তরুণ জুম্ম প্রজন্মের জুম বিমুখতা এবং সময়ের দাবীতে করণীয়
1202
পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক বিদ্যমান বাস্তবতার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে আমাদের জুম্ম তরুণ প্রজন্মের জানার ক্ষেত্রটা কতটুকু এবং জুমকে নিয়ে তাদের ভাবনাটা কেমন?
এ প্রশ্নের জবার খুজঁতে গিয়ে নেতিবাচকতার পাল্লাটা ভারী হবে নিশ্চয়ই, তবে আশার জায়গাগুলোও যে একেবারেই কম এবং সে ক্ষেত্রগুলো যে সম্প্রসারিত হচ্ছে না একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় না।
নব্বইয়ের দশকের শেষপ্রান্তে বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতীয় জীবনে নতুন আশা, স্বপ্নের বার্তা নিয়ে হাজারো তরুণ জুম্ম নাকবোঁচার রক্ত আর লাঞ্চনা-বঞ্চনা-নির্যাতনের লাল কালিতে লেখা
“পার্বত্য চুক্তি” নামক জুম্মদের অধিকার সম্বলিত খাতায় শাসকের সাথে যখন পাহাড়ের তের ভাষা-ভাষী চৌদ্দটি জুম্ম জনগোষ্ঠীর পক্ষে জুম্মদের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম এক অনন্য নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা – যিনি আদৌ জুমকে বাচাঁনোর স্বপ্নে বিভোর এক তরুণ) মুখে এক ঝলক হাসি আর
আশার স্বপ্ন নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করতে যাচ্ছেন তখনি পার্বত্য চট্টলার বুকে আমার জন্ম। ঐ সময়ের হয়ে মনে মনে গর্ববোধও করতে চাই কেননা জন্মটা আমার যে এক বীরের জাতিতে! যারা কিনা সদ্য এক রক্তাক্ত সংগ্রামের পথ পেরিয়ে শাসকদের বাধ্য করেছে চুক্তিতে উপনীত হতে!
জানিনা গর্বটা বৃথা কিনা (?) তবে এর জবাব না খুজেঁ খুজঁতে চাই আমার মত সেই রক্তাক্ত পথের শেষে যাদের জন্ম, সেই জুম্ম প্রজন্মের জুমকে নিয়ে ভাবনাটা কেমন এবং পাহাড়ের বর্তমান বাস্তবতার অতীত এবং ভবিষ্যত নিয়ে তাদের জানার ক্ষেত্রটা কতটুকু?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগটা হয়েছে তাই নিজেকে ধন্য মনে করি। কেননা, জীবনের এই প্রান্তে এসে অন্তত আমার বয়সী পার্বত্য চট্টগ্রামের নানা বন্ধু-বান্ধবীর সাথে মেশার সুযোগটুকু হয়েছে সেটা প্রত্যক্ষ বাস্তবতায় হোক কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণেই হোক।
তবে সবচেয়ে ধন্য মনে করি ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবার’ এর মত একটি বৃহৎ ও সমৃদ্ধ পরিবার পেয়ে যে পরিবারটি প্রতিনিয়ত জুমকে নিয়ে ভাবে আর জুমের দুঃখ ব্যথাগুলো ঘুচানোর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে নিয়ত।
যাক সে আলোচনায় না গিয়ে আমার ব্যাচ-এর (কেবল ঢাবির নয়) আমার বয়সীদের সাথে মেলামেশা, আড্ডার মধ্য দিয়ে আমাদের ভাবনার যে আলাপন চলে তার সূত্র ধরেই বলছি জুম্ম প্রজন্মেরর অধিকাংশই ‘জুম’ বিমূখ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের যে বিদ্যমান বাস্তবতা, তার ইতিহাস নিয়ে এদের অধিকাংশের মাথাব্যথা নেই বললেই চলে। পাহাড়ের উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং একেবারেই প্রান্তিক পরিবার থেকেই যারা উঠে এসেছে তাদের কারো না কারোর সাথে আমার পরিচয় হয়েছে, আড্ডা হয়েছে, আলাপন হয়েছে, মেলামেশা হয়েছে।
অধিকাংশই বড় কোনো বিসিএস ক্যাডার, সরকারী চাকর হওয়ার স্বপ্নে স্বপ্নবাজ। যারা সরকারী কোনো চাকরীর কোলে আশ্রয় খুজেঁ জীবনের নিরাপত্তার সুযোগ খুঁজে। স্বপ্ন দেখে বউ বাচ্চা নিয়ে বাঁচার।
কিন্তু আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধির জায়গা থেকে বলতে চাই যেখানে আমার স্বকীয়তার জায়গাটি নিরাপদ নয়, মাথা গুজাবার সেই পাহাড়ী মাচাং ঘরটি বন্য বর্বর জন্তুরা ভেঙে ফেলে ছুঁড়ে দিচ্ছে, আমার আপনার নিরীহ বোন ইতি’রা, ভাই রমেল’রা মারা যাচ্ছে,
রমেলদের লাশটুকু ওরা ওদের মত করে পুড়াচ্ছে, আমার লালন করা চর্চা করা ধর্মের প্রবর্তককে ওরা সন্ত্রাসী আখ্যা দিচ্ছে সেখানে আমার অনুভূতির পিদিমকে আমি কেন মৃত রেখেছি?
