ত্রিপুরা জাতির আদ্যোপান্ত
6676
ত্রিপুরাদের বসতি, অঞ্চল ও জনসংখ্যা
ত্রিপুরা বাংলাদেশের অন্যতম আদিবাসী জনগােষ্ঠী। এই জনগােষ্ঠীর মূল আবাসভূমিও ত্রিপুরা নামে পরিচিত। ত্রিপুরা জাতি ভারতীয় উপমহাদেশের এক প্রাচীন জাতি। বাংলাদেশে ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পার্বত্য জেলা ব্যতীত ত্রিপুরা জনগােষ্ঠী সমতল এলাকার কুমিল্লা, সিলেট, বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা, রাজবাড়ি, চাঁদপুর, ফরিদপুর ইত্যাদি অঞ্চলে বর্তমানে বসবাস করে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ত্রিপুরাদের বসবাস হলেও এ জাতির মূল অংশ বর্তমানে বসবাস করছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। ত্রিপুরা রাজ্য ছাড়াও ভারতের মিজোরাম, আসাম প্রভৃতি প্রদেশেও বেশ উল্লেখযােগ্য ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর বসতি দেখা যায়।
পার্শ্ববর্তী দেশ মায়ানমারেও ত্রিপুরাদের জনবসতি আছে বলে জানা যায় । বর্তমানে ত্রিপুরা জাতির সামগ্রিক অবস্থা প্রান্তিক হলেও এককালে এই জাতি এই ভারতবর্ষে এক পরাক্রমশালী জাতি হিসেবে স্বাধীন সার্বভৌম ত্রিপুরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল।
এ জাতির ১৭৮ জন মহারাজা একটানা ১৩৬৪ বছর সুবিস্তৃত ত্রিপুরা রাষ্ট্র শাসন করেছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ত্রিপুরা রাজাদের রাজত্বকাল সর্বসাকুল্যে ২০০০ বছরেরও বেশি।
এ জাতির ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। ত্রিপুরাব্দ’ নামে এ জাতির নিজস্ব এক অব্দও প্রচলিত আছে। ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর মানুষেরা সাধারণত পাহাড়, বন ও প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরে বসবাস করে।
যার কারণে এ জনগােষ্ঠীর লােকেরা আধুনিক সুযােগ-সুবিধা থেকে বহু দূরে অবস্থান করে। জীবন-জীবিকার তাগিদে, পেশাগত ও অন্যান্য কারণে ত্রিপুরা জাতির মানুষেরা দুর্গম পাহাড় বনাঞ্চলে বসবাস করে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরাদের বসতিও অধিকাংশই পাহাড় বনাঞ্চলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
গােমতি, চেঙ্গী, মাতামুহুরী, মাইনী, শংখ, কর্ণফুলি প্রভৃতি নদীর অববাহিকায় ত্রিপুরাদের বসতি রয়েছে। বাংলাদেশের অপরাপর অঞ্চল যেমন—সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় বসবাসরত ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর লােকও অধিকাংশই পাহাড়ের উপরে বসবাস করে।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, আসাম ও মিজোরামে বসবাসকারী ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর লােকও অধিকাংশই পাহাড় বনাঞ্চলে বসবাস করে। ভারত বা বাংলাদেশে যেখানেই হােক না কেন ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর বসতি অঞ্চলের ভৌগােলিকগত অবস্থা একই রকমের। পাহাড়, বন, ঝরনা, দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলই হলাে এদের মূল আবাসস্থল।
জনসংখ্যা
বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে একসময় ত্রিপুরাগণ যে সর্বত্র ছিল ১৮৭২ ও ১৮৮১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদন পরীক্ষা করলে তার প্রমাণ মেলে—
ক্রম | জায়গার নাম | জনসংখ্যা |
১৮৭২সাল ১৮৮১ সাল | ||
১ | কুছবিহার | _ ১১১৬ |
২ | ঢাকা | ৩৮ ৪৭ |
৩ | ফরিদপুর | _ ১০১ |
৪ | বাখেরগঞ্জ | ২১৭ ৪৫ |
৫ | নোয়াখালী | ২৩২ ১৬ |
৬ | চট্টগ্রাম | ৪৫ ২২৫ |
৭ | কুমিল্লা | ৩০০৪ ১৮৯৫ |
৮ | পার্বত্য চট্টগ্রাম | ১১৮০০ ১৫,ও৫৮ |
মোট | ১৫৬৩২ ১৮৫০৯ |
(সূত্র : পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও সংস্কৃতি- সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, পৃ. ৬৭]
১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বাংলাদেশে ত্রিপুরা জনসংখ্যা ৮১,০১৪। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ত্রিপুরা জনসংখ্যা-১১৯,৯০১। ১৯৯১ সালের জনসংখ্যাকে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হার ১.৪ গুণ করে।
বর্তমান ত্রিপুরাদের সম্ভাব্য জনসংখ্যা পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৫০,০০০ জন; চট্টগ্রামে (হাটহাজারী, সীতাকুণ্ড, মিরেরসরাই ও কুমিরা) ৩৫,০০০ জন, কুমিল্লায় ২,০০০ জন, সিলেটে ৪,০০০ জন এবং চাঁদপুর, রাজবাড়ি, ফরিদপুর ইত্যাদি এলাকায় ৩,০০০ জন।
এছাড়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ১২ লক্ষ, মিজোরামে ১ লক্ষ ২০ হাজার এবং আসামে ৩০ হাজার ত্রিপুরা জনসংখ্যা রয়েছে বলে জানা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে ত্রিপুরাদের জনসংখ্যা অনেকেই মনে করেন দুই লক্ষের কাছাকাছি হবে।
তন্মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রিপুরাদের জনসংখ্যা কমপক্ষে দেড় লক্ষাধিক। বিভিন্ন লেখকের লেখায় আমরা এ ধরনের তথ্য পেয়ে থাকি।
ত্রিপুরা জাতির প্রথম গবেষক ও লেখক প্রয়াত সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনসংখ্যা ২ লক্ষের কাছাকাছি হবে বলে ধারণা করেন। গবেষক প্রভাংশু ত্রিপুরা বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা দুই লক্ষাধিক হবে বলে ধারণা করেন।
বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর লােকেরা যেহেতু প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে। সেহেতু এ জনগােষ্ঠীর সবাইকে গণনা করা হয় না বলে জনগােষ্ঠীর গবেষকেরা মনে করেন।
ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি
জাতি হিসেবে ‘ত্রিপুরা’ নামের উৎপত্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি মতবাদের প্রচলন আছে। অনেকে বলেন, “তােয়প্রা’ থেকে ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি। তােয়’ মানে পানি বা নদী আর ‘প্রা’ মানে সঙ্গমস্থল বা মােহনা।
ধারণা করা হয় যে, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীর মােহনায় এক সময় ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর লােকেরা বসবাস করেছিল এবং রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই তিন নদীর মােহনা বা ‘তােয়’ শব্দটি অপভ্রংশ হয়ে পরবর্তীতে ত্রিপুরা’ নামটি জাতির নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
ত্রিপুরা রাজন্যবর্গের ইতিহাস গ্রন্থ ‘রাজমালা’-তেও এর উল্লেখ আছে। মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের সমসাময়িক রাজমালা গ্রন্থের লেখক কৈলাস চন্দ্র সিংহ-এর মতে, ত্রিপুরা নামের সাথে ককবরক ভাষার দুটি শব্দ জড়িত রয়েছে। শব্দ দুটি হলাে তােয় ও প্রা।
ককবরক ভাষায় তােয় অর্থ পানি আর প্রা অর্থ মােহনা বা নিকটে। তার মতে কোনাে এক সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা সমুদ্রসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সেজন্য এই রাজ্যের নাম ত্রিপুরা হয়েছে।
রাজ্যের নাম অনুসারে পরবর্তীতে জনগােষ্ঠীর নাম হয় ত্রিপুরা। দ্বিতীয় মতবাদ অনুসারে ত্রিপুরাদের এক রাজার নাম ছিল ‘ত্রিপুর’ । তিনি অতিশয় পরাক্রমশালী ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি ত্রিবেগ নগরের রাজা হন।
তিনি পরবর্তীতে ‘কিরাত’ নামক রাজ্য অধিকার করেন। কিরাত রাজ্য জয় করে ‘কিরাত’ ও ‘ত্রিবেগ’—এই দুটি রাজ্যকে এক করে এই ভূখণ্ডের নামকরণ করেন ত্রিপুরা।
তিনি এই ত্রিপুরা রাজ্যের প্রজাদের ত্রিপুরা জাতি’ বলে আখ্যায়িত করেন। তখন থেকেই জাতি হিসেবে ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর উৎপত্তি বলে অনেক ঐতিহাসিকগণ মত প্রকাশ করেন। কর্নেল উইল ফোর্ড বলেন, চট্টগ্রামের প্রাচীন নাম ‘পুষ্পগ্রাম’। এটি প্রাচীন ত্রিপুরা রাজ্যের একটি অংশ।
যে তিনটি নগরী হতে ত্রিপুরা, ত্রিপুরা নাম প্রাপ্ত হয়েছে, চট্টল তার অন্যতম নগরী। কমলাঙ্ক (কুমিল্লা), চট্টল এবং বর্মণ (রসাং)—এই তিনটি ‘পুর বা নগর হতে ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি। এই ত্রিপুরাপতি ভগবান আশুতােষ ত্রিশুল দ্বারা বিনষ্ট করত সেই ত্রিশূল কমলাঙ্ক প্রদেশে সংস্থাপন করেছিলেন।
ত্রিপুরা জাতির ঐতিহাসিক পটভূমি
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন জনগােষ্ঠী বসবাস করে আসছে। তবে তাদের বসতি স্থাপনকাল সবার এক নয়। মানব জনগােষ্ঠী তাদের জীবিকার তাগিদে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে দলবদ্ধভাবে ছুটে চলতাে।
তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ও ভারতের ত্রিপুরা জনগােষ্ঠী কখন এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল তা সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। মহাভারতের মতাে পৌরাণিক কাহিনীতে এবং প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলের মানব ইতিহাসে ত্রিপুরাদের সম্পর্কে জানা যায়।
পৌরাণিক কাহিনী
মহাভারত’ গ্রন্থে ত্রিপুরা জাতি ও ত্রিপুরা রাজ্য সম্পর্কে বেশ কয়েকটি জায়গায় উল্লেখ আছে। মহাভারত গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল দ্বাপর যুগে। শুধু তাই নয় মহাভারতের চেয়েও প্রাচীন গ্রন্থ ‘পীঠমালাতন্ত্রে’ ত্রিপুরা রাজ্য, রাজ্যের ভৌগােলিক অবস্থান ও অন্যান্য তথ্য উল্লেখিত আছে।
ত্রিপুরা মহারাজা ত্রিলােচন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনার্য ত্রিপুরা মহারাজা ত্রিলােচনকে ‘মহাভারত’-এর লেখক ব্যাস মুনি (আর্য) বর্বর বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
ত্রিপুরা মহারাজা অনার্য বলে তিনি এরূপ আখ্যাদানের সুযােগ পেয়েছিলেন। তবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ত্রিপুরা মহারাজা অংশগ্রহণ নিশ্চয়ই অনার্য জনগােষ্ঠীর জন্য এক মহা গৌরবময় অধ্যায় বৈকি। ‘
রাজন্যবর্গের জাত্যাভিমান ছিল যে, আর্যরাই কেবল যুদ্ধ বিগ্রহে শ্রেষ্ঠ অধিকারী। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ত্রিপুরা মহারাজা ত্রিলােচনের অংশগ্রহণ আর্য রাজন্যবর্গের অহংবােধকে খর্ব করে দিয়েছিল।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে মহারাজা ত্রিলােচনের বীরত্ব ও যুদ্ধকৌশল দেখে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অতিশয় খুশি হয়ে রাজ কুলতিক’ উপাধি প্রদান পূর্বক বন্ধুত্বের নিদর্শন ও বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বহু মুল্যবান রত্নখচিত একটি সিংহাসন উপহার দিয়েছিলেন।
এই সিংহসিনটিকেই ত্রিপুরা রাজন্যবর্গ ত্রিপুরা রাজ সিংহাসন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বংশপরম্পরায় ত্রিপুরা রাজন্যবর্গ এই সিংহাসনেই উপবেশন করে রাজ্য শাসন করেছিলেন জানা যায়।
ত্রিপুরা মহারাজা শুধুমাত্র কুরুক্ষত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, দাতা কর্ণরাজ এবং মহাবীর ভীম ও সহদেব-এর সাথেও যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কালক্রমে ত্রিপুরা রাজন্যবর্গ পরাক্রমশালী হয়ে উঠলেন। গুপ্ত সম্রাটগণের ভারত শাসনকালে ত্রিপুরা মহরাজারা প্রবল প্রতাপশালী হয়ে উঠছিলেন।
সম্রাট সমুদ্র গুপ্তের লাট প্রস্তর লিপির দ্বাবিংশ পভৃতিতে লিখিত আছে যে, সমতট (বঙ্গ), কামরূপ, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যের অধিপতিগণ সম্রাট সমুদ্র গুপ্তের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। কালের পরিক্রমান্তে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা কখনাে সম্প্রসারিত কখনাে সংকুচিত হয়েছে।
ফলে ভারত উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাসে ত্রিপুরা রাজ্যকে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। মহাভারত যুগের প্রথম অধ্যায়ে ত্রিপুরা রাজ্যকে ত্রিবেগ রাজ্য, প্রতিষ্ঠান নগর ও কিরাত নামে অভিহিত করা হয়েছিল। মহাভারতের দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিশেষ করে মহারাজ ত্রিপুরের রাজত্বকাল থেকে ত্রিপুরা রাজ্য ত্রিপুরা নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, আনুমানিক ৬৫ খ্রিস্টাব্দে সুই বংশের সময়কালে পশ্চিম চীনের ইয়াংসি ও হােয়াংহাে নদীর উপত্যকা হচ্ছে এদের প্রাচীন আবাসস্থল। পরবর্তীতে এই জনগােষ্ঠী ভারতের আসাম হয়ে বর্তমান বসতি অঞ্চলে বসতি গড়ে তােলে এবং রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে বলে ইতিহাসসূত্রে জানা যায় । আরাকান রাজ্যের প্রাচীন ইতিহাস ‘রাজোয়াং’ গ্রন্থে ত্রিপুরা রাজ্যকে ‘খুরতন ও পাটিকারা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
মনিপুরী রাজ্যের ইতিহাস গ্রন্থে ‘তকলেঙ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ভারতের প্রাচীন ইতিহাস লেখকগণ ত্রিপুরা রাজ্যকে জাজিনগর বা জাজনগর’ নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। ইংরেজরা টিপেরা এবং পর্তুগিজরা টিপােরা’ নামে আখ্যায়িত করেছিলেন।
ত্রিপুরা মহারাজারা প্রাচীনকালে ফা উপাধি গ্রহণ করতেন। রত্নফার আমল থেকে ত্রিপুরা মহারাজারা ‘মানিক্য’ উপাধি ধারণ করেন। মহারাজ হামতর ফা বীর রাজ ৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন আরােহণ করেন।
হামতরফা অতিশয় শক্তিশালী এ প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন। এই মহারাজার রাজত্বকালে প্রথম চট্টগ্রাম ও পদ চট্টগ্রামে জনবসতি গড়ে উঠে ও আবাদ করা হয় বলে জানা যায়। এ বিষয়ে চিটাগাং ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার-এ উল্লেখ আছে-‘King Bira Raja of Tippera(Tripura) was the founder of Chittagong Hill Tracts in 590. তিনি ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশ জয় করেন এবং শেষার্ধ্বে আরাকান রাজ্য করে ত্রিপুরা সীমানা সম্প্রসারিত করেন।
হামতরফার পরবর্তী রাজা হলেন সেংতঙফা। তিনি যখন সিংহাসন আরােহণ করেন তখন ভারতবর্ষে মুসলিম শক্তির দাপট। মহারাজা ভীরু প্রকৃতির হলেও মহারাণীর সাহসে সাহসী হয়ে তিনি আক্রমণকারী গৌড় বঙ্গের সম্রাটের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। এই যুদ্ধে গৌর বঙ্গের নবাব তুলি খাঁ শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেছিলেন। এ যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় ১২৩৪ খ্রিস্টাব্দে।
ত্রিপুরা মহারাজা সেংতুঙফার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আচঙ্গা ত্রিপুরা সিংহাসনে আরােহণ করেন। মহারাজা আচঙ্গফার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র খিচংফা সিংহাসন আরােহণ করেন এবং খিচুংফার মৃত্যুর পর ডুসুরফা সিংহাসন আরােহণ করেন।
পিতার জীবদ্দশায় ৬৯২ ত্রিপুরাব্দে বা ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা রত্মফা সিংহাসন আরােহণ করেন। রত্নফাই প্রথম ত্রিপুরা রাজা যিনি ‘মানিক্য’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। রত্নফা মৃগয়ায় গিয়ে গােমতী নদীর উজানে ৩টি মহামূল্য মানিক্য রত্ন কুড়িয়ে পেয়েছিলেন বলে মানিক্য উপাধিতে ভূষিত হন।
রত্ন মানিক্যই প্রথম ত্রিপুরা রাজা যিনি ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্যে মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন। রত্ন মানিক্যের রাজত্বকালে ত্রিপুরা রাজ্যে তামা, পিতল ও লৌহজাত শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটানাে হয়। রত্ন মানিক্য আশ্রয়প্রার্থী ১০ হাজার বাঙালিকে ত্রিপুরা রাজ্যে পুনর্বাসিত করেছিলেন।
মহারাজা মহামানিক্যের মৃত্যুর পর ধর্ম মানিক্য ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন আরােহণ করেন। জীবনের প্রথম অবস্থায় বৈরাগ্যভাব উদিত হয়ে ধর্ম মানিক) বিভিন্ন তীর্থ ভ্রমণ করেন। একদিন কাশীর মনিকণিকা ঘাটে এক ব্রাহ্মণের কাছে জানতে পারেন তাঁর পিতার পরলােকগমন হয়েছে এবং ত্রিপুরার সিংহাসন তার জন্য অপেক্ষা করছে।
ব্রাহ্মণের নিকট থেকে এ খবর পেয়ে তিনি স্বরাজ্যে চলে যান এবং সিংহাসন আরােহণ করেন। সিংহাসন আরােহণ করে তিনি রাজ্য সম্প্রসারণের জন্য সচেষ্ট হন।তিনি প্রথমে তার পূর্বপুরুষ ত্রিপুরা রাজন্যবর্গের আদি বাসস্থান সুবর্ণ গ্রাম (বর্তমান সােনারগাঁও) দখল করেন।
তাঁর রাজত্বকালে ব্রহ্মরাজ কর্তৃক আরাকান রাজা মেং সাে মােয়ান সিংহাসন চ্যুত হলে মহারাজা ধর্ম মানিক্য আরাকান রাজাকে ত্রিপুরা রাজ দরবারে আশ্রয় প্রদান করেন এবং ত্রিপুরা সৈন্য পাঠিয়ে ব্রহ্মরাজকে পরাজিত করে মেং সাে মােয়ানকে সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। ধর্ম মানিক্য ৩২ বছর রাজত্ব করার পর ১৪৬২ খ্রি. পরলােক গমন করেন।
মহারাজা ধন্য মানিক্য ধর্মমানিক্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ধন্য মানিক্য সিংহাসন আরােহণ করে অত্যাচারী সেনাপতিদের সরিয়ে যােগ্য ও বিশ্বস্ত সেনা অফিসারদের সেনাপতি পদে বসান। অতপর তিনি রাজ্য সম্প্রসারণে সচেষ্ট হন।
তিনি সেনাপতি রায় কাচাগকে দিয়ে কুকি রাজ্য ও আরাকান প্রদেশ দখল করে ত্রিপুরা রাজ্যভুক্ত করেন। ধন্য মানিক্য বঙ্গদেশ জয় করেন এবং যুদ্ধে আলাউদ্দিন হােসেন শাহকে পর পর চার বার পরাজিত করেন।
মহারাজা ধন্য মানিক্য দুবার চট্টগ্রাম অধিকার করেন। প্রথমবার ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে এবং দ্বিতীয়বার ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ, পাঠান ও আরাকান এই ত্রিশক্তিকে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করে চট্টগ্রামকে ত্রিপুরা রাজ্যভুক্ত করেন।
তিনি চট্টগ্রামে সেনানিবাস স্থাপন করেন। তিনিই ভারতবর্ষের প্রথম সার্বভৌম রাজা যিনি মুদ্রায় বাংলা লিপি উত্তীর্ণ করেছিলেন। তিনি মহাভারত গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করিয়েছিলেন।
মহারাজা ধন্য মানিক্য সীতাকুণ্ড তীর্থের প্রবর্তক এবং শম্ভুনাথ মন্দিরের নির্মাতা। মহারাজা ধন্য মানিক্যের রাজত্বকাল ১৪৯০ খ্রি. থেকে ১৫২০ খ্রি. পর্যন্ত। মহারাজা বিজয় মানিক্য ত্রিপুরা রাজন্যবর্গের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল স্থান দখল করে আছে।
তিনি মহারাজ দেব মানিক্যের পুত্র এবং মহারাজা ধন্য মানিক্যের নাতি। মহারাজ বিজয় মানিক্য ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসন আরােহণ করেন।
তিনি পিতা নিক্যের আমলে হস্তচ্যুত হওয়া বঙ্গদেশ পুনরুদ্ধারে সংকল্পবদ্ধ হন। তিনি খ্রি. বঙ্গদেশ অভিযান করেন এবং এ অভিযানে অনায়াসে জয়লাভ করেন। মাজা বিজয় মানিক্য বঙ্গদেশ ছাড়াও মনিপুর ও খাসিয়া রাজ্য জয় করেন।
ত্রিপুরা রাজন্যবর্গের মধ্যে আরেক প্রতাপশালী মহরাজা ছিলেন মহারাজ মানিক্য ! এই মহারাজার বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন বঙ্গের বারাে ভূঁইয়া পর্যন্ত। বার ভূঁইয়াদের মধ্যে বীর বলে খ্যাত পাঠান বংশীয় ঈশা খাঁ ত্রিপুরা রাজার আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন।
ত্রিপুরা মহারাজা ঈশা খাঁকে ত্রিপুরা সেনাবাহিনীর আশ্বারােহী প্রধান করেছিলেন। মহারাজ অমর মানিক্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে পর্তুগিজদের বিতাড়িত করেন।
অমর মানিক্যের মৃত্যু হলে যুবরাজ রাজধর মানিক্য ১৫৮৬ খ্রি. সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি অতিশয় ধার্মিক ছিলেন। তিনি খুব বেশি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েননি। তবে মােগল সম্রাট ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হলে তিনি রুখে দাঁড়ান।
এই যুদ্ধে মােঘল সম্রাট পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে মােগল বাহিনী প্রচুর জানমালের ক্ষতির শিকার হয়। এই যুদ্ধে মােগল বাহিনীর তিনটি কামান ত্রিপুরা সেনাবাহিনী ছিনিয়ে রাখে।
পিতা রাজধর মানিক্যের মৃত্যু হলে যশােধর মানিক্য ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার সিংহাসনে আরােহণ করেন। মহারাজা যশােধর মানিক্যের সাথে মােগল সম্রাটের যুদ্ধ বাঁধে। এ যুদ্ধে যশােধর মানিক্য পরাজিত হন।
যশােধর মানিক্যের পর কল্যাণ মানিক্য ত্রিপুরার সিংহাসন আরােহণ করেন। তিনি ১৬২৬ খ্রি. ত্রিপুরার সিংহাসন আরােহণ করেন। তিনি বাংলার নবাব সুজাউদৌল্লার সাথে এক ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হন। এ যুদ্ধ হয় কুমিল্লার কসবা অঞ্চলে। এ যুদ্ধে নবাব সুজাউদৌল্লাহ শােচনীয়ভাবে পরাজিত হন।
ত্রিপুরা মহারাজা কল্যাণ মানিক্যই ভারতবর্ষের প্রথম রাজা যিনি প্রথম বাংলায় তাম্রশাসন চালু করেছিলেন। এই মহারাজা ৩৩ বছর রাজত্ব করে ১৬৫৯ খ্রি. মৃত্যুবরণ করেন। পিতা কল্যাণ মানিক্যের মৃত্যু হলে মহারাজা গােবিন্দ মানিক্য ত্রিপুরার সিংহাসন আরােহণ করেন ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে।
রাজা হয়েও তিনি ঋষির ন্যায় জীবনযাপন করতেন বলে তিনি ইতিহাসে রাজর্ষি নামে খ্যাত। বৈমাত্রেয় ভাই নক্ষত্র রাতে ষড়যন্ত্র ও ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি থেকে মুক্তিলাভের জন্য তিনি স্বেচ্ছায় নির্বাসনে বেরিয়ে পড়েন।
নির্বাসিত জীবনের প্রথম পর্যায়ে তিনি বর্তমান খাগড়াছড়ি দীঘিনালা এলাকায় অবস্থান করেছিলেন। সে সময় তিনি এক দীঘি খনন করেন সেই থেকে রিয়াং অধ্যুষিত এই এলাকার নাম হয় ‘দীঘিনালা’। গােবিন্দ বন্ধুর নিদর্শন স্বরূপ কুমিল্লা নগরীতে শাহ সুজা মসজিদ’ নামে এক উৎকৃষ্ট মসজিদ নির্মাণ করেন।
মহারাজা কৃষ্ণ কিশাের মানিক্য ১৭৬০ খ্রি. ত্রিপুরার সিংহাসন আরােহণ করেন। মহারাজা কৃষ্ণ কিশাের মানিক্যকে ত্রিপুরা রাজন্যবর্গের মধ্যে সবচেয়ে দুর্ভাগা ও ভাগ্য বিড়ম্বিত রাজা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
মহারাজা কৃষ্ণ কিশাের মানিক্যের সাথে মীর কাশিমের মধ্যে চাকলা ও চাকলা রােশনাবাদ অঞ্চলের রাজস্ব প্রশ্নে এক ভীষণ কলহের সূত্রপাত হয়। মীর কাশিম ত্রিপুরা রাজাকে পরাস্ত করার জন্য ব্রিটিশের শরণাপন্ন হন। ব্রিটিশ এটিকে উপযুক্ত সময় মনে করে।
এখনই উপযুক্ত সময় চাকলা রােশনাবাদ, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামকে পুরােপুরি অধিকার করার। ফলে ব্রিটিশের সাথে মহারাজা কৃষ্ণ কিশাের মানিক্যের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মহারাজা কৃষ্ণ কিশাের মানিক্য পরাজিত হন এবং ব্রিটিশের সাথে এক সন্ধিতে উপনীত হতে বাধ্য হন।
মহারাজা দুর্গা মানিক্য ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি অতিশয় ধর্মপরায়ণ ছিলেন। মহারাজা দুর্গা মানিক্য হাজার হাজার মাইল দূরে বারানসীতে একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দুর্গা মানিক্যের রাজত্বকালে কোনাে ধরনের যুদ্ধ বিগ্রহ ঘটেনি।
মহারাজা রামগঙ্গা মানিক্য ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। মহারাজা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মােগড়া গ্রামের নিকটে ‘গঙ্গাসাগর’ নামে এক বিরাট দীঘি খনন করেন। তিনি ১৮২৬ খ্রি. প্রাণত্যাগ করেন।
মহারাজা গঙ্গা মানিক্যের মৃত্যুর পর মহারাজা কাশি চন্দ্র মানিক্য ১৮২৬ খ্রি. সিংহাসনে আরােহণ করেন। পিতা কাশী চন্দ্র মানিক্য ১৮২৯ খ্রি. মৃত্যুবরণ করলে মহারাজা কৃ’ কিশাের মানিক্য ১৮৩০ সালে ত্রিপুরার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। ত্রিপুরা মহারাজা কৃ’ কিশাের মানিক্যের সাথে ব্রিটিশ প্রতিনিধির দুবার বিরােধ বাধে।
চট্টগ্রামের কমিশনার মি. হার্ভে ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণের অভিপ্রায়ে ব্রিটিশ গভর্মেন্টের গভর্নর জেনারেল-এর নিকট এই মর্মে প্রস্তাব করেন যে, ত্রিপুরা রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত। রাজ্যটি দখল করা উচিত।
ইংরেজ গভর্নর মি. অকল্যান্ড বিষয়টি পর্যালােচনা করে চট্টগ্রামের কমিশনারকে এক চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে, Tippera is an independent territory that your proposition for its resumption are totally inadmissible. That the Maha Raja has full right within his territory to levy any duty he please.
মহারাজা ঈশান চন্দ্র মানিক্য ১৮৫০ খ্রি. ত্রিপুরার সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি ১১ বছর রাজত্ব করেন এবং ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ঈশান চন্দ্র মানিক্য ইহকাল ত্যাগ করলে বীর চন্দ্র মানিক্য ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার সিংহাসনে আরােহণ করেন।
তিনি একাধারে কবি, গায়ক ও চিত্রশিল্পী ছিলেন। তিনি বহু ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। মহারাজা বীর চন্দ্র যথাক্রমে ১৮৭৭ ও ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রীতদাহ প্রথা ও সতীদাহ প্রথা ঘােষণা করেন। মহারাজা বীর চন্দ্র মানিক্য তৈতন প্রথাও (বিনা পারশ্রমিক কর্মচারীদের শ্রম দানকে তৈতন প্রথা বলা হয়) নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন।
বীর চন্দ্র মানিক্য ভাষাবিদ ও নামকরা সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি মাতােস ককবরকের ন্যায় বাংলা, ইংরেজি, ফার্সি, উর্দু ও মনিপুরী ভাষায় লিখতে ও পড়তে পারতেন। এই সুপণ্ডিত মহারাজা ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে পরলােকগমন করেন।
পিতা বীরচন্দ্র মানিক্যের মৃত্যু হলে মহারাজা রাধা কিশাের মানিক্য ত্রিপুরার সিংহাসনে আরােহণ করেন ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে। মহারাজা বীর চন্দ্র মানিক্যের সময়কালে ভূমিকম্পের কারণে রাজপ্রাসাদ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মহারাজা রাধা কিশাের পূর্ব পুরুষের রাজপ্রাসাদকে মেরামত না করে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত কোম্পানি মার্টিন এন্ড বার্নকে দিয়ে অমর স্থাপত্য ‘উজ্জয়ন্ত রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন।
তার আমলে সীতাকুণ্ড তীর্থে তুলসীবতী বিরামছত্র নির্মাণ করা হয়। মহারাজা রাধা কিশাের মানিক্য জগদীশ চন্দ্র বসুর বিজ্ঞান গবেষণা, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ইত্যাদি মহৎ কাজে অকাতরে অর্থ দান করেছিলেন। মহারাজা রাধা কিশাের মানিক্য ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে সারনাথের এক মােটর দুর্ঘটনায় পরলােক গমন করেন।
পিতা রাধা কিশাের মানিক্য ইত্যাগ করলে ত্রিপুরার সিংহাসন আরােহণ করেন বীরেন্দ্র কিশাের মানিক্য ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে। তিনি শিল্প ও শিক্ষা প্রসারে বহু উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি চা শিল্প গড়ে তােলার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তার শাসনামলে ৪০টি চা বাগান গড়ে তােলা হয়েছিলাে। তিনি ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে সীতাকুণ্ড তীর্থে ভৈরব মন্দির নির্মাণ করেন।
মহারাজা বীরেন্দ্র কিশাের মানিক্য ১৪ বছর শাসন করার পর ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। ত্রিপুরা জাতির সর্বশেষ স্বাধীন রাজা বীর বিক্রম কিশাের মানিক্য ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ১৬ বছর বয়সে স্বাধীন ত্রিপুরার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। মহারাজা বীর বিক্রম মানিক্যের শাসনামলের অমর কীর্তির মধ্যে অন্যতম হলাে বর্ষাকালীন স্বপ্নপুরী রাজপ্রাসাদ নীড়মহল।
মহারাজা বীর বিক্রম কিশাের মানিক্য ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মার্চ জামিদারি চাকলা রােশনাবাদের শুভ পুণ্যাহ উপলক্ষে বাণিজ্যিক রাজধানী নগরী কুমিল্লায় ( তৎকালীন ত্রিপুরা জেলা) পদার্পণ করেন তিনি প্রকাশ্যে দরবার আহবান করে কুমিল্লাবাসীর
সমস্যার কথা জানার চেষ্টা করেন এবং জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য বিভিন্ন জনমুখী প্রতিষ্ঠানকে প্রভূত অর্থ দান করেন। স্বাধীন ত্রিপুরার সর্বশেষ রাজার অকাল মৃত্যুতে মহারাণী কাঞ্চন প্রভাদেবী ত্রিপুরার সিংহাসনে আরােহণ করেন।
এ ছিল এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ যখন ভারতবর্ষ থেকে বিটিশ শাসন গুটিয়ে যাবার পালা। এ সময়কালে মহারাজার মৃত্যু ত্রিপুরা রাজ্যকে এক সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়। মহারাজার জ্যেষ্ঠপুত্র কীরিট বিক্রম নিতান্ত বালক।
তাই রাণীকে অগত্যা সিংহাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ও ১৫ আগস্টে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীন হলাে। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ত্রিপুরা রাজ্যে শক্তিশালী শাসকের অভাবের কারণে অবশেষে ১৯৪৯ সালে এক চুক্তির মধ্য দিয়ে ত্রিপুরা রাজ্য ভারত ইউনিয়নে যােগ দেয়।
এই চুক্তির মধ্য দিয়ে ১৫০০ বছরের গৌরবময় ত্রিপুরা জাতির সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলাে। ত্রিপুরা জাতি পরিণত হলাে এক পরাধীন জাতিতে।
ত্রিপুরা রাজ্যের পরিধি
শুরুতেই উল্লেখ করেছি ত্রিপুরা জাতি ভারতবর্ষে এক পরাক্রমশালী জাতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং হাজার বছর ধরে শৌর্যে বীর্যের সাথে সুবিস্তৃত ত্রিপুরা রাষ্ট্র শাসন করেছিল। ত্রিপুরা জাতির রাষ্ট্র শাসনের ইতিহাস এতই প্রাচীন এর সবটিই লিখিত আকারে পাওয়া যায়নি।
৫৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে এ জাতির রাষ্ট্র শাসনের ইতিহাস লিখিত আকারে পাওয়া যায়। ত্রিপুরা জাতির এর পূর্বেকার শাসনের ইতিহাস অলিখিত বিধায় পরিষ্কার নয়।
৫৮৫ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল অবধি ১৩৬৪ বছর যাবত ত্রিপুরা রাষ্ট্র স্বাধীন ছিল এবং এই সময়কালে ১৭৮ জন ত্রিপুরা মহারাজা ত্রিপুরা রাষ্ট্র শাসন করেছিলেন। ত্রিপুরা রাষ্ট্রের সীমানা ছিল— উত্তরে তৈরঙ্গ নদী বা ব্রক্ষপুত্র, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে মণিপুর, পশ্চিমে বঙ্গদেশ।
বঙ্গোপসাগরের পাদদেশে অবস্থিত চট্টগ্রাম প্রথমদিকে ত্রিপুরা মহারাজাদের অধীনে ছিল। রাজপুত্রদের মধ্যে কলহের সুযােগ নিয়ে আরাকান রাজ চট্টগ্রাম দখল করে।
এরপর চট্টগ্রাম অঞ্চলটি ত্রিপুরা মহারাজ ও আরাকান রাজের মধ্যেকার এক যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হয়। এই চট্টগ্রাম অঞ্চলটি কখনাে ত্রিপুরা মহারাজ আবার কখনাে আরাকান মহারাজের অধীনে ছিল। পরবর্তীতে মােঘল ‘ এসে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
তখন থেকেই চট্টগ্রাম হয়ে দাঁড়ায় তিন র লড়াই ক্ষেত্র। তাই ইতিহাসে দেখা যায় যে, চট্টগ্রাম অঞ্চলটি কখনাে ত্রিপুরা মাজার, কখনাে বা আরাকানের আবার কখনাে বা মােঘল সম্রাটের অধীনে ছিল।
১৫২৮ সাল থেকে মহারাজা বিজয় মানিক্য ত্রিপুরা রাজ্যের একজন পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। তিনি সুদীর্ঘ ৪৭ বছর রাজত্ব করেন। দিল্লীর সম্রাট বাদশাহ আকবর এর দরবারের ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে উলে্লখ করেন, ভাটি প্রদেশের হুগলী নদীর তীর মেঘনা নদীর তীর পর্যন্ত একটি স্বাধীন রাজ্য আছে। সেই রাজ্যের নাম ত্রিপুরা। রাজার নাম বিজয় মানিক্য। যিনি রাজা হন তিনিই নামের অন্তে মানিক্য উপাধি ধারণ করেন।
সেই রাজ্যেও আমীর ওমরাহগণ নানান উপাধি পেয়ে থাকেন। এই রাজার দুই লক্ষ পদাতিক, এক সহস্র হস্তি আছে কিন্তু অশ্ব অতি বিরল। [কৈলাশ চন্দ্র সিংহ, রাজমালা]।
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ হােটেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সময় প্রকাশিত ফোল্ডারে উল্লেখ করা হয় যে, ‘Historically Chittagong was a small fishing village in the ancient kingdom of Tippera.’
PSandy’s view in AD 590 : The Tripura Raj comprised the present British district to Chittagong, Noakhali, Tippera, Sylhet, Kachar, the Garo Khasi Gaintia Hills, Lushai land and the Chittagong Hill Tracts Tripura, (Saigal, 1917; 494)।
Imperial Gezetteer of India Provincial Series Eastern Bengal and Assam-এর ৬৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, The ancient Kingdom of Tippera at various times extended its rules from the Sunderban in the west to Burma in the east and north was as far as Kamarup.
