ত্রিপুরা রূপকথা: বেদমান বুড়ো (বোকা বুড়ো)

Jumjournal
Last updated Jan 17th, 2020

969

featured image

এক গ্রামে বাস করতো এক বুড়ো। বুড়ো ছিল যেমন সরল তেমনি একটু বোকা ধরনের। পাড়ার সবাই ডাকতত বেদমান বুড়ো অথ্যাৎ বোকা বুড়ো বলে। বউটা ছিল ভারী চালাক।

সেদিন ঘরে কোন তরিতরকারি ছিল না। বুড়োটা আবার ভালো তরকারী না হলে খেতে পারতো না। বুড়ী বেচারা স্বামীর কষ্ট দেখে বললো, বিকেলে জঙ্গলে তরকারী খুঁজতে যেও। বুড়ো অমনি রাজী হয়ে গেল।

সে সাংঘাতিক অলস ছিল। বুড়ী মনে মনে ভারি খুশী হলো। যাই হোক, বুড়ো আগের চাইতে অনেক কাজের হয়েছে। তার আর দুশ্চিন্তা নেই। সে বুড়োকে কলাপাতায় মুড়ে ভাতের মোচা (পুঁটলী) দিয়ে দিলো।

একটা ভাংগা বাঁশের ঝুড়ি দিয়ে বললো, বুঝে শুনে সাবধানে পথ চলো ভাল জিনিস মানে ব্যাঙের ছাতা, চেঁকি শাক এ সব নিয়ে এসো কিন্তু। আর শোননা, বন মোরগ আর বুনো পাখীর মাংস খেতে খুবই মজার। ফাঁদ নিয়ে যাও। যদি কিছু ধরতে পারো।

আচ্ছা ঠিক আছে। বলে বোকা বুড়ো এগিয়ে চললো সামনে। যেতে যেতে সে জনপদ ছাড়িয়ে গভীর অরণ্যে চলে গেল। ঘাসের উপর ধবধবে খরগোশগুলো লুটোপুটি খেলছে। গাছের শাখায় শাখায় পাখীদের কলরব। কাঠবিড়ালীর লাফালাফী। ঝিঝি পোকার ডাক শুনতে শুনতে বুড়ো এগিয়ে চলে সামনে।

ঘাস ফড়িং-এর ছুটাছুটি দাঁড়িয়ে দেখে মুগ্ধ হয়। এদিকে মাথার উপর সূর্যটা দাঁড়িয়ে আছে। আকাশে নীল মেঘের টুকরো পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়।

বোকা বুড়োর চারপাশে পেঁকি শাকের বন, বুননা তরিতরকারি, খরগোশ ছানাদের দৌড়ঝাঁপ। বন মোরগের ছুটাছুটী। বাঁশ বনের কচি বাঁশের ডগা — ওগুলি পাহাড়ীয়া মানুষগুলি রান্না করে খায়।

সব আছে, তবু বুড়ো কোনটা ছেড়ে কোনটা নেবে বুঝতে পারে না। সে একটা ঝরণার ধারে বাবলা গাছের ঝোপের পাশেই পড়ে রইল।

তার বিশ্বাস নারায়ণ যদি দয়া করে, আর বুড়ীর যদি ভাগ্য থাকে তো তরিতরকারি আপনিই এসে ফাঁদের ভিতর ঢুকবে।

এই ভেবে কলা পাতার মোচায় বাঁধা ভাত পেট ভরে খেয়ে ঝরণার জল পান করলো, তারপর এক সময় ঘুম নেমে আসলে তার দুচোখে। এদিকে হয়েছেটা কি? কতকগুলি বক পাখী ধরার ফাঁদটার কাছে এসে কৌতুহলে দেখতে লাগলো।

ছোট্ট বকের বাচ্ছাটা অদ্ভুত জিনিসটা দেখে একেবারেই অবাক হয়ে গেল। আরো একটু কাছে যেতেই তার পা আটকে গেল জালে। সব বক ডানা ঝাপটিয়ে চেঁচামেচী শুরু করলোএবং চেষ্টা করলো যাতে ছানাটাকে মুক্ত করা যায়। কিন্তু হায় লাভ হলো না কিছুই।

 এদিকে বকের ছানাটা ভয়ে বিলাপ করে কাঁদতে লাগলো। তার কান্নার শব্দে বুড়োর ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলে দেখলো একটি ছোট্ট বকের ছানা ফাঁদের ভিতর কাঁদছে।

বুড়ো খুশী হয়ে বললো, “বা! ভারী কচি ছানা তুই। দেখতেও ভারী সুন্দর, খেতেও মজা হবে খুব। আমার বউ, তোকে খুব যত্ন করে রান্না করবে। তবে জানিস আমার এখন বড্ড ঘুম পাচ্ছে। তোকে এখন কিভাবে পাঠাবো তাই ভাবছি।”

“এ্যা! বুড়ো বলে কি? আমাকে রান্না করে খাবে?” ছোট্ট বকের বাচ্চাটা তো ভয়ে কাঠ। এতো ভয়েও সে বুদ্ধি হারালো না, সে ভিতরে ভিতরে ভীষণ অস্থির হয়ে উঠলো।

একটি অতি সুক্ষ বুদ্ধির ঢেউ খেলে গেলো তার মনে। সে অমনি মিঠে মিহি সুরে বললো ইস্ দাদু, তোমার আর কষ্ট করতে হবে না। আমাকে ছেড়ে দাও আমি সোজা চলে যাবো আর দিদিমাকে রান্না করতে বলবো।

 “এ্যা! ছোট্ট বকের বাচ্চাটা বলে কি? ভারী মিষ্টিততা কথাগুলি।” সে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তুই যাবি কেমন করে আমার ঘরে?”

“তুমি দেখিয়ে দাও দাদু- আমি সোজা চলে যাবো। এবার আমাকে ছেড়ে দাও।” বুড়ো আংগুল দেখিয়ে বললো, “ঐ সোজা উত্তর দিকে চলে যাও। সেখানে একটা বুড়ী তালি দেওয়া “রিনাই” পরে ধান শুকাচ্ছে। সেইটাই আমার বুড়ী।”

বুড়ো পাখীটার মিষ্টি কথায় তাকে ছেড়ে দিলো। আর অমনি বকের ছানাটা ছোট্ট দুইটি ডানা মেলে হারিয়ে গেল চোখের আড়ালে।

বুড়োও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে বেলা চলে গেল, সূর্য পশ্চিমের আকাশে হেলে পড়ল। পাতার ফাঁক দিয়ে শেষ আঁধারের রঙ পড়লো বুড়োর মুখের উপর। বোকা বুড়োর ঘুম বাঙলো। সে বাড়ীর দিকে রওনা হলো।

খালি হাতে বুড়োকে ফিরতে দেখে বুড়ী রেগে আগুন ভিতরে ভিতরে। তবু সে কিছুই বললো না। চুপচাপ রান্না কেরলো খালি শাক, ভাত। বুড়ো খেতে বসে চোখ ছানাবড়া করে বললো, “কি-হে, পাখীর মাংস কোথায়?” | “ন্যাকামী করতে হবে না আর।” রেগে মেগে বললো বুড়ী।

“আহা রাগ কর কেন? বক পাঠিয়েছিলাম তো” বুড়ো বলল। “কার হাতে শুনি?” বুড়ী চুলের খোঁপাটা নাচিয়ে ধমকে উঠলো। বুড়ো অমনি সবিস্তারে সব ঘটনা খুলে বললো। বুড়ী অমনি বোকা বুড়োকে ঝেটিয়ে বের করে দিল। এই বুড়ো বয়সে তুকমারী করার আর জায়গা পায় না।

 বেচারা বেদমান বুড়ো মানে বোকা বুড়ো কি আর করে! ঐ হিমেল রাতে ঠঠ করে বাইরে কাঁপতে লাগলো। একে তো মাঘ মাসের শীত। পাহাড়ী শিরশির হাওয়ার ঝাপটা।

কুয়াশায় ভিজে গিয়েছে ঘাস। আহা! বেচারা বুড়ো এভাবেই শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল। ভোর রাতে মোরগ ডাকতেই বুড়ী একটু নরম হয়ে ঘরে ডেকে নিল, হাজার হোক এত বছর এক সাথে ঘর করেছে যখন।

ভোরে চুলায় আগুন জ্বালিয়ে বুড়োকে তার পাশে বসে শরীর গরম করে নিতে বললো। নিজে ভাত দু’টো সেদ্ধ করে দিল। কলাপাতা ছিড়ে আনলো বাগান থেকে, তারপর ভাতের মোচা বেঁধে দিল, সংগে নারিকেলের খোলে জল দিয়ে বললো, “পাখীর মাংস খুবই খেতে মজা, পেলে ছেড়োনা কিন্তু। যেমন করে তোকে আনতেই হবে আজ।”

বুড়ো সকালে সূর্য উঠার আগে রওনা হলো কোমর তাঁতে বানো একটা পাতলা চাদর গায়ে দিয়ে। সে চিন্তা করতে করতে পথ চলতে লাগলো। যেতে যেতে সে ভুলে অন্য পথে চলে গেল।

সেখানকার জায়গাটা ছিল একেবারেই স্যাৎসেতে, ঝরণার পানি ঝরছে ঝরঝর শব্দে। সেই পানির স্রোতের সাথে পচা লতা পাতা ভেসে যাচ্ছে। বুড়ো দুপুরে ভাতগুলি গোগ্রাসে খেয়ে নিল। তারপর ঘুরতে ঘুরতে আবার একটি জলাধারে এস পড়ল।

জলাধারে সাদা রঙের যেন কি ফুটে আছে। বুড়ো তো খুশীতে একেরারেই ডগমগ, যেন একটা কিছু সে পেয়ে গেল। নিশ্চয় কালকের বকের ছানাটা বসে আছে তার সংগীদের নিয়ে। আর যায় কোথায় ?

“আজ ধরতেই হবে এটাকে। গতকাল রাতে ঠান্ডায় বুড়ী আমাকে যা কষ্ট দিয়েছে!” বিড় বিড় করে বতে লাগলো বুড়ো, “শালার বক! আজ আর পালাবে কোথায় ?” হাতের লাঠিটা দিয়ে ইচ্ছে মত পিটাতে লাগলাে বক ভেবে।

সেগুলি আসলে ছিল ব্যাঙের ছাতা (মাসরুম)। একে বারে দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে গেল সেগুলি। সে মনের খুশীতে সেগুলি তার বাঁশের ভাঙ্গা ঝুড়িতে নিয়ে বাড়ীর দিকে ছুটলো।

বউকে বললো, “ঝুড়ির ভিতর প্রায় শ’পাচেক বক আছে। রান্নাটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলো দেখি।”

বুড়ীর চোখ দু’টি একেবারে কপালে উঠলো – এ্যা বুড়ো তার এই কাজে শ’পাঁচেক বক মেরেছে। খুলে দেখে বললো, “হায় পোড়া কপাল! এ গুলিতে ব্যাঙের ছাতা।” যাই হোক বিকেলে সেগুলি রান্না করে দিল।

রাতে খেতে খেতে তৃপ্তিতে ঢেকুর উঠলো বুড়োর, “বা! ভারী মজাতো।” বুড়ী এক খিলি পান এগিয়ে দিল খাওয়ার পর। বললো, “দেখ বুড়ো এগুলো ধীরে ধীরে তুলতে হয়। ভাংলে যে কত মজা হতো!”

 “ঠিক আছে বুড়ী কাল আমি নিয়ে আসবো আবার,” বললো বুড়ো। তার পরদিন আবার ভাতের মোচা নিয়ে বের হয়ে গেল। আবারও সে দিক ভ্রষ্ট হলো। কলা বনে এক পাল বুনো হাতি মচমচ্ শব্দে কলাগাছ ভাঙতে লাগলো।

সে আবারও অন্যদিকে মোড় নিল, যেখানে বন মোরগদের তাড়া করে ফিরছে রামকুকুর। সাদা-সাদা বুনো ফুলগুলিতে গুন্ গুন্ করছে কালো ভোমরা। ভয়ে এবার বুড়ো আধপোড়া একটা আশ্বত্থ গাছের মাথায় উঠে বললো, “আহা! গাছের কোটরে ঐ সাদা গুলি কি? ব্যাঙের ছাতা নয় তো?”

আর দেরী নয় আজ খুব সাবধানে তুলতে হবে ব্যাঙের ছাতা, যেই সে হাত দিল অমনি অজস্র পোকা তার চোখে, মুখে, ঠোটে, হাতে, গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আসলে ঐ সাদা অংশটা ছিল মৌমাছির বাসা।

অনেকদিন হতে মৌমাছির সেখানে জমায়েত হয়ে মধু। জমা করছিল। বুড়ো যেই চাক ভাঙল। অমনি ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছির আক্রমণ করল।

বুড়ো বেচারা সেই ভাঙ্গা চাক হাতে নিয়ে গাছ থেকে পড়ে গেল। যন্ত্রণায় সে মাটিতে গড়াতে গড়াতে বললো, “ওরে বাবা! ব্যাঙের ছাতা এমন কামড় দেয় তাতাে জানি না।” সে গড়াতে গড়াতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেল।

রামকুকুরগুলিও মৌমাছির হুলের যন্ত্রণায়। পালিয়ে গেল আরেক বনে। রাধা লতার ফুল দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে গেল বুড়াের দেড় মন ওজনের শরীরের চাপে।

চাপে তার এক একটা হাত-পা হয়ে গেল হাতির পায়ের মত। ঘরে যখন ফিরল বেচারা বুড়োর থেবড় নাক হয়ে গেল ঠিক তবলার মত। তার চোখগুলি ফুলে লাল হয়ে গেল।

সে যখন গ্রামে ফিরল তখন ছেলে- বুড়ো সবাই তার থেবড়া নাকে তাধিন তাধিন তাল ঠুকতে লাগলো। বেচারা বুড়ো কোন রকম ঘরে ফিরলে ভাঙ্গা চাকটা নিয়ে। বুড়ী বুড়োকে দেখে তো হেসেই খুন। একি কিম্ভুতকিমাকার চেহারা হয়েছে বুড়োর?

একেতো থেবড়া নাক তার উপর চোখ দুতো দেখাই যায় না- এক একটা কান এক একটা কলার ফুলের মত ফুলে লাল হয়ে গেছে। বুড়ী খিল্ খিল করে হাসতে হাসতে বললো, “কি গো বুড়ো, এই সুন্দর চেহারা তুমি পেলে কোথায়?”

বুড়ো কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আর বলো না, ব্যাঙের ছাতা আমায় কামড় দিয়েছে, যন্ত্রণায় বাঁচিনে”, ঝুলে পড়া ঠোট দু’টি কোন মতে নেড়ে-চেড়ে বলল।

বুড়ী খিক খিক করে হাসতে হাসতে ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে বললো, “মরার বুড়ো, আক্কেল জ্ঞান বলতে এতটুকু নেই! এ যে মৌমাছির কামড়। আর ওটাতো মধুভরা মৌমাছির ভাঙ্গা চাক। তুমি মৌচাকে হাত দিতে গেলে কেন ? এতো ব্যাঙের ছাতা নয়।”

বুড়ী হাসতে হাসতে গরম পানি দিয়ে বুড়োর গায়ে বিধে থাকা মৌমাছির হুলগুলি তুলে দিল। বুনো লতা-পাতা বেঁটে ঔষধ লাগিয়ে দিল। রাতে খাওয়ার পর বুড়োর যন্ত্রণা একটু কমলে অমনি একটুখানি চাক থেকে মধু খেতে দিল।

বুড়ো তার ঝুলে পরা ঠোট উলটে বললো, “বা! ভারী মিষ্টিতো।” থেবড়া নাকে লেগে থাকা মধু জিহ্বা দিয়ে চাটতে চাটতে সে বললো কথাটা। আকাশে চাঁদ উঠেছে। ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো লুটিয়ে পড়েছে মেঝেতে।

ঠান্ডা হাওয়া বাইরে শির শির করে বইছে। বুড়ী বললো, “এগুলি ভাঙ্গার সময় খুব সাবধানে আগুনের মশাল জ্বালিয়ে পোকাগুলি পুড়িয়ে ফেলতে হয় আগে। তারপর মৌমাছির বাসাটা নিয়ে আসলে মধু নিংড়ে ভরে রাখা যাবে। আর সে মধু যত পুরানো হয়, তত মিষ্টি।

বুড়ো তার থেবড়া নাক ঘষে বুড়ীকে আদর করল। বীরপুরুষের মত চেঁচিয়ে বললো, “হ্যা, দেখে নিও! কাল আমি সবটাই নিয়ে আসবো তোমার জন্যে; আর আমার ভুল হবে ” তারপর দিন বুড়ী আবার মিলক (লাউ) তরকারী, ধেমাই (মারফা) চাটনি করে। বুড়োকে মধুর খোঁজে পাঠাল বনে।

বুড়ো যেতে যেতে আবার পথ ভুলে অন্যদিকে চলে গেল। সে একটা পরিত্যক্ত জুমের একটা গাইরিং (মাচার ঘরবিশেষ)-এ এসে পড়ল। পাশেই একটা চারপাওয়ালা জন্তু তার হাত পা ছড়িয়ে দিব্যি আরামে ঘুমাচ্ছে।

বুড়ো নিত্য দিনের মত তার মোচার ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম থেকে জেগে দেখল, সেই প্রাণীটা তখনও অঘোর ঘুমে অচেতন। পেটটা ঢোলের মত ফুলে আছে। আসলে ওটা ছিল আসন্ন প্রসবা একটা হরিণী।

ঐ পোড়া জুমে গাইরিং-এর পাশেই ছিল তার আস্তানা “আরে, এটা আবার কি? না-কি মৌমাছির বাসাটা মাটিতে নেমে এসেছে, এতো লাল আজকের রঙটা, ভাবলো বুড়ো । তারপর ঠিক করল।

আজ সব মধু নিংড়ে নিয়ে যেতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আজ আর ভুল করবে না সে। একটা বাঁশের চোঙায় খড়কুটা বেঁধে মশাল বানালো সে। তারপর জামার পকেট থেকে দেশলাই বের করে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল তার মৌচাকটার কাছে।

আস্তে করে আগুন জ্বালিয়ে দিল লেজের দিকে। সে চুপটি মেরে বসে রইল মশালের কাছে। একটু একটু করে আগুনটা বেড়ে উঠল। সে আরেকটা বাঁশের চোংগা নিয়ে আগুনে ফু দিতে লাগলো -ফুফু-ফু।

এদিকে ঘুমন্ত হরিণটির গায়ে যেই তাপ লেগেছে অমনি পাগুলি ছড়িয়ে বুড়োর থেবড়া নাক বরাবর দিল একটা লাথি। তারপর হুয়া-র শব্দে দৌড়ে পালিয়ে গেল।

বেচারা বুড়োর থেবড়া নাক আরো বেশী চ্যাপটা হয়ে রক্তে ভেসে যেতে লাগলো। সে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ীর দিকে রওনা হলো, “গেলাম-গেলাম, মরলাম-মরলাম!

পাড়ার লোকেরা রাস্তায় ছুটে এসে বললো, হয়েছে কি বুড়োর ? বুড়োর নাক থেকে তখনো রক্ত ঝরছে ফোটায় ফোঁটায় । জন্মের মত তার নাকটা গেছে একেবারেই থেঁতলে।

সে নাকটা দুহাতে চেপে বলল, “মৌমাছি লাথি মেরেছে আমায়। সেই আঘাতে নাকটা গেছে চলে, আহা! আমার নাকটা কোথায় পাই ?” চোখের জলে ভেসে গেলো বোকা বুড়োর বুক। অনেকে তার কষ্ট দেখে সমবেদনা জানালো- আহা! বেচারা বোকা বুড়ো।

ছেলেরা কেউ হাসলো। বুড়ী গোলমাল শুনে এগিয়ে এসে দেখলো। সে বুড়ো কে রাগে গড় গড় করে বকতে লাগলো। হাত ধরে ঘরে নিয়ে বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের মুভপাত করতে লাগলো। এমন বোকা বরের ঘরে তার জীবনপাত হলো! ইত্যাদি ইত্যাদি।

বুড়ী জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে মিসে?” “আর বলো না, মৌমাছি কাঁমড়ে দিয়েছে আমায়, বললো বুড়া। “গায়ের রঙ কেমন? দেখতে কেমন ?” জিজ্ঞেস করল বুড়ী।

“দুটো চোখ, দুটো কান আর চারটে লম্বা পা আছে।” বলল বুড়ো “ইস্! ঔটাতো হরিণ, ভারী মজা তার মাংস। হায়-হায় কি ভাল জিনিষটা না হারালো গো। ওগুলিকে বাঁশ সুঁচালো করে মারতে হয়”, বুড়ী বলল।

গ্রামবাসীরা সবাই বোকা বুড়োকে দেখতে আসল, তার হরিণ থেকে লাথি খাওয়ার কথায় পুরোগ্রাম রাষ্ট্র হয়ে গেল। সবাই এ নিয়ে হাসাহাসি করল। কেউ বা সমবেদনা জানালো।

দিন কয়েক বিশ্রাম নেবার পর বুড়া একটু সুস্থ হয়ে উঠলে বুড়ী বারবার বুড়োকে বললো, “হ্যা-গো যাওনা-গো, হরিণের মাংস অনেকদিন খাইনা, ভারী মজা খেতে!” বেচারা বুড়ো বুড়ীর মন রক্ষার জন্য আবার হরিণ খুঁজতে গেলো বনে।

হরিণ কি আর তার জন্য বসে থাকবে ? সে একটি অন্য গ্রামের চৌরাস্তায় গিয়ে জঙ্গলের ধারে বসে রইল।

এদিকে হরিণের দেখা আর মেলে না, অবসাদে দুটো চোখ বুজে আসতে চায় তার। হঠাৎ অনেকক্ষণ পর কিসের পদ শব্দে সে উৎকর্ণ হয়ে রইল। ঐ যে হরিণ আসছে দু’টো!

আসলে সে-গুলি ছিল মারমাদের ভান্তে (ধর্মগুরু)। তাদের পরণে ছিল গেরুয়া রঙ-এর পোষাক। বুড়ো উত্তর্ণ হয়ে রইল।

বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি। ধর্মং শরণং গচ্ছামি। সংঘং শরণং গচ্ছামি।

এ সব বলতে বলতে দু’জন ভান্তে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। আর যায় কোথায় ? হরিণ খুব কাছাকাছি এসেছে, সে বাঁশের খুঁচালো অংশটা আমূল গেঁথে দিল ভান্তের বুকে।

“ও দলেঅ ঙা সিবেয়া (মাগো! আমি মরে গেলাম)” বলে ভান্তে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। অন্যজন দিল দৌড় প্রাণের ভয়ে এবং বুনো পথেই অদৃশ্য হয়ে গেল। আর বোকা বুড়ো হরিণ মারার আনন্দে রাতে ঘরে ফিরে আসলো মৃত দেহটি কাঁধে নিয়ে।

“এই বুড়ী ধরো হরিণ এনেছি ভালো করে রান্নাটা সারো দেখি।” বুড়ী এসে দেখে, “হায়! ভগবান; রক্তে ভেসে গেছে বুড়োর সারা শরীর। হে ঈশ্বর এ যে মানুষ মেরে এনেছো।”

বুড়ী ভয়ে আতংকে উঠে আবার বললো, “শীগগির কাঁটাবনে ফেলে দিয়ে এসো। এক্ষণি লোক জানাজানি হয়ে গেলে অসুবিধায় পড়বে।” আহা! বেচারা বোকা বুড়ো কি আর করবে, ভান্তেকে কাঁটাবনে ফেলে আসল। তার পরদিন সকালে বুড়ী ভাত রান্না করতে করতে বলল, “যাও, মাফ চাও গে।”

রাত্রে একটা বাঘ খেয়ে ফেললো মৃত ভান্তেকে; তারপর গেরুয়া কাপড়টা মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইল সটান লম্বা হয়ে।

বুড়ো বললো, “হে ভান্তে, আমি তোমাকে কত কষ্ট দিয়েছি, কত সুঁচালো বাঁশ দিয়ে ঘাই মেরেছি। আমার অপরাধ ক্ষমা করো।”

বাঘটি “হুম” করে হুংকার দিয়ে উঠলো। বুড়ো আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে আবার সে কথাটি বললো। বাঘটি আবারও “হুম” করে হুংকার দিয়ে উঠলো।।

আরো কাছে যেতেই বাঘটি লোকটির ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে ঘাড় মটকে দিল। আর বুড়ী ভয়ে সে গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করলো।


লেখক: শোভা ত্রিপুরা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা