ত্রিপুরা লোককাহিনীঃ দুই বালিকা
722
ত্রিপুরার এক গ্রামে একটি জুমিয়া পরিবার বাস করত। ঐ জুমিয়ার তিন ছেলে-মেয়ে।
তার এক মেয়ের নাম ছিপিঙতুই। সে বড় বউয়ের মেয়ে। ছোট বউয়ের ঘরে এক মেয়ে এক ছেলে। ছেলের নাম অগুরায় আর মেয়ের নাম মইরুঙতুই।
জুমিয়া ছিল বেশ অবস্থাপন্ন গৃহস্ত।বড় বউ ছিপিঙতুইকে রেখে মারা গেল।
তারপর থেকে ছিপিংতুইকে লালনপালন করে তার সৎ মা। ছিপিঙতুইয়ের গায়ের রঙ একটু চাপা। কিন্তু সে দেখতে খুবই সুশ্রী।
সে তাঁত বোনায় বেশ দক্ষ, আর গৃহকাজেও পটু। বোন মইরুঙতুই সব সময় ছিপিঙতুইকে হিংসা করত। সে সব সময় সবচেয়ে ভালো কাপড়চোপড় পরত।
আর ছিপিঙতুইকে দেওয়া হতো পুরানো ও ছেড়া কাপড়চোপড়। এরকম বিরূপ আচরণ সত্তেও ছিপিঙতুইয়ের কোনো অভিযোগ ছিল না।
একদিন দুই বোন গেল জুমখেতে কাজ করতে। তারা জমিতে কাজ করছিল। তঠাৎ তারা ধারেকাছের গাছ থেকে একটি পাখির আওয়াজ শুনতে পেল।
পাখিটি বলছে পুরানো ছেড়া কাপড় পরা মেয়েটি রাজরানি হবে। এ কথা শুনে মইরুঙতুই তার বোনের কাপড়ের সঙ্গে নিজের কাপড় বদলে নিল।
সে ছিপিঙতুইয়ের পুরানো কাপড়গুলো নিয়ে পরে ফেলল। কিছুক্ষণ পর পাখিটি আবার এলো। এবার সে বলল, যে মেয়েটি নতুন কাপড়চোপড় পরেছে সে হবে রাজরানি।
এ কথা শুনে মইরুঙতুই খুব রেগে গেল। সে রাগে পাখিটিকে তাড়িয়ে দিল। আর বোনকেও অনেক তিরস্কার করল।
কিছুদিন পর দুই বোন আবার জুমখেতে কাজ করতে গেল। তারা যখন কাজ করছিল তখন জুমখেতের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল কিছু রাজসৈন্য।
অনেক দূর থেকে হেঁটে আসার কারণে তারা খুব তৃষ্ণার্ত ছিল। তারা মইরুঙতুইয়ের কাছে পানি চাইল। মইরুঙতুই তাদের পানি দিতে অপারগতার কথা জানাল।
সে বলল, আমার কাছে কোনো পানি নেই। এরপর রাজসৈন্যরা তাদের একটু পানি দেওয়ার জন্য ছিপিঙতুইকে অনুরোধ করল।
ছিপিঙতুইয়ের কাছেও সারাদিন চলবে এমন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ছিল না। তা সত্ত্বেও সে রাজসৈন্যদের একটু পানি দিল। এই পানি পান করে রাজসৈন্যরা খুব খুশি হল।
আর তাকে প্রাণভরে ধন্যবাদ জানাল।
রাজসৈন্যরা রাজধানীতে ফিরে গেল। তারা ছিপিঙতুইয়ের অনেক প্রশংসা করল।
রাজপ্রাসাদের সকলের কাছে ছিপিঙতুইয়ের অনেক গল্প করল। রাজাও তার গল্প শুনলেন। রাজা এমন একটি মেয়েকে খুঁজছিলেন যে রাজরানি হতে পারে।
রাজসৈন্যদের থেকে ছিপিঙতুইয়ের অনেক প্রশংসা শুনে রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি ছিপিঙতুইকে দেখতে যাবেন। রাজা রাজসৈন্যদের নিয়ে ছিপিঙতুইয়ের গ্রামে গেলেন।
রাজসৈন্যরা রাজাকে জুমখেতে নিয়ে গেল। যেখানে দুই বোন কাজ করছিল। রাজসৈন্যরা রাজাকে দূর থেকে ছিপিঙতুইকে চিনিয়ে দিল।
ছিপিঙতুইয়ের মিষ্টি চেহারা আর ভালো ব্যবহার রাজার খুবই ভালো লাগল। রাজা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। রাজা তাকে রাজরানি করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
রাজা ছিপিঙতুইয়ের কাছে গেলেন। তাকে বললেন, ছিপিঙতুইকে রাজা রাজরানি বানাতে চান। রাজসৈন্য ও রাজাকে দেখে মইরুঙতুই মাঠ থেকে দৌড়ে পালাল।
ছিপিঙতুই রাজাকে কিছুই বলল না। রাজা ছিপিঙতুইকে তার সঙ্গে রাজপ্রাসাদে যেতে বললেন। সে রাজাকে অনুসরণ করে রাজপ্রাসাদে চলে গেল।
রাজা তাকে বিয়ে করলেন। ছিপিঙতুই রাজরানি হয়ে গেল।
মইরুঙতুই মাঠ থেকে দৌড়ে বাড়ি গেল। সে তার মাকে বলল, রাজা ও রাজসৈন্যরা ছিপিঙতুইকে নিয়ে গেছেন।
রাজা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ছিপিঙতুইকে তিনি রাজরানি করবেন।
মইরুঙতুইয়ের মা একথা শুনে খুব দুঃখ পেল। তার মেয়ে রানি হতে পারল না এই কথা ভেবে সে হিংসায় জ্বলে উঠল।
আর ভাবতে লাগল, মেয়েকে রাজরানি করার জন্য অন্য পথ খুঁজতে হবে।
কয়েক বছর পর ছিপিঙতুইয়ের একটি ছেলে হল।
ছিপিঙতুই রাজকুমার আর রাজাকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে সুখে-শান্তিতে দিন যাপন করতে লাগল। ছিপিঙতুইয়ের সুখের সংসার দেখে সত্যয়ের হিংসা হল।
রানি হওয়ার পর ছিপিঙতুই একবারও বাবার বাড়ি যায়নি। ছিপিঙতুই যেন গ্রামে বাবার বাড়ি এসে বেড়িয়ে যায় সেই অনুরোধ জানিয়ে সত্য রাজপ্রাসাদে খবর পাঠাল।
সত্য মানুষ ভালো নয়, তা রাজা জানতেন। তাই রাজা ছিপিঙতুইকে গ্রামে যেতে দিতে চাননি। একদিন সত্য ছিপিঙতইয়ে খবর পাঠাল যে, তার বাবা খুবই অসুস্থ, সে ছিপিঙতুইকে শেষবারের দেখতে চায়।
এই খবর শুনে রাজা ছিপিঙতুইকে বাবার সঙ্গে দেখা জন্য বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিলেন। তিনি বলে দিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসতে।
বাড়ি পৌঁছে ছিপিঙতুই শুনল তার বাবা মারা গেছে। বাবার শোক সে অনেক কাঁদল।
তারপর প্রাসাদে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তার সৎমা ও বোন তাকে আরও কয়েকটা দিন গ্রামের বাড়িতে থেকে যেতে অনুরোধ করল।
তাদের অনুরোধে ছিপিঙতুই আরো কয়েকটা দিন বাবার বাড়ি থাকতে রাজি হল। সে তার সঙ্গে আসা রাজসৈন্য ও ভৃত্যদের ফিরে যেতে বলল।
আর কয়েক দিন পরে তাকে নিতে আসতে বলল।
বিকেলে ছিপিঙতুই ও মইরুঙতুই দু’জনে গল্প করছিল। মইরুঙতই বলল, আমি অনেক দিন হয় তোমার চুল আঁচড়ে দিই না। চল আজ তোমার চুল আঁচড়ে দিই।
ছিপিঙতুইয়ের তখন চুল আঁচড়ে নেওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না।
কিন্তু মইরুঙতুই এক রকম জোর করে তার চুল আঁচড়াতে শুরু করল। চুল আঁচড়ানোর সময় ছিপিঙতুইয়ের খোপা থেকে একটা ফুল পড়ে গেল মাটিতে।
এতে ছিপিঙতুই খুব দুঃখ পেল। সে তার বোনকে বলল, এই ফুল আমাকে রাজা দিয়েছেন।
এটা আমার জন্য খুব দরকারি। তুমি দয়া করে ফুলটা তুলে দাও।
ছিপিঙতুই গ্রামে আসার সময় রাজা তাকে এই ফুল দিয়ে বলেছিলেন, এই ফুল যতদিন তোমার কাছে থাকবে ততদিন কোনো বিপদ তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।
মইরুঙতুই শত অনুরোধ সত্ত্বেও ফুলটি তুলে দিল । বরং ফুল তুলে দেওয়ার জন্য অনেক অজুহাত দেখাল।
অগত্যা ছিপিঙতুই নিজেই মাচাঘরের নিচে গেল ফুল তুলতে। সে যেই নিচে গেল অমনি সৎমা আর বোন মইরুঙতুই দুজন মিলে তার উপর গরমপানি ঢেলে দিল।
সে ব্যথায় ককিয়ে উঠল, আর ওখানেই পড়ে পড়ে অনেক কাঁদল। সৎমা ভাবল ছিপিঙতুই মরে গেছে।
তাই সে ছিপিঙতুইকে একটি থলের মধ্যে ভরে বনের ভিতর ফেলে দিল।
রাজার ছিল একটা পোষা হরিণ। রাজা এই হরিণটাকে কিছুদিনের জন্য বনে রেখে গেছেন।
ছিপিঙতুইকে যেখানে ফেলা হয়েছে হরিণটা বনে ঘুরতে ঘুরতে সেখানে এসে হাজির হল। হরিণ থলে খুলে পেল ছিপিঙতুইকে।
