icon

দূর্বল সংস্কৃতি বনাম আধুনিকতা

Jumjournal

Last updated Dec 8th, 2020 icon 1854

সংস্কৃতির ইংরেজী প্রতিশব্দ Culture। অনেক সময় কারো কথা-বার্তা, বেশ-ভূষা ও চাল-চলনে আধুনিকতা(?)র ছাপ না থাকলে বিশেষভাবে অসভ্য-অভব্য বুঝাতে স্ব-ঘোষিত আধুনিকরা(?) তাঁদেরকে ইংরেজীতে Uncultured বলে তাচ্ছিল্য করে নিজের আধুনিকতার মাত্রাকে জাহির করবার চেষ্টা করে থাকে।

অপরদিকে ঠিক তার বিপরীত অবস্থায় যারা সে সব স্ব-ঘোষিত আধুনিক(?) ব্যক্তিবর্গের রুচি অনুযায়ী নিজেকে উপস্থাপন করতে পারে তাদেরকে বিশেষভাবে যুগোপযোগী বা আধুনিক বুঝাতে Cultured বা সভ্য বলে তথাকথিত মর্যাদার সনদ প্রদান করার চেষ্টা করে থাকে।

সাধারন অর্থে ব্যক্তির সামগ্রিক পরিচিতিই তার সংস্কৃতি। অর্থাৎ ব্যক্তি যে পরিবার বা যে জনগোষ্ঠীর হোক না কেন জন্মলগ্ন হতে সে যে পারিবারিক ও সামাজিক স্বীকৃ্ত আচরণ বহন করে ব্যক্তির সে আচরণিক সমষ্টিকে সংক্ষেপে সংস্কৃতি বলা হয়।

সংস্কৃতি শব্দটি একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ যাকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। তবুও সহজভাবে বুঝার সুবিধার্থে বিভিন্ন সমাজ বিজ্ঞানী কর্তৃক প্রদত্ত দু’একটি সংজ্ঞা অনুসরণ করা যায়।

সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে টি এস ইলিয়ট (T S Eliot) বলেছেন “মানুষের বৈশিষ্ট্যময় কার্যকলাপ এবং আগ্রহই হল তার সংস্কৃতি”।

টেইলর (Taylor) বলেছেন “সমাজের সদস্য হিসেবে ব্যক্তির অর্জিত জ্ঞান, বিশ্বাস, কলা, নৈতিকতা, আইন-প্রথা এবং অন্যান্য সামর্থ্য ও অভ্যাসের জটিল সমষ্টিই হল তার সংস্কৃতি”।

এসব সংজ্ঞাকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করলে সংস্কৃতি বলতে বুঝায়, স্মরনাতীতকাল ধরে পূর্ব-পুরুষের নিকট হতে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত যে সব ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগীত, নীতি, আদর্শ, ধর্ম ও বিশ্বাস, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, স্নেহ-ভালবাসা, সামাজিক আইন ও প্রথা, উল্লাস-অনুভূতি,

বিবাহ পদ্ধতি, মৃত্যু পরবর্তী সৎ্কার, খাদ্যাভ্যাস ও উৎপাদন পদ্ধতি, পোষাক-পরিচ্ছদ, আনন্দ-বিনো্দন, ক্রীড়া, তৈজষপত্র, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, চাল-চলন, বাসগৃহ নির্মাণ ও বসবাস পদ্ধতির সমষ্ঠিগত রুপ যা সংস্লিষ্ট জনগোষ্ঠী কর্তৃক সামাজিক ও পারিবারিকভাবে যুগ-যুগান্তরে প্রতিপালিত হয়ে আসছে।

একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে আত্মপরিচয় ধারন করবার জন্য সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী তার নিজস্ব সংস্কৃতি বংশ পরম্পরায় প্রতিপালন করে থাকে এবং তাতে তাঁরা গৌরব বোধ করে। মূলত সাংস্কৃতিক অস্তিত্বই একটি জাতির জাতিগত অস্তিত্ব বা সামগ্রিক পরিচিতি।

সংস্কৃতি প্রথমতঃ একই সমাজ ও জনগোষ্ঠীর পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার (interaction) মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তা পরিবর্তনশীল। মানুষের চিন্তা-ভাবনা, উৎপাদন পদ্ধতি ও যান্ত্রিক প্রযুক্তির অগ্রগতিসহ নানান কারনে সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটে।

এ পরিবর্তনের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দু’টো দিক রয়েছে। প্রতিকুল পরিবেশ বা প্রভাবশালী সংস্কৃতির প্রভাবে যে সংস্কৃতির অপরিকল্পিত ও অনাকাংখিত পরিবর্তন ঘটে সেটিকেই সংস্কৃতির নেতিবাচক পরিবর্তন বা এক কথায় অপসংস্কৃতির আগ্রাসন, আর স্বমহিমায় সংস্কৃতির কাংখিত অগ্রসরতাকে সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তন বলা যায়।

সংস্কৃতিবোধের বিকাশ একটি নিরন্তর ও নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। চেতনার নিভৃত গভীরে এর শেকড় পোক্ত করতে না পারলে প্রতিকূলতার হালকা ধাক্কায় সেটি উদ্ভায়ী পদার্থে রুপ নেবে সেটাই স্বাভাবিক।

তা ছাড়া বছরের বিভিন্ন সময় স্থানীয় রাজনৈতিক পাগলা হাওয়ার ধুলি ধুসরিত ঘন কুন্ডলীর পাঁকে স্বকীয় সংস্কৃতি তার আপন মাধুর্য খুঁজে পায় না বরং সেটি বর্জনের সৌভাগ্য আমাদের কপালে প্রায়ই জোটে।

এভাবে বিস্মৃতির ধারাবাহিকতায় নিজস্ব সংস্কৃতি ক্রমাগত তার আপন স্বত্ত্বা হারিয়ে ফেলছে। নব প্রজন্ম ক্রমান্বয়ে বিকশিত হচ্ছে বিকৃত সাংস্কৃতিক চর্চায় ও আত্মবিধবংসী তথাকথিত আধুনিক ধ্যান-ধারনায়।

সার্বিকভাবে পিছিয়ে পড়া বা অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর মনোজগতে দূর্বল স্বকীয়তা একটি প্রভাবশালী অনুসঙ্গ। তাই উক্ত জনগোষ্ঠীর আত্মোন্নয়নমূখী যে কোন সার্বজনীন কর্মদ্যোগ বা গতিশীল তৎপরতার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ঝুঁকি বা বাধার আশংকা তাঁদের মনোজগতে সর্বদা অনুগামী হয়ে কাজ করে।

ফলে ইতিবাচক যে কোন বৃহৎ কর্ম-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সেহেতু আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের নেতিবাচক বা অধোঃগতির দিকটাই এখানে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

“যে জাতি বিশেষতঃ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিকশিত হতে পারেনি সে জাতির সাংস্কৃতিক মেরুদন্ড অতিশয় দূর্বল। এ দূর্বল জনগোষ্ঠীকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করা বা বিভিন্ন প্রবঞ্চনায় প্রলুদ্ধ করা যে কোন শক্তিশালী ও আগ্রাসী জনগোষ্ঠীর পক্ষে খুবই সহজ একটি ব্যাপার।

এ দূর্বল জনগোষ্ঠীর একটি প্রভাবশালী অংশের ভাবনা-চিন্তাকে যেকোনভাবে বিকৃতি করে দিতে পারলেই সে জাতির সাংস্কৃতিক বিকৃতি বা বিপর্যয় ত্বরান্বিত করা সম্ভব”। এ বিকৃতি বা বিপর্যয় বিশেষতঃ পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীন দূর্বলতার কারণেই বেশী ত্বরান্বিত হয়।

মানুষ স্বভাবতই অনুকরণপ্রিয়। শৈশব কালের অনুকরণপ্রক্রিয়ার উপর মানবশিশুর মনস্তাত্ত্বিক গঠন নির্ভর করে। এ প্রক্রিয়ায় পারস্পরিক মেধা, প্রজ্ঞা ও সৃজনশীল ক্ষমতা অবচেতনভাবে একে অন্যের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

