icon

তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা: মানিক্যাব সিন্নী হানা (মানিকের বাপের সিরনী খাওয়া)

Jumjournal

Last updated Jan 18th, 2020 icon 1008

অতি প্রাচীনকালে তঞ্চঙ্গ্যা সমাজে এক লোক ছিল। তার পুত্রের নাম ছিল মানিক। লোকটার নাম পরিচয় যাই থাকুক, সে তার ছেলের বাবা অর্থাৎ মানিক্যার বাপ’ বলেই সমধিক পরিচিত ছিল।

এ’মানিক্যার বাপের জীবিতাবস্থায় কোন এক সময় তাদের পাড়ার কোন এক বাড়ীতে ‘সিরনী’ (শনি) পূজা হচ্ছিল। পূজায় মানিক্যার বাপেরও দাওয়াত ছিল।

লোকটি নিজেকে খুব জ্ঞানী মনে করত। অন্যের কথায় তেমন কান দিত না। নিজের বিবেচনায় যা ঠিক মনে করত ঠিক তেমনই ছিল তার কাজ-কর্ম ও চাল-চলন।

পূজার বাড়ীতে যথারীতি পূজার আয়োজন ও কার্যক্রম চলতে থাকে। এ দিকে মানিক্যার বাপ বাড়ীতে বিশ্রাম করে আর চিন্তা করে যে পূজা শেষ হতে আরও যথেষ্ট সময় আছে।

তাই এর মধ্যে একটু ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হবে না। যেমন চিন্তা ঠিক তেমনই কাজ। অতএব, ঘুম। একদম নাকডাকা আরামের ঘুম। শেষ বেলাতে ঘুম ভাঙল। ঘুম থেকে উঠে ছোট মেয়ে মুক্তাকে ডাকে।

মুক্তা গেছে ঝর্না থেকে পানি আনতে। আরও কিছুক্ষণ পর মুক্তা পানির কলসী নিয়ে ঘরে ফিরে। মেয়েকে দেখে মানিক্যার বাপ মুখ ধোয়ার পানি দিতে বলে। মেয়ে যখন পানি নিয়ে আসে তখন বলে, “হুক্কার কলকিতে তামাক আর আগুন দিয়ে নিয়ে আয়।”

মেয়ে বাঁশের হুক্কাটি সাজিয়ে নিয়ে বাবাকে দেয়। মানিক্যার বাপ কলকিতে জ্বলন্ত কয়লায় ফু দেয় আর লম্বা লম্বা টান দিতে থাকে। এমনি সময় মনে পড়ে সিরনী পূজায় তার দাওয়াতের কথা। অমনি হুক্কাটা রেখে বারান্দার বাঁশে ঝুলানো গামছাটা কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়।

ঘর থেকে কিছুদূর পথ এগিয়ে গিয়ে চিন্তা করে, “যাবো তো পূজায়; একটু গোসল করে পূত -পবিত্র হয়ে যাওয়াই ভাল হবে। তাই আবার ঘরের দিকে ফিরে বড় ধুতিখানা চেয়ে নেয়। ধুতি কাঁধে নিয়ে ঝর্নাঘাটে গোসল করতে রওনা দেয়।

ঝর্নাঘাটের পথটা দীর্ঘদিন ধরে পরিষ্কার করা হয়নি। পথটার দু’পাশে জঙ্গল আর বুনোলতা। এ পথে ঘাটে যাবার সময় তার নতুন বড় ধুতিখানা জঙ্গলী লতার সাথে আটকে যায়।

ফলে একটু মেজাজের সাথে ধুতিটা টানতে গিয়ে ধুতির কিছু অংশ ছিড়ে যায়। এতে আরও মেজাজ খারাপ হয়। তাতে রাগে টগবগ করে আবার ঘরে ফিরে। রাগত স্বরে মেয়ে মুক্তাকে ডেকে বলে দাওটা দিতে।

ঐদিকে সিরনী পূজার কাজ প্রায় সমাপনের সময়। অথচ সে চিন্তা করে এই কিছুক্ষণ কাজ করলেইঝর্নাঘাটের পথটা পরিস্কার করা যাবে। মেয়ে মুক্তার কাছ থেকে দাওটা নিয়ে কাজে লেগে যায় সে।

এমন সময় পাড়ার লোকজন পাশের পথ দিয়ে পূজার বাড়ীতে যেতে থাকে। তাকেও সঙ্গে যাবার জন্য ডাকলে সে বলে, “এইতোআসছি, তোমরা যাও।” এটুকু বলে আবার কাজে হাত দেয়।

কিছুক্ষণ পর দেরী হচ্ছে ভেবে কাজ বন্ধ করে তাড়াতাড়ি গোসলটা সেড়ে নেয়। ঘরে এসে দাওটা রেখে বড় ধুতিখানা পড়ে গামছা কাঁধে নিয়ে পূজার বাড়ীর দিকে রওনা দেয়।

পথ চলতে চলতে হঠাৎ তার মনে পড়ল, কালাচানের যুবতী মেয়ের বিয়ের প্রস্তাবের কথা । দূর গ্রামের এক আত্মীয়ের ছেলের জন্য তার মাধ্যমে প্রস্তাবটা পাঠানো হয়। মাঝপথে সে সোজা কালাচানের বাড়ীতে গিয়ে উঠে।

বাড়ীতে উঠে দেখে, কেউ নেই। দরজা বন্ধ। উঠানে কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর দেখে যে, কালাচানের স্ত্রী এক বোঝা লাকড়ি মাথায় নিয়ে ঘরে ফিরছে। মানিক্যার বাপ চিন্তা করে, “এ মুহুর্তে কি এমন কথা বলা যাবে? যাক, এসেছি যখন,কথাটা বলেই যাই।”

কালাচানের স্ত্রী বোঝাটা রেখে তাকে বসতে বলে। ঘরের দরজা খুলে বাঁশের হুক্কা সাজিয়ে নিয়ে আসে। মানিক্যার বাপ হুক্কা টানে আর চিন্তা করে, “এ দিকে বেলাও গড়িয়ে যায়, বিলম্ব করলে পূজাও পাবোনা, আর বিয়ের কথাও এখন না বললে দেরী হয়ে যায়।

তবুও বহুদিন পর হঠাৎ আসার কারণটা না বললে কালাচানের স্ত্রীও আবার কি মনে করে। তাই ধীরে সুস্থে বিয়ের প্রস্তাবের কথাটা বলার জন্য অপেক্ষায় বসে থাকে।

কালাচানের স্ত্রী ঘরের ভিতরে গিয়ে পানের বাটাসহ আবারো উঠানে আসে। মানিক্যার বাপ ভাবে, “না, কথাটা বলেই ফেলি।” যেন মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আবার ভিতরে আটকে যায়।

আর ভাবে ,“না- থাক, আজকে না বলে আর একদিন; কালাচান এবং তার স্ত্রী উভয়ের সামনেই বলা উচিত।”

তাই বিয়ের প্রস্তাবের কথা পুরোপুরি না বলে কালাচানের স্ত্রীকে বলল, “তোমাদের বুড়োবুড়ী দুজনের সাথে একটা কথা আছে, এজন্য আর একদিন এসে বলবো”- বলে তাড়াতাড়ি পূজার । বাড়ীর দিকে রওনা দেয়।

ঐদিকে পূজার বাড়ীতে সিরনী পূজার পাঁচালী পড়া থেকে পূজা সামগ্রীর মন্ড তৈরি ও বিতরণ, খাওয়ার পর্ব প্রায় সমাপ্তির পথে। আশপাশের সব বাড়ীর সকলকে ডেকে ডেকে পূজার প্রসাদ বিতরণ চলছে।

এসব প্রসাদ রাত্রি নাগাদ রাখা যাবে না। হয় খেয়ে শেষ করতে হবে, না হয় উচ্ছিষ্ট ইত্যাদি ছড়ার পানিতে ফেলে দিতে হবে। তাই যারা খেতে ইচ্ছুক তাদেরকে দু’তিন বারও দেয়া হচ্ছে।

মানিক্যার বাপ লাঠি হাতে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে পূজার বাড়ীর টিলা উঠতে থাকে আর চিন্তা করে, “এতক্ষণে বুঝি প্রসাদ বিতরণ চলছে। হয়তো ঠিক সময়েই পৌছতে পারব।”

প্রসাদ বিতরণ ও খাওয়া সব কিছু শেষ করে পাড়ার যুবকরা যখন হাঁড়ি-পাতিল, গামলা, গে ইত্যাদি ধোয়ার জন্য ছড়ার দিকে রওনা দেবে ঠিক সে মুহুর্তে হাঁ হাঁ শব্দ করে লাঠি হাতে পব বাড়ীর উঠানে মানিক্যার বাপ উপস্থিত।

কে একজন যেন প্রায় চিৎকার দিয়ে বললো, “………. মানিক্যা বাপ আইসে (পে, তা শুনে পূজার বাড়ীর মালিক জয়মুনি তঞ্চঙ্গ্যা আর বাড়ীর ভিতরে গল্প-গুজব ; কয়েকজন মুরুক। গোছের লোক বাইরে চলে আসল।

উঠানে তারা সবাই মানিক্যার বাপের সাথে মুখোামুখি। মানিক্যার। বাপ হাঁড়ি-পাতিল আর উচ্ছিষ্ট নিয়ে যুবকদের ছড়ার দিকে যেতে দেখে নির্বাক হয়ে উঠানে দাঁড়িয়ে।

লজ্জায়, অপমানে তার চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার নিজেকে সালানে! এ মুহুর্তে তাকে উদ্দেশ করে কিছুটা শ্লেষ কণ্ঠে মুরুব্বীরা প্রায় সমস্বরে বললেন, “হায়রে মানিক্যার বাপ!”


লেখকঃ লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।
RSS
Follow by Email
Facebook
Twitter

আরও কিছু লেখা

Leave a Reply