পরিবেশগত অভিবাসন এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ঃ ঝুঁকিতে কি রয়েছে?

Tithi Chakma
Last updated Sep 1st, 2021

1185

featured image

যৎসামান্য বাস্তুসংস্থানগত পদাঙ্ক (Ecological Footprint) থাকা সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মুখে আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি অসামঞ্জস্যহীনভাবে নাজুক অবস্থায় রয়েছে।

অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় এমন অঞ্চলে বাস করে যা বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত অবক্ষয়ের সংস্পর্শে রয়েছে, যেমন ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জ যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বড়জোর কিছুটা উপরে এবং বন নিধনের হুমকির সম্মুখীন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চল (Tropical Forest) অথবা বিশ্ব উষ্ণায়ন (Global Warming) দ্বারা প্রভাবিত মেরু অঞ্চল।

আদিবাসীদের তাঁদের ভূমি এবং বাস্তুতন্ত্রের উপর সাধারণত একটি দৃঢ় বস্তুগত এবং আধ্যাত্মিক নির্ভরতা রয়েছে।

তাঁদের জীবিকা ও দৈনন্দিন কার্যক্রম, পরিবেশ ও তার সম্পদগুলির উপর নির্ভর করে, পাশাপাশি তাঁদের সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান  ও  চিকিৎসাবিদ্যার চর্চাগুলো বংশগত সূত্রের ন্যায় গভীরভাবে প্রকৃতির সাথে গেঁথে আছে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, যেমন অবিরাম খরা, বৃষ্টির প্যাটার্নে পরিবর্তন, দাবানল, উপকূলীয় ক্ষয় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান, আদিবাসী সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবন ও মানসিক স্বাস্থ্যে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

এই প্রভাবগুলি শিকার ও কৃষি চর্চাকে ব্যাহত করা থেকে শুরু করে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বিপন্ন করে তুলেছে।

যা প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাব এ বিরূপ প্রভাবিত অঞ্চলগুলো থেকে আদিবাসীদেরকে অভিবাসনের দিকে পরিচালিত করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, প্রশান্ত মহাসাগর বা আলাস্কার কয়েকটি ছোট দ্বীপরাষ্ট্রের আদিবাসীরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান এবং উপকূলীয় ক্ষয়ের মত বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে যে কারণে তাঁদের আরও অভ্যন্তর থেকে অভ্যন্তরের দিকে গোটা সম্প্রদায়কে স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনা করতে হচ্ছে।

আমাজনে দাবানল বা বনভূমি ধ্বংসের ফলে আবাসস্থল ক্ষতি আদিবাসী  সম্প্রদায়কে তাঁদের পৈতৃক ভূমিতে প্রবেশকে সীমাবদ্ধ করতে পারে এবং তাঁদের ঐতিহ্যগত জীবিকা নির্বাহ এবং শিকার-সন্ধান বজায় রাখাকে অসম্ভব করে তুলতে পারে এবং ফলে তাঁদেরকে শহরমুখী অভিবাসনের দিকে উৎসাহী হতে বাধ্য করতে পারে।

যদিও অভিবাসন (Migration) নতুন জীবিকা বা শিক্ষাগত সুযোগের প্রস্তাব দিতে পারে, তবুও অপরিকল্পিত ও দুর্দশাগ্রস্ত অভিবাসন আদিবাসীদের দুর্বলতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে, বিশেষত একইসাথে অভিবাসী এবং আদিবাসী গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ায় তাঁরা দ্বিগুণ বৈষম্যের শিকার হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, আদিবাসীরা যখন অপরিচিত শহুরে পরিবেশে যায়, তখন তাঁরা ভাষা এবং সাংস্কৃতিক বাঁধার মুখোমুখি হতে পারে যা তাঁদের প্রতি শোষণ ও বৈষম্যের সামনে উন্মোচিত করে এবং চাকরির বাজারে বা পর্যাপ্ত আবাসে তাঁদের প্রবেশাধিকারকে বাঁধা দিতে পারে।

জাতিসংঘের সদর দফতর, নিউ ইয়র্কের ECOSOC (অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল) চেম্বারে আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালন। ছবিঃ UN / 2018
জাতিসংঘের সদর দফতর, নিউ ইয়র্কের ECOSOC (অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল) চেম্বারে আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালন। ছবিঃ UN / 2018

একটা সময় বৈশ্বিক নীতি এজেন্ডায় অভিবাসনের ইস্যুগুলি বেশি আলোচিত ছিল, সে সময়ে জাতিসংঘের সদর দফতর নিউ ইয়র্কে ৯ আগস্ট ২০১৮ – এ উদযাপিত আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী  দিবসটি অভিবাসনের মাত্রা আলোচনার জন্য উৎসর্গীকৃত ছিল।

