ত্রিপুরারা কেন দেশ ছেড়েছিলেন
1425
১.
নানা কারণে কেউ দেশ ছাড়ে। নিরুদ্দেশ হয়। কখনো স্বেচ্ছায়, কখনো বাধ্য হয়। সম্প্রতি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্যপ্রাণী অভয়রাণ্য থেকে দুম করেই অনেক মানুষ একসাথে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন। ঘটনাটি বিস্ময়কর ও নিদারুণ।
২০১৬ সনের ২৫ জুন রেমা-কালেঙ্গা বনের আদি বাসিন্দা প্রায় ১৮৭ জন ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষ নিজ দেশ ছেড়ে নিরুদ্দেশ হতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের সহায়তায় ত্রিপুরা রাজ্য থেকে ১৬৮ জনকে ফিরিয়ে আনে (সূত্র: প্রথম আলো, ২৭ জুন ২০১৬)।
সার্বভৌম কোনো রাষ্ট্রের ভিত কাঁপিয়ে দেয়া এ নির্মম নিরুদ্দেশ নিয়ে খুব একটা আলাপ বাহাস জমেনি। একটি মিছিল কী এক টুকরো প্রতিবাদলিপিও দেয়নি কেউ। কারণ এরপর জঙ্গী হামলা আর ঈদের লম্বা ছুটিতে নিমগ্ন হয়ে যায় দেশ।
রেমা-কালেঙ্গা বনের ত্রিপুরাদের কেন দেশ ছাড়তে হয়েছিল এই প্রশ্নটি অমীমাংসিতই থেকে যায়। এমনকি জারি আছে নিরুদ্দেশ হওয়ার অন্যায় বাহাদুরি।
২.
দেশে গরিষ্ঠভাগ বাঙালিরাই মনে করে ত্রিপুরা জাতি বসবাস পার্বত্য চট্টগ্রামেই। এমনকি এই জাতির নামের সাথে ভারতের একটি রাজ্যের নামের মিল থাকায় অনেকে ত্রিপুরা রাজ্যের অধিবাসী হিসেবে আদিবাসী ত্রিপুরাদের গুলিয়ে ফেলেন।
কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়; হবিগঞ্জ, মৌলভী বাজার, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, চাঁদপুরে ত্রিপুরাদের ঐতিহাসিক বসবাস। কুমিল্লা থেকে মৌলভী বাজার পর্যন্ত সীমান্তবর্তী পাহাড়ি টিলা অঞ্চল একটা সময়ে ত্রিপুরাদের ছিল।
কিন্তু এই কী প্রথম জন্মমাটি ছেড়ে দলে দলে ত্রিপুরারা দেশ ছেড়েছেন? নিশ্চয়ই নয়। ষাটের দশকে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য এক লাখ পাহাড়ের আদিবাসী উদ্বাস্তু ও নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন।
চাকমা, মারমা, তঞ্চংগ্যা, পাংখোয়াদের মত ত্রিপুরাদের গ্রাম বসতি সব তলিয়ে যায়। আমরা সেই নিরুদ্দেশের কাহিনি এখানে টানছি না। ধরে নিচ্ছি উপনিবেশিক রাষ্ট্র ঐ জুলুম চালিয়েছিল।
কিন’ ২০১৩ কিংবা ২০১৬? ২০১৩ সনের ৩ আগষ্ট খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা উপজেলার তাইন্দং ইউনিয়নের তাইন্দং, বান্দরশিং পাড়া, সর্বেশ্বও পাড়া, বগা পাড়া, তালুকদার পাড়া থেকে ত্রিপুরারা নিরুদ্দেশ হতে বাধ্য হন।
কারণ অভিবাসিত বাঙালিরা ত্রিপুরাদের বসতিতে হামলা চালিয়ে তাদের উচ্ছেদ করে। পরের দিন বাংলাদেশ সরকার ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে নিরুদ্দেশ নাগরিকদের ফিরিয়ে আনে।
এবার হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বন থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া ত্রিপুরাদের ফিরিয়ে আনে বিজিবি। খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা ও হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বাংলাদেশের মানচিত্রে বহুদূরের অঞ্চল এবং উভয়েই উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তঘেঁষা।
কিন্তু দুটি ভিন্ন সময়ে দুটি ভিন্ন অঞ্চল থেকে ত্রিপুরাদের নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনায় একটা বিষয় স্পষ্ট রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সকল জাতির প্রতি সমানভাবে সংবেদনশীল নয়। এমনকি তথাকথিত জাত্যাভিমান ত্রিপুরা জাতিদের দেখে ‘ত্রিপুরা রাজ্যের’ মানুষ হিসেবেই।
এই বর্ণবাদী মনস্তত্ত্বই ত্রিপুরাদের করুণ উচ্ছেদ বা নিরুদ্দেশের তলকে বৈধ করে বারবার। মাটিরাঙা থেকে রেমা-কালেঙ্গা অবধি। উভয় ঘটনাতেই দেখা যায় ত্রিপুরারা স্বেচ্ছায় উচ্ছেদ বা নিরুদ্দেশ হননি।
দীর্ঘসময়ের বনবিভাগীয় নিপীড়িন এবং বাঙালি নির্যাতনের ধকল না সামলাতে পেরে তারা সকলেই নিরুদ্দেশ হতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ রাষ্ট্র, বিচারব্যবস্থা, আইন কী প্রশাসন কেউ ত্রিপুরাদের পাশে দাঁড়ায়নি।
ত্রিপুরাদের বুকে জমে ওঠা দীর্ঘ অভিমান ছুঁয়ে দেখার সাহস করেনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। ২০১৩ সনের ঘটনার ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়নি বলেই, আজ তিন বছর পর আবারো ত্রিপুরাদের নিরুদ্দেশ হতে হয়।
নিশ্চিতভাবে রেমা-কালেঙ্গা বনের ত্রিপুরাদের এই নিষ্ঠুর নিরুদ্দেশের কথাও বেমালুম বিস্মৃত হবে রাষ্ট্র। বনবিভাগসহ যারা এই অন্যায় নিপীড়নের সাথে জড়িত তাদের বিচার হবে না কোনোদিন।
বনবিভাগ, অভিবাসিত বাঙালি কী বিচারহীনতার সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে ত্রিপুরাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি টিকিয়ে রাখবে রাষ্ট্র। হয়তোবা আবারও মাটিরাঙা বা রেমা-কালেঙ্গা না হোক, সাতছড়ি বা ডলুবাড়ি বা পানছড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হতে হবে ত্রিপুরাদের।
আবারো রাষ্ট্র নির্লজ্জের মত নিরুদ্দেশ হওয়া নাগরিকদের ‘উদ্ধার’ করে আনার সফল কাহিনী তৈরি করবে। কিন্তু এভাবে এক একজন ত্রিপুরা শিশুর মনে তার মাতৃভূমির কী রূপ বিকশিত হচ্ছে, তা কী রাষ্ট্র একবারও ভাববে না?
দীর্ঘ অত্যাচার ও নির্যাতনে কাহিল হয়ে যে ত্রিপুরা শিশু ঘর ছাড়ে তার বুকে কী জমে আছে? তাকে ‘উদ্ধার’ করে নিজ দেশে ফিরিয়ে আনা হলেও রাষ্ট্র সুরক্ষিত করে না তার জীবনের নিরাপত্তা।
ত্রিপুরা শিশুর কাছে তার নিজ মাতৃভূমি যেন এক দম বন্ধ গরাদ বা চিড়িয়াখানা। জীবনের দম বাঁচাতে খাঁচা ছাড়লে আবারও খাঁচায় এনে ভরবে কেউ। নিরুদ্দেশ হতে বাধ্য হওয়া ত্রিপুরা শিশুর কাছে এই প্রক্রিয়ার নামই ‘নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য’।
বনবিভাগ, অভিবাসিত বাঙালি ও রাষ্ট্রের জাত্যাভিমানী চরিত্র পাল্টাতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে প্রশ্ন করে ন্যায়বিচার সুরক্ষা করতে হবে। তা না হলে মাটিরাঙা কী রেমা-কালেঙ্গা বনের ত্রিপুরা শিশুর বুকে জমে থাকা করুণ অভিমান মুছবে না।
৩.
সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রাকৃতিক বন হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা। খাগড়াছড়ির পাবলাখালীর পর এটি দেশের বৃহত্তম বন্যপাণী অভয়ারণ্য। ১৯৮২ সনে একে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়।
প্রায় ৪৪৩৬.৭১ একর আয়তনের এই বনটি চরিত্রের দিক থেকে মিশ্র চিরহরিৎ। লজ্জাবতী বানর, উল্টোলেজি বানর, পাঁচ প্রজাতির কাঠবেড়ালী, চশমাপরা হনুমান, উল্লুক, বনরুই, মায়া হরিণ, মেছো বাঘ, সজারু, গন্ধগোকূল, শূকর, সাপ ও নানা জাতের পাখির আবাসস্থল এই বন।
মোট ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, ৭ প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে ভরপুর এই বন।
দেশের সর্ববৃহৎ শকুনের বিচরণস্থলও এই বন, এখানের ময়নাবিল এলাকায় প্রায় ৩৮টি শকুন পরিবারের বাস।
বন লাগোয়া চা বাগান, উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত, বিচ্ছিন্ন টিলাভূমি ও কিছু জলমগ্ন অঞ্চল বনের বৈশিষ্ট্যকেও করে তুলেছে অনন্য।
হবিগঞ্জ বনবিভাগের অধীন কালেঙ্গা ও রেমা বনবীটের এই অরণ্যে ঐতিহাসিকভাবেই বসবাস করছেন আদিবাসী ত্রিপুরা জাতির মানুষেরা।
ত্রিপুরাদের পাশাপাশি কিছু খাড়িয়া, ওরাঁও, মুন্ডা পরিবারও আছেন। তবে বর্তমানে ‘ফরেস্ট ভিলেজার’ হিসেবে বসতিস্থাপনকারী বাঙালিদের সংখ্যাই বেশি।
ত্রিপুরারা এ বনের আদি বাসিন্দা হলেও বনবিভাগ সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও অভয়ারণ্য ঘোষণার পর ১৯২৭ সনের উপনিবেশিক আইন অনুযায়ী বনবাসী ত্রিপুরাদের বানায় ফরেস্ট ভিলেজার।
আইন মতে প্রতি পরিবার দুই একর নিচু জমিন পায় টিলা জংলার পাদদেশে এবং দুই একর পাহাড়ি টিলা।
রেমা-কালেঙ্গা বনের আদিবাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও বনবিভাগ যখন ত্রিপুরাদের ‘ফরেস্ট ভিলেজার’ বানায় তখন নিজভূমিতে বন্দী দাস হয়ে ওঠে ত্রিপুরারা।
বনবিভাগ থেকে বরাদ্দকৃত জমিনে ধান আবাদ এবং পাহাড়ি টিলা জমিনে ফল ফলাদির গাছ লাগিয়ে তাও দিন চলে ত্রিপুরাদের।
ফরেষ্ট ভিলজার হওয়ার কারণে প্রতি পরিবার থেকে এক জনকে বনবিভাগের বনপ্রহরীদের সাথে বনে পাহারা দিতে হয়।
সকাল ৮ থেকে রাত ১০ কিংবা সন্ধ্যা ৭ থেকে সকাল ১০। নিজের লাগানো টিলা ভূমির গাছের উপর তাদের কোনো অধিকার নেই।
একটা সময় রেমা-কালেঙ্গা জুড়ে ত্রিপুরারা জুম আবাদ করতেন। বনবিভাগ ১৯৬৪ সনে জোর করে জুম বন্ধ করায়।
পরবর্তীতে নদীভাঙনে উদ্বাস্তু বাঙালিদের সুদূর নোয়াখালী থেকে টেনে আনে বনবিভাগ আশির দশকে।
নতুন এই অভিবাসিত বাঙালিদেরও ফরেস্ট ভিলেজার বানানো হয় এবং তাদের অনেকের মাধ্যমে বনবিভাগ গাছ চুরি থেকে শুরু করে বনজ সম্পদ লুটপাটের নয়া বাণিজ্য শুরু করে।
রেমা-কালেঙ্গা বনের আয়তন অসীম নয়, প্রাণসম্পদও তাই। আদিবাসিন্দা ত্রিপুরাদের সংখ্যা দিন দিন কমলেও ফরেস্ট ভিলেজার অভিবাসিত বাঙালিদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। ছোট্ট এক বনে আবাদি ভূমির সংকট দেখা দেয়।
বননির্ভর ত্রিপুরাদের জীবনধারায় তৈরি হয় অভিবাসিত বাঙালিদের সাথে নতুন সংঘাত। ত্রিপুরাদের জনসংখ্যা কমে বাঙালিরাই হয়ে ওঠে এখন রেমা-কালেঙ্গা বনের বৃহৎ জনগোষ্ঠী, তৈরি হয় জনমিতির আরেক দ্বন্দ্ব।
ত্রিপুরারা জান দিয়ে রেমা-কালেঙ্গা বনের সুরক্ষা চায়। বনবিভাগ ও অভিবাসিত বাঙালিদের লুটপাট ও অন্যায় কাজে প্রশ্ন করে। এ নিয়ে ত্রিপুরাদের সাথে দ্বন্দ্ব চলমান। বনবিভাগ কী বাঙালি বাহাদুরি যেন রেমা-কালেঙ্গা বনে এক হয়ে আছে।
হরহামেশাই ত্রিপুরাদের ঘরদুয়ারে হামলা হয়, বিতন্ডা হয়, নানা ধরণের হয়রানি, চুরি ছিনতাই। এমনসব ধকলের সাথে আবার যুক্ত হয় মার্কিন কর্পোরেট পর্যটন প্রকল্প নিসর্গ ও ক্রেল।
সব দিক থেকেই নিজের অরণ্যে অচিন মানুষ হতে থাকে ত্রিপুরারা। তারপরও ত্রিপুরারা রেমা-কালেঙ্গার জল-মাটি আঁকড়ে বাঁচতে চায়। কারণ রেমা-কালেঙ্গা বন এবং কোরাঙ্গী নদী ত্রিপুরাদের কাছে পবিত্র বনভূমি অঞ্চল।
এখানকার ত্রিপুরারা বিশ্বাস করেন এই বন তাদের জন্ম ও মৃত্যুর ঠিকানা। এখানে তাদের যুগ যুগ ধরে তাদের বহুবংশের পূর্বজনদের স্মৃতি মিশে আছে। দুম করেই এই অরণ্য জীবন ফেলে তাদের নিরুদ্দেশ হওয়ার নীতি নেই।
কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ত্রিপুরাদের এই অরণ্যনীতি চুরমার হয়ে গেছে বনবিভাগ আর বাঙালিদের নিরন্তর কোণঠাসা আর দাবিয়ে রাখবার প্রক্রিয়ায়। ২০০৬ সনের জুন মাসে এক ব্যক্তিগত সমীক্ষায় রেমা-কালেঙ্গা বনে ত্রিপুরাদের সংখ্যা জানতে পারি প্রায় ১১০০।
নিদারুণভাবে গত দশ বছরে এই সংখ্যা মাত্র কয়েকশতে এসে ঠেকেছে। পুরানবাড়ি, মঙ্গলবাড়ি, কালিয়াবাড়ি, ডেবরাবাড়ি, ছনবাড়ি, গরমছড়ি রেমা-কালেঙ্গা বনের এই প্রাচীন ত্রিপুরা গ্রামগুলি কী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে?
৪.
২৫ জুন রেমা-কালেঙ্গা বনের ত্রিপুরারা কেন দেশ ছেড়েছিলেন? এ বিষয়ে গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে চুনারুঘাটের রানীগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান জানিয়েছেন, বন কর্মকর্তরা ত্রিপুরাদের অনেক সময় নির্যাতন করে।
বন কর্মকর্তাদের লাগাতার অত্যাচারে ও অপমানে অতিষ্ট হয়েই ত্রিপুরা ও খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
দেশত্যাগ করতে বাধ্য হওয়া এবং ফেরত আসা ত্রিপুরারা জানান, বনবিভাগ তাদের উচ্ছেদের ভয় দেখায়, জমি ছেড়ে চলে যেতে বলে এবং তাদের গ্রামে বাঙালি সেটেলারদের এনে তোলার হুকমি দেয়।
এরকম পরিস্থিতিতে ২০১৬ সনের ২৪ জুন বনবিভাগ ত্রিপুরাদের জায়গা জমি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য আবারো ধমক দেয়। এ নিয়ে ত্রিপুরাদের সাথে বনবিভাগের কর্মীদের বিতন্ডা হয় এবং একপর্যায়ে বনবিভাগ ৪ জন ত্রিপুরা পুরুষকে পুলিশে সোপর্দ করে।
বাধ্য হয়েই পরের দিন ত্রিপুরারা নিজ দেশ ছেড়ে নিরুদ্দেশ হন। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই জেলায় চম্পাহোয়ার গ্রামে তাদের আশ্রয়প্রার্থী হয়ে বসে থাকতে দেখে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিষয়টির ফায়সালা করে।
কিন্তু এ ঘটনায় এখনও কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি, নিশ্চিত হয়নি ত্রিপুরাদের জীবনের সুরক্ষা। পুরো বিষয়টিই প্রশ্নহীন ও বিচারহীন থেকে গেছে। বিজিবির ৫৫ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্ণেল সাজ্জাদ হোসেন এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে জানান, ত্রিপুরাদের এভাবে বিএসএফের কাছে যাওয়ার পিছনে অন্য কারও ইন্ধন থাকতে পারে।
