ত্রিপুরা লোককথাঃ চিংড়ির সাজা
895
দুটি পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে একটি খরস্রোতা পাহাড়ী ছড়া। তীরের দু’পাশে পাথর- কুঁড়ির ছড়াছড়ি। শুধু তাই-ই নয়, যেন পাথরের উপর দিয়ে বয়ে।
চলেছে আয়নার মত স্বচ্ছ এই ঝরনার জল। একটি প্রশস্ত পাথরের উপর বসে একটি লোক দা (কাক) শান দিচ্ছে। হঠাৎ একটি চিংড়ি লাফ দিল এবং লোকটির পাছায় কমড়ে দিল।
এতে লাকটি ভয় পেয়ে যায়। ভয়ে ও রাগে দিশেহারার মতো হয়ে সে সামনের আধকাটা একটি বাঁশ এককোপে কেটে ফলল।
সে বাঁশের কোটরে ছিল একটি ছোট বাদুর। বাদুরও ভয় পেয়ে উড়ে গিয়ে প্রবেশ করল ধনেশ পাখির নাকে।
ধনেশ পাখির হাঁচি উঠল – “হ্যাঙ্গো” হাঁচির বিকট শব্দে আম গাছের ডালে বসে থাকা বানরের হাত থেকে খসে পড়ল একটি পাকা আম।
গাছের নীচে বিশ্রাম করছিল একটি গর্ভিনী হরিণী। আমটি হরিণীর উপর পড়ায়, হরিণীটি ভীত হয়ে দিল এক ছুট।
ঝোপের আড়ালে একটি মুরগী ডিমে তা দিচ্ছিল।
হরিণীর বেপরোয়া ছোটাছুটিতে ভয় পেয়ে মুরগীটি বাঁশ বনে গিয়ে লুকোল। পরে ঝোপে এসে দেখে ডিমগুলেঅ উধাও। উভ্রান্ত হয়ে ডিম খুঁজতে লাগল।
তার দুপায়ের নখের আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন লাল পিপড়ের পাল। একটি লাল পিপড়ে গিয়ে পড়ল ভর দুপুরে আরাম আয়েসে শুয়েথাকা বন শূয়রের গায়ে।
রাগান্বিত পিপড়েটি কামড়ে দিল শুয়রকে।
শয়রও বিভ্রান্ত হয়ে এক কৃষকের কচু ক্ষেতে গিয়ে সমস্ত কিছু ওলট-পালট করে দিল। কৃষক ক্ষুদ্ধ হল।
সে রাজার নিকট বন শূয়রের বিরুদ্ধে নালিশ করে সুবিচার চাইল। রাজা কৃষকের নালিশ পেয়ে বিচার ডাকালেন।
সৈন্য-সামন্ত পাঠালেন শুয়রকে ধরে আনতে তিনি ঘোষণা করলেন অপরাধীকে পাগলা হাতীর পায়ে পীষ্ট করে মেরে ফেলা হবে।
বিচার সভায় শুয়রকে আনা হল। কৃষকের শস্য ক্ষতি করার কৈফিয়ৎতলব করলেন রাজা মশায়। হাত জোর করে শূয়র জানাল যে, ইচ্ছাকরে সে এই অনিষ্ট কাজ করেনি।
হঠাৎ ভরদুপুরে লাল পিপড়ের কামড়ে সে দৌড়ে পালায় এবং সামনে যা পেয়েছে তার উপরই অনিচ্ছাকৃত ক্ষতি করে ফেলেছে।
এতে তার রাগ ও ক্ষোভ কিছুটা কমেছে। রাজা লাল পিপড়েকে ধরে আনার জন্য নির্দেশ দিলেন।
লাল পিপড়ে এসে জানায় যে, মুরগীর এলোপাথারী নখের আঁচড়ে সে দলছুট হয়ে পড়ে এবং শূকরের গায়ে এসে পড়ে। শুয়রকে কামড়ে দিয়ে সে আশ মেটায়।
রাজা মুরগীটিকে ডেকে পাঠালেন। মুরগীটি এসে জানাল যে, সে ঝোপের আড়ালে বসে সে ডিমে তা দিচ্ছিল।
এমন সময় এক হরিণী কোথা থেকে ঝড়ের বেগে এসে পড়ে ও সমস্ত ডিম নষ্ট করে দেয়। ডিম হারানোর দুঃখে এবং দু-একটি ডিম।
কোথায়ও লুকিয়ে আছে কিনা এই আশায় খুঁজতে গিয়ে এই বিপত্তি ঘটেছে। এতে তার কোন দোষ নেই।।
রাজা দেখলেন ঘটনাগুলোর পেছনে একটি না একটা কারণ জড়িয়ে পড়েছে। এর প্রকৃত উৎস স্থল কোথায় জানার আগ্রহ যেমন।
তিনি হরিণীকে সঙ্গে সঙ্গে ডেকে পাঠালেন। হরিণীর জবাবে রাজা জানলেন যে, সে একটি আম গাছের নীচে শুয়েছিল।
আম গাছের ডালে ছিল একটি বানর। বানর তার উপর একটি আম ছুঁড়ে দেয়। এতে সে ভীত হয়ে দৌড়ানোর সময় এই অঘটন ঘটেছে।
রাজার ফুমে বানর এসে জানাল যে, সে ইচ্ছে করে আম ছুঁড়েনি। আম খাওয়ার জন্য সে একটি পাকা আম পেড়েছিল।
হঠাৎ ধনেশ পাখির হাঁচির আওয়াজে সে ভয় পেয়ে যায় এবং হাতের পাকা আম ফসকে নীচে পড়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত নীচে হরিণী শুয়েছিল।
রাজার কুমক্রমে ধনেশ জানাল যে, ছোট বাদুর তার নাকে প্রবেশ করায় তারাঁচি উঠেছিল। বাদুর জানাল, যে, সে বাঁশের কোটরে শুয়েছিল।
লোকটির অকস্মাৎ দায়ের কোপে বাঁশটি কাটা পড়ায় সে বিভ্রান্ত হয়ে চোখ বুঝে উড়েছিল।
ধনেশ পাখির নাকের ছিদ্রকে গাছের কোটর মনে করে সে প্রবেশ করে।
লোকটির পাছায় চিংড়ি কামড়ে লোকটি সাময়িক ভীত হয়ে বাঁশটি কেটে ফেলেছিল বলে রাজা জানলেন এবং বুঝলেন আসল দোষী চিংড়িই।
রাজা চিংড়িকে জিজ্ঞেস করলেন চিংড়ি কেন লোকটির পাছায় কামড়েছিল।
চিংড়ি তার উত্তরে জানাল যে, লোকটি যখন পাথরে বসে দা (টাল) সান দিচ্ছিল ,তখন শীৎ-শাৎ শব্দ শুনতে ভাল লেগেছিল।
শব্দটি তার কানে যেন সুরেলা কোন যন্ত্রসঙ্গীত মনে হচ্ছিল।
তাই সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচছিল। ওই সময় তার নখ লোকটির পাছায় গিয়ে লাগে।
রাজা দেখলেন ঘটনাগুলো ঘটেছে সত্য। কিন্তু তার কারণগুলো এমনই যে কাউকে দোষী সাব্যস্থ করা যাচ্ছেনা।
এদিকে আগেই ঘোষণা করা হয়েছে যে দোষীকে পাগলা হাতীর পায়ের নীচে ফেলে মারা হবে।
রাজা বলে কথা, তার ঘোষণাকে কার্যকরী করতেই হবে। আবার এর জন্য কাউকে না কাউকে দোষী সাব্যস্থ তো করতেই হবে।
রাজা অনেক ভেবে চিন্তে চিংড়িকেই দোষী সাব্যস্থ করলেন এই বলে যে,আনন্দ উপভোগ করার অধিকার সকলেরই রয়েছে।
কিন্তু আনন্দের মাত্রা লঙ্ঘিত হয়ে যেন প্রতিবেশীর কোনরূপ ক্ষতি না হয় সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। তবে রাজা দন্ডটা কিছুটা লঘু করেছেন।
চিংড়িকে জানে মারা হবে না, শুধু পেটে হাতির এখটি পা চাপ দেবে।
দন্ডাজ্ঞার ফল স্বরূপ হাতির পায়ের চাপে চিংড়ির পেটের সমস্ত বিষ্ঠা তার মাথায় গিয়ে জমা হয়।
তখন থেকেই চিংড়ির মাথায় বিষ্ঠা হয়। এটাই তার অন্যধিক আনন্দের পরিণতি।
তথ্যসূত্র: ত্রিপুরার আদিবাসী লোককথা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।