ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার (বাগমানি/বাগমানাই/বাও মং মানাই)

Jumjournal
Last updated Sep 26th, 2021

1178

featured image

ত্রিপুৱা উত্তরাধিকার প্রথার উদ্ভব

পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাসমূহে বসবাসকারী ত্রিপুরা সমাজ ব্যবস্থায় জুম চাষকে অদ্যাবধি তাদের অন্যতম পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪২ বিধিমতে পাহাড়ে জুম চাষের জন্য জমির মালিকানা স্বত্বের প্রয়োজন হয় না, যার কারণে ত্রিপুরা সমাজে স্থাবর সম্পত্তির তথা ভূমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা স্থায়ী মালিকানা স্বত্ব অর্জনের প্রচেষ্টা অতীতে তেমন ছিল না বললেই চলে।

এ অবস্থায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অতীতে পার্বত্য জেলাসমূহে বসবাসকারী ত্রিপুরা সমাজে তেমন সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠেনি।

ইদানীংকালে জুম চাষের জন্য জমির অপ্রতুলতা এবং পর্যায়ক্রমে একই জমিতে বংশানুক্রমিকভাবে চাষাবাদের কারণে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মধ্যে উদ্যান কৃষির প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্তমান শিক্ষিত সমাজে ভূ-সম্পত্তির উপর স্থায়ী মালিকানা স্বত্ব অর্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ধারণার উদ্ভব হয়েছে।

ত্রিপুরা সমাজভুক্ত একটি পরিবারের কেউ মারা গেলে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের দায়-দায়িত্ব পালন, মূতের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবার সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং পারিবারিক কর্তব্য হিসেবে সমাজে স্বীকৃত।

ত্রিপুরা উত্তরাধিকারের সাধারণ নীতি

উত্তরাধিকার: ত্রিপুরা সমাজভূক্ত পরিবারে কারো মৃত্যু হলে তার সৎকার, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের বেলায় সামাজিক রীতিনীতি অনুসরণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সমাজের অনুশাসন ও রীতি অনুসারে মৃতের আত্মার সদ্গতির জন্য বিশেষ কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হতে হয়।

উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি কি কি: সম্পত্তির মালিক মৃত্যুকালে যেসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি রেখে মারা যান সেসবই উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য।

অস্থাবর সম্পত্তি যেমনঃ- আসবাবপত্র, থালাবাটি, কাপড়চোপড়, অলংকার, গবাদিপশু ইত্যাদি উত্তরাধিকারীগণের মধ্যে আপোষ রফায় ভাগবন্টন ও হস্তান্তর হয়।

কিন্তু লিখিত কোনো আইন বা বিধি-বিধানমতে সেগুলো ভাগবন্টন করা হয় না। কেবলমাত্র ভূমি তথা জায়গা-জমিকে স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে সামাজিক বিধিবিধানমতে ভাগবন্টন করা হয়। তাই উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি বলতে সাধারণভাবে স্থাবর সম্পত্তিকেই বুঝানো হয়।

কিন্তু একজন সম্পত্তির মালিকের সম্পূর্ণ স্থাবর সম্পত্তি উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয় না। সম্পত্তির মালিকের মৃত্যুর পর তার সৎকার/অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয়, তার অনাদায়ী ঋণ (যদি থাকে) এবং জীবদ্দশায় দখল হস্তান্তরিত হয়েছে কিন্তু মালিকানা স্বত্ব হস্তান্তরিত হয়নি এমন ভূ-সম্পত্তির দায়/দেনা মেটানোর পর যা অবশিষ্ট থাকে তার উপরই উত্তরাধিকারীগণের অধিকার বর্তায়।

সম্পত্তির উত্তরাধিকার রীতি: তিন পার্বত্য জেলার সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, সংশ্লিষ্ট মৌজার হেডম্যান/ইউ.পি চেয়ারম্যান/কার্বারী/পৌর চেয়ারম্যান/সার্কেল চীফ-এর নিকট হতে মতামত ও সুপারিশ গ্রহণ পূর্বক ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনের ৭ ধারামতে প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে সংশ্লিষ্ট জেলার দেওয়ানী আদালতের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবিধ মামলা মূলে তিনি মৃত ব্যক্তির আইনগত উত্তরাধিকারীগণকে উত্তরাধিকার সনদপত্র প্রদান করেন।

