ত্রিপুরা রূপকথা: নাডেং ডেং
1085
সে কালে ত্রিপুরা পাড়ার মধ্যে একজন খুব ঠকবাজ এবং বুদ্ধিমান লোক ছিল । নাম তার নাডেং ডেং। সে আবার একটু অচাইগিরিও করতে মাঝে মাঝে (অচাইগিরি = পুরুগিরি)।
আজকে ঢাবিং পাড়া, কালকে রিয়াং পাড়া, পরশু ফাতং পাড়া এইভাবে পুরুতগিরি করে ফলমূল, তরিতরকারি ও কিছু চাউলও সে যোগাড় করে নিতো। ঘরে একটি মাত্র বউ। তাও আবার একেবারে নিঃসন্তান। দু’জনের বেশ দিন কাটছিলো। পাড়ার লোকেরাও মোটামুটি এই দম্পতিকে বেশ সাহায্য করতো।
নাডেং ডেং বউ ছিল আবার একটু সংসারী। সে ভবিষ্যতের চিন্তাও করতো। ছেলেমেয়ে নেই, এখন কিছু যদি না জমানো হয় বৃদ্ধকালে কষ্ট পেতে হবে। সে অনেক বলে কয়ে নাডেং ডেং অচাইকে রাজী করালো জুম কাটার জন্য।
তিন চার আড়ি ধান লাগানোর মত একটা জুম কাটলো নাডেং ডেং। আগাছাগুলি যত্ন করে পোড়াল। তারপর এক সময় বৃষ্টি দিলে ধান লাগালো।
সারিবদ্ধভাবে সেই সংগে তুলোর বীজ, ধেমাই (মারপা), ফেনক (বেগুন) এবং বিভিন্ন রকমের তরিতরকারির গাছ লাগালো। একটা ছোট মাচা ঘর উঁচু করে বানালো। বলা কি যায়? শূকরে-টুকরে ধান নষ্ট করলে সব তো মাটি হয়ে যাবে।
এদিকে ধান গাছগুলি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। নাডেং ডেং ছড়া থেকে কাঁকড়া ধরে সেগুলি বাঁশের চোঙায় পুড়িয়ে মরিচ দিয়ে চাটনি করে খায়।
অবসর সময়ে গুগুন্ করে গান গায় আর বাঁশী বাজায়। দিন যায়, গাছের ফাঁকে পা ঝুলিয়ে বাঁশীতে সুর তােলে পু-পু-পু-উ-উ পাখীরা ঝাঁক বেঁধে আকাশে উড়ে যাবার সময়ে চমকে চমকে দাঁড়ায়। নাডেং ডেং-এর জুমে তুলা গাছ বাতাসে নাচতে থাকে।
বউ বাড়ীতে সংসার সামলায় আর শাক-সবজির বাগান করে। পাড়ার মেয়েরা ফিস্ ফিস্ করে কানাঘুষা করে, কি জানি নাডেং ডেং কি করছে। ছেলে নেই, মেয়ে নেই, হয়তো জুমের মধ্যে কাউকে নিয়ে রগড় করছে।
অচাইর বউ শুনে মনে মনে দুঃখ পায়। হাজার হোক মেয়ে মানুষের জাত, একটা ক্ষুদ্র সন্দেহের বিষে নীল হয়ে আসে মন। সে সেদিনই খবর দেয় ঘরে আসার জন্য। পুরুষ মানুষের মন-মেজাজ কি সবসময় ঠিক থাকে?
প্রবাসে গেলে বলা তো যায় না। অচাইর বউ বেশ বুঝতে পারে, অভিজ্ঞতালব্ধ জীবন তার। এদিকে খবর পেয়ে নাডেং ডেং তাড়াতাড়ি চলে আসে বাড়ীতে। বউ বেশ অভিমানী তার ।
রাতে ঘুমোবার আগে অচাইর বউ নাডেং ডেং-এর বুকে মুখ গুঁজে একথা-ওকথা বলতে বলতে শেষে কথাটা স্পষ্ট করে বলে, সত্যি করে বলো দেখি, জুমে তোমার সংগে কে ছিল ? এত দিন বাড়ী আস নাই কেন? নাডেং ডেং অচাই হো–হো–হো–করে হাসে, ও এই কথা।
এই জন্যই বউ এমন না খেয়ে না দেয়ে শুটকী হয়ে গেছে। এই মেয়ে জাতটাই এমন সন্দেহবাদী। সে একটু রগড় করে বউ-এর মনটা আরো ভালো ভাবে জানার জন্য বলে, উঃ সে আর বলোনা।
একটি কম বয়স্ক মেয়ে এসে প্রায়ই জ্বালাতন করে। এত সুন্দরী কিশোরী মেয়ে চোখও ফিরানো যায়না। তদুপরি এই বুড়ো বয়সে আর এসব কি মানায় ? তমিই বলো আমার। তিন কাল গিয়ে এক কাল আছে, এসব আর ভাল লাগে ?
নাডেং ডেং অচাইর বউ-এর মুখ তখন একেবারে চুপসে গেছে। সে বিছানার এক কোণে সরে গিয়ে বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার দু’চোখের কোল বেয়ে ক’ফোটা জল গড়ায়।
নাডেং ডেং আসলে জুমের মাচা-ঘরে একটা বাঘিনীর ডাক শুনেছিলো। সে রসিকতা করে বউকে তা-ই জানিয়ে দিল। বউ তো রেগে তেলে-বেগুনে একেবারে জ্বলে উঠল, যাও তুমি। আমি কালই বাপের বাড়ী চলে যাচ্ছি।
বেচারা নাডেং ডেং-এর পোড়া কপাল। সে কি আর কবে ? বউকে বুঝাতে থাকে সে। দুষ্টামি করেছে। একদিন দু’দিন, এভাবে কেটে গেল সাহ, গড়িয়ে গেল মাস।
বাঁশীটা নিয়ে সে এবার জুমে গেল। এ দিকে হয়েছেটা কি? বাঁশীর সুর আর গান যখন শোনা যায় না, তখন একটি কিশোরী বাঘিনী ভারী উতলা হয়ে উঠলো। নাঙেং ডেং অচাই-এর গান তার খুব ভালো লেগেছিল।
জুমের মাচা-ঘরের কাছে যেতেই বাঘিনী হালুম করে সামনে লাফ দিল, এই আমি তোমাকে খাব। নাডেং ডেং দাড়াও। এ্যা, বলে কি? দু-তিন হাত পিছিয়ে গেল নাডেং ডেং। সর্বনাশ, একি কথা! মুহুর্তে নাডেং ডেং -এর চেহারা পালটে গেল।
ভয়ে তবু সে ভীত হলো না। ফিক করে হেসে বললো, বাঘিনী, তুমি আমাকে খাবে? আমার কোন দুঃখ নেই। বরঞ্চ এ জন্মের কর্মফল আমার ভোগ করতে হবে না। তুমি হিতাকাঙখী বলেই এমন মধুর কথা বলতে পারলে।
এমন উপকার আর কে করতো বলো তো? কিন্তু বোন, আমি বলছি কি? জুমে হেঁটে আমার শরীরে রস টস এখন কিছুই নেই। খেলেও মজা পাবেনা। জুমের ধান উঠুক। নতুন পিঠে, ভাত খাবো। স্বাস্থ্য ভালো হবে। তবেইনা মজা হবে।
বাঘিনী ছিল একেবারে কিশোরী। মনটাও ছিল বেশ নরম। সে ভেবে দেখলো, কথাটা আসলেই ঠিক। তার মন মজে গেল ও কথায়।
সে নাডেং ডেং-কে বললো, ঠিক আছে তোমার জুমের ধান পাকলে আমাকে খবর দিও। আর বাঁশীটা একটু জোরে বাজিও হে। আমি ঝোপে বসে শুনবো। আচ্ছা। নাডেং ডেং-এর ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো।
এদিকে বাঁশী বাজিয়ে দিন যায়। বাঘিনী প্রায়ই খবর নেয়। নাডেং ডেং একবার বললো, দেখ ভাই বাঘিনী, তুমি যদি আমার মাংস খেতে চাও তাহলে এক কাজ কর। কি ? এই ধান কাটা আর মাড়ানো, তারপর ঘরে ফসল তুলতে সাহায্য করা।
ঠিক আছে আমি সাহায্য করব। তা-ই হলো, নাডেং ডেং ধান কাটে আর বাঘিনী ধান মাড়ায়। তাকে শক্ত একটা রশি দিয়ে বেঁধে খুব করে পিটালো নাডেং ডেং। তার বউ নিয়ে গেল ধানগুলি। বাঘিনী ব্যথায় গোঙাতে লাগল।
নাডেং ডেং রগড় করার জন্য বললো, আমার বাড়ীতে তোমার পায়েসের নিমন্ত্রণ রইল বুধবারে। পায়েস খেয়ে আমাকে খেতে পারবে। এই বলে সে বাঘিনীকে খুলে দিলো। খুব খুশি হলো বাঘিনী। তার দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হতে যাচ্ছে।
লোভে তার জিবের ডগায় পানি এসে গেল। নাডেং ডেং সব মালপত্র গুছিয়ে বাড়ীতে চলে গেল।
এদিকে নির্দিষ্ট দিনে নাডেং ডেং পিঠা ও পায়েস বানালো জুমের নতুন চাউল দিয়ে। পাড়ার লোকদের দাওয়াত করে কিছু খাওয়ালো, নিজেরাও খেলো। তারা খেয়ে দেয়ে বড় একটা মাটির হাঁড়িতে পায়েসের তলানি আর কয়েকটা বিষ ফল ভেংগে রেখে দিল। আর একটা বড় ধানের গোলায় ঢুকে চুপ করে রইল।
এ দিকে বাঘিনী তার সাংগপাংগ নিয়ে নাডেং ডেং অচাই-এর বাড়ীতে এসে হাজির। চিৎকার করে বাঘিনী ডাকলো, নাডেং ডেং, নাডেং ডেং। কিন্তু কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল । বাঘের দল দেখে, পাড়ার ছেলে-বুড়ো সবাই পালিয়ে গেছে।
বাঘিনী এই বার মাটির হাঁড়িতে ঢাকা পায়েসগুলি দেখতে পেয়ে খুশি হলো। সে সঙ্গীদের ডাকলো, এসো খাই। তার সঙ্গীরা সবাই খেতে শুরু করল “চপাচপ চপাচপ”। খুব মজা হয়েছে পায়েসটা। এইবার ধানের দিকে বাঘিন ডাকলো, নাভে-বুড়ো সবাই সে সঙ্গ বিষফলের টুকরো গুলি তারা খেয়ে ফেললো। হায় —হায়–একটু পরে সকলের মাথা ঘুরতে আরম্ভ করলো।
এ দিকে নাডেং ডেং-এর বউ-এর হাঁচি পেয়েছিল ভীষণ। কদিন থেকেই সর্দি। দুজনেই ভয়ে জড়োসড়ো। বউ ফিসফিস করে বললো, নাভেং ডেং, আমার হাঁটি পাচ্ছে ।
আহা, এখন নয়, একটু পরে। নাডেং ডেং-এর বউ অস্থির হয়ে উঠলো। সে বললো, উ! মা! আমি আর পারছিনে। চুপ, একটু পরেই হেঁচো, চোখ রাঙিয়ে বললো নাডেং ডেং।
উ ! — হে– হেঁ — হেঁ — হে — চো। বিকট শব্দে হেঁচে উঠল তার বউ। এদিকে বিষ ফল মাখানো পায়েস খেয়ে বাঘগুলি একে তো মুমূর্ষ, তার উপর আবার বিশ্রী শব্দ। এই রকম অশুভ শব্দ তারা কখনও শোনেনি আর।
ভয়ে তারা যে যেদিকে পারল ছুটে দৌড় মারল। কেউ নদী পার হতে গিয়ে ডুবে মরলো। কেউ হাত-পা ভেংগে মুখ থুবরে মরে গেল। নাডেং ডেং হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। পাড়া-পড়শীরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
দিন যায়, বাঘিনী মনে মনে নাডেং ডেং-কে খুঁজতে লাগলো জংগলে। এত বড় অপমানের শোধ না নিলে তার শান্তি নেই। সে স্থানীয় বাঘের নেতাকে সমস্যার কথা খুলে বললো। বাঘের নেতা সভা দিল।
দলে দলে সভায় বিভিন্ন জংগল থেকে বিভিন্ন প্রকার বাঘিনী এসে জমায়েত হলো। ডোরা বাঘ, কেন্দো বাঘ, চিতা বাঘ আরো কত রকমের বাঘ। চিতাবাঘিনী সভানেত্রীর আসন অলংকৃত করলো। তারপর শুরু হলো গরম গরম বক্তৃতা।
বাঘিনী নারী সমাজের অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য এবং জুমিয়া চাষা নাডেং ডেং-কে কিভাবে শাস্তি দেওয়া যায় এই সব বিহিত ব্যবস্থা করার জন্য আর নাডেং ডেং-এর চেহারা যাতে কোনদিন দেখা না হয় তার জন্য গংগা স্নান করা দরকার বলে চিতা বাঘিনী উল্লেখ করলো।
সব বাঘিনী আনন্দে করতালি দিয়ে উঠলো ও নাডেং ডেং-কে না দেখার জন্য একটা গাছের নীচে গংগা স্নান ও পূজা দেবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।
এ দিক নাডেং ডেং ছিল ভারী সেয়ানা। সে আগেভাগেই পাথরের অনেকগুলি টুকরা, ধারাল দা যোগাড় করে রেখেছিল। পূর্বেকার প্রস্তাব অনুযায়ী পূজা আরম্ভ হলো তিনটি শূকর, দু’টি ছাগল, সাতটি মোরগ ইত্যাদি নিয়ে। বাঁশের চোঙা ভর্তি মদ মাথায় ঢেলে তাদের অচাই মন্ত্র পড়ল উ ! ছু–! ছু–! —
নাডেং ডেং-এর চেহারা যেন
বাপ-দাদা চৌদ্দ গুষ্টির কেউ না দেখে
তার ছায়াও না দেখে
তার মাংস যেন খেতে পাই।
উ–! ছু—! ছু—! দু— !
আর যায় কোথায়? সুযোগ বুঝে নাডেং ডেং অমনি পাথরের টুকরা আর ধারাল দা-গুলি ছুড়ে মারলো তাদের মাথা ও নাক বরাবর। এই যে দেখ তোমাদের বাবা গাছের উপর। বেচারা বড় মামা আর চিতা মাসীতো মরে চিৎপটাং।
বাঘিনীরা পূজা-পার্বন ফেলে দিল দৌড়। এ বন ছেড়ে ও বন, ও বন ছেড়ে অন্য বন এইভাবে যে যেভাবে পারল সেই বনভূমি ত্যাগ করলো। আর নাডেং ডেং দিব্যি নিশ্চিন্তে দিন কাটাতে লাগলো।
লেখকঃ মিসেস শোভা ত্রিপুরা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।