ত্রিপুরা লোককাহিনী: বানর জামাই
970
একদিন একদল কিশোরী মেয়ে ফসল তুলতে জুমখেতে গেল। তারা জুমখেতে পৌছে দেখল একটা বানর বেগুন খাচ্ছে।
কিশোরীদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট মেয়েটি তার সঙ্গে আনা কুকুরকে বলল বানরটিকে তাড়িয়ে দিতে। তার কথামতো কুকুর বানরটিকে তাড়া করল।
কুকুরের ভয়ে বানরটি দৌড়ে পালাল। কিন্তু সে খুব রেগে গেল। বানর ছোট মেয়েটির এমন আচরণের প্রতিশোধ নেবে বলে সিদ্ধান্ত নিল।
তখন ছিল দুপুর। সকল মেয়েরা জুমখেতের কাজে খুব ব্যস্ত ছিল। তাদের কেউ বেগুন তুলছিল। কেউ ভুট্টা তুলছিল। কেউ তুলছিল তুলা।
কেউ টেনে তুলছিল সবজির মূল। আর তারা সবাই গান করছিল। এভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল।
সারাদিন জুমখেতে কাজ করে সবাই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ল। ওরা ঠিক করল সবাই নদীতে গোসল করবে। এদিকে ওদের খুব ক্ষুধাও পেয়েছে।
সে সময় কুকুরটা গাছের ছায়ায় ঘুমাচ্ছিল। মেয়েরা সবাই নদীর ধারে গেল। ওরা কাপড়চোপড় খুলে রাখল গাছের নিচে।
আর প্রত্যেকে একটুকরা কাপড় গায়ে জড়িয়ে পানিতে নামল।
ঠিক এমন সময় ওরা যেখানে কাপড় রেখে গেছে সেখানে বানরটি এলো। সে কাপড়গুলো তুলে নিয়ে গাছ বেয়ে উপরে ওঠে গেল।
কিছুক্ষণ পর মেয়েরা নদী থেকে উঠে এলো। ওরা কাপড় বদলাতে গিয়ে কাপড়গুলো খুঁজে পেল না। হঠাৎ ওরা গাছের উপর থেকে অদ্ভুত একটা শব্দ শুনতে পেল।
ওদিকে তাকিয়ে দেখল, বানরটি কাপড়চোপড় নিয়ে বসে আছে গাছের মাথায়। ওরা গাছ বেয়ে উপরে উঠতে পারছে না।
ওরা জানে না কীভাবে কাপড়গুলো বানরের কাছ থেকে ফেরত পাবে। তাই মেয়েরা খুব চিন্তায় পড়ে গেল। ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল।
কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পেল না। দলের সবচেয়ে বড় মেয়েটি বানরকে কাপড়গুলো ফেরত দেওয়ার বিনিময়ে কিছু বেগুন দেওয়ার প্রস্তাব দিল।
সে বলল, বানর ভাইয়া, আমার কাপড়গুলো ফিরিয়ে দাও। আমি তোমাকে বেগুন খেতে দেব।
এ কথা শুনে বানর বলল, এক হালি বেগুন নিয়ে গাছ বেয়ে এক ধাপ এগিয়ে এসো।
দলের সবচেয়ে বড় মেয়েটি বানরের দাবিমতো এক হালি বেগুন দিল।
বানর ওর কাপড়গুলো ফিরিয়ে দিল। এরপর দ্বিতীয়জন বানরকে অনুরোধ করল ওর কাপড় ফেরত দেওয়ার জন্য।
বানর তাকেও এক হালি বেগুন নিয়ে এগিয়ে আসতে বলল। মেয়েটি বানরের দাবি পূরণ করার পর বানর ওর কাপড় ফেরত দিল।
এভাবে দলের শুধুমাত্র ছোট মেয়েটি ছাড়া বাকি সবাই কাপড় ফেরত পেল। ওরা প্রত্যেকে গাছ বেয়ে এক ধাপ এগিয়ে গেল, আর এক হালি করে বেগুন দিল।
যখন সবচেয়ে ছোট মেয়েটির পালা তখন বানর বলল, গাছ বেয়ে সাত ধাপ এগিয়ে এসো এবং আমাকে সাত হালি বেগুন দাও।
বানরের চাহিদা মতো ছোট মেয়েটি সাত ধাপ এগিয়ে গেল, তাকে সাত হালি বেগুন দিল। কিন্তু বানর তাকে কাপড় তো ফেরত দিলই না বরং যখন সে বেগুন দিতে গেল, তখন বানর ওর হাত ধরে টেনে গাছের উপর তুলে নিল।
এটা দেখে যারা নিচে দাঁড়িয়েছিল তারা চিৎকার করে দৌড়ে পালাল। গ্রামে ফিরে গিয়ে ওরা সবাইকে এ ঘটনা জানাল। যখন ওরা গ্রামে পৌছল তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
চারদিকে ঘন অন্ধকার। ঘটনা শুনে গ্রামবাসীরা মাঠের দিকে ছুটল।
তারা মাঠের চারপাশে খুঁজল। কিন্তু বানর আর মেয়েটিকে পেল না।
বানর মেয়েটিকে গভীর বনে নিয়ে গেল।
মেয়েটিকে বানরের হাত থেকে বাচতে চেয়েছিল। সে ছুটে পালাতে চেষ্টা করেছিল।
কিন্তু পারেনি। প্রথম কিছুদিন সে খানা-দানা সব ছেড়ে দিয়েছিল। এভাবেও বেশি দিন টিকতে পারেনি।
পরে আসহায় একা মেয়েটি বানরের সঙ্গে গভীর বনে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছিল। এভাবে থাকতে থাকতে এক বছর পর তার একটি সন্তান হল।
ওর নাম রাখা হল টটে। আর মেয়েটিকে ডাকা হতো টটেমা বলে। সন্তান হওয়ার পর বানর ভেবেছিল মেয়েটি আর তাকে ছেড়ে পালিয়ে যাবে না।
কিন্তু মেয়েটি তখনও পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছিল।
একদিন টটেমা বুঝতে পারল তার আবার সন্তান হবে। সে তখন বানরের কাছে টকফল খেতে চাইল। ধারে কাছে কোথাও সেই টকফল পাওয়া গেল না।
মেয়েটির অনুরোধ রাখতে বানর টকফল খুঁজতে আরো গভীর বনে গেল।
এদিকে বানর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই টটেমা পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সে বিড়ালকে বিদায় দিল।
অন্যান্য প্রাণী যারা তার সঙ্গে বনে একসঙ্গে বসবাস করত তাদেরও বিদায় দিল। সে তার ছেলে টটেকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ি পথ ধরে গ্রামের দিকে রওনা হল।
সন্ধ্যাবেলায় বানর বাড়িতে ফিরল। কিন্তু বানর সেই মেয়েটি কিংবা তার ছেলে দুইজনের কাউকে খুঁজে পেল না। সে দেখল চুলায় একটি পাত্রে পানি ফুটছে।
তার পাশে বসে আছে বিড়াল। সে ভাবল, মেয়েটি আর ছেলে আশেপাশে কোথাও গেছে। ক্রমেই আঁধার হচ্ছে। তবুও তার ছেলে আর টটেমা ফিরছে না।
তাই বানর উচ্চস্বরে টটেমা বলে ডাকতে লাগল। কিন্তু সে কোনো সারা পেল না।
সে কাঁদতে লাগল। তার পাশে বসে বিড়ালও মিউ মিউ করতে লাগল।
বানর খুব কষ্ট পেল। তার খুব দুশ্চিন্তা হল। সে রেগে বিড়ালকে ছুড়ে মারল। মাটিতে পড়ে বিড়ালটা মরে গেল।
এখন বানর একা একা থাকে। সে খুব উদাসীন হয়ে পড়েছে। বিড়ালের চামড়া দিয়ে সে একটা বাদ্যযন্ত্র বানিয়েছে। এই যন্ত্রটার নাম ডং ডরং।
এ যন্ত্রটি নিয়ে সে নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। সে টটেমা আর ছেলের খোঁজ করে। সে ঘুরে বেড়ায় আর যন্ত্রটিকে উদ্দেশ্য করে গান গায়
ও ডনি ডং ডরং, ও ডনি ডং ডরং
আমার টটেমা কোথায় গেল?
আমার টটে কোথায় গেল?
ও ডনি ডং ডরং, ও ডনি ডং…
একদিন বানর একটা জুমখেতের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। কয়েক জন জুমিয়া ওখানে কাজ করছিল।
বানরটাকে অদ্ভুত একটা যন্ত্র নিয়ে গান গাইতে দেখে একজন জানতে চাইল সে কী গান গাইছে।
বানর গানটি আবার গাইল এবং পুরো ঘটনাটি জুমিয়াদের খুলে বলল।
জুমিয়ারা বলল, কিছু দিন আগে একজন মহিলা একটি শিশুকে কোলে নিয়ে এই মাঠের পাশ দিয়ে চলে গেছে।
সম্ভবত সেই তোমার টটেমা। যে পথে মেয়েটি গেছে জুমিয়ারা বানরকে সে পথ দেখিয়ে দিল।
অবশেষে বানর যেখান্তে টটেমা বাস করে সেই গ্রামটি খুঁজে পেল। দূর থেকে টটে বানরকে দেখতে পেল। টটে তার মাকে বলল, মা আমার বাবা এসেছে।
টটেমা বলল, সে একটি বানর, সে তোমার বাবা হবে কীভাবে? কিন্তু টটে দৌড়ে গিয়ে বানর বাবার কাছে গেল। তার কোলে ওঠে বসল।
এ খবর শুনে মেয়েটির মা-বাবা ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। বানর জামাইকে তারা বরণ করে নিল।
তারা বলল, বাড়িতে এসো। আমাদের সঙ্গে আমাদের বাড়িতেই তুমি থাকো।
মেয়েটির মা-বাবা বানর জামাইয়ের জন্য ভালো খানা-দানার আয়োজন করল। এই উপলক্ষে সকল গ্রামবাসীকে দাওয়াত দেওয়া হল।
তাদের খাবাড় ও পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করা হল। বানর জামাইও প্রচুর পানীয় সাবার করল। সে এত মাতাল হয়ে গেল যে সে দাঁড়াতে পারছিল না।
শেষ পর্যন্ত ধরাধরি করে তাকে বিছানায় নিয়ে যাওয়া হল। সে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘরের ভিতর বিছানাটি তৈরি করা হয়েছিল বাঁশের পাতাটন দিয়ে। মেয়েটি পাটাতনের এক পাশ থেকে কয়েকটি বাশ খুলে রেখেছিল।
রাতে মেয়েটি বানরকে ছেলের জন্য জায়গা ছেড়ে একটু দূরে সরে শুতে বলল। যেই বানর সরতে গেল অমনি পাটাতনের ফাঁকা দিয়ে পড়ে গেল।
বানর পড়ল একেবারে মাটিতে, যেখানে ছিল শূকর আর কাদামাটি। বানর কাদামাটিতে আটকে গেল, একটুও নড়তে পারল না।
শূকরগুলো বানরকে মেরে খেয়ে ফেলল।
অবশেষে টটেমা বানরের হাত থেকে মুক্তি পেল।
লেখক: আবু রেজা
ছবিটি এঁকেছেনঃ সাক্ষর চাকমা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।