ত্রিপুরা লোককাহিনীঃ হরিণ-মাতা
1035
এক গায়ে ছিল এক জুমিয়া। তার নাম শ্যামাচরণ। সংসারে আপন বলতে তার কেউ ছিল না। সে একাই জুমচাষ করত আর নিজেই রান্নাবান্না করে খেত।
একদিন শ্যামাচরণ বনে গেল। উদ্দেশ্য কোনো বন্যপ্রাণী শিকার করা যায় কিনা। সে একটি হরিণ শিকার করে নিয়ে এলো।
সে হরিণটা রান্না করল। এর অর্ধেকটা খেল, বাকি অর্ধেকটা রেখে দিল পরদিনের জন্য। তারপর সে চলে গেল জুমখেতে কাজ করতে।
সন্ধ্যায় শ্যামাচরণ ফিরে এলো ঘরে। সে দেখল কেউ একজন তার জন্য খাবার রান্না করে রেখেছে। কে করল এ রান্না- সে সম্পর্কে খোঁজখবর করে দেখল।
সে প্রতিবেশীদের কাছে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু কেউ বলতে পারল না কে খাবার তৈরি করে রেখেছে। শ্যামাচরণ খেয়ে দেখল খাবারগুলো খুব স্বাদ হয়েছে।
পরদিন শ্যামাচরণ জুমখেতে কাজ করতে গেল। ফিরে এসে আবারও দেখল তার জন্য কোনো একজন খাবার তৈরি করে রেখেছে। সে খুব অবাক হল!
তার অনুপস্থিতিতে কে খাবার তৈরি করে রাখে তা জানার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে উঠল।
পরদিন খুব সকালে জুমখেতে কাজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল। কিন্তু কাজে না গিয়ে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকল।
দুপুরের দিকে শ্যামাচরণ অবাক হয়ে দেখল, তার রেখে দেওয়া হরিণের অংশবিশেষ নারীরূপ ধারণ করছে।
আবার সেই নারীই ঘরদোর গুছাচ্ছে, খাবার রান্না করছে। এটা দেখে শ্যামাচরণ ঝাপিয়ে পড়ে মেয়েটিকে ধরে ফেলল।
শ্যামচরণ বলল, আমি তোমাকে যেতে দেব না, তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই।
মেয়েটি প্রথমে বলল, না না, তুমি আমাকে ছুইয়ো না। আমাকে যেতে দাও।।
শ্যামচরণের অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর মেয়েটি বলল, আমি তোমার বউ হতে পারি, তবে একটি শর্তে।
তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, তুমি কখনো আমাকে হরিণ-বউ বলে ডাকবে না।
শ্যামাচরণ এই শর্তে রাজী হয়ে তাকে বিয়ে করল। বিয়ের পর তারা সুখে-শান্তিতে সংসার করতে লাগল। এর মধ্যে তাদের দুটি ছেলে-মেয়ে হল।
একদিন শ্যামাচরণ এক বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত খেতে গেল। খাওয়াদাওয়ার পর সে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে গেল।
অনেকক্ষণ পার হয়ে গেল কিন্তু শ্যামাচরণ দাওয়াত খেয়ে ফিরছে না। তাই তার বউ ছেলেমেয়েদের বলল, ‘যাও, তোমাদের বাবাকে ডেকে আন।
শ্যামাচরণ যে বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়েছিল ছেলেমেয়েরা সেখানে গিয়ে বাবাকে বলল, অনেকক্ষণ হয়ে গেছে এসেছ।
এখনো ফিরছ না। মা তোমাকে ডাকছে। তোমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলেছে।
শ্যামাচরণ বলল, তোমরা বাড়ি যাও, আমি কিছুক্ষণ পরে আসব। এরপরও অনেক সময় পার হল। তখনও শ্যামচরণ এলো না। তার বউ ছেলেমেয়েদের আবার পাঠাল তাকে ডেকে আনার জন্য।
শ্যামচরণ বন্ধুদের সঙ্গে বসে গল্প করছিল। ছেলেমেয়েদের ক্রমাগত তাগিদে সে ক্ষেপে গেল। রাগের মাথায় সে বলে ফেলল, কে ডাকতে পাঠিয়েছে, হরিণবউ?
এই বলে শ্যামাচরণ ছেলেমেয়েদের তাড়িয়ে দিল।
ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফিরে গেল। মাকে বলল, বাবা তোমাকে হরিণ-বউ বলেছে।
এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মা হরিণের রূপ ধারণ করল। আর সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল বনে।।
এর কিছু দিন পর শ্যামাচরণ গাঁয়ের আরেকটি মেয়েকে বিয়ে করল।
এর মধ্যেও হরিণটি রোজই বাড়ি আসত ছেমেয়েদের দেখতে। তাদের জন্য হরিণটি প্রতিদিনই খাবার নিয়ে আসত।
শ্যামাচারণের নতুন বউ দেখল ছেলেমেয়েরা কেউ বাড়িতে খায় না। কিন্তু ওরা ঠিকই তরতরিয়ে বেড়ে উঠছে।
তাহলে ওরা কোথা থেকে কীভাবে খাবার পাচ্ছে! এসব ভেবে নতুন বউ খুবই অবাক হল। এর কিছু দিনের মধ্যেই সে জেনে গেল হরিণটিই বাচ্চাদের খাবার খাওয়ায়।
এতে তার খুব রাগ হল। নতুন বউ তখন হরিণটিকে মেরে ফেলার জন্য শ্যামাচরণকে অনুরোধ করল।
শ্যামাচরণ বনে গেল। হরিণটিকে খুঁজে বের করল। তাকে সে নতুন বউয়ের অনুরোধের কথা জানাল।
হরিণ-বউ তার ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন ছিল। সে শ্যামাচরণকে বলল, তুমি আমাকে মারতে পারো।
আমাকে মারলে তোমার বউ খুশি হবে। তবে আমাকে মারার আগে তুমি আমার স্তন নিয়ে যাও। তুমি এটা কোনো ভালো জায়গায় রাখবে।
দেখবে এটা একটা শিমুল গাছে পরিণত হবে। এই গাছই তখন আমার ছেলেমেয়েদের খাওয়াবে।
এরপরও সেই একই ঘটনা। ছেলেমেয়েরা বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে না। কিন্তু ওরা বেড়ে উঠছে ঠিকই। এটা কীভাবে সম্ভব! এর কারণ খুঁজতে গিয়ে নতুন বউ দেখল, ছেলেমেয়েরা শিমুল গাছ থেকে খাবার পাচ্ছে।
এরপর নতুন বউ শ্যামাচরণকে শিমুল গাছটি কেটে ফেলার অনুরোধ করল। বউয়ের ইচ্ছেমতো শ্যামাচরণ শিমুল গাছটি কাটতে গেল।
গাছটি শ্যামাচরণকে বলল, তুমি আমাকে কাটার পর আমার ডালপালা নদীতে ফেলে দিও। তখন আমি মাছ হয়ে নদীতে ভাসব। তখনো আমিই আমার ছেলেমেয়েদের খাবার খাওয়াব।
শ্যামাচরণ গাছটি কেটে ফেলল। গাছের ডালপালা নদীতে ফেলে দিল। শ্যামাচরণ দেখল ডালপালা একত্রে মিলে একটা বড় মাছ হয়ে গেল।
মাছটি ছেলেমেয়েদের তার সঙ্গে সমুদ্রে নিয়ে গেল।
এরপর হরিণ-বউ আর তার ছেলেমেয়েরা মাছ হয়ে সমুদ্রে নিরাপদে বসবাস করতে লাগল।
লেখক : আবু রেজা
তথ্যসূত্র : ত্রিপুরা আদিবাসী লোককাহিনী
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।