বিষয়টি নিয়ে তারা চেয়ারম্যান, মেম্বার বা পুলিশের কাছে যেতে পারতো। কিন্তু রেমা-কালেঙ্গা বনের ত্রিপুরারা কখনোই স্থানীয় সরকার বা জনপ্রতিনিধিকে তাদের পাশে পাননি। গড়ে ওঠেনি কোনো বিশ্বাস ও নির্ভরতার সম্পর্ক।
রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে নিপীড়ন কত চরমে ওঠলে মানুষ তার প্রিয় জন্মস্থল ও পবিত্র অরণ্য ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। কেবল বনবিভাগ নয়, স্থানীয় সরকার বিভাগও চায় না রেমা-কালেঙ্গার আদি বাসিন্দা ত্রিপুরারা নিজ দেশে থাকুক।
চুনারুঘাটের রানীগাঁও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তাদের সকলেই ত্রিপুরায় থাকে তাই তারা সেখানে চলে যেতে চায়। বনবিভাগ থেকে স্থানীয় সরকার যেন সকলেই মনে করে এই দেশ ত্রিপুরাদের নয়, এই জংগলে তাদের কোনো অধিকার নেই।
বৈষম্যমূলক এই মনস্তত্ত্ব বদলাতে হবে, ভেঙে চুরমার করে দিতে হবে। বনবিভাগ কী স্থানীয় সরকার বা সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে সকলের প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠতে হবে।
৫.
রেমা-কালেঙ্গা বনের ধারে কাছে বিদ্যালয়, চিকিৎসালয় বা সুবিধাজনক হাটবাজারও নেই। বনপাহারা দেয়া ছাড়া কৃষিকাজ আর বাঁশের চাঁচ তৈরি করেই জীবন চলে ত্রিপুরাদের। যুগ যুগ ধরে ত্রিপুরাসহ অপরাপর আদিবাসীরা আগলে আছেন এই বন।
দৈনিক বণিক বার্তাকে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জানান, বনের ভেতর স্কুল ও হাসপাতাল স্থাপন করা সম্ভব নয়, তাই ফরেস্ট ভিলেজারদের বনের বাইরে এনে পুনর্বাসন প্রকল্প তৈরি করছে বনবিভাগ।
নিজস্ব বাড়িসহ প্রতি পরিবার পাবে ৪ লাখ করে টাকা। বহিরাগত বাঙালি ফরেস্ট ভিলেজারদের জন্য এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হওয়া যতখানি সহজ, ততখানিই জটিল ত্রিপুরাসহ রেমা-কালেঙ্গা বনের আদিবাসীদের।
কারণ এই অরণ্য জীবন ঘিরেই গড়ে ওঠেছে ত্রিপুরা মনোজগত ও জীবন দর্শন। রাষ্ট্রকে বন নির্ভর আদিবাসী জীবনের অরণ্য বিজ্ঞান ও দর্শন বুঝতে হবে। দুম করেই বন থেকে জোর করে কাউকে বিচ্ছিন্ন করে এনে পুনর্বাসন করলেই জীবনের বিকাশ গতি পাবে না।
বনবিভাগকে ত্রিপুরাসহ রেমা-কালেঙ্গা বনের আদিবাসীদের সাথে বসতে হবে। তাদের বনবিজ্ঞান ও অরণ্য দর্শন সম্পর্কে জানতে হবে। এই অরণ্য বাঁচিয়ে রাখার জন্য ত্রিপুরাদের নিরন্তর সংগ্রামকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
পাশাপাশি বনবিভাগ, বাঙালি কী স্থানীয় সরকার সকলকেই বর্ণবাদী আচরণ পাল্টাতে হবে। ত্রিপুরাদের সাম্প্রতিক এই নিরুদ্দেশ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
গাছ, বনরুই, শকুন, বনবাসী আদিবাসী মানুষ, বানর, কাঠবেড়ালী, কোরাঙ্গী নদী সব নিয়েই তো রেমা-কালেঙ্গা বনের জীবন।
জীবনের এই জটিল শৃংখলার প্রতি নতজানু হতে হবে। এদের কাউকে আঘাত করে, তাড়িয়ে দিয়ে নয়, সকলকে নিয়েই বিকশিত হোক রেমা-কালেঙ্গার অরণ্য সভ্যতা।
লেখক : পাভেল পার্থ, গবেষক। ই-মেইল: animistbangla@gmail.com
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।