ত্রিপুরা লোককাহিনীঃ রাজহাঁস
1237
এক গ্রামে এক বৃদ্ধা একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাস করত। এই বৃদ্ধা ছিল খুবই গরিব।
একদিন সে দেখল এক জেলে মাছ বিক্রি করছে। সেই জেলে মাছ বিক্রি করতে তার বাড়ি এলো। জেলে বলল, তুমি কি মাছ কিনবে?
বৃদ্ধা বলল, আমার ছেলে কাঠ বিক্রি করতে বাজারে গেছে। আমার কাছে কোনো টাকা নেই। ছেলে বাড়ি ফেরার পর যদি তুমি মাছের দাম নাও তবে আমি মাছ কিনতে পারি।
এই শর্তে রাজি হয়ে জেলে বৃদ্ধাকে কিছু মাছ দিল। বৃদ্ধা মাছ রান্না করে ছেলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরই জেলে আবার বৃদ্ধার বাড়িতে ফিরে এসে মাছের দাম চাইল। সে বলল, সব মাছ বিক্রি করে এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি। দয়া করে মাছের দামটা দিয়ে দিন।
বৃদ্ধা বলল, আমার ছেলে এখনো বাড়ি ফিরেনি। সে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো।
কিন্তু জেলে আর অপেক্ষা করতে রাজি হল না বরং তাড়াতাড়ি দাম পরিশোধ করার তাগিদ দিল।
দাম পরিশোধ করতে না পেরে বৃদ্ধা মাছগুলো জেলেকে ফিরিয়ে দিল। রান্না করা মাছগুলো দিতে হল বলে সে খুব দুঃখ পেল।
বিকেলে বৃদ্ধার ছেলে ফিরে এলো। সে মাকে বলল, কাঠ বেচতে গিয়ে আজ বেশ বিপদেই পড়েছি। কাঠ কেনার তেমন ক্রেতা ছিল না।
খুব কম দামে কাঠগুলো বিক্রয় করতে হল। কাঠ বিক্রির টাকা দিয়ে শুধু চাল কিনতে পেরেছি। আর কোনো সদাই করতে পারিনি।
মা, আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। আমি জলদি গোসল করে আসি, তুমি খাবার দাও।
ছেলেটি নদীতে গেল গোসল করতে। আর মা গেল ভাত রান্না করতে। ছেলেটি খেতে বসে দেখল তাকে শুধু ভাত খেতে দেওয়া হয়েছে। কোনো তরকারি দেওয়া হয়নি।
বৃদ্ধা দেখল, যে হাড়িতে মাছ রান্না করেছিল, জেলেকে মাছ ফেরত দেওয়ার পরও তাতে কিছু ঝোল রয়ে গেছে। বৃদ্ধা ঝোলটুকু ছেলেকে দিল।
ছেলেটির কাছে এর স্বাদ অমৃতসমান মনে হল। সে আরো একটু ঝোল চাইল। বৃদ্ধা পুরো ঘটনা বলল।
সে ছেলেকে বলল, টাকা দিতে পারেনি বলে রান্না করা মাছ জেলেকে ফেরত দিতে হয়েছে।
ছেলেটি বলল, কাল আমি কাঠ কাঠতে যাব না। বাড়িতে যে কাঠ আছে তাই বিক্রি করে চাল কিনব।
তারপর আমি যাব রাজার পুকুরে মাছ ধরতে, তুমি মাছ রান্না করবে, আমরা দুইজন মজা করে খাব।
বৃদ্ধা মা বলল, রাজার পুকুরে মাছ ধরতে গেলে রাজার সৈন্যরা তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে, তোমাকে শাস্তি দিবে।
ছেলেটি বলল, অনেকেই রাজার পুকুরে মাছ ধরে, কিন্তু কেউ তাদের বাধা দেয় না। তাহলে আমাকে কেন বাধা দেবে?
