ত্রিপুরা রূপকথা: পরি বিবি চিনিন (সাত বোন পরী)
1079
এককালে এদেশে বিরাট এক জমিদার বাস করতো। তার ছিল ফুটফুটে সাতটি কুমার। ছয় ছেলের ছিল সাতটি সুন্দরী বউ। তাদের রূপে জমিদার বাড়ী আলোয় ঝলমল করতো। ছয় ছেলে ছিল প্রাণবন্ত উচ্ছল তারণ্যে ভরা।
ছোট ছেলেটি ছিল নির্জীব আর ঘরকুণো। শুয়ে-বসেই তার দিন কেটে যায়। পৃথিবীর কোন আনন্দ তাকে আকর্ষণ করতে পারতো না। একদিন বুড়ো জমিদার হোট করে কুমারকে কাছে ডেকে বসালেন।
চোখের জলে তার বুকের বসন ভিজে গেল। তিনি বললেন, নুং তীরবান কাই সি নিলাই প্রবাস থাং দি। আং হয়ত বেশীদিন বাচি গালাক হাম চরক তং ননা তবই ফাই দি। (তুমি ৩টি তীর নিয়ে প্রবাসে চলে যাও। বউ নিয়ে এসো। আমি আর বেশী দিন বাঁচবোনা)
বেচারা ছোট কুমার আর কি করে। সে একটি ধনুক আর সাতটি তীর নিয়ে গভীর অরণ্যে চলে গেল হাঁটতে হাঁটতে। জমিদারের ছেলে এত কষ্ট করেনি কোনদিন। ছয়টি তীরই তার লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। অথচ কেউ ধরা পড়লনা।
সে ক্লান্ত হয়ে সটান লম্বা হয়ে শুয়ে রইল একটি গাছের তলায়। এদিকে সাত বোন পরী যাচ্ছিল আকাশ পথে। তারা সন্ধ্যার তারা ফুটাতো আকাশে।
সুন্দর সাত বোন পরী আকাশ পথে পাখা মেলে উড়ছিল। চোট পরীটা বলল, ছিঃ ববই হাজার কাবো চালাবাছা- তরকম হালাই থামোনি গাম অং দিয়া। (ছিঃ দিদি ওভাবে পার হওয়া উচিৎ নয়। হাজার হউক, বেটা ছেলে)।
ছোট বোন গাছের শাখায় বানর সেজে বসে রইল। এদিকে বেলা যায় যায়। ছোট কুমার তীরটি ছুড়লো সোজা মগডালের দিকে। বানরী খপ করে ধরে ফেললো।
ছোট কুমার দেখে অবাক হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত তার ভাগ্যে জুটল বানর বউ। অগত্যা সে আর কি করে বানরীকে নিয়ে ঘরে ফিরে আসলো।
বৌদিরা সবাই হাসাহাসি ফিস্ ফিস্ কানাঘুষা করতে লাগলো। ছোট কুমারকে তারা এড়িয়ে চলতে আরম্ভ করলো। একদিন জমিদার ছেলেদের ডেকে বলল, আমিতো মরে যাবো। সব বউমাদের হাতে যদি আমি দু’টো খেতে পারতাম, তাহলে স্বর্গবাসী হতাম।
যেই বলা অমনি ছয় বউয়ের ঘরে রান্নার ধুম পড়ে গেল। কেউ শূকর কাটলো, কেউ পাখীর মাংস, কেউবা ছাগল, কাছিম প্রভৃতি তরকারী যতের সাথে রান্না করতে লাগলো।
বেচারা ছোট বউ বানরী-মুখো ঘরের এক কোণে চুপ করে বসে রইল। সেনা পারে রান্না করতে, তার না আছে একটু চেহারা। ছোট কুমার এসে তাকে ছোট একটা বেত দিয়ে মনের দুঃখে মারতে লাগলো। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ছোট বাবু, নুং মানি আনো বুয়ানী।(ছোট কুমার, তুমি আমাকে কেন মারো)।
যত বানী খনি-মাই তাং আনো থানো। নুং তামা ঢং আনি। (সবাই বাবার জন্য ভাত নিয়ে যাবে। তুমি কি করবে শুনি?) বানরী কাঁদতে কাঁদতে বললো, বফাং তেলানী ব্লাংহা অঃ বফানী ব্লাইলিফা তবইর ফাইদি। (আমাকে যে গাছ থেকে এনেছ, সেখান থেকে একটি পাতা ছিড়ে নিয়ে এসো)।
অগত্যা তা-ই করলো সে। যে গাছ থেকে বানরীকে নিয়ে এসেছিল সেখান থেকে একটা পাতা নিয়ে আসলো। বানরী বউ একটি চিঠি লিখে সে গাছের নীচে পাতাটি রেখে আসতে বললো। ছোট কুমার সেই গাছের নীচে পাতা রেখে আসলো।
ছয় বোন পরী আকাশের পথে উড়ে যেতে যেতে দেখলো ছোট বোন নীল পরীর চিঠি। পড়তে পড়তে ওদের চোখে জল দেখা দিল। তারা ছয় বোন মিলে একটি কলা পাতার মোচায় একটুখানি ভাত আর একটুখানি তরকারী রেখে গেল।
এদিকে রান্নাবান্না সেরে সব বউগুলি শ্বশুরকে ভাত দিয়ে এলো। কিন্তু ছোট বউয়ের রান্না করা ভাত এখনো এলোনা। বৃদ্ধ জমিদারের মন বিষন্ন হয়ে এলো।
তার মনে তখনো অশান্তির ঝড়ো হাওয়া। এদিকে বানরী বউয়ের অনুরোধে ছোট কুমার সেই গাছতলায় গিয়ে দেখলো ভাত আর তরকারী মোচা। সে মনের আনন্দে বাবার কাছে এল। বড় বউয়েরা হাসাহাসি চোখ টিপাটিপি শুরু করলো।
বানরী বউ আর কিইবা রাধবে? এ দিকে বৃদ্ধ জমিদার মোচা খুলে দিল। তরকারীর মোচা থেকে বেরুচ্ছে তীব্র সুঘ্রাণ। এতটুকু ভাজি আর সিদ্ধ চাটনী। অথচকিঘ্রাণ আর স্বাদ।
সবাই একটু চেখে দেখে চমৎকৃত হলো। সবাই ছোট বউয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর বৃদ্ধ পিতার মুখে একটুকরো স্মিত হাসির আমেজ। ছয় বউয়ের মুখ অপমানে কালো হয়ে গেল। তারা হিংসায় জ্বলে মরতে লাগলো। ছোট কুমার খুশি হয়ে ঘরে ফিরলো।
দিন যায়। বৃদ্ধ পিতা আবার দু’এক মাস পর ছেলেদের ডেকে বললেন, আংলে থি থাননা। বিনি সিকা ভো হামচোক তুং সুং নি ইয়াকনী যদি রি ফোয়া ফোয়া থাচুং তেলে খুব বরদা রাহা সো। (আমিতো মরে যাব, তার আগে সাত বউ-এর বোনা কাপড় পরতে চাই)।
ছয় বউ বেজায় খুশি। এইবার ছোট কুমার কেমন জব্দ হবে। তারা রেশমী সুতো জুড়ে কোমর তাতে মিহি করে নানা বর্ণের ফুল, পাতা, পাখী ইত্যাদির আল্পনা দিয়ে বয়ন করতে লাগলো কাপড়। তাদের রান্নাবান্না পাটে উঠলো। কেবল কিভাবে বুননটা সুন্দর হয় এবংনকশাগুলি ভাল হয় সেসব নিয়ে আলোচনা চলতে লাগলো।
এদিকে মাসও শেষ প্রায়। ছোট কুমার বউকে খুব করে মারলো। বানরী বেচারী কেঁদে কেঁদে বললো, “দোহাই কুমার, নিনি দামো মাপসানো। আনোতা বদি নুংখাহ আং তা হালাই ইয়ানো”।(দোহাই কুমার, আমাকে মেরোনা। যাই বল তাই করব ।)
ছোট কুমার রাগে গজরাতে লাগলো, আনি ইজ্জৎ থাংকচ, বাবানো তামা হালাই রি ব্লাং ওই রইয়ানী? নুংলে মাখারা চুংখা, তামা হালাই রি তাগানী? (আমার ইজ্জত গেল। বাবাকে কেমন করে কাপড় দেব। তুমিতো বানর। কাপড়কি করে বুনবে)। উঃ আচ্ছা ইকবোক দে। (ও আচ্ছা এই কথা) —-বলে আবার একটি গাছের পাতা আনতে বললো এবং দিদিদের চিঠি লিখে দিল সুতো আনার জন্য।
কুমার পাতাটা গাছের নীচে রেখে এল। ছয়বোন উড়তে উড়তে আবার সেই গাছের নীচে এসে দেখলো, বোনের চিঠি। তারা বক বক করে বকা দিল, পোড়া কপালী বোন মোদের।
তারপর ছোট একটা বাঁশের ভিতর রেখে গেল রেশমী সুতো। পরদিন ছোট কুমার সেই সুতাভরা চৌঙাটি এনে দিল। বানরী বউ ছোট কুমার ঘুমিয়ে পরলে একরাত্রের মধ্যেই বুনে শেষ করল। তারপর আবার বাঁশের কঞ্চিতে রেখে দিল।
ভোরে উঠে ছয় বউ সেজেগুজে শ্বশুরের হাতে কাপড় দিল। শ্বশুর খুব খুশী হলেন। তবু তৃষ্ণা জেগে রইলো মনে। তিনি বললেন, আমার ছোট বউয়ের কাপড় এখনো এলোনা।
কবে আসবে কে জানে। ছয় বউ-এর মুখ হিংসায়বিকৃত হয়ে গেল। তারা ভাবল, বানরী বউ এবার কি দেয় দেখা যাবে। এদিকে হোট কুমার এসে পৌঁছলো।
সে মাথা নত করে কুষ্ঠিত স্বরে বললো, হি লাদি, হামচোককতইনিরি। (এই নাও তোমার ছোট বউয়ের কাপড়)। ছয় বউ বাঁশের চৌঙাটি দেখে খিল খিল হাসিতে ভেঙে পড়ল।
বৃদ্ধ জমিদার আদেশ দিলেন ছোট বউ কি পাঠিয়েছে পরিষদ বর্গকে খুলতে। পরিষদবর্গ আর সভায় উপস্থিত সকলেই হতবাক। কারো মুখে রা-টি নেই।
দু’জন চাকর কাপড় খুলছে। হায় হায় কি সুক্ষ্ম ফিনফিনে ধুতি; তার মধ্যে রেশমী জরির কাজ। ময়ুরের পুচ্ছ, নদীতে পালতোলা নৌকা। যত টানো তত লম্বা হয়।
পুরো ঘরময় স্থাপিত হয়ে গেছে কাপড়টা। মাঝে মাঝে পাহাড়ের শ্যামলিকা সবুজ প্রান্তর আর হরেক রকম বুনো ফুলের চিত্র—– কি নয়নাভিরাম নকশা। বৃদ্ধ জমিদার খুশি হয়ে বললেন, সবাই ইবই আনি উপযুক্ত হামচোক। (সাবাস এটাই আমার উপযুক্ত বউ)।
ছয় বউয়ের গোমরা মখ অন্ধকারে ভরে গেল। তাদের মনের ভিতর একটা অস্থিরতা। নিজেদের হিংসার আগুনে তারা নিজেরাই জ্বলে মরতে লাগলো। ছোট কুমার ঘরে ফিরে খুব খুশি। বানরী বউকে কাঁধে করে সে তাধেই ধেই নাচন শুরু করল। বানরী বউয়ের চোখে জল এল সাফল্যের আনন্দে।
এভাবে দিন যায়। সপ্তাহ আসে, ক্রমে সপ্তাহ গিয়ে মাস আসে। মাস বিগত হয়ে বৎসর ঘুরে। গাছে গাছে জেগে ওঠে কচি কিশলয়। বনে বনে জেগে উঠে পাখীদের গান। আকাশে সোনালী, রূপালী, নীল, ধূসর মেঘমালা ভেসে বেড়ায়।
বৃদ্ধের এবার সাধ জাগলো সকল ছেলের বউকে একসাথে দেখার। ছেলেদের ডেকে তিনি নিজের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করলেন। ছয় বউতো দারুণ খুশি, মুখে তাদের আর হাসি ধরেনা।
তারা কয়েক সপ্তাহ ধরে লেবুর রস, দুধের সর, মসুরের ডাল, চন্দন বাটার সুগন্ধি শরীরে মেখে রাখলো সবাই। হলুদবাটা মিশিয়ে সেই পানিতে স্নান করলো গায়ের রঙ চর্চকে করার জন্য। তারপর নিদিষ্ট দিন এলো।
ছয় বউ চমৎকার করে সেজেগুজে রইল। তাদের সোনা-রূপার অলঙ্কার আর নতুন রিনাই-এঝিলিক দিয়ে উঠলো সৌন্দর্য। লজ্জায় মুখ ঢাকলো মেঘের আড়ালে চাঁদ। আহা বেচারা ছোট বউ। ছোট ট কুমার রাগে তাকে একটা জুম কাটতে দিয়েছিল।
সারাদিন সে রোদে পুড়ে কাজ করেছে। একেতো বিদঘুটে চেহারা; তার উপর কালিঝুলি মেখে চেহারা আরো বেশী হাস্যাস্পদ করে তুলেছে। ছোট কুমার তাকে প্রতিদিন মারে এই বলে, সব বউয়েরা সুন্দরী।