চাকমা, মং ও বোমাং সার্কেলে বসবাসকারী ত্রিপুরা সমাজে মৃত ব্যক্তির পুত্র তার সম্পত্তিতে অপ্রতিরোধ্য উত্তরাধিকারী হয়। তবে ত্রিপুরাদের উসুই গোত্রের দলের মধ্যে পুত্র ও কন্যাগণ অপ্রতিরোধ্য উত্তরাধিকারী হয়।

পুত্র সন্তানের অবর্তমানে কন্যা সন্তানগণ মৃতের সম্পত্তিতে অপ্রতিরোধ্য আইনগত উত্তরাধিকারী হয়। তবে উসুই গোত্রভুক্ত ত্রিপুরা সমাজে সানদাই প্রথা আদিকালে থাকলেও বর্তমানে এই প্রথার পরিবর্তন হয়েছে

(সূত্রঃসত্যহা পাখি)। ত্রিপুরা সমাজে দেইনদাক গোত্রভুক্ত পরিবারে মৃত মায়ের সম্পত্তির উপর কন্যা সন্তানেরা আইনগত উত্তরাধিকারী হতো বলে জানা যায়। বর্তমানে পুত্র সন্তান থাকলে কন্যা সন্তানেরা মৃত মায়ের সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হয়। তবে মৃত ব্যক্তি যদি তার মৃত্যুর পূর্বে দান বা উইলের মাধ্যমে নিজ স্ত্রী ও কন্যাকে সম্পত্তি দান করে সেক্ষেত্রে স্ত্রী ও কন্যা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।

ব্যতিক্রমঃ কেইস রেফারেন্স: খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার রামগড় উপজেলাধীন ২৩নং পরশুরাম মৌজার মৃত তালমনি ত্রিপুরার দুই পুত্র সন্তান (১) দাতা চন্দ্র ত্রিপুরা ও (২) দাতা রাম ত্রিপুরা উভয়ের নামে উত্তরাধিকার সূত্রে ২১নং খতিয়ানে ৮,১২ একর জমি এজমাইলীতে রেকর্ডভুক্ত ছিল।

দাতা রাম ত্রিপুরা মৃত্যুকালে ২ কন্যা সন্তান (১) বানাৰী ত্রিপুরা ও (২) স্বর্ণশ্রী ত্রিপুরাকে নাবালক অবস্থায় রেখে মৃত্যুবরণ করলে তার সহোদর ভাই দাতা চন্দ্র ত্রিপুরা মিচ মামলা নং-৪০৭(ডি)/৮০-৮১ তারিখঃ ০১/১২/১৯৮২ মূলে মৃত ভাইয়ের অংশ খাস করে পুনরায় নিজ নামে বন্দোবস্তী গ্রহণ করেন।

দাতা চন্দ্র ত্রিপুরা উপরোক্ত জমি সরকারী খতিয়ানে নিজ নামে অন্তর্ভুক্ত করে ভোগ-দখলে থাকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তার তিন পুত্র (১) ভীষন কুমার ত্রিপুরা, (২) হরি ভূষণ ত্রিপুরা, (৩) থৈ প্রু ত্রিপুরা মৃত পিতার নামীয় জায়গার মালিকানা স্বত্ব মিউটেশন মামলা নং- রাম-১২৪/৯৪ তারিখঃ ১০/০৩/১৯৯৬ মূলে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন।

অতঃপর ২৬/১২/১৯৯৬ দাতা রাম ত্রিপুরার ২ কন্যা (১) বানাৰী ত্রিপুরা, (২) স্বর্ণশ্রী ত্রিপুরা মৃত পিতার ভাগে প্রাপ্য অংশের উত্তরাধিকার দাবী করে জেলা প্রশাসক আদালত, খাগড়াছড়ি বিবিধ মামলা নং- ১৯১/৯৫ দায়ের করলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) উপরোক্ত মামলা খারিজ করেন।