হরিণ তার পোড়া অংশে বনজ ওষুধ লাগিয়ে দিল। পরম মমতায় সেবা করে হরিণ ছিপিঙতুইয়ের জীবন বাঁচাল।
এরপর ছিপিঙতুই হরিণের সঙ্গে বনেই বসবাস করতে লাগল।
এদিকে মইরুঙতুই বোনের পোশাক পড়ল। সাজগোজ করে আচার-আচরণে সে এমন ভান করল যেন সেই রাজরানি।
যখন রাজসৈন্য আর ভৃত্যরা রাজরানিকে নিতে এলো, তখন মইরুঙতুই তাদের সঙ্গে রাজপ্রাসাদে চলে গেল।
রাজরানি ফিরে আসায় রাজা খুব খুশি হলেন। কিন্তু তিনি রানির ব্যবহারে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করলেন।
রাজার রানিকে সন্দেহ হল। কিন্তু তিনি কোনো প্রমাণ খুঁজে বের করতে পারলেন না। দিনে দিনে রাজা খুব বিগ্ন হয়ে পড়লেন।
একদিন রাজা ঠিক করলেন তিনি শিকারে যাবেন।
খুব সকালে ওঠে রাজা সৈন্য-সামন্ত নিয়ে শিকারের উদ্দেশ্যে বনে চলে গেলেন।
সারাদিন বনে ঘুরে বেড়ালেন। কিন্তু কোনো শিকার পেলেন না। যেখানে রাজার পোষা হরিণটাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, বিকেল বেলায় রাজা সেখানে হাজির হলেন।
রাজা তার সঙ্গী-সাথীদের বললেন, আজ রাতটা তিনি পোষা হরিণের ঘরে কাটিয়ে দেবেন।
কিন্তু পোষা হরিণটা রাজার এ প্রস্তাবে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। হরিণের এ ধরনের ব্যবহারে রাজা খুব অবাক হলেন।
রাজার সন্দেহ হল, নিশ্চয় এর মধ্যে কোরো ঘটনা আছে! রাজা হরিণকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন।
কিন্তু হরিণ কোনো বিশ্বাসযোগ্য কারণ দেখাতে পারল না। অবশেষে রাজার অনুরোধে হরিণ রাজরানির সব ঘটনা খুলে বলল।
সে এও বলল, রাজরানি এখানে তার ঘরে বসবাস করছে।
হরিণের ঘর থেকে রাজরানি বেরিয়ে এলো। দেখা হল রাজার সঙ্গে। রাজা প্রতিজ্ঞা করলেন, যে বোন ছল করে রাজরানি হয়েছে তাকে তিনি শায়েস্তা করাবেন।
রাজা শিকার থেকে প্রাসাদে ফিরে গেলেন। তিনি মইরুঙতুইকে বনের ঘটনার কিছুই বললেন না।
পরদিন রাজা মইরুঙতুইকে বললেন, তুমি নদীতে গিয়ে গোসল করে এসো। মইরঙতুই সানন্দে রাজি হল।
যেই সে গোসল করতে নদীর তীরে গেল অমনি রাজা তাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেললেন।
আর আসল ফিরিয়ে আনলেন প্রাসাদে। রাজা আসল রাজরানিকে ফিরে পেয়ে খুবই খুশি হলেন।
রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি সৎশাশুড়ির বিরুদ্ধে প্রতিশোাধ নেবেন। রাজা সৎশাশুড়ি ও শ্যালককে রাজপ্রাসাদে দাওয়াত করলেন।
খাওয়া-দাওয়া, আদর-আপ্যায়ন শেষে বিদায় বেলায় রাজা তাদেরকে পাতায়ন দুটি পাত্র দিলেন।
তাদের বললেন, হাটতে হাটতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়লে তখন একটা পাত্র খুলে পানি পান করবেন।
অর্ধেক পথ যেতেই মা ও ছেলে দুই জনেই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তারা পানি পান করার জন্য পাত্রের ঢাকনা যেই ঢুকল অমনি পাত্র থেকে মৌমাছির ঝাক বেরিয়ে এলো।
মৌমাছিরা তাদের কামড়াতে লাগল। মৌমাছির হাত থেকে বেঁচে অনেক কষ্টে তারা বাড়ি পৌছল।
বাড়ি পৌছে সৎশাশুড়ি আরেকটি পাত্র খুলল।
ওই পাত্রের মধ্যে মইরুঙতুইয়ের ছিন্ন মাথা দেখে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। তার আর জ্ঞান ফিরল না। সে মারা গেল।
লেখক : আবু রেজা
তথ্যসূত্র : ত্রিপুরা আদিবাসী লোককাহিনী
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।