এটি বিশ্বব্যাপী আদিবাসী অভিবাসীরা যে চলমান চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে কারা জড়িত সেই বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করার এক অনন্য সুযোগের প্রস্তাব দেয়।

সেই বিষয়ে জাতিসংঘ অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব এবং আদিবাসীদের অভিবাসনের মধ্যকার সংযোগ একটি বিবৃতিতে আলোকপাত করেছিলেন যে আদিবাসীদের অভিবাসনের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের অপরিবর্তনীয় প্রভাব বিশ্বব্যাপী বহু আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে ইতোমধ্যে একটি কঠিন বাস্তবতা এবং বৈশ্বিক নীতি পর্যায়ে যে এই বিষয়গুলিকে আরও দৃশ্যমানতা দেওয়ার যে প্রয়োজন – তাও তুলে ধরেন।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত অঙ্গীকারের প্রসার যেখানে নির্দিষ্টভাবে আদিবাসী ও জলবায়ুর পরিবর্তনকে উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন Paris Agreements, the 2030 Agenda, এবং The Sendai Framework for Disaster Risk Reduction – তা সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তন কিভাবে আদিবাসীদের অভিবাসন প্যাটার্নকে প্রভাবিত করছি তা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে।

আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী দিবস উপলক্ষে জাতিসঘের সদর দফতর, নিউ ইয়র্কে আদিবাসী, অভিবাসন এবং  প্রান্তিক আন্দোলন নিয়ে আলোচনার সময়। ছবিঃ UN / 2018
আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী দিবস উপলক্ষে জাতিসঘের সদর দফতর, নিউ ইয়র্কে আদিবাসী, অভিবাসন এবং প্রান্তিক আন্দোলন নিয়ে আলোচনার সময়। ছবিঃ UN / 2018

আদিবাসী, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অভিবাসনের উপর আরও আলাদা তথ্য সংগ্রহ এবং গবেষণা করা জরুরি প্রয়োজন, কারণ এটি তাঁদের চাহিদা এবং দুর্বলতাগুলি আরও ভালভাবে চিহ্নিত করতে সহায়তা করবে, আবার জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁদের ঐতিহ্যগত জ্ঞানকে কিভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে তাও বুঝতে সাহায্য করবে।

তাঁদের অধিকার সুরক্ষিত হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য Sustainable Development Goals (SDGs) এবং the Global Compact for Safe, Orderly and Regular Migration (GCM) উভয়ই একটি ঐতিহাসিক সুযোগের প্রস্তাব দিচ্ছে।

GCM, আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর অভিবাসন এবং অভিবাসন ব্যবস্থাপনার ইস্যুগুলো সামনে নিয়ে আসার জন্য একটি অসাধারণ সুযোগের প্রতিনিধিত্ব করছে।

যেমনটি জাতিসংঘের মহাসচিব আন্টোনিও গুতেরেস তাঁর বার্তায় তুলে ধরেছেনঃ

“[GCM] স্থানীয় এবং বৈশ্বিক সহযোগিতার জন্য একটি আন্তর্জাতিক ফ্রেমওয়ার্ক (Framework) প্রতিষ্ঠা করবে এবং অভিবাসনের সুযোগ সুবিধাগুলো সম্প্রসারণ করে তোলার জন্য এবং আদিবাসী সম্প্রদায় এবং দুর্বল অভিবাসী গোষ্ঠীকে সমর্থন করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম  প্রদান করবে।”