যে ব্যক্তি বা জাতি মেধা, প্রজ্ঞা ও সৃজনশীলতায় যত ব্যপ্তিময়, তত বেশী মানুষ সেটিকে অনুকরণ ও অনুসরণ করে থাকে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে দূর্বল, অসচেতন, উদাসীন ও পরশ্রীকাতর মানুষ অন্যের প্রতি সহজেই অনুপ্রাণিত হয় এবং অপরের মুগ্ধতায় তার নিজস্বতাকে বিকশিত না করে বরং বিকৃতি বা বিপন্ন করে ফেলে।

স্বার্থপরতা ও সৌখিনতা মানুষের স্বভাবজাত অন্য একটি প্রভাবশালী বৈশিষ্ট্য। আধুনিকতার ভ্রান্ত ধারনা সেটিকে আরো বিকৃত করে তোলে। মানুষের চাহিদা সবসময় সর্ব-সাম্প্রতিকতায় বা আধুনিকতায়।

স্বার্থপরতা এবং সৌখিন(নিছক বিলাসিতা) প্রবৃত্তির প্রবল টানে কেবল বৈষয়িক আয়েসকেই অনেকে আধুনিকতা ভেবে ভূল করে।

তাদের চিন্তা-চেতনায় আধুনিকতার রুপ কেবল পোষাক-আশাক, ভোগ-উপভোগের ইন্দ্রিয় উপলদ্ধিতে। বুদ্ধিবৃত্তিক বা মনস্তাত্ত্বিক আধুনিকতায় স্বকীয় স্বত্ত্বা বিকাশের উপলদ্ধি তাদের মাথায় অনুপস্থিত।

“আধুনিকতা” খুব লোভনীয় এবং প্রলুদ্ধকর একটি শব্দ। আধুনিকতার প্রতি টান সর্বকালের এবং সর্বজনের; বিশেষতঃ নতুন প্রজন্মের চঞ্চলতায়। আধুনিকতার টানেই আমাদের পথ চলা।

আহম্মদ শরীফ সম্পাদিত বাংলা একাডেমির “সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান” অনুযায়ী আধুনিক শব্দের অর্থ হচ্ছে- বর্তমান কালের, হালের, সাম্প্রতিক, নব্য। কিন্ত এ নব্যতা বা আধুনিকতার নিয়ামক কারা? অবশ্যই পৃথিবীতে যারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও যান্ত্রিক প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ তাঁরাই।

যে সব দেশ বা জাতি অনগ্রসর জাতি-গোষ্টীসমূহের উপর অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব বিস্তার করছে অথবা কুটনৈতিকভাবে অন্য জনগোষ্টীর রাজনৈতিক পালা বদলের নিয়ামক হয়ে কাজ করছে, নিত্য নতুন প্রযুক্তিগত দক্ষতায় অন্যদের কাছে মডেল বা শক্তিমান প্রতিমূর্তি হয়ে প্রভাব বিস্তার করছে, আধুনিকতার ধারক-বাহক তাঁরাই।

অপ্রতিরোধ্য বিস্তরণ প্রক্রিয়ায় প্রভাবশালী সংস্কৃতি অপরাপর দূর্বল সংস্কৃতিসমূহে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে সেটিকে সাধারনত নিরবচ্ছিন্নভাবে বিকৃতি ও বিপদাপন্ন করে ফেলে। প্রভাবশালী বা আগ্রাসী সংস্কৃতির ধব্জাধারীদের উচ্ছিষ্ট অর্থেই দূর্বল সংস্কৃতিধারীদের পুঁজির বিকাশ।

দূর্বলের জাতীয় উন্নয়ন সবলের সন্তষ্টির উপর নির্ভরশীল। দূর্বলের মেধা ও প্রজ্ঞা সবলের সন্তষ্টির কাছে জিম্মি।তাদের চলন-বলন, ফ্যাশন, নৃত্য-গীত, খাদ্য-ভোজ্য সবকিছুই দূর্বলের জন্য অনুকরনীয়, অনুসরনীয় এককথায় আকর্ষনীয়।

দূর্বলের স্বার্থপরতার খায়েস এবং সৌখিনতার আস্ফালন তাঁদের উচ্ছিষ্ট অর্থে মোড়ানো। তাঁদের সৃষ্ট সবকিছুই “আধুনিকতা(?)” বলে দূর্বলের ধ্যান-জ্ঞান। আড়ালে-আবডালে, সচেতন বা অবচেতনভাবে তারা প্রভাবশালী সংস্কৃতির অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হয় জোর কদমে।

প্রভাবশালী সংস্কৃতি ধারণে দূর্বলরা গৌরব বোধ করে। তাঁদের সংস্কৃতি সবসময় বিশ্বনন্দিত(?) ও অনুসৃত। অনুভবে-উপভোগের উচ্ছলতায় প্রভাবশালী সংস্কৃতির আগ্রাসন।

ব্যক্তিগতভাবেও যে সব মানুষ ভিন্ন কোন প্রভাবশালী সংস্কৃতির প্রতি অতি উৎসাহী তাঁদের আচার-আচরণ, চাল-চলন, কথা-বার্তায়, ইশারা-ইংগিতে তথাকথিত আধুনিকতার অহংকার ও আধিপত্যবাদী মনোবৃত্তির প্রবলতা তীব্র।

কিন্ত বংশপরম্পরায় উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সংস্কৃতি যেটি পূর্ব-পুরুষকে মানুষ হতে শিখিয়েছিল, কথা বলতে শিখিয়েছিল, রুচিশীল স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দেয়, যে ক্রীড়াশৈলী ও নৃ্ত্য-গীত শৈশবকে মাতিয়ে রেখেছিল, প্রকৃতির অবিকৃত রুপের সাথে সাংস্কৃতিক যে নিবিড় সম্পর্ক-বন্ধন রচিত হয়েছিল সে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিটির প্রতি তাদের তাচ্ছিল্য খুব চোখে পড়বার মত।

পরগাছা যেমন সুদীর্ঘ সময় ধরে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে শেষপর্যন্ত মূল গাছের অস্তিত্ত্বকে ধবংস করে দেয়; তেমনি অবচেতন মনে অনুসরণ-অনুকরণ প্রক্রিয়ায় প্রভাবশালী সংস্কৃতি দূর্বল সংস্কৃতিকে চুড়ান্ত পর্যায়ে নিশ্চিন্ন করে ফেলে। এ প্রক্রিয়ার প্রবাহ এতই নিবিড় যে, কেবল কর্মসংস্থান ও সৌখিন ভোগবাদী চেতনাসমৃদ্ধ শিক্ষা দ্ধারা তা উপলদ্ধি করা মোটেই সম্ভব নয়।

সংস্কৃতি যেহেতু একটি জনগোষ্ঠীর জাতিগত অস্তিত্ত্বের হৃৎপিন্ড, সেহেতু বিপর্যস্ত ও বিকৃত সংস্কৃতি সমগ্র জাতিসত্ত্বার মরণ ব্যাধি সদৃশ। আধুনিকতার রঙিন প্রলেপে যারা মুগ্ধ এবং আবেগতাড়িত অনুকরণে যারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত তাদের জন্য “আধুনিক” ও “আধুনিকতা” শব্দ দুটি একেবারেই বিকৃত অর্থব্যঞ্জক।

তাদের জন্য আধুনিকতা মানে কেবল বাহ্যিক রঙিন পরিবর্তনশীলতায়, অনিয়ন্ত্রিত আবেগিক উচ্ছলতায়। তাঁরা তথাকথিত আন্তর্জাতিক বা বিশ্বজনীন মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং কল্পিত বিশ্বপরিবারের(Global Village)এক এক জন স্ব-প্রশংসিত স্বপ্নচারী।

নিজের গৌরবময় সংস্কৃতি অপ্রস্ফুটিত ও অবিকশিত থাকার বিপরীতে তাদের দায়িত্ববোধ তারা মোটেই লালন করেন না।

কমরেড শিবদাস ঘোষ এর মতে“…………যে কোন আদর্শ- তা মার্ক্সবাদ-লেলিনবাদ হোক, বিপ্লব বা শ্রেণী সংগ্রামের বড় বড় কথাই হোক- সব বড় আদর্শেরই প্রাণসত্ত্বা বা মর্মবস্ত নিহিত থাকে তার প্রভাবে প্রভাবিত মানুষগুলির মধ্যে যে নৈতিক বল এবং নৈতিক চরিত্র গড়ে ওঠে তার মধ্যে এবং তাদের সংস্কৃতিগত মানের মধ্যে।

তাই যে কোন রাজনৈতিক মতবাদই হোক না কেন তার চর্চার মধ্যে দিয়ে নৈতিক বল যদি তৈরি না হয়, উঁচু সংস্কৃতিগত মানকে যদি প্রতিফলিত না করে তবে সেই আদর্শবাদের তত্ত্বকথা শুনতে যত বড় বলেই মনে হোক না কেন, তা শুধু একটা বাইরের কাঠামো মাত্র এবং তা হল প্রাণহীন দেহের মতো।

যেমন প্রাণহীন দেহকে আবর্জনাস্বরুপ জ্ঞান করে ফেলে দিতে হয়, মমতা করে আঁকড়ে ধরে রাখলে তা পুঁতিগন্ধময় অবস্থায় সমাজে মানুষের অকল্যাণ সাধন করে। তেমনি উঁচুদরের নৈতিকতা এবং উন্নত সংস্কৃতিবর্জিত রাজনৈতিক মতবাদও পরিত্যাজ্য।

যদি কোন রাজনৈতিক মতবাদ ও আন্দোলন নৈতিক মানকে জাগাতে না পারে, সাংস্কৃতিক মানকে উঁচু করতে না পারে তবে মনে রাখবেন, সে রাজনীতি অনিষ্টকর এবং তা অকেজো হয়ে গিয়েছে।”

কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, সামাজিক নেতৃ্ত্ব এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধত্বশীল বিভিন্ন পেশাজীবিদের মধ্যেও নৈতিক এবং সংস্কৃতিগত একটি শক্তিশালী মান বা অবস্থান অপরিহার্য।

কারণ রাজনৈতিক আন্দোলন হোক আর সামাজিক আন্দোলন হোক সকল ক্ষেত্রেই “নাগরিক অধিকার” আদায় অথবা নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির শ্লোগানই এর প্রধান হাতিয়ার।

কাজেই নাগরিক সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান, নৈতিক শক্তি এবং সাংস্কৃতিক মানের উপর রাজনৈতিক গনতান্ত্রিকতার মাত্রা অনেকাংশে নির্ভর করে।

মূলতঃ নিজস্ব নান্দনিক সংস্কৃতির প্রতি অনাগ্রহের কারণে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি অথবা ভারতীয় সংস্কৃতির দ্বারা আমাদের দেশজ সংস্কৃতি দারুনভবে প্রভাবিত। সে জন্য দেশজ সংস্কৃতি বা লোকজ সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা এবং এর পরিসর বৃদ্ধির লক্ষ্যে বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে;

কেবল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বৈশাখী উৎসব, বসন্ত বরণ উৎসব অথবা অন্য কোন উৎসব বা মেলার মাধ্যমে আমাদের দেশবরেণ্য সাংস্কৃতিক বৌদ্ধাগনকে নিজেদের ঐতিহ্যের শেকড় সন্ধানীমূলক নানান ধরনের জাগরণী উপস্থাপনার আয়োজন করতে দেখা যায়।

সরকার বিভিন্ন সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে গ্রামীন খেলাধুলা প্রতিযোগিতা আয়োজনের মাধ্যমে দেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ সৃষ্টির নিষ্ফল প্রচেষ্টা চালায়।

