ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বিবাহ বিচ্ছেদ (কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ)
994
ত্রিপুরা বিবাহ বিচ্ছেদ
ত্রিপুরা পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করাকে ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ বলা হয়। তবে সনাতন ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরা সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদকে সহজে অনুমোদন করা হয় না। এ ধরণের ঘটনাকে অপরাধ হিসেবে সমাজে গণ্য করা হয়। তবে ত্রিপুরাদের খ্রিস্ট ধর্মানুসারীদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ নিষিদ্ধ।
এই জাতীয় সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য দেশের প্রচলিত আইনের আশ্রয় নিতে হয়। বাংলাদেশে প্রযোজ্য হিন্দু দায়ভাগা আইনানুসারে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর আইনী কোনো প্রকার সুযোগ নেই। তবে ত্রিপুরা সম্প্রদায়- সনাতন ধর্মাবলম্বী হলেও হিন্দু দায়ভাগা আইনানুসারে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিষয়সমূহের নিষ্পত্তি হয় না, যে কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত বিষয়ে ত্রিপুরা সমাজে কোনো প্রকার সমস্যার উদ্ভব হলে সেক্ষেত্রে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সামাজিক আদালত হতে স্বামী-স্ত্রীকে পরপর তিন হতে চার বার নিজ নিজ অপরাধ সংশোধনের সুযোগ দেয়া হয়।
বিবাহ বিচ্ছেদের বিভিন্ন পদ্ধতি
স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কোনো একজনের মৃত্যুতে ত্রিপুরা সমাজ স্বীকৃত একটি দাম্পত্য জীবন তথা বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে সমাজ ও আইন স্বীকৃত উপায়ে নিম্নবর্ণিত কারণে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে তাদের জীবদ্দশায় বৈবাহিক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি বা ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ হতে পারেঃ-
ক) স্বামী-স্ত্রী উভয়ে স্বেচ্ছায় সামাজিক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে ‘সুরানি’ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘কাকলাইমুকাও লাইমঃ সম্পাদন করতে পারে।
খ) সামাজিক আদালত বা বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমের আওতায় ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ করা যায়।
গ) ইদানীং শিক্ষিত সমাজে স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট/নোটারী পাবলিক-এর নিকট হলফনামা সম্পাদন মূলে ‘সুরানি’ ঘোষণার মাধ্যমে ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ সম্পাদন করা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে সম্পাদিত হলফনামার কপি একপক্ষ তার নিযুক্ত আইনজীবির মাধ্যমে অপরপক্ষকে প্রেরণ করে থাকে। (যদিও তা সামাজিক প্রথাসিদ্ধ নয়)।
কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ দাবী করার অধিকার লাভ করে: নিম্নোক্ত কারণে ত্রিপুরা সমাজে স্বামী বা স্ত্রী ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ প্রদানের অধিকার লাভ করে।
ক) স্বামী যদি দৈহিক মিলনে অক্ষম বা পুরুষত্বহীন হয় কিংবা স্ত্রী গর্ভধারণে অক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যথোপযুক্ত ডাক্তারী পরীক্ষার সনদ পত্র দ্বারা ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ দাবী করতে পারে।
খ) স্বামী বা স্ত্রী যদি পরকীয়া কিংবা ব্যভিচারে বা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে লিপ্ত হয় এবং এ ধরণের অপরাধের জন্য যে কোনো একজন তাদের সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়, তাহলে অপরজন ‘কাকলাইমুং’ দাবী করতে পারে।
গ) স্ত্রীর সম্মতি বা অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামী দ্বিতীয়বার বিবাহ করলে, সেক্ষেত্রে সতীনের সাথে একত্রে বসবাসে অসম্মত হয়ে প্রথমা স্ত্রী ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ দাবী করতে পারে।
ঘ) স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের যে কেউ একজন নিরুদ্দেশ হলে এবং ৬ মাস হতে ১ বছর পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে কোনো প্রকার দাম্পত্য সম্পর্ক বা পারিবারিক যোগাযোগ না থাকলে, সেক্ষেত্রে যে কোনো একপক্ষ তার সামাজিক আদালতে একতরফাভাবে ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ সম্পাদন পূর্বক দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হতে পারে।
ঙ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত অথবা বিকৃত রুচির হলে, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ ‘ প্রদান করতে পারে।
চ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন জঘন্য অপরাধে দন্ডিত হয়ে যদি দীর্ঘদিন কারাভোগে থাকে, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে একতরফাভাবে ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ দাবী করতে পারে।
ছ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি ধর্মীয় পুরোহিত তথা সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করে কিংবা বৈষ্ণব বা বৈষ্ণবী রূপে ধর্মীয় জীবনযাপন করে, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ একতরফাভাবে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ সম্পাদন করতে পারে।
জ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি নিষ্ঠুর প্রকৃতির, অহেতুক সন্দেহপ্রবণ, মাদকাসক্ত, অকর্মণ্য এবং নির্যাতনকারী হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ সম্পাদন করতে পারে।
ঝ) স্ত্রী যদি স্বামীর সংসারে প্রাপ্য ভরনপোষণ, ন্যায্য অধিকার, চিকিৎসা-সেবা ও পারিবারিক মর্যাদাসহ স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সেক্ষেত্রে সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ সম্পাদন করতে পারে।
ঞ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একপক্ষ যদি অবিশ্বস্ত হয় বা অবাধ্য হয়, পারিবারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালনে অনিচ্ছুক বা উদাসীন হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ প্রদান করতে পারে।
বিবাহ বিচ্ছেদের আইনগত ফলাফল
ক) সমাজ স্বীকৃত পদ্ধতিতে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ সম্পাদিত হলে স্বামী-স্ত্রী যে কেউ পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। এরূপ বিবাহ বহুবিবাহ হিসেবে গণ্য হয় না।
‘কাকলাইমুং’ সম্পাদনের পর স্বামী বা স্ত্রী এমনকি উভয়ের সম্মতিতে দৈহিক মিলন অবৈধ হয়। এরপ দৈহিক মিলনজাত সন্তান অবৈধ বা জারজ হিসেবে গণ্য হয়। স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো পক্ষ দ্বারা ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ সম্পাদনের পর পারস্পরিক সমঝোতা ও আস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে পুনরায় দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হয়। তবে ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ সম্পাদনের পর উভয়ের যদি অন্যত্র বিবাহ না হয় সেক্ষেত্রেই ‘কাইজালাইমুখ/কাইজালাইবাড়ি’ অনুষ্ঠান সম্ভব হয়।
‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ সম্পাদনের পর স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে উভয়ের প্রতি পারস্পরিক অধিকার এবং কর্তৃত্ব হারায়।
‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ সম্পাদনের পর স্ত্রী তার পূর্ব স্বামীর উত্তরাধিকারসহ পারিবারিক পদবী ও মর্যাদা হারায়।
‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ সম্পাদনের পর স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিসহ প্রাপ্য ভরনপোষণ হতে স্ত্রী বঞ্চিত হয়। স্ত্রীর অর্জিত সম্পদের উপরেও স্বামীর অধিকার থাকবে না। স্বামী সরকারী চাকুরীজীবী হলে তার মৃত্যুর পর ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ প্রাপ্ত স্ত্রী পেনশন সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়।
‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ সম্পাদনের সময় সামাজিক আদালতে পক্ষগণের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ সাপেক্ষে দাফা (পণ) সংক্রান্ত পরস্পরের দেনা-পাওনা পরিশোধ করতে হয়।
‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ সম্পাদনকালে স্ত্রী গর্ভবতী অবস্থায়
‘কালাইমুং’ বা বিবাহ বিচ্ছেদের সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী অবস্থায় অনাগত সন্তানের উপর দায়দায়িত্ব থাকে অথবা ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ সম্পাদনের পর স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ সত্ত্বেও যদি ধাত্রী বিদ্যামতে প্রমাণিত হয় যে, বিচ্ছেদ পূর্ব সময়ে স্ত্রী গর্ভবতী ছিল, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্বামীর উপর উক্ত সন্তুানের পিতৃত্বের দয়া বর্তায়।
উক্ত সন্তান অবৈধ বা জারজ গণ্য হয় না। উক্ত সন্তান তার পিতার নিকট হতে ভরনপোষণ পায় এবং আইনগত উত্তরাধিকারী হয়। বিচ্ছেদকালে গর্ভবতী স্ত্রী সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত মতে স্বামীর নিকট হতে ভরনপোষণসহ সন্তান প্রসবের যাবতীয় খরচ পায়। তবে উক্ত সন্তান সাবালকত্ব অর্জন না করা পর্যন্ত বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর হেফাজতে রাখার অধিকার থাকবে।
বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর অন্যত্র বিবাহ হলে সেক্ষেত্রে সন্তান যদি মাতৃদুগ্ধ পান করে তাহলে সন্তানের জন্মদাতা পিতা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে নাবালক সন্তানের অভিভাবক হয়।
বিবাহ বিচ্ছেদ বা ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ সম্পাদনের তারিখ হতে পরবর্তী ২৮০ দিন পর দ্বিতীয় বিবাহ ব্যতীত বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভে যদি কোনো সন্তান জনুগ্রহণ করে, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত উক্ত সন্তান অবৈধ বা জারজ বলে গণ্য হয় না এবং বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্বামী উক্ত সন্তানের পিতৃত্ব গ্রহণে বাধ্য থাকে না। তবে ‘কাকলাইমুং/কাওঃ লাইমঃ’ সম্পাদনের পর স্ত্রীর পূনঃ বিবাহ হলে তখন গর্ভজাত সন্তানের পিতৃত্বের বিষয়টি ধাত্রী বিদ্যামতে বা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে নির্ধারিত হয়।
তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।