
সে অনেককাল আগের কথা। সে সময় এক গ্রামে বাস করত এক ব্যাঙ আর এক বাদুড়। তারা ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একদিন ব্যাঙ বাদুডকে তার বাড়িতে দাওয়াত করে আনল।
খাওয়া-দাওয়া আর গল্পগুজব করে সময়টা কাটছিল ভালই। কিন্তু একটা বিষয়ে হঠাৎ তাদের মধ্যে তর্ক বেধে গেল। তর্ক গড়াল ঝগড়ায়। এক সময় ব্যাঙ খুব খেপে গেল। সে বলতে লাগল:
“তুমি বাঁশঝাড়ে লুকালে আমি তোমাকে ছিড়ে খাব।
তুমি গর্তের মধ্য লুকালে আমি তোমাকে খুঁড়ে বের করে খাব।
তুমি উড়ে গেলে আমি বাঁশের লাঠি দিয়ে তোমাকে নামিয়ে এনে খাব।
তুমি যেখানে লুকাবে, আমি সেখান থেকেই তোমাকে ধরে এনে খাব।”
একথা শুনে বাদুড় ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। সে একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোনো জায়গাই তার কাছে জুতসই মনে হল না। কাছেই ছিল একটি বড়গাছ।
সেই গাছে ছিল একটি ধনেশপাখি। বাদুড় ঠিক করল সে ধনেশপাখির নাকের ভিতর লুকোবে। যেই ভাবা সেই কাজ। বাদুড় ধনেশপাখির নাকের ভিতর ঢুকে পড়ল।
ধনেশপাখি তো পড়ল ভারি বিপদে! নাকে কেমন সুড়সুড়ি লাগছে। সে চোখ-মুখ উপরে তুলে বিকট শব্দে দিল এক হাঁচি। সেই গাছে ছিল এক বানর। গাছে একটি বড়সড় পাকা ফল দেখে । বানর সেটি পেড়ে আনার চেষ্টা করছিল।
ঠিক সেই মুহূর্তেই ধনেশপাখির হাঁচির শব্দে হকচকিয়ে গেল বানর। সঙ্গে সঙ্গে তার হাত থেকে ফলটি ছিটকে পড়ল। সেটি নিচে গিয়ে পড়ল একটি হরিণের উপর। হরিণ তো ভয়ে দৌড়! কাছেই এক বুনোমুরগি ডিমে তা দিচ্ছিল।
দিগ্বিদিক দৌড়ে হরিণটি গিয়ে পড়ল বুনোমুরগির উপর। ডিমগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। তবে বুনোমুরগিটা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেল। ডিম হারিয়ে বুনোমুরগি খুব খেপে গেল। সে রেগেমেগে ঢিবিতে থাকা লালপিঁপড়েদের সব ডিম খেয়ে ফেলল।
এতে লালপিঁপড়েদের দল ভীষণ খেপে গেল। তারা ঠিক করল, সবকিছু ধ্বংস করে দেবে। দল বেঁধে লালপিঁপড়েরা এদিকে-সেদিক ঘারাফেরা করতে লাগল। কাছেই একটা শূকর ঘুমোচ্ছিল। বাগে পেয়ে পিপড়েগুলো শূকরটাকে কামড়াতে শুরু করল।
হঠাৎ অসহ্য বহোস ঘুম ভেঙে গেল। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে শূকর দৌড়াতে শুরু করল। দৌড়াতে দৌড়াতে সে এসে পৌছল এক বৃদ্ধার জুমখেতে। লালপিপড়েদের উপর রাগ আর ব্যথার চোটে শূকরটা বৃদ্ধার জুমখেত তছনছ করে ফেলল।
শস্যখেতের করুণ দশা দেখে বৃদ্ধা রাজার কাছে গেল বিচার নিয়ে। গিয়ে বলল, “রাজামশাই, আমি এক গরিব বৃদ্ধা। একটি পাগলা শকর আমার জুমখেতের সব শস্য নষ্ট করে ফেলেছে। রাজামশাই, আপনি এর বিচার করুন।
রাজা তার সেপাইদের শূকরটাকে ধরে আনার হুকুম দিলেন। জুমখেতের ক্ষয়ক্ষতি কতটা হয়েছে তা দেখে আসারও নির্দেশ দিলেন তিনি।
সেপাইরা শূকরটাকে ধরে রাজার কাছে নিয়ে এল। রাজা বললেন, ’তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুমি এক বৃদ্ধার জুমখেত তছনছ করেছ। তোমাকে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে। যদি তোমার কোনো কথা থাকে বলো।’
শূকর বলল,’ আমার কথা শুনুন মহারাজ। দিনটা ছিল খুবই গরম। একটা গাছের নিচে আমি বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। সে সময় লালপিঁপড়েদের দল আমাকে কামড়ে দিল।
অসহ্য ব্যথায় আমি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াতে লাগলাম। এক সময় এলাম ঐ জুমখেতের কাছে। তখনও আমার ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিল। ছোটাছুটি করতে করতে জুমখেতের সব ফসল নষ্ট হয়ে গেল।’
শূকরের কথা রাজার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হল। তাহলে মূল দায়ী হচ্ছে ঐ লালপিঁপড়েদের দল। রাজা ওদেরকে ধরে আনার হুকুম দিলেন। রাজার হুকুমে সেপাইরা পিঁপড়ের দলকে এনে হাজির করল। রাজা তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা শূকরটাকে কামড়েছ কেন?’
লালপিঁপড়েরা বলল, ‘আমরা খাবারদাবার আর আণ্ডাবাচ্চা নিয়ে বাসার মধ্যেই ছিলাম। হঠাৎ একটা বুনোমুরগি এসে আমাদের বাসা ভেঙে ফেলল, সব ডিম খেয়ে ফেলল।
আণ্ডাবাচ্চাগুলো বাঁচাতে আমরা কিছুই করতে পারালাম না। রাগে-দুঃখে তখন আমরা পাগলপারা। ঠিক সেই সময়ে আমরা সামনে পেয়ে গেলাম শূকরটাকে। সবাই মিলে ওকে আচ্ছামতো কামড়ে দিলাম।
লালপিঁপড়েদের দলের জবাব রাজার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হল। তখন বুনোমুরগিকে ধরে আনার হুকুম দিলেন। সেপাইরা বুনোমুরগিকে ধরে রাজার সামনে নিয়ে এল। রাজা জানতে চাইলেন, ’তুমি লালপিপড়েদের বাসা ভেঙেছ কেন? ডিম খেয়েছ কেন?’
বুনোমুরগি বলল, আমি ডিমে তা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা হরিণ এসে আমার ডিমগুলো ভেঙে ফেলল। অল্পের জন্য আমি প্রাণে বেঁচে গেলাম। ডিম ভেঙে যাওয়ায় আমার খুব কষ্ট হল। রাগে-দুঃখে আমি লালপিপড়দের বাসা ভেঙে ফেললাম। ওদের ডিমগুলোও খেয়ে ফেললাম।
রাজার কাছে বুনোমুরগির জবাবও যুক্তিসঙ্গত মনে হল। তিনি হরিণকে ধরে আনার হুকুম দিলেন। সৈন্যরা হরিণকে ধরে রাজার সামনে এনে হাজির করল। রাজা জানতে চাইলেন, তুমি বুনোমুরগির ডিম নষ্ট করেছ কেন?
হরিণ বলল, আমি একটা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এমন সময় একটা বানর গাছের উপর থেকে ফল ছুড়ে মারে। আমি ভয়ে দৌড়াতে শুরু করি।
এক সময় ঐ বুনোমুরগির উপর গিয়ে পড়লে ওর ডিমগুলো ভেঙে যায়। আমি তো ইচ্ছে করে ডিম নষ্ট করিনি।
হরিণের কথা রাজার কাছে যুক্তসঙ্গত মনে হল। রাজা এবার বানরটাকে ধরে আনার হুকুম দিলেন। সৈন্যরা বানরকে ধরে রাজার সামনে এনে হাজির করল। রাজা বললেন, ’তুমি হরিণের গায়ের উপর ফল ছুড়ে মেরেছিলে কেন ?’