আমাদের রাজবাড়ীর ভিটেমাটি লুকিয়ে দিয়ে পাকিদের বাতি জ্বালানো সেই কাপ্তাই বাধেঁর কথা আমরা জানি। আমার নেত্রী কল্পনা অপহরণের খবর আমরা জানি, আমার বোন ইতি হত্যার কথা আমরা জানি, আমরা জানি কলমপতি, লোগাং, নান্যচর (নানিয়ারচর), লুংগুদু (লংগদু), মাল্যে গণহত্যা সহ আরো কত গণহত্যার কথা।
এইতো ইতি মরে গেলো আমাদের সামনে, রমেল চলে গেল আমাদের থেকে। আমাদের সামনেই তুমাসিং, সবিতা, সুজাতা, বলিমিলা….. বোনদের ন্যাক্কারজনক ঘটনার পর তাদের মৃত্যুর কথা জানি।
এত জেনেও তাহলে আমরা কোন শিক্ষিত বিবেকবান সেজে আমরা শাসকের গোলাম হয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে কথিত সুখে সুখী হতে চাই! জীবনের আশ্রয় খুজঁতে চাই ওদের হাতে! যাদের হাতে আমার ভাই-বোন-মা-বাবা-দাদা-দাদু’র প্রাণটা ঝরেছে?
আমরা উপরোক্ত সমস্যাগুলো নিয়ে মাথা ঘামাই না। কিন্তু কথিত ক্যাডার হয়েও আমার/আপনার সামনে আমার/আপনার মেয়েকে যখন ওরা ধর্ষণ করবে, আর আমার/আপনার মেয়ের বাচ্চাটি যখন আপনাকে “আজু”র পরিবর্তে “নানা” ডাকবে তখন কার কাছে আপনার ক্যাডারখানা উপস্থাপন করবেন গো ভাই?
রমেল চলে গেলো বিচার পাবো না জানি। তবুও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরগম হয়েছে রমেল হত্যার বিচারের দাবীতে জলপাই পোশাকধারীদের বিরুদ্ধে। ঠিক সেসময়ে জনৈক এক ব্যাচমেট পোষ্ট দিচ্ছে – রমেল হত্যার বিচারের দাবীতে দুইটা পোষ্ট শেয়ার করার পর তার শিক্ষিত মা-মামা বারণ করতেছে পোষ্ট শেয়ার না করতে। সরকারী চাকুরী পাবে না, ইনভেস্টিগেশনে ধরা খেয়ে যাবে। কেবল সে নয় পাহাড়ের অধিকাংশ পরিবারের ভাষ্যটা এমন।
তখনি বুঝে নিই সংকট খুব কাছে। পাহাড়ের অধিকাংশ সমাজ এবং পরিবারের তাদের প্রজন্মের কাছে চাহিদাটা কেমন যেন বিসিএস ক্যাডার, সরকারী চাকর বানানোর গন্ডি থেকে বের হতে পারছে না।
বরং তা বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে অধিকাংশ শিক্ষিত উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে বেড়ে ওঠারা বেশী জুম বিমুখ। চাকমা সমাজে একটা প্রবাদ মনে পড়ে যাই “পেদ ঠিগ, দুনিয়ে ঠিগ”। তার মানে কী উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরা বিলাসীতায় জীবন যাপন করে বলে ওরা জুম বিমুখ! পাহাড়ের কান্না কী ওদের ছুঁয়ে যায় না।
এইতো কিছুদিন আগে রাঙ্গামাটি শহরে এক উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে বেড়ে ওঠা এক ব্যাচম্যাটের সাথে জুম-পাহাড় নিয়ে ভাবনার আলাপনের এক পর্যায়ে জানতে পারলাম রাঙ্গামাটি শহরে বিগত বছর দু’এক আগে যে সাম্প্রদায়িক সহিংসহার ঘটনা ঘটল,
সে ঘটনার সময় জুম্মদের সোচ্চার ডাক “উজো…………উজো” শব্দ শুনে বন্ধুটি যখন যেতে চাইল তখনি তার পরিবার থেকে বারণ আসে – “যেওনা……যাওয়ার মানুষ আছে”।
আমি বলছি না ওখানে যেতে দিলেই জুম পাহাড়ের সমস্যার সমাধান। কিন্তু ঐ বারণটাই যে ম্যাসেজ দিচ্ছে আমরা আমার সন্তানকে পাহাড়ের সমস্যা থেকে দূরে রাখছি। আর অধিকাংশ পরিবারই দূরে রাখতে চাই। এটাই বাস্তব।