তুমি এই বাদরমুখ নিয়ে কি করে যাবে? সবাই তোমাকে দেখে ঢিল মারবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। মানসিক কষ্টে ছোট বউ প্রতি রাত ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে। তার কান্না শুনে ছয় বোন আকাশ পথে থমকে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছে।
তার কান্না শুনে পাখিরা গান ভুলে যায়, গাছের পাতা ঝরে। সে কুমারকে ডেকে বলে, আমি যাবো, তবে এক শর্তে। আমাকে পালকি করে নিয়ে যেতে হবে। আর কোনদিন তোমার কাছে ফিরে যাবোনা। “বেশ ধিক তংগো মাথারানি মাথাং নাইয়ানী আং মুচুইয়া”। (বেশ ঠিক আছে। বানরের মুখ দেখার ইচ্ছা আমার নেই।)
সকালে ছয় বউ সেজেগুজে দেমাগে সারা ঘরময় পায়চারী করে। পায়ের রূপোর মলে ঝংকার উঠে যুন যুন কানু। কানের স্বর্ণচাপার ঝুমকো দোলে দুল দুল দুল। তারপর মুখের উপর আবার এক প্রস্থ দুধের সর-বাটা মাখে।
বার বার আয়নায় নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখে। একজন আরেকজনকে ডেকে বলে, দিদি তোমাকে আজ একেবারে রাজকুমারীর মত মনে হচ্ছে। ছয় বউ রূপের দেমাগে পা ফেলে ফেলে শ্বশুরকে প্রণাম করলো। ছোট বউ আসেনি এখনো।
ছয় বউ একজন আরেকজনকে চিমটি কাটে আর বলে, ওলো সই, ছোট বউয়ের রূপ দেখে আজ জমিদার বাড়ীর কুকুরগুলির মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। এদিকে বেচারী বানরী বউটা এতদিন ছিল ছদ্মবেশে।
আসলে সে ছিল সাত বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট; অথচ সবার চাইতে সুন্দরী। নাম “নীল পরী”। সে খোলসটা খুলে রেখে দিব্যি একটা সুন্দর রিনাই পরে পালকি থেকে রেশমী চাদরে মুখ ঢেকে নামলো।
জমিদার বললেন, হামচবোক তুংনউংনী মাখার ফোয়া ক্ষুন রাদি। (ছোট বউমা মুখ তোল)। ছোট ট বউ মুখ থেকে রেশমী চাদর তুলে নেয়। ঘর ভর্তি মানুষ স্তব্ধ হয়ে দেখে, চোখের পলক পড়ে না।
মোমের পুতুলের মত একটি নিটোল মুখ। চোখের পাপড়ীগুলি অপূর্ব মায়াময়। দাঁতগুলি মুক্তার মত ঝকঝক করছে। ঠোটের কোণে বিশ্বভোলা হাসির ছটা। মেঘের মত কোনো কালো চুল। নিটোল হাত পা চোখ দুটি যেন আপনা থেকেই কথা বলে।
সরু কোমর। দুধ আলটায় মিশানো রঙ। পাতলা দুটি ঠোঁট। আকাশী নীল রিনাই আর লাল রিসাই। নিরাভরণ হাত-পা; তবু যেন কি অদ্ভুত আদুরে চেহারা। তার সামনে ছয় বউ-এর প্রসাধন চর্চিত মুখাবয়ব মনে হলো পাংশুটে রুক্ষ।
হিংসার আগুনে তাদের চেহারা ফ্যাকাসে ধূসর। ছয় বউয়ের দিক থেকে বৃদ্ধ জমিদার ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ছোট বউএর মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমিই আমার উপযুক্ত বউ। বৃদ্ধ জমিদারের ক্লান্ত দুটো চোখ ছাপিয়ে ফোটায় ফোঁটায় জল গড়িয়ে পড়ল।
আবেগে তার কণ্ঠ হয়ে এলো রুদ্ধ। আপন মনে ঘূণায়, হিংসায় ছয় বউ ফিসফিস করে কানাকানি করে বেড়িয়ে গেল। তারা ছুটতে ছুটতে ছোট কুমারের ঘরে এসে তন্ন তন্ন করে বললো, এইতো ছদ্মবেশী রাক্ষুসীর চামড়াটা। নে পুড়িয়ে দে।
দেখি নিশ্চয় তার রূপ ঝলসে যাবে। বেটী নিশ্চয় যাদু জানে। তারা ছয় বউ মিলে আগুন ধরিয়ে দিলো চামড়ায়। এদিকে হয়েছে কি? সারাগ্রাম রাষ্ট্র হয়ে গেল ছোট বউ-এর রূপের কথা।
সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে হোট কুমারকে ধন্য ধন্য করতে লাগলো। ছোট কুমার এসব শুনে একেবারে থ। ছোট কুমার তার প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গেল।
সে উদ্ধশ্বাসে জমিদার বাড়ার দিকে দৌড়ে চলে গেল। গিয়ে যা দেখলো, সে অবাক হয়ে গেল। মুগ্ধ হয়ে সে দেখলো, ছোট বউ কি অপূর্ব সুন্দর। তার চোখের পলক যেন পড়ে না।
এদিকে ছয় বউ চামড়ায় আগুন ধরিয়ে দিতেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো সেটা। নীল পরী ছটফট করতে লাগলো। তার সুন্দর দুটো চোখ ছাপিয়ে জল ঝরতে লাগলো ফোটায় ফোটায়। তার দুটি হাত উপরে উঠলো।
হাতের পাশে দেখা দিলে দুটি বিচিত্র রঙের পাখনা। প্রজাপতির মত সুন্দর। ছোট বউ এসে বললো, কুমার তুমি কথা রাখনি। আমি আকাশের নীল পরী। দেবতার মেয়ে। সাত বোনের ছোট নীল পরী। মানুষ ভারী নিমকহারাম। আমি চলে যাচ্ছি।
তার পাখা দুটি মেলে দিলো নীল পরী। আকাশে পাখা মেলে দেখা দিলো আরো সুন্দরী ছয়টি মেয়ে। তারা মধুর সুরে ডাকলো, “ফাইদিথাই থাক ফাই” (আয় ছোট বোন আয়)। নীল পরী কাদতে কাঁদতে আকশে উড়ে গেল।
নীল মেঘের সাথে ভাসতে ভাসতে হারিয়ে গেল আকাশের মেয়ে আকাশের অসীম নীল দিগন্তে। ছড়িয়ে রইল তার নীল বর্ণের বেশ।
পৃথিবীতে তার এক এক ফোটা চোখের জল ঝরনাধারা হয়ে ছল ছল কল কল করে কাঁদে। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। তার হৃদয় বিদারী কান্নার আমেজ ছড়িয়ে রইল বাতাসে বাতাসে।
ছোট কুমার অপরিসীম দুঃখ নিয়ে উন্মাদের মতো ছুটে গেল সামনে। কিন্তু তারতো পাখা নেই। আকাশে উড়তে পারলোনা। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যায়। ছুটতে ছুটতে কাটাবনে তার শরীর কাঁটায় জর্জরিত হয়ে যায়। সে অবিরাম ছুটে ছুটে পার হয়ে যায় গ্রাম, প্রান্তর, নদী-নালা।
তার চোখের জল তার অবরুদ্ধ বেদনার বিলাপ দেখে সজল হযে উঠে পৃথিবীর বিরহী মানুষের চোখ। পথিক থমকে দাঁড়িয়ে শুধায়, কুমার একটু থামো, তোমার কথা খুলে বলল।
হোট কুমার কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমারতো সময় নেই। সেখানে আমার যেতে হবে, যেখানে নীলপরী পাখা। মেলে উড়ে চলে গেছে তার ছয় বোনের সাথে। কিন্তু কোথায় কত দূরে তার ঠিকানা, আমার জানা নাই।
পথিকের বুক থেকে বেড়িয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। এভাবেই ছোট কুমার এগিয়ে চলে সামনে। কোথায়, কবে, কত দূরে, তার যাত্রা শেষ হবে কে জানে?
লেখকঃ শোভা ত্রিপুরা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।