জাতিসংঘের সদর দফতর, নিউ ইয়র্কে জিসিএমের চুক্তির নথি চূড়ান্তকরণ। মিরস্লাভ লাজাক(কেন্দ্র), সাধারণ পরিষদের সত্তর-দ্বিতীয় অধিবেশনের সভাপতি এবং অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত গ্লোবাল চুক্তিটির সহ সহযোগীঃ হুয়ান হোসে গমেজ কামাচো (ডান দিক থেকে দ্বিতীয়), জাতিসংঘ মেক্সিকোর স্থায়ী প্রতিনিধি এবং জার্গ  লউবার (ডানে), জাতিসংঘ সুইজারল্যান্ডের স্থায়ী প্রতিনিধি বৈঠক শেষে নথির খসড়া চূড়ান্ত করে গেভেলটি ধরে রাখেন। বামদিকে হলেন আন্তর্জাতিক অভিবাসনের সেক্রেটারি-জেনারেলের বিশেষ প্রতিনিধি এবং সম্মেলনের সেক্রেটারি-জেনারেল, উপ মহাসচিব আমিনা মোহাম্মদ। ছবিঃ Mark Garten / UN (2018)
জাতিসংঘের সদর দফতর, নিউ ইয়র্কে জিসিএমের চুক্তির নথি চূড়ান্তকরণ। মিরস্লাভ লাজাক(কেন্দ্র), সাধারণ পরিষদের সত্তর-দ্বিতীয় অধিবেশনের সভাপতি এবং অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত গ্লোবাল চুক্তিটির সহ সহযোগীঃ হুয়ান হোসে গমেজ কামাচো (ডান দিক থেকে দ্বিতীয়), জাতিসংঘ মেক্সিকোর স্থায়ী প্রতিনিধি এবং জার্গ লউবার (ডানে), জাতিসংঘ সুইজারল্যান্ডের স্থায়ী প্রতিনিধি বৈঠক শেষে নথির খসড়া চূড়ান্ত করে গেভেলটি ধরে রাখেন। বামদিকে হলেন আন্তর্জাতিক অভিবাসনের সেক্রেটারি-জেনারেলের বিশেষ প্রতিনিধি এবং সম্মেলনের সেক্রেটারি-জেনারেল, উপ মহাসচিব আমিনা মোহাম্মদ। ছবিঃ Mark Garten / UN (2018)

তবে,  GCM -কে আরও কিছু করা করতে হবে – বিশেষত GCM -এর বাস্তবায়ন ধাপগুলোর সময় – আদিবাসীদের চাহিদা ও তাঁদের যে উদ্বেগগুলো রয়েছে সেগুলো নিশ্চিত করতে হবে।

এসডিজিগুলো (SDGs) টেকসই উন্নয়নে আদিবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্বীকার করে এবং উচ্চমানের, সময়োপযোগী, নির্ভরযোগ্য এবং পৃথকীকরণের তথ্য প্রাপ্যতা বৃদ্ধির গুরুত্বকে জোর দেয়।

এইক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিগুলো অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং আদিবাসীদের যোগসূত্রের উপর জ্ঞান বিকাশ করে তুলতে সহায়ক হতে পারে যা নীতি এবং ক্রিয়াপদ্ধতির অগ্রগতির দিকে পরিচালিত করবে।

আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো বহু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও এটি জোর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ যে আদিবাসীরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মূল ভুমিকা পালনকারী এবং তাঁরাই ইতিবাচক অবদান রাখে।

আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি বিশ্বজুড়ে পৃথিবীর পৃষ্ঠের প্রায় ২২% এবং গ্রহটির জীববৈচিত্রের ৮০%  সুরক্ষা দেয় যা তাঁদেরকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় একটি শক্তিশালী অংশীদার করে তোলে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার সার্থক নীতি ও কর্মসূচি বিকাশের জন্য তাঁদের ঐতিহ্যগত জ্ঞানের স্বীকৃতি ও মূল্য দেওয়া দরকার।

ফলস্বরুপ আদিবাসীরা যখন মনে করবে যে তাঁদের পৈতৃক ভূমি ছেড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই – এ ধরণের  ঘটনায় তখন এটি তাঁদের বেদনা প্রশমিত করতে  সাহায্য করতে পারে।

ইউএনএফসিসিসি (the United Nations Framework Convention on Climate Change) – এর মাধ্যমে বিশ্ব জলবায়ু নীতিতে আদিবাসীদের দৃঢ় অংশগ্রহণ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়ায়ের পাশাপাশি তাঁদের কিছু নির্দিষ্ট চাহিদা এবং উদ্বেগ আলোকপাত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে।

পেরু (Peru), দক্ষিণ আমেরিকা (South America)। ছবিঃ IOM / 1971
পেরু (Peru), দক্ষিণ আমেরিকা (South America)। ছবিঃ IOM / 1971

GCM এর বাস্তবায়ন পর্বে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আলোচনায় আদিবাসীদের দাবি গুলিকে নিয়মিতভাবে অন্তর্ভুক্ত করার এখনই সময়।

এছাড়াও আমাদের অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন ও আদিবাসীদের মধ্যকার যোগসূত্র সমাধান করার জন্য জলবায়ু ও অভিবাসীদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন অব্যাহত রাখতে হবে এবং আদিবাসীরা যাতে পিছিয়ে না পড়ে সেদিকে ও লক্ষ্য রাখতে হবে।

মূল আর্টিকেল লিঙ্কঃ https://medium.com/@IOMatUN/environmental-migration-and-indigenous-peoples-what-is-at-stake-1c127228fb67

জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।

আরও কিছু লেখা