কেউ বাধা দিলে আমি চলে আসব। তোমাকে এ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
পরদিন সকালে ছেলেটি বাজারে গেল। কাঠ বিক্রি করে তাড়াতাড়ি চাল নিয়ে ফিরে এলো। তারপর সে গেল রাজার পুকুরে মাছ ধরতে।
সারাদিন সে বড়শি পেতে বসে রইল, কিন্তু একটি মাছও ধরতে পারল না।
রাজার পুকুরে আর যারা মাছ ধরতে এসেছিল তারা সবাই বাড়ি চলে গেল।
কিন্তু ছেলেটি শূন্যহাতে বাড়ি ফিরতে চায়নি। তাই সে বড়শি পেতে বসেই রইল। হঠাৎ ছেলেটি দেখল বড়শিতে একটা রাজহাঁস ধরা পড়েছে।
সে রাজহাঁসটি নিয়ে বাড়ি গেল।
রাজহাঁস দেখে বৃদ্ধা ভয় পেল। সে বলল, এটা কারো পালিত রাজহাঁস। তুমি এটা চুরি করে এনেছ।
যাও যেখান থেকে এনেছ এটাকে সেখানে রেখে এসো। না হলে আমরা বড় বিপদে পড়ব।
ছেলেটি বলল, মা তুমি ভয় পেয়ো না। আমি রাজহাঁস নিয়ে আসার সময় কেউ আমাকে দেখেনি। আমি কখনো রাজহাঁসের মাংস খাইনি।
তুমি আমাকে রাজহাঁসের মাংস রান্না করে দাও। ছেলের অনুরোধে বৃদ্ধা রাজহাঁসের মাংস রান্না করল। তারপর দুইজন মিলে মজা করে খেল।
অনেক দিন পর মা ছেলে দুইজনে এমন ভালো খাবার খেল।
বিকেলে রাজার প্রহরীরা পুকুরের সব রাজহাঁস ঘরে নিতে এলো। তারা দেখল একটা রাজহাঁস কম।
তারা আশেপাশের সব জায়গায় খোঁজ করল। কিন্তু কোথাও পেল না। অবশেষে রাজার পেয়াদারা জানতে পারল, ঐ বৃদ্ধার ছেলে আজ পুকুরে বড়শি পেতে বসেছিল।
তারা সন্দেহ করল, ঐ বূদ্ধার ছেলেই রাজহাঁসটি চুরি করতে পারে। তাই তারা বৃদ্ধার বাড়ি এলো। তখন বৃদ্ধা ও তার ছেলে ঘুমাচ্ছিল।
রাজার পেয়াদারা ঘরের দরজায় কড়া নাড়ল। বৃদ্ধাকে দরজা খুলতে বলল।
তারা বৃদ্ধাকে বলল, রাজার হাঁস চুরি হয়েছে, আমরা ওটা খুঁজতে এসেছি।
বৃদ্ধার ঘর তল্লাশি করে তারা এক কোণে পেল রাজহাঁসের কিছু পালক।
পালক দেখে তাদের সন্দেহ হল। তারা তন্ন তন্ন করে খুঁজে রাজহাঁসের রান্না করা মাংস পেল।
এ অপরাধে বৃদ্ধার ছেলেকে বন্দী করে জেলে পাঠানো হল।
একমাত্র ছেলেকে বন্দী করার কারণে বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। অজ্ঞান অবস্থায় সে একটা স্বপ্ন দেখল।
স্বপ্নে এক বৃদ্ধা তার কাছে এলো।
সে বলল, হে বৃদ্ধা, তুমি কেঁদো না। ঈশ্বরের নাম জপ করো। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে পূজা মানত করো। এতে তোমার ভালো হবে।
বৃদ্ধা বলল, মা, আমি খুব গরিব। আমার অনেক বয়স হয়েছে। আয় রোজগার করতে পারি না। আমার এক মাত্র ছেলে জেলে বন্দী।
যে আয় রোজগার করত সেই রাজহাঁস চুরির দায়ে জেলে গেল।
আমি পূজার জিনিস যোগাড় করব কীভাবে? পূজাই বা দেব কীভাবে?