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আগমনের পর ত্রিপুরা রাষ্ট্রের সীমানা ক্ষুদ্র আকার ধারণ করতে থাকে। ত্রিপুরা রাষ্ট্রের অংশ বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা, নােয়াখালী, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্রিটিশ ভারতের অধীনে চলে যায়। ত্রিপুরা রাষ্ট্রের উত্তর ও পূর্বদিকের সীমানাও সংকীর্ণ হতে হতে বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা অবধি সংকুচিত হয়।
বর্তমানে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা উত্তরে সিলেট ও আসাম প্রদেশ, দক্ষিণে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, পূর্বে মিজোরাম ও পশ্চিমে সিলেট, কুমিল্লা ও নােয়াখালী জেলা। ত্রিপুরা রাজ্যের বর্তমান আয়তন ৪০৮৬ বর্গমাইল। পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্যের আয়তন ছিল ৭৫,০০০ বর্গমাইল।
ত্রিপুরাদের ব্রিটিশ বিরােধী কৃষক বিদ্রোহ
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের ত্রিপুরাদের উপর ব্রিটিশদের প্রভাব সম্পর্কে সামান্য ধারণা পাওয়া যায়। তার মধ্যে অন্যতম হলাে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিটিশদের বিরুদ্ধে জুমকর বিরােধী কৃষক আন্দোলন। আমেনা মােহসীন (১৯৯৭:৩০) ও হােসাইন (১৯৯০ঃ১২২) গবেষণায় জুমকর বিরােধী আন্দোলন প্রসঙ্গে ত্রিপুরাদের ভূমিকা সম্পর্কে জানা যায়।
তারা উল্লেখ করেছেন যে, ব্রিটিশ শােষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে ত্রিপুরারা সুসংগঠিত ছিল। এমনকি তারা ব্রিটিশদের জুমকর প্রদানে বিরত ছিল। সে পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলকে নিয়ে আলাদা মহকুমা সৃষ্টি করেছিল।
ঔপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর স্বার্থবিরােধী ও শােষণের বিরুদ্ধে অবস্থান করার ক্ষেত্রে ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর প্রতি ঔপনিবেশিক শাসকদের এ ধরনের মনােভাব বা অভিব্যক্তি তা বর্ণবাদী মানসিকতার পরিচয় বহন করে।
ত্রিপুরা মহারাজার বিরুদ্ধে ত্রিপুরা কৃষক প্রজাদের বিদ্রোহ ত্রিপুরা মহারাজা বীর বিক্রম কিশাের মানিক্যের রাজত্বকালে অতিরিক্ত করারােপ এবং রাজকর্মচারী ও রায়চৌধুরীদের নানারকম অত্যাচারের বিরুদ্ধে ত্রিপুরা জনগণের এক বিদ্রোহ সংঘটিত হয় যেটি ইতিহাসে ‘রিয়াং বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত।
এই বিদ্রোহ প্রথমদিকে কিছুটা ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে উঠলেও পরবর্তীতে তা রাজবিদ্রোহ রূপে পরিণতি লাভ করে। এই বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন রতনমনি ত্রিপুরা।
বিদ্রোহটি ইতিহাসে রিয়াং বিদ্রোহ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় রতন মনি ত্রিপুরার নামও রতন মনি রিয়াং হয়ে যায়। রতন মনি ত্রিপুরা প্রথমে রামগড়ে বসবাস করতেন। পরে তিনি দক্ষিণ ত্রিপুরায় চলে যান।
তিনি দক্ষিণ ত্রিপুরার অমরপুরের পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রম তৈরি করে বসবাস করেন। দক্ষিণ ত্রিপুরার বহু লােক তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ও তার শিষ্যরাই পরবর্তীতে মুক্তিকামী রিয়াং গােত্রের ত্রিপুরা জনগণের নেতৃত্ব দেয়।
ত্রিপুরা মহারাজার রাজস্ব সংগ্রহ করার জন্য এলাকায় সর্দার বা প্রতিনিধি নিয়ােগ করা থাকতাে। ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর রিয়াং গােত্রের এলাকায়ও সে রকম সর্দার ছিল যারা রাজস্ব সংগ্রহ করতেন।
বিনিময়ে এ সব সর্দারদের কোনাে প্রকার রাজস্ব প্রদান করতে হতাে না। সর্দার ও রাজ কর্মচারীগণ সুযােগ পেয়ে নিরীহ ও অসহায় প্রজাদের উপর জুলুম শুরু করে দিয়েছিলেন। এমনিতেই ত্রিপুরা প্রজা সাধারণের দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী।
উপরন্তু ১৯৪২-৪৩ খ্রি. জুমের ফসল ভালাে না হওয়ায় এিপুরাদের অবস্থা অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। তার উপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চাপ। মহারাজার নির্দেশে যুদ্ধের সৈনিকদের জন্য ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান চলতে থাকে। রাজার কর্মচারীরা জোর করে দরিদ্র প্রজাদের নিকট থেকে নামমাত্র মূল্যে ধান চাল সংগ্রহ করতে লাগলেন।
এদিকে মহারাজার ঘরচুক্তি কর ও অন্যদিকে পুলিশের অত্যাচারে প্রজাগণ একেবারেই অতিষ্ঠ। এসব কারণে দক্ষিণ ত্রিপুরার রিয়াং গােত্রের ত্রিপুরা জনগণ মহারাজা ও তাঁর সর্দারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মহারাজা বীর বিক্রম কিশাের মানিক্য প্রজাদের মধ্য থেকে সৈন্য সংগ্রহে সচেষ্ট হন। রিয়াং যুবকগণ এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। রিয়াং রায়চৌধুরীরা মহারাজাকে জানালেন যে, রতন মনিই রিয়াংদের সেনাবাহিনীতে যােগদানে বাধা প্রদান করছে।
খাদ্যের অভাবে রিয়াংরা জর্জরিত হয়ে উঠলে রতনমনির নেতৃত্বে কিছু রিয়াং রায়চৌধুরীদের বাড়ি ঘর থেকে ধানচাল লুট করে নিয়ে আসে এবং তা জনগণের মাঝে বিলি করে দেয়।
রায়চৌধুরীরা মহারাজাকে আবার জানালেন যে, রতনমনির নেতৃত্বে তার শিষ্যরা রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে। এই সংবাদ পেয়ে বীরবিক্রম কিশাের মানিক্য রতনমনিকে গ্রেফতার করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী পাঠালেন।
রাজার সশস্ত্র বাহিনীর সংগে রতনমনির লােকদের সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বহু লােক হতাহত হয়। এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য মহারাজার সশস্ত্র বাহিনীর লােকেরা রিয়াংদের উপর ভয়ানক অত্যাচার শুরু করে দেয়।
রাজার বাহিনীর লােকেরা রিয়াংদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। অনন্যোপায় হয়ে রতনমনি ও তাঁর কিছু শিষ্য পার্বত্য চট্টগামে পালিয়ে যায়। ব্রিটিশ সৈন্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের গ্রেফতার করে আগরতলায় পাঠিয়ে দেয়।
আগরতলায় অস্বাভাবিকভাবে রতন মনির মৃত্যু হয়। অনেকে সন্দেহ করেন যে, তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। এভাবে মহারাজা বীর বিক্রম কিশাের মানিক্য এবং মহারাজার কর্মচারী-প্রতিনিধিদের অতিরিক্ত করারােপ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিরীহ জনগণের বিদ্রোহ ও সংগ্রামের অবসান ঘটে। বলা যায়, এই বিদ্রোহ ছিল একাধারে ত্রিপুরা মহারাজা ও ব্রিটিশের বিরুদ্ধে এক জনবিদ্রোহ।
মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরাদের ভূমিকা
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য জনগােষ্ঠীর মতাে ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীরও ছিল বলিষ্ঠ ভূমিকা। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষত বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে যে যুদ্ধ হয় সে যুদ্ধে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দেয় হেমদারঞ্জন ত্রিপুরা। কোম্পানি কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা পুরাে এক প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধাসহ ১৯৭১ সালের ১৩ আগস্ট তৎকালীন মহকুমা সদর রামগড়ের পাকবাহিনীর সদর দপ্তরে আক্রমণ করেন।
১০ সেপ্টেম্বর বর্তমান মানিকছড়ি উপজেলার ডাইনছড়ি চেপ্রু পাড়া এলাকায় পাকবাহিনীর উপর এ গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করেন। হেমদারঞ্জন ত্রিপুরা এই মানিকছড়ি এলাকায় বেশ কয়েকবার পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকবাহিনী একজন ক্যাপ্টেনসহ ১৩ জন পাকহানাদার সদস্যকে খতম করে।
মুক্তিযুদ্ধে আরো অংশগ্রহণ করেন রঞ্জিত ত্রিপুরা, রাজেন্দ্র ত্রিপুরা, রণবিক্রম ত্রিপুরাসহ বহু ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লােক। অপরদিকে বরেন ত্রিপুরা ছিলেন একজন মুক্তিযােদ্ধা সংগঠক। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থান করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বহন করেন। ত্রিপুরারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও তা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি।
ত্রিপুরাদের সামাজিক সংগঠন
ত্রিপরা সমাজ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। পিতাই পরিবারের প্রধান এবং পিতার পরিচয়েই সাধারণত সন্তানদের বংশ পরিচয় নির্ধারিত হয়। অবশ্য ত্রিপুরাদের কোনাে কোনাে গোত্রে মেয়ে সন্তানরা মায়ের বংশ পরিচয়ে পরিচিত হন। যেমন ফাদভ, দেনদাউ, গাবিং ইত্যাদি গোত্রে মেয়ে সন্তানরা মায়ের বংশ পরিচয়ে পরিচিত হন।
গোত্র বা দফা
ত্রিপুরা জাতি ৩৬ দফা বা গােত্রে বিভক্ত। এগুলি হলাে—দেনদাউ, গাবিঙ, খালি, নাইতুঙ, ফাদুঙ, তুঙবাই, হারবাঙ, কেওয়া, উসুই, কেমা, রিয়াং, জমাতিয়া, আসলং, গর্জং, খাকুলু, কলই, মােকচাক, মুইচিং, গাইগ্রা, বেরী, রুপিনী, মলসম, হাপাং, বংচের, বঙ, জানতং, চরই, দাম্পা, মংবাই, হালাম, কলি, মুরাসি, মাখা, মাইপালা।
তবে বাংলাদেশে এই ৩৬ দফার মধ্যে সম্ভবত ১৩/১৪টি দফা বাস করে । এগুলি হলাে—দেনদাউ, গাবি, খালি, নাইতুঙ, ফাদুঙ, হারবাঙ, কেওয়া, উসুই, কেমা, রিয়াং, মাইপালা, আসলং ইত্যাদি। ত্রিপুরাদের যে ৩৬টি দফা রয়েছে তার প্রত্যেকটির আবার বেশ কয়েকটি গােষ্ঠী রয়েছে।
ত্রিপুরা ব্যক্তির জীবনচক্র
জন্ম
ত্রিপুরা সমাজে শিশু জন্ম হলে জন্মের পরে পরে গুমাচৗক (দাত্রী), অচাই (পৌরিহিত) মিলে ছড়া বা নদীতে যেয়ে পূজা দিতে হয়। এ পূজাকে বলা হয়—কউমা বৗতৈ লানাই’; হলুদ, সুকই বমলক ও পানি মিশিয়ে কউমা বৗতৈ’ তৈরি করতে হয়। সেই কউমা বৗতৈ বাঁশের চুঙায় করে বাড়িতে নিয়ে যেতে হয়।
পূজা দেওয়ার পর সেই বাঁশের চুঙার কউমা বৗতৈ-এর সাথে পূজায় বলি দেওয়া মুরগির রক্ত মেশাতে হয়। গুমাচৗকসহ যেসব নারী-পুরুষ সন্তান প্রসবের সাথে পৃক্ত ছিল তাদের সবার শরীরে কউমা বৗতৈ’ ছিটিয়ে দিয়ে শুদ্ধ করতে হয়। শরীর থেকে নাভি পৃথক হবার পর আবার মুরগি কেটে নদী বা ছড়ায় গিয়ে পূজা দিতে হয়।
তবে ত্রিপুরা সমাজে শিশুর জন্য সংক্রান্ত সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হলাে—আবিয়াক সুনায় পাণ্ডা বা নামকরণ অনুষ্ঠান। ছাগল, শূকর, মুরগি কেটে এই আবিয়াক সুনায় অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে গুনাটক, অচাই, সন্তান প্রসবকালীন সহযােগিতায় যারা ছিলেন তাদের এবং আত্মীয়স্বজনকে অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করা হয়।
এই অনুষ্ঠানেই শিশুর নামকরণ করা হয়। যে বা যারা নবশিশুর নাম দিতে চায় তারা সবাই এক একটি নাম প্রস্তাব রেখে প্রদীপ জ্বালিয়ে নামকরণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিনীর প্রদীপ শেষ পর্যন্ত জ্বলতে থাকবে তার প্রস্তাবিত নামানুসারে শিশুটির নাম চূড়ান্ত হবে। এভাবে সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ত্রিপুরা সমাজের নব শিশুর নামকরণ করা হয়।
বিবাহ
ত্রিপুরা সমাজ ব্যবস্থায় চার ধরনের বিবাহ ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায় । এগুলি হলাে :
১. হামজাকলাই লামা,
২. খকয়ৈই লামা,
৩. ফারান খৗলায়ৈ লামা ও
৪. চামিরি কামা।
হামজাক-লাই লামা
কোনাে বিবাহ যদি উভয় পক্ষের অভিভাবক ও ভাবী বর-কনে এর সম্মতিক্রমে সামাজিক অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয় তাকে ত্রিপুরারা হামজাক-লাই লামা বিবাহ বলে। হামজাক-লাই লামা দু পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। যেমন—
ক. ত্রিপুরাদের একেবারেই সনাতন পদ্ধতি অনুসারে মা-বাবা ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনরাই ছেলের জন্য বউ ঠিক করে। ছেলের পক্ষে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন ও ঘটক বউ দেখতে যায়। বউ দেখতে যাবার সময় ত্রিপুরাদের রীতি অনুসারে কনে পক্ষকে পিঠা, মদ, নারিকেল ইত্যাদি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয়। একটি ভালাে দিন দেখে বরপক্ষ বউ দেখতে যায়। কনেপক্ষও বরপক্ষকে আন্তরিকতা সহকারে আদর আপ্যায়ন করে।
ত্রিপুরা সমাজে বউ প্রস্তাবনার কথামালাও সাহিত্যরসে ভরপুর। বর পক্ষ কনে পক্ষের নিকট সাহিত্যরস দিয়ে সুন্দরভাবে এ প্রস্তাবনা উপস্থাপন করে। বরপক্ষ বলে—“আমরা বড় একটি আশা নিয়ে আপনাদের সমীপে উপস্থিত হয়েছি আমরা পরিশ্রান্ত । আপনাদের ছায়া বটবৃক্ষের ন্যায় সুশীতল ও প্রসারিত। আমরা এ ছায়াতে আশ্রয় লাভের কামনা করছি।’
বর পক্ষের প্রস্তাবে কনেপক্ষ রাজি হলে বলেন, আপনাদের আশ্রয় প্রদান ও ক্লান্তি নিবারণের উপযুক্ত ক্ষমতা ও যােগ্যতা আমাদের নেই। তথাপি আপনারা আমাদের অপর্যাপ্ত ছায়ায় আশ্রয় চেয়ে কৃতার্থ করেছেন। আমরা সানন্দে আপনাদের গ্রহণ করেছি।’
আর যদি প্রস্তাবে কন্যাপক্ষ রাজি না হয়, সেক্ষেত্রে বলেন, “আমাদের পর্ণকুটিরে আপনাদের পদধূলি আমাদেরকে ধন্য করেছে। আমরা পূর্ণিমা তিথিলগ্নে সাগরের জোয়ার অপেক্ষা করছি, অপেক্ষা করছি বসন্তের মৃদু সমীরণের। এই বউ প্রস্তাবনা অনুষ্ঠানে কন্যার মা-বাবা ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন উপস্থিত থাকেন।
বিবাহ বিষয়ে উভয় পক্ষ যদি ঐক্যমতে উপনীত হয়, তাহলে বিবাহের দিন-তারিখ নির্ধারণের জন্য বর পক্ষকে আরেকবার আসতে হয়। এই বৈঠকে বিবাহের দিন-তারিখ চূড়ান্ত করা হয় এবং বিবাহ সংক্রান্ত অন্য বিষয়াদি আলােচনাক্রমে ঠিক করা হয়।
খ. হামজাক লাই লামার দ্বিতীয় পদ্ধতি হলাে—অভিভাবক বা আত্মীয়-স্বজন নয়, বর নিজে প্রথম কোনাে মেয়েকে পছন্দ করে। ত্রিপুরা সামাজিক রীতি অনুসারে ত্রিপুরা যুবকেরা রাতে যুবতীদের কাছে বেড়াতে যায়। জুমের ধান কাটার পর ত্রিপুরা যুবকেরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে যুবতীদের নিকট বেড়াতে যায়।
এভাবে ত্রিপুরা যুবক-যুবতীর মধ্যে মনের মিলন ঘটে এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার জন্য ঐকমত্য হয়। যুবক-যুবতীর মধ্যে পছন্দ ও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার সিদ্ধান্তের পর কনের মা-বাবার সম্মতিক্রমে কনের আত্মীয়স্বজন বর দেখতে যায়।
বর পক্ষের মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজন এ বিবাহে সহমত পােষণ করলে উক্ত যুবক-যুবতীর বিয়ে সম্পন্ন হতে পারে। কোনাে পক্ষের অভিভাবকের সম্মতি ব্যতিরেকে এ ধরনের বিবাহ অনুষ্ঠিত হতে পারে না।
খকয়ৈ লামা
কোনাে একটি অভিভাবক পক্ষ বা উভয় অভিভাবক পক্ষের সম্মতি ব্যতিরেকে বর-কনে এর সম্মতিক্রমে যদি কোনাে বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় সে বিয়েকে আমরা ‘খকয়ৈ লামা’ বলতে পারি। এ ধরনের বিয়েতে যদি বর পক্ষের অভিভাবকের মত থাকে সেক্ষেত্রে কনের বাড়িতেই সামাজিকভাবেই বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে থাকে।
বিয়ের অনুষ্ঠান করার আগে বা পরে দেরি না করে কনে এর মা-বাবাকে উক্ত বিয়ের কথা জানাতে হয়। আর যদি এ বিয়েতে বর এর অভিভাবকদের মত না থাকে সেক্ষেত্রে নব দম্পতি বর-এর কোনাে না বাড়িতে যেয়ে উঠে এবং সেখানেই বিয়ের প্রাথমিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়।
চামিরি কামা
বর-কনে ও উভয় পক্ষের অভিভাবকদের সম্মতি সামাজিক অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে যে বিয়ে কনের বাড়িতে বিয়ে অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়, সে বিয়েকে ‘চামিরি কামা’ বলে। এই বিয়ের মাধ্যমে বর কনের বাড়িতে যায় এবং কনের বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। যে সব চামিরি বা বর আর্থিক অবস্থা ভালাে নয় সাধারণত তারাই কনের বাড়িতে বর হিসেবে উঠে যায়।
কোনাে পরিবারে ছেলে সন্তান না থাকলে সে-পরিবারের অভিভাবকরা মেয়ের জন্য পছন্দসই বর পেলে মেয়ে সন্তানের জন্য জামাই তুলে নিজের বাড়িতে। এটাকেই ত্রিপুরা সমাজে চামিরি কামা’ বলে।
বিশিষ্ট লেখক প্রভাংশু ত্রিপুরা-এর মতে ত্রিপুরা বিবাহ ৩ প্রকার। যথা : ১. কাইজালাই কৗচাং, ২. কাইজালাই বচং ও ৩. কাইজালাই কুসুর।
ত্রিপুরাদের সনাতন রীতি অনুসারে বর পক্ষ কনে পক্ষকে দাফা বা নগদ অর্থ দিতে হয়। মা-বাবা কন্যা সন্তানকে অনেক কষ্ট করে ছােট থেকে বড় করেছে। কন্যা এখন বড় হয়েছে। পরিবারের আয়-উৎপাদনে সহযােগিতার উপযুক্ত সময় এখন।
এ সময়ে তাদের বিয়ে দিতে হচ্ছে। তাই যে বর পক্ষ কনে পক্ষের পরিবারের কন্যা সন্তানকে বউ করে নিয়ে যাচ্ছে সেই কন্যার শিশু অবস্থা থেকে বর্তমান অবধি যে সব খরচ হয়েছে সে সব খরচ বর পক্ষকে দিয়ে যেতে হবে—এ হলাে দাফা’ রীতির মূল কথা।
এ রীতি ত্রিপুরা সমাজে অনেক প্রাচীন। তবে বর্তমানে নানা সামাজিক পটপরিবর্তনের ফলে এ রীতির প্রচলন বেশ হ্রস পেয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলােতে মাত্র কিছু পরিমাণে এ রীতির প্রচলন পরিলক্ষিত হয়।
বিধবা বিবাহ ও বহু বিবাহ
ত্রিপুরা সমাজে বিধবা বিবাহের প্রচলন আছে। বিধবা বিবাহ ত্রিপুরা সমাজে সিদ্ধ। ত্রিপুরা সমাজে অতীতে বহু বিবাহের রীতি সীমিত আকারে থাকলেও বর্তমানে এ রীতির প্রচলন নেই বললেই চলে। তবে অতীতকাল থেকে এ রীতি সমাজে নিন্দনীয় ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত।
