icon

দুর্গম এলাকায় এক জুম্ম তরুণের পাঠাগার প্রতিষ্ঠা

Jumjournal

Last updated May 9th, 2021 icon 1601

জ্ঞানশ্রী মহাথেরো ভান্তে পাঠাগার করুণা শিশু সদনের প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত একটি পাঠাগার যেটির প্রতিষ্ঠা একজন জুম্ম তরুণ উদ্যোক্তা।

বই মনের চোখ খোলে। আর এ বই সংরক্ষণের উৎকৃষ্টতম স্থান হলো লাইব্রেরী বা পাঠাগার। বই যেমন জ্ঞানের বাহন, তেমনি লাইব্রেরী বা পাঠাগার হচ্ছে সেই জ্ঞানের ধারক ও রক্ষক।

আমাদের জুমজার্নালের নিজস্ব প্রতিবেদক আপনাদের জানাচ্ছেন এক স্বপ্ন বিলাসী জুম্ম তরুণ উদ্যোক্তার এমনই এক পাঠাগার প্রতিষ্ঠার  কথা।

বান্দরবান জেলার একটি উপজেলার নাম থানচি। জেলা সদর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৬২ কিলোমিটার। থানচি বেশ দুর্গম একটি এলাকা।

এই দুর্গম এলাকাতে বলিপাড়া নামে একটি ইউনিয়ন রয়েছে। এই বলিপাড়া নামক এলাকাতেই রয়েছে ‘করুণা শিশু সদন’ নামে একটি বৌদ্ধ আশ্রম।

আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন জ্ঞানশ্রী মহাথেরো নামক এক বৌদ্ধ ভিক্ষু।

এই বৌদ্ধ আশ্রমে ৩য় শ্রেণী থেকে ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্য্যয়নরত এক জুম্ম তরুণ শিক্ষার্থী নিশৈমং মারমা।

তিনি ৮ম শ্রেণী থেকে এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন বান্দরবানেরই একটি স্কুল ‘রুমা আবাসিক স্কুলে’। সেখান থেকে ভর্তি হন নটরডেম কলেজে।

তরুণ এই মেধাবী শিক্ষার্থী জানান, নটরডেম কলেজে থাকাকালীন সময়েই অতীতে ফেলে আসা সেই স্মৃতিবিজড়িত ‘করুণা শিশু সদন’ নামক বৌদ্ধ আশ্রমে একটি পাঠাগার গড়ে তোলার সুচিন্তা তাঁর মাথায় আসে।

স্বপ্ন দেখেন এমন একটি পাঠাগার করার যেখানে বৌদ্ধ আশ্রমটি ছাড়াও পুরো বলিপাড়া ইউনিয়নের সকল ছেলেমেয়ে সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনার সুযোগ এবং একই সাথে জ্ঞান চর্চার পরিবেশ পাবে।

তাঁর এই উদ্যোগে সাড়া দেয় কাছের বন্ধুরাও। ফলে তাদের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে তিনি স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হন।

করুণা শিশু সদন
করুণা শিশু সদন

নিশৈমং জানান, পাঠাগার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের কথা ফেসবুকে সবার সাথে শেয়ার করেই শুরু হয় তাদের প্রাথমিক কাজ বই সংগ্রহ করা।

তিনি ফেসবুকে লিখেন, “ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা বিস্তারে বা জ্ঞান বিকাশে সহায়ক হিসেবে আমরা একটি লাইব্রেরী স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।

এরকম দুর্গম এলাকায় লাইব্রেরী স্থাপনের বিষয়টি যথেষ্ট কঠিন, কিন্তু অসম্ভব ব্যাপার নয়। আমাদের এই স্বপ্নটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দরকার আপনাদের অকুণ্ঠ সমর্থন।

আপনাদের যেসব বই পড়া হয়ে গেছে বা টেবিলের কোণায় অনাদরে পড়ে আছে কিংবা অনেক আগের কেনা আপাতত অপ্রয়োজনীয় বইগুলো আমাদের পাঠাগারের জন্য দান করতে পারেন।”

তাঁর এই উদ্যোগে অনেকেই সাড়া দেন। এদের মধ্যে রয়েছেন তাঁর হলের কিছু সিনিয়র এবং জুনিয়র শিক্ষার্থী। তাঁর নিজের ডিপার্টমেন্ট ইতিহাস বিভাগের অনেক শিক্ষার্থী, এমনকি এই ডিপার্টমেন্টের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকও রয়েছেন।

তিনি বলেন, “দিনাজপুরে বিআরটিএতে চাকরি করেন উথুই মারমা। ফেসবুকে পোস্ট দেখে তিনি আমাকে প্রয়োজনীয় বইয়ের তালিকা পাঠানোর অনুরোধ করেন।

তারপর বিকাশে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন। এটি বড় প্রেরণা ছিল। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক শহীদুল হাসান স্যার দিয়েছেন ৩১টি বই।

অজয় চৌধুরী নামে এক ভদ্রলোক দিয়েছেন ১২৭টি বই। তিনি নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা। নিউটন চাকমা, ত্রিবেণী চাকমা, টমাস চাকমা তিন ভাই-বোন। সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, তাঁরা পাঠাগারে ৪৫টি বই ও ১২টি ম্যাগাজিন দিয়েছেন।”

জ্ঞানশ্রী মহাথেরো ভান্তে পাঠাগার
জ্ঞানশ্রী মহাথেরো ভান্তে পাঠাগার

এখানেই থেমে থাকেনি। তাঁর উদ্যোগের কথা জানতে পেরে সাড়া দিয়েছেন দেশের স্বনামধন্য পত্রিকা প্রথম আলোর সহ-সম্পাদক আনিসুল হকও।

নিশৈমং মারমার ভাষায়, “লেখক আনিসুল হকের সঙ্গে একদিন বইমেলায় দেখা হয়েছিল। তাঁকে পাঠাগারের কথা বলি। তিনি বললেন, “অনেক ভালো উদ্যোগ। কাজ চালিয়ে যাও।”

পরে ভিজিটিং কার্ড দিয়ে মেইল করতে বললেন। মেলার পরে একদিন তাঁর অফিসে গিয়ে ৮২টি বই ও ২১টি ম্যাগাজিন নিয়ে আসি।

বইমেলায় তাহমিনা আমিন নামের একজন প্রবাসী লেখিকারও দেখা পেয়েছিলাম। তিনি পাঠিয়েছিলেন নিজের লেখা ঢাকা ড্রিম নামে বইটির ১০০টি কপি। পাঠাগারের জন্য ১০ কপি রেখে বাকিগুলো অন্য পাঠাগারে দিয়ে দিয়েছি।”

এছাড়াও এগিয়ে এসেছিলেন চেনা-অচেনা অনেক মানুষ এবং বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মত প্রতিষ্ঠানও। তিনি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।

নিশৈমং মারমার হিসাব মতে, বর্তমানে প্রায় ৮৬৭টি বই, ৬২টি ম্যাগাজিন, ৮৫০০ টাকা তিনি সবার কাছ থেকে সহযোগিতা হিসেবে পেয়েছেন।

একজন সচেতন তরুণ উদ্যোক্তা এবং অনেক মানুষের সহযোগিতার ফসল বলিপাড়া পাঠাগার। এই পাঠাগারের নাম রাখা হয়েছে করুণা শিশু সদনের প্রতিষ্ঠাতার নামানুসারে – জ্ঞানশ্রী মহাথেরো ভান্তে পাঠাগার ।

জ্ঞানশ্রী মহাথেরো ভান্তের যে অবদান তাঁর স্বীকৃতিসরূপ এই নামকরণ জানান পাঠাগারের উদ্যোক্তা নিশৈমং মারমা। তিনি আরো জানান, ২৯ জুন, ২০১৭ ইং তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে পাঠাগার উদ্বোধন করেন থানচি উপজেলা চেয়ারম্যান ক্যহ্লাচিং মারমা।

পাঠাগারের স্থায়ী ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। পাঠাগারে এসে যে কেউ বই পড়তে পারবেন। ১৫ দিন পর্যন্ত বাসায় নিয়েও রাখতে পারবেন।

নিশৈমং মারমা
বই গ্রহণকালে নিশৈমং মারমা (ডানে)

“আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিটি এলাকায় পাঠাগার অতীব প্রয়োজন। জ্ঞান-চার্চায় লাইব্রেরীর চেয়ে বড় সহায়ক কিছু হতে পারে না।

আমাদের জুম্ম ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা প্রতি অনীহা, ব্যাপক পরিমাণে ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীদের ব্যাকগ্রাউন্ডের সমস্যা।

আমরা যদি আমাদের ছেলে-মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষাতা আকর্ষণীয় করতে তুলতে পারি, তাদের স্বপ্নটা, ইচ্ছাটা জাগিয়ে তুলতে পারি তাহলে হয়তোবা আমরা অতি শীঘ্রই শিক্ষিত এক জুম্ম সমাজ গড়ে তুলতে পারবো।

আর তাদের এই জাগরণ তুলতে একমাত্র সম্ভব বই! তাদের হাতে বই তুলে দেওয়া দায়িত্ব আমাদের সবার।” এই বলে তিনি সবার প্রতি শেষ আহ্বান জানান।

পাঠাগার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহা সমুদ্রের সহিত এই লাইব্রেরীর তুলনা হইত।

এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোকে কালো অক্ষরের শৃঙ্খল কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।

……… হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্য যেমন কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরীর মধ্য মানব হৃদয়ের বন্যাকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে।

…… লাইব্রেরীর মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানবহৃদয়ের অতল স্পর্শে নামিয়াছে। যে যেদিকে ইচ্ছা ধাবমান হও, কোথাও কোন বাঁধা পাইবে না।”

বেকন বলেছেন, “মানুষের জীবনে যাকিছু চাওয়া-সুখ, শান্তি, আনন্দ, বিনোদন, বেদনার উপশম, সবই পাবে বইয়ের মাঝে লাইব্রেরীতে।”

প্রিয় পাঠক, আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান সমাজে এই ধরনের অনেক জুম্ম উদ্যোক্তা এবং স্বপ্ন বিলাসী তরুণের প্রয়োজন।

আজকের তরুণ আগামী সমাজের ভবিষৎ পথ প্রদর্শক। ইংরজীতে একটি কথা আছে, What we do today, determines where we will be tomorrow.

জুমজার্নাল বিশ্বাস করে, নিশৈমং মারমার মত আরো অনেক জুম্ম তরুণ সমগ্র জুম্ম জাতির এই ক্রান্তিকালে নিজের কাঁধ পেতে সমাজকে রক্ষা করে নিয়ে যাবে এক উজ্জল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের পথে।

“ভাবনার বৈচিত্রে বিকশিত হোক তারুণ্য”


জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।
RSS
Follow by Email
Facebook
Twitter

আরও কিছু লেখা

Leave a Reply