ত্রিপুরা লোককথাঃ মিষ্টি বাশির সুর

Jumjournal
Last updated Mar 26th, 2020

711

featured image

ভীষণ তেষ্টা পেয়েছিল এক বুনো শুকরের। গ্রীষ্মের দুপুর। বৃষ্টি হয়নি অনেক দিন।

গাছ-গাছালির পাতার ছায়ায় বনের মাটি যদিও শীতল, একটানা অনেকদিন বৃটির ছোঁয়া না পেয়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে মাটির বুক।

এখনই বৃষ্টি আসুক চাইছিলো সবাই। গাছপালা, পোকা-মাকড়, পশু, পাখি এমনকি বাতাসও।

পাহাড়ের চড়াই-উত্রাইয়ের মাঝামাঝিলুংগা জমিতে শীতলতা আরো বেশী। গুমোট গরম আর তেষ্টায় মেদবহুল বুলো শুকরের সে কি করুণ অবস্থা।

কিছুই ভাল্লাগছিলোনা। একটু স্বস্তির খোজে নেমে গিয়েছিলো সে লুংগায়।

লুংগার মাটি এমন শুকননা,তবে অনেক নরম। এক ফোটা জলের জন্যে মরিয়া হয়ে শক্ত চোয়াল দিয়ে মাটি খুঁড়ে চলছিল শুকর।

উপরের শক্ত আস্তরণ ভেঙ্গে অপেক্ষাকৃত অনেক নরম মাটি খুঁড়ে যাচ্ছিলো সে।

নাকে আসছিল ঠান্ডা জলের গন্ধ। তেষ্টা বাড়ছিল তার প্রতি পলে। আরো আরো দ্রুততায় খুঁড়ছিল শুকর।

খুঁড়তে খুঁড়তে এক সময় ঠোটে, চোয়ালে, নাকের ডগায় জলের স্পর্শ। ভেজা, ঠান্ডা মাটির নীচের বুননা মূল চিবিয়ে জলের অভাব কিছুটা মিটাতে পেরেছিল সে।

খুব ক্ষিদে পেলে যেমন, তেমনটা খাওয়া যায় না। বেশী তেষ্টা পেলে অল্প জলেই তৃপ্তি আসে।

অনেক চেষ্টায় তেষ্টা মিটিয়ে গর্তের পাশে বিশ্রাম নিচ্ছিল শুকর। গর্তের তলার মাটি চুইয়ে বেশ কিছু জল জমে গিয়েছিল ততক্ষণে।

দুরের পাহড়ি ঝর্ণা ছাড়া বনের এই অঞ্চলে ধারে কাছে কোথাও জল নেই। এই অবস্থায় গর্তের জল সুরক্ষিত রাখতে চাইল শুকর।

জলের খোঁজে যখন তখন যে কেউ এখানে চলে আসবে এবং গর্তের জলে চেষ্টা মেটাবে। কাজেই একজন বিশ্বস্ত পাহাড়াদার দরকার।

পশের গছের ডালেবসা একটি দোয়েল পাখিকে জল পাহাড়ার দায়িত্ব দিল শুকর। বললো, তেষ্টা পেলে এই গর্তের জলই খেয়ে নিও তুমি।

তবে হ্যাঁ। তুমি ছাড়া অন্য কেউ যেন না খায় এই জল। পাখিকে জল পাহাড়ার দায়িত্ব দিয়ে শুকর চলে গেল খাবারের খোঁজে। শুকর চলে যাবার কিছুক্ষণ পরেই একটি খরগোশ এল। জল খেতে।

খরগোশকে দেখে দোয়েল পাখি গর্তের জল না খেতে অনুরোধ করলাে। পাখি বললেঅ,“ভাই খরগোশ তুমি যদি এই গর্তের জল পান করো তাহলে শুকর এসে আমাকে মেরে ফেলবে।

শুনে খরগোশ বললো, তোমার শুকর বন্ধু দেখতে কেমন?

পাখি বললো “শুকর বন্ধু চোখ দুটো মোরগের ডিমের মতো বড় ওর দাঁতগুলো কুঠারের মাতা ধারালো এবং লেজ কুকুরের লেজের সমান, পাখির কাছে শুকরের বর্ননা শুনে খরগোশ ভীষণ ভয় পেল এবং তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে পালিয়ে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে একটি হরিণ শাবক এলো। খুব তেষ্টা পেয়েছিল তার। শুকরের খোঁড়া গর্তের জল দেখে একদমইতর সইছিলোনা।

ব্যাপার দেখে পাখি হরিণ শাবককে গর্তের জল খেতে বারণ করলো।

হরিণ শাবক কারণ জানতে চাইতে পাখি জানালো সব কথা। বললো “খুব কষ্ট করে গর্ত খুঁড়ে জলের সন্ধান পেয়েছে শুকর।

এই জল যাতে অন্য কেউ ব্যবহার না করে তার জন্যে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে সে। আর আমি যদি এই দায়িত্ব পালন করতে না পারি তাহলে ফিরে এসে আমাকে মেরেই ফেলবে সে”।

সব শুনে হরিণ শাবক বললো।তা কেমন দেখতে তোমার শুকর বন্ধু ?” –মোরগের ডিম দেখেছো? — শুকর বন্ধুর চোখ দুটো যেন এক একটা মোরগের ডিম।

দাঁতের ধার? সে কুঠারের থেকেও ধারালো। আর লেজ? তা কম করেও ছয়টি কুকুরের লেজের সমান।

শুকরের বর্ণনা শুনে হরিন শাবকও ভয় পেল এবং জলের খোঁজে বনের অন্য প্রান্তে চলে গেল।

এমনি করে অনেকেই এল কিন্তু শুকরের ভয় দেখিয়ে সবাইকে ফিরিয়ে দিল পাখিটি। এক সময় মস্ত এক বাঘ এলো সেখানে জল পান করতে।

বাধা দিল পাখি। জানালো সব। শুকরের দেহের বর্ণনাও দিলো।

সব শুনে বাঘ বললো, “তোমার শুকর বন্ধুর কি আমার মতো তীক্ষ্ণ, ধারালো নখ আছে? “পাখি বললো,“না” “এমন শক্ত পোক্ত গোঁফ আছে কি তোমার শুকর বন্ধুর? শুচালো দাঁত।

এবারো পাখি বললো না।

বেশ আত্মপ্রত্যয় নিয়ে বাঘ বললো, তোমার শুকর বন্ধুর যদি আমার নখের মতো তীক্ষ্ণ ধারালো নখ এবং আমার গোফের মতো শক্ত, পোক্ত গোঁফ না থাকে তাহলে জেনে রাখো আমি তোমার শুকরবন্ধুর থেকে অনেক বেশী শক্তিধর।

সুতরাং, আমি অনায়াসে এই জল খেতে পারি।” এই বলে বাঘটি শুকরের খোঁড়া গর্তের জল খেতে লাগলো।

বাঘের কান্ড দেখে তৎক্ষণাৎ পাখি উড়ে গেল এবং খুঁজে খুঁজে শুকর বন্ধুকে খুঁজে বের করে জানালো সব কথা।

সবশুনে শুকরের ভীষণ রাগ হলো। বাঘকে সাজা দেবায় উদ্দেশ্যে সে সেই গর্তের দিকে ছুটলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেল।

আকাশ পথে উড়ে পাখিও পৌঁছে গেল সেখানে। শুকর পোঁছানোর অনেক আগেই।

শুকরের খোঁড়া গর্তের সব জল পান করে তৃপ্ত হয়ে বাঘ শুয়ে পড়েছিল গর্তের পাশে – গাছের ছায়ায়।

দৌড়াতে দৌড়াতে শুকর পৌঁছালো সেখানে। এবং অতর্কিতে ঝাপিয়ে পড়লো বাঘের উপর।

শক্ত চোয়াল দিয়ে গুতো মারলো বাঘের পেটে বাঘও ঝাপিয়ে পড়লো শুকরের উপর। শুরু হলো লড়াই।

আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে এক সময় দুজনেই হয়ে গেল নিস্তেজ। মরে গেল বাঘ ও শুকর।

চোখের সামনে বন্ধু শুকরের এমন পরিণতি দেখে খুব দুঃখ পেল পাখি। বাঘের উপর খুব রাগ হলো তার।

বনের অনেক পাখিই প্রত্যক্ষ করল এই ঘটনা, মৃত পশুর মাংস-খেতে অনেক পশুই এলো সেখানে।

রেগে মেগে মৃত বাঘের মাংস টুকরো টুকরো করে খেলো সেই পাখিটিও। ক্ষিদের চোটে নয়, শুকর বন্ধুকে মেরে ফেলার জন্যে ক্রোধে।

হিংসা, ও ক্রোধের পরিবেশ কিছুক্ষণ পর শান্তি হলো। বাঘ ও শুকরের দেহ মাংস ভূক পশু, পাখিরা খেয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিল। পড়েরইলো হাড়গুড়।

শুকরের বন্ধু পাখির মাংস খাওয়ার অভ্যেস ছিল না। হঠাৎ করে বাঘের মংস খাওয়ায় ভাল হজম হলো না। অম্বলে পেট ফুলে টইটুম্বুর।

অশ্বস্তিতে আফসোস করতে করতে এক সময় মরেই গেল পাখিটি। মরে গিয়ে পড়ে রইলো শুকনো বাঁশ পাতার উপর।

শুকরের বন্ধু পাখির মৃতদেহ পড়ে থাকা শুকনো বাঁশ পাতার স্তুপের নীচের গর্তে থাকতো এক ইদুর।

বাঘ-শুকরের ধস্তাধস্তি, লড়াইয়ের শব্দ শুনতে পেয়েছিল সে। কিন্তু ভয়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে উপরে এসে দেখার সাহস ছিল না তার।

রাগ, হিংসা, যুদ্ধের চরম পরিণতি মৃত্যুর পর শান্ত হলো পরিবেশ, গর্ত থেকে বেরিয়ে ইদুর দেখলো বাঘ, শুকর আর পাখির মৃত দেহাবশেষ।

এমন ঘটনায় খুব দুঃখ পেল ইদুর বিশেষ করে পাখির মৃত দেহ দেখে।

পাখির পায়ের হাড় দিয়ে একটি বাঁশি বানালো ইদুর। কেমন হয়েছে বাঁশি পরখ করে দেখার জন্য যুঁদিয়ে বাঁশি বাজাতে লাগল সে।

মিষ্টি বাঁশির সুরে অবিষ্ট হলো চারপাশ। পাশের এক বানরের খুব ভাল লাগল সেই বাঁশির সুর। এই বাঁশি আমার চাই-ই ভাবল বানর।

বাঁশির সুর শুনে শুনে ইদুরের কাছে পৌঁছে গেল বানর। ইদুরের খুব তারিফ করল। ইদুর খুব খুশী হলো মনে মনে।

বিনয়ের সাথে বানরকে বলল এ আর তেমন কিছু কি। একটু চেষ্টা করলে আপনিও পারবেন। এই বলে ইদুর আবার বাঁশি বাজাতে লাগল।

চাইলে কিছুতেই দেবেনা এই বাঁশি বুঝল বানর। শখের বাঁশি বলে কথা। ইদুরের কাছ থেকে জোর করে বাঁশি ছিনিয়ে নবার মতলব আঁটল সে।

হাতে করে বুননা আঠা লাগিয়ে দিল বানর। বুনো তরুক্ষীর লাগতেই জ্বালা করতে লাগল চোখ ইদুরের।

চোখ খুলতেও পারছিলনা সে ইদুরের বাঁশি ফেলে চোখে হাত দিল ইদুর। সেই সুযোগে ইদুরের বাঁশি নিয়ে পালিয়ে গেল বানর।

প্রিয় বাঁশি হারিয়ে কাঁদতে লাগল ইদুর। বুনো গাছের আঠায় চোখ বন্ধ হয়ে , আছে। খুলতে পারছিলনা সে।

ইদুরের কান্না শুনে এক চিল এল। চিলকে সব খুলে বলল ইদুর। বলল বানরের দুষ্টুমির কথা।

চিল খুব যত্নে তার ঠোট দিয়ে ইদুরের চোখ থেকে বুনো গাছের আঠা সব সরালো। ইদুর দেখতে পেল চোখে।

কিন্তু চোখের থেকেও প্রিয় বাঁশির জন্যে আমার বাঁশি, আমার বাঁশি” বলে কেঁদেই চললো৷

ইদুরকে অভয় দিয়ে চিল বলল, কেঁদোনা ভাই। বানরের কাছ থেকে এনে তোমার বাঁশি তোমাকে দেবোই।

 এর মধ্যে বানর পৌঁছে গেছে আস্তানায়। গাছের ডালে বসে আয়েশ করে আনাড়ির মতো বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছিল বানর।

চিল ও ইদুর শুনল সে সুর। ইদুরের মন খারাপ করে ইদুর চলে গেল গর্তে। চিল উড়ে গেল বানরের সন্ধানে।

অনবরত ফু দিয়েই যাচ্ছিল বানর বাঁশিতে। কিছুক্ষণ বসে থেকে চিল বললো “বা! দারুণ বাজান তো আপনি!

বাঁশির এমন মিষ্টি সুর অনেকদিন শুনিনি।” চিলের কথা শুনে বানর বাঁশিতে ফু দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিল।

তা দেখে চিল বলল,“একি! বাজানো বন্ধ করলেন কেন! দয়া করে বাজান, আমি শুনবো।

এমন ঘটনার জন্যে বানর প্রস্তুত ছিলনা। বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে শব্দ করা আয়ত্বে আনার চেষ্টা করছিল সে।

এমন শব্দকে সুর’ হিসাবে চিলের ভাললাগার জন্যে বানর ভাবল,“এ নিশ্চই আশ্চর্য বাঁশি—ফু দিলেই সুরেলা শব্দ বেরোয়।

এমন ভেবে বানর সেই বাঁশিতে ফুঁ দিয়েই চললো। কিছুক্ষণ তা শুনে চিল বলল, “বাঃ! ভারি মিষ্টি। এমন মিষ্টি সুর অনেকদিন শুনিনি।

উৎসাহে বানর ফু দিয়ে চললো বাঁশিতে। এক সময় ক্লান্ত হয়ে বানর ফু দেয়া থামাল। সুযোগ বুঝে চিল বললো, “এমন সুন্দর বাঁশি। আমাকে একটু বাজাতে দেবেন?”

 আসলে চিল খুব ভালো বাঁশি বাজাতে জানে। চোরের মনে খিরা ক্ষেতে। চিলের অনুরোধ শুনে বানর ভাবলো,“চিল নিশ্চই আমাকে ঠকিয়ে বাঁশি নিয়ে যেতে এসেছে।”

বানর বলল,“আজ আর ভাল্লাগছেনা ভাই। কাল এসো তোমাকে অনেক্ষণ বাঁশি বাজিয়ে শোনাবো।” চিলের তো মনে অন্য বুদ্ধি,—সে বানরকে বললো,“বাঁশিটা আমার কাছে দাওনা ভাই! একটু চেষ্টা করে দেখি – বাজাতে পারি কি না?

চিলের কথা শুনে বানর ভাবল,“কি আর করবে। বাঁশিতে ফু দেবে। তা দিক না। কিন্তু চিল যদি বাঁশি নিয়ে আকাশে উলে যায় ? – না! তা হাতে দেবো না।

এই ভেবে বানর বললো, “ভাই চিল! ব্যপার কি জানো! —অনেক কষ্ট করে এই বাঁশি সংগ্রহ করেছি। দেখার জন্যে তোমাকে দেবো ঠিকই।

তবে কিছু শর্ত সাপেক্ষে।” চিল বললো—উচু আকাশে উড়তে উড়তে অনেকের অনেক রকম বাঁশিই শুনি ভাল লাগে। বাঁশির এমন মধুর সুর শুনতে যে কোন শর্তই আমি মানতে রাজি।

সব শুনে বানর বললো,“তুমি যে আমার বাঁশি নিয়ে পালিয়ে যাবে না – তার প্রমাণ কি? এবার চিল বললো –“যখন আমি বাঁশি বাজাবো তখন তুমি আমায় লেজের পুচ্ছ ধরে থেকো – যাতে আমি বাঁশি নিয়ে পালিয়ে যেতে না পারি। — বানর রাজী হলো এবং বাঁশিটি চিলের হাতে দিয়ে দিল।

এমন বাঁশি পেয়ে চিল বাজাতে শুরু করল। চিলের দক্ষ বাজনার সুরে মোহিত হল চারদিক।

সুরের মুর্থনায় বানরও আবিষ্ট হল। চোখ বুঝে এলো বানরের। চিল সত্যিই খুব ভাল বাঁশি বাজায়। আর বানরও ভাল সুরের সমজদার।

এমন অবস্থায় ইদুর বন্ধুর কথা রাখতে চেষ্টা করল চিল। বানরের তন্ময়তার সুযোগে চিল হঠাৎকরে উড়ে গেল আকাশে। বাঁশি নিয়ে। বানরের তখন কিছুই করার নেই।

বানরের কাছ থেকে বাঁশি নিয়ে চিল এলো ইদুরের কাছে। ইদুরকে ফিরিয়ে দিল তার বাঁশি।

ইদুর খুব খুশি হলো। ইদুর ও চিল সেই থেকে এক সাথে থাকতে শুরু করলো।

পাখির হাড়ে বানানো বাঁশি বাজিয়ে। চিল আর ইদুরের বাজানো বাঁশির সুরে বনের পশুপাখি সবাই মোহিত হলো।

তথ্যসূত্র: ত্রিপুরা আদিবাসী লোককথা

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা