ত্রিপুরা রূপকথা : চার বন্ধুর জুমচাষ
774
ত্রিপুরার এক ঘন বন। সেখানে বাস করে চার বন্ধু।
চার বন্ধুর একটি বাঘ, একটি শূকর, একটি শিয়াল আর একটি মুরগি। তারা একে অপরকে খুব ভালোবাসে।
বেশির ভাগ সময় তারা একসঙ্গে কাটায়। একদিন চার বন্ধু ঠিক করল তারা জুমচাষ করবে। এ কাজে আয় হলে তারা একটি ঘর বানাবে।
সে ঘরে তারা একসঙ্গে বসবাস করবে। চার বন্ধু সিদ্ধান্ত নিল, তারা একের পর আরেকজন পর্যায়ক্রমে জুমখেতে কাজ করবে, খেত তৈরি করবে, বীজ বুনবে, ফসল কাটবে।
কোনো এক শুভদিনে চার বন্ধু জুমখেত তৈরির জন্য জমি খুঁজতে বের হল।
অনেক চেষ্টার পর জুমচাষের জন্য খুবই উপযোগী একটি জমি তারা খুঁজে পেল।
জমিটিতে আছে অনেক ঝোপঝাড় ও বুনো লতাপাতার সমাহার, যা জুমখেত তৈরির জন্য খুবই উপকারী।
চার বন্ধু সিদ্ধান্ত নিল প্রথম দিন শূকর, শিয়াল আর মুরগি জুমখেতে কাজ করবে। আর বাঘের জন্য এটা বিশ্রামের দিন।
খুব ভোরে ওঠে শূকর, শিয়াল আর মুরগি কাজ শুরু করল। বন্ধুদের মাঠে কাজ করতে দেখে বাঘ বলল, বন্ধুরা, তোমরা সারাদিন মাঠে কাজ করছ, তাই তোমাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা আমার দায়িত্ব।
আমি ঘরে গিয়ে তোমাদের জন্য খাবার তৈরি করব। তোমরা সবাই সময়মতো খাবার খেতে চলে এসো। বাঘের এ প্রস্তাবে সবাই রাজী হল।
তারা বাঘকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে বলল। তারা বলল, সময় মতো সবাই বাঘের বাড়িতে খাবার খেতে চলে আসবে।
বাড়ি ফিরে বাঘ রান্না শুরু করল। চুলায় ভাতের হাঁড়ি চাপিয়ে দিল।
তারপর সে গেল শিকারে। বাঘ একটা হরিণ শিকার করে আনল। বন্ধুদের জন্য খুব যত্ন করে হরিণটাকে রান্না করল।
তিন বন্ধু জুমখেতের কাজ শেষ করে বাঘের বাড়ি গেল। বাঘ তাদের খাবার খেতে দিল। চার বন্ধু একসঙ্গে খেল।
খাবারগুলো তাদের খুব ভালো লাগল। এত স্বাদের রান্নার জন্য বাঘকে সবাই ধন্যবাদ দিল।
পরদিন ছিল শূকরের ছুটির দিন। বাঘ, শিয়াল ও মুরগি মাঠে কাজ শুরু করল। শূকর বন্ধুদের জন্য খাবার তৈরির প্রস্তাব দিল।
সবাইকে কাজ শেষে তার বাড়ি চলে আসতে বলল। শূকর বাড়ি ফিরে খাবার তৈরি শুরু করল। চুলায় ভাতের হাঁড়ি চাপিয়ে দিল।
তারপর বের হল বুনোআলু যোগাড় করতে। শূকর ফিরে আসতে আসতে ভাত রান্না হয়ে গেল। তারপর সে বন্ধুদের জন্য বুনোআলু রান্না করল।
জুমখেতে কাজ শেষে সবাই শূকরের বাড়িতে খাবার খেতে এলো। তারা এক সঙ্গে খাবার খেল।
খাওয়া শেষে সবাই শূকরের তৈরি খাবারের খুব প্রশংসা করল। সবাই তাকে ধন্যবাদ জানাল।
পরদিন ছিল শিয়ালের বিশ্রামের দিন। বাড়িতে কিছু সমস্যা থাকার কারণে সে ছুটি কাটাতে আপত্তি করল।
শিয়াল প্রস্তাব দিল সে মাঠে কাজ করবে তার পরিবর্তে আজ মুরগি বিশ্রাম নিক। আলোচনা শেষে বন্ধুরা সবাই।
একমত হল আজ মুরগি বিশ্রাম নিবে। নিয়ম অনুসারে মুরগি বাড়ি গিয়ে। খাবার তৈরি করবে।
বাড়ি পৌছে মুরগি ডিম পাড়ল। তারপর ভাত রান্না করল, ডিম আর সবজি রান্না করল।
কাজ শেষে বন্ধুরা সবাই মুরগির বাড়ি এলো। সবাই একত্রে খাবার খেল। খাওয়া শেয়ে মজার মজার খাবারের জন্য মুরগিকে সবাই অনেক ধন্যবাদ জানাল।
পরদিন শিয়ালের বিশ্রামের দিন। এ কথা আগেই ঠিক করা ছিল। শিয়ালকে বলা হল বাড়ি গিয়ে ছুটি কাটাতে।
নিয়ম অনুসারে শিয়াল আজ তিন বন্ধুর জন্য খাবার তৈরি করবে। শিয়াল বাড়ি গিয়ে রান্না করার জন্য তেমন কিছুই খুঁজে পেল না।
অনেক ভেবে সে সিদ্ধান্ত নিল বন্ধুদের জন্য মাংস রান্না করবে। তাই সে শিকার করতে গেল।
সে বাঘের মতো হরিণ শিকার করতে চাইল। কিন্তু হরিণের শিং দেখে সে ভয়ে ফিরে এলো। তারপর চিন্তা করল শূকরের মতো বুনোআলু এনে রান্না করবে।
কিন্তু মাটি এত শক্ত যে মাটি খুঁড়ে আলু বের করতে পারল না। সে বিফল হয়ে আবার বাড়ি ফিরে এলো।
সব শেষে শিয়াল ঠিক করল সে মুরগির মতো ডিম রান্না করবে। তাই সে ঝুড়িতে ডিম পাড়তে বসল।
কিন্তু ডিমের পরিবর্তে বেরিয়ে এলো বিষ্ঠা। এর মধ্যে থেকে বের হল দুর্গন্ধ। তৎক্ষণাৎ শিয়াল কলাপাতা দিয়ে বিষ্ঠাটা ঢেকে দিল।
তারপর ঝুড়িটা রেখে দিল ঘরের এক কোণে। এসব করতে করতেই দুপুর হয়ে গেল। বন্ধুদেরও খাবার খেতে আসার সময় হয়ে গেল।
শিয়াল কোনো খাবার তৈরি করতে না পারার কারণে সে ভান ধরল যে তার জ্বর এসেছে। সে কথা গায়ে মুড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
কাজ শেষে বাঘ, শূকর আর মুরগি এলো শিয়ালের বাড়িতে। শিয়ালকে ওরা ঘরে দেখতে পেল না।
ওরা চিৎকার করে ডাকতে লাগল, বন্ধু তুমি কোথায়? তুমি কোথায়? তুমি কথা বলছ না কেন?
ওরাও ঘরের ভিতর থেকে দুর্গন্ধ পাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর ওরা ভাবল শিয়াল হয়তো ওদের জন্য নতুন কোনো খাবার তৈরি করেছে।
ঘরে ঢুকে ওরা দেখল শিয়াল বিছানায় শুয়ে আছে। বন্ধুদের দেখে শিয়াল বলল, আমি এখানে শুয়ে আছি। আমার খুব জ্বর।
তাই তোমাদের জন্য কোনো খাবার তৈরি করতে পারিনি। তোমরা যদি খাবার বানাও তো আমি খুব খুশি হব।
বন্ধুরা বুঝতে পারল জ্বরের কারণে শিয়াল খাবার বানাতে পারেনি। তাই তারা রান্না করার সিদ্ধান্ত নিল। বাঘ দেখল ঘরের কোণে একটা ঝুড়ি কলাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
সে ভাবল শিয়াল তাদের জন্য দুই বানিয়েছে। বাঘ ঝুড়ির ঢাকনা খুলতে চেষ্টা করছে।
এ দৃশ্য দেখে ধূর্ত শিয়াল বুঝতে পারল, বন্ধুরা ঝুড়ির বিষ্ঠা সম্পর্কে জানতে পারলে তার বিপদ আছে। শিয়াল তৎক্ষণাৎ জঙ্গলে পালিয়ে গেল।
এর মধ্যে ঝুড়িটি মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল। ঝুড়ির বিষ্ঠা ছিটকে গিয়ে পড়ল বাঘের চোখে-মুখে। বিষ্ঠার দুর্গন্ধ পেয়ে বাঘ খুব ক্ষেপে গেল।
সে গর্জন করতে লাগল। বাঘের গর্জনে অন্য বন্ধুরাও ভয় পেল। ওরা সবাই প্রাণ বাঁচাতে জঙ্গলে পালিয়ে গেল।
চার বন্ধুর জুমচাষের পরিকল্পনা ব্যর্থ হল।
তথ্যসূত্র : ত্রিপুরা আদিবাসী লোককাহিনী
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।