ত্রিপুরা সমাজের বিবাহ সংস্কৃতি
1176
বাংলাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ত্রিপুরা একটি অন্যতম নাম। এদেশের পাহাড় ও সমতলের বিভিন্ন এলাকায় এ জনগোষ্ঠীর বসবাস থাকলেও ত্রিপুরাদের অধিকাংশই বসবাস করে পার্বত্য চট্টগ্রামে।
এই জনগোষ্ঠীর যেমন রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য তেমনি প্রচলিত রয়েছে নিজস্ব বিবাহরীতিও। আর এই বিবাহরীতি অনুসরণ করে ত্রিপুরারা যুগ যুগ ধরে সম্পাদন করে আসছে তাদের বিবাহকার্য।
ত্রিপুরা বিবাহরীতিতে সাধারণত পারিবারিকভাবে অভিভাবকদের পছন্দ অনুযায়ী পাত্র-পাত্রী নির্বাচনপূর্বক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নানারকম সামাজিক রীতি-নীতি ও অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়ে থাকে।
প্রথমে কোন ছেলের অভিভাবক কোন মেয়েকে পছন্দ হলে কোন নিকট আত্মীয় অথবা পরিচিত জনের মাধ্যমে কনের অভিভাবকের নিকট তাদের সম্পর্কের ইচ্ছা জানিয়ে থাকে।
এরপর উভয় পক্ষের সম্মতি থাকলে পঞ্জিকার শুভদিন দেখে বরের বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজন বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন- পিঠা, নারিকেল, মদ, পান-সুপারি, মিষ্টি ইত্যাদি নিয়ে পাত্রীর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায়।
দুই পক্ষের আলোচনায় কনের পক্ষ থেকে চাহিদা যেমন- গয়না-গাঁটি, কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য ভরণ-পোষণ, বিয়ের আয়োজন কিরকম হবে, বাদ্য-বাজনা আনবে কিনা, দাফা (যৌতুক) দিতে হবে কিনা ইত্যাদি উত্থাপিত হয়।
আলোচনায় উপস্থিত কনে, কনের বাবা-মা সহ সকলের মতামত গ্রহণের মাধ্যমে পঞ্জিকা দেখে বিয়ের দিন ধার্য করা হয়।
অতপর নির্ধারিত তারিখে বর, বরের বাবা অথবা মা , নিকট আত্মীয়স্বজনের কয়েকজন ও গ্রামের গণ্যমান্য কয়েকজন মিলে বরযাত্রী দল গঠন করে প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে কনের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
তবে এ দলে বরের ভাই ও বোন লাগে এমন দুইজন বালক-বালিকাকে গয়না হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়। বর যাত্রী কনের বাড়িতে পৌঁছলে প্রথমে বরযাত্রীদেরকে উঠানে বসিয়ে পিঠা ও শরবতসহ বিভিন্ন প্রকার হাল্কা নাস্তা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।
অতপর কনের মা বরকে একটি বাইলিং অর্থাৎ কুলায় ধূপ জ্বালিয়ে বরণ করে ঘরের ভেতরে নিয়ে বসায় এবং বর পক্ষের নিয়ে আসা গহনা, রিনাই, রিসা, সাজগোজ করার বিভিন্ন দ্রব্যাদি গ্রহণ করে কনেকে সাজগোজ করানোর জন্য নিয়ে যায়।
সাজগোজ সম্পন্ন হওয়ার পর কনেকে বরের পাশে বসানো হয় এবং এসময় বরের সাথে আসা দুইজন গয়নাকেও দুইপাশে বসানো হয়।
অতপর কনে পক্ষের আত্মীয়-স্বজন সকলেই বর-কনের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং কনেপক্ষের আয়োজনকৃত ভোজন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। ভোজনসহ বিভিন্ন আয়োজন শেষে কনে মা-বাবা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, চাচা-চাচী, মামা-মামী, ভাই-বোনসহ সকল নিকট আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বরের সাথে চলে যায়।
রওনা দেওয়ার সময় কনের সাথে কনে পক্ষের কয়েকজন নিকট আত্মীয়-স্বজনও থাকে। যাওয়ার পথে কনে পক্ষের বিশেষ করে দাদা-দাদী, নানা-নানী, দুলাভাই-ভাবীসহ অনেকেই অভিমান করে থাকে এবং তাদের অভিমান ভাঙ্গার জন্য চাহিদানুযায়ী বিভিন্ন জিনিস প্রদান করলে খুশিমনে বরের বাড়িতে যায়।
বরের বাড়িতে পৌঁছামাত্র বাড়ির উঠানে বর কনেসহ কনেপক্ষের সবাইকে বসিয়ে বরপক্ষের লোকজন বিভিন্ন রকম পিঠা, শরবত, মিষ্টিসহ ফলমূল দিয়ে আপ্যায়ন করে।
এর পর দরজার সামনে বরের ছোট ভাই কনের পা ধুইয়ে জল পান করে এবং বরের মা বাইলিং অর্থাৎ কুলায় ধূপ জে¦লে বরণ করে নিয়ে বাড়িতে ঢুকিয়ে নিয়ে যায়।
এরপর পঞ্জিকার বিবাহলগ্ন অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে গ্রামের অচাই (ওঝা) অথবা পুরহিত বিবাহ কার্যটি সম্পন্ন করেন। বিবাহ কার্যটি সম্পাদনের সময় উপকরণ হিসেবে কলাপাতার উপরে দুই মুঠো ভাত, বাঁশের চোঙায় মদ ও পানি, মুরগীর দু’টি রান সিদ্ধ, সিন্দুর, তুলা, চাল ইত্যাদি নেওয়া হয়।
অতপর বর কনে ছড়ায় গিয়ে গঙ্গা প্রণাম করার পর কলসীতে করে ছড়া থেকে জল এনে বাড়িতে ঢুকে রান্না ঘরের চুলা, কাঠি ইত্যাদি প্রণাম করে।
পরের দিন বরের বাড়ির উঠানে নতুন সংসারের মাঙ্গলিক পূজা হিসেবে কাথারক পূজা দেওয়া হয় এবং সাধ্যানুযায়ী ভোজের আয়োজন করা হয়। ভোজনে আত্মীয়-স্বজন, গ্রামবাসী এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের অংশগ্রহণে ঘর-বাড়ি মুখরিত হয়ে উঠে।
সকলেই সংসার জীবনের সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করে বর ও কনেকে আশীর্বাদ প্রদান করে থাকে। সেদিন কনের বাবা-মা ও আত্মীয় স্বজন বরের বাড়িতে এসে ভোজনে অংশগ্রহণ করে এবং মেয়েকে বর ও বরের মা বাবার নিকট মেয়ের দায়িত্ব বুঝে দিয়ে পরের দিন চলে যায়।
তবে বর্তমানে এ রীতি নীতি উপেক্ষা করে অধিকাংশ ছেলেমেয়েরাই নিজেদের পছন্দের পাত্র বা পাত্রী ঠিক করে পরে অভিভাবকের সম্মতি অনুযায়ী বিবাহ কার্য সম্পাদন করে থাকে।
অনেক সময় বিবাহে অভিভাবকের অসম্মতি থাকলে বর-কনে পালিয়ে গিয়ে কোন মন্দিরে অথবা অচাই (ওঝা) এর মাধ্যমে বিয়ে করে থাকে। আর অনেক সময় বর কনের বাড়িতে এসে বিবাহকার্য সম্পাদন করে থাকে।
এক্ষেত্রে বরকে ঘরজামাই হিসেবেই কনের বাড়িতে থাকতে হয়। এছাড়াও ত্রিপুরা সমাজের বিধবা নারীদের বিবাহ করার রীতিও প্রচলিত রয়েছে।
অতীত ও বর্তমান সমাজের সামাজিক রীতিনীতির মধ্যে মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সাদৃশ্য থাকলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তনও পরিলক্ষিত হয়।
আর এ পরিবর্তনের ছোঁয়া ত্রিপুরা সমাজের বিবাহ রীতিতেও লেগেছে বলে অনেককে রিনাইয়ের পরিবর্তে শাড়ি অথবা ধূতির পরিবর্তে প্যান্ট-শার্ট পরিধান করতে দেখা যায়।
তবুও এ সুন্দর, সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় ত্রিপুরা বিবাহরীতি অনুসরণীয় হয়ে থাক সকল ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বিবাহকার্যে ,এই প্রত্যাশা রইল।
লেখকঃ মুকুল কান্তি ত্রিপুরা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।