কৃষি, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, আইন প্রণয়নে বিশেষ প্রাধিকারসহ মােট ৩৩টি বিষয় হস্তান্তরের বিধান রয়েছে।
এক্ষেত্রে আরাে গুরুত্বপূর্ণ যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে পাহাড়ী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে ঘােষণা করা হয়েছে এবং এই বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রাখার বিধান করা হয়েছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে আত্মপরিচয়ের অধিকার যথাযথভাবে স্বীকৃত হয়নি।
বস্তুতঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা এখনাে কার্যকরভাবে প্রবর্তিত হতে পারেনি।
এখনাে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলােকে চুক্তি মােতাবেক ক্ষমতায়নের পরিবর্তে অথর্ব অবস্থায় রাখা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলােকে পরিণত করা হয়েছে দুর্নীতির আখড়ায়। সেটেলার বাঙালি কর্তৃক বেদখলকৃত ভূমি স্ব স্ব জুম্ম মালিকদের নিকট ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ভূমি কমিশন গঠনের মাধ্যমে ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তির বিধান এখনাে বাস্তবায়িত হয়নি।
ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০০১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরােধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে বিরােধাত্মকভাবে প্রণীত হয়। এখনাে সেই বিরােধাত্মক ধারাসমূহ সংশােধিত হয়নি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের বিধানটি লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতি পদে পদে। অব্যাহতভাবে সমতল অঞ্চল থেকে বহিরাগতরা পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকছে ও বসতি গড়ে তুলছে। তারা পাহাড়ী-বাঙালী স্থায়ী অধিবাসীদের জায়গা-জমি জবরদখল করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনসারে আভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু পাহাড়ীদের পুনর্বাসনের বিধান এখনাে বাস্তবায়িত হয়নি। জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্সকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বাের্ড এর কোটি কোটি টাকা ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মােতাবেক স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভােটার তালিকা প্রণীত হয়নি এবং চুক্তির পর আজ অবধি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। উপরন্তু ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক একপ্রকার সেনাশাসনসহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়নি।
মহাজোট সরকার গত ৩০ জুন ২০১১ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশােধনী জাতীয় সংসদে পাশ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিসহ আপামর পার্বত্যবাসী ও দেশের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক নাগরিক সমাজের দাবী ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলােকে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনগুলাের আইনী হেফাজত প্রদানের লক্ষ্যে সংবিধানের প্রথম তফসিলে ‘কার্যকর আইন’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা।
বলাবাহুল্য, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে চুক্তির সাংবিধানিক গ্যারান্টি প্রদানের দাবী করা হয়েছিল। তখন সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগ সরকারের জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশােধনের মতাে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই।
তাই তাদের পক্ষে সাংবিধানিক গ্যারান্টি বা স্বীকৃতি প্রদান করা সম্ভব হবে না। তবে ভবিষ্যতে সংবিধান সংশােধনের মতাে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তারা তা প্রদান করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সংবিধানের পঞ্চদশ সংশােধনীকালে তার ধারেকাছেই যায়নি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার ফলে ও সাংবিধানিক গ্যারান্টি প্রদান না করার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনাে অঞ্চলগত স্বশাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি; যে কারণে এ অঞ্চলে জাতিগত সমস্যা একটি প্রকট আকার ধারণ করে রয়েছে।
(খ) সংস্কৃতিগত জাতীয় স্বায়ত্তশাসন
পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতিত অপরাপর সমতল জেলাগুলােতে প্রায় ৪০টির অধিক প্রান্তিক আদিবাসা জাতি রয়েছে যারা বিভিন্ন জেলাগুলােতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। জনসংখ্যার দিকে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনসংখ্যা থেকে তারা অনেক বেশি। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের মতাে তাদের অঞ্চল-ভিত্তিক একক কেন্দ্রীভূত সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই বললেই চলে। এ ধরনের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সংখ্যাল্প জাতিসমূহের জন্য অঞ্চল-ভিত্তিক স্বশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে এ ধরনের জাতিসমূহের সমস্যা সমাধানের জন্য সংস্কৃতিগত জাতীয় স্বায়ত্তশাসনের সুপারিশ করা হয়েছে।
এখানে সংস্কৃতি বললেই কেবল ভাষা, পােষাক-পরিচ্ছদ, ধর্ম, ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, গান-বাজনাকেই বুঝলে হবে না। সংস্কৃতি একটি ব্যাপক শব্দ। সংস্কৃতি হলাে মানুষের সমস্ত কর্মকান্ড- অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, ধর্মীয়, সমষ্টিগত, পারিবারিক, ব্যক্তিগত কর্মকান্ড ইত্যাদি। এ সকল কর্মকান্ডের মধ্যেই একটি জাতির সংস্কৃতি নিহিত থাকে। এককথায় বলা যায়, গােটা জীবনপ্রণালীই হলাে সংস্কৃতি।
সুতরাং সংস্কৃতিগত স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে কেবল ভাষা, পােষাক-পরিচ্ছদ, ধর্ম, ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, গান-বাজনা সংরক্ষণের স্বাধীনতাকেই বুঝলে ভুল হবে। সংস্কৃতিগত স্বায়ত্তশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, ধর্মীয়, সমষ্টিগত, পারিবারিক, ব্যক্তিগত অধিকারের স্বাধীনতাকে অবশ্যই বুঝতে হবে।
বিশ্বের দেশে দেশে প্রান্তিক আদিবাসী জাতির সংস্কৃতির অধিকার তাদের আত্মপরিচয়ের অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং সর্বোপরি তাদের ভূমি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। আদিবাসী জাতিসমূহের সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের ভূমি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সুরক্ষা প্রয়ােজন।
তাদের ভূমি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ যদি না থাকে, তারা যদি তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে পড়ে, তারা ভূমিহীন জাতিতে পরিণত হয়, তাহলে তাদের সংস্কৃতির অস্তিত্বই থাকবে না। একটা জাতির তার স্বতন্ত্র জাতীয় অস্তিত্ব ও পরিচয়ের মূল ভিত্তি হলাে সংস্কৃতি।
তার সংস্কৃতি যদি নাই থাকে এবং সংস্কৃতির মৌলভিত্তি উৎপাদন প্রণালী’ বা উৎপাদন ব্যবস্থা যদি তারা হারিয়ে ফেলে তাহলে তাদের স্বতন্ত্র জাতীয় অস্তিত্বের প্রশ্নই আসে না। আর এখানে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের অর্থ হচ্ছে নিজের ভাগ্য নিজেরাই নির্ধারণ করার অধিকার। তারা তাদের উন্নয়নের অধিকার প্রয়ােগ করার জন্য অগ্রাধিকার তালিকা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ, গ্রহণ ও বাস্তবায়নের অধিকার, নিজেদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করার অধিকারের স্বাধীনতাকে বুঝতে হবে।
তাই প্রান্তিক আদিবাসী জাতিসমূহের জন্য সংস্কৃতিগত স্বায়ত্তশাসনকে দেখতে হবে তাদের প্রথাগত ভূমি অধিকার, তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার, তাদের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত পূর্বক সম্মতি ব্যতীত ছিনিয়ে নেয়া ভূমি, ভুখন্ড ও সম্পদের পুনরুদ্ধার ও ফেরত পাওয়ার অধিকার, তাদের মাতৃভাষার অধিকার, রাষ্ট্র ভাষার পাশাপাশি মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের অধিকার, নিজস্ব ভাষায় নিজস্ব সংবাদ মাধ্যম প্রতিষ্ঠার অধিকার, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রথা চর্চা ও পুনরুজ্জীবিতকরণের অধিকার, উন্নয়নের অধিকার প্রয়ােগ করার জন্য অগ্রাধিকার তালিকা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ, গ্রহণ ও বাস্তবায়নের অধিকার, নিজেদের নৃতাত্তিক পরিচয়, উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করার অধিকারের স্বাধীনতার সাথে।
উপরােক্ত সংস্কৃতিগত স্বায়ত্তশাসনের আলােকে এদেশে আদিবাসী জাতিসমূহের জন্য নিম্নলিখিত দাবী উত্থাপিত হয়ে আসছে-
(১) সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে ৪৬টির অধিক আদিবাসী জাতিসমূহের জাতিসত্তা, ভাষা ও সংস্কৃতির সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা।
(২) আদিবাসী জাতিসমূহের ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারসহ ভূমি, ভূখন্ড ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর আদিবাসী জাতিসমূহের অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা।
(৩) বেহাত হওয়া আদিবাসীদের জায়গা-জমি পুনরুদ্ধারের জন্য ভূমি কমিশন গঠন করা।
(৪) দেশের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলােতে আদিবাসী জাতিসমূহের জন্য জাতীয় সংসদের আসন ও স্থানীয় সরকার পরিষদে আসন সংরক্ষণ করা।
(৫) আদিবাসী অধিকার আইন প্রণয়ন করা এবং আদিবাসী অধিকার বিষয়ক কমিশন গঠন করা।
(৬) আদিবাসী জাতিসমূহের সাংবিধানিক ও আইনী রক্ষাকবচ যাতে আদিবাসী জাতিসমূহের সম্মতি ছাড়া সংশােধন বা বাতিল করা না হয় তার গ্যারান্টি প্রদান করা।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশােধনীর মাধ্যমে একদিকে আদিবাসীদের ‘আদিবাস ‘ হিসেবে জাতিগত পরিচিতির স্বীকৃতি লাভের প্রাণের দাবীকে উপেক্ষা করে এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রত্যেক জাতির আত্মপরিচয়ের সহজাত অধিকারকে খর্ব করে সংবিধানে আদিবাসীদের “উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগােষ্ঠী ও সম্প্রদায়” হিসেবে অসম্মানজনক ও বিভ্রান্তিকর পরিচয়ে আখ্যায়িত করা হয়েছে; অন্যদিকে আদিবাসী ও বৃহত্তর মূলজনগােষ্ঠী নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণকে জাতি হিসেবে বাঙালি পরিচিতি প্রদান করার মাধ্যমে ভিন্ন ভাষাভাষি ও ভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারী আদিবাসী জাতিসমূহকেও বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
সর্বোপরি ৪০ বছর পর (১৯৭২ সালের পর) ২০১০ সালে সংবিধান সংশােধনের সময়েও সংবিধানে আদিবাসীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি সংক্রান্ত মৌলিক অধিকারগুলো সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয়েছে।
বলাবাহুল্য বাংলাদেশ একটি বহু জাতির, বহু ভাষার, বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। এ দেশে বৃহত্তর বাঙালি জাতি ছাড়াও আদিবাসীরা স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করে আসছে। এসব জাতিসমূহ যুগ যুগ ধরে নিজস্ব সমৃদ্ধ সমাজ, সংস্কৃতি, রীতিনীতি, ধর্ম-ভাষা ও স্বতন্ত্র নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি নিয়ে এ অঞ্চলে বসবাস করে আসছে।
তাদের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস, সামাজিক রীতিনীতি, ভৌগােলিক পরিবেশ, দৈহিক-মানসিক গঠন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনযাত্রা ইত্যাদি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগােষ্ঠী থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আদিবাসী জাতিসমূহকে সংবিধানে “বাঙালী” হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আদিবাসীরা নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশী, কিন্তু জাতি হিসেবে বাঙালি নয়। তারা জাতি হিসেবে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারাে, খাসি, সাঁওতাল, মুন্ডা, মাহাতাে, হাজং ইত্যাদি অর্ধ শতাধিক এক একটি স্বতন্ত্র জাতি।
দেশের দরিদ্র, বঞ্চিত ও প্রান্তিক আদিবাসী জাতিসমূহের উন্নয়নের জন্য সরকারের কোনো উন্নয়ন নীতিমালা নেই। আদিবাসীদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে সকল উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়, তা অনেকটা উপর থেকে আদিবাসীদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। এসব উন্নয়ন পরিকল প্রণয়ন, গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আদিবাসীদের সিদ্ধান্ত-নির্ধারণী কোনাে ভূমিকা নেই।
তাই এ উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে আদিবাসীদের সামগ্রিক উন্নয়ন তাে দূরের কথা, এতে আদিবাসী জীবনধারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের সংস্কৃতি, জাতিগত অস্তিত্ব এবং ভূমি ও সম্পদের উপর তাদের মালিকানা স্বত্বকে বিপন্ন করে তােলে চরমভাবে।
কাপ্তাই বাঁধ, ফুলবাড়ী কয়লা খনি, মধুপুরে বনায়ন, ইকো-পার্ক ও জাতীয় উদ্যান ঘােষণা ইত্যাদি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অনুরূপভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন বিশেষ কার্যাদি বিভাগ কর্তৃক দেশের সমতল অঞ্চলের আদিবাসী জনগােষ্ঠীর উন্নয়ন কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের কোন সিদ্ধান্ত নির্ধারণী ভূমিকা নেই।
এই থােক বরাদ্দের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ নেই ফলে এই বরাদ্দ আদিবাসীদের মধ্যে নতুন সমস্যা তৈরি করছে, যা তাদের ঐতিহ্যবাহী ঐক্য ও সংহতিকে ব্যাহত করছে। এভাবে দেশের সমতল অঞ্চলেও জাতি-সমস্যা এক উদ্বেগজনক অবস্থায় বিরাজ করছে।
দেশের বিদ্যমান জাতি-সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এদেশের শাসকগােষ্ঠীকে অবশ্যই উদার গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা নিয়ে রাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক কাঠামাে ও শাসনব্যবস্থার মধ্যেই সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।
তার পাশাপাশি আদিবাসী জনগণসহ দেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন আর প্রান্তিক আদিবাসী জাতিসমূহের জাতীয় অস্তিত্ব ও আবাসভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণের সংগ্রাম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমানতালে এগিয়ে নিতে হবে।
লেখক: মঙ্গল কুমার চাকমা।
তথ্যসুত্র : তাক্রুপ্ : বৈসুক -সাংগ্রাই-বিঝু-বিষু-বিহু-সংকলন ২০১৩
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।