শেকড়ের সন্ধানে : রাজমালার আলোকে ত্রিপুরার উৎপত্তির ইতিহাস
1456
বিশ্বব্যাপী মহামারী আকার ধারণ করা অদৃশ্য শক্তি ‘কোভিড-১৯’ এর বিরুদ্ধে বর্তমান যুদ্ধকালীন সময়ে পুরো বিশ্বের প্রতিটি নাগরিকই এখন এক একজন যোদ্ধা।
হ্যাঁ, হয়তোবা কেউ যুদ্ধ করছেন সম্মুখ সমরে আবার কেউবা বাড়িতে অবস্থান করে। তফাৎটা শুধু এইটুকুতেই।
আর বাড়িতে বসে থাকার সময়টাকে আমরা যদি এই ‘কোভিড-১৯’ বিষয়ের বাইয়ে গিয়ে একটু নিজের মতো ভাবি তাহলে কেমন হয়?
আর সেই ভাবনায় যদি এসে যায় নিজের শেকড়, তাহলে নিশ্চয় ভাল লাগারই কথা। তাই এমনই এক শেকড় বিষয়ক “রাজমালার আলোকে ত্রিপুরার উৎপত্তির ইতিহাস” বিয়য়ক আলোচনা আমার আজকের ক্ষুদ্র প্রয়াস।
তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনাদের অসাধারণ মন্তব্যগুলোই আমার এই আলোচনাকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করবে।
“আমরা বারংবার বলিয়াছি, ত্রিপুর রাজবংশ অতি প্রাচীন এরূপ প্রাচীন বংশ ভারতে দ্বিতীয় নাই।”
ত্রিপুরার প্রখ্যাত রাজমালা প্রনেতা শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহ যখন তাঁর ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ গ্রন্থের উপক্রমিকার চতুর্থ অধ্যায়ে ত্রিপুরা সম্পর্কে এমন উক্তি করেন তখন স্বাভাবিকভাবে যে কোন ত্রিপুরার বুক গর্বে ভরে যাওয়ার কথা।
কারণ এমন গৌরবান্বিত মহিমা কয়টি জাতিরইবা থাকে। তখন এমন প্রাচীন রাজবংশের উৎপত্তি কিভাবে হল? ত্রিপুরা নামইবা কিভাবে এল? এমন প্রশ্নগুলো বারংবার তাড়িত করতে থাকে আমার এই অনুসন্ধিৎসু মনটাকে।
আসলে, পৃথিবীর কোন সমাজ, সভ্যতা বা সংস্কৃতি তাৎক্ষণিকভাবে এক দিনে গড়ে উঠেনা। সবকিছুর থাকে এক একটি সংগ্রামী ইতিহাস।
আর এ উৎপত্তির ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেক গবেষক ও ইতিহাসবেত্তাগণ বারংবার হোচৎ খাওয়া সত্বেও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও আবিস্কারের নেশায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন বিভিন্ন গবেষণা কর্মে।
যার ফলশ্রুতিতে আমরা আজ অনায়াসে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ইতিহাস জানতে সমর্থ হয়েছি।
ঠিক তেমনি ভারতীয় উপমহাদেশের একটি প্রাচীন জাতি ত্রিপুরাদেরও রয়েছে তেমনই উৎপত্তির ইতিহাস, যার লিখিত ইতিহাস রচনা শুরু হয়েছিল ‘রাজরত্নাকর’ বা ‘রাজমালা’র মাধ্যমে।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য, প্রচীন ও মধ্যযুগে এ ত্রিপুরা রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল ব্যাপক। তাই বর্তমান বাংলাদেশের অনেক ভূখন্ডই তৎকালীন ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল, এতে কোন সন্দেহ নেই।
তাই বলতে কোন দ্বিধা নেই যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ত্রিপুরাদের স্থায়ী বসবাস সুপ্রাচীনকাল থেকেই পাকাপোক্ত।
যেমন, অদ্যাবধি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ছাড়াও বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা (পূর্ব নাম ত্রিপুরা), চাঁদপুর, সিলেট ও রাজবাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে ত্রিপুরারা ।
তাই ত্রিপুরাদের সংস্কৃতিতে পাহাড় এবং সমতলের সংস্কৃতির নিবিড় আলিঙ্গন বেশ লক্ষনীয়।
এখন রাজমালা কি এবং রাজমালায় ‘ত্রিপুরা’ জাতির উৎপত্তি বিষয়ে কি কি উল্লেখ রয়েছে সেটিই আলোচনার মূখ্য বিষয়।
একটি বিষয়ে আমরা কম বেশি সকলেই অবগত যে ‘রাজমালা’ নামক গ্রন্থেই পদ্যাকারে জায়গা করে নিয়েছে ত্রিপুরা রাজ্যের অধিকাংশ রাজার কাহিনীগুলো।
যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও পরিলক্ষিত হয়। তবে এই রাজমালা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামও ধারণ করেছে। যেমন কখনও রাজরত্নাকর, কখনও রাজমালা আবার কখনও কৃষ্ণমালা ইত্যাদি।
তাই ত্রিপুরা রাজন্যবর্গের ইতিহাস লেখার অধিকাংশ তথ্যের যোগানদাতা এই রাজমালা গ্রন্থটি। এখানে একটি কথা পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার যে, মূল রাজমালা কিন্তু বর্তমানে সহজলভ্য নয়।
কালের গর্ভে এমন মহা মূল্যবান গ্রন্থটি হারিয়ে যাওয়ার আবছা ইতিহাসটাও বেশ রহস্যজনক।
কথিত আছে, প্রাচীনকালে ত্রিপুরা রাজাদের ইতিহাস সংরক্ষণ করার জন্য ককবরক বা ত্রিপুরা ভাষায় কলমা বা কোলোমা লিপিতে দুর্লবেন্দ্র চোনতাই লিপিবদ্ধ করেছিলেন ‘রাজরত্নাকর’ নামক একটি গ্রন্থ।
পরবর্তীতে শুক্রেশ্বর ও বাণেশ্বর নামের দুই ব্রাহ্মণ সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করেন এবং পরবর্তীতে সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা হয়।
পূর্বের রাজমালা যে ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়েছিল তার ঐতিহাসিক প্রমাণ ‘শ্রী রাজমালা’র দ্বিতীয় লহরের ধর্ম মাণিক্য খন্ডের ৬ নং পৃষ্ঠায় নিম্নরূপ সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে-
“পূর্ব রাজমালা ছিল ত্রিপুর ভাষাতে।পয়ার গাথিল সব সকলে বুঝিতে॥সুভাষাতে ধর্ম্মরাজে রাজমালা কৈল।রাজমালা বলিয়া লোকেতে নাম হৈল”
অর্থাৎ ত্রিপুর ভাষার রাজমালাটিকে অন্যভাষী বিশেষ করে বাংলা ভাষাভাষীদের বুঝার সুবিধার্থে অনুবাদ করা হয়েছে।
তবে কৈলাস বাবু, কালীপ্রসন্ন বাবু ও ভূপেন্দ্রচন্দ্র বাবু সহ যাঁরাই রাজমালা লেখার চেষ্টা করুক না কেন তাঁদের বিভিন্ন গ্রন্থের উপর নির্ভরশীলতা থেকে কম-বেশি অনুমেয় যে, মূল রাজমালার অনেক অংশই বর্তমান রাজমালাতে স্থান পায়নি অথবা বর্তমান রাজমালার অনেক অংশই মূল রাজমালাতে ছিল না।
যাহোক, শ্রীকালীপ্রসন্ন সিংহ বিদ্যাভূষণও রাজন্যবর্গের ইতিহাস সম্পাদনা করতে গিয়ে রাজমালাসহ আরো অন্যান্য গ্রন্থের উপর নির্ভর করেছিলেন। তার সম্পাদিত রাজমালার রচনা শুরু হয়েছিল মূলত মহারাজা ধর্মমাণিক্যের শাসনামল থেকে।
রাজমালা মোট ৬ টি লহরে বিভক্ত। যথা: প্রথম লহর, দ্বিতীয় লহর, তৃতীয় লহর, চতুর্থ লহর, পঞ্চম লহর ও ষষ্ঠ লহর।
প্রথম লহরের বিষয় ছিল দৈত থেকে মহামাণিক্য পর্যন্ত বিবরণ। উক্ত লহরের বক্তা ছিলেন বাণেশ্বর, শুক্রেশ্বর ও দুর্ল্লভেন্দ্র নারায়ণ এবং শ্রোতা ছিলেন মহারাজ ধর্ম্যমাণিক্য। রচনাকাল ধরা হয় পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে।
দ্বিতীয় লহরের বিষয় ছিল ধর্ম্মমাণিক্য থেকে জয়মাণিক্য পর্যন্ত বিবরণ । এই লহরের বক্তা ছিলেন রণচতুর নারায়ণ। উক্ত লহরের শ্রোতা মহারাজা অমরমাণিক্য। এই লহরের রচনাকাল ছিল খৃ: ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগ।
তৃতীয় লহরের বিষয় ছিল অমরমাণিক্য থেকে কল্যাণমাণিক্য পর্যন্ত বিবরণ। উক্ত লহরের বক্তা ছিলেন রাজমন্ত্রী, শ্রোতা ছিলেন মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য এবং এই লহরের রচনাকাল ছিল খৃ: অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ।
চতুর্থ লহরের বিবষয় ছিল গোবিন্দমাণিক্য থেকে কৃষ্ণমাণিক্য পর্যন্ত বিবরণ। বক্তা ছিলেন জয়দেব উজীর এবং শ্রোতা ছিলেন মহারাজ রামগঙ্গামাণিক্য। উক্ত লহরের রচনাকাল ছিল খৃ: অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ।
পঞ্চম লহরের বিষয় ছিল রাজধরমাণিক্য থেকে রামগঙ্গামাণিক্য পর্যন্ত বিবরণ। বক্তা ছিলেন দুর্গামণি উজীর এবং শ্রোতা ছিলেন মহারাজা কাশীচন্দ্রমাণিক্য। এই লহরের রচনাকাল ছিল খৃ: উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে।
ষষ্ঠ লহরের বিষয় ছিল রামগঙ্গামাণিক্য থেকে কাশীচন্দ্রমাণিক্য পর্যন্ত বিবরণ। উক্ত লহরের বক্তা ছিলেন দুর্গামণি উজীর এবং শ্রোতা ছিলেন মহারাজা কৃষ্ণকিশোরমাণিক্য। এই লহরের রচনাকাল ছিল খৃ: উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে।
শ্রীকালীপ্রসন্ন সিংহ বিদ্যাভূষণ কর্তৃক সম্পাদিত রাজমালাতে মহারাজা কৃষ্ণকিশোরমাণিক্যর পরের রাজাদের বিষয়ে আর তেমন কিছু জানার সুযোগ থাকে না।
কৈলাসচন্দ্র বাবুর ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ গ্রন্থেও বীরচন্দ্রের পরবর্তী রাজন্যবর্গ সম্পর্কে খুব বেশি লেখা নেই। তবে ভূপেন্দ্র চন্দ্র বাবু লেখার চেষ্টা করেছেন ত্রিপুরার শেষ স্বাধীন মহারাজার সময়কাল অবধি।
তবে ত্রিপুরা রাজন্যবর্গের ইতিহাস যাঁরাই লিখার চেষ্টা করুক না কেন কম বেশি সকলেই ত্রিপুরার উৎপত্তি নিয়ে ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করেছেন যা আমার ‘রাজমালার আলোকে ত্রিপুরার উৎপত্তির ইতিহাস’ বিষয়ে আলোচনায় অনেক সহায়তা করবে বলে আমার বিশ্বাস।
আর আমার আজকের আলোচনার বিষয় রাজমালা না হলেও উপরোক্ত আলোচনাটি টানলাম এই কারণে যে, রাজমালা সম্বন্ধে এমন কিঞ্চিৎ পরিমাণ ধারণা পরবর্তী আলোচনায় অংশগ্রহণে অনেক বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
‘রাজমালা’ নিয়ে ইতিপূর্বের পোস্টে বেশ কিছু বিষয় আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু আলোচনায় এ সম্পর্কিত আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপেক্ষিত রয়ে গেছে বিধায় আরেকটু আলোচনার প্রয়োজনবোধ করছি।
আচ্ছা, একটু কল্পনাশক্তি দিয়ে ভেবে দেখুনতো, ত্রিপুরা মহারাজাগণের রাজ্য শাসনের অতীত ঘটনাগুলো যখন কোন এক সুতো দিয়ে একটি মালা আকারে গাঁথা হয়, তাহলে কেমন হবে? আবার তা যদি হয় ঠিক সাদা, লাল, হলুদ ববেগুনি পুষ্পমাল্যের মতো?
সত্যিই অপূর্ব সুন্দর মনে হবে তাই না? হ্যা, আমার কাছে ত্রিপুরা অধিপতিদের পদ্যাকারে নান্দনিক এই ধারাবাহিক সুবিন্যস্ত ঘটনাগুলো তেমনই অসাধারণ একটি মালার মতোই মনে হয়।
হয়তোবা এই কারণেই রাজমালা গ্রন্থের প্রণেতাগণ মহারাজাগণের কাহিনীগুলোকে বিভিন্ন সর্গে, পর্বে অথবা লহরে সন্নিবেশিত করে নাম দিয়েছিলেন ‘রাজমালা’।
তবে এই রাজমালা সৃষ্টির কৃতিত্ত্ব কি সব মহারাজাগণকে দেওয়া যায়? না, এমন কৃতিত্বের অর্জন শুধুই মহারাজা ধর্ম্মমাণিক্যের।
কেননা, তাঁর পূর্বের ত্রিপুরা মহারাজাগণের মধ্যে কারোর মনে রাজাগণের ইতিহাস রচনার এমন অভূতপূর্ব সৃষ্টিশীল ভাবনার উদয় ঘটেছিল বলে আমার অন্তত মনে হয়না। অথবা হলেও তা কোনরূপ ফলাফল পরিলক্ষিত হয়নি।
তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ‘রাজমালা’ গ্রন্থ রচনা করানো মহারাজা ধর্ম্মমাণিক্যের শাসনামলের এক উজ্জল অবিনশ্বর কীর্তি।
এই মহারাজা ধর্ম্মমাণিক্য ছিলেন মহারাজা রত্নমাণিক্যের অধস্তন তৃতীয় পুরুষ। তিনি ছিলেন পবিত্রমনা, ধর্মপরায়ন ও করুণহৃদয়সম্পন্ন রাজা। মহারাজা ধর্ম্মমাণিক্য ত্রিপুরা নরপতিদের এই ইতিহাস রচনার ভার দিয়েছিলেন চতুর্দ্দশ দেবতার চন্তাই বা প্রধান পূজারী দুর্লভেন্দ্র চন্তাইকে।
দুর্লভেন্দ্র চন্তাই রচনার দায়ভার কাঁধে নিলেন। রচনায় পন্ডিত শুক্রেশ্বর ও বানেশ্বর ভাতৃদ্বয়ের অবদানও নিতান্ত কম নয়। প্রথম যে গ্রন্থটি প্রকাশ করা হয় তাঁর নাম দেওয়া হয় ‘রাজরত্নাকর’।
গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল ৮৬৮ ত্রিপুরাব্দ(১৪৫৮ খ্রি.) থেকে ৮৭২ ত্রিপুরাব্দ(১৪৬২ খ্রি.) সময়ের মধ্যে। কেননা মহারাজা ধর্ম্মদেব এর রাজত্ত্বকাল ছিল এই চার বছর।
তবে মহারাজা ধর্ম্মমাণিক্যের সময়ের প্রথম ও প্রাচীন রাজমালাটি বর্তমানে খুঁজে পাওয়াটা দুস্কর। কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে বললেও অত্যুক্তি না হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
প্রায় সকল পন্ডিতগণের মতে, ‘রাজরত্নাকর’ রচিত হয়েছিল ত্রিপুরা জাতির জাতীয় ভাষা ‘ত্রিপুর ভাষায়’(বর্তমানে এই ভাষাটি ককবরক বা ত্রিপুরা ভাষা হিসেবেই পরিচিত)।
‘শ্রীরাজরত্নাকরম্’ গ্রন্থের ভূমিকার চার নং পৃষ্ঠায় জ্যোতিষ নাথ(৩০/০৮/২০০২খ্রি.) ‘রাজরত্নাকরম’ এর প্রথম সর্গের কথা উল্লেখ করে বলেন-
“এই সর্গেই কথিত হয়েছে যে, চন্তায়ি দুর্লভেন্দ্র ত্রিপুরভাষায় আদিতম রাজরত্নাকরটি রচনা করেছিলেন। কালের ব্যবধানে এর অবলুপ্তি যে কোন কারণেই ঘটুক না কেন, এ কথা আজ ঐতিহাসিকভাবে প্রতিপাদনযোগ্য যে ত্রৈপুরভাষীদের প্রাচীনভাষাসংস্কৃতি একদিন নিজ অধিকারেই উত্তম সাহিত্যকৃতি রচনার শক্তি অর্জন করেছিল” (সূত্র: জ্যোতিষ নাথ, শ্রীরাজরত্নাকরম্, ২০০২ খ্রি.)।
আবার এই গ্রন্থটিকে সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে নাম দেওয়া হয় ‘রাজমালা’। এই সংস্কৃত বা বাংলা ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলোর উপর ভিত্তি করেই অধূনা রাজমালাগুলো সম্পাদিত হয়েছে।
তাই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বর্তমানে যেই ত্রিপুরার ইতিহাস লিখার প্রচেষ্টা করুক না কেন তাঁর রাজমালার আশ্রয় নেওয়াটা আবশ্যক।
আমি ত্রিপুরার উৎপত্তির ইতিহাস বিষয়টি আলোচনার জন্য যে রাজমালা বা গ্রন্থগুলোর আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেছি সেগুলোর পরিচিতি এবং ত্রিপুরার উৎপত্তির বিষয়টি কিভাবে উপস্থাপিত হয়েছে সেগুলোই আমার আলোচনার মূখ্য বিষয়।
তবে আজকে সবগুলো বিষয়ে বিশদভাবে আলোচনা করার সুযোগ না পেলেও পরবর্তী পর্বগুলোতে অবশ্যয় আলোচনার সুযোগ পাওয়া যাবে বলে আমি আশাবাদী।
তাই আজ আমি প্রথমেই আলোচনায় নিয়ে আসতে চাই শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহ প্রণীত ও শ্রীযোগেশচন্দ্র সিংহ কর্তৃক ১৩০৩ বঙ্গাব্দের(১৮৯৬খ্রি.) আশ্বিন মাসে প্রকাশিত ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ গ্রন্থটিকে।
যে গ্রন্থটি মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের সময়ে প্রণীত হয়েছিল। তিনি এই গ্রন্থে ত্রিপুরা রাজ্যকে ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন রাজ্য বলে আখ্যা দিয়েছেন। গ্রন্থের ভূমিকার শুরুতেই তিনি লিখেছেন-
“ত্রিপুরা ভারতবর্ষ মধ্যে একটী অতি প্রাচীন রাজ্য। সুবিখ্যাত গুপ্ত সম্রাটদিগের শিলালিপি পর্য্যালোচনা দ্বারা অনুমিত হইতেছে যে, মিবারও ইহার ন্যায় প্রাচীন নহে।”
কিন্তু কে এই কৈলাসচন্দ্র সিংহ? কিভাবে তিনি এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন? তাহলে একটু জেনে নেওয়া যাক।
শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহের জন্ম ১৮৫১ খ্রি. এবং মৃত্যু ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে কৈলাসচন্দ্র সিংহ এর খুল্লপিতামহ রায় রামপ্রসাদ সিংহ ছিলেন ত্রিপুরা রাজার অধীনন্ত এক রাজকর্মচারী।
কিন্তু নিজ গুণে গুণান্বিত এই রামপ্রসাদ বাবু পরবর্তীতে মহারাজা রাজধর মাণিক্যের প্রতিনিধি(আম-মোক্তার) নিযুক্ত হয়ে তৎকালীন জাহাঙ্গীর নগর অর্থাৎ বর্তমান ঢাকায় আজীবন কর্মরত ছিলেন।
তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পর তাঁর ছেলে অর্থাৎ শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহ এর পিতা রায় গোলকচন্দ্র সিংহ ১২৪০ বঙ্গাব্দে ত্রিপুরার রাজকার্যে যোগদান করেন। তিনি চাকুরী জীবনের অধিকাংশ সময় ছিলেন সেরেস্তাদার অর্থাৎ তৎকালীন ত্রিপুরার রাজস্ব বিভাগের প্রধান কর্মচারী।
পিতা ১২৭৩ বঙ্গাব্দে স্বর্গবাসী হওয়ার পর মাত্র ১৫ বছর বয়সে শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহ ত্রিপুরার রাজকার্যে কর্মজীবন শুরু করেন।
তবে রাজকার্যে মাত্র ৪ বছর কাজ করার পর তিনি পদত্যাগ করেন।
তাঁর এভাবে পদত্যাগের পেছনে যে কারণটি সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য ছিল মহারাজা ঈশানচন্দ্র মাণিক্যেরে একমাত্র জীবিত পুত্র কুমার নবদ্বীপচন্দ্র বাহাদুরের সাথে তৎকালীন মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের কলহ। কেননা শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহ পক্ষ নিয়েছিলেন কুমার নবদ্বীপের।
এমনকি বিভিন্ন জমিদারি, চাকলে রোশনাবাদে স্বীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির জন্য কুমার নবদ্বীপ ব্রিটিশ বিচারালয়ে শরনাপন্ন হওয়ার সময় মামলা মোকাবিলার সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন কৈলাস বাবু।
উল্লেখ্য, নবদ্বীপচন্দ্র ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ সচীন দেববর্মনের পিতা।
তৎকালীন সময়ে ত্রিপুরার ইতিহাস সম্পর্কিত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ কৈলাসচন্দ্র সিংহ সংগ্রহ করতে সমর্থ হন।
এমনকি ১২৮৩ বঙ্গাব্দে ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত’ নামক একটি পুস্তকও প্রকাশ করেন তিনি।
আর পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের পর সৃষ্টি করেন ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ নামক মহারাজাদের কাহিনীসম্বলিত একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ। (সূত্র: শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহ, রাজমালা ও ত্রিপুরার ইতিহাস, ১৩০৩ ত্রিপুরাব্দ )
শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহ তাঁর এই ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ গ্রন্থে ত্রিপুরার উৎপত্তি নিয়ে যে আলোচনাটি করেছেন তা খুবই যৌক্তিক এবং তথ্যসমৃদ্ধ ।
এমনকি ত্রিপুরা রাজবংশের গৌরবময় অধ্যায়গুলো তিনি অত্যন্ত সুচারুরূপে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন তাঁর এই গ্রন্থে।
তবে বিষাদের সময়গুলোও এড়িয়ে যাননি তিনি। লিখেছেন নিখুঁত ভঙ্গিমায়। বারংবার ত্রিপুরা জাতির কথা তুলে ধরেছেন নিবিড়ভাবে। তাহলে একটু দেখে নিই ত্রিপুরার উৎপত্তি সম্পর্কে কি লিখেছেন তিনি?
গ্রন্থ রচনার শুরুতেই অর্থাৎ প্রথম অধ্যায়ে শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহ ‘ত্রিপুরা’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে একটি বিশদ আলোচনা করেছেন। এমনকি প্রচলিত কিছু ধারণার দ্বিমতও পোষণ করেন এই ইতিহাসবেত্তা।
শ্রীকৈলাস বাবু তাঁর রাজমালার প্রথম ভাগের উপক্রমণিকার প্রথম অধ্যায়ের সূচনার ১ নং পৃষ্ঠায় তেমনই প্রচলিত অযৌক্তিক (তাঁর মতে) ধারণাগুলো তুলে ধরেছেন এবং লিখেছেন-
“কামরূপ ও রাক্ষিয়াং দেশের মধ্যবর্তী স্থানকে প্রাচীন আর্য্যগণ সুহ্ম আখ্যা দান করেন। ইহার অন্য নাম কিরাত দেশ। বিষ্ণুপুরানে লিখিত আছে, ভারতের “পূর্ব্বদিকে কিরাতের বাস”। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে, লৌহিত্য বংশীয় মানবদিগকে আর্য্য ঋষিগণ কিরাত আখ্যায় অভিহিত করিয়াছেন। তদনন্তর কিরাত ভূমি “তৃপুরা” আখ্যাপ্রাপ্ত হয়। এই “তৃপুরা” শব্দ হইতে ক্রমে ত্রীপুরা এবং “ত্রীপুরা” হইতে ত্রিপুরা শব্দের উৎপত্তি।
ত্রিপুরা শব্দের মূল নির্ণয় করা সুকঠিন। তন্ত্র ও পুরাণ আলোচনা দ্বারা বিবিধ প্রকার সিদ্ধান্ত অনুমান করা যাইতে পারে, “ত্রিপুরাসুর হইতে ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি কিম্বা ত্রিপুরাসুর নির্ম্মিত তিনটি পুরী হইতে ত্রিপুরা নামের উদ্ভব; অথবা ভগবতী ত্রিপুরা সুন্দরী হইতে ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি কিম্বা রাজবংশের স্থাপনকর্তার নামানুসারে এই দেশ ত্রিপুরা আখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছে।”
অর্থাৎ প্রাচীনকালে উত্তরে কামরূপ এবং দক্ষিণে রাক্ষিয়াং (রাক্ষিয়াং অর্থ রাক্ষসের নিবাসভূমি এবং প্রাচীন বঙ্গবাসীরা এই দেশকে রসাঙ্গ বলতেন, যার বর্তমান নাম আরাকান) দেশের মধ্যবর্তী স্থানকে সুহ্ম বলা হতো যার অন্য নাম ছিল কিরাত দেশ।
এই কিরাত ভূমিই পরবর্তীতে তৃপুরা আখ্যাপ্রাপ্ত হয় এবং তৃপুরা শব্দটি থেকে ত্রীপুরা ও পরবর্তীতে ‘ত্রিপুরা’ রূপে পাকাপোক্ত হয়।
আবার ত্রিপুরাসুর থেকে ‘ত্রিপুরা’ নামের উৎপত্তি কিংবা তিনটি পুরী হইতে ত্রিপুরা নামের উদ্ভব; অথবা ভগবতী ত্রিপুরা সুন্দরী থেকে ‘ত্রিপুরা’ নামের উৎপত্তি কিংবা রাজবংশের স্থাপনকর্তার নামানুসারে এই দেশের নাম ‘ত্রিপুরা’, ইত্যাদি সিদ্ধান্তগুলোকে শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহ কোনমতেই মানতে নারাজ। বরং তিনি বলেছেন
“এই সকল সিদ্ধান্ত আমাদের বিবেচনায় নিতান্ত অযৌক্তিক”।
অন্যদিকে তিনি ত্রিপুরা নামের উৎপত্তিতে ত্রিপুরাদের জাতীয় ভাষার প্রভাবকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, তিপ্রা বা ত্রিপুরাদের জাতীয় ভাষায় জলকে বলা হয় ‘তুই’, আর তুই এর সাথে ‘প্রা’ যুক্ত হয়ে নিষ্পন্ন হয়েছে ‘তুইপ্রা’ শব্দটি।
আর এই তুইপ্রা শব্দ থেকে ‘তিপ্রা’ ও তিপ্রা শব্দ থেকে ক্রমেই ‘তৃপুরা’, ‘ত্রীপুরা’ এবং ‘ত্রিপুরা’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।
এইভাবে ‘ত্রিপুরা’ শব্দের উৎপত্তিকেই তিনি বেশ গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তাই উক্ত অধ্যায়ের ২ ও ৩ নং পৃষ্ঠায় তিনি উল্লেখ করেছেন-
“যে অনার্য্য কিরাতদিগকে আমরা “তিপ্রা”(ত্রিপুরা) আখ্যায় পরিচিত করিয়া থাকি, তাহাদের জাতীয় ভাষায় জলকে “তুই” বলে। এই তুই শব্দের শহীদ প্রা সংযুক্ত করিয়া “তুইপ্রা” শব্দ নিষ্পন্ন হইয়াছে। সেই তুইপ্রা হইতে তিপ্রা, এবং তিপ্রা হইতে ক্রমে তৃপুরা, ত্রীপুরা ও ত্রিপুরা শব্দের উৎপত্তি।”
এমনকি তিনি পাদটীকায়ও এ নিয়ে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছেন এভাবে-
“এই তুই শব্দ সংস্কৃত তোয় শব্দের অপভ্রংশ কি না তাহা বিশেষ বিবেচ্য, কারণ ত্রিপুরা জাতির পূর্ব্ব ও দক্ষিণ দিগবাসী কুকি, কুইমি, মুরু, খেয়াং বঞ্জুগী ও পংখু জাতি জলকে তুই বা তোই বলে। কেবল সিন্ধুগণ ‘তি’ বলিয়া থাকে। সিন্ধুগণ দ্বারা “তিপ্রা” নামকরণও বিচিত্র নহে।”
তাঁর মতে কালিদাস ও হিয়োনসাঙ এর লিখনীতেও সাগর তীরবর্তী একটি দেশের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সুতরাং তিনি মনে করেন, এই অনার্য্য কিরাতগণ এই দেশকে ‘তুইপ্রা’ আখ্যা দিয়েছিলেন। আর এভাবেই তুইপ্রা থেকে ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি। তিনি লিখেছেন-
“কবিচুড়ামণি কালিদাস ববুবংশে সুহ্মদেশকে মহাসাগরের “তালিবন শ্যাম উপকন্ঠ” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। চীন পরিব্রাজক হিয়োনসাঙের ভ্রমণ বৃত্তান্ত “সি-উ-কি” গ্রন্থে কমলাঙ্ক(কুমিল্লা) সাগরতীরবর্তী দেশ বুলয়া বর্ণিত হইয়াছে। আমাদের বিবেচনায় অনার্য্য কিরাতগণ এই জল অর্থাৎ সমুদ্রের তীরবর্তী দেশকে “তুইপ্রা” আখ্যা প্রদান করিয়াছিল। সেই তুইপ্র কিরূপে তিপ্রা(ত্রিপুরা) শব্দে পরিণত হইয়াছে তাহা পূর্ব্বে বর্ণিত হইয়াছে।”
তিনি তাঁর উক্ত গ্রন্থে ‘ত্রিপুরা’ শব্দটিকে শুধুমাত্র একটি দেশ বা রাজ্যের নাম হিসেবেই ব্যবহার করেননি বরং ব্যবহার করেছেন জাতিবাচক নামের ক্ষেত্রেও।
শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহ প্রাচীন সুহ্ম বা ত্রিপুরা রাজ্যের আয়তন ৭৫০০০ বর্গমাইলের কম নয় বলে মনে করেন।
আর্থাৎ তৎকালীন কুকি প্রদেশ, মিতাই(মণিপুর) রাজ্য, কাছার, শিলহট্ট(শ্রীহট্ট), চট্টগ্রাম ও নওয়াখালী এই সুহ্ম বা ত্রিপুরার অন্তর্গত ছিল বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন ।
এমনকি রাজ্যের সীমানা উত্তরে তৈরাঙ্গ নদী, দক্ষিণে রসাঙ্গ(আরাকান), পূর্ব্ব সীমা মেখলী(মণিপুরী) রাজ্য এবং পশ্চিমে বঙ্গের সহিত সংলগ্ন বলে প্রাচীন রাজমালার সূত্র ব্যবহার করেন।
তাঁর গ্রন্থের প্রথম ভাগের প্রথম অধ্যায়ের ৪ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন-
“কিঞ্চিদুন পঞ্চশতাব্দী পূর্ব্বেযৎকালে মহারাজ ধর্ম্মমাণিক্যের সভাপন্ডিত ব্রাহ্মণকূলজাত শুক্রেশ্বর ও বাণেশ্বর “রাজমালা” রচনা করেন, তৎকালে তারা ত্রিপুরা রাজ্যের সীমা এইরূপে নির্দেশ করিয়াছেন-
কিরাত নগরে রাজা বিধির গঠন।
রাজ্যের সীমানা কহি শুনহ বচন।।
উত্তরে তৈরঙ্গ নদী দক্ষিণে রসাঙ্গ।
পূর্ব্বেতে মেখলী সীমা পশ্চিমে কাচবঙ্গ।।
ত্রিবেগ স্থানেতে রাজা করিল এক পুরী।
নানামত নির্ম্মাইল পুরীর চওারি।।
-প্রচীন রাজমালা”
শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহের রাজমালার এই অধ্যায়ে ত্রিপুরা রাজ্য বহির্জগতে কি কি নামে পরিচিত, তা খুবই সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন।
যেমন, তাঁর মতে ব্রহ্মার প্রচীন ইতিহাস ‘মহারাজোয়াং’ গ্রন্থে এই রাজ্যকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘পাটিকারা’ নামে, আরাকানের প্রাচীন ইতিহাস রাজোয়াং গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে ‘থুরতন’ নামে, মিতাই বা মণিপুরীরা বলতেন ‘তকলেঙ’, আবার প্রাচীন মুসলমান ইতিহাস লেখকগণ ত্রিপুরা রাজ্যকে ‘জাজনগর’ বা ‘জাজিনগর’ নামে বর্ণনা করেছেন।
এইভাবে শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহ তাঁর ‘রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে ত্রিপুরার উৎপত্তি সম্পর্কে সুনিপুন ও বিশ্লেষণাত্বক উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রাচীন রাজমালার অনেক মূল্যবান তথ্যগুলো তুলে ধরেছেন। রেখে গেছেন অনন্য অবদান।
যাঁর উপর ভিত্তি করে আমরা আজও বলার সাহস পাই একটি স্বাধীন রাজ্য ত্রিপুরার কথা। যুগে যুগে ত্রিপুরা মহারাজারা যেমন অমর হয়ে আছেন প্রজা বা জাতির নিকট, তেমনি শ্রীকৈলাসচন্দ্র সিংহও বেঁচে থাক তাঁর এই অসামান্য কীর্তিতে। আর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গবেষকগণ লিখে যাক ত্রিপুরার গৌরবময় ইতিহাসগুলো।
লেখক: মুকুল কান্তি ত্রিপুরা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।