ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবারের সাথে বিগত একটি বছর
1469
স্কুল-কলেজের ছোট্ট গন্ডি পেরিয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগটা নেহায়েৎ ছোট করে দেখার কিছু নেই। সেটা অবশ্যই বিরাট সৌভাগ্যের সাথে জীবনের চলমান গতিকে নতুনত্ব দেওয়ার এক বিশাল প্রাপ্তি বলে মনে করি। সেটা নিশ্চয় ২০১৭’র হাত ধরে পাওয়া। উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ স্থানে পড়ালেখার সুযোগটা কেবল আনুষ্ঠানিক পড়ালেখা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো সংবলিত একটি সার্টিফিকেট অর্জনকে নির্দেশ করছে না সেটা যতই দিন যাচ্ছে ততই অনুধাবন করতে পারছি। দিন পেরোনোর সাথে সাথে দায়বোধের মাত্রাগত পরিবর্তন যেমন এসেছে সেই সাথে আগামীর চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাগুলোকে সামনে নিয়ে এগোনোর অনানুষ্ঠানিক শপথের মূল্যবোধ ততই সমৃদ্ধ হচ্ছে।
সে দায়বোধ ব্যাক্তি থেকে পরিবার তথা সমাজের গন্ডি ছাড়িয়ে ‘স্বকীয় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ জাতি’ তথা দেশকেও ধারণ করার নির্যাস পাচ্ছে। আগামীর জীবনকে সাজানোর ছোট্ট স্বপ্নটিকে পাল্টিয়ে বৃহৎ পরিসরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রটাও নিশ্চয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সাথে নতুন যুক্ত হওয়া।
স্বপ্নটি বলবো!! নিশ্চয়।
মোটাদাগে বলতে পারি দেশের অন্য অধিকাংশের মত আমারও কেবল স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হয়ে সরকারী প্রোটোকলে কাঠামোবদ্ধ নিয়মে বউ-বাচ্চা নিয়ে বাঁচার! এই এক বছর পেরিয়ে ছোট্ট অনুধাবনে কিছুটা রাজনৈতিক ভাষায় বলতে পারি এটা কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিতার ছাপে লালন করা বুর্জোয়া ব্যক্তিত্বের সাজানো স্বপ্ন। আধো কী নেই! আছে। তবে সেটার সাথে যুক্ত হয়েছে উপরোক্ত দায়বোধগুলো।
আগেই বললাম সেই দায়বোধ ব্যাক্তি থেকে পরিবার তথা সমাজের গন্ডি ছাড়িয়ে ‘স্বকীয় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ জাতি’ তথা দেশকেও ধারন করার নির্যাস পাচ্ছে আস্তে আস্তে।
দায়বোধের সাথে চিন্তার মধ্যে যেমন এসেছে নতুনত্ব তেমনি মূল্যবোধেও পরিবর্তন। অনেকেই বলবে খুব বেশী ভাব নিচ্ছি!! বলতেও পার!! কিন্তু এই একটি বছরে মননশীলতার পরিবর্তনের পেছনে যে পরিবারটির সাথে বেড়ে উঠাকে বেশী গুরুত্ব দিতে হয় সেটি হল: “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবার”। মোটাদাগে এ পরিবারের কাছ থেকে যতকিছু শিখেছি তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এ পরিবারটি তার প্রতিটি সদস্যকে সর্বোচ্চ বিকাশের সাথে শেকড়কে ধারণ করার তাগিদ দিচ্ছে সর্বদা। যার মূল স্পিরিটটাই এরকম “চেতনায় অবিরাম শেকড়ের টান”! (আমাদের অন্যতম স্লোগান)
মোটামুটি ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের শেষ নাগাদে জগন্নাথ হলের সাথে নতুন সম্পর্কের সৃষ্টি। কষ্ট করে ফ্লোরিং করতাম দ্বোতলার উপরে “বড়গাঙ” নামের মোটামুটি বড়সড় একটা রুমে। রুমের নাম “বড়গাঙ”! এ কেমন কথা! হ্যাঁ এ এমন কথা।।যে ছোট্ট শব্দে জুড়ে আছে শেকড়। আগে জানতাম নাতো! এখন জেনে গেছি। বড়গাঙ নামের ছোট্ট নদীটি পাক সরকার কর্তৃক ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে সৃষ্টি হওয়া বৃহৎ জলরাশি। বর্তমানে কর্ণফুলী আর সেই “বড়গাঙ” নেই। পাকিস্তান সরকার এ নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর ভিটেমাটি থেকে শুরু করে যাপিত জীবনগুলোকে জলরাশিতে ডুবিয়ে ছন্নছাড়া করেছে।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুম্ম শিক্ষার্থীরা কী ভুলতে পারে এ বড়গাঙ কে! দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়ুয়া জুম্ম শিক্ষার্থীরা কী সর্বোচ্চ দায়বোধ রাখবেনা এ বড়গাঙ কে স্মরণ করে, ধারণ করে সামনে এগোনোর! তা কী হয়?
জেনে গেলাম বড়গাঙ রুমের মাহাত্ম। এক এক করে পরিচয় হলাম বড়গাঙের ভেতরে থাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম, জুম্ম ও আদিবাসীদের ইতিহাস, লড়াই, সংগ্রাম, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির বইগুলোর সমাবেশ “শিবচরণ গ্রন্থাগার” এর সাথে! বড়গাঙ রুমের সাথে লাগোয়া “তৈনগাঙ” নামের দু’টি বাথরুম। ফেইক স্মার্ট হয়ে এখন সবাই বলি “বাথরুম”! কিন্তু আমাদের পূর্বপূরুষরা যে গোসল ছাড়তো প্রকৃতির সাথে মিতালি গড়ে প্রবাহমান ছড়ার এককোণে বৈঠা পেতে! যার নাম আমরা বলতাম “গাঙ”। এ গাঙ নিয়ে অসংখ্য উপাখ্যান রযেছে আমাদের জুম্ম সমাজের ইতিহাসে। যাক, সে কথায় না গিয়ে গাঙ (যেখানে গোসল ছাড়া হয়) নিয়ে আমাদের চাকমা সমাজে প্রচলিত একটি প্রবাদ মনে পড়ছে সেটি এরকম- ‘গাঙ দেলে মুদো এজে, লাঙ দেলে আজা এজে’। (বাংলা:- গাঙ দেখলে প্রসাব ধরে, প্রেমিকা দেখলে হাসি পায়।) গাঙ-লাঙ এর সম্পর্কিত এ প্রবাদটি দেখেই বুঝা যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের এ গাঙগুলোতে কত চিক্কোদা-চিক্কোবী’র (জুম্ম যুবক-যুবতী) প্রেমের রহস্য জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে জীবনগুলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যের হলেও সত্য যে আমাদের “তৈনগাঙ” এ কোনো ‘লাঙ’/যুবতী’র দেখা মেলে না। 😃😃 যদিও এ লাঙগুলোকে খুঁজতে যেতে হয় শামসুননাহার হলের সামনের চত্বরে, নইতো কেউ সুফিয়া কামালের সামনে আবার কেউবা কার্জনের সবুজের পাদদেশে, রোকেয়া হলের গেইট এ, কেউবা নীলক্ষেত পেরিয়ে কুয়েত মৈত্রী হলের দিকে, টিএসসিতে কিংবা অন্যকোথাও।
যাক, কথাটা মজার হলেও আমরা এমনই করি। কেবল লাঙের সম্পর্কের জের ধরে নয় এ স্পটগুলোতে আমরা অনেক সময় বসে থাকি সিনিয়র জুনিয়র সবাই মিলে। একসাথে আড্ডা, মজা সব হয় আর আলোচনার কেন্দ্রে জুড়ে থাকে পাহাড়-জুম। আগেই বলেছি চেতনায় শেকড়কে ধারণ করার প্রয়াস আমরা প্রতিটি সময় পেয়ে থাকি।
বড়গাঙ রুমের ভেতরে ছোট্ট আরেকটি রুম রয়েছে নাম “কেওক্রডং”। অনেকেই জানে এ কেওক্রডং এর কথা। বিগত সেপ্টেম্বরে বগালেক বেয়ে আসল কেওক্রডং জয় করে এসেছি যদিও। এ বড়গাঙ রুমে অবস্থানরত প্রায় ২০ এর অধিক জুম্ম বড় ভাইদের সাথে আমরা যখন প্রথম বর্ষের আরো ১০/১২ জনের একটি টিম এসে ভীড় করলাম তখন বাড়তি চাপ নিয়ে আমাদেরকে রাখার দায়ভারটা খুব বেশী করে অনুভব করতে লাগলেন পরিবারের বড়’রা। সিদ্ধান্ত হল বড়গাঙের বারান্দায় তেলপাড় ঘেরা দিয়ে আমাদের থাকবার ব্যবস্থাটা করার। এ রুমটার নাম দিলাম “মিনি বড়গাঙ”। এই মিনি বড়গাঙেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দিনগুলোর পথচলা। এখানেই ব্যাচ কেমিষ্ট্রিটা জমে উঠলো আর কত হাসি, ঠাট্টা, আড্ডা, আলোচনা সাথে অবশ্যই যুক্তি-তর্ক এবং ঝগড়া। তবে আমরা বড়গাঙ নামের শেকড়ে যেহেতু যাপন করছি জীবনগুলো আড্ডা-আলোচনা’র মধ্যে নিশ্চয় মিশে আছে আমাদের জুম-পাহাড়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবারের যেসব সদস্য জগন্নাথ হলে বড়গাঙ রুম ছাড়াও অন্যান্য রুমে থাকে তাদের মধ্যে রয়েছে চিম্বুক (১০০৩), লোগাং (১০১৫), মাওরুম (১০১৬), গোমতী (২১৮), সাংগ্রাই (২০৮), স্ববন (৪৬৫), জুমল্যন্ড(৮০২০), সহ অারো অন্যান্য রুমগুলোতে। বড়গাঙ বাদে অন্য সব রুমগুলোতে মোটামুটি সিনিয়ররাই অবস্থান করে। তবে আমরা সবাই এক হয়েই থাকি। সিনিয়রদের প্রতি সম্মান আর জুনিয়রদের প্রতি অগাধ ভালোবাসার বন্ধন যেন আমাদেরকে বেঁধে ফেলেছে আর করে ফেলেছে একই পরিবারের সন্তান। জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবারের বিভিন্ন কার্যক্রম আর চেতনাগত মেলবন্ধনের কারনে জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবারের অনেকেই সক্রিয় রাজনীতিতেও যুক্ত। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কার্যক্রমে কোনো না কোনোভাবে এ রাজনৈতিক সম্পৃক্তরায় নেতৃত্ব দিয়ে থাকে তবে সব ক্ষেত্রে নয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র-যুব সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী ছাত্র সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাথেই অনেকের সম্পৃক্ততা। যার ফলে, জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবারের গড়নে, ধরণেও দেখা মেলে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের দলীয় সংগীতের দু’লাইনের বিশাল তাৎপর্যের বাস্তবিক এ চেহারাগুলোর সমাবেশ –
“পাংখো, খুমি, লুসাই, মুরং, মারমা,
তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খিয়াং, চাক, ত্রিপুরা, চাকমা।”
আমরা সবাই এক হয়েই থাকি। ঐক্যবদ্ধ এ শক্তির সংহতিতে ক্রমেই যুক্ত হয়ে পড়েছি জুম-পাহাড় কেন্দ্রিক নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক কিংবা কখনো রাজনৈতিক কার্যক্রমেও। আগেই বলেছিলাম দায়বোধের মাত্রাগত পরিবর্তন এনে দিয়েছে এ পরিবারটি। বছরের শুরুতে মার্চ কি এপ্রিলের দিকে আমরা শুনলাম সাজেক কাঁদছে। অনাবৃষ্টিতে ক্ষতির শিকার জুমনির্ভর পাহাড়ীরা না খেয়ে মরছে কিন্তু আমরা জানি, তাদের কাছেই সাজেকের রমরমা পর্যটন রিসোর্ট, হোটেল, মোটেল! জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবারের সিনিয়র টু জুনিয়র সবাই মিলে মাঠে নামলাম এদের জন্যে। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখি, আমাদের প্রতিটি উদ্যোগ, পদক্ষেপ, সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনাগুলো চলে আসে “গেট টুগেদার” নামের মাসিক কিংবা দ্বি-মাসিক বা ত্রৈমাসিক গেদারিং এর মধ্য থেকে। এই গেট টুগেদারেই রয়েছে পাহাড় থেকে দূরে অবস্থানরত জুম্ম শিক্ষার্থীদের যান্ত্রিক জীবনে পড়াশুনার ব্যস্ততার মধ্যেও জুম-পাহাড় নিয়ে আমাদের চিন্তা, উদ্যোগ, চেতনা, অনুভূতি, আবেগের মিশেল।
এখানেই আমাদের সিনিয়র টু জুনিয়র, চিক্কো দা-চিক্কোবী, ব্যাচ টু ব্যাচের সকল সদস্যের মধ্যে পরিচয়, কথাবার্তা, প্রেম তথা প্রণয়! তবে আমরা যারা হলে অবস্থান করি আমাদের মধ্যেও মাসিক, দ্বি-মাসিক কিংবা ত্রৈমাসিক হল মিটিং হয়। যাক, এ গেদারিংগুলো থেকেই আমরা পরিকল্পনা করি কখনো সাজেকের পাশে দাড়াঁনোর, লংগদুতে অগ্নিসংযোগের সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্থ জুম্মদের পাশে দাড়াঁনোর, কখনো দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলে শীতবস্ত্র বিতরণের। তবে এই নয় যে উক্ত উদ্যোগগুলোর মাধ্যমে পাহাড়ে আহামরি কিছু করেছি কিন্তু আমরা আমাদের চেতনাকে শাণিত রাখতে চায় সর্বদা। বিভিন্ন সময় তাৎক্ষণিকভাবে রাস্তায় নামি সুজাতা, তুমাসিং কিংবা ইতি হত্যার বিচারের দাবী তুলে। আর স্লোগান তুলি,
“ইতি হত্যার বিচার কর/করতে হবে”
“অবিলম্বে পার্বত্য চুক্তি/বাস্তবায়ন করতে হবে”
মনে আছে, সেনা নির্যাতনে নিহত হওয়া রমেল হত্যার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদী স্লোগানের কোরাসগুলো। রমেল কে নির্যাতন করা হল, হাসপাতালে নেয়া হল পরে মৃত রমেলের লাশ পুড়িয়ে ফেলা হল!! আপন জুম্ম ভাইয়ের মৃত্যুর পর লাশ পেট্রোলে পুড়িয়ে ফেলার খবরে সেদিন জগন্নাথ হল কম্পিত করেছিলাম স্লোগানে, স্লোগানে। হত্যার প্রতিবাদে তারুণ্যের তেজদীপ্ত কন্ঠে, গভীর আবেগ, দুঃখ আর ক্ষোভের মিশেলে গলা হাকিয়ে চিৎকার করেছিলাম –
“আমার ভাই হত্যা কেন/প্রশাসনের জবাব চাই”
কেবল রমেল নয় আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি হত্যা, ধর্ষণ, সহিংসতার বিরুদ্ধে দায়বোধের গভীর ক্ষোভ থেকে রাস্তায় নামতে তাড়িত হতে শিখেছি। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাথে সম্পৃক্ততাই বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে জুম-পাহাড়ের প্রতি আবেগকে আরো বেশী শাণিত করেছি বলে মনে হয়। শিখেছি অনেক কিছু – প্রেস-রিলিস দেয়া, বিভিন্ন ছোটখাট কার্যক্রমে নেতৃত্বদান, বিভিন্ন কাজে সংগঠিতকরণ, এমনকি “চান্দা’ নেওয়ার কৌশলও!! তবে প্রত্যক্ষ বাস্তবতায় দেখেছি প্রতিটি কার্যক্রম পরিচালনার শেষপর্যায়ে সবসময় আর্থিক টানপোড়ন থাকেই সেটা সামাজিক, সাংস্কৃতিক কিংবা রাজনৈতিক। আর এটাই বিশ্বাস করি এ টানাপোড়নই জুম-পাহাড়ের প্রতি আমাদের সীমাহীন আবেগের তাড়নায় অতৃপ্ত প্রত্যাশার বহিঃপ্রকাশ।
চেতনার সাথে বাস্তবতার সমীকরণ মেলাতে গিয়ে প্রথম বর্ষেই আরেকটি নতুন সৃষ্টি করলাম সেটি সম্ভবত “INDIGENOUS TEACHING HOME!” বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু জুম্ম শিক্ষার্থীদের সহায়ক একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রথম বর্ষেই এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে চলমান রাখতে হাত দিয়েছিলাম জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবারের অপর তিন সিনিয়র দাদা’র সাথে। আমরা চারজনেই শুরু করেছিলাম আর প্রথম বছরের ছোট্ট সফলতারও দেখা পেয়েছি। এই লেখাটি লেখা পর্যন্ত যতদূর জেনেছি আমাদের কোচিং এ পড়ুয়া যেসব জুম্ম শিক্ষার্থী বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে তাদের মধ্যে দুইজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, দুইজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, চার-পাঁচজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাকীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। আমরা শুরু করেছিলাম অল্প সংখ্যক জুম্ম শিক্ষার্থী দিয়ে। তবে আগামী দিনে এ প্রতিষ্ঠানটির কলেবর বৃদ্ধি করতে পারি জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবারের সকলের সহযোগীতায়। এ প্রতিষ্ঠানটির পেছনে আমাদের সফলতা বা ব্যর্থতা সময়ই বলে দিবে তবে জুম আর জুম্মদের প্রতি আবেগের কমতি থাকবে না।
যাইহোক, প্রথম প্রথম আচরণগত টুকটাক সীমাবদ্ধতাগুলোর সুযোগে পরিবারের বড়’রা শাসাতেন। আধো বিভিন্ন সময় এ শাসনের গন্ডিতে আবদ্ধ। তবে এ শাসনই আমাদের সৌন্দর্য্য বলে মনে করি। এ শাসনের বন্ধনে থেকে স্নেহের দামটুকু নেয়ার সুযোগগুলো হাতছাড়া করিনি এই একটি বছরে। কখনো কখনো কোনো বড় ভাইয়ের ওয়ালেট খালি করতে ভুল করিনি! এমনও আছে জৈনক এক বড়ভাই টিএসসি’র পাশে ডিবিবিএল এর বুট থেকে টাকা তুলতে যেতে বাধ্য হয়েছে কারণ আমরা নাস্তা অর্ডার করে খেতে বসেছি!! যাইহোক, এসবের মধ্যেই আমরা আবিষ্কার করেছি বড় ভাইদের সামনে ওয়ালেট বের করা বেয়াদবী!! কী যে মজা। কিন্তু মজার দিন যে, শেষ! সামনে ‘১৮ তে পা দিতে যাচ্ছি। পরিণত বয়স হয়েছে বলে সামনে ছোট ভাই-বোনেরা আসবে আর আমরা! সেটা সময়ই বলে দিবে।। তবে কিছু খাওয়াতে না পারলেও ভাঙা গলায় কিছু গান নিশ্চয় শুনাতে কার্পণ্য করবো না।সেই গানগুলোতেও আমাদের জুম-পাহাড়ের নির্যাস পেয়ে বসি আমরা। কখনো রণজিৎ স্যারের ‘চেঙে মেউনি হাজলং’, কখনোবা মাদলের গান ধরি, ‘পাখির স্বভাব পাখির মত উড়বে বলে, বন পাহাড়ে উড়ে-ঘুরে গাইবে বলে!’ তবে আমরা গানগুলোর মাহাত্মকে ধারণ করেই কখনোবা বার্গী পাখির মত উড়ে গিয়েছি সেই প্রিয় পাহাড়ে। অাবার কখনো আমাদের স্বকীয় শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে মূলধারার সংস্কৃতির সাথে মেলবন্ধন সৃষ্টির প্রয়াস পেয়ে গড়া “জুম লিটারেচার এন্ড কালচারাল সোসাইটি’র” বিভিন্ন কার্যক্রমের সাথে একাত্ম হয়েছি এই একটি বছরেই। এক আধটু গিটারের টুংটাং আর কাজন চাপড়ানোও শেখা হয়েছে তবে সেটা আমার স্বকীয় গান গেয়েই! কখনো নিউ বিল্ডিঙের ছাদে, কখনোবা হলের মাঠের গ্যালারীর ছাদে, টিএসসি’র করিডরে নয়টো মিনি বড়গাঙেই বসিয়েছি গানের আসর! বিভিন্ন সময়ে আমরা কখনোবা ব্যাচ এর সবাই মিলে বা সিনিয়র টু জুনিয়র মিলে বসেছি “সিদোল” মেশানো তরকারী স্বাদ নেওয়ার জন্য। আমরা কী না করলাম!
যাক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যেই পেয়েছি তিনটি জিনিস। প্রথমটি জুম, দ্বিতীয়টি জুম, তৃতীয়টিও নিশ্চয়ই জুম। ‘১৭ শেষে ‘১৮ আসছে সাথে আসছে নবীন কিছু অনুজ। কিছু শেখাতে না পারলেও অন্তত জুম চাষ শেখাতে হয়ত ভুল করবো না। বছরের পর বছর যাবে আর সময়ের পরিক্রমায় আমাদের আবেগগুলো শাণিত হবে জুমের প্রেরণায়।দিন চলে যাবে তার মত করে আর আমাদের চ্যালেঞ্জ হবে উপরোক্ত কার্যক্রমগুলো চালিয়ে নিয়ে যাওযার সাথে নতুন কিছু সৃষ্টির তাগিদে সৃজনশীল উদ্যোগ নেওয়ার। অনেক চ্যালেঞ্জ আর সম্ভাবনাকে সাথে নিয়ে সামনে এগুনোর শপথে ২০১৮ কে স্বাগত জানিয়ে কালায়ন দা’র সাথে কন্ঠ মিলিয়ে ভীষণভাবে গাইতে চাই –
“আগাজত হালা মেঘ উদিব্, ধমক দিনেই বোয়েরান বেই যেব।
ঝিমিদত সংসার জ্বলিব, হানফাদা দেবা প্যারাক গরিব্
লাভ নেই সিয়ত দোরেনেই, লাভ নেই সিয়ত পল্লেনেই!
গরিবং জাদ্-অ হাম মন দি লামিনেই”
জয়তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবার।। 💜💜
সতেজ চাকমা
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।