ত্রিপুরা লোককাহিনীঃ স্বর্গের ফুল খেরেঞ্জবার

Jumjournal
Last updated Mar 26th, 2020

827

featured image

ত্রিপুরার এক গ্রামে বাস করত এক যুবক। তার নাম ধনঞ্জয়।

সে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গেছে। বেশ কিছু দিন সেখানে বেড়িয়েছে। এরপর বাড়ি ফেরার পালা।

তখন চৈত্রমাস, গড়িয়া পূজার সময়। বাড়ি ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে পূজা উদযাপন করতে পারবে একথা ভেবে ধনঞ্জয় খুব খুশি।

ধনঞ্জয় খুব সকাল সকাল বউকে নিয়ে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হল। তাকে অবশ্যই সূর্যাস্তের আগে পৌঁছাতে হবে।

বাড়িতে ফেরার পুরো পথটা ঘন বনে ঢাকা। সন্ধ্যার আগে এ পথটুকু পাড়ি দিতে না পারলে বিপদ হতে পারে।

তাই তারা দুই জনেই খুব জোরে হাঁটছিল যেন আঁধার নামার আগেই বনজঙ্গল পাড়ি দিতে পারে। পথে তারা ফুলের মিষ্টি সুবাস পেল। ধনঞ্জয়কে তার বউ বলল, ফুলের কী সুগন্ধ! এটা কী ফুল?

ধনঞ্জয় বলল, আমরা একে বলি খেরেঞ্জবার। এটা এক ধরনের অর্কিড।

তার বউ বলল, আমি কখনো এই ফুলের কথা শুনিনি, এই ফুল দেখিও নি। আমি জীবনে কখনো এমন সুগন্ধ পাইনি।

আমাকে এই ফুল একটি তুলে এনে দেবে? আমি খোপায় পরব?

ধনঞ্জয় বলল, এই ফুল খোপায় খুঁজে চুল সাজানো ঠিক নয়। এটা স্বর্গের ফুল। এই ফুল শুধুমাত্র ঈশ্বরের জন্যে ফোটে। মানুষের জন্যে এ ফুল ক্ষতিকর।

বউ ক্ষেপে গিয়ে ধনঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করল, স্বর্গের ফুল পৃথিবীতে কীভাবে এলো?
ধনঞ্জয় বলল, অভিশপ্ত এক অপ্সরাকে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে পাঠানো হয়।

সে মর্ত্যে আসার সময় তার প্রিয় ফুলের বীজ নিয়ে আসে। পৃথিবীর পরিবেশ এই বীজ গজানোর মতো উপযোগী ছিল না।

তাই এই বীজ গজাননার জন্য স্বর্গের দেবতাদের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এরপর ধনঞ্জয় বউকে দেখাল গাছের খোড়লে মাটির স্পর্শ ছাড়া কীভাবে এই ফুলগাছ বেড়ে উঠেছে।

ধনঞ্জয় বলল, ফুলগাছের মূল বড়গাছের দেহে জড়িয়ে আছে আর এভাবেই এই ছোট ফুলগাছটি বড় গাছ থেকে খাবার পাচ্ছে।

ধনঞ্জয় বউকে ফুল দেখিয়ে বলল, দেখ এগুলোই খেরেঞ্জবার ফুল। আমি শুনেছি যদি কেউ এই ফুল খোঁপায় খুঁজে সে তৎক্ষণাৎ গিবন হয়ে যাবে।

ধনঞ্জয়ের বউ এ কথা বিশ্বাস করল না। সে অনেকক্ষণ ফুলের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর নীরব আর নিশ্ৰুপ হয়ে গেল। কিন্তু মুখে কিছু বলল না।

ধনঞ্জয় বুঝল তার বউ কষ্ট পেয়েছে। সে বলল, তুমি কষ্ট পেয়ো না। আমি একটি ফুল তোমায় তুলে দিতে পারি।

কিন্তু ফুলটি খোঁপায় খুঁজবে না। তুমি খোঁপায় ফুলটি পরলে কিন্তু আমি গিবন হয়ে যাব।

এরপর ধনঞ্জয় বড়গাছে উঠল, একটি ফুল তুলে বউকে দিল। ফুল পেয়ে বউ খুব খুশি হল। চমৎকার ফুলগুলো দেখে বউ লোভ সামলাতে পারল না।

ধনঞ্জয়ের নিষেধ সে ভুলে গেল। ফুলটি নিয়ে খোপায় খুঁজল। সঙ্গে সঙ্গে তার স্বামীর হাত দুটি গাছের সঙ্গে জড়িয়ে গেল।

ধনঞ্জয় বলল, তুমি কি খোঁপায় ফুল গুঁজেছ? মনে হচ্ছে আমার শরীর বদলে যাচ্ছে!
ধনঞ্জয়ের বউ তার ভুল বুঝতে পারল। তাড়াতাড়ি খোপা থেকে ফুলটি তুলে ছুড়ে ফেলল।

সে গাছের দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। দেখল তার স্বামীর শরীর সত্যিই বদলে যাচ্ছে। সে খুব ভয় পেয়ে গেল।

সে দেখল তার স্বামী পুরোপুরি গিবন হয়ে গেছে। সে অনেক কাদল, ভগবানের কাছে ক্ষমা চাইল। কিন্তু কিছুতেই কোনো লাভ হল না।

সে ধনঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করল, তুমি কীভাবে আবার মানুষে পরিণত হবে আমাকে বলো? আমি তাই করব!

ধনঞ্জয় বউকে বলল, আমি আর কোনো দিন মানুষ হব না। আমাকে এখন গিবনদের সঙ্গে জঙ্গলেই থাকতে হবে।

তুমি দ্রুত হাঁটতে শুরু করো, যাতে গোধুলির আগেই গ্রামে পৌঁছুতে পার। আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে তুমি থেকো।

হয়তো পরের জন্মে আমাদের আবার মিলন হবে।

ধনঞ্জয়ের বউ মনে খুব কষ্ট পেল। সে বলল, আমি তোমার সঙ্গে সুখেশান্তিতে জীবন কাটাতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু ঈশ্বর আমাদের সহায় হল না! আমি কার জন্য বাড়ি ফিরব? আমি এখানেই মরতে চাই! এই বলে সে গাছে মাথা ঠুকতে লাগল।

এতে তার মাথা ফেটে রক্ত ঝরতে লাগল। অবশেষে সে ওই গাছতলায় মারা গেল। ধনঞ্জয় সবই দেখল। কিন্তু আর্ন্তনাদ করা ছাড়া সে আর কিছুই করতে পারল না।

সে শুধু বুকফাটা আওয়াজ তুলল, হু… হু… হুলুক… হুতা…।

পরের জন্মে ধনঞ্জয়ের বউ বনরুই হয়ে জন্মাল। খেরেঞ্জবার ফুলের জন্য তার লোভের কারণে সে আর গিবন হয়ে জন্মাতে পারল না।

প্রতি বছর চৈত্রমাসে খেরেঞ্জবার ফুল ফোটে। আগের জীবনের কথা স্মরণ করে গিবনরা চেঁচায় ‘হু… হু… হুলুক… হুতা বলে।

আর বনরুইরা আগের জীবনের অপূর্ণ প্রত্যাশার কথা মনে করে মাটিতে লেজ আছড়ায়।
এই দম্পতির বিষাদময় জীবন দেখে ঈশ্বর খেরেঞ্জবার ফুল থেকে মিষ্টি গন্ধ তুলে নেয়।

সে কারণে দেখতে সুন্দর হলেও খেরেঞ্জবার ফুলে এখন আর কোনো গন্ধ নেই।

লেখক : আবু রেজা

তথ্যসূত্র : ত্রিপুরা আদিবাসী লোককাহিনী

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা