ত্রিপুরা রূপকথা : জন্মান্তর
885
এক গ্রামে বাস করত এক জুমিয়া পরিবার। সেই জুমিয়ার স্ত্রীর সন্তান হবে।
একদিন জুমিয়ার স্ত্রী সন্তানের জন্য কাপড় বুনছিল। কাপড় বোনার সময় মাকু পড়ে গেল টংঘরের নিচে, একেবারে মাটিতে।
জুমিয়ার ঘরের নিচে ছিল গবাদিপশুর থাকার জায়গা। সেখানে ছিল একটি গাভী। জুমিয়ার স্ত্রী গাভীকে মাকুটি তুলে দেওয়ার অনুরোধ করল।
গাভীটি মাটি থেকে মাকু তুলে তার হাতে দিল। কিছুক্ষণ পর মাকুটি আবার পড়ে গেল।
জুমিয়ার স্ত্রী আবার গাভীকে মাকুটি তুলে তার হাতে দেওয়ার অনুরোধ করল। গাভীটি আবার মাকু তুলে তার হাতে দিল।
মাকুটি আবারও পড়ে গেল। সে আবার গাভীকে মাকুটি তুলে দিতে অনুরোধ করল।
তখন গাভী বলল, আমারও খুব শীগগির একটা বাছুর জন্ম নিবে। আমার অবস্থাও তোমারই মতো। তাই আমার পক্ষে বারবার মাকু তুলে দেওয়া সম্ভব নয়।
জুমিয়ার স্ত্রী আবারও গাভীকে একই অনুরোধ করল। তখন গাভী বলল, আমি একটি শর্তে মাকু তুলে দিতে পারি।
আমাদের উভয়ের যদি ছেলে সন্তান হয় তবে তারা দুইজন বন্ধু হবে।
আর আমার যদি এঁড়ে বাছুর আর তোমার মেয়ে হয় তবে দুইজনের বিয়ে দিতে হবে। জুমিয়ার স্ত্রী এই শর্ত মেনে নিল।
কিছুদিন পর জুমিয়ার স্ত্রীর একটি মেয়ে হল। আর গাভীটির একটি এঁড়ে বাছুর হল।
মেয়েটি আর এঁড়ে বাছুর একসঙ্গে হেসে-খেলে বড় হতে লাগল। এঁড়ে বাছুরটি মেয়েটিকে ছেড়ে কোথাও যায় না।
মেয়েটি যেখানেই যায় এঁড়ে বাছুরটিও সব সময় তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। পড়শীরা মেয়েটি আর এঁড়ে বাছুরের সম্পর্ক নিয়ে নানা কথা বলে।
একদিন পড়শীদের কথা শুনে মনের দুঃখে মেয়েটি কেঁদে ফেলল। সে মাকে জিজ্ঞেস করল, কেন এঁড়ে বাছুরটি সব সময় আমার পিছন পিছন ঘুরে?
মেয়েটির মা সকল ঘটনা তাকে খুলে বলল এবং গাভীকে দেওয়া তার প্রতিশ্রুতির কথাও জানাল।
এ কথা শুনে মেয়েটি মহাচিন্তায় পড়ে গেল। সে এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চায়। সারাদিন সে মুক্তির পথ খোঁজে।
একদিন মেয়েটি জুমখেতে গেল। এঁড়ে বাছুরের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা ভেবে সে এমনিতেই মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত ছিল।
শেষ পর্যন্ত জুমখেতে একটা গাছের ডালে ফাসি নিয়ে মারা গেল। এঁড়ে বাছুটিরও গাছের কাছেই ছিল। মেয়েটির মৃত্যু দেখে এড়ে বছুরটিও গাছের সঙ্গে মাথা ঠুকে মরল।
এর অনেক অনেক কাল পর ওদের পুনর্জন্ম হল। মেয়েটি একটি রাজপরিবারে রাজকন্যা হিসেবে জন্ম নিল।
আর এঁড়ে বাছুরটি জন্ম নিল। একটি শ্বেতহস্তী হিসাবে। শ্বেতহস্তীটিও রাজপ্রাসাদেই থাকত।
সে আগের জন্মের সব ঘটনা মনে করতে পারত। আর তাই সে রাজকন্যাকে খুব পছন্দ করত।
ধীরে ধীরে রাজকন্যার খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেল সে। শ্বেতহস্তীটি প্রতিদিন রাজকন্যাকে তার পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তার সঙ্গে খেলা করে।
একদিন রাজকন্যাকে পিঠে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে রাজপ্রাসাদ থেকে অনেক দূরে চলে গেল। রাজকন্যা ফিরে না আসায় রাজা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন।
রাজকন্যার খোঁজে রাজপ্রাসাদের চারদিকে লোক পাঠালেন। কিন্তু কেউ রাজকন্যাকে খুঁজে পেল না।
অবশেষে রাজা ঘোষণা করলেন, যে রাজকন্যাকে খুঁজে আনতে পারবে রাজা তাকে অর্ধেক রাজত্ব দান করবেন।
আর রাজকন্যাকে তার সঙ্গে বিয়ে দিবেন। | ভুটিয়া আর রঙিয়া দুই ভাই। এই রাজার রাজত্বেই এক গ্রামে তারা বাস করে।
রাজার ঘোষণা তাদের কানেও পৌছে গেল। তারা সিদ্ধান্ত নিল রাজকন্যাকে খুঁজতে বের হবে।
তারা দুইজনে হাতির পায়ের চিহ্ন দেখে দেখে জঙ্গলে চলে গেল। কয়েক মাস এভাবে চলতে চলতে অবশেষে তারা পৌছে গেল গহীন বনে।
তারা দেখল ছোট্ট একটা পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে শ্বেতহস্তীটা। রঙিয়া শ্বেতহস্তীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে এগিয়ে গেল।
আর ভুটিয়া লুকিয়ে রইল ঝোপের আড়ালে। যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত শ্বেতহস্তীর পরাজয় ঘটল। রঙিয়া শ্বেতহস্তীকে হত্যা করে রাজকন্যাকে উদ্ধার করল। |
ভুটিয়া, রঙিয়া আর রাজকন্যা তিনজনে ফিরছিল। ফেরার পথে সন্ধ্যা হল। তারা ঠিক করল রাতটা বনেই কাটিয়ে দেবে।
তারা বনের মধ্যে একটা বড় ঘর খুঁজে পেল। রাতটা এ ঘরেই কাটিয়ে দেবে বলে ঠিক করল।
তারা ঘরে ঢুকে দেখল, ঘরের কোণে এক গাদা হাড় পড়ে আছে। আর পুরো ঘর খালি। ঘরের কোথাও কিছু নেই।
তারা ঝাড়পোছ করে ঘরের ভিতর ঘুমানোর জায়গা ঠিক করে নিল।
গোধূলি বেলায় কয়েকজন লোক একটি মেয়েকে নিয়ে এই ঘরের কাছে এলো। তাদের সকলেই কাঁদছিল।
তাদের কান্না শুনে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো রঙিয়া। জিজ্ঞেস করল, তোমরা কাদছ কেন?
লোকগুলো বলল, এখানে বাস করে এক রাক্ষস। আমরা সকলেই তার খাবার হব।
তার নির্দেশ মতো প্রতি রাতে একজন মানুষকে তার খাবার হিসাবে এই ঘরে পৌঁছে দিতে হয়। আজ আমার পরিবারের পালা।
তাই আমি এই মেয়েটিকে নিয়ে এসেছি রাক্ষসের জন্য।
তারা রঙিয়াকে আরো বলল, তোমাদের এ জায়গা ছেড়ে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া উচিত। যে কোনো সময় রাক্ষস চলে আসতে পারে।
সে তোমাদের দেখলে সকলকে হত্যা করবে, তোমাদের সকলকে খেয়ে ফেলবে।
রঙিয়া রাক্ষসের কথা শুনে ভয় পেল না। রঙিয়া আর তার ভাই রাতটা এই ঘরে কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
আর গ্রামবাসীরা মেয়েটিকে ওদের কাছে রেখে চলে গেল। গভীর রাতে রঙিয়া অদ্ভুত গোঙানির শব্দ শুনতে পেল।
রাক্ষস এসে গেছে। সেই এই অদ্ভুত শব্দ করছে। রাক্ষস বলল, কে এই ঘর দখল করে রেখেছে?
রঙিয়া জবাব দিল, এই ঘর এখন রঙিয়ার দখলে। রাক্ষস রঙিয়ার শক্তি আর ক্ষমতার কথা শুনল। রঙিয়া বলল, সেই শ্বেতহস্তীকে হত্যা করছে।
একথা শুনে রাক্ষস ভয় পেয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর রাক্ষস আবার ফিরে এলো এবং আগের মতো একই প্রশ্ন করল।
ঘরটি রঙিয়ার দখলে থাকার কথা শুনে রাক্ষস আবার চলে গেল। না এয় শেষ, ক্রমেই ভোর হয়ে আসছে। রঙিয়ার তখন খুব ঘুম পেল।
সে ভুটিয়াকে জেগে ঘর পাহারা দিতে বলল। তাকে আরো বলল, রাক্ষস যদি আবার আসে তাহলে যেন সে বলে, ঘর এখন রঙিয়ার পাহারায় আছে।
কিছুক্ষণ পর রাক্ষস আবার এলো। এবার সে হিংস্র শব্দ করতে লাগল। শব্দ শুনে ভুটিয়া ভয় পেয়ে গেল।
রাক্ষস জিজ্ঞেস করল, এই ঘর এখন কে পাহারা দিচ্ছে? ভুটিয়া জবাব দিল, এই ঘর এখন ভুটিয়ার পাহারায় আছে।
রাক্ষস তখন বেপরোয়া হয়ে উঠল। ঘরের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ল। ভুটিয়ার সঙ্গে তার যুদ্ধ হল।
সে ভুটিয়াকে পরাজিত করে রাজকন্যা আর গ্রামের সেই মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেল। সকালে রঙিয়া জেগে উঠল।
সে ভুটিয়া, রাজকন্যা আর গ্রামের সেই মেয়েটির কাউকে ঘরে দেখতে পেল না। সে ঘরের আশেপাশে সব জায়গায় খুঁজল।
খুঁজতে খুঁজতে জঙ্গলের ভিতরে আধমরা অবস্থায় ভুটিয়াকে পেল। কিছু সেবাযত্নের পর ভুটিয়ার জ্ঞান ফিরে এলো। সে রঙিয়াকে সব ঘটনা খুলে বলল।
দুই ভাই আবার বনের মধ্যে রাক্ষসের খোঁজে বের হল। এক জায়গায় এসে তারা দুমড়ানো-মোচড়ানো ঝোপঝাড় দেখতে পেল।
কিন্তু এর আশেপাশের ঝোপঝাড় ছিল সবুজ-সতেজ। এটা দেখে তাদের সন্দেহ হল। রঙিয়া ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে ফেলল।
এর নিচে দেখতে পেল একটা খুব বড় গর্ত। রঙিয়া বন থেকে খুঁজে আনল একটা লম্বা লতা। লতাটা বাধল একটা গাছের সঙ্গে।
এই লতার সাহায্যে সুড়ঙ্গপথ ধরে তারা পৌছল পাতালপুরীতে। সেখান থেকে কিছুক্ষণ হেঁটে পৌছল রাক্ষসের আস্তানায়।
রাজকন্যা আর গ্রামের সেই মেয়েটিও সেখানে আছে। রঙিয়া লড়াই করে রাক্ষসটাকে মেরে ফেলল। আর রাজকন্যাকে উদ্ধার করল।
রাক্ষসের আস্তানা থেকে ফেরার সময় আগে ভুটিয়া, রাজকন্যা আর গ্রামের মেয়েটি লতা বেয়ে পাতাল থেকে উপরে উঠে এলো।
কিন্তু রঙিয়া উপরে ওঠার আগেই ভুটিয়া লতাটা কেটে দিল। ভুটিয়ার মনে ছিল অসৎ উদ্দেশ্য, সে চায় রাজকন্যাকে বিয়ে করে অর্ধেক রাজত্ব পেতে।
রঙিয়া সুড়ঙ্গপথে আটকা পড়ে গেল। সে আর বের হতে পারল না। ভুটিয়া প্রথমেই গ্রামে এসে মেয়েটিকে তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে দিল।
তারপর গেল রাজার কাছে। রাজাকে বলল, আমি শ্বেতহস্তীকে হত্যা করেছি, তারপর রাজকন্যাকে উদ্ধার করে এনেছি।
ভুটিয়া রাজাকে তার সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ের আয়োজন করতে বলল।
রাজকন্যা জানত রঙিয়া তখনও বেঁচে আছে। সে একদিন নিশ্চয়ই ফিরে আসবে।
রাজকন্যা রাজাকে বলল, তুমি বিয়ে পিছিয়ে দাও। এত তাড়াতাড়ি আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়।
আমি এক বছর পর বিয়ে করব। ভুটিয়াকে তুমি এক বছর অপেক্ষা করতে বলল।
রঙিয়ার পাতাল থেকে সুড়ঙ্গপথে বের হয়ে আসার কোনো উপায় ছিল না। ভাগ্য ভালো তার কাছে লতাগাছের কিছু বীজ ছিল।
সে মন্ত্র পড়ে পাতালপথে বীজগুলো বুনে দিল। বীজগুলো থেকে তৎক্ষণাৎ লতাগাছ জন্মাল আর দ্রুত বাড়তে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই লতাগাছ আরো বড় হল। লতাগুলো বেরিয়ে এলো গর্ত থেকে আর একটা গাছ বেয়ে উপরে উঠতে লাগল।
আর লতা সেই বেয়ে রঙিয়া উপরে উঠে এলো। তারপর প্রথমে সে গেল গ্রামের সেই মেয়েটির বাড়িতে।
সে মেয়েটির বাবাকে সকল ঘটনা খুলে বলল। মেয়েটির বাবা তাকে বাড়িতে আশ্রয় দিল আর রাজার সঙ্গে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিল।
রঙিয়া রাজার সঙ্গে দেখা করতে গেল। তাকে দেখে রাজকন্যা চিনে ফেলল।
সে রাজাকে বলল, এ সেই লোক যে শ্বেতহস্তী আর রাক্ষসকে মেরেছে। প্রকৃত পক্ষে সেই আমাকে উদ্ধার করেছে।
রাজা রঙিয়ার সঙ্গেই তার মেয়ের বিয়ে দিলেন আর তাকে অর্ধেক রাজত্ব দান করলেন।
রঙিয়া তার ভাই ভুটিয়াকে ক্ষমা করে দিল। আর গ্রামের সেই মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ে দিল। তারপর দুই ভাই মিলে সুখেশান্তিতে একত্রে বসবাস করত লাগল।
তথ্যসূত্র : ত্রিপুরা আদিবাসী লোককাহিনী
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।