কিন্ত ঐতিহ্যবাহী স্বকীয় সংস্কৃতি বা স্বদেশি সংস্কৃতির প্রতি মৃয়মাণ মৌসুমীপ্রেম লক্ষ লক্ষ বিকৃত সংস্কৃতিসেবী বা তথাকথিত আধুনিক মনস্কদের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারে না। ফলে দেশজ সংস্কৃতির সামগ্রিক বৈচিত্র্যময়তা এখন কেবল মুখের বুলিতে।

আর যে সমস্ত অঞ্চলে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস, সে অঞ্চলে সারা বছরের মধ্যে কেবল চৈত্র সংক্রান্তির (বিঝু, বৈসু, সাংগ্রাই, বিহূ, বিষু, চাংক্রাইন) দুই/তিন দিনের আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্যেই তাঁদের সর্বোচ্চ সাংস্কৃতিক চেতনা সীমাবদ্ধ।

কিন্ত মনোজগতে ঘাঁটি গেড়ে বসা অপসংস্কৃতির তপ্ত তাপদাহে দু-এক পশলা বৃষ্টির ফোটা অতৃপ্ত প্রান্তরের তৃষ্ণা মেটাতে পারে না।

সংস্কৃতিবোধের বিকাশ একটি নিরন্তর ও নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। চেতনার নিভৃত গভীরে এর শেকড় পোক্ত করতে না পারলে প্রতিকূলতার হালকা ধাক্কায় সেটি উদ্ভায়ী পদার্থে রুপ নেবে সেটাই স্বাভাবিক।

তা ছাড়া বছরের অধিকাংশ সময় স্থানীয় রাজনৈতিক তপ্ত হাওয়ার উদ্বেগ উৎকন্ঠায় স্থানীয় স্বকীয় সংস্কৃতি তার আপন মাধুর্য খুঁজে পায় না।

মাঝে মধ্যে স্থানীয় রাজনৈতিক পাগলা হাওয়ার ধুলি ধুসরিত ঘন কুন্ডলীর পাঁকে সেটি বর্জনের সৌভাগ্যও আমাদের কপালে প্রায়ই জোটে।

এভাবে বিস্মৃতির ধারাবাহিকতায় স্বকীয় সংস্কৃতি ক্রমাগত তার আপন স্বত্ত্বা হারিয়ে ফেলছে। নব প্রজন্ম ক্রমান্বয়ে বিকশিত হচ্ছে বিকৃত সাংস্কৃতিক বিশ্বাসে ও আত্মবিধবংসী তথাকথিত আধুনিক ধ্যান-ধারনায়।

প্রকৃত আধুনিকতা মানে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে সর্ব-সাম্প্রতিক আকর্ষণীয় উদ্ভাবন ও এর বিস্তরণ যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম। প্রথমতঃ নবতর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও দ্বিতীয়তঃ নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতির বলয় বিস্তৃতির সুক্ষ্ম প্রতিযোগিতা।

এ ক্ষেত্রে কেবল খুব উঁচুমানের সৃজনশীলতা, মেধা ও প্রজ্ঞাদীপ্ত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কোন বিকল্প নেই। একটি কাংখিত মানের শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, গবেষণার প্রতি মননশীল আলোকিত প্রজন্মের মাধ্যমেই কেবল এর বহিঃপ্রকাশ ঘটানো সম্ভব।

কিন্ত বর্তমানে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেন এক একটা নিস্তরঙ্গ নদী, পরিবারগুলো যেন এক একটা শেওলা ও আবর্জনায় পরিপূর্ণ পাতকুয়া, আর সমাজগুলো যেন কচুরিপানায় ভরা দূর্গন্ধযুক্ত এক একটা বিশাল বিশাল জলাশয়।

এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর আশান্বিত হবার কিংবা শিল্প-সাহিত্য গবেষণার ক্ষেত্রে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবার সুযোগ খুবই ভয়াবহ। এগুলোর কার্যকারিতা ও ব্যবহারোপযোগীতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব সকলের দৃষ্টিতে যেন কেবল সরকারের। ব্যক্তির কিংবা সমাজের উদ্যোগ কেবল দায়ছাড়া।

অন্যদিকে সরকারের অনেক ইতিবাচক আইন ও উদ্যোগ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সামাজিক আন্দোলনে রুপদান আমাদের একান্ত আবশ্যক। কিন্ত সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর যথার্থ তৎপররতার অভাবে সে সব গণমূখী কর্মসূচী মূখ থুবড়ে পড়ে থাকে।

বিশ্বকবি বলেছেন – “সৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্যক্তিই বড়, সমাজ বা রাষ্ট্র নহে”। অবশ্য আমরা সৃষ্টিশীল, নৈতিক বলে বলীয়ান কিংবা নিবেদিত কোনটাই হতে পারিনি বলে আমাদের এমনতর অবস্থা বলে আমার ধারণা।

বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা ও পরশ্রীকাতরতা শক্তির বেদিমূলে পঁচন ধরায়। ইচ্ছাশক্তি ও সাহসী ভূমিকা নৈতিক দূর্বলতার কাছে জিম্মি।

অথচ আমাদের সর্বোচ্চ সৃজনশীলতা, মেধা ও স্বকীয়তাকে নৈতিক শক্তিতে পরিনত করে সামনে এগুবার পথে নিবেদিত হতে পারলে অনেক বাধার মধ্যে দিয়ে হলেও অন্তত শম্ভুক গতিতে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বৈশ্বিক পরিমন্ডলে প্রভাবশালী স্থান লাভ করতে পারত।

প্রত্যাশিত পৃষ্ঠপোষকতা ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনের (Stakeholder) স্বতঃস্ফুর্ত তৎপরতা ত্বরান্বিত হলে এতদিন দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া আদিবাসী সংস্কৃতির চিরায়ত ধারা, লুকায়িত ইতিহাস, ঐতিহ্য, গান, কবিতা, বীরত্বগাথা, দেশের জন্য অবদানের অমূল্য কাহিনী দেশী-বিদেশি বৃহত্তর সাহিত্য পরিমন্ডলে আসন পেত।

স্বর্গীয় প্রেম-বিরহের পবিত্র পালাগান (গেংখুলী), তন্দ্রা জড়ানো ঘুম পাড়ানী গান(ওলি), তরুণ-তরুণীর পারস্পরিক মন মাতানো উভ’গীত, ঐতিহ্যবাহী ধুধুক, হেংগরঙ, শিঙ্যা নানান ধরনের বাদ্যযন্ত্রে বড় বড় দেশের সুসজ্জ্বিত আন্তর্জাতিক মিলনায়তনে হাজারো দর্শকের করতালীতে গীত হত।

বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ইলেক্ট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়াতে সাড়ম্বরে নিয়মিত স্থান পেত। অঞ্চল ভেদে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য-পুস্তক বোর্ডের আওতায় বুদ্ধিদীপ্ত প্রবাদ বাক্য(দাগ’হধা), পুরাকালের রুপকথা(পজ্জন), ধাঁধাঁ (বানা’) বিভিন্ন শিক্ষার্থীর পাঠমালায় শোভা পেত।

আকর্ষনীয় নাধেং, ঘিলে, পত্তি, পোর, ইজিবিজি, দাঙ, পেক প্রভৃতি খেলাধুলাসহ আদিবাসী নানান ধরনের ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার প্রতিযোগিতা দেশের বড় বড় ষ্টেডিয়ামে আড়ম্বরপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হত।

দেশের সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্টির পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় আদিবাসী সংস্কৃতির নান্দনিকতা বিশ্বজুড়ে অভিনন্দিত হত।

আশার কথা-একদিন হয়তো হবে; কিন্ত সেদিন আমার সমসাময়িক কয়েক প্রজন্মের পদচিহ্ন এ পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।


[লেখক: ভদ্র সেন চাকমা, সাধারন সম্পাদক, আরাঙ, বাঘাইছড়ি, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা। শিক্ষা, সাহিত্য, সামাজিক ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন “আরাঙ” এর মূখপত্র “আগপাদা”-র প্রথম প্রকাশনায়(০২/১০/২০১৫ খ্রিঃ) প্রকাশিত প্রবন্ধ]

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।
RSS
Follow by Email
Facebook
Twitter

আরও কিছু লেখা

Leave a Reply