ফিরে দেখা ইতিহাসঃ বাংলাদেশে ত্রিপুরা সাম্রাজ্যের সাক্ষী
1870
বর্তমান বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলই যে একসময় স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ ছিল কিংবা ত্রিপুরা সাম্রাজ্যের অধীন ছিল, ইতিহাস অন্তত সে কথা স্বীকার করে।
যদিও এদেশের পিএইচডি ডিগ্রীধারী ইতিহাসবিদরা বিষয়টি সূক্ষ্মভাবে এড়িয়ে যান। সম্ভবত এর পেছনের কারণটা এমন হতে পারে যে, এতে করে ত্রিপুরাদের কাছে বাঙ্গালিদের নতি স্বীকারের সামিল হবে।
কিন্তু ঐতিহাসিক কালের সাক্ষীগুলোকে তো আর এড়িয়ে যাওয়া যায় না! বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে ত্রিপুরা রাজন্যবর্গের শাসনামলে খনন করা পুকুর-দিঘী, নির্মাণ করা রাস্তাঘাট, হাটবাজার, মন্দির, মসজিদ, স্কুল, ভবন প্রভৃতি স্থাপনা; সেইসাথে হিন্দু ব্রাহ্মণদের মাঝে দান করে যাওয়া বহুগ্রাম। এসবের একটি ছোট্ট বর্ণনা নিম্নে তুলে ধরা হলঃ-
সিলেট জেলা
১। বিজয়পুরঃ মহারাজা বিজয় মাণিক্য (১৫২৮-৬৪) সিলেটের (তৎকালীন শ্রীহট্ট) কিছু গ্রামের সমন্বয়ে “বিজয়পুর” নামে একটি পরগণা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
২। ত্রিপুরা জাঙ্গালঃ “বিজয়পুর” পরগণায় মহারাজা বিজয় মাণিক্য একটি উন্নত রাস্তাও নির্মাণ করেন, যা আজও “ত্রিপুরা জাঙ্গাল” নামে পরিচিত।
৩। মহোদয়া দিঘীঃ মহারাজা দুর্গা মাণিক্য (১৮০৯-১৩) স্বীয় মাতা মহোদয়া দেবীর নামে এই দিঘী তৎকালীন শ্রীহট্ট অঞ্চলে খনন করেন।
৪। হাটখোলা বাজারঃ মহারাজা দুর্গা মাণিক্য স্বীয় মাতাকে তিতাস নদীর তীরে হাটখোলা নামে একটি বাজার এবং তৎসন্নিহিত অঞ্চল তালুক প্রদান করেন। বর্তমানে বাজারটি “মহোদয়াগঞ্জ বাজার” নামে পরিচিত।
মৌলভীবাজার জেলা
১। নির্মাই শিববাড়িঃ বর্তমান শ্রীমঙ্গল উপজেলাস্থ শঙ্করসেনা নামক স্থানে এটি অবস্থিত। মহারাজা ধর্ম মাণিক্য (১৪৩১-১৪৬২) নিজ কন্যা নির্মাইয়ের নামে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৪৫৮ সালে।
২। নির্মাই দীঘিঃ নির্মাই শিববাড়ি মন্দিরটি প্রতিষ্ঠাকালে মহারাজা ধর্ম মাণিক্য মন্দিরের সংলগ্নে এই বিশাল দিঘীটি খনন করেন।
৩। মহারাজার কাছারিবাড়িঃ ১৮৯৭ সালে ত্রিপুরা মহারাজা রাধা কিশোর মাণিক্য এ কাছারিবাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন। এ কাছারি বাড়িটি ১.৬৭ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত। শতাধিক বছরের পুরোনো কাছারি বাড়িটি ৩টি কক্ষ, ৮টি দরজা ও ৯টি জানালা বিশিষ্ট ১ তলা ভবন, যা প্রস্থে ৩০ ফুট ও দৈর্ঘ্যে ২০ ফুট লম্বা। প্রতিটি দেয়াল ১২ ইঞ্চি চওড়া চুন সুরকি দ্বারা নির্মিত।
৪। কাছারিবাড়ির পুকুরঃ কাছারিবাড়ির পাশেই রয়েছে শান বাঁধানো ঘাটসহ একটি বিশাল পুকুর, যেটি কাছারিবাড়ির নির্মাণকালে খনন করা হয়েছিল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা
১। কমলা সাগরঃ বর্তমান কসবা উপজেলায় অবস্থিত এই বিশাল দিঘীটি মহারাজা ধর্ম মাণিক্য (১৪৩১-১৪৬২) স্বীয় মহিষী কমলা দেবীর নামে খনন করেছিলেন।
২। গুণ সাগরঃ কসবা উপজেলাস্থ জাজিয়াড়া গ্রামে এই দিঘীটি অবস্থিত। মহারাজা গোবিন্দ (১৬৬০-৭৬) স্বীয় মহিষী গুণবতী দেবীর নামে ১৬৬২ সালে দিঘীটি খনন করেছিলেন।
৩। গঙ্গা সাগরঃ মহারাজা রামগঙ্গা মাণিক্য (১৮১৩-২৬) তাঁর রাজত্বকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোগড়াপারা গ্রামের নিকটে স্বীয় নামে এই বিশাল দিঘীটি খনন করেছিলেন।
৪। রাধামাধব মন্দিরঃ মন্দিরটি বর্তমান আখাউড়া রেলস্টেশনের নিকটে অবস্থিত। মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহারাজা কৃষ্ণ মাণিক্য (১৭৬৩-৮৩)।
নারায়ণগঞ্জ জেলা
১। দেবদিঘীঃ মহারাজা দেব মাণিক্য (১৫২০-২৮) তাঁর রাজত্বকালে বঙ্গদেশ বিজয়কে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য সুবর্ণগ্রামে (সোনারগাঁ) একটি বিশাল দিঘী খনন করেন। দিঘীটি “দেবদিঘী” নামে আজও বিদ্যমান।
কুমিল্লা জেলা
১। ধর্ম সাগরঃ মহারাজা ধর্ম মাণিক্য (১৪৩১-৬২) স্থানীয় প্রজাদের পানীয় জলের সুবিধার্থে স্বীয় নামে বিশাল এই দিঘীটি খনন করেন। মহারাজা দিঘীটি উৎসর্গ করেন ১৪৫৮ সালের বৈশাখ মাস, সোমবার, শুক্লা ত্রয়োদশ তিথিতে। দিঘীটি উৎসর্গকালে তিনি ৭ জন ব্রাহ্মণকে ২৯ দ্রোণ শস্যপূর্ণ ভূমি দান করেন।
২। জগন্নাথ মন্দিরঃ মহারাজা অমর মাণিক্য (১৫৭৭-৮৬) তাঁর রাজত্বকালে এই জগন্নাথ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।
৩। চৌদ্দগ্রামঃ জগন্নাথ মন্দিরটি উৎসর্গকালে মহারাজা অমর মাণিক্য ব্রাহ্মণ ও প্রজা সাধারণের মাঝে চৌদ্দটি গ্রাম তাম্র সনন্দে দান করেন, যা পরবর্তীকালে চৌদ্দগ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে এটি কুমিল্লার একটি প্রসিদ্ধ উপজেলা।
৪। শাহ সুজা মসজিদঃ মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য (১৬৬০-৭৬) কুমিল্লা নগরীর মুসলিম প্রজাসাধারণের জন্য স্বীয় বন্ধু শাহ সুজার নামে এই মসজিদটি নির্মাণ করে দেন ১৬৬৭ সালে।
৫। গোবিন্দ মাণিক্য দীঘিঃ মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য চৌদ্দগ্রামের বাতিসা গ্রামে স্বীয় নামে এই বৃহৎ দিঘীটি খনন করেন।
৬। সতের রত্ন মন্দিরঃ মহারাজা দ্বিতীয় ধর্ম মাণিক্য (১৬৮৫-১৭১২) তাঁর রাজত্বের শেষভাগে কুমিল্লার জগন্নাথপুরে প্রসিদ্ধ এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় তিনি তা সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। তাঁর উত্তরসূরী মহারাজা কৃষ্ণ মাণিক্য (১৭৬০-৮৩) মন্দিরটির কাজ সমাপ্ত করেন।
৭। নানুয়ার দীঘিঃ কুমিল্লা শহরের পূর্ব অংশে ত্রিপুরা মহারাজা ধর্ম মাণিক্যের স্বীয় মহিষী ধর্মপরায়না নানুয়ার দেবীর নামে এই সুবৃহৎ দীঘিটি খনন করেন।
৮। রানীর দীঘিঃ ত্রিপুরার মহারাজা কৃষ্ণ মানিক্যের সহর্ধমিনী জাহ্নবি দেবী কর্তৃক ১৭৮৪-১৭৮৫ সালে এই দীঘিটি করেন কুমিল্লা শহরের মধ্যস্থানে। যার পশ্চিমপাড়ে ভিক্টোরিয়া কলেজ অবস্থিত।
৯। তালপুকুরঃ ঐতিহ্যবাহী এই পুকুরটির খনন কালের কোন সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও অনুমান করা হয় যে, এ পুকুরটিও ত্রিপুরার রাজপরিবারের অর্থানুকূল্যেই খনন করা হয়েছিল।
১০। বীরচন্দ্র গণ-পাঠাগার ও নগর মিলনায়তনঃ এটি ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে ১০ বিঘা জমির ওপর নিজ অর্থায়নে এ ভবন নির্মাণ করেন। এটিই কুমিল্লা টাউন হল নামে পরিচিত। এ অঞ্চলের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে টাউন হলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
১১। মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্যের অসামান্য কৃতিত্বঃ মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য (১৯২৩-৪৭) তাঁর রাজত্বকালে স্বাধীন ত্রিপুরা রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ, বাণিজ্যিক নগরী- কুমিল্লাতে জেলা বোর্ড, কুমিল্লা হাসপাতাল, মাধ্যমিক ইংরেজি স্কুল, বালিকা বিদ্যালয়, অভয় আশ্রম, তত্ত্বসভা ভবন, খাদিমূল ইসলামী মাদ্রাসা, হিন্দুসভা ভবনসহ আরও বহু স্থাপনা নির্মাণ করেন।
ফেনী জেলা
১। রাজাঝির দীঘি বা রাজনন্দিনীর দীঘিঃ মোট ১০.৩২ একর আয়তন বিশিষ্ট এ দীঘিটি ফেনীর ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানের একটি। ফেনী জেলার জিরো পয়েন্টে ফেনী রোড ও ফেনী ট্রাংক রোডের সংযোগ স্থলে এটি অবস্থিত। জনশ্রুতি আছে, প্রায় ৫/৭ শত বছর পূর্বে ত্রিপুরা সাম্রাজ্যের এক প্রভাবশালী মহারাজা তার কন্যার অন্ধত্ব দূর করার মানসে দৈব্যস্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে এ দীঘিটি খনন করেন। স্থানীয় ভাষায় কন্যা-কে “ঝি” বলা হয়। তাই দীঘিটির নামকরণ করা হয় ‘রাজাঝির দীঘি’।
১৮৭৫ সালে ফেনী মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হলে তার সদর দপ্তর গড়ে তোলা হয় এই রাজাঝির দীঘির পাড়ে। দীঘির পাড়ে বর্তমানে ফেনী সদর থানা, ফেনী কোর্ট মসজিদ, অফিসার্স ক্লাব, জেলা পরিষদ পরিচালিত শিশু পার্ক সহ ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন গড়ে উঠেছে ।
চট্টগ্রাম জেলা
১। চট্টেশ্বরী মন্দিরঃ এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন মহারাজা ধন্য মাণিক্য (১৪৯০-১৫২০)। মন্দিরটি উৎসর্গকালে মহারাজ ব্রাহ্মণ ও সেবায়েতদের মাঝে ভূমি সম্প্রদান করেন এবং উক্তস্থলে দুর্গোৎসব করেন। এই দুর্গোৎসবটি ছিল ত্রিপুরা রাজ্যভুক্ত চট্টগ্রামের প্রাচীনতম দুর্গোৎসব।
২। চট্টেশ্বরী দিঘীঃ চট্টেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠাকালে মহারাজা ধন্য মাণিক্য প্রজাদের পানীয় জলের সুবিধার্থে এই সুপরিসর দিঘীটি খনন করেন।
৩। শম্ভুনাথ মন্দিরঃ সীতাকুণ্ড তীর্থস্থানের এই মন্দিরটি মহারাজা ধন্য মাণিক্য ত্রিপুরা জাতির স্থাপত্য শৈলীর অনুকরণে চতুষ্কোণ ও চৌচালা আদলে নির্মাণ করেন। মন্দিরটি নির্মাণ পূর্বক মহারাজা ব্রাহ্মণ ও সেবায়েতদের মাঝে তাম্র সনন্দ দ্বারা বিস্তর ভূমি দান করেন। উল্লেখ্য যে, মন্দিরটিতে প্রতিষ্ঠিত শিব বিগ্রহটি ছিল প্রকৃতিগতভাবে উৎপন্ন। সেজন্য মন্দিরের নাম রাখা হয়েছিল স্বয়ম্ভুনাথ, যা পরবর্তীতে “শম্ভুনাথ” নামে পরিচিতি লাভ করে।
৪। শ্রী শ্রী অন্নপূর্ণা মন্দির ও বিরুপাক্ষ মন্দিরঃ সীতাকুণ্ড তীর্থস্থানের এই মন্দির দুইটি মহারাজা বিজয় মাণিক্য (১৫২৮-৬৪) ১৫৫০ সালে নির্মাণ করেন।
৫। চন্দ্রনাথ মন্দিরঃ সীতাকুণ্ড তীর্থস্থানের এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য (১৬৬০-৭৬)। তিনি শিব যজ্ঞাদি করে মন্দিরটি উৎসর্গ করেন এবং তাম্র সনন্দে ব্রাহ্মণদের মাঝে ভূমিদান করেন।
৫। গোবিন্দ সাগরঃ চন্দ্রনাথ মন্দিরটি নির্মাণ পূর্বক মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্য স্বীয় নামে এই দিঘীটি খনন করেন। দিঘীটি বর্তমানে সীতাকুণ্ডস্থ রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম ও গিরিশ ধর্মশালার উত্তরপার্শ্বে বিদ্যমান রয়েছে।
৬। মা ভবানী মন্দিরঃ সীতাকুণ্ড তীর্থস্থানের এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য (১৮৬২-৯৬)। তিনি ১৮৭৬ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।
৭। রাণী তুলসীবতী বিরাম ছত্রঃ সীতাকুণ্ড তীর্থক্ষেত্রের এই বিরাম ছত্রটির নির্মাতা মহারাজা রাধা মাণিক্য (১৮৯৬-১৯০৯)। তিনি ১৮৯৭ সালে বিরাম ছত্রটি নির্মাণ করেন। সংস্কারের অভাবে বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে।
৮। ভৈরব মন্দিরঃ মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্য মাণিক্য (১৯০৯-২৩) সীতাকুণ্ড তীর্থস্থানে ১৯১১ সালে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন, যা আজোবধি বিদ্যমান।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা
১। শ্রী শ্রী ত্রিপুরা সুন্দরী কালীবাড়ি মন্দিরঃ মন্দিরটির অবস্থান রাংগামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা থানাধীন রাইখালী ইউনিয়নের রাইখালী রাজারে। এ মন্দিরটি রাংগামাটি জেলার ২য় বৃহত্তম মন্দির। মন্দিরটি আধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধা নিয়ে গড়ে উঠেছে। এ মন্দিরে সকল ধরণের পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
মন্দিরের গেইটে উল্লেখিত তথ্যমতে, মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৯১০ সালে। তবে, রাঙ্গামাটির শিক্ষক Satyajit Tripura দাদার তথ্যমতে, ত্রিপুরা মহারাজা বিজয় মাণিক্য তাঁর শাসনামলে (১৫২৮-৬৪) চন্দ্রঘোনার রাইখালী বাজারে প্রথম দুর্গা পূজার আয়োজন করেছিলেন। তাঁরই স্মৃতিস্বরূপ পরবর্তীতে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা
১। মাণিক্য দিঘীঃ মহারাজা গোবিন্দ মাণিক্যের (১৬৬০-৭৬) স্বেচ্ছা-নির্বাসন জীবনকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য স্থানীয় ১২ জন রিয়াং সর্দারের নির্দেশে ১২টি ছোট-বড় দিঘী খনন করা হয়। দিঘীর সমাহারের কারণে পরবর্তীকালে উক্ত অঞ্চলটি “দীঘিনালা” নামে পরিচিতি লাভ করে।
বর্তমানে কেবল একটি দিঘীর অস্তিত্ব রয়েছে, যা “মাণিক্য দিঘী” নামে পরিচিত। অবশিষ্ট ১১টি দিঘীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয় যে, হয়তো সেসব দিঘীগুলো বর্তমান স্থানীয় লোকজনের ব্যক্তি মালিকাধীন পুকুর হয়ে গেছে কিংবা মাটি ভরাট করে ফেলা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা
১। বীর কমলার দীঘিঃ ১৫১৩-১৪ সালে মহারাজা ধন্য মাণিক্যের (১৪৯০-১৫২০) শাসনামলে ত্রিপুরা রাজ্যের অখণ্ডতার রক্ষার্থে ত্রিপুরা সেনাবাহিনী রোসাং (বিশেষত বর্তমান কক্সবাজার জেলা) আক্রমনের মাধ্যমে রামু-চকরিয়া দখল করে নেন।
সেই বিজয়কে স্মৃতি রক্ষার্থে ত্রিপুরা সেনাবাহিনী একটি দিঘী খনন করেন, যা মহারাজার স্বীয় মহিষী কমলা দেবীর নামে উৎসর্গ করা হয়।
সেই দিঘীটি আজও কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলায় কাকারা ইউনিয়নে ‘বীর কমলার দিঘী’ নামে সগৌরবে ও স্বীয় মহিমায় ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে।
তথ্য সূত্রঃ
১। “ত্রিপুরা জাতি” – শোভা রাণী ত্রিপুরা (পার্বত্য চট্টগ্রামের শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকার সম্মাননা প্রাপ্ত এবং বেগম রোকেয়া পদক প্রাপ্ত লেখিকা)
২। “ত্রিপুরা জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি” – প্রভাংশু ত্রিপুরা (বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক ও গবেষক)
৩। “নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শত বছরের পুরনো কাছারি বাড়ি” – www.zerohour24.com, 27 October, 2018
৪। “বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনজাতি” (সম্পাদনা) – বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ
৫। “শ্রীমঙ্গলের শ্যামলিমায়” (ভ্রমণ গাইড) – ইসমাইল মাহমুদ, আতাউর রহমান কাজল
৬। YAKHLWI (Newspaper, 2013)
৭। www.comillasadar.comilla.gov.bd
৮। “কুমিল্লা ব্যাংক আর ট্যাঙ্কের শহর” – কুমিল্লার কাগজ, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৬
১০। www.feni.gov.bd
১১। www.kaptai.rangamati.gov.bd
১২। “বীর কমলার দিঘি” – প্রথম আলো, ২২ জানুয়ারী ২০২০
