ত্রিপুরা লোককাহিনী: বুননা শূকর ও ইঁদুর
747
এক বনে বাস করতো এক শূকর। গ্রীষ্মকালে এই বনে পানির অভাব দেখা দেয়।
শূকরকে তখন পানির খোঁজে অনেক জায়গায় ছুটোছুটি করতে হয়। একদিন শূকরটি বনে খাবার খুঁজছিল।
এক জায়গায় এসে শূকরটির মনে হল এখানে অনেক পানি পাওয়া যেতে পারে। এই ভেবে সে পানির জন্য গর্ত করতে শুরু করল।
কিছু সময় পরে এই গর্তের তলায় পানি দেখা গেল। পানি পেয়ে শূকরটি নিশ্চিন্ত হল। সে ভাবল এই জল সে সংরক্ষণ করবে, যাতে অভাবের সময় এই পানি ব্যবহার করতে পারবে।
শূকরটি ঠিক জানে না এই পানির ফোয়ারা সে কীভাবে দেখে-শুনে যত্ন করে রাখবে। তাকে তো বেশির ভাগ সময় খাবারের খোঁজে বনের নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়।
শূকর ভাবল ফোয়ারা পাহারা দিয়ে না রাখলে অন্য প্রাণীরা দেখতে পেলে পানি খেয়ে ফেলবে।
তাই সে ঠিক করল কোনো একজনকে পানির ফোয়ারা পাহারার দায়িত্ব দেওয়া হবে। অনেক চিন্তার পর শূকরটি ভাবল একাজে লাগাতে হবে একটা ছোট্ট প্রাণীকে।
বড় কাউকে পাহারায় বসালে সেই খেয়ে জল শেষ করে ফেলবে।
কাছেই একটা গাছের ডালে ছিল একটা ছোট্ট পাখি। শূকর ভাবল, এই পাখিটিকেই সে পানি পাহারার কাজে লাগাবে।
খুবই ছোট বলে পাখিটি খুব বেশি পরিমাণ পানি খেতে পারবে না। এই ভেবে সে ছোট্ট পাখিটির কাছে গেল।
তাকে পানির ফোয়ারা পাহারা দেওয়ার অনুরোধ জানাল। সে পাখিটিকে বলল, পানির ধারে কাছে অন্য কাউকে ঘেষতে দিও না।
পাখিটি শূকরের অনুরোধে পানির ফোয়ারা দেখাশোনোর দায়িত্ব নিল।
কিছুক্ষণ পর একটা খরগোশ এলো সেখানে। সে পানি পান করতে চাইল। ছোট্ট পাখিটি খরগোশকে পানি পান করতে নিষেধ করল।
সে বলল, তুমি যদি এ পানি পান কর তাহলে শূকর তোমাকে হত্যা করবে।
খরগোশ বলল, তুমি আমাকে শূকরের ভয় দেখাচ্ছ, শূকর কতটা শক্তিশালী?
পাখিটি বলল, ‘শূকরের আছে ডিমের মতো ইয়া বড় বড় চোখ, কুড়ালের মতো ধারাল দাঁত আর আছে ইয়া লম্বা একটা লেজ।
শূকরের দেহের বর্ণনা শুনে খরগোশ ভয় পেল। সে দৌড়ে পালিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর এলো একটা হরিণ। তার খুব তৃষ্ণা পেয়েছে।
পানির ফোয়ারা দেখে সে পানি পান করতে চাইল। ফোয়ারা পাহারায় থাকা ছোট্ট পাখিটি হরিণকে পানি পান করতে নিষেধ করল।
হরিণ এর কারণ জানতে চাইল। পাখিটি বলল, এই ফোয়ারা তৈরি করেছে এক শূকর। সে আমাকে ফোয়ারাটি পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছে, যাতে অন্য কেউ পানি নিতে না পারে। যদি তুমি পানি খেয়ে ফেল তো শূকর তোমাকে হত্যা করবে।
হরিণ পাখিটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘শূকর কতটা শক্তিশালী?,
পাখিটি বলল, ‘শূকরের আছে ডিমের মতো ইয়া বড় বড় চোখ, কুড়ালের মতো ধারলো দাঁত আর আছে ইয়া লম্বা একটা লেজ।
শূকরের দেহের বর্ণনা শুনে হরিণ ভয় পেল। সে দৌড়ে পালিয়ে গেল।
সব শেষে এলো বাঘ। বাঘও পানি পান করতে চাইল। ছোট্ট পাখিটি বাঘকে পানি খেতে নিষেধ করল।
পাখিটি আগের মতোই বাঘের কাছে শূকরের দেহের বর্ণনা দিল। এসব শুনে বাঘ বলল, ‘শূকরের কি আমার মতো ধারালো থাবা আছে?’
পাখিটি বলল, “না, নেই তো!
বাঘ বলল, ‘শূকরের কি আমার মতো গোঁফ আছে?”
পাখিটি বলল, “না, নেইতো!
বাঘ বলল, ‘শূকরের যদি আমার মতো থাবা কিংবা গোঁফ কোনোটাই না থাকে, তাহলে শূকরের চেয়ে আমিই বেশি শক্তিশালী।
আমি পানি পান করব। একথা বলে বাঘ ফোয়ারা থেকে পানি পান করা শুরু করল।
ছোট্ট পাখিটি তৎক্ষণাৎ উড়ে গেল। শূকরটাকে খুঁজে জানাল, তার ফোয়ারা থেকে বাঘ সব জল খেয়ে নিচ্ছে।
একথা শুনে শূকর খুব রেগে গেল। বাঘকে মোকাবেলা করার জন্য তৎক্ষণাত সে ছুটে এলো। শূকর ফোয়ারার কাছে পৌছতে পৌছতে বাঘ পানি পান শেষ করেছে।
মুহূর্ত দেরি না করে শূকর ঝাপিয়ে পড়ল বাঘের উপর। বাঘও শূকরের গায়ে ধারলো নখের থাবা বসাল।
প্রচণ্ড লড়াই করে বাঘ আর শূকর মারাত্মক জখম হল। অবশেষে দুইজনেই মরে গেল।
ছোট্ট পাখিটি শূকরের মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ হল।
সে মনে করল, বাঘ শূকরটিকে অযথা হত্যা করল। বাঘ এখানে পানি পান করতে না এলে দুইজনের মধ্যে লড়াইও হতো না, শূকরটিও মরত না।
প্রচণ্ড ক্রোধের কারণে পাখিটি বাঘের মাংস খুটে খুটে খেল। পশুর মাংস খাওয়ার অভ্যাস না থাকার কারণে পাখিটির পেটে বদহজম হল।
এ কারণে ছোট্ট পাখিটি বেশ দুর্বল হয়ে পড়ল। পাখিটি একটি বাঁশঝাড়ের উপর বসে ছিল। একটি বাঁশ পাখিটির উপর ভেঙে পড়ল।
ছোট্ট পাখিটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মরে গেল।
বাঁশঝাড়ের নিচে বাস করত একটি ইদুর। শূকর ও বাঘের মধ্যে যখন লড়াই চলছিল তখন ইদুরটি ছিল গর্তের ভিতরে।
সে লড়াইয়ের আওয়াজ পাচ্ছিল। কিন্তু ভয়ে বাইরে আসতে তার সাহস হয়নি। কিছুক্ষণ পর ইঁদুর আর কোনো শব্দ না পেয়ে গর্তের বাইরে বেরিয়ে এলো।
ইদুর দেখল বাঘ, শূকর আর ছোট্ট পাখিটি মরে পড়ে আছে। ইদুর চিন্তা করল পাখিটির পা দিয়ে ভালো বাঁশি বানানো যাবে।
ইঁদুর তৎক্ষণাৎ পাখির পা দুটি কেটে ওগুলো দিয়ে একটি বাঁশি বানাল। ইদুর বাঁশিটি বাজাতে শুরু করল।
এর কাছেই বাস করত একটি বানর । বাশির মিষ্টি সুরে আকৃষ্ট হল বানর। বানর ঠিক করল বাঁশিটি সে কেড়ে নেব।
এই ভেবে ইদুর যেখানে বাঁশি বাজাচ্ছিল সেখানে এলো। সে হাতে করে কিছু আঠা নিয়ে এসেছিল।
প্রথমে বানর ইদুরের বাশির সুরের প্রশংসা করল। তারপর হঠাৎ সে ইঁদুরের চোখে আঠা ছিটিয়ে দিল।
আঠার কারণে ইঁদুর চোখ খুলতে পারল না। বানরটি তখন ইঁদুরের কাছ থেকে বাঁশিটি ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেল।
ইঁদুর তার প্রিয় বাঁশিটি হারিয়ে ফেলল। ওদিকে চোখও খুলতে পারছে না। তাই সে কাঁদতে শুরু করল। তখন একটা চিল আকাশে উড়ছিল।
ইঁদুরের কান্না শুনে সে নিচে নেমে এলো। চিল ইঁদুরের কান্নার কারণ জানতে চাইল। ইদুর বলল, বানর আমার চোখে আঠা লাগিয়ে দিয়েছে।
এ কারণে আমি চোখ খুলতে পারছি না। আর আমার প্রিয় বাঁশিটিও নিয়ে গেছে। ইঁদুরের দুরবস্থা দেখে চিলের মায়া হল।
চিল তার ছোট নখ দিয়ে ইঁদুরের চোখ থেকে আঠা সরিয়ে দিল। চিল বলল, তুমি কেঁদো না, আমি বানরের কাছ থেকে তোমার বাঁশিটি ফিরিয়ে এনে দেব।
চিলটি তখন বানরের বাড়ি গেল। চিল দেখল বানর আয়েশ করে বসে বাশি বাজাচ্ছিল। চিল বাঁশিটি বাজিয়ে দেখতে চাইল। বানর তাতে রাজি হল না।
সে বলল, বাঁশিটি দেখতে দিলে তুমি ওটা নিয়ে পালিয়ে যাবে। চিল বানরকে বলল, তুমি আমার লেজ ধরে রাখ তাহলে আমি আর পালাতে পারব না।
বানর চিলের এ কথায় রাজি হল। বানর হাতের মধ্যে চিলের লেজ ধরে রেখে বাঁশিটি চিলকে বাজাতে দিল। চিল কিছুক্ষণ বাঁশিটি বাজাল।
বানর বাঁশির সুরে নিজের মধ্যে হারিয়ে গেল। হঠাৎ চিল ঝাঁকি দিয়ে বানরের হাত থেকে লেজ ছাড়িয়ে নিল।
আর বাঁশিটি নিয়ে উড়ে গেল। চিল ইঁদুরের বাড়িতে এসে তাকে বাঁশিটি ফিরিয়ে দিল।
সেই থেকে চিল আর ইঁদুর এই দুটি প্রাণী সুখ-শান্তিতে একসঙ্গে বাস করতে লাগল। আর মাঝে মাঝেই তারা বাঁশি বাজাত।
লেখক : আবু রেজা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।