বিবাহ বিচ্ছেদ
ত্রিপুরা সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা নিতান্ত কম। কম হলেও এ রীতিও ত্রিপুরা সমাজে সিদ্ধ। সন্তান জন্মলাভের যােগ্যতা না থাকা, ব্যাভিচার, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার বিভিন্ন কারণে এক সাথে সংসার করার কারণে অসামর্থ্যতা ইত্যাদি বিবাহ বিচ্ছেদ হতে পারে। ত্রিপুরা সমাজে শালিসের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ করা হয়ে থাকে।
গোত্র/গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ প্রথা
ত্রিপুরা সমাজে যে ৩৬টি গােত্র রয়েছে এই গোত্রগুলির মধ্যে বিবাহ সিদ্ধ। একই গােত্রের মধ্যেও বিবাহ সিদ্ধ । অতীতে এক গোত্রের সাথে অপর গােত্রের মধ্যেকার বিবাহ হয় না বললেই চলে। এক গােত্রের সাথে অপর গােত্রের নারী পুরুষের মধ্যেকার বিবাহের সূচনা সময়কাল সম্ভবত ১০০ বছরের বেশি হবে না।
তবে এক গােষ্ঠীর সাথে অপর গােষ্ঠীর নারী পুরুষের মধ্যেকার বিবাহ যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ বিবাহ হচ্ছে—১. আপন ভাইবােন; ২. আপন খালা, চাচা-চাচি, মামা-মামি; ৩.আপন খালাতাে ভাইবােন, চাচাতাে ভাইবােন, মামাতাে ভাইবােন এবং ৪. সৎ মা, সৎ ভাইবােন ইত্যাদি।
মৃত্যু ও সৎকার
ত্রিপুরারা সাধারণত মৃতদেহকে দাহ করে। একেবারে কম বয়সী শিশু (দাঁত উঠেনি এমন শিশু) মারা গেলে বা কোনাে লােক দুরারােগ্য বা ছোঁয়াচে রােগ যেমন : কলেরা, বসন্ত, কুষ্ঠ ইত্যাদি রােগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তাকে কবর দেয়া হয়।
এ ধরনের শিশুর ক্ষেত্রে অনেক সময় দোলনা বা খাঁচায় করে গভীর জঙ্গলের গাছের আগায় রেখে দিয়ে আসা হয়। ত্রিপুরা সমাজে রীতি অনুসারে মৃতদেহ পােড়ার আগে স্নান করিয়ে নতুন কাপড়-চোপড় পরাতে হয়। বাঁশের তৈরি শবাধারে করে মৃতদেহটি শ্মশানে নেয়া হয়।
মৃতদেহ ঘর থেকে শ্মশানে নিয়ে যাবার সময় ঘর থেকে শ্মশান পর্যন্ত সাদা সুতা টেনে নেয়া হয়। ত্রিপুরারা উত্তরদিক মাথা রেখে মৃতদেহ পুড়িয়ে থাকে। সাধারণত মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃতদেহটি দাহ করা হয়। কিন্তু কোনাে কারণে ছেলে-মেয়ে বা নিকট আত্মীয়-স্বজন খুব দূর অবস্থানের কারণে অপেক্ষা করতে হয় সেক্ষেত্রে মৃতদেহ ৪৮ ঘণ্টাও রাখা হয়।
মৃতদেহ পােড়ার জন্য কাঠ দিয়ে পুরুষের ক্ষেত্রে ৫টি ধাপ এবং নারীর ক্ষেত্রে ৭টি ধাপ সম্বলিত চিতা তৈরি করা হয়। রীতি অনুসারে মৃতব্যক্তির সন্তানরাই প্রথম চিতায় অগ্নিসংযােগ করে। মৃতব্যক্তির সন্তান না থাকলে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনরা প্রথম অগ্নিসংযােগ করে।
সামাজিক রীতি অনুসারে মৃতদেহ দাহ করার সাতদিন অথবা তেরদিন পর শ্রাদ্ধক্রিয়া অনুষ্ঠান সম্পাদন করতে হয় । মৃত ব্যক্তির বড় সন্তান বা উপযুক্ত কোনাে সন্তান এ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে থাকে ভাইবােনদের সহযােগিতা নিয়ে। এই শ্রাদ্ধক্রিয়া অনুষ্ঠানে আত্মীয়-স্বজন, অনুসারী, শুভাকাঙ্ক্ষী ও পাড়া-প্রতিবেশী উপস্থিত থাকে।
যে সব আর্থিক সামর্থ্যহীন ব্যক্তি রীতি অনুসারে ৭ বা ১৩ দিনে শ্রাদ্ধক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে না তারা তাদের সুবিধা অনুসারে এ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে থাকে। আর গ্রামের যে সব নারী বা পুরুষ একেবারে অসহায়, গরিব শ্রাদ্ধক্রিয়া অনুষ্ঠান করার যাদের একবারে সামর্থ্য নেই তাদের ক্ষেত্রে গ্রামবাসীরা অর্থ-চাল উত্তোলন করে শ্রাদ্ধক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সহযােগিতা প্রদান করে থাকে।
ত্রিপুরা জাতির উত্তরাধিকারী আইন ও প্রথাগত বিচার ব্যবস্থা :
ত্রিপুরাদের সামাজিক সমস্যাদি নিষ্পত্তির জন্য যেমনি নিজেদের ঐতিহ্যগত সামাজিক প্রতিষ্ঠান হেডম্যান-কার্বারী আদালত রয়েছে, তেমনি রয়েছে নিজস্ব প্রথাগত আইন। এই প্রথাগত আইনের ভিত্তিতে ঐতিহ্যগত সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে হেডম্যান-কার্বারীরা ত্রিপুরাদের সামাজিক সমস্যাদি নিষ্পত্তি করে থাকেন। কার্বারী হলো গ্রামের প্রধান। তিনি গ্রামের ফৌজদারি, দেওয়ানি সব ধরনের বিবাদের বিচার করে থাকেন।
যদিওবা ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি বা পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্য কোনাে আইন কার্বারীদের এ ধরনের ক্ষমতার স্বীকার করে না। তবে প্রথাগত ব্যবস্থার সামাজিক অধিকার নিয়ে যুগ যুগ ধরে কার্বারীরা গ্রামের সব ধরনের বিবাদ ও মামলা নিষ্পত্তির দায়িত্ব পালন করে আসছে।
হেডম্যান’ হলেন মৌজার প্রধান। বেশ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে মৌজা গঠন হয়ে থাকে। মৌজার আয়তন হলাে ২ বর্গমাইলের বেশি এবং ১০ বর্গমাইলের কম। কোনাে কার্বারীর আদালতে কোনাে মামলার নিষ্পত্তি না হলে উচ্চ আদালত হিসেবে সে মামলা মৌজা প্রধানের আদালতে চলে যায়।
সামাজিক সমস্যাদি সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি করার আইনি ক্ষমতা মৌজা প্রধানের আছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি মৌজা প্রধানকে এ ক্ষমতা দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি অনুসারে ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি করার ক্ষমতা মৌজা প্রধানের না থাকলেও বাস্তবে মৌজা প্রধানরাও ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করে থাকেন।
মৌজা প্রধানরা এ কাজটি যুগ যুগ ধরে করে আসছে। কোনাে মামলা মৌজা প্রধানের আদালতে নিষ্পত্তি না হলে সে মামলা সার্কেল চিফ তথা রাজার আদালতে চলে যায়।
ত্রিপুরা সমাজে প্রথাগতভাবে নারীরা আইনের দিক থেকে স্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না। পুত্র সন্তানরাই একমাত্র পরিবারের স্থাবর সম্পত্তির আইনি অধিকারী। তবে ত্রিপুরা জাতির কোনাে কোনাে গােত্রে কন্যা সন্তানরা অস্থাবর সম্পত্তির পাশাপাশি স্থাবর সম্পত্তির অধিকার ভােগ করে থাকে। যেমন ফাদু, দেনদাউ, গাবিং ইত্যাদি গােত্রে মেয়ে সন্তানরা মায়ের বংশ পরিচয়ে পরিচিত হন।
এ সব গােত্রে মেয়ে সন্তানরাই উত্তরাধিকারী হিসেবে মায়ের সম্পত্তি ভােগ করে থাকে। ত্রিপুরা সমাজে সাধারণভাবে পুত্র সন্তানরাই পরিবারের যাবতীয় সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী।
তবে কোনাে কোনাে পরিবারের মাতা-পিতা কন্যা সন্তানদেরও সম্পত্তির ভাগ দিয়ে থাকে। বর্তমানে অধিকাংশ পরিবারে এই রীতি অনুসৃত হচ্ছে। তবে কন্যা সন্তানদের এ অধিকার পুত্র সন্তানদের সমান নয়।
মা-বাবার দয়ার উপরই এটি নির্ভর করে কন্যা সন্তানরা স্থাবর সম্পত্তির ভাগ কত অংশ পাচ্ছে। এ পর্যন্ত দেখা গেছে যে, কন্যা সন্তানরা পুত্র সন্তানের সম পরিমাণ স্থাবর সম্পত্তির ভাগ পায় না।
ত্রিপুরা জাতির ধর্মীয় অবস্থা
ধর্ম ও ধর্মীয় গােষ্ঠী
ত্রিপুরারা মূলত সনাতন (হিন্দু ধর্ম) ধর্মাবলম্বী। তবে বর্তমানে বান্দরবান জেলার ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর অধিকাংশই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলায়ও ত্রিপুরাদের একটি অংশ বর্তমানে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। সনাতন ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর লােকেরা দূর্গা পূজা, কালী পূজা, রাসমেলা ইত্যাদি ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকে।
অপরদিকে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা বড়দিন পালন করে। সারা বাংলাদেশে ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর মধ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বী আনুমানিক ৮০ শতাংশের মতাে হবে এবং খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ২০ শতাংশ হতে পারে।
ত্রিপুরাদের পূজা-পার্বণ
সনাতন ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরারা দূর্গা পূজা, কালী পূজা, স্বরস্বতী পূজা ইত্যাদি পালন করে থাকে। এছাড়াও ত্রিপুরারা বহুবিধ পূজা-পার্বণ করে থাকে। পূজা-পার্বণের মধ্যে ক. কের পূজা, খ. কাথারক পূজা, গ, চুমুলাই পূজা, ঘ, সাকচরাই, ঙ, নাইরাং, চ. খ্রাঙ পূজা, ছ. মৗতাই কাইমানি, ছ, খার্চি পূজা ইত্যাদি অন্যতম।
ক. গরিয়া পূজা : ত্রিপুরাদের গরিয়া পূজা হলাে বৈসু উৎসবের অন্যতম দিক। পরিবারের মঙ্গল কামনাই হলাে এই পূজার অন্যতম দিক। পারিবারিকভাবে যারা কিছুটা সচ্ছল তারাই এই অনুষ্ঠানের আয়ােজক। তবে বিশেষভাবে মানত না করে থাকলে এই অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয় না।
তাছাড়া প্রতি বছরও এই অনুষ্ঠানের আয়ােজন করার বিধান নেই। এই পূজা আয়ােজনের উদ্দেশ্যে একটি সুনির্দিষ্ট দল গঠন করা হয়, তার মধ্যে আয়ােজক পরিবারের একজন সদস্য, একজন সর্দার, পূজা অর্চনার জন্য অচাই ও তাছাই (অচাই হলাে যিনি মন্ত্র পড়েন আর তাছাই হলাে যিনি প্রাণী বলী দেন)।
খ. কের পূজা : ‘কের’ শব্দের বাংলা অর্থ হলাে গণ্ডি বা বেষ্টনি। অতি প্রাচীনকাল থেকে ত্রিপুরা মহারাজারা রাজ্যবাসীকে সমস্ত প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, শত্রুর আক্রমণ থেকে রাজ্য ও প্রজাদের রক্ষা ইত্যাদির লক্ষ্যে কের পূজার আয়ােজন করতেন।
পরে বাস্তবতার কারণে রাষ্ট্র সীমানার মধ্যে বিস্তৃত না রেখে অঞ্চল বা গ্রাম এলাকার সীমারেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়। ‘কের পূজার বিভিন্ন নাম যেমন—গ্রাম সীমার মধ্যে কেরপূজা অনুষ্ঠিত হলে গ্রামমুদ্রা’, অঞ্চল পর্যায়ে হলে মহামুদ্রা, রাষ্ট্রীয়ভাবে হলে ‘রাজমুদ্রা’ নামে অভিহিত করা হয়।
বাংলাদেশের ত্রিপুরাদের মধ্যে কেরপূজা হয়ে থাকে গ্রামভিত্তিক। কেরপূজা গ্রামবাসীদের সমবায়ভিত্তিক এক সার্বজনীন পূজা। এই পূজায় গ্রামের সকলেই অংশগ্রহণ করে। কেরপূজা একদিকে পূজা অপরদিকে উৎসবও বটে ।
গ্রামবাসীরা বৎসরে দুইবার ‘কেরপূজা’ দেয়। একবার মহিষ বধ করে, অন্যটি শূকর ও ছাগল বধ করে। কেরপূজা গ্রামের সকল শ্রেণীর মানুষের এক মিলনমেলাও বটে। পূজা দেওয়ার সময় ও মহিষ বধকালে গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই গাঙে চলে যায় পূজা ও মহিষ বধ করার দৃশ্য দেখার জন্য।
কেরপূজার জন্য বাঁশ কেটে ও বেতের মাধ্যমে নানা ধরনের নকশা তৈরি করা হয়। বাঁশ ও বেতের তৈরি এসব নকশা ও কারুকার্য দেখতে খুব সুন্দর। কেরপূজার দিনে অন্য গ্রামের মানুষেরা গ্রামে ঢােকা নিষিদ্ধ।
কেউ যদি জেনে বা না জেনে গ্রামে ঢুকলে তাকে জরিমানা দিতে হয়। কেরপূজার উপাস্য দেবতাগণ হলেন—সিবরাই, সন্ত্রাংমা, সুকুন্দ্রায়, মুকুন্দ্রায়, হাচুকমা, তুইবুকমা, ইক্ষিত্রা, বিক্ষিত্রা, কালাক্ষী, রন্দকা, দন্ডকা, কালাকতর ও বনিরক।
গ. খার্চ্চি পূজা : খার্চ্চি পূজা ত্রিপুরাদের এক জনপ্রিয় উৎসব। এটি মূলত ত্রিপুরা রাজ্যে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই উৎসবটি সপ্তাহব্যাপী চলে। খার্চ্চি হলাে ধরিত্রীর পূজা। খার্চ্চি পূজায় চৌদ্দ দেবতাকে অর্চনা করা হয়ে থাকে।
এই দেবতাগুলি হলাে-মাতাই কতর, লাম, প্রা, সঙ্ংমা, তুইমা, মাইলুমা, খুলুমা, হাচুকমা, বুড়াসা, বানিরাও, থানিরাও, বুরৈদক, কারায়া, গরয়া ইত্যাদি।
কথিত আছে পাঁচ হাজার বছর আগে দ্বাপর যুগে ত্রিপুরা মহারাজা ত্রিলােচন দেবাদিদেব মহাদেব কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ত্রিপুরা রাজ্যে চতুর্দশ দেবমন্দির স্থাপন করেন। এই মন্দিরটি ত্রিপুরা জাতির কূলমন্দির। এই চতুর্দশ দেব পূজার নাম খার্জি পূজা। চতুর্দশ দেবগণের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য যে নৃত্য পরিবেশন করা হয় সেটিই ‘হজাগিরি নৃত্য। পূজা চলাকালীন যে রাত্রে হজাগিরি নৃত্যানুষ্ঠান করা হয় সে রাত্রে জনগণ, এমনকি রাজাও ঘর হতে বের হওয়া নিষেধ আছে।
ঘ. চুমলাই পূজা : পারিবারিক অশান্তি দূর করার জন্য, যশ ও খ্যাতি বৃদ্ধির জন্য, ধন-জন সমৃদ্ধির জন্য এবং আপদ-বিপদ থেকে রেহাই পাবার জন্য চুমলাই পূজা দেয়া হয়। চুমলাই পূজার উপাস্য দেবতা হলাে মুকুন্দ্রায় বা নকসু মাতাই।
শরৎকালে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ভাদ্র মাসে জুম ক্ষেতের ফসল ঘরে তােলা শেষ হলে যে নবান্ন উৎসব ত্রিপুরারা করে থাকে তা চুমলাই নামে পরিচিত। চুমলাই সিদ্ধিদাতা দেবতা। তিনি কাথার অর্থাৎ পবিত্র। বিবাহ অনুষ্ঠানে চুমলাই পূজা অবশ্যই দিতে হয়।
ঙ. সাকচরাই পূজা : সাকচরাই পূজা মূলত আত্মরক্ষার পূজা। শত্রুতাড়ন, বিপদ থেকে মুক্তি, ধন-জন বৃদ্ধি, শক্তি অর্জন এবং সুখ ও ঐহিক কামনায় ‘সাকচরাই পূজা করা হয়। এ পূজার উপাস্য দেবতা হলাে বুড়াসা ও সপ্ত সীকাল।
চ. সিমতৗং পূজা : সিমতৗং-এর অর্থ হলাে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন। বৈসু সংক্রান্তির আগে বিশেষ করে বসন্তকালে ত্রিপুরা জাতি প্রয়াত পিতৃপুরুষদের পারলৌকিক মঙ্গল কামনায় বংশ প্রদীপ জ্বালিয়ে একটি পূজানুষ্ঠানের আয়ােজন করে থাকে। এ পূজার নাম সিমতৗং।
সামর্থ্যবান উত্তরাধিকারী ব্যক্তিরা সিমতৗং পূজার আয়ােজন করে থাকে। সিমতৗং পূজার আয়ােজকরা একটি ভােজসভারও আয়ােজন করে থাকে। এ পূজার জন্যে বিশেষ কারুকার্য সহকারে অপরূপভাবে বাঁশের চাকলা তৈরি করতে হয়।
প্রতিটি চাকলায় পঞ্চ বা সপ্তদীপ জ্বালানাে হয়। চোন্তাই যখন প্রয়াত পিতৃপুরুষদের একে একে নাম ধরে সংকল্প বাক্য উচ্চারণ করে তখন ঢােলের গ্রীংচাং গ্রীংচাং বােলে আত্মীয়-স্বজন ও অভ্যাগতরা বিশেষ ভঙ্গিমা সহকারে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে। সিমতৗং পূজার দৃশ্য অতিশয় মনােরম ও হৃদয়গ্রাহী হয়ে থাকে।
সিমতৗং পূজার উপাস্য দেবতা হলাে মাতাই কতর। সিমতৗং পূজা মর্যাদা, মঙ্গল ও শান্তির প্রতীক। পূজা সম্পাদনে গৃহস্থের শৌর্য-বীর্য, মানমর্যাদা ও বংশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। ত্রিপুরা প্রথানুসারে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনকে পুণ্য ও মঙ্গলের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ছ. কাথারক পূজা : কাথারক’ অর্থ পবিত্র বা মঙ্গল। পরিবারের অর্থনৈতিক-সামাজিক শ্রীবৃদ্ধি, ঐশ্বর্য বৃদ্ধি, বিপদ মুক্তি, দাম্পত্য সুখ-শান্তি ও রাজ্য জয়কল্পে কাথারক পূজার আয়ােজন করা হয়। বিবাহ অনুষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে কাথারক পূজা দিতে হয়। কাথারক পূজার সময় কাথারক নৃত্য মতান্তরে ‘বােতল নৃত্য পরিবেশন করা হয়।
ত্রিপুরা জাতির সামাজিক উৎসব
পুরাদের প্রধান সামাজিক উৎসবের নাম ‘বৈসু। ত্রিপুরারা তিনদিন ধরে এই সব উদযাপন করে থাকে। এগুলাে হলাে—১. হারি বৈসু, ২. বৈসুমা ও ৩.বিসিকাতাল। পুরােনাে বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানানোকে কেন্দ্র করে এ ঐতিহ্যবাহী উৎসব উৎযাপন করা হয়ে থাকে।
হারি বৈসু : বৈসুর এ দিনকে মূলত প্রস্তুতি পর্ব বলা চলে। এ দিনে ত্রিপুরা রমণীরা বিন্নি ধানের চাউল থেকে পিঠা তৈরি করার জন্য গুড়াে চাউল তৈরি করে। হারি বৈসু’র দিন থেকে ঘরে ঘরে পিঠা বানানাের ধুম পড়ে যায়। এদিনে ত্রিপুরা নারীপুরুষ মিলে সকাল সকাল জঙ্গলে গিয়ে কলা পাতা, লাইরু পাতা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে এবং এই কলা পাতা, লাইরু পাতা দিয়ে নানান রকমের পিঠা তৈরি করে।
এদিন ত্রিপুরা রমণীরা কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করে। এদিন গ্রামের সকল বয়সের নারী-পুরুষ খুব ভােরে উঠে ফুল সংগ্রহ করে এবং খুব সকাল সকাল নদীতে গিয়ে স্নান করে নদীতে ফুল উৎসর্গ করে।
ঘরের কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করার মধ্য দিয়ে পুরােনাে বছরের সকল প্রকার আপদ-বিপদ, সকল প্রকার জঞ্জাল ধুয়ে মুছে যাবে বলে ধারণা করা হয়। হারি বৈসুর দিন থেকে শিশু-কিশাের, যুবক-যুবতীরা নানারকম খেলাধুলা ও আনন্দে মেতে ওঠে। হারি বৈসু’র দিন থেকে গরয়া নৃত্য শুরু হয়।
শুরুর দিন থেকে একটানা ৫/৭ দিন ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে গরয়া চেরকরা ঢােল-বাঁশি বাজিয়ে গরয়া নৃত্য পরিবেশন করে। গরয়া নৃত্যের নাচ-গান, ঢােলের বাজনা ও বাঁশির সুর বৈসু উৎসবকে অধিক পরিমাণে আকর্ষণীয় ও মাধুর্যময় করে তােলে।
এ দিনে গৃহকর্তা ঘরের গবাদি পশুর পরিচর্যা করে থাকে। গবাদি পশু হাল চাষ থেকে শুরু করে ঘরের অনেক কাজে উপকারে আসে। সেজন্য এই পবিত্র দিনে গবাদি পশুর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বিশেষ যত্ন নেয়া হয়, ফুলের মালা দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করা হয়।
বৈসুমা : এ দিনটি এক মহান দিন। এ দিনে ত্রিপুরা সমাজে কোনাে ভেদাভেদ থাকে না। সমাজের ধনী-গরিব, উচ্চ শ্রেণী-নিম্ন শ্রেণী লীন হয়ে যায়। ধনী বা সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষেরাও গরিব বা নিম্ন শ্রেণীর বাড়িতে বেড়াতে যায়।
তেমনি গরীব বা নিম্ন শ্রেণীর মানুষেরাও ধনী বা বিত্তবানদের বাড়িতে বেড়াতে যায়, সবাই হিংসাদ্বেষ ভুলে গিয়ে ভাব বিনিময় করে এবং একে অপরকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে ধনী-গরিব সবাই সামর্থ্যানুযায়ী নানা ধরনের পিঠা, মদ, সরবত, পাঁচন ইত্যাদি অতিথিদের পরিবেশন করে।
