icon

ত্রিপুরা লোককাহিনী: অলস পুরোহিত

Jumjournal

Last updated Jan 17th, 2020 icon 821

এক গ্রামে বাস করত এক বৃদ্ধা। সে ছিল খুব গরিব। তার ছিল এক ছেলে। ছেলেকে নিয়েই সে এই গ্রামে থাকত। তার নিজের কোনো জমি। নেই। সংসারে আয় করারও কেউ নেই। তাই তার জীবন চলত খুব কষ্টে। অন্যের জুমখেতে কাজ করে সে সংসার চালাত।

বৃদ্ধার একমাত্র ছেলের নাম অভিরাম। সে যুবক বয়সের একটি ছেলে। কিন্তু সে ছিল খুবই অলস। কোনো কাজ করতে চাইত না, সারাদিন শুধু বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করত।

কখনো আবার পাখি শিকার করতে যেত। সারাদিন আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরত। সে কখনোই গৃহস্থালি কাজে মাকে সাহায্য করত না। এমন কি জুমখেতের কাজেও তার মাকে কোনো সাহায্য করত না। তবুও মা ছেলেটিকে খুব ভালোবাসত।

একদিন বৃদ্ধা ছেলেকে বলল, সকল যুবক ছেলেই জুমখেতে কিছু না কিছু কাজ করে, নিদেনপক্ষে ফসল কাটতে আর বন পোড়াতে সাহায্য করে।

তুমি কেন কোনো কাজ করছ না? তুমি যদি কাজ না কর, তবে আমার পক্ষে তোমার চাহিদা মেটানো আর সম্ভব নয়। মায়ের কথা শুনে ছেলে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল।

একদিন ভোরে অভিরাম একটা ছেট বাঁশের ঝুড়ি আর একটা দা নিয়ে কাজের জন্য বেরিয়ে গেল। বৃদ্ধা মা এতে খুবই খুশি হল। তার অলস ছেলে কাজে বেরিয়েছে, সে আয় করবে, এসব ভেবে মা স্বস্তি পেল।

অনিশ্চয়তা আর দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়ে সে অনেক হালকা বোধ করল। সে মনেরআন্দে গান ধরল। তার খুশি দেখে প্রতিবেশীরা অবাক হল। অভিরাম বলল, হ্যা মা। সে মাকে চিন্তা করতে বারণ করল আর ফসলের জন্য অপেক্ষা করতে বলল।

কিছুদিন পর জুমখেত পোড়ানোর কাজ শুরু হল। বৃদ্ধা অভিরামকে বলল, যদি ভালো ফল পেতে চাও তোভালো করে জুমখেত পোড়াও। সেদিন বৃদ্ধা ছেলেকে সাতটি জুমখেত থেকে আনা সাত রকম মাটি দিল, সাত ঘর থেকে আনা সাত ঘটি পানি দিল, আর দিল সাতটি মশাল।

সে অভিরামকে বলল, জুমখেত পোড়ানোর আগে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে এই প্রার্থনা কোরো যে, জুমখেত পোড়ানোর সময় যদি কোনো প্রজাতির চারাগাছ পুড়ে মারা যায় তো সে তোমার ইচ্ছাকৃত পাপ নয়।

কোনো জীবন্ত প্রাণীকে আহত বা আঘাত করার জন্যও তুমি দায়ী নও। এ অভিরাম জুমখেতে গেল। সে দেখল, যে লতাগুল্মে গত কয়েক দিন আগে কেটে দিয়েছিল সেগুলো শুকিয়ে গেছে।

সে মায়ের উপদেশ ভুলে গেল। প্রার্থনা না করেই সে জুমখেতের লতাগুল্মে আগুন দিল। আগুনের শিখা বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিপিণ্ডে পরিণত হল।

অভিরাম যে জুমখেত পোড়াচ্ছিল সাপের রাজা নাগরাজ ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেখানেই থাকত। আগুনে পোড়ানোর সময় নাগরাজ জুমখেতে ছিল না।

ফিরে এসে দেখল তার ছেলেমেয়েরা পুড়ে মরে গেছে। এ অবস্থা দেখে নাগরাজ খুব রেগে গেল। সে এর প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সে বৃদ্ধার বাড়ি গেল। বৃদ্ধা যে ঘরে থাকে তার চারদিকে সাতবার ঘুরল।

তারপর দরজার সামনে দাড়িয়ে ক্রোধে হিসহিস শব্দ করতে লাগল। বৃদ্ধা বুঝতে পারল তার ছেলে জুমখেত পোড়ানোর কাজে কোনো ভুল করেছে। সে ঘর থেকে বের হতে পারল না।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে অভিরাম দেখল ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। নাগরাজ। সে ঘরে ঢুকতে পারল না। চিৎকার করে সে মাকে ডাকল। মাকে বলল, নাগরাজ কুদ্ধ কেন? ওকে শান্ত করব কীভাবে?

বৃদ্ধা বলল, নিশ্চয় তুমি আমার উপদেশ মতো জুমখেত পোড়ানোর আগে প্রার্থনা করনি। জুমখেতের আগুনে নাগরাজের পরিবারের কেউ হয়তো মারা গেছে। আর তাই নাগরাজ প্রতিশোধ নিতে চায়।

বৃদ্ধা অভিরামকে একটা কালো মুরগি, কিছু ধান, হলুদ, কাটারি, একটা কলাপাতা ইত্যাদি নিয়ে বনের ভিতর মামার কাছে যেতে বলল।

অভিরাম সকল জিনিস নিয়ে মামার খোঁজে বনে গেল। বনে পৌছেই সে উচ্চস্বরে মামাকে ডাকতে লাগল। কিন্তু তার ডাকে কেউ সারা দিল না।

অনেক ডাকাডাকি করে যখন সে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ঠিক তখন দুই পাহাড়ের মাঝ থেকে আসা একটা আওয়াজ শুনতে পেল। অভিরাম সেই বরাবর যেতে লাগল।

সে লম্বা, শক্ত-সমর্থ, কালো চেহারার একজন বৃদ্ধলোক দেখতে পেল। অভিরাম তাকে বলল, মা আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। সে এখন ঘরে বন্দী। নাগরাজ তাকে আটকে রেখেছে। দয়া করে আমাকে সাহায্য করুন।

বৃদ্ধ লোকটি অভিরামের সব কথা শুনল। তাকে শান্ত হতে বলল আর চিন্তা করতে নিষেধ করল। সে অভিরামকে কলাপাতা বিছিয়ে তার উপর কাটারিটা রাখতে বলল।

অভিরামকে আরও বলল, তুমি এখন ওচাই হয়ে পূজা করো। অভিরাম বলল, কীভাবে পূজা করতে হয় তার কিছুই আমি জানি না। আমি কীভাবে ওচাই হব?

বৃদ্ধ অভিরামকে তার নির্দেশনা অনুসরণ করে পূজার মন্ত্র পড়তে বলল। আর মন্ত্র পড়তে পড়তে কলাপাতাটা সাত টুকরো করে কেটে ফেলতে বলল। অভিরাম তাই করল।

এরপর বৃদ্ধ অভিরামকে বাড়ি ফিরে যেতে বলল। অভিরাম দেখল বৃদ্ধ লোকটি মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল।

অভিরাম বাড়ি ফিরে দেখল নাগরাজের শরীর সাত টুকরো করে কাটা। তার মা ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে। সে মামাকে খুঁজে পাওয়ার ঘটনাটা মাকে বলল।

বৃদ্ধা অভিরামকে বলল, যে বৃদ্ধ লোকটির সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল। সে ‘বুড়া দেবতা’ এবং অভিরাম তারই সন্তান। অভিরাম মাকে বলল, আমি সব সময় তোমার উপদেশ মেনে চলব।

তখন থেকে আদিবাসী সমাজে বাধ্যতামূলকভাবে বুড়াচা’র পূজা করা হয়। যে কোনো বিপদ-আপদ বা রোগমুক্তির জন্য এ পূজা করা হয়। যে পূজার অনুষ্ঠান পরিচালনা করে তাকে ‘ডেঙ্গা ওচাই’ বলা হয়।

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।
RSS
Follow by Email
Facebook
Twitter

আরও কিছু লেখা

Leave a Reply