************************************************
এখানে জানিয়ে রাখা আবশ্যক, স্বাধীন ত্রিপুরা রাষ্ট্রটি কোনকালেই ভারতের অঙ্গীভূক্ত রাজ্য ছিল না, কোনকালেই মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়নি, এমনকি ব্রিটিশ শাসনাধীনেও চলে যায়নি। ত্রিপুরা জাতি সর্বদাই স্বাধীন জাতির মর্যাদায় সমাসীন ছিল।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ৪৭’র দেশ ভাগের সময়েও স্বাধীন ত্রিপুরার জাতীয় পতাকা উদীয়মান ছিল।
এর মাত্র দুই বছর পর অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, রাষ্ট্রীয় গোলযোগের সুযোগ নিয়ে ভারত সরকার নিজস্ব সেনাবাহিনীর সহায়তায় স্বাধীন ত্রিপুরা রাষ্ট্রকে ‘Merger Agreement’-এর মাধ্যমে জোরপূর্বক দখলে নেয়। এর ফলে স্বাধীন ত্রিপুরা রাষ্ট্রটি ভারতের অঙ্গীভূত রাজ্য হিসেবে গন্য হয়।
যদি আজও স্বাধীন ত্রিপুরা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকতো, তবে কি বাংলাদেশের ইতিহাসবিদগণ ত্রিপুরা সাম্রাজ্যের ইতিহাসকে অস্বীকার করতে পারতেন? মনে হয় না- তারা তা করতে পারতেন।
তারা বরং বর্মণ, দেব, কাম্বোজ, পাল, সেন, মুঘল প্রভৃতি রাজবংশের মতো ‘ত্রিপুরা রাজবংশ’কেও বাংলাদেশের ইতিহাসে স্থান দিতে বাধ্য হতেন।
কারণ, সকল প্রকারের ঐতিহাসিক উপাদান ও গৌরব আমাদের ত্রিপুরা জাতির রয়েছে, আছে এবং থাকবে। এর স্বপক্ষে উপর্যুক্ত তথ্যগুলোই যথেষ্ট।
আশাবাদী মানুষ হিসেবে আমি আজও স্বপ্ন দেখি, একসময় বাংলাদেশের ইতিহাসে “ত্রিপুরা রাজবংশ” নামে একটি অধ্যায় সংযোজিত হবে।
আশা রাখি, সুশীল সমাজ, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী লেখক, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদগণ এ বিষয়ে এগিয়ে আসবেন।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখিকা শোভা ত্রিপুরা যথার্থই বলেছেন, “ত্রিপুরাদের সম্পর্কে প্রকাশিত পুস্তক এবং স্কুল পাঠ্য বইয়ে অনেক ভুল তথ্য দেওয়া আছে। সেখানে ত্রিপুরাকে সামান্য একটি উপজাতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ত্রিপুরাকে তুচ্ছার্থে টিপরা বা ত্রিপুরা উপজাতি বলা হয়েছে যা বেদনাদায়ক। পাঠ্য-পুস্তকের এই সকল ভুল সংশোধনের প্রয়োজন।”
সেইসাথে বাংলাদেশে আজও বিদ্যমান ত্রিপুরা সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক কালের সাক্ষীসমূহের সংরক্ষণে আমাদের সকল ত্রিপুরাকেই উদ্যোগী হয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
কারণ, যেসব গৌরবের ইতিহাস আমরা অর্জন করেছি, সেসব গৌরবের ইতিহাস রক্ষার দায়িত্ব আমাদেরই। সেসব ইতিহাসের মাঝেই রয়েছে আপনার, আমার তথা সমগ্র ত্রিপুরা জাতির অস্তিত্ব। সেসব ইতিহাস আমাদের কখনই ভোলা উচিত নয়।
লেখক: মুকুল ত্রিপুরা
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।