তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা: কলাখু কন্যা পসন (কলার মোচার কন্যার গল্প)
887
সে অনেক দিন আগের কথা। এক দেশে এক বুড়ো আর এক বুড়ী থাকত। তাদের ছিল এব মাত্র ছেলে। একদিন বুড়ো মারা গেল। ফলে বুড়ী তার ছেলেকে নিয়ে দিন কাটাতে লাগল।
দেখতে দেখতে ছেলে বড় হল। মনে তার বিয়ে করার ইচ্ছে জাগল। এভাবে দিন যায়। ছেলের ভারী মুখ দে। মা জিজ্ঞেস করল, “বাছা, তোমার কি হয়েছে?” উত্তরে ছেলে বলল, “মা, আমি বিদেশ ঘুরে আসব।’ বুড়ী ছেলেকে সম্মতি দিয়ে কলাপাতা মুড়িয়ে ভাত আর তরকারি দিয়ে বিদায় দিল।
চলতে চলতে ছেলেটি অন্য আর এক দেশে এসে পৌছাল। পথে যেতে যেতে একটি ঘরে এক বুড়ীকে দেখতে পেল। সে বুড়ীকে নানী সম্বোধন করে ডাকতে লাগল।
বুড়ী নানী ডাক শুনতে পেয়ে আহ্লাদিত হয়ে বলল, “তুমি কে নাতি? আমাকে নানী ডাকলে, এতোদিন আমাকে নানী ঢাকার কেউ ছিল না। ছেলেটি বলল, “আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। আমাকে একটু আশ্রয় দেবে?” বুড়ী বলল, “তোমার যত দিন থাকতে ইচ্ছা থাক।”
তারপর অনেক দিন কেটে গেল। একদিন বুড়ী উঠানে ধান শুকাতে দিয়ে বলল, “নাতি, তুমি এই ধান পাহারা দাও। আমি নদীতে গিয়ে পানি নিয়ে আসি”। “আচ্ছা বলে ছেলেটি ধান পাহারা দিতে লাগল।
এভাবে বসে বসে পাহারা দিতে গিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল টের পেল না। হঠাৎ এক সময় তার ঘুম ভেঙে গেল। দেখতে পেল, শুকাতে দেয়া ধানগুলি সাতজন সুন্দরী পা দিয়ে নেড়ে দিচ্ছে।
ঐ দৃশ্য দেখে সে একেবারে অবাক হল। ঐ সাতজনের মধ্যে একজন সবচেয়ে সুন্দরী ছিল। যাকে তার খুবই পছন্দ হল। তাদের দেখার জন্য সে চুপচাপ শুয়ে থাকল।
এমন সময় বুড়ীর আসার শব্দ হল। শব্দ পেয়ে ঐ সুন্দরী কন্যারা চটপট পালাতে শুরু করল। তারা কোথায় যায় ছেলেটি দেখতে লাগল।
দেখতে পেল যে, বাড়ীর পাশের কলাগাছগুলিতে তারা একে একে মিলিয়ে গেল। সে তার পছন্দের মেয়েটি কোন কলাগাছটিতে ঢুকল তা মনে মনে চিহ্নিত করে রাখল। আর আপন মনে ভাবতে লাগল, এদের একজনকে অবশ্যই পেতে হবে। তারপর গোমড়া মুখে বসে থাকল।
বুড়ী এসে জিজ্ঞেস করল, “কিরে নাতি, তোমার কি হয়েছে? মন খারাপ নাকি”। উত্তরে বলল, “নানী, অনেক দিনতো তোমার এখানে কাটালাম। আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। আমার এখন বাড়ী যাওয়া প্রয়োজন”।
বুড়ী বলল, “বেশতো তুমি যখন যেতে চাই তাহলে যাবে। আর হ্যা যাওয়ার সময় বাড়ীর সামনের একটি কলাগাছ কেটে নিয়ে যাবে। পথে অনেক পাহাড় পড়বে; পাহাড়ে পৌছে একটি করে খোসা ছাড়াবে”। ছেলেটি খুবই খুশী হল।
খাওয়া দাওয়া সেরে বুড়ীর কাছ থেকে বিদায় নিল। যাওয়ার সময় সবচাইতে বেশী সুন্দরী মেয়েটি যে কলাগাছটিতে ঢুকেছিল সেই কলাগাছটি কেটে নিয়ে গেল।
ছেলেটি পথ চলা শুরু করল। মনে দারুণ খুশী। পথে একটি পাহাড়ে পৌছালে বুড়ীর কথা অনুযায়ী খোসা ছাড়াতে লাগল। এভাবে পাঁচ-ছয়টি পাহাড় পার হওয়ার পর সেই মেয়েটি কলা। থেকে বের হয়ে আসল।
তার রূপের ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। কিন্তু মুশকিল হলো অন্য জায় বাড়ী যাওয়ার চেষ্টা করলে মেয়েটি হাঁটতে পারে না। ধরে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ব্যথায় ককি উঠে। ফলে কোনক্রমেই মেয়েটিকে বাড়ী নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
ঐ স্থানে ছিল একটি পানির কুয়া। কুয়ার পাশেই ছিল একটি বিশাল বটগাছ। অবশেষে আর কোন উপায় না দেখে মেয়েটিকে ঐ বটগাছটির একটি উঁচু ডালে রেখে ছেলেটি বাড়ী থেকে ঘোড়া নিয়ে আসার জন্য রওনা হয়ে গেল।
এদিকে হলো কি, ঐ জায়গার আশেপাশেই থাকত এক মায়াবী রাক্ষসী। পানির কুয়ার কাছে আসতেই বটগাছের ডালে বসে থাকা সুন্দরী মেয়েটিকে দেখল।
হিহি করে হেসে উঠে বলল, “তুমি সুন্দর নাকি আমি সুন্দর”। তারপরে আবার বলে উঠল, “ও নাতনী, আমাকে এক খিলি পান দাও না”।
উত্তরে মেয়েটি বলল, “কিন্তু আমার কাছে তো পান নেই”। রাপসী বলল, “তাতে কি? তুমি বটগাছের পাতা আর বিচিগুলি দিয়ে তারপর গাছের আঠালোরসটা লাগিয়ে খিলি বানিয়ে আমাকে দাও।”
মেয়েটি তার কথামতো পাতা আর বিচিগুলিকে দিয়ে খিলি বানিয়ে মায়াবীর দিকে ছুড়ে দিল। কিন্তু মায়াবী পান মাটিতে পড়ে গেল বলে ফেলে দিল।
এভাবে পর পর তিন বার হাত থেকে ফেলে দেওয়ার পর বলল, “তুমি আমাকে হাতে হাতে দাও। তাহলে আর পড়ে যাবে না।” যেই মাত্র হাতে হাতে দিতে গেল অমনি হাতে টান দিয়ে জোরে নামিয়ে আনল।
এরপর মেয়েটিকে মেরে পানির কুয়াটির মধ্যে পুঁতে ফেলে নিজে সেই সুন্দরী মেয়েটির রূপ ধারণ করে বটগাছের ঠিক সেই ডালটিতে বসে রইল।
আর কুয়ার মধ্যে যে জায়গাটিতে মেয়েটিকে পুঁতে রেখেছিল ঠিক সেইখানটিতে একটি লাল পদ্মফুল ফুটল।
এরমধ্যে ছেলেটি ঘোড়া নিয়ে ফিরে আসল। কিন্তু ঘোড়ার পিঠে মেয়েটিকে যতবারই তুলতে চাইল ততবারই ঘোড়াটি পিঠ সরিয়ে নিল। সে চিন্তা করল, নিশ্চয় এর কোন কারণ আছে। চারদিকে তাকাতেই কুয়ার মধ্যে একটি লাল পদ্মফুল দেখতে পেল।
সে সেই লাল পদ্মটিকে কুয়া থেকে তুলে নিয়ে আসল। এবার কিন্তু ঘোড়া আর কোন বাধা দিল না। বাড়ী ফিরে এসে সে লাল পদ্মটিকে সযত্নে বাক্সে রেখে দিল। আর সুন্দরীরূপী মায়াবীকে নিয়ে সংসার করতে লাগল।
কিছু দিন যেতে না যেতেই মায়াবীর জ্বালায় সংসারের সুখ-শান্তি নষ্ট হয়ে গেল। মনে তার আর শান্তি রইল না। ছেলেটি গোপনে পদ্মটিকে বের করে অপলক তাকিয়ে থাকে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এভাবে দিন যায়।
কিন্তু মায়াবী একদিন ঘটনাটি টের পেল। ফলে পদ্মটিকে বাক্স থেকে বের করে দু’হাতে কচলে ছিড়ে ফেলল এবং তা বাইরে ছুড়ে ফেলে দিল।
কিছুদিন পর যে জায়গাটিতে ঐ পদ্মটিকে ফেলে দিয়েছিল ঠিক সে জায়গায় একটি লাউগাছ গজিয়ে উঠল। বেড়ে উঠতে উঠতে লাউগাছটি ঘরের চাল ছেয়ে ফেলল। ঐ লাউগাছটিতে একটি লাউ ধরল।
যখন বুড়ীর ছেলে ঐ দিকে হেঁটে যেত তখন লাউটি উপরে উঠে যেত। আর যখন সুন্দরীরূপী রাক্ষসী ঐ দিকে হেঁটে যেত তখন লাউটি তার কপালে টোকা দিত।
এভাবে লাউটি বার বার মাথায় লাগার ফলে বিরক্ত হয়ে লাউটি ছিড়ে এনে রান্না করল। নিজে খাওয়ার পর স্বামীর জন্যও রেখে দিল।
কিন্তু বুড়ীর ছেলেটি না খেয়ে তা ফেলে দিল। এবারও যে জায়গাটিতে লাউ তরকারী পড়েছিল ঠিক সে জায়গায় একটি সুপারি চারা জন্মাল। সেই সুপারি গাছে এক সময় সুপারি ধরল। ধরার পর সুপারি পেকে গাছ থেকে ঝরে পড়ল।
কাছাকাছি এক বাড়ীতে এক বুড়ো আর বুড়ী বাস করত। একদিন ঐ পথ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা একটি সুপারি কুড়িয়ে পেল এবং সুপারিটিকে ঘরের এক ঝুড়িতে রেখে দিল। পরের দিন বুড়ো আর বুড়ী যথারীতি কাজের জন্য বাইরে গেল।
দুপুর বেলা বাড়ী ফিরে রান্না করার জন্য রান্না ঘরে ঢুকে বুড়ীতো একেবারে হতবাক। কে যেন রান্না করে দিয়ে গেছে। এভাবে দু-তিন দিন যাবৎ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। বুড়ী বুড়াকে বলল, “এর নিশ্চয় কোন রহস্য আছে”।
তারপর বুড়ো বলল, “চিন্তা করোনা। আজ তুমি কাজে যাবে। আমি ঘরে পাহারা দেব”। যথারীতি বুড়ী কাজে চলে গেল। এদিকে বুড়ো বুড়ী যাওয়ার পর মদের বোতল বের করে আরাম করে খেতে খেতে একসময় মাতাল হয়ে বেঘোরে ঘুমাতে লাগল।
বুড়ী বাড়ী ফিরে এসে দেখে, রান্না আগের মতোই করা আছে। আর বুড়ো ঘরের এক কোণে মাতাল হয়ে পড়ে আছে। এরপর বুড়োকে বলল, “তোমার দ্বারা কিছুই হবেনা। কাল আমি পাহারা দেবো। দেখি, কে রান্না করে যায় “।
পরের দিন বুড়ী ঘরের এক কোণে লুকিয়ে থেকে পাহারা দিতে লাগল। এক সময় যে ঝুড়িতে সুপারিটি রাখা ছিল সেখান থেকে এক অপরূপ সুন্দরী মেয়ে বের হয়ে আসল।
তারপর রান্নাঘরে ঢুকে রান্না করার জন্য ব্যবস্থা করতেই বুড়ী চুপি চুপি গিয়ে পেছন থেকে জাপটে ধরল। মেয়েটি ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য বহু চেষ্টা করল কিন্তু পারলনা। অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বুড়ো-বুড়ীর সাথে বাস করতে লাগল।
বুড়ী মেয়েটির অপূর্ব রূপের জন্য কোন বিপদ হতে পারে ভেবে মেয়েটির সারা গায়ে কালি মাখিয়ে দিত। এভাবে দিন চলে যায়।
একদিন ঐ ছেলেটি তার ঘোড়া নিয়ে পথে বের হলো। চলতে চলতে সেই বুড়ো-বুড়ীর বাড়ীতে পৌছাল। এদিকে বুড়ী ছেলেটিকে আসতে দেখে মেয়েটিকে লুকিয়ে থাকতে বলল।
কিন্তু ছেলেটি তা দেখে ফেলল। তারপর ছেলেটি সেখানে গিয়ে বলল, “নানী, আমার খুব পানির তৃষ্ণা লাগছে। আমাকে এক গ্লাস পানি দেবে?” বুড়ী এক গ্লাস পানি এনে ছেলেটির দিকে বাড়িয়ে দিল।
কিন্তু ছেলেটি বলল, “আমি এ পানি পান করব না, যদি তোমার ঘরে যে মেয়েটি থাকে সে এনে দেয় তবে পান করব।” অতঃপর বুড়ী মেয়েটিকে পানি এনে দেয়ার জন্য বলল। মেয়েটির হাত থেকে পানির গ্লাস নেয়ার সময় গ্লাস থেকে ছলকে কিছু পানি মেয়েটির হাতে পড়ে গেল।
এতে হাতে মাখানো কালির কিছু অংশ মুছে গিয়ে আসল রূপ বেরিয়ে পড়ল। ছেলেটি বুঝতে পারল ঘটনা। সে মেয়েটিকে একটানে তুলে ঘোড়ায় , চড়িয়ে বাড়ীতে ফিরে আসল।
বাড়ী ফিরে মেয়েটি রাতে তার সেই অতীতের ঘটে যাওয়া জীবনের কাহিনীগুলো একে একে বলতে লাগল। এই কাহিনী শুনে সুন্দরীরূপী ডাইনী রাগে ফেটে পড়ল এবং তার আসল রূপে ফিরে গেল।
আর রাগে চিৎকার করতে করতে মারা গেল। অতঃপর ছেলেটি সেই কলাধু কন্যাকে নিয়ে সুখে জীবন কাটাতে লাগল।
লেখক: রবিন তঞ্চঙ্গ্যা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।