বানর বলল, ’আমি গাছ থেকে একটি ফল পাড়ছিলাম। ফল পাড়ার আনন্দে বেশ খোশমেজাজে ছিলাম। হঠাৎ একটা ধনেশপাখি হাঁচি দিল। হাচির প্রচণ্ড শব্দে আমি হকচকিয়ে উঠলাম। আর তাতেই আমার হাত থেকে ফলটা ছিটকে পড়ল।’
বানরের কথা রাজার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হল। রাজা এবার ধনেশপাখিকে ধরে আনার হুকুম দিলেন। ধনেশপাখিকে ধরে রাজার সামনে
হাজির করা হল। রাজা তাকে বললেন, ’তুমি কেন হাঁচি দিলে?’
ধনেশপাখি পাখি বলল, ‘আমি বাসাতেই বসেছিলাম। হঠাৎ একটা বাদুড় এসে আমার নাকের ভিতর ঢুকে পড়ল। আমার ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল। তখন নাক দিয়ে বিকট শব্দে হাঁচি বেরিয়ে এল।
ধনেশপাখির কথা রাজার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হল। রাজা এবার বাদুড়কে ধরে আনার হুকুম দিলেন। বাদুড়কে নিয়ে আসা হলো রাজা তাকে বললেন, ‘তুমি ধনেশপাখির নাকের ভিতর ঢুকে পড়েছিলে কেন?
বাদুড় জবাব দিল, ব্যাঙ আমাকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। সে বলেছিল,
“তুমি বাঁশঝাড়ে লুকালে আমি তোমাকে ছিড়ে খাব।
তুমি গর্তের মধ্য লুকালে আমি তোমাকে খুঁড়ে বের করে খাব।
তুড়ি উড়ে গেলে আমি বাশের লাঠি দিয়ে তোমাকে নামিয়ে এনে খাব।
তুমি যেখানে লুকাবে, আমি সেখান থেকেই তোমাকে ধরে এনে খাব।”
ব্যাঙের হুমকিতে আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। ঐ অবস্থায় ধনেশপাখির নাকের ফুটো আমার কাছে সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে হল। তাই আমি ওর নাকের ভিতর লুকিয়ে পড়লাম।
বাদুড়ের কথাও রাজার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হল। রাজা এবার ব্যাঙকে ধরে আনার হুকুম দিলেন। ব্যাঙকে আনা হলো রাজা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বাদুড়কে হত্যার হুমকি দিয়েছিলে কেন?
ব্যাঙ বলল, বাদুড় আমার বন্ধু। আমরা নানা বিষয়ে আলোচনা করছিলাম। কিন্তু আমার একটি কথার সঙ্গে বাদুড় কিছুতেই একমত হচ্ছিল না। তাই ওর উপর আমার খুব রাগ হল। আমি ওকে খেয়ে ফেলার হুমকি দিলাম।
ব্যাঙের জবাব রাজার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হল না। রাজা সেপাইদের ব্যাঙকে আটক করতে নির্দেশ দিলেন। রাজা বললেন, ’কেউ আমার কথার সঙ্গে একমত না হলে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেব- এটা তোসাংঘাতিক কথা। ব্যাঙ অপরাধ করেছে। এজন্য অনেক প্রাণীকে কষ্ট পেতে হয়েছে।
বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে ব্যাঙকে সাজা দেওয়া হল। সেপাইরা মেরে মেরে ব্যাঙের পাঁজর ভেঙে দিল। সেই থেকে ব্যাঙ আর কখনও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সব সময় তারা বুকে ভর দিয়ে চলে।