ত্রিপুরা লোককাহিনীঃ লাল ঘন্টা
889
অনেক কাল আগের কথা। মিজোরামের পাহাড়ে ছিল এক আদিবাসী গ্রাম।
ঐ গ্রামের হেডম্যান রালেকা। তার ছিল সাহসী এক ছেলে। নাম তার সেনেরইয়া। শৈশব থেকেই সেনেরইয়া জুমখেতে চাষের কাজের চেয়ে বনেজঙ্গলে শিকারে যেতেই বেশি পছন্দ করত।
সে ছিল ভালো তীরন্দাজ। তীর ছুড়ে সে অনায়াসেই লক্ষ্যভেদ করতে পারত।
তখন ছিল শীতকাল। একদিন সেনেরইয়া ভোজালি আর তীর-ধনুক নিয়ে গেল বনে। সে বন্যপ্রাণী শিকারের জন্য ওঁত পেতে রইল।
এক সময় সে একটা বড় প্রাণী শিকার করে ফেলল। শিকার করা প্রাণীটি নিয়ে এলো গ্রামে। গ্রামবাসী ওর শিকার দেখে খুব খুশি হল।
শিকার করা প্রাণীটির মাংস সবাই ভাগ করে নিল। শিকারে গেলে সেনেরইয়া কখনোই খালি হাতে ফিরত না।
সব সময় বড় বড় বন্যপ্রাণী শিকার করে ফিরত, যা গ্রামের সবাই ভাগ করে নিত। গ্রামের সবাই তার সাহসের জন্যও গর্ববোধ করত। আশেপাশের গ্রামেও তার শিকারের খ্যাতি ছিল।
সেনেরইয়ার মা-বাবার বয়স হয়েছে। তারা চান সেনেরইয়া বিয়ে করুক।
প্রথমে সে না-রাজি থাকলেও বৃদ্ধ মা-বাবার তাগিদে সে বিয়ে করতে রাজি হল। তবে শর্ত একটাই পাত্রী সে নিজে পছন্দ করবে।
পাশের গ্রামের হেডম্যান জিয়ালুঙ্গার মেয়ে জলখিপরি। সে ছিল খুবই সুন্দরী। আর কাপড় বোনা, নাচে-গানেও বেশ পারদর্শী ছিল সে।
একদিন এক অনুষ্ঠানে সেনেরইয়া এই মেয়েটিকে দেখে পছন্দ করে ফেলে। আর তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেনেরইয়া মা-বাবকে বলে সে জলখিপরিকে বিয়ে করতে চায়।
তার পছন্দের কথা শুনে মা-বাবা জিয়ালুঙ্গার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ঘটক পাঠায়। কিন্তু জিয়ালুঙ্গা পুরানো শত্রুতার কারণে বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।
একথা জানতে পেরে সেনেরইয়া মনক্ষুন্ন হয়। অবশেষে সেনেরইয়া নিজেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে জিয়ালুঙ্গার কাছে যায়।
জিয়ালুঙ্গা একটা শর্তে মেয়েকে তার কাছে বিয়ে দিতে রাজি হল। তাকে একটি লালঘণ্টা এনে দিতে হবে।
সে জানাল, তুইবুয়ান নদীর তীরে থিচুই নামে এক বৃদ্ধা বাস করে। তার কাছে আছে একটি লাল ঘণ্টা। ওটি এনে দিতে পারলেই সেনেরইয়ার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন।
পরদিন সেনেরইয়া লালঘণ্টাটি আনার জন্য সেই বৃদ্ধার খোঁজে বের হল। কয়েকদিন হেঁটে বৃদ্ধা যে গ্রামে থাকে সেই গ্রামে পৌছল সে।
তারপর খোঁজাখুঁজি করে পেয়ে গেল সেই বৃদ্ধাকে। সেনেরইয়া বৃদ্ধাকে সকল ঘটনা খুলে বলল। আর লাল ঘণ্টাটি তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করল।
সেনেরইয়ার ভদ্র আচরণ আর আদবকায়দা দেখে বৃদ্ধা মুগ্ধ হল। একটা শর্তে সে ঘণ্টাটি সেনেরইয়াকে দিতে রাজী হল।
সে বলল, প্রতিদিন একটি বন্যশূকর এসে আমার খেতের ফসল নষ্ট করছে। তুমি যদি বন্যশূকরটাকে ধরে আনতে পার তবে তোমাকে লাল ঘন্টাটি দিতে পারি।
সেনেইরইয়া শর্তে রাজি হল। সে বৃদ্ধার জুমখেতে গেল। সেখানে বন্যশূকরটাকে ধরার জন্য একটা ফাঁদ পেতে রাখল।
তারপর জঙ্গলের ভিতর একটা চৌকিঘর বানিয়ে তাতে রাত কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। মধ্যরাতে সে ফাদ থেকে বন্যশূকরের আওয়াজ শুনতে পেল।
সে গিয়ে দেখল ফাঁদে একটা বন্যশূকর ধরা পড়েছে। সেনেইরইয়াকে দেখে বন্যশূকরটি তেড়ে আসতে চাইল।
ফাঁদে আটকে থাকার কারণে আসতে পারল না।
সেনেইরইয়া কাটারি দিয়ে বন্যশূকরটার একটা কান কেটে ফেলল। তারপর বৃদ্ধাকে এ খবর জানাতে তার বাড়িতে গেল।
বন্যশূকরটি ফাঁদ ভেঙে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ছুটতে পারল না। অবশেষে শূকরটা কান্না শুরু করল।
ওর কান্না শুনতে পেল শূকরদের দলের নেতা। সে এসে দেখল, সবচেয়ে বড় আর শক্তিশালী শূকরটাই ফাঁদে ধরা পড়েছে।
এ অবস্থা দেখে সে চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে বুঝতে পারল, এই শক্তিশালী শূকরটাকে হারালে তাদের মহাবিপদ।
তাই সে ছোট একটা শূকরকে ফাঁদে আটকে রেখে বড় শূকরটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেল।
‘পরদিন সকালে সেনেরইয়া বৃদ্ধাকে নিয়ে জুমখেতে এলো।
বড় শূকরের বদলে ফাঁদে একটা ছোট শূকর দেখে সে তো অবাক! ছোট শূকরটাকে দেখে বৃদ্ধাও খুব রেগে গেল। সে সেনেরইয়াকে বকাঝকা করে চলে গেল।
সেনেরইয়া কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ সে ভাবল। তারপর একটা বুদ্ধি আঁটল। সে ছোট শূকরটাকে ফাঁদ থেকে মুক্ত করে দিল।
শূকরটা মুক্ত হয়েই ছুটতে শুরু করল। আর সেনেরইয়া শূকরটাকে অনুসরণ করতে লাগল।
ছোট শূকরটা জঙ্গলের ভিতর ছুটতে ছুটতে শূকরদের ডেরায় চলে গেল।
ছোট শূকরটাকে দেখে সব শূকর বেরিয়ে এলো। শূকরদের দলনেতা সেনেরইয়ার সামনে এসে দাঁড়াল।
সেনেরইয়া বলল, যে বড় শূকরটি আমার ফাঁদে ধরা পড়েছিল আমি তাকে নিতে এসেছি। তাকে ফিরিয়ে দাও।
শূকরদের দলনেতা এমন ভান করল যেন সে কিছুই জানে না। ঠিক সেই সময় সেনেরইয়ার ফাঁদে ধরা পড়ে কান কাটা যাওয়া বড় শূকরটি এসে পড়ল।
ওর কানটাই সেনেরইয়া কেটে নিয়েছিল। এবার আর দলনেতা আগের রাতের ঘটনা অস্বীকার করতে পারল না।
সে সেনেরইয়ার কাছে বড় শুকরটি হস্তান্তর করতে বাধ্য হল। সেনেরইয়া বড় শূকরটিকে বৃদ্ধার কাছে নিয়ে এলো।
বৃদ্ধা খুশি হয়ে সেনেরইয়াকে লালঘণ্টাটি দিয়ে দিল। লালঘণ্টাটি নিয়ে সেনেরইয়া নিজ গ্রামের দিকে রওনা দিল। গ্রামের কাছাকাছি গিয়েই সে ঘণ্টা বাজাতে লাগল।
ঘণ্টার শব্দ শুনে সবাই তাকে অভ্যর্থনা জানাতে বেরিয়ে এলো। সেনেরইয়া ঘণ্টাটা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য জিয়ালুঙ্গার বাড়ির দিকে ছুটল।
তাড়াতাড়ি পৌছানোর জন্য সে অতি দ্রুত দৌড়াতে লাগল। দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় সে পিছলে পড়ে গেল।
আর ঘন্টাটি হাত ফুসকে পাহাড় থেকে জলাশয়ের মধ্যে পড়ে গেল। সেনেরইয়া পানিতে ঝাপিয়ে পড়ল। খুঁজতে লাগল ঘণ্টাটি।
ঘণ্টাটি খুঁজতে খুঁজতে সে একটি সাপের দেখা পেল। এই সাপটি হল সাপের রাজা। আর এই সাপের রাজাই হল তাদের গোত্রপতি।
এই সাপটিই লালঘণ্টাসহ সেনেরইয়াকে জিয়ালুঙ্গার কাছে নিয়ে গেল। জলখিপরির বাবা জিয়ালুঙ্গা ঘণ্টাটি পেয়ে খুব খুশি হল।
সে সেনেরইয়াকে অনেক ধন্যবাদ জানাল। তারপর সে তার মেয়ে জলখিপরিকে সেনেরইয়ার কাছে বিয়ে দিল।
একটা ভালো দিনে মহা ধুমধামের সঙ্গে জলখিপরি আর সেনেরইয়ার বিয়ে হল। দুই গ্রামের সব মানুষ বিয়েতে অনেক আনন্দ করল।
পাহাড়ের যেখান থেকে ঘণ্টাটি পড়ে গিয়েছিল পরবর্তীকালে সে জায়গাটির নাম হল ডারলন থালং।
যারা সেখানে বাস করত তাদেরও বলা হতো ডারলন। এখানকার ডারলং আদিবাসী নামটি এসেছে ডারলন শব্দটি থেকে।
লেখক : আবু রেজা
তথ্যসূত্র : ত্রিপুরা আদিবাসী লোককাহিনী
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।