তার মানে আমরা কেবলই অন্যের দিকে তর্জনী নির্দেশ করতে অগ্রগামী। কিন্তু তর্জনীটা নিজের দিকে তাক করতে অাগ্রহী নই।কিন্তু দেখেন বন্ধুরা মার্টিন নেমলার একটা কবিতা, যার মর্মার্থ বুঝে নেয়া জরুরী হয়ে পড়েছে –
যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিলো,
আমি কোন কথা বলিনি,
কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।
তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল,
আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি শ্রমিক নই।
তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে,
আমি তখনও চুপ করে ছিলাম,
কারণ আমি ইহুদি নই।
আবারও আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে,
আমি টু শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,
কারণ আমি ক্যাথলিক নই।
শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোন কথা বলল না,
কারণ, কথা বলার মত তখন আর
কেউ বেঁচে ছিল না।
-মার্টিন নেমলার
এছাড়া বাস্তব অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে বলছি – সাজেক কাঁদছে, নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে। চেয়ারম্যান, মেম্বারদের ওঠানো তহবিলে চাউল বিতরণ হয়েছে।
পাহাড়ের এক অনলাইন নিউজের বরাতে জানতে পারলাম ১০ কেজি চাউলের জন্য মানুষ নয় মাইল হেটেঁ গেছে। দেখেন সাজেককে পুঁজি করে ওরা কত টাকা কামাই করলো অথচ আমরা আমাদের ভূমিতেই দুর্ভিক্ষের শিকারে দশ কেজি চাউলের জন্য হাটছি নয় মাইল।
এ নয় মাইল হাঁটা লোকেরা অনেক কেঁদেছে সাজেক বাঁচানোর জন্য, কিন্তু ওদের চোখের জলের কুঠুরি শুকিয়ে গেছে বন্ধু।
পাহাড় কাঁদে, জুম কাঁদছে। তবুও আমাদের বিবেক নড়ে না। কপালে ভাঁজ পড়ে না। আসলে পারবো কী পাহাড়কে একপেশে রেখে, জুমঘরের কান্নাকে পাশ কাটিয়ে বিলাসী জীবনে কথিত ক্যাডার হয়ে আমাদের জীবনকে যাপন করতে? একেবারেই না।
বন্ধুরা ঐ যে আমাদের সম্প্রীতির বান্দরবানে ‘উপজাতীয় মুসলিম ছাত্রাবাস’ যাত্রা শুরু করেছে!! কিছুদিন পর আমার মত একঝাঁক নাকবোঁচা দেখামাত্র বলবে ‘আস্লামুআলাইকুম’! খুব ভালো লাগবে তাইনা জুম্ম বন্ধুরা।
কাজেই আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হবে। সময় অনেক গড়িয়ে গেছে। দেয়ালে তো পিঠ অনেক আগেই ঠেকে গেছে। চুক্তির মাধ্যমে পাওয়া কোটা সুবিধার মাধ্যমে সেই ‘৯৮ থেকেতো অনেক পাহাড়ী নানা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে নানা ক্যাডার হয়েছে,
সরকারের চাকর হয়েছে, আধো হচ্ছে কিন্তু পাহাড়ের কান্নাতো কমে না, বরং বেড়েই চলেছে। তাহলে আসুন না আমরা আমাদের স্বপ্নের মধ্যে পাহাড়কে জুড়ে দিই। পাহাড়ের কান্নায় কেদেঁ উঠি সবাই।
আমরা আমাদের অবিসংবাদিত নেতা এম.এন লারমার ডাক শুনি…. পড়ালেখা শেষ করে আদামে ফিরে চলি। শুনবেন কী?
নাকবোঁচা বন্ধুরা আসুননা আমাদের স্বপ্নকে পাল্টাই। সময় এসেছে BCS কে না বলি, মোনঘরে শিক্ষকতা করি।
অসংখ্য মোনঘর গড়ে তুলি পাহাড়ে। যেখানে ফিরে পাবো পাহাড়-জুম’কে। আর সেখানেই জীবনের স্বার্থকতা খুঁজি। সময়ের দাবীকে সঙ্গে নিয়ে আমরা আমাদের সমীকরণের সমাধান খুঁজি।
লেখক : সতেজ চাকমা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।