ত্রিপুরা লোককথাঃ লাংগাই রাজা

Jumjournal
Last updated Mar 23rd, 2020

926

featured image

সেই অনেকদিন আগের কথা। অতীতে পাশাপাশি অবস্থিত তিনটি রাজ্য ছিল – ত্রিপুরা, লুসাই, ও কুকী রাজ্য। ত্রিপুরা রাজ্যের ঠিক সীমান্তের রাজ্য ছিল লুসাই রাজ্য।

তার পর কুকী রাজ্য। কুকীদের অনেকেই আবার তখন বারকিহালামও বলে থাকেন। ত্রিপুরায় ছিলেন তিপ্রা রাজা। নাম কাসকু। কাসকুর রাজ্যে ছিল সর্বমোট ছয়কুড়ি ছয়টি গ্রাম।

গ্রামগুলো ছিল বর্ধিষ্ণুও হাসি-আনন্দের জোয়ারে মূখরিত। প্রতি গ্রামেই আছে ছয়কুড়ি ছয় পরিবার এবং বৃদ্ধ ও শিশু বাদে ছয়কুড়ি ছয়জন যুবক-যুবতী।

অবশ্য পাশের লুসাই রাজ্যের রাজার নাম সিকাম। কুকীরাজ্যের রাজার নাম লাংগাই। এক সময়ে লুসাই রাজ্যের প্রতি লাংগাই রাজার লোভ হয়।

সেই রাজ্য দখল করে নেওয়ার ইচ্ছা জাগে। তাই জোরজবরদস্তি দখল নেওয়ার জন্য একসময় লাংগাই রাজা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।

আর লুসাই রাজা ছিলেন শক্তির দিক দিয়ে লাংগাই রাজার তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল। কুকী রাজার আক্রমণ প্রস্তুতির সংবাদে সে বিচলিত হয়ে পড়ে।

আর তার সামরিক শক্তি যে লাংগাই শক্তির তুলনায় অনেক দুর্বল এটা তার জানা ছিল। এজন্য তিনি তুলনামূলক শক্তিশালী রাজা ত্রিপুরার কাসকু রাজার শরণাপন্ন হলেন। তিনি যুদ্ধে ত্রিপুরা রাজার সাহায্য প্রার্থনা করলেন।

এদিকে, কাসকু রাজাও কুকীর রাজার তুলনায় কম শক্তি সম্পন্ন। তার পক্ষেও একা কুকীরাজাকে পরাজিত করা সম্ভব নয়— একথা তিনি জানেন।

তবে কিছুদিন পূর্বে বিং কৗরঙ নামক এখ মহাশক্তিশালী যুদ্ধবীর ব্যক্তির সঙ্গে তার মেয়ের বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়েছে। মেয়ের জামাই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করলে যুদ্ধে জয় অবশ্যম্ভাবী, এটা তিনি ভাল করেই জানেন।

তবুও যুদ্ধের নামে অজানা আতঙ্কে তাঁর বুক কেঁপে উঠে। কারণ ইতিমধ্যে লুসাইরাজা। বিতাংকৗরঙ এর নাম শুনেছে এবং কাসকু রাজার মেয়ের সঙ্গে যে তার বিবাহ হয়েছে।

এটাই তিনি জানতে পেরেছেন। লুসাই রাজা তাই কাসকু রাজার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করার সময় বিতাং কৗরঙ এর প্রসঙ্গও উত্থাপন করতে ভুলেননি।

শ্বশুর কাসকু রাজা চান না যে বিতাং কৗরীঙ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করুক। এমনিতেই সবে মাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তাই সদ্য বিবাহিত জামাইকে শত্রু মুখে ঠেলে দিতে তার মনের সায় ছিল না।

এবার আসা যাক বিতাং কৗরাঙ প্রসঙ্গে। বিতাং কৌরাঙ শিশু বা বাল্যকালে এরকম সাহসী ছিল না। দৈবক্রমে সে সাহসী ও বীরে পরিণত হয়।

সে ছিল এক বিধবা মাতার একমাত্র সন্তান। একদিন গভীর রাত্রে এক রমণী তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিল “সামনের আমাবশ্যার রাত্রে তুমি গুমতি নদীর পাড়ে চলে যাও।

কিন্তু কাউকে সঙ্গে নেওয়া যাবে না, একাই যাবে। কাউকে আমার এই স্বপ্নের কথাও প্রকাশ করো না। সেখানে তুমি একটি বিরাট বড় বটগাছ দেখতে পাবে। সেই বটগাছের নীচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে এবং গুমতি নদীরদিকে নজর রাখবে।

তখন দেখবে গুমতির ভালে সাতটি অজগর ভেসে আসছে। সাত মাথাওয়ালা অজগর। তার সাতটি মাথায় থাকবে সাতটি ঝুটি। প্রতিটি ঝুটির উপর থাকবে একটি উজ্জ্বল প্রদীপ।

দ্বিতীয়টি আসবে এর ঠিক পেছনে পেছনে। এর থাকবে ৬টি মাথা ৬টি বুটিতেও থাকবে ৬টি উজ্জ্বল প্রদীপ। এরপর পাঁচ মাথা ও পাঁচটি খুঁটিওয়ালা তৃতীয় অজগরটিও পাঁচটি উজ্জ্বল প্রদীপ বহন করে এগিয়ে আসতে থাকবে।

চতুর্থ অজগর আসবে চারটি মাথায় চারটি উজ্জ্বল প্রদীপ বহন করে। তার মাথায়ও থাকবে চারটি ঝুটি। পঞ্চম অজগরের থাকবে তিনটি মাথা ও তিনটি ঝুটি। আর মাথায় থাকবে তিনটি উজ্জ্বল প্রদীপ। ৬ষ্ঠ অজগরটি আসবে পঞ্চমটির পর।

এর থাকবে দুইটি মাথা ও মাথায় একটি করে দুইটি ঝুঁটি। আর বহন করে আনবে দুহিট উজ্জ্বল প্রদীপ। সপ্তম অজগরটির একটিই মাথা ও মাথায় থাকবে একটি ঝুটি। উজ্জ্বল একটি প্রদীপ মাথায় বহন করে সে সর্বশেষে আসবে।

এই সাতটি অজগরের মধ্যে যেটি তোমার পছন্দ তার একটিকে তুমি ধরে রাখতে পার। সাতটির মধ্যে যে কোন একটি তোমার হাতে ধরা পড়বে; কোন আপত্তি থাকবে না।

তাহলে তুমি অশেষ গুণবান এবং বীর হবে। তোমার অবাধ্য হয় এমন কোন লোক পৃথিবীতে থাকবে না এবং তুমি যে কোন অসাধ্য কাজ সাধন করতে পারবে।” তাকে এ কথাগুলো বলেই রমণীটি হারিয়ে যায় এবং সেও ঘুম থেকে জেগে উঠে।

ঘুম থেকে জেগে উঠে বিতাং কৗরঙ চিন্তান্বিত হয় এবং ভাবতে থাকে —“এ কী স্বপ্ন দেখলাম।” তাই খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে সে মাকে বলল – “মা, মা, আমাবশ্যা কবে। মা বলল –কেন বিতাং? বিতাং বলল – এমনিতেই জিজ্ঞেস করছি।

মা বলে— বড়দাকে বলতে শুনেছি, আগামী শনিবারেই অমাবশ্যার লগ্ন। বিতাং বলল -তা-ই নাকী? মা একথা শুনে বলল -তোমার কোথাও যাবার কথা আছে নাকি বাবু? না, এমনিতেই জিজ্ঞেস করছিলাম -বিতাং বলল।

তখন থেকেই সে বহু আকাঙ্খিত সেই দিনটির জন্য প্রহর গুনতে থাকে। দেখতে দেখতে তার সেই শুভ দিনটি এলো। অমাবশ্যার আগের দিন সে আবার মাকে বলল – মা, মা, অমাবশ্যার দিনে আমি নিরামিষ খেতে ইচ্ছা করি।

সেই দিনটিতে নিরামিষ খেলে নাকি শরীর এবং মন সুস্থ থাকে। লোকের কল্যান হয়। কথা হলো-স্বপ্নে রমণীটি তাকে যে কথা বলেছিল, একে সফল করে তোলার জন্যই সে মাকে নিরামিষ ভোজনে রাজী করাতে চায়।

মা তার একথা শুনে মনে মনে খুশীই হয় এবং অমাবশ্যার দিনে শুদ্ধ পবিত্রভাবে নিরামিষ রেধে ছেলেকে আহার করায়। খেয়ে দেয়ে ছেলেটি অর্থাৎ বিতাং মাকে বলল – মা, মা, আমি পাড়ার শেষপ্রান্তে অবস্থিত একজনের বাড়ীতে অল্পক্ষণের জন্য গিয়ে আসি।

রাত বেশী হলেও তুমি আমার জন্য কিছুই চিন্তা করো না মা। বিতাংগের এ কথা শোনে মা বলল -বাছা, একে অমাবশ্যার রাত, তারপর শনিবার, এরকম দিনে বাড়ী থেকে বেরোতে নেই।

কেন তুমি আজ বেরোতে চাচ্ছ?ও মা, পাশের বাড়ীতে যেতেও কেন তুমি অমাবস্যা, শনিবার, মঙ্গলবার বলে বাঁধা দিচ্ছে। চিন্তা করো না, তোমার ছেলের কিছু হবে না— একথা বলেই হাতে একটি টাক্কাল নিয়ে সন্ধার দিকে বিতাং ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে।

যাবার সময় এটুকুই বলে যায়—মা, আমি চললাম, কেমন। মা আর কি করেন। শুধু হে নিশিকালী, তুমিই জান ।

স্বপ্নের দেখা সেই রমণীর কথা অনুসরণ করেই সে গুমতী নদীর দিকে ধীরে ধীরে হেঁটে যেতে থাকে। স্বপ্নে দেখা সেই রমণীর কথাগুলো একে একে তার মনে পড়তে থাকে। চলতে চলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হয়।

তার হাঁটার গতিও বাড়তে থাকে। সেই অন্ধকার রাতে চারিদিক নীরব নিস্তব্ধ। কারও সাড়া শব্দ নেই। অন্ধকারের মধ্যে শুধু পোকা মাকড়ে! ডাক শোনা যায়। তবুও সে সাহস নিয়ে সমানের দিকে অকুতোভয়ে এগিয়ে যেতে থাকে।

স্বপ্নে দ্রষ্টা সেই রমণীর কথাই তার বারংবার মনে পড়তে থাকে এবং তাকে মনে মনে স্মরণ করেই সে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে দুপুর রাতের কিছু আগে সে গুমতি নদীর পাড়ে গিয়ে উপস্থিত হয়।

স্বপ্নে দ্রষ্টা সেই রমনীর কথা অনুসারেই সে গোমতীর পাড়ে একখানি বৃহৎ বটগাছ দেখতে পেয়ে সেই গাছের নীচে গিয়ে আশ্রয় নিলো। সেখানে আশ্রয় নিয়েই সে অমাবশ্যার সেই বিভৎস অন্ধকারে চারিদিক্‌ নিরীক্ষণ করতে থাকে।

আশ্বিন মাসের অমাবশ্যার সেই রাতে গুমতী নদীর পাড়ে ব্যাঙের কট কট শব্দও ঝি ঝি পোকার ডাক ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর সাড়া শব্দ ছিল না। সেখানে গুমতী নদী সাস রবে বয়ে যাচ্ছিল।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই সে নদীর পাড়ে অবস্থিত সেই বটগাছটার নীচে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সমস্ত খেয়াল পর্যবেক্ষণ করে এবং স্বপ্নের কথা ভাবতে থাকে।

ভাবতে ভাবতেই সে চারিদিকে চোখ মেলে তাকায়। অন্ধকারে সে কিছু দেখতে পায় না। শুধু মাঝে মধ্যে জোনাকীর মিটমিটে ক্ষীণ আলো দেখতে পায়।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সে হাতের টাক্কালে নীচের আগাছা পরিষ্কার করে বসার জায়গা করে নেয়।

এদিকে রাত যত বাড়ে, অন্ধকারও বাড়তে থাকে। ততই নীরবতাও বাড়তে থাকে। এর মধ্যে হুতুম পেঁচাও বিকৃত কণ্ঠে ডাকতে শুরু করে। দেখতে দেখতে এভাবেই রাত দুপুরে পরিণত হয়। পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত অমাবশ্যার রাতের অন্ধকার আরও ভয়ার্তরূপ ধারণ করে।

বিতাং কৗরীঙ এর কিন্তু একটিই মাত্র লক্ষ্য যে, কখন গুমতীর বক্ষে আজগরগুলো সাঁতার কাটতে কাটতে তার পাশ দিয়ে চলে যাবে। মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে সে গুমতী নদীর বক্ষে চেয়ে থাকে এক অধীর আগ্রহে।

সেই সময় বিতাং দেখতে পেল যে, গুমতীর দুই দিকের পাড় হঠাৎ যেন আলোকিত হয়ে উঠেছে। সেই আলো যেন আকাশ-পাতাল জুড়ে তার প্রভাব বিস্তার করেছে। তখনও কিন্তু নীরবতা পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান।

তিনি দেখতে পেলেন যে, গুমতীর বক্ষে বেশ কয়েকটি বড় বড় অজগর স্বপ্নে কল্পিত যুবতী বা রমণীর কথামতো তাদের সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে দ্রুত গতিতে প্লাবিত হয়ে আসছে।

এগুলো যাচ্ছে সেই বটগাছের পাশ দিয়েই। বিতাং প্রথমে এদের যে কোন একটির উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে ভয় পায়।

কিন্তু একটির পর একটি করে ছয়টি অজগর পেরিয়ে যাবার পর সে মনটাকে আরও শক্ত করে এবং শপথ নেয় যে শেষ সপ্তম অজগরের উপর সে ঝাঁপিয়ে পড়বেই এবং যে কোন মূল্যেই সেই অজগরটিকে ধরতেই হবে।

এদিকে শেষ অজগরটি একটি মাথা ও মাথার উপর একটি ঋটি এবং একটি উজ্জ্বল প্রদীপ নিয়ে যখন বিতাং এর ঠিক বরাবরে এসে পড়ে তখন সে আর স্থির থাকতে পারে না। মরলে মরবো, তবুও ছাড়বো না – এ কথা ভেবে সে মৃত্যু ভয় তুচ্ছ।

করে গুমতী বক্ষে ধাবমান শেষ অজগরটির উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং শক্ত হাতে অজগরটিকে ধরে ফেলে। কিন্তু দেখতে দেখতেই অভাগরটি মানুষে পরিণত হয়ে যায়।

একটি সুন্দরী যুবতীতে পরিণত হয়ে তার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে। আর তার সারা শরীর সোনার অলঙ্কারে ঝকঝক করছে। সেই সুন্দরী যুবতীটির কপালে আবার সিন্দুরও শোভা পাচ্ছে।

বিতাং কৗরৗঙ অবাক বিস্ময়ে সুন্দরী যুবতীটির দিকে তাকিয়ে থাকে। একটি ভয়াবহ অজগর সাপ কিভাবে মানুষে পরিণত  হলো সে ভেবে পায় না।

যুবতীটিই শান্তভাবে মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে বিতংকে বলল – বাবু, তুমি আমাকে ধরে আমার আগের দিদিদের ধরলে ভাল হতো। তাহলে সাত রাজার ধন পাওয়া যেত। আমার কাছে তুমি কিইবা পাবে।

সোনা দানা তো দূর অস্ত, আমার কাছে যে তোমাকে দেওয়ার কিছুই নেই। আমার কাছে এই একটি মাত্র তরবারিই আছে। – এই বলে সে মুখব্যাদান করে | জিহাখানি বের করে।

জিহ্বা বের করার সময় তার মুখ থেকে একখানি উজ্জ্বল ছিপ ছিপে তলোয়ার বেরিয়ে আসে। সেই তলোয়ারখানি বিতাং এর হাতে তুলে দিয়ে সে বলল তুমি এই তলোয়ারখানি গ্রহণ করো, এটা বিসকরম বা বিশ্বকর্মার তলোয়ার।

মায়ের নাম নিয়ে এই তলোয়ারটিকে নির্দিষ্ট উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে নিক্ষেপ করলে সেদিকেই এটা যাবে। হাজার হাজার সেনাও এর গতিরোধ করতে পারবে না। এই তলোয়ারটি যতক্ষণ হাতে থাকবে ততক্ষণ। তোমার সঙ্গে কেউ পেরে উঠবে না। সর্বক্ষেত্রেই তুমি হবে জয়ী।

এই বলেই বিতাং এর হাতে তলোয়ারখানি সঁপে দিয়ে তলোয়ারখানি অতি সযত্নে রাখিও”এই কয়টি কথা বলে যুবতীটি কোথায় হারিয়ে যায়। বিতাং কৗরঙ এই তলোয়ারটি হাতে নিয়ে ভালভাবে দেখতে থাকে।

সে দেখল যে, তলোয়ারটির মুখ অতি মসৃণ এবং ধারালো। সে এটাকে কোমরে গুজে বাড়ীর পথে রওনা দেয়। বাড়ীতে পৌঁছতে পৌঁছতেই প্রথম ভোরের মোরগ ডেকে উঠে।

এভাবেই বিং করৗঙ তার স্বপ্নে পাওয়া ফসল কুড়িয়ে বাড়ীতে ফিরে আসে। তার মধ্যে গুণগত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। তখন থেকেই বিতাং কৗরঙ গুণে এবং শক্তিতে সকলের অপ্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠে।

যে কোন কাজেই কেউ তাকে পরাজিত করতে পারে না। সকলেই তার কাছে হার মানে।

অপরদিকে ত্রিপুরার কাসকুরাজার কন্যাও বড় হতে থাকে। শেষে এক তন্বী যুবতীতে পরিণত হলে তার বিয়ের প্রস্তাব উঠে। রাজকুমারীর বিয়ে বলে কথা। যেন তেন পুরুষের সঙ্গে রাজা তার মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজী নয়।

রাজ্যের শ্রেষ্ঠ ও শক্তিশালী এবং অশেষ গুণ সম্পন্ন একজন পুরুষের কাছেই তিনি মেয়েকে সমর্পন করতে ইচ্ছুক। তাই এবার কাসকু শুরু করলেন বর বাছাই পর্ব।

তিনি প্রচার করলেন যে যে পুরুষ বা বর তাঁর বাড়ীতে পালিত চৌদ্দ বছরের এক খাসি করা শূকরকে এক হাতে মেরে এবং একহাতেই পুড়িয়ে কুটি কুটি করে। মাংসগুলো কেটে দিতে পারবে তাকেই তিনি কন্যাদান করবেন।

বিতাং এই কাজটি করতে সক্ষম হয়েছিল। অন্য অনেক যুবক এ কাজে এগিয়ে এসেও তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়।

সেজন্য কাসকু রাজা খুশী হয়ে বিতাং কৗরঙ এর সঙ্গেই যুবতী কন্যার বিয়ে দেন অতি জাকজমক সহকারে।

বিয়ে দেওয়ার ঠিক কিছুদিন পরই লুসাই রাজার সাহায্যের প্রর্থনা সংবাদ কাসকু রাজার কর্ণগােচর হয়। কুকী রাজার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে শুধু সৈন্য দিয়ে সাহায্য করলেই হবে

বীর পুরুষ ও দক্ষযোদ্ধা রাজাজমাতা বিতাং কৗরভকেও পাবার অর্জি জানালেন লুসাই রাজা। লুসাই রাজদূতের মুখে এই প্রার্থনা সংবাদ শুনে কাসকুরাজা কন্যা ও জামাতাকে আনয়নের জন্য পুত্র থুতুরুকে বিতাংকৗরৗএর বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলেন।

আর গানের মাধ্যমে বলে দিলেন – হে পুত্র, গিয়ে বল তোমার মেঝদিকে এবং মেঝ জামাতাকে। এবার নবান্নের সময় তাদের আসা চাই। রাজ্যের অবস্থা বড়ই মন্দ।

একসঙ্গে বসে সম্মিলিতভাবে পানভোজন করব। তাই অন্ততঃ একদিন ও এক রাত্রির জন্য তাদের আসতে বল। আশা করি তারা আমার নিমন্ত্রণ রক্ষা করবে।

বাবা কাসকুর আদেশে ছেলে থুতুরু জামাইবাবু বিতাং এর বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। জামাই বাবুর বাড়ীতে গিয়ে সে বাবার নিমন্ত্রণ বিস্তৃতভাবে গানের মাধ্যমে ব্যক্ত করে।

বিতাংগের স্ত্রী কনিষ্ঠ ভ্রাতা থুতুরুর মুখে পিতা কাসকু রাজার নিমন্ত্রণের সামগ্রিক বৃত্তান্ত এবং কারণ জানতে পেরে চিন্তান্বিতভাবে স্বামীকে সংগীতের মাধ্যমে সুর তুলে বলতেলাগল- “হে আমার লক্ষী সোনা, প্রাণাধিক, তোমাকে আমার কিইবা বলার আছে।

তুমি তো আমার চেয়ে অনেক বেশী জান। পাহাড়ের অপেক্ষাকৃত নিম্ন ঠান্ডাভূমিতে অবার লকন গাছে অত্যধিক পরিমান ফুল ও ফলের সমাহার পরিদৃষ্ট হয়। গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত লকন গাছে ফুল ও ফল ধরেছে।

যেটা অন্যান্য বারের চেয়ে তুলনায় অনেক বেশী। জানিনা,দেশ এবং রাজ্যের মর্যাদা পরিস্থিতির জন্যই এর আগাম বার্তা হিসাবে এটা ঘটেছে কিনা।

পুর্বে ছোট বেলায় আমি যখন দাদু ও দিদিমার মাঝখানে ঘুমাতাম তখন তারা পূর্বপুরুষদের প্রবাদ উল্লেখ করে আমাকে বলেছিল যে, লঙ্কনে ফুল এবং ফল বেশী পরিমানে দেখা দিলে অর্থাৎ ফলন বেশী হলে দেশে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হয়।

দেশের অমঙ্গল ঘটে। আর সকালবেলায় উচ্চস্থান থেকে চিল ডাকলে অমঙ্গল হয় আর বিকাল বেলায় চিল ডাকলে তা.মঙ্গল সূচক ডাক হিসাবে চিহ্নিত হয়।”

স্ত্রীর এ কথায় বিতাং কৗরৗঙ সংগীতের মাধ্যমে জবাব দেয় — “ঘাটের ভাটি দিকে প্রাপ্ত ‘সৗবাম’ নামক এক ধরনের মাছ যেমন ঘাটের জল ঘোলা করে স্নানের অযোগ্য করে ফেলে, তেমনি তুমিও বেশী বাড়াবাড়ি করে সমস্ত ঘটনাকে ঘোলাটে করে ফেলছ।

তুমি ওভাবে কথা বলে সবকিছু গোলমালে ফেলোনা। তাতে অসন্তুষ্ট স্ত্রী লুসাই রাজার দেশের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা সংগীতের মাধ্যমে বিবৃত করে স্বামী বিতাংকে বলতে থাকে “লুসাই রাজার দেশে এখন অরাজকতা বিরাজ করছে। মহিলারা মুদ্রার মালা ব্যবহার করতে পারে।

হাতে ধারালো দাও রাখতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বাড়ীতে বৃহৎ শুয়র এবং বড় মোরগ রাখতে পারে না। জলের কলস পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। রাজার লুসাই এহেন অত্যাচাররে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।”

স্ত্রীর মুখে এ কথা শুনে কৗরাঙ বিতাং হাসতে হাসতে বলে –“হে আমার হৃদয় | লক্ষ্মী, তুমি এসব মি বলছ! নিজেকে আরও বেশী অলঙ্কারে সাজাও এবং নিশ্চিত মনে ভাল কাপড়-চোপড় পড়তে শুরু করে।

আমার কিছুই হবে না, এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। চলো, এবার রত্নভূষণে ভূষিত হও, উত্তম বস্ত্রাদি পরিধান করো, দুজনে মিলেই শশুর মশাইয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করি।”

বিতাং এর স্ত্রী আবার জবাব দেয় –“হে প্রাণনাথ, হৃদয়ের। আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারি ঠিকই, মিন্তু আমার মোরগ এবং শুকরগুলো কে যত্ন করবে বলে তো।

সুতরাং হে সোনা, এবার তুমি একাই গিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করে এসো।” স্ত্রীর আর কিইবা করার আছে, স্বামী যে বড়ই বেপরোয়া। তাকে বাধা দিয়ে রাখার সাধ্য কারও নেই।

তাই সে অনিচ্ছা সত্বেও ভাই থুতুরুর সঙ্গে স্বামীকে পাঠালো। তবে যাবার আগে ভাই পুতুরুকে স্বামী সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিয়ে বলতে লাগলো – “হে থুতুরু ভাই, নিমন্ত্রনের কতকগুলো নিয়ম রক্ষা করে চলল।

আমন্ত্রিতদের সকলের খাওয়া হলে তোমরা দুই-ভাই পাবে। সকলের আগে কোন সময় খেও না। আসলে জামাইবাবু তো পিতৃতুল্য। তোমার জামাইবাবুর যাতে কোন ক্ষতি না হয় তা দেখার দায়িত্ব তােমার উপর রইল।

তাকে পানীয় খেতে দিও না এবং শরীরের ক্ষতি করে এমন খাবার খেতে দিও না।” স্বামীকে উদ্দেশ্য করে আবার বলতে থাকে –“ হে প্রাণেশ্বর, শ্বশুর বাড়ীতে গিয়ে তুমি ঘরের সম্মুখ ভাগ দিয়ে প্রবেশ করে রান্নাঘরের চুলার পাশে গিয়ে বসবে। মা-বাবার সাথে কপালের ভাল-মন্দ সব কিছু খুলে বলবে এবং নিসংকোচে খোলামেলা আলোচনা করবে।”

এ কথাগুলো বলেই সে চোখের জলে বিতংকে বিদায় দেয়। এক অজানা আশঙ্কায় তার হৃদয় কাঁপতে থাকে।

থুতুরু এবং বিতাংকাসকু রাজার বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। শ্বশুর বাড়ীতে গিয়ে সে দেখল যে, একজন লুসাই রমণী গান গেয়ে বাচ্চাকে ঘুম পাড়াচ্ছে দোলনায় দোলা দিতে দিতে।

সেসম্ভবত লুসাই রাজার দেশের লোক – এটা বিতাং বুঝতে পারে। লুসাই রমণীটির গানের সারমর্ম হলো – তোমার মা গিয়েছে জুমের কাজে, বাবা গিয়েছে বাজারে। হে শিশু তুমি ঘুমাও। লাংগাই রাজার দেশে শুনেছি অলঙ্কার ব্যবহার করা যায় না, হাতে ধারালো দাও রাখা যায় না।

শূকর পালা যায় না, মোরগ পালা যায় কলসও কেড়ে নেওয়া হয়। এতো অত্যাচারী সেই লাংগাই রাজা। তার জ্বালাতনে লুসাই রাজ্যের জনগণ বড়ই বিপন্ন। এ সময়ে তুমি জ্বালাতন করিও না, চুপ-চাপ ঘুমিয়ে পড়ো।

লুসাই রমণীর মুখে এরূপ গান শুনে বিতাং কৗরঙ আর চুপ-চাপ থাকতে পারে না। লাংগাই রাজার এহেন কার্যকলাপ তার মনে ঘৃণার উদ্রেক করে।

তাই রমনীটিকে সান্ত্বনা দিয়ে সে গানের সুর তুলে বলতে লাগল — হে রমণী, তুমি লুসাই রাজাকে এ জন্য চিন্তা করতে রাবণ করে দাও। তাকে আমার কথা গিয়ে বললা।

তাকে বলল —“যদি সে আমাকে অর্ধেক রাজ্য দান করে, দুইটি হাতি থাকলে আমাকে একটি,দুইটি ঘোড়া থাকলে একটি আমাকে, এমনকি একজোড়া কবুতর থাকলেও আমাকে।

একটি, মারগ দুটির মধ্যে আমাকে একটি এবং দু’টি কুকুর থাকলেও আমাকে একটি দিতে রাজী হয় তাহলেই আমি লাংগাই রাজার বিরুদ্ধে যথো পযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে এর প্রতিকার করতে পারি। কারণ আমি বীর বিতংকৗরঙ।

কেউ যুদ্ধে আমার সমকক্ষ নয়। আমার লক্ষ্য অভেদ্য। বিফল হবার নয়। বাণ মারলে বা বন্দুক ছুঁড়লে একটি শিকার ভূপাতিত হবেই।

এখনও আমি কুকীদের বশীভূত করে আমার পাশে পাশে রাখতে পারি। অনেক বড় বড় এলাকাকেই আমি অনায়াসে আমার অধীনে নিয়ে আসতে পারি।”

এদিকে মেয়ের জামাইকে দেখে শ্বশুর কাসকু রাজার আনন্দের আর সীমা থাকে না। জামাতাকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন করা হয়। এক সময় খাওয়া-দাওয়া চলে। সঙ্গে পানীয় দেওয়া হয়। খেতে খেতে জামাই এবং শ্বশুরের মধ্যে অনেক বিষয় নিয়ে কথাবর্তা হয়।

চলে শলাপরামর্শও। গানের আসরও বসে। এমন সময় লুসাই রাজার। সৈন্য সামন্ত কাসকু রাজা এবং বিতাং এর খোঁজ করতে করতে সেখানে এসে উপস্থিত হয়।

তারা বলল –“বিতাং কৗরৗঙকে আমাদের খোঁজ করা হবে। অঢেল টাকার বিনিময়ে তারা বিতাংকে চাই। তাই বিতংকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য তারা অনুরোধ করতে থাকে।

সেই সময় কাসকু রাজা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সংগীতের মাধ্যমে জবাব দিয়ে বলে হে লুসাই রাজার সৈন্যগণ, তোমাদের পাঁচ টাকা আমার প্রয়োজন নেই। বিতাং কোথায় তা আমি জানিনা।

বিতাং কৗরঙ কি পশু না পাখী, সেগাছের ডালে ডালে বসে, না আকাশে আকাশে উড়ে বেড়ায় তাও আমার অজ্ঞাত। কাসকু রাজা জানে যে, একবারের জন্য খোঁজ পেলে লুসাই সৈন্যদের অনুরোধ বিতাং ফেলতে পারবে না। সে অহেতুক একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেই।

তাতে জামাতা জিতে আসতে পারবে এমন নিশ্চয়তা কোথায়। কুকী নামক একটি দুর্ধর্ষ ও যুদ্ধবীর জাতির বিরুদ্ধে লুসাইদের হয়ে জামাতাকে যুদ্ধে পাঠাতে তিনি মোটেই রাজী ছিলেন না।

শ্বশুর মশাইয়ের কথা শ্রবণ করে বিতাংকৗরৗঙ ঘরের অভ্যন্তরে তেকে বলতে লাগল ভোরে আপনিতেই মোরগ ডেকে উঠে, লোক দেখলে কুকুরও আপনিই ডেকে উঠে বা ঘেউ ঘেউ করে। কারও কিছুই বলতে হয় না।

তেমনিই আমিও মায়ের ছেলে সন্তান। আমিও অন্যের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারি না। হাতে যতক্ষণ ধনুর্বাণ এবং বন্দুকখানি থাকবে, ততক্ষণ একটি পাখিও আমার নজর এড়িয়ে যেতে পারে না।

একগুলিতেই সাতটি চাতক পাখী ধরাশায়ী করতে পারি। কুকীদের এখনও আমি ঘরের পিছে পিছে রাখতে পারি। তারা আমার বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য।

আমি অতি সহজেই কুকীদের পরাস্ত করে লুসাই রাজ্যের সংকট মোচন করতে পারি। তবে একটি শর্ত রইল যে, অর্ধেক রাজ্য আমাকে দিতে হবে।

এমনকি পশু-পক্ষী যা আছে সবগুলোই দুইভাগে ভাগ করে আমাকে একভাগ  বিতাং এর শর্ত ও প্রস্তাব সমূহ নিয়ে চলে যায় লুসাই রাজার নিকট অবহিত করার জন্য।

এদিকে বিতাং কৗরঙ এর স্ত্রী জানতে পারে যে, তার স্বামী অহঙ্কার পূর্ণ কথাবার্তা বলে বেড়াচ্ছে। সেজন্য তার চিন্তার শেষ নেই। বিতাং বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করলে সে অভিমান করে বলল – হে আমার সোনা, হৃদয়েশ্বর। তুমি আমার কথা রাখ নাই।

তোমাকে মদ্যপান করতে বারণ করেছিলাম, বাধা দিয়েছিলাম অখাদ্য কুখাদ্য গ্রহণ না করতে। কারও সঙ্গে অহঙ্কারপূর্ণ কথা বলতে নেই, অহঙ্কার প্রকাশ করতে নেই ও আমি পূর্বেই তোমাকে বলেছিলাম দিতে হবে।

লুসাই রাজ্যের সেনারাএবং সাবধানও করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি অহঙ্কার বশে আমার কথা অমান্য করেছ।

অন্যদিকে কাসকু রজার কাছে লুসাই রাজা দূতের পর দূত পাঠাতে থাকে বিতাংকৗরৗগের সাহায্য প্রার্থনা করে। এমন কোন দিন যায় না যেদিন লুসাই রাজার লোক তার দরবারে আসে না।

তাই কাসকু রাজা অসহ্য হয়ে থুতুরুর কাছে বিতাং কৗরৗঙকে আনয়নের দায়িত্ব অর্পণ করে এবং বলে পাঠায় যে যে কোন প্রকারেই হোক জামাতাকে নিয়ে আসা চাই।

বাবর আদেশে থুতুরু বিতাংগের বাড়ীতে গিয়ে সুর তুলে বলতে লাগল – হে জামাইবাবু, তুমি আমার বাবার তুল্য। বৃদ্ধ বাবা কাসকু রাজা আমাকে বলেছে নিম্নোক্ত কথাগুলো তোমাকে বলার জন্য।

মুরগীও অনেক সময় প্রতিদিন ডিম পাড়ে না, কিন্তু লুসাই রাজার দূত প্রতিদিন আসছে। একটি দিনও বাদ যায় না। তাদের জন্য বনের আলু ফুরিয়ে গেছে, বনের কলাগাছ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে

 লুসাই রাজার সৈন্যদের প্রতিদিন বেঁধে বেড়ে খাওয়াতে হচ্ছে। সেজন্য বনের আলু এবং কলাগাছেরও আকাল পড়েছে।

 থুতুরুর সুখে এসব কথা শুনে বিতাং তার স্ত্রীর সঙ্গে শলাপরামর্শ করল। সে ঠিক করলো যে, পরের দিন ভোরের মোরগ ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই সে তার শ্বশুর মশাই কাসকু রাজার সঙ্গে দেখা করতে যাবে এবং লুসাই রাজার হয়ে কুকীররাজার বিরুদ্ধে ও যুদ্ধ করবে এটাও সে মনে মনে স্থির করে ফেলে।

 কিন্তু এদিকে তার স্ত্রীর মন শান্তিতে নেই। সময় যত যেতে থাকে ততই তার মনে চিন্তার ছায়া ঘনীভূত হয়ে আসে। স্বামীকে বিদায় দিতে সে কুণ্ঠা বোধ করে।

স্বামী বিহনে থাকতে তার মন ছটফটিয়ে উঠে। স্বামীকে বাদ দিয়ে একা থাকার কথা সে ভাবতেই পারে না। সে ভাবতে থাকে যদি ভোরের মোরগ না ডাকে তাহলে তার স্বামীর যাওয়াও বন্ধ হবে। হয়তো আরও কিছুক্ষণ স্বামী সঙ্গ পেতে পারে।

এই সব কল্পনা করেই সে মোরগের উদ্দেশ্যে এই বলে গান গাইতে থাকে –হে আমার কালো মোরগ, সুন্দর মোরগ, আজ ভোরে তুমি ডেকো না। মোরগ গো, তুমি আমার কথা শোননা। আমার কথা রাখলে সোনার বাটিতে তোমাকে জল দেব।

রূপার বাটিতে ভাত দেব। পা-দুটি রুপা দিয়ে মুড়িয়ে দেব। ঠোটখানি সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দেব। কালো মোরগ গো, তুমি আমার কথা রাখো।

 বিতাং কৗরীও স্ত্রীর মুখে একথা শশানে মোরগটিকে ধমক দিয়ে বলল – হে কালা মোরগ, আমি বলছি আগামীকাল খুব ভোরে তোমাকে ডাকতেই হবে। আমার কথামতো না চললে তোমার নাড়ীভুড়িবের করে ফেলব। মাংসখানি সকলকে ডেকে খেতে দেব।

সুতরাং সাবধান, কাল সকালে অবশ্যই ডাকবে। নিজের সর্বনাশ ডেকে এনো না। বিতাং এর ধমক খেয়ে মোরগটি ভয় পেয়ে যায়। তাই ভোরের নির্ধারিত সময়েই মোরগিটি ডেকে উঠে। তার কথা অমান্য করার ক্ষমতা এবং সাহসও মোরগটি হারিয়ে ফেলে।

সুতরাং মোরগ ডাকার সাথে সাথেই বিতাং কৗরৗঙ স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শ্বশুর বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিতে উদ্যত হল, এমন সময় তার স্ত্রী বলতে লাগল – হে আমার সোনা, যাবার আগে আমার একটি কথা শুনে যাও।

পথে ক্ষুধা লাগবে, তার জন্য ঘ্রাণযুক্ত ভাত, ব্যঞ্জণ (তরকারী) সঙ্গে নাও। মাখার জন্য ঘ্রাণযুক্ত তৈল এবং কানে গোঁজার জন্য ঘ্রাণযুক্ত ফুল নিয়ে নাও।

এমনকি বার বৎসর পেরিয়ে তের বৎসর হলেও ঘ্রাণযুক্ত ভাত-তরকারী নষ্ট হবে না। এমন তার গুণ। ঘ্রাণযুক্ত তৈলও কখনাে শুকাবে না, ঘ্রাণ যুক্ত ফুলও নষ্ট হবে না।

তারপর ঘ্রাণযুক্ত ভাত, তরকারী, মাথার চুলে মাখার জন্য তৈল এবং কানে গোজার ফুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে স্ত্রী তার স্বামী বিতাং এর উদ্দেশ্যে আরো বলল – হে সোনা, আমার প্রাণেশ্বর, কুকীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবার সময় বিরাট উঁচু টিলায় উঠে পড়বে।

সেখানে উঠতে হাতির ডাক শুনতে পাবে। হাতির ডাক শোনার পর চলতে চলতে কর্মকারের বাড়ী দেখতে পাবে।

কর্মকারের বাড়ীর পর কুম্ভকারের বাড়ী দেখতে পাবে। এর পর চলতে চলতে হাড়ি-মালী ইত্যাদি ঘরদোর দেখতে পাবে।

এ সমস্ত পরামর্শের পর স্ত্রী তার স্বামী বিতাংকে অনিচ্ছা সত্বেও চোখের জলে বিদায় দেয়। বিতাং বীরের মতো কঠিন পৌর; নিয়ে শ্বশুর বাড়ীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।

বিতাংকৗরঙ তার শ্বশুর বাড়ীতে গিয়ে হাজির হলে উভয়ের মধ্যে কুকীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অভিযানের কৌশল নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়। কাসকু রাজা তার সৈন্যদের সর্বতোভাবে প্রস্তুত করে তোলে। চারিদিকে সাজ সাজ রব পড়ে যায়।

বিং কাসকুর সৈন্যদের সঙ্গে শেষবারের মতো খাওয়া দাওয়া করে। লাংগাই রাজার রাজ্যে যুদ্ধ যাত্রার প্রারম্ভে রাজ্যের জনগণের সম্মুখে বিতাং শপথ নিয়ে বলল জুমের কাউন (মাইসৗয়) গাছগুলো কেটে যেমন মাইসৗয় ফসল সংগ্রহ করে আমিও তেমনি বার হলাম অর্থাৎ কুকীদের পরাজিত করে তের হালামকে আমার করায়ত্ব করবোই। শেষে বিজয় পতাকা উড়িয়ে আমি আবার রাজ্যে ফিরে আসব।

তখন শ্বশুরকাসকু রাজা বলল-বারহালামকে পরাজিত করে তেরহালামকে বশে এনে তুমি যথাশীঘ্র ফিরে এস। কারণ তাতে খাওয়া পড়ার অভাব হতে পারে। তাই হেজামাতা, আমি আশীর্বাদ করি যুদ্ধে জয়লাভ করে তুমি যথাশীঘ্র ফিরে আসবে।

পরিশেষে সবাইকে প্রণাম জানিয়ে বিতাং কৗরঙ শ্যালক থুতুরুকে সাথে নিয়ে লাংগাই রাজার দেশ অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে তারা লাংগাই রাজার রাজ্যের সীমান্তে গিয়ে হাজির হয়।

তখন লাংগাই রাজার রাজধানী ছিল একখানি সুউচ্চ টীলার উপর। বিরাট বড় পাহাড়ের সবচেয়ে উচ্চ শৃঙ্গে তিনি রাজধানী স্থাপন করেছিলেন নিরাপত্বার স্বার্থেই।

রাজধানীর চারিদিকে উচ্চ খাড়া পাহাড়, আর এই রাজধানীতে যাবার একটি মাত্র সরু রাস্তা। আবার এই সরু পথ দিয়ে একজনের বেশী লোক যাওয়া যায় না। এই সরু পথ দেখে বিতাংকৗরৗঙ অবাক হল।

সে এই পথ ধরেই তার সৈন্যদের একজন একজন করে উপরে উঠতে আদেশ দেয়। কিন্তু পথটি এত খাড়া যে দুই পা এগোলে একপা পিছিয়ে আসতে হয়। এভাবে হাঁটতে থাকে তারা। ফলে একদিনের পথ সাতদিনে হেঁটেও তারা শেষ করতে পারে না।

সেজন্য তাদের জমা রসদও ফুরিয়ে আসতে থাকে। এ অবস্থায় আরও রসদ আনার প্রয়োজন দেখা দেয়। বিতাংকৗরীঙ আবার শ্যালক থুতুরুকে পাঠালোতার স্ত্রীর কাছে। গানের মাধ্যমে তাকে বললো সমস্ত কথা।

বললো- হে আমার থুতুরু ভাই। ঘ্রাণ যুক্ত খাবার, পানীয়, তৈল, ফুল,সবই। ফুরিয়ে গেছে। বনের আলু, কাঁকড়া মাদও আর পাওয়া যায় না। লাংগাই রাজার রাজধানী এক উঁচু টীলায় অবস্থিত, দুই পা এগোই আবার এক পা পিছুতে হয়।

এ অবস্থায় খাদ্য না পাঠালে পথের মাঝে না খেয়ে মরতে হবে। যুদ্ধের সাধ আর মিটবে না। তাই তোমার দিদিকে অতিশীঘ্র খাদ্য, পানীয়, তৈল, ফুল ইত্যাদি যথাশীঘ্র পাঠাতে বলল।

খুতুরু আর কি করে। জামাইবাবুর পাঠানো বার্তা নিয়ে সে গেল তার বড় বোনের কাছে। বড় বোনকে বিতাং কৗরৗঙগের সংবাদ দিয়ে খাদ্য পানীয়, তৈল, ফুল ইত্যাদি পাঠাতে বললো।

| এ কথা শোনে বিতাং – এর স্ত্রী গানের মাধ্যমে বলতে থাকে “হে আমার লক্ষী ভাই, আমার এই কথাগুলো তোমার জামাইবাবুকে অবশ্যই জানাবে। বিকেলের দিকে কালীপূজা এবং সকাল বেলায় লা দেবতার পূজা দিতে বলিও।”

এই বলেই সে ঘ্রাণযুক্ত খাবার ভাত, তরকারী এবং পানীয়, তৈল, ফুল ইত্যাদি থুতুরুর হাতে তুলে দেয় এবং বলতে থাকে বার হালামকে পরাস্ত করে, তের হালামকে বশে এনে সে যেন অতিশীঘ্র দেশে ফিরে আসে।

থুতুরু উক্ত সামগ্রীগুলাে নিয়ে বিতাং কৗরঙ এর কাছে ফিরে যায়। ফিরে গিয়ে সে তার জামাই বাবুকে দিদির সমস্ত কথা খুলে বলে।

স্ত্রীর পরামর্শের কথা শ্যলক থুতুরুর মুখে অবগত হয়ে বিতাং কৗরঙ কালী এবং লাম্মা দেবতার পূজা দেয়। এই দুই দেবতার পূজার পরই বিতাং এবং তার সৈন্যদল লাংগাই রাজার রাজধানীতে অতিসহজেই উঠে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।

একে একে তারা খাড়া টীলা অতিক্রম করে। লাংগাই রাজার রাজধানীর অদূরে পৌছেই। বিতাং রাজার কাছে দূত পাঠায়। দূতের মাধ্যমে সে বলে পাঠাল- হে লাংগাই রাজা, দেশ রক্ষা করতে হলে অবশ্যই আমার বশ্যতা মানতে হবে।

তাহলেই বিনা যুদ্ধে আমি তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি। দূতের মুখে একথা শুনে লাংগাই বলে পাঠাল দেশ রক্ষার জন্য যে কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে আমি রাজী।তবুআমি তোমার বশ্যতা বিনাযুদ্ধে মেনে নেব না।

লাংগাই এর একথা শুনে তার কুমারী কন্যা তাকে বলল বাবা, বিতাংকৗরৗঙ মস্ত বড় একজন বীর। তার সাথে পেরে ওঠা কোন মতেই সম্ভব নয়। তা ইতিপূর্বেই আমি তোমাকে বলেছিলাম। তার সঙ্গে শত্রুতা করে লাভ নেই।

বাবা, তার বশ্যতা মেনে নাও। তাতে একূল সেকূল দুই কুলই রক্ষা হবে। লাংগাই তার মেয়ের কথা কানে তুলেনি। তিনি মেয়ের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেই বিরাট কুকী সেনা নিয়ে বিতাং এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যুদ্ধে লাংগাই এর সৈন্যরা হেরে যান। বিতাং অতি সহজেই জয়লাভ করে।

লাংগাইকে যুদ্ধে হারিয়ে তার কন্যাকে বিতাং বলল- হে রাজকুমারী, দেশ রক্ষা পেতে হলে তোমাকে একটি কাজ করতে হবে।

এক্ষুণিই যুদ্ধে নিহত তোমার মাবাবার মাথা কেটে চুলা তৈরী করে কুমার নির্মিত ছোট পাতিল দিয়ে রান্না বান্না করে আমার সৈন্যদের খাবার দিতে হবে।

রাজকুমারীর বাঁচার বিকল্প কোন পথ ছিল না। সে তাতেই রাজী হয়ে যায় এবং সাথে সাথে মা-বাবার মাথা কেটে চুলা তৈরী করে রান্না বসিয়ে দেয়। রান্নার পর কুমার নির্মিত ছোট ছোট পাতিলে করে বিতাং এর সৈন্যদের খেতে দেওয়া হয়।

এদিকে যুদ্ধে পরিশ্রান্ত বিতাং আরও কিছুদিনের জন্য কুকী রাজ্যে বিশ্রাম নিতে চাইল। তাই শ্যলক থুতুরুকে স্ত্রীর নিকট পাঠিয়ে দিল। যাবার সময় বলল – কুকী দেশে খাদ্য এবং পানীয়ের অভাববশতঃ আমার শরীর নিতান্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে।

তাই কুকী রাজার কন্যাকে বিয়ে করে কিছুদিন এখানে থাকতে হচ্ছে। তুমি তোমার দিদির নিকট এ সমস্ত কথা খুলে বলল।

তুমি দিদির কাছে থেকে ঘ্রাণযুক্ত খাবার দাবার, পানীয়, তৈল এবং কানে গোঁজার ফুল নিয়ে এস। আমি যে ভাত-কাপড়ের অভাবে আছি একথা দিদিকে বলতে ভুলো না।

 বিতাং এর আদেশে থুতুরু তার দিদিকে গিয়ে বলল – হে দিদি, জামাইবাবু বড়ই অভাবে দিন কাটাচ্ছেন তার জন্য উপযুক্ত খাদ্য-পানীয় তৈল, ফুল ইত্যাদি দিতে বলেছেন। তাছাড়া তিনি লাংগাই রাজার যুবতী কন্যা রাজকুমারীকে বিয়ে করেছেন।

সুতরাং দেশে ফিরতে তার আরও কিছুদিন সময় নেবে। একথা শুনে স্ত্রী একেবারে আকাশ থেকে পড়ল। সেও থুতুরুকে বিতাং এর উদ্দেশ্যে বলে পাঠাল – হে স্নেহের ভাই থুতুরু, তুমি তোমার জামাইবাবুকে গিয়ে বলল যে বড়ই অভাবে পড়আমি বাজারের সাধারণ একজন হাতকাটা মুদিকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি। স

ুতরাং তাকে উপযুক্ত খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র, ইত্যাদি সামগ্রী পাঠানোর ক্ষমতা আমি হারিয়ে ফেলেছি। আমার তো এগুলো নিঃশেষ হয়ে গেছে। দেওয়ার মতো আর কিছুই নেই।

এখন একমাত্র লাংগাই রাজার কন্যাই তার এ অভাব পূরণ করতে পারে। সুতরাং লাংগাই রাজার কন্যার কাছেই তাকে উপযুক্ত খাদ্য পানীয় ইত্যাদি চাইতে বলল।

এদিকে বেচারা থুতুরু আর কি করে! সে দিদির সমস্ত কথা জামাইবাবুকে গিয়ে বলল। একথা শুনে বিতাং ভাবল যে, তার স্ত্রী নিশ্চয় তার প্রতি বিরাগ হয়েছেন এবং মনে কষ্ট পাচ্ছেন।

একথা ভেবেই সে সসৈন্যে আবার দেশে ফিরে যান। এবংস্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তার কাছে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।

তথ্যসূত্র: ত্রিপুরার আদিবাসী লোককথা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা