ত্রিপুরা রূপকথা: জেলে ও বোয়ালমাছ
900
গোমতী নদীর ধারে বাস করতো একজন গরীব জেলে। সংসারে তার একটি মাত্র ছেলে আমি একটি বউ ছিল।
মাছ ধরে যা আয় হতো তা দিয়েই তার সংসার জীবন নির্বাহ করতো। একদিন মাছ ধরতে গিয়ে তার জাল আটকে গেল পানিতে।
সে বেচারা কোনমতে ডুবটুব দিয়ে জালটা পানির উপর তুলতেই অবাক হয়ে গেল। ইয়া বড়া এক বোয়ালমাছ; তার ওজন কমপক্ষে চার পাঁচ মণের মত।
সে ভাবলো, মাছটি রাজবাড়ীতে নিয়ে গেলে ভাল হবে। যেই ভাবা অমনি বউকে ডেকে এনে অনেক কষ্টে দু’জনে মাছটা রাণীর কাছে নিয়ে গেল।
অন্দরমহলে কি ঢোকা যায়? দরজায় বসে থাকা পাহারাদারতো কিছুতেই যেতে দেবে না। অনেক হাতে পায়ে ধরে তবেই তো রানীর কাছে আসা গেল।
রাণী হাতের হিরার চুড়ি আর স্বর্ণের বালা ঘুরিয়ে এলেন সামনে। এত বড় মাছ তিনি কখনো দেখেননি।
তিনি জেলেকে বললেন, কত দাম মাছটির? জেলে দুষ্টামী করার জন্য বললো, মাছটাকেই জিজ্ঞেস করুন রাণী মা।
রাণী তো একেবারেই অবাক। মাছ কি কখনো কথা বলে? তবুও তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার দাম কত বোয়াল?
বোয়াল মাছটা উত্তর না দিয়ে মানুষের মত খিলখিল করে হেসে উঠল। রাণী অবাক হয়ে বললেন, এই মাছটি তো মানুষের মতোই হাসে।
এটা কেউ যেন না কিনে। বেচারা জেলে আর কি করে। মাছটা কথা বলে সেজন্য কেউ তাকে কিনলো না।
শেষ পর্যন্ত সেটা আবার গোমতীর গভীর জলে ফেলে দিল বাধ্য হয়ে। এদিকে রাজা ঘরে ফিরলে রাণী বিস্তারিত খুলে বললো রাজাকে এবং মাছটা কেন হাসলো সেই ব্যাপারে বিহিত করার জন্য অনুরোধ করলো।
রাজা রাজদরবারে প্রবীণ মন্ত্রীকে তলব করে পাঠালেন। মন্ত্রী আসতেই তিনি মন্ত্রীকে মাছটির ঘটনা বলে হাসির কারণ জিজ্ঞেস করলেন।
মন্ত্রী বললেন, মহারাজ বেআদবি মাফ করবেন। আমি তো কোন দিন মাছকে কথা বলতে শুনিনি। রাজা খুব চটে গেলেন।
তিনি মন্ত্রীকে বললেন, যদি একমাসের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান করতে না পারেন তাহলে গর্দান যাবে।
একমাস আপনাকে সময় দেয়া হলো। বেচারা প্রবীণ মন্ত্রী শুষ্ক মুখ ও চেহারা নিয়ে ঘরে ফিরে আসলেন।
ললাটে দুশ্চিন্তার ছাপ। স্ত্রীকে ডেকে বললেন, আমার একমাত্র ছেলেকে ডেকে নিয়ে এসো। মন্ত্রী বউ ছেলেকে ডাকলেন।
বাবা, তুই আমার একমাত্র ছেলে। একমাসের মধ্যে আমার গর্দান যাবে। হয়তো তোকেও বাঁচতে দেবেনা।
যে দিকে চোখ যায় তুই চলে যা, অন্য রাজ্যে গিয়ে আশ্রয় নিবি। কি ব্যাপার বাবা খুলে বলুন আমাকে।
প্রবীণ মন্ত্রী সব কিছুই বিস্তারিত বলে দিলেন ছেলেকে। তারপর দিন মন্ত্রীর ছেলে একটা ছাতা আর একজোড়া জুতা ও কিছু খাবার জিনিষ ও আত্মরক্ষার জন্য একটি ধারালো ছুরি নিয়ে। অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো।
যেতে যেতে যেতে অনেক মাঠ, ঘাট, প্রান্তর অতিক্রম করে সে একটা মরুপথ দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো।
পথে একজন ত্রিপুরা গোয়ালার সাথে দেখা। সে ছিল বিয়ার গোত্রের। দুজনেই পাশাপাশি এগিয়ে যেতে যেতে পরিচয় হলো।
বৃদ্ধ গোয়ালা জিজ্ঞেস করলো, বাবু গোত্র কি? নিবাস কোথায়? জবাব দিলো, ক্ষত্রিয় পেশায় সৈনিক। নিবাস নাই।
যেখানে রাত হয় সেখানেই আশ্রয় নেয়। পথে-ঘাটে সবখানেই আমার বাড়ী মশায়। সামনে একটা ঝরণার ঘোলা জল।
হাঁটু অবধি খসোতা জলে খড়কুটো নিয়ে আবর্ত রচনা হচ্ছে। মন্ত্রী পুত্র জুতা পায়ে দিয়ে ঝরণাটা পার হলো।
তারপর রাস্তায় উঠে আবার খুলে ফেললো। ছেলেটি বুড়োর পাশাপাশি হেঁটে যেতে লাগলো। বুড়োর বেদম হাসি পেল।
এতো সুন্দর ছেলে,অথচ ভীষণ বোকা। মাথার উপর দ্বিপ্রহরের কড়া রোদের আলো; কিন্তু তবু ছেলেটি হাতের ছাতাটি মেলে না।
রোদের তাপে তার চোখ-মুখ লালচে হয়ে গেছে। বুনোপথ পার হয়ে পরিত্যক্ত জুম পেরিয়ে তারা পাহাড়ের কাঁকর বিছানো পথে এগিয়ে যেতে লাগলো।
কাছেই ছিল একটা বটগাছ। দু’জনেই পরিশ্রান্ত হয়ে গল্প করতে করতে সেখানে বসে পড়ল।
গাছের ডালে অজস্র নানা বর্ণের পাখির কুজন। বটগাছ থেকে ঝরে প্রা পাতার শব্দ। পাখির আধ খাওয়া ফুল ঝরে পড়ছে মাটিতে।
ছেলেটি বসেই ছাতাটি মেলে ধরলো গাছের ছায়ায়। বৃদ্ধ লোকটি মুচকি হাসলো মন্ত্রী পুত্রের কান্ড দেখে।
কিন্তু মুখে কিছুই বললো না। এ কেমন বোকা ছেলে। এত রৌদ্রে হেঁটে আসলো; অথচ গাছের ছায়ায় বসে কিনা ছাতাটা মেলে ধরলো পাগল-টাগল নয়তো?
হুহু করে বাতাস বইছে। মির মির করে পাতা ঝরছে। পাখিদের উল্লসিত কলকাকলীও বেড়ে আসছে। দু’জন আবার পথ চলা আরম্ভ করল।
ছেলেটিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখল, সত্যি রাজপুত্রের মতো মায়াময় চেহারা। নাতনী হেমবালার সাথে মানাবে ভালো।
একটি ক্ষীণ আশা মনের কোণে উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেল। দু’জনে সমান তালে পা ফেলতে লাগলো।
কিছুদূর যেতেই যুবকটি একটি প্রস্তাব করলো মিটমিট করে হেসে, এই যে দাদু, এক কাজ করা যাক। পাকা চুলে হাত বুলিয়ে দাদু হাসলো, কি শুনি?
তুমি আমাকে কাঁধে করে কিছুদূর যাবে। আর আমি তোমাকে কাঁধে নিয়ে কিছুদূর যাবো।
তাহলে দ্রুত পথটা ফুরিয়ে আসবে। বলল কি দাদু? তুমিতো জোয়ান ছেলে। আমাকে কাঁধে করে নিয়ে যেতে তোমার কষ্ট হবার কথা নয়।
কিন্তু আমি বুড়ো মানুষ, নিজে হাঁটতেই দায়। তোমাকে নেবো কেমন করে? যুবক মুচকি হেঁসে পথ চলতে লাগলো।
বুড়ো ভাবলল, এ ছেলেটা নিরেট গর্দভ। তবু এত সুন্দর ছেলে হাতছাড়া করতে সেনারাজ।
সেবললো, দেখো দাদুভাই, তোমাকে আজ আমার বাড়ীতে যেতে হবে। আমি খুব খুশী হবে। তাহলে একটা শর্ত আছে।
কি শর্ত? আমি কথা বলবো, বাড়ীর কাছে গেলে তোমাকে গলা খাকারী দিতে হবে।
সে কি কথা আমি কি ঘরের অচেনা মানুষ নাকি নিজের বাড়ীতে অমন করতে হয় এজীবনেও শুনিনি।
তা না হলে যেতে পারবো না। ঠিক আছে, ঠিক আছে, বললো বুড়ো।
এদিকে সুন্দর একটা বাগানে ছিমছাম ছবির মতো একটা মাচা ঘর। চারপাশে নারকেল, খেজুর গাছ আর লিচু গাছে সবুজ স্নিগ্ধতা।
একটা মেয়ে অপরূপ সুন্দরী। বাঁশের মাচায় কাপড় বোনার সুতাগুলি গুছাচ্ছিল। বুড়ো অমনি গলা খাকারী দিয়ে উঠলো, এ হেইম এ হেইম।
মেয়েটি অমনি পরনের রিনাইটা ঠিক করে দিল দৌড়। এ দিকে যুবকটি ঘরে আসলে তাকে খুব আপ্যায়ন করা হলো।
মেয়ের মা সেই। ভর সন্ধ্যায় ঢেকিতে চাউল গুড়ি করল পিঠে বানাবার জন্য। মেয়েটি কলাপাতা কেটে নিয়ে আসলো। বড় একটা মুরগী কাটা হলো অতিথির জন্য।
বুড়ো ঘরের ভিতর ফিস ফিস করে রাস্তার ঘটনা ব্যক্ত করল, আর ঘর জামাই তোলার ইচ্ছে করলো।
নাতনীকে ফিসফিস করে বললো, কিরে পছন্দ হয়েছে তোর? সুন্দরী নাতনী দাদুর পিঠে কিল বসিয়ে দেয় একটা।
দাদু রসিকতা করে বললো, সুন্দর হলে কি হবে একেবারে বোকা। কি রকম?
বুড়ো সেই ঝরণা পার হওয়া থেকে আরম্ভ করে বটগাছের ছায়ায় ছাতা মেলে দেয়া তারপর আবার রাস্তায় একে অন্যকে কাঁধে নিতে বলা।
বাড়ীতে পৌঁছে গলা খাকারী দেয়ার কথা। গর গর করে বলে গেল। নাতনী হেসে বললো, দাদু তুমিতো এক নম্বর বোকা। কেন? কেন?
সোজা রাস্তায় কাটা আছে কিনা দেখা যায়, কিন্তু ঝরণার গভীরে কত কাটা সুচালো পাথর থাকে লুকিয়ে। সেগুলি যদি পায়ে বিধে।
প্রবাসী মানুষ অসুখ করলে কে দেখবে। সে জন্যেই যে জুতা পায়ে দিয়েছিলো। বুড়ো ভেবে দেখলো, কথাটা আসলেই ঠিক। সে বললো, আচ্ছা মানলাম।
কিন্তু ছায়ার নীচে এসে যে কেন ছাতাটা মেলে ধরল শুনি? হায় হায়! দাদু এখানেও তুমি হারলে।
রোদে যে ছাতা দেয় নাই আকাশটা ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন ছিল বলে। গাছের উপর পাখিরা পাকা ফল খাচ্ছে।
ফল বা পাখির বিষ্ঠা মাথার উপর পড়ে চুল নোংরা করবে। সেজন্যেই ছাতা মেলে দিয়েছিল প্রবাসী মানুষ কাপড় যেন নোংরা না হয়, তাই অমন করেছিল।
আচ্ছা, তোর যুক্তি মানলাম। কিন্তু পথে আমাকে কাঁধে নিতে বললো কেন? আচ্ছা দাদু তুমি একটা আস্তা বোকা।
এর মানে হচ্ছে তুমি কিছুক্ষণ গল্প করবে। আর সে কিছুক্ষণ গল্প করবে, এভাবে কথা বলতে বলতে যেমন পথ ফুরিয়ে আসবে তেমনি আনন্দও পাবে।
আরে কথাটাতো ফেলনা নয়। নাতনী, কিন্তু ঘরের কাছে এসে গলা খাকারী দিতে বললো কেন আমাকে বৃদ্ধ দাদু, এরও একটা কারণ আছে বৈকি।
গলার রূপার হাসুলী আর টাকার মালায় হাত বুলাতে বুলাতে মেয়েটি বললো, দেখ দাদু, বাড়ীর মেয়েরা কে কি অবস্থায় থাকে বলাতো যায় না।
তুমি যাতে অপ্রস্তুত না হও। প্রবাসী মানুষের কাছে লজ্জা না পাও তার জন্যই এই ব্যবস্থা। দাদু তাহলে তো তোর উপযুক্ত বর হয়েছে।
ঝি ঝি পোকারা ডেকে উঠল কাশবনে। আকাশে জেগে থাকা চাঁদ ক্লান্ত হয়ে পশ্চিমের আকাশে ডুবে গেল। শুকতারাটিও স্থান হারিয়ে ফেলল।
সারা আকাশ ফরসা হয়ে গেল নবীন সূর্যলোকে। নাতনীটা শুয়োরের খোয়ারে খাবার দিয়ে এলো। উঠান ঝাট দিল। ঝকঝক করে উঠলো উঠোন।
হে মরা গরুর গোয়াল থেকে একটু বাইরে গোবর আনলো। সকালে পানি থেকে একটা পদ্ম ছিড়ে এনে দিলো।
রাস্তার উপর একটু খানি গোবর ছড়িয়ে পদ্মফুলটা দিয়ে আসলো। যাতে মন্ত্রী পুত্রের চোখে পড়ে।
এদিকে মন্ত্রী পুত্রের ঘুম ভাঙলো। মুখ-হাত ধুয়ে সে যেই রওয়ানা দেবে অমনি ঝানু বুড়োটা এসে হাজির। ….ওহে বুড়ো দাদু, আমি চললাম।
এ্যা, ছিঃ খালি মুখে যাবে এই সকালে? সুযোগ হাতছাড়া হয় দেখে দাদু চেঁচিয়ে উঠলো। আর একটা দিন থাকো হে নাতি।
আমার সুন্দরী নাতনীর সাথে তোমার বিয়ে দেব। ঘর জামাই করব। না-না, যতদূর দৃষ্টি যায়। ততদূর যেতে হবে। বিয়েটিয়ে করতে পারবনা।
ঘর জামাইও থাকতে পারবনা। আমাকে যেতে দিন। গোধরল মন্ত্রীপুত্র। অগত্যা কি আর করা। বুড়োনাতনীকে পিঠা এনে দিতে বললো।
কলাপাতায় মোড়ানো পিঠা নিয়ে একটি ষোড়শী তন্বী হাজির হলো সামনে। কি অপূর্ব দেহবল্লরী মেয়েটির।
মেঘের মত বিরাট কালো চুলের খোপায় বুনো ফুল। গলায় রূপার টাকার মালাগুলি চিক চিক করছে।
ঐচিবুক ঐ পাতলা ঠোঠ আর হলুদচাপা ফুলের মত গায়ের রং দেখে স্বপ্ন মনে হলো মন্ত্রী পুত্রের।
এত সুন্দর গুছিয়ে রিনাইটা পরেছে যে বলার বাইরে। খুব ভালো লাগলো এই স্নিগ্ধ প্রভাতের মোড়শী মেয়েটাকে। তবু বাবার আদেশ মনে পড়ল।
যতদূর চোখ যায় এগিয়ে যেতে হবে। সে পা বাড়ালো আবার। বাশের সাঁকোটা নামতেই চোখে পড়লো গোবরের উপর পদ্মফুলটা হাসছে।
আরে এ নিশ্চয় সেই রূপসী মেয়েটির কারসাজী। খুব বুদ্ধিমান মেয়েটি নিশ্চয়। এ মেয়েকে বিয়ে করলে তার অপকার না হয়ে উপকারই হবে।
সে আবার ফিরে এসে বললো, আমি তোমাদের ঘরজামাই হতে রাজী আছি। খুশীর বন্যাউপচে পড়ল সকলের চোখে-মুখে।
সাত সাতটি মুরগী আর বিরাট একটা শূকর কেটে সেদিনই মহাসমাবেশে হেমবালা মেয়েটির বিয়ে হলো মন্ত্রী পুত্রের সাথে।
রাতে মন্ত্রীর পুত্র তার নিজের কষ্টের কথা তার বাবার দুর্দশার কথাগুলি বললো মেয়েটিকে। শুনে হেমবালা হাসলো।
এই কথা কিছুদিন পর আমি শশুর বাড়ী যাব। তাই হলো সুখে-আনন্দে তাদের প্রায় বিশদিন কেটে গেল।
তারা সেখান থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এলো মন্ত্রী পুত্রের দেশে। এদিকে দেশে ফিরে মন্ত্রী পুত্র দেখলে মাথা ভর্তি উকুন তৈলহীন জট নিয়ে তার বাবা পুত্র শোকে অন্ধ হয়ে গেছে। মন্ত্রী আরো বুড়ো হয়ে গেছে।
লক্ষ্মী বউ হেমবালা। পায়ে ধরে প্রণাম করলো শ্বশুর-শাশুড়ীকে। গরম জল দিয়ে স্নান করিয়ে দিল দু’জনকে শ্বাশুড়ীর উকুন বাছলো সারাদিন।
বসে বসে চুলের জট খুলে দিল। রাতের গভীরে অমবস্যার নিবীড় অন্ধকারে গোমতীর তীরে এসে দাঁড়ালো।
গোমতীর জল তখন ছলছল-ছল-কল-কল করে ছুটে চলেছে। তীরে দাঁড়িয়ে এস সে তিনটি তালি বাজালো।
সই-সই শোন শোন। আমি হেমবালা এসেছি। শ্বশুরের ভারী বিপদ। তুমি ছাড়া উপায় যে নেই। শোন শোন, সই আমার শোন ।
বোয়ালমাছটি তার বিশাল হাঁ-করা মুখ নিয়ে ভেসে উঠলো। আসলে ছোট বেলায় হেমবালা তাদের বাড়ীর কাছে ঝরণার কুপটাতে এই মাছটিকে নিয়েই খেলতো।
এ তার শৈশবের সাথী। বড় হয়ে গোমতী নদীর মোহনায় ছেড়ে দিয়েছে। মাছটি অমনি ভেসে উঠলো। কত দিন পর এসেছ সই কিসের খবর নিয়ে?
হেমবালা বোয়ালের কাছে এগিয়ে গেল। তার গায়ে বুলিয়ে দিল হাত। তারপর চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দিয়ে বললো, তুমি কেন রাণী মাকে দেখে হাসলে।
এটুকু বলতে না পারলে আমার শ্বশুরের গর্দান যাবে। উঃ এই কথা? তোমার শ্বশুরকে বলল, কাল রাজাকে বলতে যেন গোমতীর তীরে সভা দেয়।
সেই সভায় ঐ জেলে থাকবে। যে জেলেটা আমাকে রাজবাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিল। সবাই জানে রাণীর তলপেটে আছে গভীর কালো তিল।
সব সৈনিককে ডেকে যেন তিনি জেনে নেন। যদি বিশ্বাস না করে তাহলে তিনটি তালি দিলে আমি উঠে আসব।
এই বলে মাছটি গোমতীর জলে হারিয়ে গেল। সকালে শ্বশুরতে সব ঘটনা বললে পুত্রবধূ। মন্ত্রী গিয়ে বললো রাজাকে। মহারাজনদীর তীরে সভা ডাকুন তারপর বলব।
ঢুলী ঘোষণা করল তৎক্ষনাৎ। অমুক জায়গায় গোমতীর কুলে সবাই যেন জড়ো হয়। রাজার আদেশ। সব সৈনিক যেন সেখানে উপস্থিত থাকে।
তাই হলো। তারপর কাতারে কাতারে সৈন্য দাঁড়ালো নদীতে। রাজ্যের সকল লোক হাজির হলো সভায়।
রাজা-রাণী, প্রবীণ মন্ত্রী, মন্ত্রী পুত্র, পুত্র বধু আর সেদিনের জেলেও হাজির। মন্ত্রীর পুত্রবধূ হেমবালা বললো, মহারাজ আপনার স্ত্রী কুলটা।
গর্জে উঠলেন রাজা। কি? অতবড় দুঃসাহস? তার প্রমাণ। অমনি মন্ত্রীর পুত্রবধূতিন তালি দিল। ভেসে উঠলো বোয়ালটা।
খিল খিল করে হেসে সবাইকে সচকিত করে তুললো। সে হাসি থামিয়ে বললো, মহারাজ, মন্ত্রীর পুত্রবধূর কথাই ঠিক।
আপনি যখন রাজকার্যে ব্যস্ত তখন রাণী মা আপনার বেতন ভোগী সৈনিকদের সঙ্গ দেন। জিজ্ঞেস করুন সব সৈনিকদের’রাণী মার তলপেটে ওরা একটি তিল দেখেছে কিনা।
আর সবার হাতে রাণী মায়ের দেয়া একটি সোনার আংটি আছে। | রাজা দেখলেন, ঠিকই প্রত্যেকের হাতে রাণীর দেয়া উপহার।
সেখানে জ্বলজ্বল করছেরাণীর নাম। সবাইকে নিভৃতে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন রাজা। সৈনিকদের চার-তৃতীয়াংশ অপরাধ স্বীকার করলো।
তারা বললো, রাণী মার তলপেটে ঠিকই তারা একটি গভীর তিল দেখেছে। রাজা বিষন্ন বদনে বসলেন রাণীর পাশে।
চোখে তার আগুনের ভাটা জ্বলছে। বোয়ালমাছ গোমতীর জলে ভেসে ভেসে বললো, মহারাজ, তাই রাণীকে দেখে তার অভিনয় চাতুর্য দেখে আমি হেসেছিলাম।
মন্ত্রীকে আপনি মার্জনা করেন। জেলেটাকে পুরস্কৃত করেন। রাণীকে শায়েস্তা না করলে অদূর ভবিষ্যতে আপনার মৃত্যু অনিবার্য বলে হারিয়ে গেল মাছটি।
রাজা প্রজাহিতৈষী।তিনি আদেশ দিলেন, জেলেকে একশত স্বর্ণমুদ্রা দিতে।
রাণীকে কোমর অবধি মাটির গর্তে ঢুকিয়ে ঢিল মারতে নির্দেশ দিলেন আর অপরাধী সৈনিকদের হাত-পা বেঁধে গোমতীর জলে ভাসিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন।
তা-ই হলো। রাণীকে ঢিল মারতে মারতে রক্তাক্ত করা হলো। সৈনিকরা ঝাপিয়ে পড়লো জলে।
মন্ত্রী পুত্রের হাতে রাজ্যভার দিয়ে রাজা মনের দুঃখে দেশান্তর হলেন। আর রাণীর কুলটা শরীর পচে গেল। শিয়াল কুকুরে ভাগাভাগি করে খেলো।
লেখক: শোভা ত্রিপুরা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।