তঞ্চঙ্গ্যা জাতির মহাতরী – বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা
1097
সংগঠন বিহীন একটি সমাজে বা জাতিতে ঐক্য থাকে না। ঐক্য বিহীন সমাজে শৃঙ্খলা আশা করা যায় না। আবার শৃঙ্খলা বিহীন একটি সমাজ বা জাতি কখনাে উন্নতি করতে পারে না। সুতরাং একটি সমাজে বা জাতিতে ঐক্য সৃষ্টি, শৃঙ্খলা আনয়ন ও জাতিকে উন্নতির পথে বেগবান করতে হলে একটি সংগঠন অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
তারই প্রয়ােজনে তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ঐক্য, প্রগতি তথা সামগ্রীক উন্নয়নে প্রথম যে সংগঠনটি গঠন করা হয় তার বর্তমান নাম ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’ বা বাতকস।
প্রত্যেক দল বা সংগঠনের পিছনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক অনেক গুণাগুণ পরিলক্ষিত হয়। পড়ে থাকে অনেক না বলা ইতিহাস। বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থাও এসৰ গুণাগুণের উধের্ক্ষ যেতে পারেনি।
তবে সংগঠনের কর্ণধারদের কার্যক্রম যেমনই হােক না কেন একথাটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা তঞ্চঙ্গ্যা জাতির অকলিম বন্ধ হয়েই নীরবে নিভতে কাজ করে চলেছে। সুতরাং বাতকস’র অতীত ইতিহাস ও জাতির কল্যাণে অর্জিত তার কার্যাবলী সকলের সামনে উপস্থাপন করা উচিত বলে মনে করি।
বাংলাদেশী তঞ্চঙ্গ্যাদের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের নাম ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’। সংক্ষেপে এর নাম ‘বাতকস’। ইংরেজিতে এর নাম Tanchangya Welfare Organisation of Bangladesh (Bwob)।
এটি একটি অরাজনৈতিক এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ কল্যাণমূলক সংগঠন। ১৯৬৬ সালে এটি প্রথম গঠিত হলেও ১৯৮৩ সনকে এর প্রতিষ্ঠা সাল হিসেবে গণ্য করা হয়।
তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি
তঞ্চঙ্গ্যা জাতির ইতিহাসের পিছন দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, পূর্বে তঞ্চঙ্গ্যাগণ তারা কি তঞ্চঙ্গ্যা নাকি চাকমা?’ এমন একটি প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত ছিল। পূর্বপুরুষেরা অফিস আদালতে ‘চাকমা’ লিখে এসেছে। নামের শেষে চাকমা’ পদবী যােগ করে অনেকে সরকারী চাকুরীতে প্রবেশ করেছে;
তারা জায়গা-জমির দলিলে “চাকমা” পদবী লিখে এসেছে। তারা জানে এবং সকলে একবাক্যে স্বীকার করে যে, তারাই আসল চাকমা। এখন তারা কী করে নব আমদানীকত তঞ্চঙ্গ্যা টাইটেলটিকে ব্যবহার করবে? এদের মধ্যে অনেকে “চাকমা” টাইটেলটি ব্যবহার করার পক্ষে এবং এতেই তারা স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করেন।
আবার ‘চাকমা’ হিসেবে স্বীকার করলেও বর্তমান চাকমাদের সাথে তাদের আতিক যােগাযােগে বিস্তর ফারাক ছিল। ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে অনেকখানি মিল থাকলেও যার যার স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রেখে চলত।
বর্তমান চাকমাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তােলা তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে বলতে গেলে নিষিদ্ধই ছিল। তখন তারা চাকমাদের সাথে মিশে যেতেও পারছিলেন না, আবার ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ টাইটেলটিকেও গ্রহণ করতে পারছিলেন না। সুতরাং নানাবিধ সমস্যা তাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছিল।
ষষ্ঠ বৌদ্ধ সংগীতিকারক চাকমা রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথের (গৃহীনাম ফুলনাথ তঞ্চঙ্গ্যা) ও তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে প্রথম বিএ পাশ ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে ঘিরে তঞ্চঙ্গ্যাদের উৎসাহের কমতি ছিল না। তারা চাকমাদের থেকে আলাদা পরিচয়ে তঞ্চঙ্গ্যা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
ফলশ্রতিতে রাঙ্গুনীয়া উপজেলাধীন রইস্যাবিলি নামক তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামে ১৯৬৬ সালে ঈশ্বরচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যাকে সভাপতি ও নব কুমার তঞ্চঙ্গ্যাকে সাধারণ সম্পাদক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট তঞ্চঙ্গ্যা। সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি গঠিত হয়েছিল।
উক্ত কমিটির উদ্যোগে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে যাদু বিদ্যায় পারদর্শী তমরু খেলােয়ার গজেন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (বলী), প্রসিদ্ধ বৈদ্য রাংঞা কার্বারী ও কালাচান তঞ্চঙ্গ্যার (বৈদ্য) নিকট আদি প্ৰচলিত তঞ্চঙ্গ্যা বর্ণমালা হাতে লিখা বার্মিজ-তঞ্চঙ্গ্যা মিশ্রিত বর্ণমালায় তঞ্চঙ্গ্যা ভাষায় লিখা ও শেখার চর্চা শুরু হয়; কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে সে প্রয়াস বেশী দূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। অঙ্কুরেই বিলুপ্ত হয়ে যায় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি।
তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা (তসস)
তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন কমিটি। গঠনের উদ্দেশ্য ও গৃহীত কাজের গতি ঝিমিয়ে পড়লেও ভিতরে ভিতরে ‘চাকমা’ নাকি ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ কোনটিকে তারা গ্রহণ করবে এমন দোটানা তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে চলছিল।
১৯৭৯ সালে রাঙ্গামাটিতে অনুষ্ঠিত পার্বত্য লােকজ মেলায় কিছু সচেতন ও সাহসী তঞ্চঙ্গ্যার উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় তারা প্রথমবারের মতো ‘তঞ্চঙ্গ্যা’ পরিচয় নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করার সাহস দেখিয়েছিল।
সেই সাহস প্রদর্শনের সুযােগ দেয়ার জন্য তৎকালীন উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট (উসাই), রাঙ্গামাটি এর পরিচালক অশােক কুমার দেওয়ানের নিকট তঞ্চঙ্গ্যা জাতি চিরকাল কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ থাকবে।
সেই সময়ে রাঙ্গামাটিতে প্রতিবছর পার্বত্য লােকজ মেলা ‘স্বর্ণশীলা’ নামে মাসব্যাপী। মেলা বসত। ১৯৭৯ সালে উক্ত মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রদর্শনের জন্য একদল তঞ্চঙ্গ্যা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। খবর পেয়ে উসাই’র পরিচালক অশােক কুমার দেওয়ান বাবু বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যাকে ডেকে পাঠান এবং অনুষ্ঠানে তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীদের সাংস্কৃতিক অলষ্ঠান পরিবেশনের আহ্বান জানান। ঐ বছরই তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীদের পরিবেশনায় তঞ্চঙ্গ্যা জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি নির্ভর অনুষ্ঠান পরিবেশন করার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীগােষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটে।
সেই সময়ে এ্যাডভােকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যা, আদিচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (বর্তমানে ভিক্ষ), প্রয়াত সুনীলা তঞ্চঙ্গ্যা, রােহিনী তঞ্চঙ্গ্যা, ফুলধর তঞ্চঙ্গ্যা, পরিমল তঞ্চঙ্গ্যা, প্রয়াত মীনা তঞ্চঙ্গ্যা, শােভা তঞ্চঙ্গ্যা, জয়শ্রী তঞ্চঙ্গ্যা, উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা, শিক্ষা তঞ্চঙ্গ্যা, অমল বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ ব্যক্তি সেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন।
তারা এক নাগারে ১৮/১৯ দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছিলেন। উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণসহ যাবতীয় আর্থিক যােগান দিয়ে ছিলেন জ্ঞান বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা নামক একজন সচেতন তঞ্চঙ্গ্যা।
১৯৭৯ সালে উক্ত অনুষ্ঠান চলাকালে অশােক বাবু (অশােক কুমার দেওয়ান) তঞ্চঙ্গ্যা শিল্পীগােষ্ঠীর বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যা, আদিচন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা ও দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যাকে অফিসে ডেকে পাঠান।
অশােক বাবু ঐ সময় সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সাংগঠনিক ভূমিকার অপরিহার্যতার কথা ব্যক্ত করেন। অশােক বাবু বলেন, “আপনাদের (তঞ্চঙ্গ্যাদের) সংস্কৃতি, কৃষ্টির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে যা চাকমাদের সাথে সাদশ্য নয়। আপনাদের শিক্ষাদীক্ষায় আরও অগ্রসর হতে হবে।”
দীননাথ বাবু সেই দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বলেন, “সার্বিক দিক উন্নয়নের জন্য তিনি (অশােক বাবু) তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সম্মিলিত একটি সামাজিক এবং সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি সংগঠন গড়ে তােলার উৎসাহ ও পরামর্শ দেন; যার মাধ্যমে সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা অধ্যুষিত অঞ্চলে শিক্ষা, সংস্কৃতির উন্নয়ন সাধন করা যায়।
সর্বোপরি তঞ্চঙ্গ্যা সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহত রাখার তাগিদ দেন এবং সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে জোড়ালােভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সকল রকমের সহযােগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।”
অশােক বাবুর সেই পরামর্শ পেয়ে তাদের মনােবল আরও দৃঢ় হতে থাকে। বিশেষ করে তরুণ বিধুভূষণ তাে একটি সংগঠন গঠনের জন্য পুরােদমে মাঠে নেমে যান। তিনি এবং বেশ কিছু তরুণের সহযােগিতায় ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সালে রহস্যবিলি গ্রামে একটি সভার আয়ােজন করা হয়।
উক্ত সভায় ২৪০ জন তঞ্চঙ্গ্যা উপস্থিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্য থেকে ১৫ জনকে নিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র (তসস) কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়। একই সাথে তখনকার বাস্তবতা অনুসারে রচিত হয় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার গঠনতন্ত্র।
বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা (বাতকস)
তসস গঠনের পর অনেকে আবার এই সংগঠন ও বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েন নি। কিন্তু স্বপ্নবিলাসী তরুণ বিধুভূষণ তঞ্চঙ্গ্যা দমে যাবার পাত্র নন। তিনি কিছু সহকর্মী নিয়ে এই সংগঠনে সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যাদের একত্রিত করার জন্য তােড়জোড় শুরু করেন। তঞ্চঙ্গ্যা অধ্যুষিত এলাকাতে গিয়ে বারবার আলােচনা সভা আয়ােজন করা হয়।
দীর্ঘ প্রায় একযুগ এভাবে চলে যায়। অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে ১৯৯৫ সালের ৮ই এপ্রিল বান্দরবানের বালাঘাটাস্থ প্রাইমারী স্কুল মাঠে বৃহত্তর তঞ্চঙ্গ্যাদের নিয়ে তঞ্চঙ্গ্যা মহাসম্মেলন সাফল্যজনক ভাবে সম্পন্ন করা হয়।
এই মহাসম্মেলনেই সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থাকে আরাে গতিশীল ও যুগােপযােগী করে ঢেলে সাজানাের। সেই সাথে প্রয়োজন হয় ১৯৮৩ সালে প্রস্তুতকৃত তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার গঠনতন্ত্র সংস্কারের। একই সাথে উক্ত সম্মেলনে নতুন করে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। এই কার্যনির্বাহী কমিটিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
২১ এপ্রিল ১৯৯৫ সালে, নবগঠিত কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থার নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা রাখা হয়।
একই সাথে ১৯৮৩ সালে প্রস্তুতকৃত বাতকস এর গঠনতন্ত্র সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করার জনা পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি “গঠনতন্ত্র প্রণয়ন উপকমিটি” গঠন করা হয়। গঠনতন্ত্র প্রণয়ন উপকমিটিতে ছিলেন-
১। সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা – আহ্বায়ক
২। লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা – যুগ্ম আহ্বায়ক
৩। অনিল তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য
৪। সুভাষ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য
৫। উচ্চত মনি তঞ্চঙ্গ্যা – সদস্য গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটি বাকস এর পুরাতন গঠনতন্ত্রকে আট অধ্যায়ে বিভক্ত করে সংশােধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে গঠনতন্ত্র চুড়ান্ত করে। সংশােধিত গঠনতন্ত্র ১৯৯৯ সালে প্রথম প্রকাশ করা হয়।
এরপর ২০০৯ সালে এটি পুনরায় সংশােধন করে ২০১২ সনে পুস্তকাকারে প্রকাশ করা হয়।
বাতকস এর লক্ষ্য
বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থার ২০১২ সালে প্রকাশিত গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে – “এই সংস্থার প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হইতেছে বাংলাদেশে বসবাসরত সমগ্র তঞ্চঙ্গ্যা জাতিসত্তার জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তাহাদের শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি আদর্শ ও ঐতিহ্যের সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও মান উন্নয়ন পূর্বক তাহাদিগকে রাষ্ট্রের উপযুক্ত ও আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়িয়া তােলা।”
বাতকস এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য
নির্ধারিত লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাকসের ৮টি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যথা-
১. তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের জন্য উদ্বুদ্ধকরণে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।
২, তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক সম্প্রসারণের জন্য বিদ্যালয়, হােস্টেল ও আশ্রম ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৩. বাংলাদেশের অন্যান্য জাতিসত্ত্বার সাথে তঞ্চঙ্গ্যাদের মধ্যে সুসম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ববােধ বজায় রেখে পারস্পরিক সমন্বয় সাধন করে উন্নতির পথে এগিয়ে নেবার প্রচেষ্টা করা।
৪. সংস্থার যাবতীয় নীতি-পদ্ধতি ও কার্যের অগ্রগতির ধারা তঞ্চঙ্গ্যা জনসাধারণের মাথা তথা বাহিরে ব্যাপক প্রচারের উদ্দেশ্যে সাময়িকা বা মুখপত্র প্রকাশ করা।
৫. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং তঞ্চঙ্গ্যা ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশনা ও প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
বাতকস এর সাংগঠনিক স্তর
বাতকস এর কাজের গতি বেগবান করার লক্ষ্যে বাতকসকে চারটি সাংগঠনিক স্তরে বিভাজিত করা হয়েছে।
(১) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি,
(২) ষ্ট্যান্ডিং কমিটি,
(৩) আঞ্চলিক কমিটি ও
(৪) এলাকা কমিটি।
বাতকস এর পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয় ৫১ জন সদস্য নিয়ে। এছাড়া আরও ১৯ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে এর আকার দাঁড়ায় ৭০ জনে। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, সিনিয়র সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে ষ্ট্যান্ডিং কমিটি গঠন করা হয়।
২১ জন পূর্ণাঙ্গ সদস্য ও ৭ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে গঠিত হয় একেকটি আঞ্চলিক কমিটি। এছাড়া ১১ জন পূর্ণাঙ্গ সদস ও ৩ জন বিকল্প সদস্য নিয়ে গঠিত হয় একেকটি এলাকা কমিটি গঠনের কথা গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে।
বাতকস এর সাংগঠনিক অঞ্চল
তঞ্চঙ্গ্যাদের বসতিসমুহ বিচ্ছিন্নভাবে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এ চারটি জেলায় ছড়ানাে ছিটানাে। এ সব তঞ্চঙ্গ্যা এলাকাকে বারােটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। অঞ্চলসমুহ হলাে-
(১) রাঙ্গামাটি অঞ্চল,
(২) দেবতাছড়ি-রইস্যাবিলি অঞ্চল,
(৩) কাপ্তাই অঞ্চল,
(৪) বিলাইছড়ি অঞ্চল,
(৫) ফাতােয়া অঞ্চল,
(৬) রাজস্থলী অঞ্চল,
(৭) রাজভিলা অঞ্চল,
(৮) বান্দরবান অঞ্চল,
(৯) রােয়াংছড়ি অঞ্চল,
(১০) আলীকদম অঞ্চল,
(১১) নাইক্ষ্যংছড়ি অঞ্চল ও
(১২) কক্সবাজার অঞ্চল।
বাতকস এর সম্মেলন সমুহ
১৯৮৩ সালে সস গঠনের পর থেকে ২০১৬ পর্যন্ত মােট ৬টি তঞ্চঙ্গ্যা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদের মধ্যে রইশ্যাবিলিতে ১টি, ওয়াগ্গা অঞ্চলে ২টি, বান্দরবান অঞ্চলে ২টি ও রাঙ্গামাটি সদর অঞ্চলে ১টি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ ৬টি সম্মেলনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৮ই এপ্রিল, ১৯৯৫ সালে বান্দরবান সদরে বালাঘাটা প্রাইমারি স্কুলের মাঠে অনুষ্ঠিত সম্মেলন।
এই সম্মেলনের পরে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র নাম পরিবর্তন করে বর্তমান। বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা রাখা। এ সম্মেলনে চারটি জেলার প্রায় পাঁচ হাজার তঞ্চঙ্গ্যা অংশ গ্রহণ করেছিল।
এ মহাসম্মেলনই তঞ্চঙ্গ্যা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার, শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনার মতাে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এ সম্মেলনে প্রতিটি তঞ্চঙ্গ্যা অঞ্চল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি নতুন করে গঠন করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি পদে বরিত হন বাবু প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা ও মহাসচিব মনােনীত হন বাবু অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (চেয়ারম্যান)।
১৯৯৫ সালের মতাে আরেকটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কাপ্তাই উপজেলাধীন ওয়াগ্গা হাই স্কুল মাঠে ২০০৪ সালের ১২ই এপ্রিল। এ সম্মেলনেও প্রতিটি তঞ্চঙ্গ্যা অঞ্চল হতে প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিল।
উৎসবমুখর পরিবেশে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলােচনা সভার মাধ্যমে সাফল্য জনকভাবে সম্মেলনটি সম্পন্ন করা হয়। এ সম্মেলনেও নতুন করে বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। এতে বাবু প্রসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা ও বাবু অনিল চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা স্বপদে পুনরায় মনােনীত হন।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ইনষ্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয় বাতকস এর ৬ষ্ঠ কেন্দ্রীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনে প্রথম বারের মতাে ভােটাভুটির মাধ্যমে কেন্দীয় কমিটি গঠন করা হয়। এতে বাবু প্ৰসন্ন কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা তৃতীয়বারের মতাে সংস্থার সভাপতি নির্বাচিত হন।
এছাড়া বাবু দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যাকে মহাসচিব, অভিলাষ তঞ্চঙ্গ্যাকে সাংগঠনিক সম্পাদক ও রনি তঞ্চঙ্গ্যাকে অর্থ সম্পাদক করে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট বাতকস এর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়।
বাতকস এর গৃহীত ও বাস্তবায়িত কার্যাবলী
বাতকস শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সামগ্রিক কল্যাণে এই সংস্থা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাকসের গহীত ও বাস্তবায়িত কাজ সমূহ-
১. ‘বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা’ (বাতকস) এর প্রথম সাফল্য ২৩/০১/১৯৯৭ইং তারিখে বাকসের একটি প্রতিনিধি দল তৎকালীন জাতীয় সংসদের হুইপ আবুল হাসনাত আবদুলস্নাহর সাথে সাক্ষাত করে এবং স্মারকলিপিসহ তঞ্চঙ্গ্যাদের স্বাধ্যতা বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে তঞ্চঙ্গ্যাদের একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি লাভ করাতে সক্ষম হয়।
২. এ সংস্থা স্থানীয় সরকার পরিষদ (বর্তমান জেলা পরিষদ) ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে তঞ্চঙ্গ্যাদের জন্য আলাদা আসনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে।
৩. তঞ্চঙ্গ্যা ভাষা ও শিক্ষার উন্নয়নে বাতকস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
৪. সাংস্কৃতিক উন্নয়নে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃ-গােষ্ঠি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রভিত্তিক তঞ্চঙ্গ্যা নৃত্য, গীত, নাটক, আবৃত্তি এবং ঐতিহ্যবাহী পীংগিলি গীত, খেংস্থরং ও বাঁশী প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতিমধ্যে ইনষ্টিটিউটয়ে ১০দিন ব্যাপী কিছু প্রশিক্ষণের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।
৫. পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রছাত্রীদের তুলে আনার লক্ষ্যে রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই, রাজস্থলী ও বান্দরবানে চারটি তঞ্চঙ্গ্যা ছাত্রাবাস নির্মাণ করা হয়েছে।
৬. সংস্থার নিজস্ব জায়গায় পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ৫০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে রাঙ্গামাটি সদরে সংস্থার কমপেস্নক্স নির্মান করা হয়েছে।
৭. লেখক ও পাঠক সৃষ্টির জন্য বাতকসের মুখপত্র সিঙ্কাবা প্রকাশ করা হচ্ছে।
৮. তঞ্চঙ্গ্যাদের প্রথাগত আইন সংরক্ষণ ও সুষ্ঠুভাবে চর্চার নিমিত্তে তঞ্চঙ্গ্যা সামাজিক রীতি-প্রথা সম্বলিত একটি পুস্তক প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
৯. তঞ্চঙ্গ্যাদের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা সংরক্ষণ ও চর্চার নিমিত্তে ২০১৩ থেকে প্রতিবছর ‘বিষু’ উপলক্ষ্যে গােল্ডকাপ ‘ঘিলা খেলা’ ও অবিলম্বে এই আশা ব্যক্ত করা যায়। তঞ্চঙ্গ্যা সমাজের প্রতিভাবানদের উৎসাহিত করে ভাষা, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রথা, অর্থনীতি, রাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে তঞ্চঙ্গ্যাদের সামগ্রীক উন্নয়নে বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা অবিস্মরণীয় অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
তথ্য সূত্রঃ
১ গঠনতন্ত্র: বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা; দ্বিতীয় প্রকাশ ২০১২ (সংশােধিত)।
২. বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থা প্রসঙ্গেঃ এ্যাডি, দীননাথ তঞ্চঙ্গ্যার প্রবন্ধ; সিঙ্কাবা (২০১৩)।
৩. বিধু ভূষণ তরঙ্গ্যা, বাতকস এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এর সাথে ব্যক্তিগত আলাপ।
তঞ্চঙ্গ্যা জাতির মহাতরী বাতকস প্রসঙ্গ-১
লেখকঃ সুমনা তঞ্চঙ্গ্যা,বিএসএস ২য় বর্ষ, কর্ণফুলী ডিগ্রী কলেজ
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।