স্বপ্নবুড়ি বলল, তুমি চিন্তা করো না। তোমার ছেলে বাড়ি ফিরে আসবে। তুমি রাজহাঁসের একটি পালক ঈশ্বরের নামে রাজার পুকুরে ফেলে দিও।
সাবধান রাজার পুকুরে পালক ফেলার সময় পিছনে তাকাবে না।
বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করল, আমি ঈশ্বরের পূজা দেব কীভাবে? পূজার জন্য কী কী লাগবে? আমি তো এসবের কিছুই জানি না।
স্বপ্নবুড়ি বলল, কিছু চাল, কলাপাতা আর গুড় জোগাড় করো। চাল গুঁড়ো করে তিন পদের পিঠা বানাও। কিছু দুধ নাও। এসব একটা কলাপাতায় রাখো।
যখন পূজা দিবে তখন তুমি সবার আগে এগুলো দেবীর সামনে রাখবে। যারাই দেবীর সামনে প্রসাদ রাখবে সবাই দেবীর নামে অর্চনা করবে।
এভাবে দেবীকে তোমার পূজা দেওয়া হয়ে যাবে।
একথা শুনে বৃদ্ধা খুবই খুশি হল। সে বলল, আমি জানি না তুমি কে? দয়া করে তোমার পরিচয় দাও।
স্বপ্নবুড়ি হেসে বলল, যথাসময়ে তুমি আমার পরিচয় পাবে। এরপর স্বপ্নবুড়ি অদৃশ্য হয়ে গেল।
বৃদ্ধা জেগে ওঠে স্বপ্নের কথা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারল না। তবও স্বপ্নবুড়ি তাকে যা বলেছিল তা পালন করার সিদ্ধান্ত নিল।
তখনও সকল হয়নি। সে রাজহাঁসের একটি পালক নিয়ে রাজার পুকুরে গেল।
ঈশ্বরের নাম স্মরণ করে পালকটি পুকুরে ছুড়ে দিল। এরপর ফিরে এলো বাড়িতে।
সেই রাতে রাজাও একটি স্বপ্ন দেখল। সে দেখল এক বৃদ্ধ নারী তাকে বলছে, তুমি রাজহাঁস চুরির দায়ে এক বৃদ্ধার ছেলেকে বন্দী করেছ।
কিন্তু রাজহাঁস তো তোমার পুকুরেই সাঁতার কাটছে। রাজা তখন পুকুরপাড়ে লোক পাঠাল।
তারা গিয়ে দেখল হারিয়ে যাওয়া রাজহাঁস পুকুরে সাঁতার কাটছে।
রাজা তখন প্রহরীদের ডেকে বলল, তোমরা নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছ না।
তোমরা মিথ্যে অভিযোগে এক বৃদ্ধার ছেলেকে বন্দী করেছ। যাও এক্ষুণি তাকে ছেড়ে দাও।
আর বিনা দোষে বন্দী করার জন্য তোমরা তাকে পাঁচ রূপী ক্ষতিপূরণ দেবে।
প্রহরীরা এ ঘটনায় খুবই অবাক হল। কিন্তু পুকুরে রাজহাঁস সাঁতার কাটতে দেখে তারা বাধ্য হয়ে বৃদ্ধার ছেলেকে মুক্তি দিল। তাকে পাচ রূপী ক্ষতিপূরণও দিল।
জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বৃদ্ধার ছেলেটি বাড়ি ফিরে এলো। ছেলেকে দেখে বৃদ্ধা খুবই খুশি হল।
বৃদ্ধা বলল, সব কিছুই সম্ভব হয়েছে ঈশ্বরের কৃপায়।
এক্ষুণি বাজারে যাও, ঈশ্বরের পূজার জন্য জিনিসপত্র নিয়ে এসো।
পরদিন ঈশ্বরের পূজা দেওয়া হল। গাঁয়ের সবার আগে বৃদ্ধা পূজা দিতে গেল। স্বপ্নে যেমন বলা হয়েছিল ঠিক সেভাবে বৃদ্ধা পূজা দিল।
পূজার জন্য দেবীর উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রসাদ গায়ের সকলকে বিতরণ করল।
এরপর বৃদ্ধা আর তার ছেলে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।
লেখক : আবু রেজা
তথ্যসূত্র : ত্রিপুরা আদিবাসী লোককাহিনী
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।