তবে ‘বৈসুমার দিনে প্রাণীবধ একেবারেই নিষিদ্ধ। ‘বৈসুমার দিনেও গরিয়া নৃত্য পরিবেশন করা হয়। গরয়া নৃত্য ছাড়াও পালা গান ও বিভিন্ন খেলাধুলা সারাদিন ধরে চলে। অনেক সময় রাত পর্যন্ত খেলা চলে।
বিসিকাতাল : বৈসু’র এই দিনটি নববর্ষকে স্বাগত জানানাের দিন। নতুন বছরে সুন্দর ও নিরাপদ জীবনের প্রত্যাশায় সমাজের সকল বয়সের মানুষ বয়ােজ্যেষ্ঠদের নিকট আশীর্বাদ গ্রহণ করে।
বিশেষ করে শিশু-কিশাের ও যুবক-যুবতীরা নতুন কাপড় চোপড় পরিধান করে গ্রামের ঘরে ঘরে ঘুরে হাঁস-মুরগি ও অন্যান্য পশু-পাখির খাবার বিলিয়ে দেয় এবং ত্রিপুরা সামাজিক রীতি অনুসারে বয়স্কদের পা ধরে সালাম করে আশীর্বাদ গ্রহণ করে।
গ্রামের যুবক-যুবতী ও নবদম্পতি গ্রামের মুরব্বি ও বয়স্কদের নদী বা কুয়ার সতেজ ও পরিষ্কার পানি তুলে স্নান করায় এবং আশীর্বাদ গ্রহণ করে। এ দিনে পরিবারের সকল সদস্যের মঙ্গলের জন্য পূজা ও উপাসনা করা হয়। এ দিনে গ্রামের প্রতিটি পরিবার সামর্থ্যানুসারে আমিষ খাদ্যের আয়ােজন করে।
পিঠা, পাঁচন, মদ ইত্যাদি তাে আছেই। এ দিনে গ্রামের অবস্থাপন্ন মানুষেরা গ্রামের গরিব ও বিধবাদের জন্য বিশেষ ভােজের আয়ােজন করে। গ্রামের প্রত্যেকটি ঘরের দরজা সারাদিন রাত খােলা থাকে অতিথিদের জন্য। মনে করা হয়ে থাকে যে, এদিনে কেউ যদি খালি মুখে ফিরে যায় তা গৃহস্থের জন্য অমঙ্গল।
ত্রিপুরা ভাষা ও বর্ণমালা
ত্রিপুরা ভাষা একটি সমৃদ্ধ ভাষা। এ জনগােষ্ঠীর যে ৩৬টি গােত্র রয়েছে তাদের অনেক শব্দে প্রচুর পরিমাণে প্রতিশব্দ পাওয়া যায়। ত্রিপুরাদের ভাষার নাম ককবরক। কক অর্থ ভাষা এবং বরক অর্থ মানুষ অর্থাৎ মানুষের ভাষা। কিন্তু ব্যবহারিক অর্থে ককবরক এর অর্থ হলাে ত্রিপুরা ভাষা বা ত্রিপুরাদের ভাষা।
ককবরক’ হলাে সিনাে-টিবেটান পরিবারের তিব্বতী-বর্মী উপ-পরিবারের ভাষা। বৃহত্তর অর্থে এ ভাষা বােডাে গ্রুপের যেমন : গারাে, দিমাছা, কোচ, মেচ, চুটিয়া, হাজং, রাভা ইত্যাদি জনগােষ্ঠীসমূহের ভাষার একই শ্রেণীভুক্ত একটি ভাষা।
ককবরক ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে ভাষাতত্ত্ববিদগণ ককবরক ভাষাকে তিব্বতী-বর্মী ভাষায় বােডাে বা বােরাে শ্রেণীভুক্ত করেছেন। চীনের উত্তর পশ্চিমে ইয়াংসি ও হােয়াংহাে নদীর উৎসস্থলের মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই ভাষার জন্ম বলে পণ্ডিতগণ মনে করেন।
পরবর্তীকালে এই জনগােষ্ঠী চীনের দক্ষিণাঞ্চলে ভারত বার্মা-ইন্দোচীনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে এবং পরে ইরাবতী, চিণ্ডুইন, ব্রহ্মপুত্র, সালাউন, মেকং, মেনাম নদীর অববাহিকার পথ ধরে ভারত-বার্মা ইন্দোচীন ও দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
এই তিব্বতী-বর্মী ভাষাভাষী জনগােষ্ঠীকে দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত করা হয়। একটি হলাে টিবেটো-হিমালয়ান এবং অপরটি হলাে আসাম-বর্মী। বোডো ভাষা আসাম বর্মী ভাষায় অন্তর্ভুক্ত একটি ভাষা।
ত্রিপুরা মহারাজাদের রাজত্বকালে ত্রিপুরা ভাষা ‘ককবরক রাষ্ট্রের অন্যতম ভাষা হলেও পরবর্তীতে এ ভাষা ত্রিপুরা রাজ্য সরকার কর্তৃক অবহেলিত অবস্থায় পতিত ছিল। ১৯৪৯ সালে ত্রিপুরা রাজ্য ভারত ইউনিয়নে যােগদানের আগ পর্যন্ত ককবরক হাজার বছর ধরে ত্রিপুরা রাজ্যের রাষ্ট্র ভাষা ছিল।
কেবলমাত্র ১৯৭৯ সাল থেকে ককবরক আবার ত্রিপুরা সরকারের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। বর্তমানে ত্রিপুরা রাজ্যে ককবরক ভাষায় মাধ্যমিক পর্যায় অব্দি পড়ালেখা চলছে কিন্তু বাংলাদেশে এ ভাষার মাধ্যমে এখনো সরকারি পর্যায়ে পড়ালেখার সুযােগ সৃষ্টি হয়নি।
তবে বেসরকারিভাবে এনজিওগুলো প্রি-প্রাইমারি পর্যায়ে ককবরকে পড়ালেখা শুরু করে দিয়েছে। ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি ককবরক ভাষায় সাহিত্য চর্চার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ত্রিপুরা ভাষার নিজস্ব কোনাে বর্ণমালা নেই। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশ ক’জন ত্রিপুরা ত্রিপুরাদের নিজস্ব হরফ সৃষ্টি করলেও ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর লােকেরা রােমান হরফে পড়ালেখা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
বর্তমানে রােমান হরফে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। প্রি-প্রাইমারি থেকে এ শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। ধীরে ধীরে তা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃত করার পরিকল্পনা আছে বলে জানা গেছে। বর্তমান সময়ে যে সব লিটল ম্যাগাজিন বেরুচ্ছে সেগুলােতেও রােমান হরফে সাহিত্য চর্চা করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
ত্রিপুরাদের লােক-সংস্কৃতি ও সাহিত্য
ত্রিপুরা লােকসাহিত্য
ত্রিপুরাদের লােক-সাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ। ত্রিপুরাদের যে সব লােক-গীতিকাব্য রয়েছে সেগুলি অন্য ভাষার অনেক সমৃদ্ধ সাহিত্যকে হার মানাবে। যেমন : ‘পুন্দা তান্নায়’, লাংগই রাজানাে বুমানি’, ‘হায়া হা সিকাম কামানি’, ‘খুম কামানি’, ‘গাঁ তলিয়ো থাঁমানি ইত্যাদি গীতিকাব্য এক একটি শত পৃষ্ঠার ওপরে হবে এবং এগুলি হাসিকান্না, দুঃখ-বেদনা ও সাহিত্যরসে ভরপুর।
এ ছাড়া ত্রিপুরাদের বহু রূপকথা ও লােককাহিনী আছে যেগুলির সাহিত্যমান অনেক উঁচু। এসব সাহিত্যসমৃদ্ধ গীতিকাব্য, রূপকথা ও গল্পের বেশির ভাগ এখনাে অপ্রকাশিত রয়ে গেছে।
৬/৭টি গীতিকাব্যের মধ্যে অদ্যাবধি মাত্র ২টি গীতিকাব্য গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়েছে ত্রিপুরাদের ধাঁধা, প্রবাদ প্রবচন ইত্যাদিও বেশ সমৃদ্ধ। উল্লেখ্য যে, ত্রিপুরা রাজন্যবর্গের ইতিহাস ‘রাজমালা’ প্রথমে ককবরকে লেখা ছিল। পরে রাজমালা বইখানি সংস্কৃত ও বাংলায় অনুবাদ করা হয়।
বাংলাদেশে ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর ভাষা ও সাহিত্য বিকাশে বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ ও ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম — এই দুটি সামাজিক সংগঠনের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ দুটি সংগঠনের প্রচেষ্টায় ত্রিপুরাদের লােকসাহিত্য সংরক্ষণ ও বিকাশে বহুমুখী উদ্যোগ আমরা লক্ষ করি।
যদিওবা এ উদ্যোগ ত্রিপুরাদের সমৃদ্ধ লােকসাহিত্য সংরক্ষণ ও বিকাশে যথেষ্ট নয়। সান্তআ’ নামে এক অনিয়মিত পত্রিকাও ত্রিপুরা সাহিত্য সংরক্ষণ ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
অনিয়মিত হলেও এ পত্রিকা বেশ ক’ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। বর্তমানে ‘হমচাঙ’ নামে আর একটি পত্রিকা বেরুচে্ছ। ভারত ও বাংলাদেশে ত্রিপুরা সাহিত্যিকরা ককবরকের পাশাপাশি বাংলা ভাষায়ও সাহিত্যচর্চা করে থাকে। ভারতে বাংলাদেশের তুলনায় লােকসাহিত্য সংরক্ষণ, ভাষা ও সাহিত্যচর্চা এবং এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতা অনেক বেশি।
সে কারণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে লােকসাহিত্যের বহু প্রকাশনা দেখা যায়। সেখানে কবি, সাহিত্যিক ও লেখকের সংখ্যাও অনেক বেশি। বাংলাদেশে লেখকের সংখ্যা খুবই কম। অনেক জনপ্রিয় বই প্রকাশের মাধ্যমে ত্রিপুরা জনগােষ্ঠীর সাহিত্যিকরা ককবরক ও বাংলায় সমানভাবে পারদর্শীতা দেখিয়ে চলেছেন।
ত্রিপুরা জাতির নাচ ও গান
ত্রিপুরাদের নাচ ও গান অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এ সব নাচ ও গান ত্রিপুরাদের জীবন-জীবিকার সাথে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত। ইতিহাস, পৌরাণিক কাহিনী ও জীবন-জীবিকার উপর ভিত্তি করে এ সব ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গান রচিত হয়েছে।
আমরা যদি গানের কথা বলি, ত্রিপুরাদের এ সব গান এখনাে বেশিরভাগ অলিখিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত। অথচ এসব গানের প্রত্যেকটি খণ্ড এক একটি বড় আকারের গ্রন্থ হবে। এসব ঐতিহ্যবাহী গানের মধ্যে ইতোমধ্যে ২টি গীতিকাব্য গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
এই দুটি গ্রন্থের নাম-১. লাংগৈ রাজানো বুমানি’ ও ২. ‘পুন্দা তানমানি’। প্রথম গীতিকাব্যটি ত্রিপুরা রাজার যুদ্ধ ও রাজ্য জয়ের উপর লিখিত এবং অপরটি প্রেমের করুণ কাহিনী নিয়ে লিখিত।
এ ধরনের আরাে বেশ কয়েকটি গীতিকাব্য যেমন : ১. গঙ্গা তলীয় থাঁমানি, ২. গোঁসাই রাজ্যা থাঁমানি, ৩. কুচুক হা সিকাম কামানি, ৪. হায় বিদেশি থাঁমানি’, ৫. ‘খুম কামানি ইত্যাদি সাহিত্যসমৃদ্ধ গীতিকাব্য ত্রিপুরা জাতির সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে।
তবে এর কতগুলি সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে এ সব মূল্যবান সাহিত্যসম্পদ সংরক্ষণের সুযােগ সীমিত। আদিবাসীদের এ সব সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পদ গবেষণা করার ক্ষেত্রে, সংরক্ষণে সরকারের পৃষ্ঠপােষকতা একেবারে নেই বলা যায়।
ত্রিপুরাদের এ সব সাহিত্য সম্পদ বাংলা ভাষার মূল্যবান সাহিত্যসম্পদের সমতুল্য। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ত্রিপুরাদের গান ও সুর সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এভাবে- মধ্য রাত্রে সকরুণ বাঁশির সুর শুনিয়া এখানকার (ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুর) এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, এ সুর কোথা থেকে আসিতেছে? উত্তরে বলিলেন, বন্য বরাহ হইতে জুম ক্ষেত্র রক্ষা করিবার নিমিত্ত কৃষক বাঁশি বাজাইয়া ক্ষেত্র পাহারা দিতেছে। ক্ষেত্র রক্ষা করিবার নিমিত্ত যাহাদের বাঁশির সুরে এ বৈচিত্র্যময় শৈল বিন্যাস, উপরের শিখরে এটার স্থান অবশ্যম্ভাবী।
বিশিষ্ট লেখক প্রভাংশু ত্রিপুরা সংগীতের সাতটি রাগ-রাগিনী আছে বলে উল্লেখ করেছেন। এগুলি হলাে—ক. রাগ : ত্রিপুরা সারং- গরয়া নৃত্য রাগ-ত্রিপুরা সারংভুক্ত। খ. রাগ : ত্রিপুরা ভৈরব : ত্রিপুরাদের কাথারক নৃত্য বা বােতল নৃত্য রাগত্রিপুরা ভৈরবভুক্ত। গ. রাগ : গােমতী ইত্যাদি।
ত্রিপুরাদের গীতকে এর বৈশিষ্ট্য অনুসারে চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথা : ১. লােক সংগীত, ২. বাউল, ৩. কাব্য সংগীত ও ৪. কীর্তন পদবাচ্য সংগীত।
ত্রিপুরাদের নাচ-গান পরিবেশিত হয় সাধারণত বিবাহ অনুষ্ঠানে, পূজা-পার্বণ ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে। ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী নাচগুলির মধ্যে গরয়া নৃত্য’ কাথারক নৃত্য বা বােতল নৃত্য, হজাগিরি নৃত্য, কেরপূজা নৃত্য, মাইমিতা অন্যতম
গরিয়া নৃত্য : গরিয়া নৃত্য জুমচাষ ও ত্রিপুরাদের জীবন-জীবিকার উপর রচিত। জুম কাটা, জুমে বীজ বপন, জুমক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করা, পশু-পাখি তাড়ানো, ধান কাটা, ধান পরিষ্কার করা, সুতা কাটা, কাপড় বুনন ইত্যাদি জীবন-জীবিকা নিয়ে এ নৃত্যের দৃশ্যসমূহ সাজানাে হয়েছে। এ নৃত্যে ঢােল, বাঁশি ব্যবহার করা হয়। এতে কথামালার সুরে সুরে নৃত্য পরিবেশন করা হয়। এ নৃত্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে নর্তকের সংখ্যা যত বেশি হয় তত বেশি আকর্ষণীয় হয়।
কাথারক নৃত্য : কাথারক নৃত্য’ বা ‘বােতল নৃত্য ত্রিপুরাদের একটি ঐতিহ্যবাহী নৃত্য। এ নৃত্য ত্রিপুরাদের বিবাহ অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়। ত্রিপুরাদের বিবাহ অনুষ্ঠানে কাথারক পূজা’ নামে এক পূজা দিতে হয়।
এই পূজাতে কাথারক নৃত্য পরিবেশন করতে হয়। এই কাথারক পূজার সমাপান্তে বর ও কনে পক্ষের কেঁজুকেজা দুজন ঢােলের তালে তালে মাথায় দীপশিখা সমেত বােতল, হাতে থালাসহকারে এবং পানি ভর্তি কলসির উপরে উঠে নাচতে হয়।
এখানে দীপশিখা জ্ঞানের প্রতীক, পানি ভর্তি কলসি কর্মের প্রতীক, মদভর্তি বােতল শক্তির প্রতীক এবং ফুলের মালা ভক্তির প্রতীক। সুতরাং জ্ঞান, শক্তি, ভক্তি ও কর্মের সমন্বয়ে কাথারক নৃত্যের অনুপম সৃষ্টি। ত্রিপুরা রাজারা যুদ্ধ শুরু করার পূর্বে এই কাথারক বা মাঙ্গলিক নৃত্য-এর আয়ােজন করে থাকে।
কোনাে শুভ কাজ শুরু করার পূর্বে অথবা জুম কাটা শুরু করার আগে বা কোনাে কিছুর মঙ্গল কামনায় ত্রিপুরারা কাথারক পূজার আয়ােজন করে কাথারক নৃত্য পরিবেশন করে থাকে। এ জন্য এই নৃত্যের আরেক নাম মাঙ্গলিক নৃত্য।
ত্রিপুরা জাতির পােশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকার
ত্রিপুরাদের বয়নশিল্প ও পােশাকের নকশা বেশ সমৃদ্ধ। নানা ধরনের পরিধেয় বস্ত্র প্রতিটি ঘরে তৈরি হয়ে থাকে। ত্রিপুরারা জুম চাষ করে। জুমচাষ থেকে কার্পাস উৎপন্ন হয়। এই কার্পাস থেকে ত্রিপুরা রমণীরা সুতা উৎপাদন করে।
কার্পাস বা তুলা থেকে সুতা কীভাবে তৈরি করা হয় এবং সুতায় রং করার প্রযুক্তি ত্রিপুরা রমণীরা প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার করে আসছে। এই রং করা সুতা দিয়ে ত্রিপুরা রমণীরা সুন্দর সুন্দর নকশা সম্বলিত বিভিন্ন পরিধেয় বস্ত্র তৈরি করে থাকে।
কালমা নামক গাছের পাতা ও অন্যান্য গাছের পাতা ও গাছের বাকলা দিয়ে রং তৈরি করা হয়ে থাকে।ত্রিপুরা রমণীদের প্রধান পরিধেয় বস্ত্রের নাম হলাে—রিনাই, রিসা ও কুবাই। রিনাই পরা হয় কোমর থেকে নিচের অংশ আবরণের জন্য।
কুবাই ও রিসা পরা হয় কোমরের উপরের অংশ আবরণের জন্য। রিসা ব্যবহৃত হয় বক্ষ বন্ধনের জন্য, মাথায় পাগড়ির মতাে করে ব্যবহারের জন্য। অনেক সময় রিনাই পরাকে আরো শক্ত করার জন্য রিসা দিয়ে কোমর শক্ত করে বাঁধা হয়।
বর্তমানে ত্রিপুরা রমণীরা রং করা বিভিন্ন রঙের সুতা ক্রয় করে কাপড় বোনে। অনেকে টেক্সটাইলে আদিত রিনাই-রিসাও ব্যবহার করে। অতীতে ত্রিপুরা রমণীদের ন্যায় ত্রিপুরা পুরুষেরাও ঘরের তৈরি গামছা ও কুবাই (শার্ট) ব্যবহার করতো।
কিন্তু বর্তমানে কালের আবর্তে ত্রিপুরা পুরুষেরা বাজার থেকে আধুনিক পোশাক-পরিচ্ছদ পরে। ত্রিপুরাদের বিভিন্ন প্রকার রিনাই-রিসা রয়েছে যেমন—১. রিনাই চাঙগ্রং, ২. রিনাই খাইচৈংতৈ, ৩. রিনাই নাগি, ৪. রিনাই কলফ, ৫. রিনাই বেখ:, ৬. য়ংসা রিনাই ইত্যাদি। রিসাও বিভিন্ন প্রকারের । যেমন—খাজা রিসা, বখরুক রিসা, চাঙ রিসা ইত্যাদি।
ত্রিপুরাদের প্রত্যেকটি দফার রমণীদের পোশাক-পরিচ্ছদের নকশা আলাদা। ত্রিপুরা রমণীর পোশাক রিনাই-রিসার নকশার বিন্যাস দেখে কে কোন দফার রমণী তা অনায়াসেই চিহ্নিত করা যায়।
কোনো কোনো গোত্রের রিনাই-রিসা বেশ কয়েক ধরনের হয়ে থাকে। ত্রিপুরাদের সব গোত্রের পোশাকে লাল, কালো, নীল, হলুদ ও সাদা রঙের ব্যবহার দেখা যায়। তবে ত্রিপুরা রমণীরা তাদের পোশাকে লাল ও কালো রঙটাই অধিক ব্যবহার করে।
ত্রিপুরা জাতির অলংকার
ত্রিপুরা রমণীরা বিভিন্ন ধরনের অলংকার ব্যবহার করে থাকে। যেমন : সাংগে, আঁচিলি, বাংগ্রি (বালা, কুঁচি), তয়া, চন্দ্রহার, সিকল, রামতাঙ, বেঙকি, ওয়াখুমু, নাফু, লক, কালচি, যেইতাঁ, সউরাঙ, বলবলি ইত্যাদি। ত্রিপুরা রমণীরা সাংগে
ব্যবহার করে চুলের খোঁপায়, আঁচিলি, লক, চন্দ্রহার ও রামতাঙ ব্যবহার করে গলার হার হিসেবে, তয়া ও ওয়াখুম ব্যবহার করে কানের দুল হিসেবে, বেঙকি হার করে পায়ে, নাফু ও বরবলি ব্যবহার করে নাকে, য়েইতাঁ ব্যবহার করে হাতের আঙুলে।
ত্রিপুরা জাতির আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র
ত্রিপুরা জাতির বাঁশ ও বেত শিল্প বেশ সমৃদ্ধ। জীবন-জীবিকার বেশিরভাগ প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাঁশ ও বেত দিয়ে তৈরি করে এ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। কাপড় বুনন, ধান রাখার জন্য, হাঁস-মুরগি রাখার জন্য, মাছ শিকারের জন্য, ঘরের নৈমিত্তিক কাজ ইত্যাদির জন্য ত্রিপুরারা বাঁশ ও বেতের নানারকম সামগ্রী তৈরি করে থাকে। যেমন : মং, কচা, কৗবাং, জাংগা, ফালা, চেমাই, লাই, য়াম, দালকি, লংগাই ইত্যাদি ধান ও নানাবিধ শস্য রাখার পাত্র।
টন বা তুঙ, সেরি ইত্যাদি ধান বা চাল পরিমাপ করার জন্যে। থুরি, পাইরেং, রিখুক্র, রিখ্রোক, বেংকে, বুমুল ওয়াফ্রি ইত্যাদি কাপড় বোনার জন্যে। তাখোক, বেংগলা, মাওচাঁ, ওয়াউগ্রো ইত্যাদি মোরগ-মুরগি রাখার জন্য।
জাংগা, ঔাউকু, কিসিপ, সংমা, দসানা, মাই কাঠি, নাচুয়ান,থুয়াম, লাকু, মাইচাম ইত্যাদি নৈমিত্তিক ব্যবহার্য সামগ্রী। লুসি, বাংবু, চপ্রা, চৈ, দুলা, বারাই ইত্যাদি মাছ শিকারের জন্য ব্যবহার্য সামগ্রী। ফুঁ-ওয়াসা, গেদা, বাদৌক, বাদু বা বাতুল, গুড়া, দুক ইত্যাদি পশু-পাখি শিকারের জন্য ব্যবহৃত সামগ্রী।
ত্রিপুরা জাতির খাদ্যাভ্যাস ও রন্ধন সংস্কৃতি
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা দু পদ্ধতিতে ভাত রান্না করে। যথা : ক, সুংনায় পদ্ধতিতে ও খ. প্রৈঙনায় পদ্ধতিতে। এর মধ্যে প্রৈঙনায় পদ্ধতি বেশ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এই পদ্ধতিতে বাঁশের চোঙায় ভাত রান্না করা হয়। বাঁশের চুঙায় রান্না ভাত খুবই সুস্বাদু। সাধারণত অতিথি ও সম্মানিত ব্যক্তিদের বাঁশের চোঙায় রান্না করে ভাত খাওয়ানো হয়।
বিন্নি ভাত চোঙায় রান্না করলে অত্যন্ত সুস্বাদু ও সুগন্ধিযুক্ত হয়। দেবতাদের উদ্দেশ্যে খাদ্য সমর্পণ করতে গেলে চোঙায় করে ভাত রান্না করে দিতে হয়। তরকারি রান্না করার ক্ষেত্রে ত্রিপুরারা ১২ প্রকারের রন্ধনপ্রণালি ব্যবহার করে। যথা : ১. সেরজাক, ২. য়কজাক, ৩. হাংজাক, ৪. প্রেংজাক, ৫, মৌকজাক, ৩০ গুদাকজাক, ৭. রুজাক, ৮. চাখৈ, ৯. কুরুয়া বা লাকসু, ১০, বানসু বা বাঙসঙ, ১১. সেক ও ১২. পাচন।
এগুলোর মধ্যে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা সাধারণত রুজাক, গুদাকজাক, চাখৈ সঙজাক তরকারি অধিক পরিমাণে খায়। ত্রিপুরা পরিবারের প্রতিটি ঘরে পদগুলির কোনো না কোনো একটি বা দুটি তরকারি প্রতিদিন থাকে।
মৌকজাক হাংজাক ও প্রেংজাক ত্রিপুরাদের বিশেষ খাদ্য। এই তিন প্রকারের খাদ্য সুস্বাদু। কলা পাতা বা অন্য কোনো পাতার মাধ্যমে মৌকজাক তরকারি তৈরি করতে হয়।
প্রেংজাক বা প্রৈংজাক তরকারি তৈরি করতে বাঁশের চোঙার মাধ্যমে আর হাংজাক তৈরি করতে হয় আগুনের তাপে। চাখৈ বা চাখ্রৈ তরকারির সাথে ত্রিপুরাদের নামের একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। ত্রিপুরাদেরকে ‘চাখ্রৈ চানায় মৈখ্রৈ চানায় বলা হয়। উল্লেখ্য যে, চাখৈ তরকারিও ত্রিপুরাদের এক অতিশয় প্রিয় খাদ্য।
ত্রিপুরা জাতির খাদ্য সংস্কৃতিতে মসলা এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ত্রিপুরারা প্রায় সব তরকারি রান্নার ক্ষেত্রে মসলা ব্যবহার করে থাকে। তবে ত্রিপুরারা এ সব মসলা নিজেরাই উৎপাদন করে। ত্রিপুরা জুমিয়ারা এ সব মসলা জুমে উৎপাদন করে।
এ সব মসলা বাড়ির আঙ্গিনায়ও উৎপাদন করা সম্ভব। ত্রিপুরারা যে সব মসলা ব্যবহার করে সেগুলি হলো : ১. বানা, ২. লকবানা, (৩. খুঁইচানী, ৪. মাইত্রাঁ বা মাইত্রাম। বর্তমানে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা তরকারিতে বাজারের বিভিন্ন মসলাও ব্যবহার করে।
ত্রিপুরা জাতির ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা
ত্রিপুরাদের আউটডোর খেলাধুলার অন্যতম হলো সুই, গুদু, চু বা চুর, ওয়াসৌলাই, পর খেলা, হাতিতি, ওয়াক-মৗসা, ওয়াদেং ইত্যাদি এবং ইনডোর খেলাধুলার মধ্যে তকঃ, চেচঙ, পাইং, খগ্রি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
১. সুকই : ত্রিপুরাদের এ খেলাটি খুবই আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয়। সাধারণত দল বেঁধে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ খেলায় দল বেঁধে দুপক্ষ অংশগ্রহণ করে। প্রতিটি দলে কমপক্ষে পাঁচজন ঊর্ধ্বে ১০ জন পর্যন্ত দেখা যায়। বিশেষ করে বৈসুর দিনে দল বেঁধে ত্রিপুরারা এ খেলায় অংশগ্রহণ করে। প্রতি গ্রুপে ২/৩ জন করে হলেও এ খেলা অনুষ্ঠিত হতে পারে।
সুকই খেলাকে চাকমা ভাষায় ঘিলা খেলা বলে। এ খেলা অনুষ্ঠানের জন্য লম্বালম্বি মাঠ দরকার। সুকই খেলার আকার গোলাকার। সুকই খেলার ২১টি স্তর আছে বলে জানা যায় যেমন : ১. য়ামুক, ২. পেকাই, ৩. য়েসকু বথঃ, ৪. ইয়াকসি, ইয়াকগ্রা, ৫. খাচুক, ৬. ফামকই-য়াকসি, ইয়াকগ্রা ৭. অমথাই, ৮. মকল, ৯. কপাল, ১০. য়াকতিরি, ১১. ফিকং ১২. য়েসি বৌথাই ১৩. য়াপলাই ইত্যাদি। যে দলটি নির্ধারিত স্তরগুলি অতিক্রম করে চূড়ান্ত স্তরে আগে শেষ করতে পারবে সেই দলটি বিজয়ী দল হিসেবে ঘোষিত হবে।
২. গুদু খেলা : গুদু খেলাও সুকই খেলার মতো দল বেঁধে খেলা হয়। এ খেলাটিও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর এক ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় খেলা। এই খেলাটি অনেকটা কাবাডি খেলার মতো। এ খেলার জন্য দৈর্ঘ্য ৯/১০ হাত এবং প্রস্থের জন্য ৭/৮ হাত প্রশস্ত মাঠ দরকার। এ ধরনের মাপের মাঠের মাঝখানে দাগ কেটে দুটি ক্ষেত্র (কোট) তৈরি করা হয়।
এ খেলায় খেলোয়াড়কে গুদু গুদু উচ্চারণ করে এক নিঃশ্বাসে বিপক্ষ দলের কোটে গিয়ে বিপক্ষ দলের কাউকে স্পর্শ করে ফিরে আসতে হবে। এভাবে বিপক্ষ দলের কাউকে স্পর্শ করে ফিরে আসতে পারলে বিপক্ষ দলের ঐ ব্যক্তি মারা গেছে বলে ধরে নেয়া হয় এবং ঐ ব্যক্তিকে কোট থেকে বের হয়ে যেতে হয়।
আবার প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়রা যদি তাকে ধরে রাখতে পারে তাহলে সে বাদ যাবে। এভাবে যে দল অপর দলের সকল সদস্যকে কোট থেকে বের করে দিতে পারবে সে দলই বিজয়ী বলে ঘোষিত হবে। গুদু খেলার প্রতিটি দলের সদস্য সংখ্যা-৫ বা ৭ বা ৯ হয়ে থাকে।
৩. উয়াসৌলাই : এই খেলাটিও দলীয় খেলা। দল বেঁধে ৫ বা ৭ বা ৯ জনের গ্রুপ করে পক্ষ বিপক্ষ হয়ে এ খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। এ খেলার জন্য একটি শক্ত লম্বা বাঁশের প্রয়োজন। এই বাঁশের দুপাশে দুগ্রুপ একে অপরকে ঠেলতে থাকে। এই ঠেলাঠেলিকে যে দলটি অপর দলকে ঠেলে স্থানচ্যুত করে দূরে ঠেলে নিতে পারবে সে দলটি বিজয়ী বলে ঘোষিত হবে।
৪. চু বা চুর খেলা : চুর খেলাও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর এক প্রাচীন খেলা। এ খেলা অনেকটা লাটিম খেলার মতো। এ দুটির মধ্যে পার্থক্য হলো—লাটিম খেলাটির দণ্ড হয় পেরেকের আর চু-এর দণ্ডটি হলো কাঠের।
চুর কাঠের দণ্ডটি চুর মূল অংশেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শক্ত গাছের ডাল থেকে চু তৈরি করা হয়। এই খেলাটি এককভাবে বা দলীয়ভাবে আয়োজন করতে পারে। এই খেলার এভাবে হয়—এক পক্ষের সদস্য সজোরে মাটিতে নিক্ষেপ করে ঘুরাবে বিশ ঘূর্ণায়মান সেই চুটিকে লক্ষ করে সজোরে আঘাত করবে।
এই আঘাটে যদি ঘূর্ণায়মান চুটির মৃত্যু হয় অর্থাৎ মাটিতে লুটে পড়ে সেক্ষেত্রে যে আঘাত সে ব্যক্তি বা তার দল পয়েন্ট পাবে। আর যদি ঘূর্ণায়মান চুটি আঘাত লুটায়ে দিতে না পারে তাহলে পয়েন্ট পাবে না। এভাবে ব্যক্তি বা দল যে বেশি পাবে তিনি বা ঐ দলটি বিজয়ী বলে ঘোষিত হবে।
পর খেলা : এ খেলাটিও দলীয় খেলা। এ খেলার জন্য প্রশস্ত মাঠ দরকার। এ খেলায় ৫ বা ৭ জনের পক্ষ বিপক্ষ দল গঠন করা হয়। এ খেলায় ৫ সদস্যবিশিষ্ট না হলে ৫টি প্রতিবন্ধক লাইন তৈরি করতে হয়। প্রতিটি লাইনে একজন সদস্য থাকবে।
বিপক্ষ দলের সদস্যরা ফাঁকি দিয়ে সেই প্রতিবন্ধক স্তর পার হয়ে যাবে। যে দলটি নিষ্কণ্টকভাবে অপর দলের সদস্যদের ফাঁকি দিয়ে সমস্ত প্রতিবন্ধক পার হতে পারবে সে দলটি বিজয়ী বলে বিবেচিত হবে। অন্যদিকে ত্রিপুরাদের ইনডোর খেলাধুলার মধ্যে তক, চেচঙ, পাইং, খগ্রি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নিম্নে তার কিছু বর্ণনা দেয়া গেল :
১. তক খেলা : খেলা ঐতিহ্যবাহী ইনডোর খেলা। এ খেলা ২ জন, ৪ জন, ৬ জন মিলে খেলতে পারে। মূলত খুমক্রমৗং গাছের ফলের বিচি দিয়ে এ খেলা খেলে থাকে। শামুকের খোলস দিয়েও এ খেলা খেলে থাকে। তক খেলার জন্য ৫টি বিচি বা ৫টি শামুকের খোলস দরকার।
এ খেলা পবিপক্ষ হয়ে দুজন খেলোয়াড় খেলতে পারে বা দুজন করে বা তিনজন করেও খেলতে পারে। এ খেলার কয়েকটি ধাপ আছে। যে ব্যক্তি খেলার সমস্ত আগে শেষ করতে পারবে তাকে খেলায় বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হবে।
২. চেচঙ খেলা : চেচঙ খেলাটিও এক জনপ্রিয় খেলা। এ খেলা মূলত কিশোর-কিশোরীরা খেলে থাকে। এ খেলার জন্য চার বা পাঁচ আঙ্গুলের সম পরিমাণ প্রশস্ত ছোট বাঁশের কঞ্চির দরকার হয়। বাঁশের কঞ্চি ২১ বা ৩১ বা ৩৩ অর্থাৎ বিজোড় হতে হবে। খেলোয়াড় প্রথমে হাতের তালুতে বাঁশের কঞ্চি রাখবে। তারপর খেলতে শুরু করবে।
খেলোয়াড় খেলার পর সমস্ত কঞ্চি থেকে মাত্র একটি কঞ্চি ধরে রাখতে হবে। একটি কঞ্চি ধরতে পারলে এক পয়েন্ট পাবে। যদি একটি না ধরে দুটি কঞ্চি ধরে রাখে তাহলে এ খেলোয়াড় আর খেলতে পারবে না। এভাবে যে বেশি পয়েন্ট পাবে খেলায় সেই খেলোয়াড়কে বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হবে। এ খেলায় ২ জন বা ৪ জন খেলে থাকে।
৩. পাইং খেলা : পাইং খেলাটিও এক ঐতিহ্যবাহী খেলা। মাটিতে বা প্রশস্ত কাঠের উপরে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ খেলা আবার তিন প্রকার। যথা : ক. ষোল পাইং, খ. ছয় পাইং ও গ. তিন পাইং।
ক. ষোল পাইং : এ খেলায় দুজন প্রতিযোগী ১৬টি করে মোট ৩২টি পাইং গুটি বসিয়ে খেলা করে থাকে। এ খেলার জন্য ৩৭ ঘর বিশিষ্ট পাইং তৈরি করতে হয়। প্রতিযোগী দুজন এ খেলায় যে বেশি প্রতিপক্ষের গুটি মেরে ফেলতে পারবে সে অবশেষে বিজয়ী হিসেবে বিবেচিত হবে।
ছয় পাইং : ছয় পাইং খেলায় ১৫টি ঘর থাকে। পক্ষ ও বিপক্ষ খেলোয়াড় ৬টি করে মোট ১২টি গুটি নিয়ে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ খেলায়ও ষোল পাইং-এর ন্যায় যে প্রতিপক্ষের গুটি বেশি মেরে ফেলতে পারবে সেই বিজয়ী হবে।
গ. তিন পাইং : এ খেলায় ৯ ঘর থাকে। পক্ষ বিপক্ষ দুজন খেলোয়াড় ৩টি করে মোট ৬টি গুটি নিয়ে খেলে। এ খেলায় উপরে উল্লিখিত দুটি খেলার ন্যায় অনুরূপ পদ্ধতিতে প্রতিপক্ষ দুজন খেলোয়াড় খেলবে এবং যে অপরের গুটি মেরে ফেলতে পারবে সেই বিজয়ী হবে।
ত্রিপুরা জাতির প্রথা ও রীতিনীতি
পার্বত্য চট্টগ্রামের অপরাপর আদিবাসীদের ন্যায় ত্রিপুরা জাতিরও ভূমি ব্যবস্থাপনায় নিজস্ব প্রথা, রীতি ও পদ্ধতি রয়েছে। এ জনগোষ্ঠীর ভূমি মালিকানার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অলিখিত। যে ব্যক্তি কোনো বন পাহাড়কে প্রথম একবার জুমচাষ বা ভোগদখল করবে, সেদিন থেকেই সেই জুমভূমি তার হবে।
মালিক বা প্রথম ভোগদখলকারী ব্যক্তির অনুমতি ব্যতিত এই জুমভূমি অন্য কেউ ভোগদখল বা চাষ করতে পারবে না। প্রথম দখলের মধ্য দিয়ে মালিকানা নির্ধারিত হয়ে যায়। বিষয়টি গ্রাম প্রধান কার্বারী’ ও গ্রামবাসী জানা থাকলেই হলো। ভূমি মালিকানার বিষয়ে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রথাগত রীতি অনুসারে লিখিত ব্যবস্থার কোনো প্রয়োজন নেই। গ্রামবাসীরা গ্রাম প্রধান কার্বারীর নেতৃত্বে গ্রাম এলাকার বনকে এক সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা করে থাকে।
গ্রাম এলাকার বনকে তারা কয়েকটি ভাগে ভাগ করে থাকেন। যেমন : জুমভূমি, গো চারণভূমি ও রিজার্ভ বা কালিত্র। জুমভূমি হলো জুমিয়াদের জুম চাষের জন্য, গো চারণভূমি হলো গরু-মহিষ চরানোর জন্য আর রিজার্ভ বা কালিত্র হলো কার্বারী বা হেডম্যান-এর নেতৃত্বে গৃহ নির্মাণের জন্য বাঁশ-গাছের জন্য সংরক্ষিত এলাকা হেডম্যান বা কার্বারীর অনুমতি সাপেক্ষে এই সংরক্ষিত এলাকা থেকে গৃহ নির্মাণের জন্য বাঁশ-গাছ সংগ্রহ করতে পারে।
জুম চাষের ক্ষেত্রে বনভূমি সংরক্ষণেরও এ জনগোষ্ঠীর কতকগুলি রীতি প্রচলিত আছে। জুমচাষের জন্য জুমভূমি কাটা হয়ে গেলে জুম পোড়ানোর আগে কথা জুমের চারিদিকে পরিষ্কার করতে হয় যাতে জুমের আগুন বনের চারিদিকে ছড়িয়ে নাপড়ে। এভাবে জুমের আগুন থেকে বনকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
তবে আজকাল এ নিয়ম সবাই পালন করছে না। যার কারণে দেখা যায় যে, জুম এড়ানোর সাথে সাথে বনের অনেক এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বন ও চাষিদের জুমভূমি নষ্ট হয়। পূর্বে জুমচাষিরা নিজেদের স্বার্থে অর্থাৎ জুমভূমি তার স্বার্থে পাহাড়-বন যাতে আগুনে পুড়ে না যায় তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। বর্তমানে এ ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে।
ঐতিহ্যবাহী রীতি অনুসারে জুমচাষের জন্য জুমভূমি কাটার সময়কালে বড় বড় গাছপালা কাটা হতো না। পার্বত্য চট্টগ্রামে কাঠের ব্যবসা জমজমাট হবার পর জুমভূমির বড় বড় গাছসহ পাহাড়ের সব গাছ উজাড় হয়ে যায় এবং পাহাড়গুলি জুমচাষের অযোগ্য হয়ে যায়। এতে জুমচাষিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ত্রিপুরা লোকসাহিত্য
ত্রিপুরাদের রূপকথা ও লোককাহিনী অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ত্রিপুরারা এসব কাহিনীকে ককদুমা, কারাকক বলে। উল্লেখযোগ্য কারাকক-ককদুমার নাম —খুমপৈ, জুয়াংফা, সিপ্রাসা, মাথিয়া, কওয়াই কেন্দারায়, নাউঅই, ওয়াকসা রাজা ইত্যাদি।
কওয়াই কেন্দারায় : কওয়াই কেন্দারায় ত্রিপুরা শব্দ। কওয়াই-এর বাংলা হলো সুপারি আর কেন্দারায় এর অর্থ হলো শক্তিমান। এই রূপকথার নায়কের নাম কওয়াই কেন্দারায়। নায়কের এ ধরনের নামকরণের কারণ আছে। নায়কের নামকরণ ও বীরত্বের কাহিনী নিয়ে এ রূপকথা বিরচিত।
এক মহিলার চার পুত্র সন্তান ছিল। নাগ রাজার পায়খানা খেয়ে স্বাদ পেয়ে এই চার পুত্র নাগ রাজার মাংস খাবারের জন্য নাগরাজাকে মারতে যায়। তাদের ধারণা নাগ রাজার পায়খানা এতো যদি সুস্বাদু হয় নাগ রাজার মাংস আরো অধিক সুস্বাদু হবে। এই চার পুত্র নাগ রাজার খুঁজে বের হয়। তারা নাগ রাজার সাক্ষাৎ পায়।
নাগ রাজার সাথে এই চার পুত্রের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে চার পুত্র মারা যায়। কিন্তু তাদের মা অপেক্ষায় থাকে। ফিরে না আসাতে দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় মহিলাটি দিনাতিপাত করতে থাকে। অপরদিকে স্বামী গেছে কাজে। রাজার ডাকে তাকে যেতে হয়েছে। শিপাঙ গাছ কেটে রাণীর জন্য পেঁকি বানাতে হবে। লোকটি চার মাস ধরে কাটলেও ও গাছটা কাটা যায় না।
মহিলাটির দুশ্চিন্তা আরো বাড়ে। একদিন তিনি ঝাড়ু ঝাড় দিচ্ছিলেন। ঝাড়ু দিতে দিতে মেঝেতে একটি সুপারি পাওয়া যায়। এই সুপারি মহিলাটি কোমরে রাখে। তারপর কিছুক্ষণ পর দেখা যায় সুপারিটি আর নেই। কিছুদিন পর মিহলাটি অনুভব করতে থাকে, সে গর্ভবতী হতে চলেছে। এরপর সে পুত্র সন্তান লাভ করে। এ পুত্র সন্তানের নাম রাখে কওয়াই কেন্দারায়।
এই কওয়াই কেন্দারায় অনেক বলবান ও শক্তিশালী। সে শিপাঙ গাছ উপরে রাজার নিকট হস্তান্তর করে তার পিতাকে রাজার হাত থেকে উদ্ধার করে এবং নাগ রাজাকে মেরে ফেলে তার চার ভাইকে উদ্ধার করে।
ত্রিপুরাদের মধ্যে গাঁ তলিয়ো খাঁমানি রূপকথা অত্যন্ত জনপ্রিয়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে গোবিন্দ মানিক্যের শাসনামলে চট্টগ্রামের একটি জনপদের নাম নারাণ পাড়া। বর্তমানে এই গ্রামটি ফটিকছড়ি উপজেলায় অবস্থিত। এই পাড়ায় উজির বুড়া নামে এক প্রভাবশালী ব্যাক্তি বাস করতেন। এই উজির বুড়ার ছেলে গান্ধেরব’ ত্রিপুরার বিবাহ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই গীতিকাব্যটি রচিত হয়েছে।
ত্রিপুরা জাতির আদিবাসী চিকিৎসা জ্ঞান
ত্রিপুরাদের আদিবাসী চিকিৎসা জ্ঞান বেশ সমৃদ্ধ। মূলত গাছের শিকড়, লতাপাতা, ফুল-ফল, ছাল ইত্যাদি বনজ দ্রব্য-সামগ্রীর সাহায্যে চিকিৎসা করা হয়। গাছের সজীব পাতা, ছাল বা ফল-মূল-শেকড় থেকে রস নিয়ে অথবা গুড়ো করে ওষুধ তৈরি করা হয়। নিম্নে কয়েকটি রোগের চিকিৎসা বর্ণিত হলো – জণ্ডিস রোগের চিকিৎসার জন্য আমলকি, হরিতকি, বাকালা, চিরতা, পিপলি, তুলসি, অড়হর পাতার রস মধুর সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো হয়।
মইতারাবি মূল, সিকাম লামাক মূল, অরাই গাছের মূল, চেতুয়াং গাছের ছাল, গোল মরিচ ও ককেলেং গাছের মিশ্রিত রসও জণ্ডিস রোগ চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়। ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হলে ১৫টি তাজা তুলসি পাতার সাথে ১০টি কচি শিউলি পাতা একত্রে বেটে শোধিত রস মধুসহ সেবন করলে আরোগ্য লাভ হয়।
কেসেদোক বেত-এর রসও ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। বকৗসং-এর চিকিৎসার জন্য দোকসা সাঙদারি গাছের ছাল শুকিয়ে নারিকেল তেলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করলে এই রোগটি ভালো হয়। পেটের ব্যথা হলে কেসেদোক-এর আগা, পেয়ারা গাছের আগা ও তুলসি পাতা একসাথে বেটে রুল খেলে পেটের ব্যথা ভালো হয়। এছাড়া ত্রিপুরা বৈদ্যরা যুগ যুগ ধরে যক্ষ্মা রোগে, হাড়ভাঙা, বাত রোগসহ ইত্যাদি রোগের চিকিৎসা করে আসছে বনজ ঔষধি ব্যবহার করে।
ত্রিপুরা জাতির শিক্ষা
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার একেবারে কম। তবে এ বিষয়ে সরকার কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। ১৯৯৮ সালে এডিবি কর্তৃক পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের ৬৫.৫১%, মারমাদের
৫৩.১৭%, বাঙালিদের ৫২.৬০% শিক্ষার হারের বিপরীতে ত্রিপুরাদের শিক্ষার হার অত্র ২৭.২৪%। রাষ্ট্র ও সরকারি সুযোগ-সুবিধার বঞ্চনা, আদিবাসী বান্ধবহীন শিক্ষা নীতিমালা, শিক্ষা চেতনার অভাব ইত্যাদি কারণে ত্রিপুরারা শিক্ষাদীক্ষায় বেশ পিছিয়ে আছে। ত্রিপুরাদের গ্রামীণ জীবন, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বিদ্যালয় না থাকা, থাকলেও বিদ্যালয় নিয়মিত না চলা, যুগ যুগ ধরে শিক্ষার সুবিধা থেকে বঞ্চনা শিক্ষাদীক্ষায় ত্রিপুরাদের অনগ্রসরতার অন্যতম কারণ।
উপরের চিত্র থেকে এটি পরিষ্কার যে, বাঙালিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩টি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ত্রিপুরাদের জনসংখ্যা চতুর্থ হলেও শিক্ষাদীক্ষার দিক দিয়ে এর অবস্থান অত্যন্ত নিম্নে। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা যতই উপরের শ্রেণীতে উঠতে থাকে ততই তাদের ঝরে পড়ার হার বেড়ে যায়। অভিভাবকদের অসচেতনতা, দরিদ্রতা, শিক্ষক-শিক্ষিকার অদক্ষতা ও অসহযোগিতা হচ্ছে মূল কারণ। কারো কারো প্রাইমারি শিক্ষা শেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ সময়কালে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়।
যে সব কারণে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে পড়ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো গ্রামে বিদ্যালয় না থাকা, দরিদ্রতা বা অর্থনৈতিক সমস্যা, সরকারি নীতিমালা, সচেতনতার অভাব, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস, দুর্বল নেতৃত্ব, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা না পাওয়া, স্কুলে ত্রিপুরা ভাষাভাষী শিক্ষক না থাকা ইত্যাদি।
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর তিনভাগের একভাগ গ্রামে এখনো সরকারি প্রাইমারি স্কুল নেই। খাগড়াছড়ি জেলার সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের ২০টি ত্রিপুরা গ্রামের মধ্যে ১০টি গ্রামে সরকারি প্রাইমারি স্কুল নেই এবং রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় দুই-তৃতীয়াংশ ত্রিপুরা গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই।
বাংলাদেশের অপরাপর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ন্যায় এ জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরাও মাতৃভাষায় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। ইদানীং এনজিও-এর মাধ্যমে প্রি-প্রাইমারি পর্যায়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা শুরু করা হলেও সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার কোনো ব্যবস্থা নেই।
দেশের আদিবাসীরা শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ হলো এ সংক্রান্ত সরকারের এক বিশেষ নীতিমালার অভাব। তাই ত্রিপুরা ও অন্যান্য আদিবাসীর শিক্ষা উন্নয়নের জন্য দেশের শিক্ষা নীতিমালার অধীনে একটি বিশেষ ব্যবস্থা থাকা দরকার। জাতীয়ভাবে যে সব নীতিমালা রয়েছে তা আদিবাসীদের মনের জন্য যথেষ্ট নয়।
সেজন্য শিক্ষা এবং সকল ক্ষেত্রে জাতীয় মালাগুলোতে আদিবাসীদের স্বাতন্ত্র্য প্রেক্ষাপট অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। যেমনঃ আদিবাসী গ্রামে প্রাইমারি বা অন্যান্য পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান নীতিমালা শিথিল করা প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী আদিবাসী গ্রামগুলির পরিবার সংখ্যা ২০/৩০-এর মধ্যে। ২০/৩০ পরিবার নিয়ে গঠিত গ্রামে ১০০ ছাত্র-ছাত্রী পাওয়া বড়ই দুষ্কর।
অথচ জাতীয় শিক্ষা নীতি অনুসারে কোনো গ্রামে নতুন প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে গেলে কমপক্ষে ১০০ ছাত্র-ছাত্রী দরকার। এ ক্ষেত্রে আদিবাসীদের জন্য নীতিমালা শিথিল করা দরকার। হাইস্কুল বা কলেজে পড়তে আসা প্রত্যন্ত এলাকার ছাত্রছাত্রীদের জন্য লেখাপড়া করার সরকারিভাবে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেই।
পড়াশোনার খরচ বহন করতে পারার কারণে প্রত্যন্ত এলাকার ছাত্র-ছাত্রীরা ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠে পড়াশোনা বন্ধ করতে হয়। দারিদ্র্য ও আর্থিক সংকটের কারণে অনেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না। হাইস্কুল বা কলেজে পড়তে আসা প্রত্যন্ত এলাকার ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া নিশ্চিত করার জন্য সরকারের তরফ থেকে হোস্টেল ও অন্যান্য সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে।
এক সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যন্ত এলাকা ও গরিব ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকার ছাত্রছাত্রী এবং গরিব আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিল। আবাসিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো থাকলেও সরকারের অর্থায়নের অভাবে বিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রত্যন্ত এলাকার ছাত্রছাত্রীদের জন্য লেখাপড়া নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়া-বই-পুস্তক-পোশাক-পরিচ্ছদসহ আবাসিক বিদ্যালয় চালু করা জরুরি প্রয়োজন। পাশাপাশি ত্রিপুরা বা ত্রিপুরাদের মতো পিছিয়ে থাকা আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের জন্য দেশে উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ ও বিদেশে স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করার ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা থাকা দরকার। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও ত্রিপুরাদের অবস্থান আরো হতাশাব্যঞ্জক বলা চলে। বিগত কয়েক বছরের উচ্চশিক্ষায় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী শিক্ষার্থী সংখ্যা চিত্র নিম্নে দেয়া গেল :
সাল |২০০০] ২০০১] ২০০২ । ২০০৩ | ২০০৪ ২০০৫। ২০০৬ | ২০০৭ ২০০৮ শিক্ষার্থী১৪ ১৭ ৮ি ৯ি ১৪ ১৩ ১৬ ১৯ | ২২
ত্রিপুরা জাতির অর্থনৈতিক সংগঠন
ত্রিপুরাদের প্রধান পেশা কৃষি। কৃষির মধ্যে রয়েছে জুমচাষ, লাঙ্গলচাষ ফলবাগান চাষ। এ সব চাষের সাথে জড়িত চাষিদের বাইরে রয়েছে চাকরিজীবী, কতিপয় ব্যবসায়ী ও দিনমজুর। এছাড়া সমাজে আর একটি পেশাজীবী আছে যারা প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল। তারা জঙ্গল থেকে লাকড়ি, শন, তরকারি ইত্যাদি সংগ্রহ করে বিক্রি করে জীবন ধারণ করে।
জুম চাষ’ ত্রিপুরাদের জীবন-জীবিকার প্রধান পেশা। সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ত্রিপুরা আদিবাসীরা অতীতে মূলত জুম চাষের উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। জুমের উপর ভিত্তি করেই ত্রিপুরাদের অর্থনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ত্রিপুরাদের নাচ, গান, ছড়া, গল্প, মূল্যবোধ, বাদ্য-যন্ত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি গড়ে উঠেছে জুম চাষকে কেন্দ্র করে।
অরণ্যাবৃত কোনো পাহাড়ের জঙ্গল কেটে সেই পাহাড়ের কর্তিত জঙ্গল, গাছপালা, লতাপাতা শুকিয়ে গেলে তা পুড়ে ফেলে পরিষ্কার করে তাতে ধান, তিল, সুতা, ভুট্টা, মারফা, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, শাক-সবজি ইত্যাদি এক সাথে চাষ করার পদ্ধতিকে ‘জুমচাষ’ বলে। জুমে একই পাহাড়ে একই সময়ে বিভিন্ন প্রজাতির শস্য একসাথে চাষ করা হয়ে থাকে।
বর্তমানে জুম চাষের বিরতিকাল ৩৬ বছরে নেমে এসেছে। আগেকার দিনে জুম চাষের এই বিরতিকাল ১০-১৫ বছর ছিল। প্রাকৃতিক উপায়ে জুমভূমির উর্বরতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এভাবে জুমভূমিকে দীর্ঘ বছর পতিত অবস্থায় রাখা হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জুমভূমির স্বল্পতার কারণে জুমভূমির বিরতিকাল হ্রাস পেয়েছে।
সাধারণত পৌষ-মাঘ মাসে জুম চাষের জন্য জঙ্গল কাটা হয়। চৈত্র মাসে জুমের কর্তিত জঙ্গলে আগুনে পোড়া হয়। বৈশাখ মাসে ভস্মীভূত হয়নি এমন গাছের কঞ্চি, বাঁশ, লতা ইত্যাদি পরিষ্কার করা হয়। বৈশাখ মাসের শেষে বীজ বপন শুরু হয় এবং জৈষ্ঠ্য মাসের মধ্যে বীজ বপনের কাজ সম্পন্ন করা হয়।
শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি থেকে ধান পাকা শুরু হয় । ভাদ্র মাসে জুমের ধান পুরোদমে পাকে। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসে জুমের তুলা ও তিল জুমক্ষেত থেকে উত্তোলন করা হয়। ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে জুমচাষ একটি জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশবান্ধব এবং লাভজনক পদ্ধতিও বটে।
পূর্বে জুমে ১ আড়ি ধান বপন করে ৬০-১০০ আড়ি ধান উৎপাদন করা যেতো। তবে বর্তমানে জুমে ১ আড়ি ধান বপন করে পাওয়া যাচ্ছে ৩০-৬০ আড়ি ধান মাত্র। জুম চাষের ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে কোনো ধরনের সার ব্যবহার করা হয় না।
সার ব্যবহার না করেই জুমভূমিতে ধান, শাক-সবজি, মরিচ, মসলা, তিল, ভুট্টা, কার্পাস, আলু ইত্যাদির ভালো ফলন হয়ে থাকে। জুমক্ষেতের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছড়া-ঝরনার ছড়াছড়ি। এ সব ছড়াতে মাছ, ছোট চিংড়ি, শামুক, কাঁকড়া
ইত্যাদি সহজেই পাওয়া যায়। জুমক্ষেতের পার্শ্বস্থ বনে বন্য পশুপক্ষী শিকার করা যায়। এদিক থেকে জুমচাষ একটি আত্মনির্ভরশীল চাষ পদ্ধতি।
অনেকে মনে করে থাকেন যে, জুমচাষ বন ধ্বংস করে এবং জুম চাষের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃক্ষ ও বন ধ্বংস হয়েছে। আদিবাসীরা শত শত বছর ধরে জুমচাষ করে আসছে, তথাপি পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃক্ষ ও বন উজাড় হয়নি।
বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামে যখন থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিকে কাঠ আহরণ শুরু হয়েছে তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বৃক্ষ ও বন দ্রুত ধ্বংস হতে থাকে। সুতরাং জমচাষ কখনোই পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃক্ষ ও বন ধ্বংসে প্রধান কারণ হতে পারে না।
প্রথাগত অধিকারকে অস্বীকার করে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের নামে জুমভূমি অধিগ্রহণ করা এবং ফলশ্রুতিতে জুমভূমি দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসা, জুমচাষে আশানুরূপ ফলন না পাওয়া, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর একটি অংশ বাগান চাষের দিকে ঝুঁকছে।
তবে উপযুক্ত বাজারজাতকরণের সুবিধার অভাব এবং ব্যবসা বা বাজার অর্থনীতি সম্পূর্ণ বাঙালিদের করায়ত্ব হওয়ায় অন্যান্য জনগোষ্ঠীর কৃষকদের মতো ত্রিপুরা বাগানচাষিরাও উৎপাদিত ফলমূলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে ভার বহন করে বাজারে নেয়ার পর ফলবাগান চাষিরা অনেক সময় পানির দরে তাদের উৎপন্ন কৃষি পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ ত্রিপুরা সাধারণভাবে প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় বাস করে। স্বভাবতই তাদের লাঙ্গলচাষের জমি তেমন একটা নেই বললেই চলে।
অপরদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন সার্কেলে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর কোনো সার্কেল চিফ বা রাজা না থাকার কারণে তুলনামূলকভাবে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা অধিকতর ভঙ্গুর অঞ্চলে বসতি স্থাপনে বাধ্য হয়েছে। ফলত ত্রিপুরাদের মধ্যে ধান্যজমির পরিমাণ অত্যন্ত কম বলা যায়।
এছাড়া ফেনী ভ্যালিতে ত্রিপুরাদের যে সমস্ত বিস্তৃত সমতল ধান্যজমি ছিল সেগুলো বিভিন্ন সময়ে বসতিকারী বাঙালিদের নিকট হাতছাড়া হয়ে গেছে।পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মতো ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর আবাদি ভূমি ও বাস্তুভিটা বেহাত হয়ে যাচ্ছে।
ভূমির উপর তাদের প্রথাগত অধিকারকে পদদলিত করে সরকার তাদের জুমভূমি বনায়ন, ইকো-পার্ক, পর্যটন কেন্দ্র, সামরিক স্থাপনা, অভিবাসী বাঙালি বসতি প্রদান ইত্যাদি অজুহাতে অধিগ্রহণ করে চলেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, খাগড়াছড়ি জেলার আলুটিলায় তথাকথিত ইকোপার্ক স্থাপনের নামে ত্রিপুরাদের কয়েকশত একর জায়গা-জামি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা করেছে সরকার।
এতে করে অনেক ত্রিপুরা পরিবারের তাদের জুমচাষে বিঘ্ন ঘটবে। দ্বিতীয়ত বহিরাগত বাঙালিদের দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দ্যা রুরাল পুওর (ডর্প) নামে একটি এনজিওকে বান্দরবান জেলার সরই ইউনিয়নের টঙ্গোঝিরি এলাকায় আদিবাসী ত্রিপুরা গ্রামবাসীর ২৫ একর জমি তাদের অগোচরে ইজারা দেয়া হয়।
এসব জমিতে ত্রিপুরা অধিবাসীদের বাগান-বাগিচাও গড়ে তুলেছে। তৃতীয়ত ২০০৮ সালে প্রায় ১০০ একর জুমভূমি দখল করে খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলাধীন বাদলছড়া মৌজার আলুটিলা মৌনে থেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ নামে একটি এনজিও বনায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।
এর ফলে এলাকার আদিবাসী ত্রিপুরা সম্প্রদায় উচ্ছেদ আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। এসব ভূমিতে তাদের জুমচাষ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে তাদের জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
অপরদিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পাহাড়ে বসবাসকারী ত্রিপুরা অধিবাসী তাদের জমিজমা হারিয়ে বর্তমানে ভূমিহীন জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত রয়েছে। বর্তমানে দিনমজুরি করা এবং সীতাকুণ্ড পাহাড় থেকে গাছ-বাঁশ সংগ্রহ করে বিক্রি করা ছাড়া তাদের আর জীবনজীবিকার কোনো উৎস নেই।
অনুরূপভাবে সিলেট ও কুমিল্লা বসবাসকারী ত্রিপুরাদের অবস্থাও এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। তারাও দিন দিন ভূমিহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছে নতুবা কেউ কেউ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। তাদের চিরায়ত ভূমি হাতছাড়া হয়ে ত্রিপুরারা ভূমিহীন হয়ে পড়ছে।
ফলত ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর মারাত্মক ধরনের নৈতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এমনিতেই ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তার উপর যেটুকু সম্বল আছে, সেই ভূমিও তাদের হাতছাড়া হচ্ছে।
ত্রিপুরা জাতির মাঝে ব্যবসা করে এমন লোকের সংখ্যা নিতান্ত কম। সে কারণে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক দৈন্যতা খুব বেশি পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়। ইদানীং এ জনগোষ্ঠীর কিছু কিছু লোক ব্যবসা-বাণিজ্য করার চেষ্টা-চরিত্র করছে।
মুদি দোকান, মনিহারী দোকান, ঠিকাদারি, বনজ দ্রব্যসামগ্রী ইত্যাদি ক্ষেত্রে ত্রিপুরাদের ব্যবসায় লিপ্ত দেখা যায়। শিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত বেকার লোকেরাই ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকছে বলা যায়।
তবে পুঁজির স্বল্পতা, অঞ্চলের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা, সহজ-সরল উৎপাদন মানসিকতা, ব্যাংক ঋণের অভাব, প্রশাসনের অসহযোগিতা ইত্যাদি কারণে ত্রিপুরা ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় তেমন সুবিধা করতে পারছে না।
শিক্ষিত ত্রিপুরাদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি চাকরি গ্রহণ করেছে। এিপুরাদের মধ্য থেকে হাতেগোনা মুষ্টিমেয় কয়েকজন সরকারের বিসিএস ক্যাডারভুক্ত চাকরিজীবী রয়েছে।
তবে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী থেকে বড় অফিসার পদে খুব বেশি নেই বললেই চলে। কর্মসংস্থানের অভাবের কারনে বর্তমানে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর অনেক শিক্ষিত যুবক-যুবতী বেকার জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বিভিন্ন কারণে সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকেও নানাভাবে বঞ্চিত।
এর প্রধান কারণ হলো ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষ বন-জঙ্গল পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করে। যার কারণে এ জনগোষ্ঠীর লোকেরা বরাবরই সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। যেমন : শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্য সেবা, স্বাস্থ্যসম্মত পানীয় সুবিধা, হাট-বাজার ও ব্যবসাবাণিজ্যের সুবিধা ইত্যাদি থেকে এ জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বঞ্চিত।
ত্রিপুরা নারীর অবস্থা
ত্রিপুরা সমাজে নারীরা পারিবারিক জীবন-জীবিকা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সন্তান লালনপালন ছাড়াও ত্রিপুরা নারীরা চাষাবাদ ও গৃহস্থালির সমস্ত কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কিন্তু পরিবারের এসব কাজ সমাজে খুব বেশি মূল্য দেয়া হয় না। সম্পত্তির অধিকার, শিক্ষা অধিকার, সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠনে অংশগ্রহণ সবক্ষেত্রে ত্রিপুরা নারীরা পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করে না । ত্রিপুরা সমাজে সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং সামাজিক বিচার ব্যবস্থায়ও নারীদের অংশগ্রহণ একেবারেই সীমিত।
ত্রিপুরাদের ৩৬টি গোত্রের মধ্যে বেশিরভাগ গোত্রে নারীরা উত্তরাধিকারী সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। সমাজের যে সব নারী সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে এগিয়ে এসেছে সেক্ষেত্রে সমাজের তরফ থেকে আশানুরূপ উৎসাহ-উদ্দীপনা ও সহযোগিতা তারা পায়নি।
ত্রিপুরা সমাজে এখনো কন্যা সন্তানরা নানা বৈষম্য ও অবহেলার শিকার হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবারের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো ত্রিপুরা সমাজেও পুত্রসন্তানের তুলনায় কন্যা সন্তানরা অবহেলার শিকার হয়।
অপরদিকে তারা অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের ভেতরে পুরুষ সদস্য কর্তৃক নানা সহিংসতার শিকার হয়। পরিবারে দিনভর ঘরকন্নার কাজ করার পর অনেক মেয়ে স্বামী কর্তৃক অনেক স্ত্রী নির্যাতনের শিকার হয়। বিশেষ করে মদ্যপ স্বামী পুরুষ দাপটের শিকার হয় অসহায় ত্রিপুরা নারীরা। এছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সামাজিক বেড়াজালে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো ত্রিপুরা নারীরাও আবদ্ধ থাকে।
পরিবারে, সমাজে ত্রিপুরা নারীরা যেমনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার তেমনি রাষ্ট্রীয়ভাবেও এরা বিভিন্ন নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা শাসনের উপস্থিতি ও সেটেলার বসতি স্থাপন ত্রিপুরা নারীসহ আদিবাসী নারীদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক বড় ধরনের হুমকি।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণ, খুন, অপহরণ কিংবা শ্লীলতাহানি যে কোনো আদিবাসী নারীদের জন্য এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যেমন : ২০০১ সালের ২২ মে খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গায় দুর্গাবাড়ি সেনা ক্যাম্পের কতিপয় সেনা সদস্য কর্তৃক চারজন ত্রিপুরা ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ উল্লেখ করা যেতে পারে।
একজন ধর্ষিত নারীর একবছরের শিশু সন্তান উক্ত পাশবিক ঘটনা চলাকালে আহত হয়। উক্ত ঘটনা এই এলাকায় চরম উত্তেজনা দেখা দেয় এবং ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীসহ জনমনে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়।
এতকিছু সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ত্রিপুরা সমাজে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ত্রিপুরা নারীরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শুধুমাত্র আঞ্চলিক পর্যায়ে নয়, জাতীয় পর্যায়েও ত্রিপুরা নারীরা অবদান রাখছে।
এ অবদানের স্বীকতিস্বরূপ ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর একজন নারী মানবাধিকার ও উন্নয়নকর্মী ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অনন্যা শীর্ষ দশ-এ নির্বাচিত হয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী নারী আন্দোলনের লড়াকু নারী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনে বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে আসছে।
উক্ত সংগঠনের সভাপতি ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর একজন নারী নেত্রী অলংকৃত করেছেন। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকসংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশে ত্রিপুরা নারীদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিশেষ করে নৃত্যকলা উৎকর্ষ সাধনে ত্রিপুরা নারীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য বলা যায়।
ত্রিপুরাদের রাজনৈতিক সংগঠন
ব্রিটিশ আমলে ত্রিপুরারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তেমন অংশগ্রহণের সুযোগ পায়নি। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থায় ত্রিপুরারা বঞ্চিত হয় সার্কেল বিভক্তির সময়। সেসময় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী থেকে কোনো সার্কেল প্রধান (চিফ) নিয়োগ করা হয়নি।
জানা যায়, সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলে মোট ৩১,৮৯৭ জনসংখ্যার মধ্যে ত্রিপুরাদের সংখ্যা ছিল ১৮,৫৫৯ জন আর চাকমা ও মারমাদের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৬৯৮০ ও ৬৩৫৮ জন। কিন্তু সেসময় সংখ্যার বিচারে সার্কেল প্রধান নিয়োগ করা হয়নি। মূলত ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্যতা ও রাজনৈতিক সম্পর্কই ছিল মূল বিবেচ্য।
অন্যদিকে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলা ও মং সার্কেলটি ত্রিপুরা রাজ্যের মূল ভূখণ্ডের সীমান্তবর্তী এলাকা। তাই অনেকে ধারণা করেন যে, ব্রিটিশদের রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী হতে সার্কেল প্রধান নিয়োগ করা হয়নি। ব্রিটিশরা তিনটি স্তরে পার্বত্য শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল তা হচ্ছে সার্কেল প্রধান, হেডম্যান ও কার্বারী।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩৬৯ জন হেডম্যানের মধ্যে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী থেকে বর্তমানে হেডম্যান রয়েছেন ৪০ জন। আর ত্রিপুরাদের কতজন কার্বারী বা পাড়া প্রধান রয়েছে তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীও গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রথম স্বাদ পায় ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তনের মাধ্যমে।
সেসময় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী থেকে ইউনিয়ন কাউন্সিলে কতজন ব্যক্তি চেয়ারম্যান বা মেম্বার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে তা জানা না গেলেও ত্রিপুরারা প্রথম গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আমলে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রথম স্নাতক পাশ করা সন্তান বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে (এমএলএ) নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তিনি ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও ছিলেন। বলা যায় যে, এরপর আইনসভা মতো সর্বোচ্চ জাতীয় রাজনৈতিক ফোরামে দীর্ঘকাল ধরে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী থেকে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ হয়নি। অতি সম্প্রতি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে একজন ত্রিপুরা নেতা সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
তিনি হলেন খাগড়াছড়ি জেলার আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং এককালের জনসংহতি সমিতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ শাসনব্যবস্থার অধীনে প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জন্য সদস্যপদ সংরক্ষিত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে ত্রিপুরাদের জন্য ২টি সদস্যপদ সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
এছাড়া খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে ৬টি সদস্যপদ, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদে ১টি সদস্যপদ এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদে ১টি সদস্যপদ (DPB-সহ) মোট ৮টি সদস্যপদ সংরক্ষিত রয়েছে। এছাড়া এসব পরিষদগুলোতে চেয়ারম্যান পদটি ত্রিপুরাসহ সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষিত রয়েছে।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদে সংরক্ষিত আসন অনুসারে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী থেকে দুজন সদস্য দায়িত্বরত থাকলেও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো অন্তর্বর্তী পরিষদ দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সংরক্ষিত আসন অপূর্ণই রয়ে গেছে। তবে অন্তর্বর্তী খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী থেকে পর পর কয়েকজন দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০০৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিন পার্বত্য জেলায় ২৫টি উপজেলা পরিষদের মধ্যে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী থেকে চেয়ারম্যান পদে কোনো ব্যক্তি নির্বাচিত হতে পারেনি। তবে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী থেকে পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১ জন (থানচি উপজেলায়) ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২ জন (রাজস্থালি ও থানচি উপজেলায়) নির্বাচিত হয়েছে। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী থেকে অনেকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে দায়িত্বরত রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতিতে তথা দেশের জাতীয় রাজনীতিতে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তি ভূমিকা পালন করে চলেছে। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ও জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোতে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর অনেক লোক সম্পৃক্ত রয়েছে।
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনরত বিভিন্ন নারী সংগঠন, ছাত্র সংগঠন ,যুব সংগঠন ইত্যাদি অঙ্গ সংগঠনগুলোতে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী থেকে অনেক থানায় ব্যক্তি সক্রিয় রয়েছেন। জাতীয় পর্যায়ের আদিবাসী সংগঠনেও ত্রিপুরা গোষ্ঠীর অনেকে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছে।
ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ লোক পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলে বসবাস করে বিধায় জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র আন্দোলনের সময় বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ত্রিপুরাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সাহসী ও বলিষ্ঠ। বলতে গেলে জনসংহতি সমিতির অনেক ঘাঁটি এলাকা তারাই সুরক্ষিত রেখেছিল।
নির্মম পৈশাচিক শারীরিক নির্যাতনের মধ্যেও তারা আন্দোলনরত গেরিলা সদস্য গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা রক্ষা করেছিলেন। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত ও অত্যন্ত দরিদ্র হওয়া রাজনৈতিক দিক থেকে সাধারণ ত্রিপুরারা অনেক পিছিয়ে পড়া। সাধারণভাবে তারা রাজনৈতিক সচেতন নয়। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক বঞ্চনার শিকার হলেও সংগঠিতভাবে তা মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়।
লেখক- শক্তিপদ ত্রিপুরা এবং সন্তোষ বিকাশ ত্রিপুরা
টীকা
৫৬. Sontosh Tripura : 2008:38
৫৭. Amena Mohasin 1997:29 Sontosh Tripura 2008: 37 ৫৮. Arunendu Tripura, 2001 : 31-42, Sontosh Tripura 2008:46
তথ্যসূত্র
১. পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও সংস্কৃতি সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা
২. বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনজাতি বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ, ২০০১ খ্রিস্টাব্দ
৩. পূব-ই রাবাইনি সাল বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ, ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দ
৪. ত্রিপুরা জাতি ও সংস্কৃতি প্রভাংশু ত্রিপুরা, ১৪১২ ত্রিপুরাব্দ ৫. ত্রিপুরা জাতির মানিক্য উপাখ্যান প্রভাংশু ত্রিপুরা, ১৪১০ ত্রিপুরাব্দ
৬. The Tripuras of Chittagong Hill Tracts- Baren Tripura, 1978
৭. চট্টগ্রামের ইতিহাস পূর্ণচন্দ্র দেববর্মা
৮. ত্রিপুরার ইতিহাস ড. সুপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায়
৯. রাজমালা কালীপ্রসন্ন সেন
১০. আদিবাসী জনগোষ্ঠী : জীবন ও জীবিকা জাবারাং কল্যাণ সমিতি, ২০০৪
১১. রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস শ্রী কৈলাসচন্দ্র সিংহ, গতিধারা, ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ
১২. অসিতচন্দ্র চৌধুরী, স্বাধীন ত্রিপুরা সেন্সস রির্পোট ১৩১০ ত্রিপুরা (১৯০১খ্রিস্টাব্দ), আগরতলা, ত্রিপুরা, ১৩১৫ এিং (১৯৯৫)
১৩. উপেন্দ্র রুপিনী : রুপিনী সমাজের রূপরেখা, ত্রিপুরা রাজ্য উপজাতি সাংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র ও সংগ্রহশালা, ত্রিপুরা সরকার,১৯৯৮
১৪. কুমুদ কুন্ডু চৌধুরী (সম্পাদিত), এ হু হু,ককবরক হা নি কক গসিজাকমা বিসি ২৫ পালায়মুঙ-মুকুমু বৗচাপ ত্রিপুরা রাজ্য উপজাতি সাংস্কৃতিক গবেষণা কেন্দ্র ও সংগ্রহশালা,
ত্রিপুরা সরকার, আগরতলা, জানুয়ারি, ২০০৪
১৫. জগৎজ্যোতি রায় : বিদ্রোহ বিবর্তন ও ত্রিপুরা ১৯৯৯, ত্রিপুরা দর্পণ
১৬. য়াখৗতৗং, ককবরক তের সংখ্যা, ২০০০; আগরতলা, ত্রিপুরা
১৭. ড. পদ্মিনী চক্রবর্তী, ত্রিপুরা উপজাতি নৃত্য : একটি সমীক্ষা, ত্রিপুরা রাজ্য উপজাতি সাংস্কৃতিক গবেষণা কেন্দ্র ও সংগ্রহশালা, ত্রিপুরা সরকার, মার্চ ১৯৯২
১৮. প্রশান্ত ত্রিপুরা ও অবন্তী হারুন, পার্বত্য চট্টগ্রামে জুমচাষ, সেড, ঢাকা, ২০০৩
১৯. শুভব্রত দেব, রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস, অক্ষর, আগরতলা ত্রিপুরা, ১৪০৫ বঙ্গাব্দ
২০. সমীরন রায় (সম্পাদিত) : ত্রিপুরা দর্পণ তথ্যপুঞ্জি ও নির্দেশিকা ২০০৭
২১. সন্তোষ বিকাশ ত্রিপুরা, জুম চাষ ও রাষ্ট্রীয় নীতি : পার্বত্য আদিবাসীদের ভূমি অধিকারের প্রসঙ্গ, এই প্রবন্ধটি উপস্থাপিত হয়েছিল গত ১৮ অক্টোবর,২০০৮ সালে ঢাকায় ওয়াইডব্লিওসিএ মিলনায়তনে
২২. Amena Mohasin, The politics of nationalism : the cases of the CHT, Bangladesh, the Uiversity Pess Lmited, Dhaka, 1997.
২৩. Anugatamani Akhanda, Marraige system of tribal societies of Tripura (A study based on major tribes), Tribal Research Institute, Govt. of Tripura, Agartala, Tripura, 1995
২৪. Benimadab Majumder, The legislative opposition in Tripura, Tripura State tribal cultural research institute and Museum, Govt. of Tripura, Agartala
২৫. Chittagong Hill Tracts District Gazetteer, Statistics, 1901-1902, the Bengal secretariat book depot, Calcutta, 1905 : 7
২৬. Dr. Dwijendra Lal Bhowmik, Tribal Religion of Tripura, A Socio Religious Analysis, Tribal Research Institute, Government of Tripura, Agartala, 2003
২৭. Dr. Direndra Chandra Nath, Sri RAJMALA (VOL-I-IV), Tribal Research Institute, Govt. of Tripura, Agartala, 1999
২৮. D. K. Tyagi, Tribal Folks of Tripura, Tripura State, Tribal Cultural Research Institute & Museum, Government of Tripura, January, 1997
২৯. Dr. Chandrika Basu Majumder, Democratic Heritate of Tribes of Tripura, Tribal Research Institute of Tripura, Agartala, February, 2002
৩০. Dr. Bibhas Kanti Kalikdar, Customary Laws and Practices Riangs of Tripura, Tribal Research Institute, Agartala, November, 1998
৩১. Dr. D.N Goswami & Sri Arun Debbarma, The Administrative Report of Tippera State from the years (1894-95, 1914-1915, 1918-19), Tribal Nesearch and Cultural Institute, Govt. of Tripura, Agartala.
৩২. J.G. Cumming, Survey and Settlement of the Chakla Roshnabad Estate m the district of Tippera and Noakhali, 1892-99, Tripura State Tribal Cultural Research Institute and Museum, Goverment of Tripura Agartala, December, 1997 Pradip Nath Bhattacharjee, Tha Jamatiyas of Tripura, Directorate of Research, Department of welfare for sch. Tribes and sch. castes, Government of Tripura, 1983
৩৩. Prasanto Tripura, 1992. The colonial foundation of pahari ethnicity,the journal of social studies, [Dhaka : Centre for Social Studies, Dhaka University] no. 58
৩৪. Priyabrata Bhattacharjee, Tribal pujas and festivals in Tripura, Directorate of Tripura State Tribal cultural research institute and museum, Govt. of Tripura, Agartala
৩৫. S.B.K. Dev Varman, The tribes of Tripura, A dissertation, Directorate of Research, Tribal Research Institute of Tripura, Agartala, December 2003
৩৬. Sontosh Kumar Chakraborty, A study of Tripura language, Tribal Research Institute, Govt. of Tripura, Agartala, Tripura, July, 1989
৩৭. Sontosh Bikash Tripura, Blaming Jhum, Denying Jhumiya, Challenges of the Indigenous peoples land rights in the Chittagong Hill Tracts, Bangladesh, A case study on Chakma and Tripura, M. Phil Thesis, University of Tromso, Norway.
৩৮. The cases Poverty in the Chittagong Hill Tracts, Research and Advisory Services
৩৯. Sontosh Tripura and Tone Bleie, 2008, emerging issues of Indigenous Peoples Rights in Bangladesh : why application of international law remains an uphill struggle, Solidarity, Bangladesh Indigenous Peoples Forum.
20
৪০. Tone Bleie, 2005, Tribal Peoples, Nationalism and the Human Rights Challenges : The Adivasis of Bangladesh, University Press Limited.
৪১. Willem van Schendel (ed.), Francies Buchanan in Southeast Bengal (1798) His journey to Chittagong, the Chittagong Hill Tracts, Noakhali and Commilla, University Press Limited, 2008
৪২. web link:
৪৩. Government letter to the commissioner of Chittagong Hill Tract: dated the 27 December 1838]
44. Situational Analysis, Strategies and Action Plan for Mainstreaming Indigenous Children’s Education Outside the Chittagong Hill Tracts by Sanjeeb Drong, January 2006 following Sharing Meeting DPE]
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।