অতঃপর উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে দাতা রাম ত্রিপুরার দুই কন্যা অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রাম বিভাগ- এর আদালতে বিবিধ আপীল নং- ২৩/৯৭ দায়ের করলে বিজ্ঞ আদালত ২৩/০৫/২০০১ ত্রিপুরা সমাজে প্রচলিত প্রথা ও রীতিনীতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে আপীলকারীগণের আপীল মঞ্জুর করেন এবং আপীলকারীগণকে মৃত পিতার আইনগত উত্তরাধিকারী হিসেবে মৃত দাতা রাম ত্রিপুরার ভাগের প্রাপ্য অংশ দুই কন্যার নামে রেকর্ড সংশোধনের জন্য জেলা প্রশাসক, খাগড়াছড়িকে নির্দেশ প্রদান করেন।

অতঃপর উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে দাতা চন্দ্র ত্রিপুরার তিন পুত্র তাদের ত্রিপুরা সম্প্রদায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী হিসেবে হিন্দু দায়ভাগা আইনানুসারে কন্যা সন্তান মৃত পিতার সম্পত্তিতে আইনগত উত্তরাধিকারী হয় না, এই যুক্তিতে ভূমি আপীল বোর্ড, সেগুনবাগিচা, ঢাকা মামলা নং- ৪৯/২০০২ আপীল (খাগড়াছড়ি) দায়ের করলে বিজ্ঞ সদস্য- ২ ভূমি আপীল বোর্ড, ঢাকা ৩০/১০/২০০৪ আপীল মঞ্জুর করে প্রদত্ত আদেশে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের ২৩/০৫/২০০১ প্রদত্ত আদেশ বাতিল ঘোষণা করেন।

উত্তরাধিকারযোগ্য পদ পদবী: পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০- এর ৪৮ বিধিমতে সার্কেল চীফ নিয়োগ এবং হেডম্যান নিয়োগ ও বরখাস্ত বিষয়ে লিপিবদ্ধ আছে।

ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধি ১৯০০ এর ৪৮ বিধিমতে ত্রিপুরা সমাজের হেডম্যান/কার্বারী এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফের সুপারিশ বা মতামতকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়।

হেডম্যান/কার্বারী/রোয়াজা নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র যদি যোগ্য হন তাকে সেই পদে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা হয়।

খ) ত্রিপুরা সমাজে রোয়াজা/নারান এ দু’টি বংশানুক্রমিক হওয়াতে জ্যেষ্ঠপুত্রের অগ্রাধিকার থাকে, যদিও উক্ত পদ ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনমতে স্বীকৃত নয়।

উদাহরণঃ খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার অধীনে এবং চাকমা সার্কেলের অন্তর্গত ৩১নং বোয়ালখালী মৌজার হেডম্যান পদে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় কিশিরাম পোমাং তার নাবালক পুত্র সন্তান ময়ুরধ্বজ পোমাংকে রেখে অকালে মৃত্যুবরণ করলে উক্ত মৌজার কার্বারী কাশীমনি ত্রিপুরা হেডম্যান পদে নিযুক্ত হন।

পরবর্তীতে কাশীমনি ত্রিপুরা বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করলে মৌজা হেডম্যান পদের প্রশ্নে ১৯৪০-৪১ সনে কাশীমনি ত্রিপুরার পুত্র রঙ্গচাঁন ত্রিপুরা এবং ভূতপূর্ব হেডম্যান কিশিরাম পোমাং-এর পুত্র ময়ুরধ্বজ পোমাং-এর মধ্যে রামগড় মহকুমা আদালতে মামলার উদ্ভব হয়।

রামগড় মহকুমা প্রশাসকের আদালত ১৯০০ সনের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪৮ বিধিমতে কাশীমনি ত্রিপুরার জ্যেষ্ঠ পুত্র রঙ্গচাঁন ত্রিপুরাকে হেডম্যান নিয়োগ করেন। অতঃপর রঙ্গচাঁন ত্রিপুরা হেডম্যান থাকাবস্থায় একমাত্র কন্যা হরিবালা ত্রিপুরাকে উত্তরাধিকারী রেখে মৃত্যুবরণ করলে ভূতপূর্ব হেডম্যান কিশিরাম পোমাং-এর পুত্র ময়ুরধ্বজ্জ পোমাং হেডম্যান পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হন।

ত্রিপুরা সমাজের উত্তরাধিকার প্রশ্নে অগ্রাধিকার ভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাস

ক) ত্রিপুরা পরিবারে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে মৃতের পুত্র সন্তানেরা তার অপ্রতিরোধ্য আইনগত উত্তরাধিকারী। তাদের উপস্থিতি অন্য সকল নিকটাত্মীয়ের অধিকারকে খর্ব করে।

এক্ষেত্রে সন্তান বলতে- ঔরসজাত, অবৈধ ও দত্তক সন্তানকে বুঝায়। পুত্র বা কন্যার মৃত্যুজনিত কারণে পুত্রবধু ও মৃত কন্যার স্বামী সম্পত্তির উত্তরাধিকার হয় না।

তবে মৃত পুত্র-কন্যার সন্তানগণ আইনগত উত্তরাধিকারী হিসেবে গণ্য হয়। উসুই গোত্রভুক্ত ত্রিপুরা সমাজের আদি রীতি অনুসারে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী ও কন্যা সন্তানেরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতো।

কিন্তু বর্তমান আধুনিক সমাজে মৃতের স্ত্রী  (একতৃতীয়াংশ) এবং পুত্র ও কন্যা সন্তানেরা সমান হারে সম্পত্তির ভাগ পাচ্ছে। উসুই/রিয়াং গোত্রের মৃত ব্যক্তির পুত্র ও কন্যা সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকারী হয়। দত্তক সন্তান মৃত পিতার  (এক-পঞ্চমাংশ) সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। (সুত্রঃ- সত্যহা পাঞ্জি বান্দরবান)

খ) ত্রিপুরা পরিবারে মৃত ব্যক্তির পুত্র সন্তান যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে কন্যা সন্তানেরা মৃত পিতার সম্পত্তিতে আইনগত উত্তরাধিকারী হয় এবং কন্যা সন্তানগণ মৃত পিতার সম্পত্তির সমান হারে ভাগ পায় । মৃত ব্যক্তির কন্যা সন্তানগণের মধ্যে ঔরসজাত কন্যা, অবৈধ কন্যা, দত্তক কন্যা সকলেই কন্যা সন্তান রূপে গণ্য হয়।

ভিন্ন ধর্ম বা সম্প্রদায়ের কারো সাথে বিয়ের কারণে ভিন্ন সমাজের রীতি ও আচার-আচরণে বসবাসকারী কন্যা সন্তান পিতার উত্তরাধিকারী হয় না। সেক্ষেত্রে ত্যাজ্য সম্পত্তির মালিকের ভাই বা ভাইপো উত্তরাধিকারী হয়।

গ) স্বামীস্ত্রী: স্বামী-স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামী মৃত স্ত্রীর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। তবে স্বামী দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করলে সেক্ষেত্রে প্রথমা স্ত্রীর পুত্র সন্তানগণ মৃত মায়ের সম্পত্তির অপ্রতিরোধ্য আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

ঘ) পিতামাতা: মৃত ব্যক্তির যদি স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি-নাতনী থাকে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি যাদের ঔরসজাত অথবা দত্তক সন্তান রূপে যাদের স্নেহে লালিত পালিত হয়েছে সেই পিতামাতা মৃতের উত্তরাধিকারী হয়।

ঙ) রক্ত সম্পৰ্কীয়: ত্রিপুরা সমাজে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি, নাতনী, পিতা, মাতা যদি কেউ জীবিত না থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির ভ্রাতা, ভ্রাতার পুত্রকন্যা, তাদের অবর্তমানে মূতের বোন, বোনের পুত্র-কন্যাগণ আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।

চ) ত্রিপুরা পরিবারে মৃতের যদি স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, ভাই, বোন এবং ভাইপো-ভাইঝি ও ভাগ্নে-ভাগ্নী, এদের রক্ত সম্পকীয় নাতি-নাতনী কেউ যদি জীবিত না থাকে অথবা জন্মগ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে কাকা/জেঠা, তাদের অবর্তমানে কাকা/জ্যেঠার পুত্র-কন্যা উত্তরাধিকারী হয়।

ছ) ত্রিপুরা সমাজে মৃত ব্যক্তির ‘চ’ অংশের রক্ত সম্পৰ্কীয় কেউ যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে পিসি, তার অবর্তমানে পিসতুতো ভাই-বোন ও তাদের পুত্র-কন্যা উত্তরাধিকারী হয়।

জ) মৃত ব্যক্তির ‘চ’ ও ‘হ’ অংশের রক্ত সম্পর্কীয় উত্তরাধিকারীও যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির মামা, তার অবর্তমানে মামাতো ভাই-বোন তাদের পুত্র-কন্যা উত্তরাধিকারী হয়।

ঝ) মৃত ব্যক্তি যে ধর্মের অনুসারী সেই ধর্ম হতে বিচ্যুত বা ধর্মান্ত রিত এবং জাতিচ্যুত পুত্র, কন্যা, স্ত্রী কিংবা রক্ত সম্পৰ্কীয় কেউই মৃতের ত্যাজ্য সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না।

ঞ) মৃত ব্যক্তির একাধিক স্ত্রীর বেলায় প্রত্যেক স্ত্রীর সন্তানগণ পিতার সম্পত্তির সমান অংশীদার হয়। তবে পদ ও পদবীর ক্ষেত্রে প্রথমা স্ত্রীর সন্তান অগ্রাধিকার পায়।

সম্পত্তির ভাগবন্টন: ত্রিপুরা সমাজে পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগবন্টন নিম্নরূপে করা হয়ঃ-

ক) ত্রিপুরা সমাজে পৈত্রিক সম্পত্তি মৃতের আইনগত উত্তরাধিকারী পুত্র সন্তানগণের মধ্যে হারাহারিভাবে ভাগ হয়। পুত্র সন্তানগণের অবর্তমানে মৃতের কন্যা সন্তানগণ পৈত্রিক সম্পত্তিতে সমান হারে ভাগ পায় । উসুই/রিয়াং গোত্রভুক্ত মৃতের কন্যা সন্তানেরাও পিতার সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হয়।

খ) ত্রিপুরা সমাজে যদি পিতা তার জীবদ্দশায় কন্যা সন্তানকে দান বা উইলনামা মূলে কোনো স্থাবর সম্পত্তি দান করে তবে কন্যা সেই পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকারী হয়। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক আইনগত উত্তরাধিকারীগণের সকল প্রকার আপত্তি আইনতঃ অগ্রাহ্য হয়।

গ) মৃত পিতার একান্ত ব্যবহার্য জিনিস পিতা যে পুত্রের ভরনপোষণে থেকে মৃত্যুবরণ করে, সেই পুত্র অথবা জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং মৃত মাতার একান্ত ব্যবহার্য জিনিস জ্যেষ্ঠ কন্যা পায়।

অবৈধ সন্তানের উত্তরাধিকার স্বত্ব: যে ব্যক্তির ঔরসে অবৈধ সন্তান (জারজ) জন্মগ্রহণ করে সেই ব্যক্তির (জন্মদাতা) সামাজিক রীতিনীতি ও প্রথা অনুসারে সন্তানের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করা হয়। তবে ভিন্ন কোনো ব্যক্তির পিতৃ পরিচয়ে সে যদি পরিচিত হয়, সেক্ষেত্রে জন্মদাতা পিতার উত্তরাধিকার সে দাবী করতে পারে না। কেবলমাত্র নিজ মাতার নামীয় সম্পত্তির (যদি থাকে) উত্তরাধিকারী হয়।


তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা,  এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা